ভাঙাপুকুর রহস্য – ৬

ঘরজুড়ে নিঃশব্দ চাপা উত্তেজনা।
হেডস্যার, পরিমল ঘোষের দীর্ঘদিনের সহকর্মী, এখন হা করে তাকিয়ে আছেন অফিসার বিশ্বাস–এর দিকে।
যাকে এতদিন ধুলোমাখা পাগলের ছেঁড়া জামায় রাস্তায় ঘুরতে দেখেছেন, আজ তিনি দাঁড়িয়ে আছেন পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন ইউনিফর্মে, বুক সোজা করে, চোখে টানা দৃষ্টি।

অফিসার বিশ্বাস এগিয়ে এসে একটা বই তুলে দিলেন হেডস্যারের হাতে।

— “স্যার, প্রতিদিন আপনি আমাকে দশ টাকা করে দিতেন, মনে আছে? মোট ৪২০ টাকা হয়েছিল। ওই টাকাতেই আমি এই বইটা কিনেছি। আপনার জন্য।”
তার ঠোঁটে হালকা হাসি।

হেডস্যার থতমত খেয়ে বইটা হাতে নিলেন। এখনো তিনি ঠিক বুঝে উঠতে পারছেন না —
এই মানুষটা পাগল ছিল? নাকি তিনি-ই পাগল হয়ে গিয়েছিলেন?

অবিনাশ সামনে এসে শান্ত স্বরে বললেন —
— “তিনি হলেন অফিসার সুদীপ বিশ্বাস। স্পেশাল ব্রাঞ্চ থেকে পাঠানো হয়েছিল আন্ডারকভার মিশনে। আমি নিজেই অনুরোধ করেছিলাম উনাকে নুপুরের ওপর নজর রাখতে, কারণ আমি নিশ্চিত ছিলাম, পরিমল বাবু কোনো না কোনোভাবে ওর ওপর হামলা করবেন। আর ওনাকে হাতেনাতে ধরার এটিই ছিল একমাত্র সুযোগ।”

দারোগা অনুপম একটু কেশে নিয়ে প্রশ্ন করলেন —
— “স্যার, কিন্তু আপনি জানলেন কীভাবে যে উনি নুপুর ম্যাডামের উপর হামলা করবেন?”

অবিনাশ জবাব দিলেন:

— “আমি সাইবার সেলকে অনুরোধ করেছিলাম — নুপুরের নাম্বার থেকে পরিমল ঘোষের নাম্বারে একটা গোপন এসএমএস পাঠাতে। তাতে লেখা ছিল:
‘আমি সব জেনে গেছি। আপনি যা করছেন, সেটা আমি পুলিশকে জানাতে চলেছি।’
এই মেসেজ দেখে ও ভয় পায়। ভয়ই ওর দুর্বলতা। আর সেখান থেকেই সে নুপুরকে কিডন্যাপ করে।”

হেডস্যার ভুরু কুঁচকে বললেন —
— “তাহলে তুমি… নুপুরকে ট্র‍্যাপ হিসেবে ব্যবহার করেছিলে?”

অবিনাশ একটু থেমে, মাথা নিচু করে বলল —
— “আমাকে লজ্জা দেবেন না স্যার।
এই পরিকল্পনা করার পর থেকেই আমি অপরাধবোধে ভুগছি।
সবচেয়ে ভয় পেতাম — যদি আমি ওকে বাঁচাতে না পারি… যদি কিছু হয়ে যায়…
কিন্তু ঈশ্বরের কৃপায় সব ঠিকঠাক হয়েছে। নুপুরও নিরাপদ। এবং পরিমল ঘোষ… শেষ পর্যন্ত ধরা পড়েছে।”

এই সময় দারোগাবাবু এগিয়ে এসে আবার প্রশ্ন করলেন —
— “স্যার, আপনি পরিমল ঘোষের পুরো কাহিনি জানলেন কীভাবে?
আমাদের একটু খুলে বলবেন?”

