হেমেন্দ্রকুমার রায়
শরৎচন্দ্রের মতন বৃহৎ প্রতিভা ‘যমুনা’র মতন ছোটো পত্রিকায় বেশিদিন বন্দি থাকবার জন্যে সৃষ্ট হয়নি। অবশ্য শরৎচন্দ্র যদি ‘যমুনা’কে ত্যাগ না করতেন, তাহলে ‘যমুনা’ যে কেবল আজ পর্যন্ত বেঁচে থাকত তা নয়, আকারে ও প্রচারে আজ সে হয়তো বিপুল হয়ে উঠতে পারত; কারণ ১৩২০ সালেই তার গ্রাহক-সংখ্যা বেড়ে উঠেছিল আশাতীত। কিন্তু ‘যমুনা’ বেশিদিন আর শরৎচন্দ্রকে ধরে রাখতে পারলে না। ‘যমুনা’র সম্পাদকরূপে পরে শরৎচন্দ্রের নাম বিজ্ঞাপিত হল বটে, কিন্তু ‘ভারতবর্ষ’ তার সবল বাহু বাড়িয়ে তখন শরৎচন্দ্রকে টেনে নিয়েছে। সম্পাদক শরৎচন্দ্রের চেয়ে ঔপন্যাসিক শরৎচন্দ্রের পসার বেশি। তার সমস্ত নূতন রচনা ‘ভারতবর্ষে’ই প্রকাশিত হতে লাগল।
‘যমুনা’র সর্বনাশ হল বটে, তবে শরৎচন্দ্রের দিক থেকে এটা হল একটা মঙ্গলময় ঘটনা। কারণ ‘যমুনা’ ধনীর কাগজ ছিল না, শরৎচন্দ্রকে সে কোনওরকম অর্থসাহায্য করতে পারত না। কিন্তু ‘ভারতবর্ষে’র স্বত্বাধিকারীরা হচ্ছেন বাংলাদেশের সর্বপ্রধান প্রকাশক এবং তাদের নিয়মিত অর্থসাহায্যের উপরেই নির্ভর করে নিজের ভবিষ্যৎ সম্বন্ধে নিশ্চিন্ত হয়ে শরৎচন্দ্র দাসত্ব ত্যাগ করে সাহিত্যজীবনকেই গ্রহণ করলেন একান্তভাবে। শরৎচন্দ্রের মতন শিল্পীকে স্বাধীনতা দিয়ে ‘ভারতবর্ষে’র স্বত্বাধিকারীরা যে বঙ্গসাহিত্যেরই উপকার করলেন, এ সত্য মানতেই হবে। এবং এইখানেই স্বর্গীয় প্রমথনাথ ভট্টাচার্যের কৃতিত্বের কথা মনে ওঠে। কারণ শরৎচন্দ্রকে ‘ভারতবর্ষে’র বড়ো আসরে হাজির করবার জন্যে তিনি যথেষ্ট—এমনকী প্রাণপণ চেষ্টাই করেছিলেন।
যমুনায় কথাসাহিত্যের যে উৎসব আরম্ভ, ‘ভারতবর্ষে’র মস্ত আসরে স্থানান্তরিত হয়ে তার সমারোহ বেড়ে উঠল। শরৎচন্দ্র তখন বাংলা সাহিত্যের জন্যে নিজের সমস্ত শক্তিপ্রয়োগ করলেন, তার লেখনীর মসী-ধারা অকস্মাৎ যেন প্রপাতে পরিণত হতে চাইলে বিপুল আনন্দে! সে তো বেশিদিনের কথা নয়, আজও অধিকাংশ পাঠকের মনেই তখনকার সেই বিস্ময়কর মহোৎসবের স্মৃতি নিশ্চয়ই বিচিত্র রঙের রেখায় আঁকা আছে! মোপাসাঁর সাহিত্যজীবনের মতো শরৎচন্দ্রের নবজাগ্রত সাহিত্যজীবনও প্রধানত একযুগের মধ্যেই মাতৃভাষার ঠাকুরঘরে অধিকাংশ শ্রেষ্ঠ অর্ঘ্য নিবেদন করেছিল। প্রতি মাসে নব নব উপহার— নব নব বৈচিত্র্য—নব নব বিস্ময়! পরিচিতরা অবাক হয়ে ভাবতে লাগলেন, ওই তো এক রোগজীর্ণ শীর্ণদেহ অতি সাধারণ ছটফট মানুষ, যার মুখে ক্ষুদ্র সাহিত্যিকদেরও মতো বড়ো বড়ো বুলি শোনা যায় না, বিদ্বানদের সভায় গিয়ে যিনি দুটো লাইনও গুছিয়ে বলতে পারেন না, রাজপথের জনপ্রবাহের মধ্যে যিনি কারুর দৃষ্টি আকর্ষণ করেন না, তার মধ্যে কেমন করে সম্ভব হল এই মহামানুষোচিত শক্তির প্রাবল্য, নরজীবন সম্বন্ধে এই অদ্ভুত অভিজ্ঞতা, মানবতার আদর্শ সম্বন্ধে এই উদার উচ্চধারণা, সংকীর্ণ প্রচলিতের বিরুদ্ধে এই সগর্ব বিদ্রোহিতা এবং কল্পনাতীত সৌন্দর্যের এই অফুরন্ত ঐশ্বর্য।
কেবল ‘ভারতবর্ষ’ নয়, পরে মাঝে মাঝে ‘বঙ্গবাণী’ ‘নারায়ণ’ ও ‘বিচিত্রা’ প্রভৃতি আসরে গিয়েও শরৎচন্দ্র দেখা দিয়ে এসেছেন। তার কোনও কোনও উপন্যাস একেবারে গ্রন্থাকারে প্রকাশিত হয়েছে(যেমন বামুনের মেয়ে), কোনও কোনও উপন্যাস সমাপ্ত হয়নি, কোনওখানির পাণ্ডুলিপি নষ্টও হয়ে গিয়েছে (যেমন ‘মালিনী’)। ‘ভারতবর্ষে’র সঙ্গে সম্পর্ক স্থাপনের পরে শরৎচন্দ্র এই উপন্যাস বা গল্পগুলি লিখেছিলেন : বিরাজ-বৌ, পণ্ডিতমশাই, বৈকুণ্ঠের উইল, স্বামী,মেজদিদি, দর্পচূর্ণ, আঁধারে আলো, শ্ৰীকান্ত (১ম, ২য়,৩য় ও ৪র্থ পর্ব) দত্ত, পল্লীসমাজ, মালিনী, অরক্ষনীয়া, নিষ্কৃতি, গৃহদাহ, দেনাপাওনা, মানুনের মেয়ে, নববিধান, হরিলক্ষ্মী, মহেশ, পথের দাবি, শেষ-প্রশ্ন, বিপ্রদাস, জাগরণ (অসমাপ্ত), অনুরাধা, সতী ও পরেশ, আগামী কাল (অসমাপ্ত), শেষের পরিচয় (অসমাপ্ত), এবং ভালোমন্দ (১ম পরিচ্ছেদ)। মধ্যে মধ্যে প্রবন্ধও লিখেছেন। শেষের দিকে শিশুসাহিত্যেরও প্রতি তার দৃষ্টি পড়েছিল,কিন্তু এ-বিভাগে বিশেষরূপে উল্লেখযোগ্য নূতন কিছু করবার আগেই তাকে মহাকালের আহানে সাড়া দিতে হয়েছে। তিনি অনেক পত্র রেখে গেছেন, তারও অনেকগুলির মধ্যে শরৎ-প্রতিভার স্পষ্ট ছাপ আছে এবং একত্রে প্রকাশ করলে সেগুলিও সাহিত্যের অন্তর্গত হতে পারে।
