হেমেন্দ্রকুমার রায়
‘একদিন অপ্রত্যাশিতভাবে হঠাৎ যখন সাহিত্যসেবার ডাক এল তখন যৌবনের দাবি শেষ করে প্রৌঢ়ত্বের এলাকায় পা দিয়েছি। দেহ শ্ৰান্ত, উদ্যম সীমাবদ্ধ—শেখবার বয়স পার হয়ে গেছে। থাকি প্রবাসে, সব থেকে বিচ্ছিন্ন, সকলের কাছে অপরিচিত, কিন্তু আহানে সাড়া দিলাম, ভয়ের কথা মনেই হল না।
আঠারো বৎসর পরে হঠাৎ একদিন লিখতে আরম্ভ করলাম। কারণটা দৈব দুর্ঘটনারই মতো। আমার গুটিকয়েক পুরাতন বন্ধু একটি ছোটো মাসিক পত্র বের করতে উদ্যোগী হলেন। কিন্তু প্রতিষ্ঠাবান লেখকদের কেউই এই সামান্য পত্রিকায় লেখা দিতে রাজি হলেন না। নিরুপায় হয়ে তাঁদের কেউ কেউ আমাকে স্মরণ করলেন। বিস্তর চেষ্টায় তাঁরা আমার নিকট থেকে লেখা পাঠাবার কথা আদায় করে নিলেন। এটা ১৯১৩ সনের কথা। আমি নিমরাজি হয়েছিলাম। কোনও রকমে তাদের হাত থেকে রেহাই পাওয়ার জন্যেই আমি লেখা দিতেও স্বীকার হয়েছিলাম। উদ্দেশ্য—কোনও রকমে একবার রেঙ্গুনে পৌছোতে পারলেই হয়। কিন্তু চিঠির পর চিঠি আর টেলিগ্রামের তাড়া আমাকে অবশেষে সত্য-সতাই আবার কলম ধরতে প্ররোচিত করল। আমি তাদের নবপ্রকাশিত য‘মুনা’র জন্য একটি ছোটোগল্প পাঠালাম। এই গল্পটি প্রকাশ হতে না হতেই বাংলার পাঠক-সমাজে সমাদর লাভ করল। আমিও একদিনেই নাম করে বসলাম। তারপর আমি অদ্যাবধি নিয়মিতভাবে লিখে আসছি। বাংলাদেশে বোধ হয় আমিই একমাত্র সৌভাগ্যবান লেখক যাকে কোনওদিন বাধার দুর্ভোগ ভোগ করতে হয়নি।’
উপরের কথাগুলি শরৎচন্দ্রের। ওই হল তার সাহিত্যক্ষেত্রে পুনরাগমনের সংক্ষিপ্ত ইতিহাস। কিন্তু ব্যাপারটা আমরা একটু খুলেই বলতে চাই। কারণ আমাদের চোখের সামনে ঘটেছে প্রায় সমস্ত ঘটনাই। এবং এখন থেকে শরৎচন্দ্রের জীবনী লেখবার জন্যে আমাদের আর জনশ্রুতির বা অন্য কোনও লেখকের উপরে নির্ভর করতে হবে না।
‘যমুনা’ একখানি ছোটো মাসিক কাগজ। লক্ষ্মীবিলাস তৈলে’র স্বত্বাধিকারীরা প্রথমে এই কাগজখানি বের করেন। তারপর এর ভার নেন শ্ৰীযুক্ত ফণীন্দ্রনাথ পাল। সে হচ্ছে ১৯১৩ খ্রিস্টাব্দের কথা। প্রথমে যমুনা’র গ্রাহক দুই শতও ছিল কি না সন্দেহ। কিন্তু তখনকার উদীয়মান এবং কয়েকজন নাম-করা লেখক লেখা দিয়ে, যমুনাকে