শৈশব-জীবন (১৮৭৬-১৮৮৬)

হেমেন্দ্রকুমার রায়

হুগলি জেলার একটি গ্রামের নাম হচ্ছে দেবানন্দপুর। যদিও এক সময়ে দেবানন্দপুরের রায়গুণাকর ভারতচন্দ্রের নামের সঙ্গে জড়িত থাকবার সৌভাগ্য হয়েছিল, তবু একালে এ গ্রামটির নাম কিছুকাল আগে খুব কম লোকেরই জানা ছিল। কিন্তু এখন শরৎচন্দ্রের নামের সঙ্গে জড়িত হয়ে দেবানন্দপুর আবার বিখ্যাত হয়ে উঠেছে। পৃথিবীর সব দেশ, নগর ও গ্রাম বড়ো হয় মানুষেরই মহিমায়। কোনও বিশেষ দেশে জন্মেছে বলে কোনও মানুষ বড়ো হতে পারে না। অনেকে বড়ো হবার জন্যে বড়ো বড়ো দেশে যান। কিন্তু সত্যিকার প্রতিভাবান মানুষ নিজেই বড়ো হয়ে নিজের দেশকে বড়ো করে তোলেন।

এই দেবানন্দপুরে মতিলাল চট্টোপাধ্যায় নামে এক ব্রাহ্মণ বাস করতেন। মতিলাল ধনী ছিলেন না, ছিলেন তার উলটোই—অর্থাৎ গরিব মতিলাল ছিলেন সেকালকার অনেক ব্রাহ্মণেরই মতন নিষ্ঠাবান, কারণ বাংলাদেশের গ্রামে গ্রামে তখন পাশ্চাত্য সভ্যতার প্রভাব বেশি বিস্তৃত হতে পারেনি। এখন বিলাতি শিক্ষায় অনেকেই ব্রাহ্মণোচিত কর্তব্যের কথা ভুলে যান, কিন্তু মতিলাল নাকি এ-দলের লোক ছিলেন না। শরৎচন্দ্রের কথায় জানতে পারি, মতিলালের আর একটি গুণ ছিল তা হচ্ছে সাহিত্যপ্রীতি।

মতিলালের সহধর্মিণীর নাম ভুবনমোহিনী দেবী। এর কথা ভালো করে এখনও জানা যায়নি, শরৎচন্দ্রের উক্তি থেকেও তার কথা জানা যায় না। তবে তার সম্পর্কে-ভাই শ্রীযুক্ত সুরেন্দ্রনাথ গঙ্গোপাধ্যায় লিখেছেন তিনি বড়ো সাদা-মাঠা লোক ছিলেন। কিন্তু এই নিতান্ত সাদাসিধা মানুষটির অন্তরে একটি মেহের সমুদ্র নিহিত ছিল। তিনি কোনওদিন কাহারও সহিত সম্বন্ধের দাবির দিক দিয়া ব্যবহার করিতেন না। কর্তারা তাহার সেবা-ভক্তিতে মুগ্ধ ছিলেন এবং আমরা ছিলাম সেই বিশুদ্ধ মেহের উপাসক। আজও তার কথা মনে করিতে বুকের মধ্যে চাপা ব্যথার মতো বোধ হয়—চক্ষু সরস হইয়া উঠে!

১২৮৩ সালের ভাদ্র মাসের ৩১শে (ইংরেজি ১৮৭৬ অব্দের ১৫ই সেপ্টেম্বর) তারিখে মতিলালের প্রথম পুত্ৰলাভ হয়। এই ছেলেটিই বাংলার আদরের নিধি শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়। গরিব হলেও প্রথম পুত্রসস্তান লাভ করে মতিলাল ও ভুবনমোহিনী যে আনন্দের আতিশয্যে খানিকটা ঘটা করে ফেলেছিলেন, এইটুকু আমরা অনায়াসেই ধরে নিতে পারি। কিন্তু শিশুর ললাটে সেদিন বিধাতা-পুরুষ গোপনে যে অক্ষয় যশের তিলক একে দিয়েছিলেন, পিতা বা মাতা কেউ সেটা আবিষ্কার করতে পারেননি। এবং এই শিশু বড়ো হয়ে যখন পিতৃকুল ও মাতৃকুল ধন্য করলেন আপন প্রতিভায়, দুর্ভাগ্যক্রমে মতিলাল বা ভুবনমোহিনী সেদিন বিপুল আনন্দে পুত্রকে আশীৰ্বাদ করবার জন্যে সংসার-নাট্যশালায় উপস্থিত ছিলেন না!

শরৎচন্দ্রের আরও ছয়টি ভাই জন্মেছিলেন।

মধ্যভ্রাতার নাম প্রভাসচন্দ্র। অল্প বয়সেই সন্ন্যাস-ব্রত নিয়ে রামকৃষ্ণ মঠে গিয়ে তিনি নরনারায়ণের সেবায় নিযুক্ত হয়েছিলেন। সন্ন্যাসী প্রভাসচন্দ্রের নাম হয় স্বামী বেদানন্দ। ভারত, সিংহল ও ব্রহ্মের দেশে দেশে ছিল তার কার্যক্ষেত্র। ১৯৩০ খ্রিস্টাব্দে তিনি যখন দেশে ফিরে আসেন, শরৎচন্দ্র তখন পাণিত্রাসে বাস করছেন। রুগ্নদেহ নিয়ে বেদানন্দ জ্যেষ্ঠ ভ্রাতার আবাসে গিয়ে উঠলেন এবং শরৎচন্দ্রেরই কোলে মাথা রেখে পৃথিবী থেকে চিরবিদায় নিলেন। রূপনারায়ণের তীরে শরৎচন্দ্র স্বামী বেদানদের স্মৃতিরক্ষার জন্যে একটি সমাধিমন্দির রচনা করে দিয়েছেন এবং পাণিত্রাসে অবস্থানকালে প্রতিদিন সন্ন্যাসী-ভ্রাতার স্মৃতির তীর্থে পুষ্পাঞ্জলি অর্পণ করতেন।