দেশবন্ধু চিত্তরঞ্জন শরৎচন্দ্রের প্রতি যে সম্মান দেখিয়েছিলেন, তার তুলনা নেই। ‘নারায়ণ’ পত্রিকার জন্যে গল্প নিয়ে শরৎচন্দ্রের কাছে একখানি সই-করা চেক পাঠিয়ে দিয়ে দেশবন্ধু লিখেছিলেন—আপনার মতন শিল্পীর অমূল্য লেখার মূল্য স্থির করবার স্পর্ধা আমার নেই, টাকার ঘর শূন্য রেখে চেক পাঠালুম, এতে নিজের খুশিমতো অঙ্ক বসিয়ে নিতে পারেন। …সাধারণের দৃষ্টিতে শরৎচন্দ্রও হয়তো বোকার মতন কাজ করেছিলেন,—কারণ নিজের অসাধারণতার মূল্য নিরূপণ করেছিলেন তিনি মাত্র একশো টাকা!
বর্তমান ক্ষেত্রে শরৎসাহিত্য নিয়ে আমরা কোনও কথা বলতে চাই না, কারণ শরৎচন্দ্র পরলোকে গমন করলেও তার অস্তিত্বের স্মৃতি এখনও আমাদের এত নিকটে আছে যে, সমালোচনা করতে বসলে আমরা হয়তো যথার্থ বিচার করতে পারব না; লেখনী দিয়ে হয়তো কেবল প্রশংসার উচ্ছাসই নির্গত হতে থাকবে, কিন্তু তাকে সমালোচনা বলে না। এবং এখন উচিত কথা বলতে গেলেও অনেকের কাছে তা অন্যায়-রকম কঠোর বলে মনে হতে পারে। সুতরাং ও-বিপদের মধ্যে না যাওয়াই সঙ্গত।
অতঃপর বাংলা রঙ্গালয়ের সঙ্গে শরৎচন্দ্রের সম্পর্কের কথা সংক্ষিপ্তভাবে বলতে চাই।
তাঁর যে-উপন্যাস নাট্যাকারে সর্বপ্রথমে সাধারণ রঙ্গালয়ে উপস্থিত হয়েছিল, তার নাম হচ্ছে ‘বিরাজ-বেী’। নাট্যরূপদাতা ছিলেন শ্ৰীযুক্ত ভূপেন্দ্রনাথ বন্দ্যোপাধ্যায় এবং নাট্যমঞ্চ ছিল ‘স্টার থিয়েটার’। যশস্বী নট-নটীরাই এই নাটকের বিভিন্ন ভূমিকায় রঙ্গাবতরণ করেছিলেন বটে, কিন্তু নানা কারণে ‘বিরাজ-বৌ’য়ের পরমায়ু সুদীর্ঘ হয়নি।
তারপর শ্ৰীযুক্ত শিশিরকুমার ভাদুড়ী যখন মনোমোহন নাট্যমন্দিরের প্রতিষ্ঠা করলেন, তখন ভারতী-সম্প্রদায়ভুক্ত সাহিত্যিক বন্ধুদের বিশেষ অনুরোধে শরৎচন্দ্র পুরানো বাংলার ইতিহাস-সম্পৰ্কীয় একখানি নূতন নাটক লেখবার জন্যে উৎসাহিত হয়ে উঠেছিলেন। শরৎচন্দ্রের অনুরোধে নাচঘর সম্পাদক সেই সুখবর জনসাধারণেরও কাছে বিজ্ঞাপিত করেছিলেন। শিশিরকুমার সে-সময়ে ‘ভারতী’র আসরে নিয়মিতরূপে হাজিরা দিতেন। নূতন নাটক নিয়ে শরৎচন্দ্রের সঙ্গে তিনি জল্পনা-কল্পনা করেছিলেন বলেও স্মরণ হচ্ছে। শরৎচন্দ্রের নিজেরও দৃঢ়বিশ্বাস ছিল, তিনি নাটক লিখতে পারেন। এবং তার সাহিত্যিক বন্ধুদেরও দৃঢ়বিশ্বাস ছিল, যার উপন্যাসে এত নাটকীয় ক্রিয়া, সংলাপ ও ঘটনা-সংস্থান আছে, তার লেখনী নিশ্চয়ই নাট্য-সাহিত্যকে নূতন ঐশ্বর্য দান করতে পারবে। দুর্ভাগ্যক্রমে শেষ পর্যন্ত কারুর বিশ্বাসই সত্যে পরিণত হল না। যদিও এখনও আমাদের বিশ্বাস আছে যে, নাটক লিখলে শরৎচন্দ্রের লেখনী বিফল হত না। – শিশিরকুমার তখন নাট্যমন্দিরে বসে নূতন নাটকের অভাব অনুভব করছেন এবং থিয়েটারি নাট্যকারদের তথাকথিত রচনা তার পছন্দ হচ্ছে না। ওদিকে ‘ভারতী’ ইতিমধ্যে আবার শ্ৰীমতী সরলা দেবীর হস্তগত হয়েছে। সেই সময়ে শ্ৰীযুক্ত শিবরাম চক্রবর্তী ‘ভারতী’র পৃষ্ঠায় শরৎচন্দ্রের দেনা-পাওনা উপন্যাসকে ‘ষোড়শী’ নামে নাট্যাকারে প্রকাশ করেছেন। তার মধ্যে সাফল্যের সম্ভাবনা দেখে শিশিরকুমার তখনই শরৎচন্দ্রের আশ্রয় নিলেন। শরৎচন্দ্রের হস্তে পরিবর্জিত, পরিবর্ধিত ও পরিবর্তিত হয়ে ‘ষোড়শী’ নাট্যমন্দিরের পাদ-প্রদীপের আলোকে দেখা দিয়ে কেবল সফলই হল না, নাট্যজগতে যুগান্তর উপস্থিত করলে বললেও অত্যুক্তি হবে না। সেই সময়ে শরৎচন্দ্র আর একবার উৎসাহিত হয়ে বলেছিলেন, এইবারে আমি মৌলিক নাটক লিখব? কিন্তু তার সে উৎসাহও দীর্ঘস্থায়ী হয়নি।
‘ষোড়শী’র সাফল্য দেখে শরৎচন্দ্রের উপন্যাস থেকে রূপান্তরিত আরও অনেকগুলি নাটক একাধিক সাধারণ রঙ্গালয়ের জন্যে গ্রহণ ও অভিনয় করা হয়েছিল, যথা—‘পল্লীসমাজ’ ‘বারমা’, ‘চন্দ্রনাথ’, ‘চরিত্রহীন’, ‘অচলা’ ও ‘বিজয়া’ প্রভৃতি। অভিনয়ের দিক দিয়ে কোনওখনিই ব্যর্থ হয়নি। যদিও নাটকত্বের দিক দিয়ে সবগুলি সফল হয়েছে বলা যায় না—বিশেষত চরিত্রহীন । বলা বাহুল্য শরৎচন্দ্রের আর কোনও উপন্যাসের নাট্যরূপই ‘ষোড়শী’র মতো জনপ্রিয়তা লাভ করতে পারেনি।