সাহায্য করতেন। যেমন, স্বর্গীয় কবি দেবেন্দ্রনাথ সেন, স্বর্গীয় কবি রসময় লাহা, স্বর্গীয় কবি সত্যেন্দ্রনাথ দত্ত স্বর্গীয় কৃষ্ণচন্দ্ৰ কুণ্ডু, স্বর্গীয় যতীন্দ্রনাথ পাল, স্বৰ্গীয় হেমেন্দ্রলাল রায়, স্বর্গীয় সতীশচন্দ্র ঘটক, স্বগীর্য় ইন্দিরা দেবী, ডক্টর শ্ৰীযুক্ত সতীশচন্দ্র বাগচী, শ্ৰীমতী নিরুপমা দেবী, শ্ৰীযুক্ত মোহিতলাল মজুমদার, শ্ৰীযুক্ত কুমুদরঞ্জন মল্লিক, শ্ৰীযুক্ত কালিদাস রায়, শ্ৰীমতী অনুরূপা দেবী, শ্ৰীযুক্ত উপেন্দ্রনাথ গঙ্গোপাধ্যায়, শ্ৰীযুক্ত সৌরীন্দ্রমোহন মুখোপাধ্যায়, শ্ৰীযুক্ত সুরেন্দ্রনাথ গঙ্গোপাধ্যায়, শ্ৰীযুক্ত করুণানিধান বন্দোপাধ্যায়, শ্ৰীযুক্ত বসন্তকুমার চট্টোপাধ্যায়, শ্ৰীযুক্ত কৃষ্ণবিহারী গুপ্ত, শ্ৰীযুক্ত শরচ্চন্দ্র ঘোষাল, শ্ৰীযুক্ত বিভূতিভূষণ ভট্ট ও শ্ৰীযুক্ত ব্রজেন্দ্রনাথ বন্দোপাধ্যায় প্রভৃতি আরও অনেকে। সুতরাং শরৎচন্দ্রের এই উক্তিটির মধ্যে অতিরঞ্জন আছে—প্রতিষ্ঠাবান লেখকদের কেহই এই সামান্য পত্রিকায় লেখা দিতে রাজি হলেন না। উপরে যাদের নাম করা হল তাদের অনেকেই তখন জনসাধারণের কাছে শরৎচন্দ্রের চেয়ে ঢের বেশি বিখ্যাত এবং তাদের সাহায্যে অনেক বড়ো মাসিকপত্র চলছে।
তবু যে ‘যমুনা’র সম্পাদক শ্ৰীযুক্ত ফণীন্দ্রনাথ পাল বিশেষভাবে শরৎচন্দ্রকে নিজের কাগজের প্রধান লেখক করবার জন্যে ব্যগ্র হয়ে উঠলেন, তার একমাত্র কারণ এই যে, শরৎচন্দ্রের মধ্যে তিনি প্রথম থেকেই বৃহৎ প্রতিভার অস্তিত্ব অনুভব করেছিলেন। ফণীন্দ্রনাথের অমন অতিরিক্ত আগ্রহ না থাকলে শরৎচন্দ্রকে পুনর্বার সাহিত্যের নেশা অত সহজে পেয়ে বসত না বোধহয়। একখানি বিখ্যাত মাসিকপত্রে সম্প্রতি বলা হয়েছে, শরৎচন্দ্রকে আবিষ্কার করার জন্যে স্বর্গীয় প্রমথনাথ ভট্টাচার্যের দাবি সর্বগ্রগণ্য। একথা সম্পূর্ণ অমূলক। শরৎচন্দ্রের একখানি পত্রেও (২৮-৩-১৯১৬) দেখেছি, তিনি স্পষ্ট ভাষাতেই ফণীবাবুকে লিখেছেন আপনার claim যে আমার উপর first তাহাতে আর সন্দেহ কী? শরৎচন্দ্রকে পুনর্বার কলম ধরাবার জন্যে প্রমথবাবু প্রথমে কোনও চেষ্টাই করেছেন বলে জানি না। এ-সম্পর্কে প্রমথবাবুর কথা নিয়ে পরে আলোচনা করব। আপাতত কেবল এইটুকু বললেই যথেষ্ট হবে যে, শরৎচন্দ্রকে আবার সাহিত্যক্ষেত্রে স্থায়ীভাবে আনবার জন্যে যাঁরা বিশ্লেষ চেষ্টা করেছিলেন তাদের মধ্যে প্রধান হচ্ছেন শ্রীযুক্ত ফণীন্দ্রনাথ পাল, শ্ৰীযুক্ত সৌরীন্দ্রমোহন মুখোপাধ্যায় ও শ্ৰীযুক্ত সুরেন্দ্রনাথ গঙ্গোপাধ্যায়।