অবিনাশ গভীর স্বরে বলতে শুরু করলেন:

— “আমাকে যখন এখানে আন্ডারকভার হিসেবে পাঠানো হয়, তখন তথ্য ছিল যে এখানে হিউম্যান ট্রাফিকিং হচ্ছে — শিশু পাচার।
সেই দিক থেকেই তদন্ত শুরু করি। পরিমল ঘোষের উপর নজর তখনও ছিল না।

আমি স্পেশাল ব্রাঞ্চকে বলেছিলাম স্কুলের সব শিক্ষক-কর্মচারীর ব্যাকগ্রাউন্ড চেক করতে।
তখনই এক অদ্ভুত তথ্য বেরিয়ে এল।

পরিমল ঘোষ —
কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের গোল্ড মেডালিস্ট, সাইকোলজিতে পিএইচডি করেছেন, এবং তিন তিনবার ডাক্তারেট পেয়েছেন।
অথচ তিনি গ্রামের স্কুলে মাস্টারি করছেন?

আমার একটু খটকা লেগেছিলো। আমি প্রথমে ভেবেছিলাম,লোকটার মধ্যে কিছু একটা গণ্ডগোল তো আছে।  হয়তো টাকার লোভে শিশু পাচারে জড়িত, কাউকে সহায়তা করছেন।
তাই নজর রাখতে শুরু করি ওনার উপর।”

এই পর্যন্ত বলেই অবিনাশ একটু থামলেন, তারপর নিজের দিকে তাকিয়ে থাকা বিস্মিত মুখগুলোর দিকে চেয়ে হালকা হেসে বললেন —
— “আপনাদের নিশ্চয়ই মনে আছে, পরিমল বাবুর বাড়িতে একদিন চোর ঢুকেছিল?”

সবাই চমকে একে অপরের মুখের দিকে তাকাল।

— “হ্যাঁ, সেই চোরটা আমি-ই ছিলাম,” বললেন অবিনাশ।
“চুপিচুপি ঢুকে ওনার লাইব্রেরি ঘরে গেলাম।
সেখানে অসংখ্য সাইকোলজির বই, আর একটা ডায়েরি পেলাম, যেখানে লেখা ছিল: Subject 3C, Fear threshold, Panic scale — আরও অনেক কিছু।

ঠিক তখনই পরিমল বাবু ঘুম থেকে উঠে পড়েন — আর আমাকে পালাতে হয়।

সেই রাতে আমারও সন্দেহ হয়েছিল, আমি হয়তো ভুল করছিলাম।
হয়তো উনি শুধু বইপ্রেমী, নির্লোভ মানুষ। হয়তো গ্রামের শান্তি ভালোবাসেন।

আমি নতুন করে তদন্ত করতে চাইছিলাম — অন্য অ্যাঙ্গেল থেকে।
ঠিক তখনই নুপুর আমাকে রিমার খাতাটা দেখায়।
সেখানে লেখা —
‘তিনি বললেন আমি সাবজেক্ট 5E। হি হি…’

আমার সন্দেহ আবার ঘুরে আসে পরিমল ঘোষের দিকে।”

এই সময় সবাই যেন চুপ করে গিয়েছিল।
সবার মনে একটা প্রশ্নের ওজন জমে আছে — কিন্তু কে বলবে?

নুপুর নিজেই বলল —
— “স্যার, একটা কথা বুঝলাম না।
আপনার গাড়িটা ঠিক সেই বাড়ির সামনে গিয়েই খারাপ হল —
বিষয়টা একটু বেশি নাটকীয় নয়?”

অবিনাশ হাসল।
— “ঠিক ধরেছেন। আমার কাছে ইন্টেলিজেন্স রিপোর্ট ছিল —
অফিসার বিশ্বাস আগেই আমাকে জানিয়ে রেখেছিলেন।
আমি চাইছিলাম না তখনই আমার আসল পরিচয় ফাঁস হোক।
আর আন্ডারকভার মানেই তো একটা ছোট্ট নাটক!”

নুপুর বলল —
— “তাহলে আপনি গাড়ি ইচ্ছা করে বন্ধ করে দিয়েছিলেন?”