বাংলার চলচ্চিত্র প্রথম থেকেই শরৎচন্দ্রের প্রতিভাকে অবলম্বন করতে চেয়েছে। এ বিভাগেও সর্বাগ্রে শরৎচন্দ্রকে পরিচিত করেন শিশিরকুমার, তার আঁধারে আলোর চিত্ররূপ দেখিয়ে। তারপর নানা চিত্র-প্রতিষ্ঠান শরৎচন্দ্রের কথাসাহিত্যের সাহায্যে অনেকগুলি ছবি (সবাক বা নির্বাক) তৈরি করেছেন, যথা—‘চন্দ্রনাথ’, ‘দেবদাস’ (সবাক ও নির্বাক), ‘স্বামী’, ‘শ্রীকান্ত’, ‘পল্লীসমাজ’, ‘দেনা পাওনা’, ‘বিজয়া’, ‘চরিত্রহীন’ ও ‘পণ্ডিতমশাই’। এদের মধ্যে একেবারে ব্যর্থ হয়েছে ‘চরিত্রহীন’ ও ‘শ্রীকান্ত’। অন্যগুলি অল্পবিস্তর জনপ্রিয়তা অর্জন করতে পেরেছে। কিন্তু সকলকার উপরে টেক্কা দিয়েছে সবাক ‘দেবদাস’, কী চিত্রকথা হিসাবে আর কী চিত্রশিল্প হিসাবে সে অতুলনীয়! চলচ্চিত্র জগতে আনাড়ি পরিচালকের পাল্লায় পড়ে শরৎচন্দ্রের প্রতিভার দান কলঙ্কিত হয়েছে বারংবার সাধারণ রঙ্গালয়ে তা এতটা দুর্দশাগ্রস্ত হয়নি কখনও। তার প্রধান কারণ, সাহিত্যশিক্ষাহীন বাঙালি পরিচালকদের দৃঢ় ধারণা, গল্পলেখকদের চেয়ে তারা ভালো করে গল্প বলতে পারেন। এই মূখোচিত ধারণার কবলে পড়ে বাংলাদেশে শ্রেষ্ঠ সাহিত্যিকদের নাম বহুবার অপমানিত হয়েছে। যারা বঙ্কিমচন্দ্র ও শরৎচন্দ্রকে মানে না, সেসব হতভাগ্যের কাছে অন্যান্য লেখকরা তো নগণ্য! কিন্তু শরৎচন্দ্রের নাম রেখেছে ‘দেবদাস’,—যদিও চলচ্চিত্রজগতে মনস্তত্ত্ব-প্রধান কোনও শ্রেষ্ঠ উপন্যাসেরই মর্যাদা সম্পূর্ণ অক্ষুণ্ণ থাকতে পারে বলে বিশ্বাস করি না। শরৎচন্দ্রের আরও কয়েকখানি উপন্যাস নাট্যরূপলাভের জন্যে অপেক্ষা করছে। তার কোনও কোনও মানসসন্তান ইতিমধ্যেই ছবিতে হিন্দি কথা কয়েছে, ভবিষ্যতে আরও অনেকেই কইতে পারে।
শরৎচন্দ্রের বহু রচনা ইউরোপের ও ভারতের নানা ভাষায় অনুদিত হয়ে প্রচুর সমাদর লাভ করেছে, এখানে তাদের নিয়ে বিশেষভাবে আলোচনা করবার ঠাই নেই। আরও কিছুকাল জীবিত থাকলে তিনি হয়তো নোবেল-পুরস্কার পেয়ে সমগ্র পৃথিবীর বিস্মিত চিত্ত আকর্ষণ করতে পারতেন।
একদৃষ্টিতে যতটা দেখা যায়, আমরা শরৎচন্দ্রের জীবন ততটা দেখে নিয়েছি বোধহয়। যৌবনে যে-শরৎচন্দ্রের দেশে মাথা রাখবার ছোট্রো একটুখানি ঠাঁই জোটেনি, ট্যাঁকে দুটি টাকা সম্বল করে যিনি মরিয়া হয়ে মগের মুল্লুকে গিয়ে পড়েছিলেন, প্রৌঢ় বয়সে তিনিই যে দেশে ফিরে এসে বালিগঞ্জে সুন্দর বাড়ি, রূপনারায়ণের তটে চমৎকার পল্লি-আবাস তৈরি করবেন, মোটরে চড়ে কলকাতার পথে বেড়াতে বেরুবেন, একদিন যারা তার দিকে মুখ ফিরিয়ে তাকাননি, তারাই এখন তার কাছে ছুটে এসে বন্ধু বা আত্মীয় বলে পরিচয় দিতে ব্যস্ত হবেন, এটা কেহই কল্পনা করতে পারেননি বটে, কিন্তু এসব খুব আশ্চর্য ব্যাপার নয়, কারণ এমন ব্যাপার আরও বহু প্রতিভাহীন ও বিদ্যাহীন ব্যক্তির ভাগ্যেও ঘটতে দেখা গিয়েছে।
আশ্চর্য ব্যাপার হচ্ছে এই শরৎচন্দ্রের জীবনে আলাদীনের প্রদীপের মতন কাজ করেছে বাংলা সাহিত্য। বাংলা সাহিত্য গরিবকে দুদিনে ধনী করে তুলেছে এমন দৃষ্টান্ত দুর্লভ। বড়ো বড়ো বাঙালি সাহিত্যিকদের দিকে তাকিয়ে কী দেখি? দীনবন্ধু, বঙ্কিমচন্দ্র ও দ্বিজেন্দ্রলাল উচ্চপদস্থ সরকারি কর্মচারী ছিলেন এবং রবীন্দ্রনাথ হচ্ছেন জমিদার। হেমচন্দ্ৰ যত দিন ওকালতি করতেন, কবিতা লিখতেন নির্ভাবলায়; কিন্তু অন্ধত্বের জন্যে ওকালতি ছাড়বার পর তাকে পরের কাছে হাত পেতে বাকি জীবন কাটাতে হয়েছে। এবং সাহিত্য অত বড়ো প্রতিভাবান মাইকেলকে কোনও সাহায্যই করেনি—হাসপাতালে গিয়ে তিনি মারা পড়েছেন একান্ত অনাথের মতো। বাংলাদেশের বড়ো সাহিত্যিকদের মধ্যে একমাত্র শরৎচন্দ্রই কেবল সাহিত্যের জোরে দুই পায়ে ভর দিয়ে বুক ফুলিয়ে দাঁড়াতে পেরেছেন,—ভারতীর পুরোহিত হয়েও লক্ষ্মীর ঝাঁপিকে করেছেন হস্তগত!