এ-সম্বন্ধে সৌরীন্দ্রমোহনের বিবৃতি উদ্ধারযোগ্য
‘১৩১৯ সাল—পূজার সময় হঠাৎ শরৎচন্দ্ৰ আসিয়া উপস্থিত। আমায় বলিলেন— বড়দিদি গল্পটা আমায় পড়িতে দাও—
‘বেশ মনে আছে সেদিন কালীপূজা। বেলা প্রায় দুটার সময় আমার গৃহে বাহিরের ঘরে শরৎচন্দ্র, উপেন্দ্রনাথ ও আমি—বাঁধানো ভারতী খুলিয়া আমি বড়দিদি পড়িতে লাগিলাম! শরৎচন্দ্ৰ শুইয়া সে গল্প শুনিতে লাগিলেন। মাঝে মাঝে উঠিয়া বসেন। আমার হাত চাপিয়া ধরিয়া বলেন—চুপ। তার চোখ অশ্রুসজল, স্বর বাষ্পার্দ্র। শরৎচন্দ্র মুগ্ধ বিস্ময়-ভরা দৃষ্টিতে বলিলেন—এ আমার লেখা! এ গল্প আমি লিখিয়াছি!
তাঁর যেন বিশ্বাস হয় না। আমরা তাহাকে তিরস্কার করিলাম—লেখা ছাড়িয়া কী অপরাধ করিতেছ, বলো তো! শরৎচন্দ্র উদাস মনে বসিয়া রহিলেন—বহুক্ষণ পরে নিঃশ্বাস ফেলিয়া বলিলেন—লিখব। লেখা ছাড়া উচিত হয় নাই। লেখা ভালো—আমার নিজের বুকই কঁপিয়া উঠিতেছিল! তিনি বলিলেন—চাকরিতে একশো টাকা মাহিনা পাই। অনেককে খরচ দিতে হয়। শরীর অসুস্থ—সে দেশে আর কিছুদিন থাকিলে যক্ষ্মারোগে পড়িবেন—এমন আশঙ্কাও জানাইলেন।
আমি বলিলাম—তিন মাসের ছুটি লইয়া আপাতত কলিকাতায় চলিয়া এসো। মাসে একশো টাকা উপার্জন হয়—সে ব্যবস্থা আমরা করিয়া দিব।
শরৎচন্দ্ৰ কহিলেন-দেখি।
তার প্রায় তিন মাস পরে। শরৎচন্দ্র আবার কলিকাতায় আসিলেন।
‘যমুনা;- সম্পাদক ফণীন্দ্র পাল আমায় ধরিয়াছেন— ওই ‘যমুনা’কে তিনি জীবন-সর্বস্ব করিতে চান, আমার সহযোগিতা চাহেন।
শরৎচন্দ্ৰ আসিলে তাঁকে ধরিলাম—এই যমুনার জন্য লিখিতে হইবে।
শরৎচন্দ্র বলিলেন—একখানা উপন্যাস ‘চরিত্রহীন’ লিখিতেছি পড়িয়া দ্যাখো চলে কী না।
প্রায় পাঁচ আনা অংশ লেখা চরিত্রহীনের কপি তিনি আমার হাতে দিলেন। পড়িলাম। শরৎচন্দ্ৰ কহিলেন—নায়িকা কিরণময়ী। তার এখনও দেখা পাও নাই। খুব বড়ো বই হইবে।