— “হ্যাঁ।
কিন্তু যখন সেই ঘরে আমরা বাচ্চাদের মৃতদেহ দেখলাম —
আমি বুঝলাম, খেলাটা অনেক বড়, অনেক ভয়ংকর।
আর তখন আমার আসল পরিচয় লুকিয়ে রাখা ঠিক নয়।”

ঘরটা তখন নিস্তব্ধ।

সবাই তাকিয়ে আছে সেই মানুষটার দিকে —
যে একদিন স্কুলের জীবনবিজ্ঞানের শিক্ষক ছিলেন,
আজ কারাগারে বাঁধা এক বিকৃত গবেষক।

পরিমল ঘোষ, হাতকড়া পরা অবস্থায়,
চুপচাপ তাকিয়ে রইলেন জানালার বাইরে —
যেখানে কুয়াশায় ঢাকা গাছেরা অন্ধকারের মতো নীরব।

অবিনাশ প্রশ্ন করল —
— “আপনার গবেষণার পেছনে উদ্দেশ্যটা ঠিক কী ছিল?”

পরিমল ধীরে চোখ ফিরিয়ে তাকাল।
চোখে কোনও অনুশোচনা নেই —
বরং সেই পুরনো, ঠাণ্ডা আত্মবিশ্বাস।

— “তোমরা ভয় পাও, আমি বিশ্লেষণ করি।
তোমরা পালাও, আমি মেপে দেখি কে কতদূর দৌড়ায়।
তোমাদের চোখে মৃত্যু মানে শেষ, আমার চোখে সেটা পরীক্ষার শেষ স্কেল।”

তার ঠোঁটের কোণে একটা ম্লান হাসি।

— “আমি বুঝতে চেয়েছিলাম —
‘ভয়’ মানে কী?
এটা কি শারীরিক প্রতিক্রিয়া? মানসিক প্রতিক্রিয়া?
না কি এক বিজ্ঞানসম্মত মাপকাঠি —
যেখানে সঠিক উপাদান দিলে প্রতিটি মানুষ একইভাবে প্রতিক্রিয়া জানায়?”

অবিনাশ কিছু বলার আগেই সে বলতে থাকে —

— “আমি পিএইচডি করেছিলাম Fear Response under Conditioning Stimulus–এর উপর।
কিন্তু তাত্ত্বিক গবেষণায় আমার মন ভরেনি।
আমি চাইছিলাম বাস্তবের উপর কাজ করতে।
কিন্তু কেউ আমাকে সেই স্বাধীনতা দিচ্ছিল না।
তাই আমি নিজেই সেটা করে দেখালাম — সাহসিকভাবে।”

নুপুর চাপা স্বরে বলল —
— “আপনি শিশুদের ব্যবহার করলেন আপনার গবেষণার যন্ত্র হিসেবে… ওরা তো মানুষ…”

পরিমল একটু ঝুঁকে বলল:

— “মানুষ নয়, Subject
Subject 1A, 3F, 5E… তোমাদের বোধগম্য হবে না।
তারা ছিল আলাদা আলাদা ব্যাকগ্রাউন্ডের, আলাদা ভয় নিয়ে গড়া…
কিন্তু একটা সময় পরে, আমি আবিষ্কার করলাম —
ভয়ের গভীরতা মাপা যায়।
এবং প্রত্যেকটা Subject ভেঙে পড়ে একই প্যাটার্নে।”

তার চোখে তখন যেন এক ধরণের উন্মাদ আলো।

— “তোমরা ভাবো আমি খুন করেছি?
না। আমি কাউকে খুন করিনি।
তারা ভয় পেয়ে মরেছে — তাদের হার্ট ফেল হয়েছে, সেটা আমার দায় নয়।
আমি শুধু তাদের চোখে ভয় দেখেছি।
তোমাদের দৃষ্টিতে পাপ, আমার কাছে — Science।”

অবিনাশ মুখ শক্ত করে বলল —
— “আপনি নিজের পাণ্ডিত্যের নাম করে নিরীহ বাচ্চাদের উপর নৃশংস পরীক্ষা চালিয়েছেন।
আপনার গবেষণায় কোনও Human Ethics ছিল না।”

পরিমল একবার হেসে উঠল —
— “Human Ethics?
Newton আর Einstein-কে কেউ থামাতে পেরেছিল?
আমি তো শুধু ‘ভয়’কে ধরার চেষ্টা করেছিলাম…
যদি এই পৃথিবীর সবচেয়ে বড় অস্ত্র কিছু থাকে — সেটা ভয়।”