নিজের বাড়ি, নিজের গাড়ি ও নিজের টাকার কাড়ির গর্বে শরৎচন্দ্র একদিনের জন্যেও একটুও পরিবর্তিত হননি, তার মুখে কেউ কোনওদিন দেমাকের ছায়া পর্যন্ত দেখেনি। সাদাসিধে পোশাকে, সরল হাসিমাখা মুখে, বিনা অভিমানে তিনি আগেকার মতোই আলাপীলোকদের বাড়িতে গিয়ে হাজির হতেন, যারা তাকে চিনত না তার কথাবার্তা শুনেও তারা বুঝতে পারত না যে তিনি একজন পৃথিবীবিখ্যাত অমর সাহিত্যস্রষ্টা! ভানই যাদের সর্বপ্ন সেই পুঁচকে লেখকরা শরৎচন্দ্রকে দেখে কত শিক্ষাই পেতে পারে!
রেঙ্গুন থেকে চাকরিতে জবাব দিয়ে দেশে ফিরে এসে শরৎচন্দ্র কয়েক বৎসর শিবপুরে ভাড়া করে বাস করেন। কিন্তু শহরের একটানা ভিড়ের ধাক্কা সইতে না পেরে শেষটা তিনি রূপনারায়ণের রূপের ধারায় ধোয়া পানিত্ৰাসে (সামতাবেড়) নিরালা পল্লি-আবাস বানিয়ে সেইখানেই বাস করতে থাকেন। বাগানে ঘেরা দোতলা বাড়ি, লেখবার ঘরে বসে নটিনী নদীর নৃত্যলীলা দেখা যায়; পল্পিকথার অপূর্ব কথকের পক্ষে এর চেয়ে মনোরম স্থান আর কোথায় আছে? কখনও লেখেন, কখনও পড়েন, কখনও ভাবেন; কখনও বাগানে গিয়ে ফুলের চারা আর ফলের গাছের সেবা করেন; কখনও পুকুরের ধারে দাঁড়িয়ে যত্নে পালিত মাছদের আদরে ডেকে খাবার খেতে দেন; কখনও গাঁয়ের ঘরে ঘরে গিয়ে পল্লিবাসীদের কুশল-সংবাদ নেন এবং পীড়িতদের হোমিওপ্যাথি চিকিৎসা করে আসেন। এই ছিল শরৎচন্দ্রের কাছে আদর্শ জীবন!
কিন্তু যাঁর সৃষ্টির মধ্যে বিচিত্র জনতার শ্রেণী, বহুজনধাত্রী কলিকাতা নগরীও মাঝে মাঝে বোধহয় তাঁকে প্রাণের ডাকে ডাকত। তাই শেষ-জীবনে বালীগঞ্জেও তিনি একখানি বড়ো বাড়ি তৈরি করিয়েছিলেন। তারপর তার স্নেহ শহর ও পল্লির মধ্যে দুইভাগে বিভক্ত হয়ে যায়।
এবং শহরেও ছিল তাঁর আবাসে সকলের অবারিত দ্বার। আগন্তুকদের ভয় দেখাবার জন্যে বড়োমানুষীর দিনেও তার দেউড়িতে লাঠি-হাতে চাপদাড়ি দারোয়ান বসেনি কোনওদিন। তাই শরৎচন্দ্রের প্রশস্ত বৈঠকখানার ভিড়ের মধ্যে দেখা যেত দেশবিখ্যাত নেতা, সাহিত্যিক ও শিল্পীর পাশে নিতান্ত সাধারণ অখ্যাত লোকদের; হোমরা-চোমরা মোটরবিলাসী বাবুগণের পাশে কপর্দকহীন মলিনবাস দরিদ্রদের; পক্ককেশ গভীরমুখ প্রাচীনবৃন্দের পাশে ইশকুলের অজাতশত্রু চপল ছোকরাদের! শরৎচন্দ্র ছিলেন সমগ্র মানবজীবনের চিত্রকর, তাই কোনওরকম মানুষকেই তিনি ত্যাগ করতে পারতেন না—তিনি ছিলেন প্রত্যেকেরই বন্ধু, তাই সবাই এসে র্তার সঙ্গে আলাপ করে খুশি হয়ে বাড়ি ফিরে যেত। সেইজন্যেই আজ তার মৃত্যুর পরে অগুনতি মাসিকে, সাপ্তাহিকে ও দৈনিকে স্মৃতিকথার আর অন্ত নেই, যিনি তাকে একদিন দুদণ্ডের জন্যে দেখেছেন, তিনিও শরৎ-কাহিনি লিখতে বসে গেছেন প্রবল উৎসাহে এবং তিনিও এই ভাবটাই প্রকাশ করেছেন যে শরৎচন্দ্র তাকে, একান্ত স্বজনেরই মতনু ভালোবাসতেন! হয়তো সেইটেই আসল সত্য, বিরাট বিশ্বের বৃহৎ আকাশ থেকে ছোট্ট তৃণকণার প্রেমে যিনি হাসতে-কাদতে নারাজ। সাহিত্যিক বা শিল্পী হওয়া তার কাজ নয়!