চরিত্রহীন যমুনায় ছাপা হইবে স্থির হইয়া গেল।—তিনি অনিলা দেবী ছদ্মনামে ‘নারীর মূল্য’ আমায় দিয়া বলিলেন—আমার নাম প্রকাশ করিয়ো না। আপাতত যমুনায় ছাপাও।
তাই ছাপানো হইল। তারপুর দিলেন গল্প—‘রামের সুমতি’। যমুনায় ছাপা হইল। বৈশাখের যমুনার জন্য আবার গল্প দিলেন—‘পথনির্দেশ’।
শরৎচন্দ্র এই সময়ে যমুনা-সম্পাদককে রেঙ্গুন থেকে যেসব পত্র লিখেছিলেন, সেগুলি পড়লেই বেশ বুঝা যায় যে, পাথর-চাপা উৎসের মুখ থেকে কেউ পাথর সরিয়ে দিলে উৎস যেমন কিছুতেই আর নিজের উচ্ছসিত গতি সংবরণ করতে পারে না, শরৎচন্দ্রের অবস্থা হয়েছিল অনেকটা সেই রকম। অনেক দিন চেপে-রাখা সাহিত্যের উন্মাদনা আবার নূতন মুক্তির পথ পেয়ে শরৎচন্দ্রকেও এমনি মাতিয়ে তুলেছিল যে যমুনার ভালোমদের জন্যে যেন সম্পাদকের চেয়ে তারই দায়িত্ব ও মাথাব্যথা বেশি! একলাই প্রত্যেক সংখ্যার সমস্তটা লিখে ভরিয়ে দিতে চান এবং একাধিকবার তা দিয়েছেনও। এমনকী কেবল গল্প নয়, কবিতা ছাড়া বাকি প্রত্যেক বিষয় নিয়ে কলম চালাবার ইচ্ছাও তার হয়েছিল। মাঝে মাঝে ছদ্মনামে তিনি সমালোচনা পর্যন্ত লিখতে ছাড়েননি। তাদের মধ্যে বিশেষভাবে উল্লেখ্য হচ্ছে নারীর লেখা ও ‘কানকাটা’ নামে প্রবন্ধ দুটি; যুক্তিসঙ্গত মতামত, সতেজ ভাষা এবং হাস্য ও বিদুপরসের জন্যে সমালোচক শরৎচন্দ্রকে মনে রাখবার মতো; কিন্তু তার গ্রন্থাবলীতে ওদুটি রচনা এখনও পুনর্মুদ্রিত হয়নি।
‘যমুনা’য় প্রথমেই বেরুল শরৎচন্দ্রের নূতন গল্প ‘রামের সুমতি’। এ গল্পটির ভিতরে ছিল জনপ্রিয়তার অপূর্ব উপাদান এবং শরৎচন্দ্রের পরিপক্ক হাতের লিপিকুশলতা। তার উপরে ‘রামের সুমতি’র আর একটি মস্ত বিশেষত্ব হচ্ছে, সার্বজনীনতায় সে অতুলনীয়। কারণ ‘রামের সুমতি’ কেবল বয়স্ক পাঠকের উপযোগী নয়, তাকে অনায়াসেই শিশুসাহিত্যেরও সমুজ্জ্বল কোহিনুর বলে গ্রহণ করা যেতে পারে। প্রকাশ্য সাহিত্যক্ষেত্রে সর্বপ্রথম আবির্ভাবের জন্যে এমন আবালবৃদ্ধবনিতার উপযোগী বিষয়বস্তু নির্বাচন করে শরৎচন্দ্র নিজের আশ্চর্য তীক্ষ্ণবুদ্ধির পরিচয় দিয়েছেন। কারণ সেই একটিমাত্র গল্প সর্বশ্রেণীর পাঠককে বুঝিয়ে দিলে যে, বাংলা সাহিত্যক্ষেত্রে নূতন এক অসাধারণ প্রতিভার উদয় হয়েছে।