তিন সপ্তাহ পর।

পরিমল ঘোষ-কে আদালতে তোলা হয়েছিল।

অভিযোগপত্রে লেখা ছিল:
অবিচারিক মানসিক নির্যাতন, অপ্রাপ্তবয়স্কদের উপর বেআইনি পরীক্ষা, এবং পরোক্ষভাবে একাধিক মৃত্যুর জন্য দায়ী —
যদিও তার বিরুদ্ধে খুনের সরাসরি প্রমাণ মেলেনি।

কোর্টরুমে সে একবারও দুঃখপ্রকাশ করেনি।
বরং একই ঠান্ডা গলায় বলেছিল—

“আমি যা করেছি, বিজ্ঞানের জন্য করেছি।
যাদের মৃত্যু হয়েছে, তারা গবেষণার প্রয়োজনীয় ত্যাগ মাত্র।”

বিচারক তার কথায় কান দেননি।

তাকে দেওয়া হয় আজীবন কারাদণ্ড।
কিন্তু…
অনেকের মতে, এই রায়ে পুরোটা বিচার হয়নি।

তাকে পাগলাগারদে পাঠানো হয়নি,
কারণ তার মানসিক ভারসাম্য পরীক্ষায় ‘স্বাভাবিক’ বলে রিপোর্ট এসেছিল।
সে জেলে যাবে, ঠিক সাধারণ বন্দীদের সাথেই।

শুধু একটা আলাদা কেবিন থাকবে তার,
যেখানে কোনো বই, কোনো খাতা, কোনো কলম দেওয়া হবে না।

পরিমল ঘোষের গবেষণা সেখানেই শেষ।

আকাশটা আজ যেন অনেকখানি পরিষ্কার।
ভাঙাপুকুরের রোদে কুয়াশার গন্ধ মিশে নেই।

অবিনাশ দাঁড়িয়ে আছে নিজের সরকারি গাড়ির পাশে।
কলকাতার দিকে যাত্রা করার আগে
মনের ভেতরে একটা শব্দ ঘুরছে — অপূর্ণতা

ঠিক তখনই, বাঁ দিকের পথ ধরে আসতে দেখা গেল নুপুরকে।
হাঁটছে একা, কিন্তু তার চোখে ভীষণ নরম ক্লান্তি।
অবিনাশ এগিয়ে গেল।

— “নুপুর?”

সে থামল।
কিছুক্ষণ চুপচাপ তাকিয়ে থাকল অবিনাশের দিকে।
তারপর বলল —
— “আপনি ফিরে যাচ্ছেন?”

— “হ্যাঁ,” অবিনাশ মাথা নোয়াল।
— “আপনি?”

নুপুর একটু থেমে বলল —
— “আমিও।
এই গ্রামে থাকার আর কিছু নেই আমার।
রিমা ছিল… সে নেই।
আমি একা হয়ে গেছি।
এখানে আমার আর কোনও পিছুটান রইল না।”

অবিনাশ তাকিয়ে রইল কিছুক্ষণ।
তারপর ধীরে, খুব ধীরে বলল —
— “সবাই একা হয় কোনও না কোনও সময়।
তবে চাইলে…
…একসাথে একা হওয়া যায়।”

নুপুর একবার তাকাল তার চোখে।
তার চোখে কাঁপছিল না বলা একটা প্রশ্ন —
না হয়, সম্ভাবনা।

অবিনাশ বলল না আর কিছু।
চুপ করে দাঁড়িয়ে থাকল শুধু।

নুপুরও কিছু বলল না।

তবে তার হাতটা,
খুব স্বাভাবিকভাবে,
ধীরে ধীরে এগিয়ে এসে ধরা পড়ল অবিনাশের হাতের ভেতর।

না চেয়ে, না বলেই,
তারা দুজনে তাকিয়ে রইল সামনে —
যেখানে রোদ পড়েছে নরম ঘাসে।

সেই রোদের মধ্যে দিয়ে দুটো হাত ধরা থাকল,
আর গল্পটা
অবশেষে
শেষ হলো না,
শুধু থেমে গেল — একসাথে হাঁটার আগে।

– সমাপ্ত –

অধ্যায় ৬ / ৬

সকল অধ্যায়

নোট নিতে এবং টেক্সট হাইলাইট করতে লগইন করুন

লগইন