তাঁর গোপন দান ছিল অনেক। নিজের জীবনের শ্রেষ্ঠাংশ নষ্ট হয়ে গিয়েছিল অভাব ও দীনতার হাহাকারে, তাই পরের দুঃখে তিনি অটল থাকতে পারতেন না। অনেক সময়ে ভিখারির হাতে একমুঠো সিকি দুআনি আনি ঢেলে দিয়েছেন দেশের ডাকে হাসিমুখে যারা শাস্তিকে মাথা পেতে নিয়েছে, তাদের পরিবারের অসহায়তার কথা ভেবে সমবেদনায় তাঁর প্রাণ ছটফট করত। তাই বহু রাজবন্দির পরিবারে গিয়ে পৌঁছোত তার অযাচিত অর্থসাহায্য। শরৎচন্দ্র নিজেও ছিলেন দেশের কাজে অগ্রণী:দেশবন্ধু চিত্তরঞ্জন, যতীন্দ্রমোহন ও সুভাষচন্দ্র প্রভৃতির সঙ্গে প্রায়ই কংগ্রেসের কাজে মেতে উঠতেন। শেষের দিকে শরীর ভেঙে পড়াতে এদিকে হাতেনাতে কাজ করা তার পক্ষে অসম্ভব হয়ে উঠেছিল বটে, কিন্তু তার মন পড়ে থাকত জাতীয় কর্মক্ষেত্রেই। এক সময়ে তিনি বঙ্গীয় প্রাদেশিক রাষ্ট্ৰীয় সমিতির সদস্য এবং হাওড়া জেলা রাষ্ট্ৰীয় সমিতির সভাপতি পর্যন্ত হয়েছিলেন।
শরৎচন্দ্রের লেখবার ধারা ছিল একটু স্বতন্ত্র। বহু নবীন লেখককে জানি, যারা বড়ো বড়ো লেখকের রচনাপ্রণালীর অনুসরণ করেন। এটা ভুল। কারণ প্রত্যেক লেখকেরই মনের গড়ন বিভিন্ন, তাই তাদের রচনাপ্রণালীও হয় ব্যক্তিগত। শরৎচন্দ্র আগে প্লট বা আখ্যানবস্তু স্থির করতেন না, আগে বিষয়বস্তু ও তার উপযোগী চরিত্রগুলিকে মনে মনে ভেবে রাখতেন, তারপর ঠিক করতেন তারা কী কী কাজ করবে। গতযুগের সাহিত্যসম্রাট বঙ্কিমচন্দ্রের পদ্ধতি ছিল সম্পূর্ণ অন্য রকম। বঙ্কিম-সহোদর স্বর্গীয় পূর্ণচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়ের মুখে শুনেছি, বঙ্কিমচন্দ্র আগে মনে-মনে করতেন ঘটনা-সংস্থান। শরৎচন্দ্রের আর এক নূতনত্ব ছিল। প্রায়ই তার মুখে শুনেছি যে, মনে-মনে নূতন উপন্যাসের কল্পনা স্থির হয়ে গেলে তিনি নাকি গোড়ার দিক ছেড়ে শেষাংশের বা মধ্যাংশের দু-চারটে পরিচ্ছেদ আগে থাকতে কাগজে-কলমে লিখে । রাখতে পারতেন। তার চরিত্রহীনের একাধিক বিখ্যাত অংশ এইভাবে লেখা!
শরৎচন্দ্রের ঝরঝরে লেখা দেখলে মনে হয়, ভাষা যেন অনায়াসে তার মনের ভিতর থেকে বেরিয়ে এসেছে। কিন্তু আসলে তিনি দ্রুত লেখকও ছিলেন না এবং খুব সহজে লিখতেও পারতেন না এবং লেখবার পরেও অনেক কাটাকুটি করতেন। বেশ ভেবে-চিন্তে বাক্যরচনা করতেন। বর্তমান জীবনী-লেখক ‘যমুনা’র যুগে রচনায় নিযুক্ত শরৎচন্দ্রকে দেখবার সুযোগ পেয়েছিলেন একাধিকবার। তখন তার মনে হয়েছিল, লিখতে লিখতে শরৎচন্দ্ৰ যেন বিশেষ মানসিক যন্ত্রণা ভোগ করছেন এবং প্রত্যেক ভালো লেখকেরই পক্ষে এইটেই হয়তো স্বাভাবিক! রচনাও তো জননীর প্রসব-বেদনার মতো;—যন্ত্রণাময় অথচ আনন্দময়!
যশস্বী হয়ে শরৎচন্দ্র প্রায় প্রতিদিনই অসংখ্য সম্পাদকের লেখার জন্যে তাগাদা সহ্য করেছেন, অটলভাবে এবং অম্লানবদনে। কিন্তু অধিকাংশ লেখকের মতো তাগাদার চোটে সহসা যা তা একটা কিছু লিখে দিয়ে কারুকে কখনও তিনি খুশি করতেন না। সম্পাদকরা রাগ করবেন বলে তিনি সাহিত্যের অপমান করতে রাজি ছিলেন না—টাকার লোভেও নয়! কথিত ভাষায় সাহিত্য রচনা করা ছিল শরৎচন্দ্রের মতবিরুদ্ধ। এ ভাষা তিনি ব্যবহার করতেন কদাচ। এ-বিষয়ে তিনি পুরাতনপন্থী ছিলেন। কথ্যভাষার সুদৃঢ় দুর্গ ভারতী’ আসরেও গিয়ে তিনি বহুবার নিজের অভিযোগ জানিয়েছিলেন।
সাহিত্যসেবার জন্যে তার ভাগ্যে প্রথম পুরস্কার লাভ হয় কলিকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের পক্ষ থেকে জগত্তারিণী পদক’। এ-সম্বন্ধে শরৎচন্দ্রের পুরাতন বন্ধু, পুস্তকের প্রকাশক ও মৌচাকসম্পাদক শ্ৰীযুক্ত সুধীরচন্দ্র সরকার লিখেছেন; সভা-সমিতিকে তিনি বর্জন করিয়া চলিতেন। আমার বেশ মনে আছে যে-বারে বিশ্ববিদ্যালয় হইতে র্তাহাকে ‘জগত্তারিণী মেডেল দেওয়া হয়, সেইবারের কনভোকেশনের দিনে মেডেল দিবার সময়ে তাহাকে খুঁজিয়া পাওয়া গেল না। হাজার হাজার লোকের সম্মুখে মেডেল পরিয়া আত্মপ্রসাদ লাভ করিবার প্রবৃত্তি তাঁহার ছিল না। তাই সেইদিন তিনি আমাদের দোকানের নিভৃত কোণে আত্মগোপন করিয়াছিলেন। আমরা জানি, সর্বপ্রথমে শরৎচন্দ্রকে যেদিন একটি সাহিত্য-সভার সভাপতি করা হয়, সেদিনও তিনি সুধীরচন্দ্রের পুস্তকালয়ে গিয়ে লুকিয়ে ছিলেন। কিন্তু এমন লুকোচুরি করে ছিনেজোক সভাওয়ালাদের কতদিন আর ফাকি দেওয়া যায়? শেষের দিকে শরৎচন্দ্রকে বাধ্য হয়ে সভার অত্যাচার সহ্য করতে হত, কিন্তু তার লাজুক ভাব কোনওকালেই যায়নি। আর একজন বিখ্যাত সাহিত্যিকের এই রকম সভা-ভীতি দেখেছি। তিনি হচ্ছেন স্বর্গীয় প্রভাতকুমার মুখোপাধ্যায়। সভার ব্যাপারে তিনি ছিলেন শরৎচন্দ্রেরও চেয়ে পশ্চাৎপদ!