সেদিনের কথা মনে আছে। তখন ‘ভারতী’, ‘প্রবাসী’, ‘মানসী’ ও ‘নবভারত’ প্রভৃতি প্রধান পত্রিকায় লিখে অল্পবিস্তর নাম কিনেছি—অর্থাৎ সম্পাদকরা লেখা পেলে বাতিল করবার আগে কিঞ্চিৎ ইতস্তত করেন। কিন্তু রামের সুমতি পড়ে নিজের ক্ষুদ্রত্ব সম্বন্ধে সচেতন না হয়ে পারলুম না। একেবারে এত শক্তি নিয়ে কী করে তিনি দেখা দিলেন? সাহিত্যিক বন্ধুদের কাছ থেকে খোঁজ নেবার চেষ্টা করলুম—কে এই শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়? কোথায় থাকেন, কী করেন? অনুসন্ধানে জানতে পারলুম, শরৎচন্দ্র অকস্মাৎ লেখক হননি, ১৩১৪ সালে তারই লেখনীজাতা বড়দিদি ‘ভারতী’র আসরে গিয়ে হাজিরা দিয়েছে। মনে একটা বদ্ধমূল সংস্কার ছিল, কলম ধরেই কেউ পুরোদস্তুর লেখক হতে পারে না; ‘রামের সুমতি’র শরৎচন্দ্র সেই সংস্কারের মূল আলগা করে দিয়েছিলেন। এখন আশ্বস্ত হয়ে বুঝলুম, শরৎচন্দ্র নূতন লেখক নন—‘রামের সুমতি’র পিছনে আছে আত্মসমাহিত সাধকের বহুদিনের গভীর সাধনা! আর্টের আসর আর ম্যাজিকের আসর এক নয়—এক মিনিটে এখানে ফলন্ত আমগাছ মাথা চাগাড় দিয়ে ওঠে না।
১৩২০ সালের বৈশাখ থেকেই শরৎচন্দ্র যমুনা তথা বঙ্গসাহিত্যের আসরে অবতীর্ণ হলেন পূর্ণ উদ্যমে। ওই প্রথম সংখ্যাতেই বেরুল তার পুরাতন ক্রমপ্রকাশ্য উপন্যাস ‘চন্দ্রনাথ’, নবলিখিত ক্রমপ্রকাশ প্রবন্ধ ‘নারীর মূল্য’ ও সদ্যরচিত বড়ো গল্প ‘পথনির্দেশ’। নারীর মূল্যের নূতন রকম নবযুগের উপযোগী জোরালো যুক্তি এবং পথনির্দেশের লিপিকুশলতা আবার সকলের বিস্মিত দৃষ্টি আকর্ষণ করলে। (যদিও জনপ্রিয়তার হিসাবে এ গল্পটি ‘রামের সুমতি’র মতন সাফল্য অর্জন করেনি)। শ্রাবণ সংখ্যায় আত্মপ্রকাশ করলে বিন্দুর ছেলে। এ গল্পটি সাহিত্যক্ষেত্রে যে-উত্তেজনা সৃষ্টি করেছিল তার আর তুলনা নেই এবং এর পরে কথাসাহিত্যের আসরে শরৎচন্দ্রের স্থান কোথায়, সে-সম্বন্ধে কারুর মনে আর কোনও সন্দেহ রইল না।
১৩২০ সালের ‘যমুনা’য় শরৎচন্দ্রের নিম্নলিখিত রচনাগুলি প্রকাশিত হয়েছিল ১। নারীর মূল্য’ সম্পৰ্কীয় পাঁচটি প্রবন্ধ, ২। কানকাটা (প্রতিবাদ বা সমালোচনা), ৩। গুরুশিষ্য-সংবাদ (প্রচ্ছন্ন হাস্যরসাত্মকনাট্য-চিত্র), ৪ পথনির্দেশ(বড়োগল্প), ৫ বিন্দুর ছেলে (বড়োগল্প), ৬। পরিণীতা (বড়োগল্প), ৭। চন্দ্রনাথ (উপন্যাস) ও ৮ চরিত্রহীন (উপন্যাস)।