শরৎচন্দ্র তাঁর সাহিত্যজীবনে সবচেয়ে উল্লেখযোগ্য পুরস্কার পেয়েছিলেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের কাছ থেকে। মৃত্যুর অনতিকাল আগে এই ডক্টর উপাধি লাভ করে হয়তো তিনি যথেষ্ট সান্তনা লাভ করেছিলেন—যদিও তার প্রতিভার মূল্য ওই উপাধির চেয়ে ঢের বেশি। উপাধি মানুষকেই বড়ো করে, প্রতিভাকে নয়।
১৩৩৯ সালে দেশবাসীর পক্ষ থেকে কলকাতার টাউন-হলে ‘শরৎ-জয়ন্তী’র আয়োজন হয়েছিল। কিন্তু সেই অনুষ্ঠানে একশ্রেণীর লোক এমন অশোভন কাণ্ড করেছিল যা ভাবলে আজও লজ্জা পেতে হয়! এর আগে ও পরে জীবনে আরও বহু বৃহৎ অনুষ্ঠানে শরৎচন্দ্র সম্মানলাভ করেছেন, কিন্তু এখানে তার ফর্দ দেওয়া অনাবশ্যক মনে করি, কারণ ওসব শোভা পায় সুবিস্তৃত পূর্ণাঙ্গ জীবনচরিতে।
সাহিত্যিক শরৎচন্দ্র সম্বন্ধে আমাদের যা বলবার তা মোটামুটি বলা হয়ে গেছে। তবে সাধারণ পাঠক হয়তো তার আরও কোনও কোনও পরিচয় পেতে চাইবেন। এখানে তাই আরও কিছু বলা হল। যারা এর চেয়েও বেশি কিছু চাইবেন, পরিশিষ্ট অংশের দিকে দৃষ্টিপাত করবেন।
জীবজন্তুদের প্রতি শরৎচন্দ্রের প্রাণের টান ছিল চিরদিনই। খুব ছেলেবেলাতেও তিনি বাক্সে করে নানারকম ফড়িং পুষতেন, পরিচর্যা করতেন নিজের হাতে। কোনও বাড়ির উঁচু আলিসা দিয়ে একটা মালিকহীন বিড়ালকে চলাফেরা করতে দেখলে তিনি দুর্ভাবনায় পড়তেন— যদি সে পড়ে যায়! পাখি, ছাগল ও বানর প্রভৃতি সব জীবকেই তিনি সমান যত্নাদর বিলিয়ে গেছেন। তার পোষা দেশি কুকুর ভেলু তো প্রায়-অমর হয়ে উঠেছে! ‘যুবরাজ’, ‘বংশিবদন’ প্রভৃতি আদরের ডাকে তিনি তাকে ডাকতেন! কেবল ভেলু নয়, যে-কোনও পথচারী কুকুর ছিল তার স্নেহের পাত্র। নিজের মোটরচালককে বলা ছিল, পথে যদি কখনও সে কুকুর চাপা দেয়, তাহলেই তার চাকরি যাবে! র্তার এই কুকুর-প্রতি দেখলে কবি ঈশ্বর গুপ্তের লাইন মনে হয়
কত রূপ স্নেহ করি
দেশের কুকুর ধরি,
বিদেশের ঠাকুর ফেলিয়া!
ভেলুর কয়েকটি গল্প পরিশিষ্টে শরতের ছবিতে দেওয়া হল। পাণিত্রাসের বাগানে পুকুরের মাছরাও তাকে চিনত। দুটি মাছ আবার তাকে সবচেয়ে বেশি ভালোবাসত। একবার বর্ষায় রূপনারায়ণ ছাপিয়ে বাগানে জল ঢুকে সেই মাছ দুটিকে ভাসিয়ে নিয়ে গিয়েছিল বলে তার দুঃখ কত! তার বাগানের একটি গর্তে দুটি বেজি তাদের বাচ্চা নিয়ে বাস করত। গায়ের এক ছেলে সেই বাচ্চাটিকে চুরি করে পালায়। শুনেই শরৎচন্দ্র তার বাড়িতে গিয়ে হাজির। ছেলেটিকে বোঝাবার চেষ্টা করলেন যে, সন্তানের অভাবে মা বাপের মনে কত কষ্ট হয়। কিন্তু ছেলেটি তবু বুঝল না দেখে শরৎচন্দ্র ক্রুদ্ধ হয়ে তখন জোর করে বাচ্চাটিকে কেড়ে এনে আবার নেউল-দম্পতিকে ফিরিয়ে দিলেন।
শরৎচন্দ্র যা তা খেলো কাগজে লিখতে পারতেন না। আর কোনও লেখককেই তার মতন নিয়মিতভাবে দামি কাগজে লিখতে দেখিনি। লেখার সরঞ্জাম সম্বন্ধে শরৎচন্দ্রের এই শৌখিনতা রচনার প্রতি তাঁর পবিত্র নিষ্ঠাকে প্রকাশ করে। তাঁর হাতে বরাবরই ফাইন্টেন পেন দেখেছি, যখন ও-পেনের চলন হয়নি, তখনও। তিনি খুব বড়ো ও মোটা কলম ও সূক্ষ্ম নিব ব্যবহার করতেন। ঘনিষ্ঠ বন্ধুদের দামি ফাউন্টেন পেন উপহার দিতে তিনি ভালোবাসতেন। তার হাতের লেখার ছাদ ছোটো হলেও চমৎকার ছিল। যেন মুক্তার সারি। তামাক ছাড়া তার একদণ্ড চলত না। লেখবার সময়েও গড়গড়ায় তামাক খেতেন। কেউ তাকে গড়গড়া উপহার দিলে খুশি হতেন। বঙ্কিমচন্দ্র ও অমৃতলাল বসুও ছিলেন গড়গড়ার এমনি ভক্ত। তিনি চায়েরও একান্ত অনুরাগী ছিলেন। অনেক দিনই তাকে আট-দশ পিয়ালা চা-পান করতেও দেখা গিয়েছে। তার একটি বদ-অভ্যাস ছিল—আফিম খাওয়া।
তিনি স্থির হয়ে এক জায়গায় বসে থাকতে পারতেন না। কখনও চেয়ারের উপরে দু’ পা তুলে ফেলতেন, কথা কইতে কইতে কখনও মাথার চুলের ভিতরে অঙ্গুলি সঞ্চালন করতেন, কখনও হঠাৎ উঠে দাঁড়িয়ে ঘরের ভিতরে একবার পায়চারি করে আসতেন। সভাপতিরূপেও এ অস্থিরতা তিনি নিবারণ করতে পারতেন না।
মাঝে মাঝে গরদের জাম-কাপড়-চাদর পরতেন বটে, কিন্তু কোনওদিনই তিনি ফিটফট পোশাক বাবু হতে পারেননি। বেশির ভাগ সময়েই আটপৌরে জাম-কাপড়ে একছুটে বেরিয়ে পড়তেন। একসময়ে তালতলার চটি ছাড়া আর কোনও জুতো পরতেন না। বাড়িতে তাকে হাত-কটা জামা পরে থাকতে দেখেছি।
যৌবন-সীমা পার হবার আগেই তিনি নিজেকে বুড়ো বলে প্রচার করতে ভালোবাসতেন। একবার হাওড়ার এক সভায় রবীন্দ্রনাথের পাশে দাঁড়িয়েই তিনি নিজের প্রাচীনতার গর্ব প্রকাশ করেন। তার চেয়ে বয়সে অনেক বড়ো রবীন্দ্রনাথের বিস্মিত মুখে সেদিন মৃদু কৌতুকহাস্য লক্ষ করেছিলুম! তার আগেকার অধিকাংশ পত্রেই এই কল্পিত বৃদ্ধত্বের দাবি দেখা যায়!