ইতিমধ্যে একটি ঘটনা ঘটেছে। ‘রামের সুমতি’ বেরুবার অনতিকাল পরেই শ্রীয়ুক্ত প্রভাতচন্দ্র গঙ্গোপাধ্যায় (বর্তমানে আনন্দবাজার পত্রিকা’র সম্পাদক-মণ্ডলীভুক্ত) একদিন বিখ্যাত কবি ও সাহিত্যিক শ্ৰীযুক্ত বিজয়চন্দ্র মজুমদারের কাছে গিয়ে ওই গল্পটি পড়ে শুনিয়ে এসেছেন। বিজয়বাবু প্রশংসায় একেবারে উচ্ছসিত হয়ে উঠলেন। এবং তার মুখে শুনে স্বর্গীয় দ্বিজেন্দ্রলাল রায়ও রামের সুমতি পাঠ করে অভিভূত হয়ে যান। তখন দ্বিজেন্দ্রলালের সম্পাদকতায় মহাসমারোহে ‘ভারতবর্ষ’ প্রকাশের উদ্যোগ-পর্ব চলছে। দ্বিজেন্দ্রলাল শরৎচন্দ্রকে ভারতবর্ষের লেখকরূপে পাবার জন্যে আগ্রহবান হন। দ্বিজেন্দ্রলালের পৃষ্ঠপোষকতায় তখন একটি শৌখিন নাট্য-সম্প্রদায় চলছিল এবং সেখানকার সভ্য স্বর্গীয় প্রমথনাথ ভট্টাচার্য ছিলেন শরৎচন্দ্রের পরিচিত ব্যক্তি। তিনি শরৎচন্দ্রকে দ্বিজেন্দ্রলালের আগ্রহের কথা জানালেন এবং তার ফলে লাভ করলেন শরৎচন্দ্রের চরিত্রহীন উপন্যাসের প্রথম অংশের পাণ্ডুলিপি। সকলেই জানেন, ‘চরিত্রহীন’ কোনওকালেই রুচিবাগীশদের মানসিক খাদ্যে পরিণত হতে পারবে না। রুচিবাগীশ বলতে যা বোঝায় দ্বিজেন্দ্রলাল তা ছিলেন না বটে, কিন্তু তার কিছু আগেই তিনি করেছিলেন কাব্যে দুর্নীতির বিরুদ্ধে বিষম যুদ্ধঘোষণা। কাজেই তার নূতন কাগজে তিনি চরিত্রহীন প্রকাশ করতে ভরসা পেলেন না। চরিত্রহীন বাতিল হয়ে ফিরে আসে এবং পরে যমুনায় বেরুতে আরম্ভ করে। এই প্রত্যাখ্যানের জন্যে শরৎচন্দ্ৰ মনে যে আঘাত পেয়েছিলেন, সেটা তখনকার অনেক সাহিত্যিক বন্ধুর কাছে প্রকাশ না করে পারেননি। কিন্তু সেজন্যে আত্মশক্তির উপরে তার নিজের বিশ্বাস ক্ষুণ্ণ হয়নি কিছুমাত্র। ‘যমুনা’তে যখন ‘চরিত্রহীন’ প্রকাশিত হতে থাকে তখনও একশ্রেণীর লোক তাঁর বিরুদ্ধে তুমুল আন্দোলন উপস্থিত করে। কিন্তু শরৎচন্দ্র ছিলেন—অটল।