প্রকাশ্য সাহিত্যজীবনের প্রথম কয় বৎসর এই সব জায়গায় গিয়ে তিনি প্রাণ খুলে মেলামেশা করতেন ২২।১, কর্নওয়ালিস স্ট্রিটের ‘যমুনা’ কার্যালয়ে ও পরে ‘মর্মবাণী’ কার্যালয়ে; সুকিয়া স্ট্রিটে ‘ভারতী’ কাৰ্যালয়ে; গুরুদাস অ্যান্ড সন্সের দোকানে; রায় এম সি সরকার অ্যান্ড সন্সের দোকানে; ৩৮নং কর্নওয়ালিস স্ট্রিটের শ্ৰীযুক্ত গজেন্দ্রচন্দ্র ঘোষের বৈঠকখানায়, এবং শ্ৰীযুক্ত নির্মলচন্দ্র চন্দ্রের আলয়ে। শেষ-জীবনে তাকে আর কোনও সাহিত্য-বৈঠকে দেখা যেত না। মাঝে মাঝে তিনি একাধিক থিয়েটারি আসরে (প্রায়ই দর্শকরূপে নয়) উপরি-উপরি হাজিরা দিতেন।
পানিত্ৰাসে যেসব সাক্ষাৎপ্রার্থী গিয়ে উপস্থিত হতেন, তারা ফিরে আসতেন শরৎচন্দ্রের অতিথি-সৎকারে অভিভূত হয়ে। তিনি পরমাত্মীয়ের মতো সকলকে ভালো করে না খাইয়ে দাইয়ে ছেড়ে দিতেন না। বিংশ-শতাব্দীর অতি আধুনিক লেখক হলেও মানুষ-শরৎচন্দ্রের ভিতরে সেকেলে হিন্দু-স্বভাবটাই বেশি করে ফুটে উঠত।
আজকালকার অধিকাংশ সাহিত্যিকই নিজেদের কোনও বিশেষ দলভুক্ত বলে মনে করেন এবং এটা সগর্বে প্রচারও করেন। কিন্তু শরৎচন্দ্র বরাবরই ছিলেন দলাদলির বাইরে। প্রাচীন ও আধুনিক সব দলেই তিনি দীর্ঘকাল ধরে মিশেছেন একান্ত অন্তরঙ্গের মতো, কিন্তু কোথাও গিয়ে আপনাকে হারিয়ে ফেলেননি, বা কোনও দলের বিশেষ মনোভাব র্তার মনকে চাপা দিতে পারেনি। কেবল তাই নয়। তার চেয়ে বড়ো কথা হচ্ছে, আত্মাভিমানের বশবর্তী হয়ে তিনি নিজেও কোনও দলগঠন করেননি। সাহিত্যক্ষেত্রে ‘শরৎচন্দ্রের দল’ বলে কোনও দল নেই। অথচ এমন দলসৃষ্টি করা তার পক্ষে ছিল অত্যন্ত সহজ।
ভবিষ্যতের ইতিহাস সাহিত্যে শরৎচন্দ্রের আসন স্থাপন করবে কত উচ্চে, আজ তা কল্পনা করা কঠিন। তবে বর্তমান যুগের কথাসাহিত্যে রবীন্দ্রনাথ ও তার মাঝখানে যে অন্য কারুর ঠাঁই হবে না, এটা নিশ্চিতরূপেই বলা যায়। এবং শরৎচন্দ্রের অতুলনীয় জনপ্রিয়তার কাহিনি যে সুদূর ভবিষ্যৎ যুগকেও বিস্মিত করবে সে-বিষয়েও সন্দেহ করবার কারণ নেই। এখন বাকি রইল শরৎচন্দ্রের শেষ রোগশয্যার কথা। সেটা নিজে না বলে এখানে বাতায়নে’র বিবরণী উদ্ধার করে দিলুম
‘মৃত্যুর বছর দুই পূর্বে থেকে শরৎচন্দ্রের শরীরে ব্যাধি প্রকট হয়। চিরদিন তিনি বলতেন, শরীরে আমার কোনও ব্যাধি নেই, শুধু অর্শটাই মাঝে মাঝে যা একটু কষ্ট দেয়। অর্শ যে আর সারবে তা আমার মনে হয় না, তা এতদিন ও আমাকে আশ্রয় করে আছে যে ওকে আশ্রয়হীন করাও কঠিন। কিন্তু কুমুদ (ডাঃ কুমুদশঙ্কর রায়) ওর পরম শত্রু। সে বলে, ওকে তাড়াতেই হবে। একথা ওকে আর জানতে দিইনে। জানলে ভয়ে ও এমনি সঙ্কুচিত হয়ে উঠবে যে প্রাণ আমার ওষ্ঠাগত করে তুলবে। একেই তো ওকে খুশি রাখতে দিনে কয়েক ঘণ্টা আমার কাটে, ওর ওপর ও যদি অভিমান করে তাহলে বুঝতেই পারছ আমার অবস্থা কী হবে!…’ অর্শর কথা উঠলে এমনি পরিহাসই তিনি করতেন।
দিন যায়—অর্শ ব্যাধিটি পুরাতন ভৃত্যের মতো তার সঙ্গেই থাকে। একদিন ডাঃ কুমুদশঙ্কর নিষ্ঠুরভাবে তাকে তার দেহ থেকে কেটে বার করে দিলেন। তিনি বললেন, বাঁচলুম! এতদিনে সত্যি ও আমায় ছেড়ে গেল। কিন্তু ভয় হয়, প্রতিশোধ নিতে ও কুমুদকে না ধরে।