১৩২০ সালে শরৎচন্দ্র রেঙ্গুন থেকে ছুটি নিয়ে কলকাতায় ফিরে আসেন। সে-সময়ে ‘যমুনা’র আফিস উঠে এসেছে ২২১, কর্নওয়ালিস স্ট্রিটে। শ্ৰীমানী মার্কেটের সামনে এখন যেখানে ডি. রতন কোম্পানির আলোক-চিত্রালয়, ওইখানে ছাদের উপরে সতরঞ্চ বিছিয়ে রোজ সন্ধ্যায় বসত ‘যমুনা’র সাহিত্য-আসর। শরৎচন্দ্রকেও সেখানে দেখা যেত প্রত্যহ। ওখানকার কিছু কিছু বিবরণ পরিশিষ্টে মৎলিখিত শরতের ছবির মধ্যে পাওয়া যাবে।
এবারে শরৎচন্দ্র কলকাতায় এলেন বিজয়ীর বেশে! যমুনায় প্রকাশিত রচনাবলী তখন তাকে সাহিত্যিক ও পাঠকসমাজে সুপ্রসিদ্ধ করে তুলেছে এবং যমুনা-কার্যালয় থেকেই গ্রন্থাকারে তার প্রথম উপন্যাস ‘বড়দিদি’ মুদ্রিত হয়েছে। প্রতিদিনই নব নব অপরিচিত ভক্ত একান্ত সুপরিচিতের মতন আসেন তার সঙ্গে আলাপ করে ধন্য হতে এবং আরও আসেন মধুলুব্ধ ভ্রমরের মতন প্রকাশকের দল। চারিদিক থেকে নিমন্ত্রণ-আমন্ত্রণের অন্ত নেই। শরৎচন্দ্র এবারে এসে বাসা বেঁধেছিলেন মুক্তারামবাবু স্ট্রিটের এক মোড়ে। সেই বাসা তুলে দিয়ে আবার যখন তিনি রেঙ্গুনে ফিরে গেলেন, তখন তিনি নিশ্চয়ই বুঝতে পেরেছিলেন যে, আর তাকে কেরানিগিরি করে সুদূর প্রবাসে জীবনযাপন করতে হবে না! মানুষের পক্ষে এই সফল উচ্চাকাঙক্ষার অনুভূতি কী সুমধুর!
হলও তাই। পর-বৎসরেই কেরানি শরৎচন্দ্র হলেন পুরোপুরি সাহিত্যিক শরৎচন্দ্র। এবং তখন তার জনপ্রিয় গ্রন্থাবলী প্রকাশের ভার পেলেন সর্বপ্রথমে ‘যমুনা’-আসরেরই অন্যতম সভ্য শ্ৰীযুক্ত সুধীরচন্দ্র সরকার,—এখন ‘রায় এম. সি. সরকার অ্যান্ড সন্স’ নামক সুবিখ্যাত পুস্তকালয়ের একমাত্র স্বত্বাধিকারী। প্রসঙ্গক্রমে বলে রাখি, শরৎচন্দ্রের শেষ পুস্তক ছেলেবেলার গল্প প্রকাশেরও অধিকার পেয়েছেন ওই সুধীরবাবুই।
ওই সময়ে শরৎচন্দ্রের অদ্ভুত জনপ্রিয়তা কতখানি চরমে উঠেছিল, একটিমাত্র ঘটনাই তা প্রমাণিত করবে। এম.সি. সরকার থেকে যখন চরিত্রহীন পুস্তকাকারে প্রকাশিত হল, তখন সেই সাড়ে তিন টাকা দামের গ্রন্থ প্রথম দিনেই সাড়ে চার শত খণ্ড বিক্রি হয়ে যায়! আর কোনও বাঙালি লেখক বাংলাদেশের পাঠকসমাজের ভিতরে প্রথম দিনেই এত মোটা প্ৰণামী পেয়েছেন বলে শুনিনি। পরে তার পথের দাবি নাকি এর চেয়েও বেশি আদর পেয়েছিল!
নোট নিতে এবং টেক্সট হাইলাইট করতে লগইন করুন
লগইন