হঠাৎ তার শরীরে প্রতিদিন জ্বর হতে লাগল আর সঙ্গে কপাল থেকে মাথা পর্যন্ত এক রকম যন্ত্রণার সূত্রপাত হল। জ্বরও ছাড়তে চায় না—যন্ত্রণাও যেতে চায় না। একদিন জ্বর গেল, কিন্তু যন্ত্রণা রয়ে গেল। চিকিৎসকেরা বললেন, ‘নিউরলজিক পেন’ …নানা চিকিৎসা চলতে লাগল,—শেষে যন্ত্রণারও উপশম হল। কিন্তু কিছুদিন যেতে না যেতে পেটে এক রকম অস্বস্তি অনুভব করতে লাগলেন। পরীক্ষায় বুঝা গেল পাকস্থলীতে ক্যানসার হয়েছে। এ কথা তার কাছে গোপন রাখা হল—ইতিমধ্যে রঞ্জনরশ্মির পরীক্ষার সাহায্যে চিকিৎসকেরা রোগ সম্পর্কে নিঃসন্দেহ হলেন। এদিকে শরীর তার অত্যন্ত দুর্বল—অস্ত্রোপচার করা সম্পূর্ণ অসম্ভব। চিকিৎসকেরা বড়ো মুশকিলে পড়লেন। শেষে স্থির হল বাড়ি থেকে (২৪নং অশ্বিনীকুমার দত্ত রোড) তাকে কোনও নাসিংহোমে রেখে শরীরে যখন কিছু শক্তি সঞ্চয় হবে তখন অস্ত্রোপচার করা হবে। এই সিদ্ধান্তের পরই তাকে ২৮শে ডিসেম্বর ১৯৩৭ তারিখে পার্ক স্ট্রিটের একটি ইউরোপিয়ান নাসিংহোমে স্থানান্তরিত করা হয়। সেখানে তার বিশেষ অসুবিধা হওয়ায় ১লা জানুয়ারি ১৯৩৮ তারিখে তিনি চলে আসবার জন্যে এমনি জিদ ধরে বসেন যে তাকে অন্য নাসিংহোমে স্থানান্তরিত করা ব্যতীত আর উপায় রইল না। তিনি বলেছিলেন, আমাকে যদি এখান থেকে না নিয়ে যাওয়া হয় তাহলে আমি মাথা ঠুকে মরব। এখানকার নার্সগুলো আমাকে বড়ো বিরক্ত করে। (মানে তাকে তামাক ও আফিম খেতে দেয় না!)
যেখানে তাকে স্থানান্তরিত করা হল তার নাম হচ্ছে ‘পার্ক নাসিংহোম’। কাপ্তেন সুশীল চট্টোপাধ্যায়ের ভবানীপুরস্থ ৪নং ভিক্টোরিয়া টেরাসের ভবনের নীচের তলায় এটি অবস্থিত। এরই ১নং ঘরে তাকে রাখা হল।
এখানে কিছুদিন রাখবার পর বুধবার ১২ই জানুয়ারি তারিখে বেলা ২॥০ টার সময় অত্যন্ত গোপনে তার পাকস্থলীতে অস্ত্রোপচার করা হয়। এটি ক্যানসারের উপর অস্ত্রোপচার নয়। মুখের মধ্যে দিয়ে কিছু খাবার শক্তি তাঁর আর ছিল না, অথচ দেহে রক্তের প্রয়োজন। এই উদ্দেশ্যে পাকস্থলীতে অস্ত্রোপচার করে তাকে খাওয়াবার ব্যবস্থা করা হয়। এই অন্ত্রোপচার ব্যাপারে শরৎচন্দ্র যে মানসিক শক্তির পরিচয় দিয়েছেন তা থেকে বেশ বুঝা যায় মৃত্যু সম্বন্ধে তিনি একটুও শঙ্কিত ছিলেন না। চিকিৎসকেরা তার জীবনের কোনও আশাই রাখেননি, তাই তারা অস্ত্রোপচারের পক্ষপাতী ছিলেন না। শরৎচন্দ্র কিন্তু নাছোড়বান্দা—অস্ত্রোপচার করতেই হবে। জোর করে বললেন, আমি বলছি তোমরা করো—তোমাদের কোনও দায়িত্ব নেই… ভয় কিসের-I am not a woman.
তার ইচ্ছাই পূর্ণ হল। এর পর চার দিন মাত্র তিনি জীবিত ছিলেন। ১৬ই জানুয়ারি ২রা মাঘ, রবিবার, বেলা ১০টার সময় নার্সিংহােমেই তার জীবনলীলার অবসান হয়। বেলা ১১টার সময় তার নিজের মোটরগাড়িতে তাকে তার বাড়িতে আনা হয়। বৈকালবেলায় ৪টের সময়, এক বিরাট শোভাযাত্রা সহ তার শবদেহ কেওড়াতলার শ্মশানতীর্থে আনীত হয়। ৫-৪৫ মি. সময়ে তার চিতায় অগ্নিসংযোগ করা হয়।
শরৎচন্দ্র মহাপ্রস্থান করেন রবিবার, ২রা মাঘ ১৩৪৪; তাঁর বয়স হয়েছিল একষট্টি বৎসর দুই মাস মাত্র।
মৃত্যুর পূর্বে শরৎচন্দ্রের শেষ কথা হচ্ছে, আমাকে দাও—আমাকে দাও—আমাকে দাও! ..কে তাকে কী দিতে এসেছিল, কিসের জন্য তার এই অন্তিম আগ্রহ?…শরৎচন্দ্রের মুখ চিরমৌন, শরৎচন্দ্রের লেখনী চির-অচল। তার প্রার্থিত সেই অজ্ঞাত নিধির কথা আর কেউ জানতে পারবে না।
নোট নিতে এবং টেক্সট হাইলাইট করতে লগইন করুন
লগইন