বর্তমান আছেন শরৎচন্দ্রের একমাত্র সহোদর শ্ৰীযুক্ত প্রকাশচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়। শরৎচন্দ্রের আগ্রহে বিবাহ করে তিনি গৃহী হয়েছেন বটে, কিন্তু তারও প্রথম জীবনের কিছুকাল কেটেছে ভবঘুরের মতো।

এবং শরৎচন্দ্রও প্রথম যৌবনে ছিলেন ভবঘুরের মতো। মাঝে মাঝে গৈরিক বস্ত্র পরে বেড়াতেন, সন্ন্যাসীদের সঙ্গে মেলামেশা করতেন। সুতরাং দেখা যাচ্ছে, নিষ্ঠাবান ব্রাহ্মণ মতিলালের বংশে সন্ন্যাসের বীজ গুপ্ত হয়ে ছিল, তার পুত্রদের সংসারের বাঁধন সহ্য হত না। এ-সবের উপরে হয়তো মতিলালের কতকটা প্রভাব ছিল।

শরৎচন্দ্রের দুই বোন—শ্ৰীমতী অনিলা দেবী ও শ্ৰীমতী মণিয়া দেবী। বড়ো বোন অনিলা দেবীর নাম নিয়েই শরৎচন্দ্র যমুনা’ পত্রিকায় নারীর মূল্য’ নামে বিখ্যাত রচনা প্রকাশ করেছিলেন। শরৎচন্দ্র এই বোনটির কাছে থাকতে ভালোবাসতেন। তাই আনিলা দেবীর শ্বশুরবাড়িরই অনতিদূরে পাণিত্রাসে এসে নিজের সাধের পল্লি-ভবন স্থাপন করেছিলেন। ছোটো বোন মণিয়া দেবীর শ্বশুরালয় হচ্ছে আসানসোলে।

শরৎচন্দ্রের মাতামহের নাম স্বর্গীয় কেদারনাথ গঙ্গোপাধ্যায়। তিনি হালিশহরের বাসিন্দা ছিলেন। তার দুই পুত্র, বিপ্রদাস ও ঠাকুরদাস। তারা ভাগলপুরে প্রবাসী হয়েছিলেন। ঠাকুরদাস স্বর্গে। শরৎচন্দ্রের একমাত্র নিজের মামা বিপ্রদাস এখন পাটনায় থাকেন।

হালিশহর ও কাঁচড়াপাড়া একই জায়গার দুটি নাম। নৈহাটিও এর পাশেই। একসময় এ অঞ্চল সাহিত্যচর্চার জন্যে প্রসিদ্ধ হয়ে উঠেছিল। রামপ্রসাদ, ঈশ্বর গুপ্ত, বঙ্কিমচন্দ্র, সঞ্জীবচন্দ্র ও হরপ্রসাদ শাস্ত্রী প্রভৃতি বহু বিখ্যাত সাহিত্য সেবকেরই জন্মভূমি হচ্ছে এই অঞ্চলে। শরৎচন্দ্রের মাতামহ-পরিবারেও যে সাহিত্যচর্চার বীজ ছিল, তার প্রমাণ পাওয়া যায়। সুতরাং ওদিক থেকেও তার কিছু কিছু সাহিত্যানুরাগের প্রেরণা আসা অসম্ভব নয়। প্রেরণ যে-কোনও দিক থেকে কখন কেমন করে আসে তা বলা বড়ো শক্ত। সকলের অগোচরে স্ফুলিঙ্গের মতো সে মানুষের মনে ঢোকে। তারপর যখন অগ্নিতে পরিণত হয়, সকলের চোখ পড়ে তার উপরে। তবে শরৎচন্দ্রের নিজের বিশ্বাস, তিনি পিতারই সাহিত্যানুরাগের উত্তরাধিকারী হয়েছিলেন।

ঠাকুমা নাকি শরৎচন্দ্রকে অত্যন্ত আদর দিতেন, নাতির হরেকরকম দুষ্টুমি দেখেও তাঁর হাসিখুশি একটুও ম্লান হত না। এবং শোনা যায় বালক শরৎচন্দ্রের দুষ্টামির কিছু কিছু পরিচয় লিপিবদ্ধ আছে ‘দেবদাস’-এর প্রথমাংশে। নিজের বাল্যজীবনের প্রথমাংশের কথা শরৎচন্দ্র এইভাবে বলেছেন

‘ছেলেবেলার কথা মনে আছে। পাড়াগাঁয়ে মাছ ধরে, ডোঙা ঠেলে, নৌকা বয়ে দিন কাটে, বৈচিত্র্যের লোভে মাঝে মাঝে যাত্রার দলে সাগরেদি করি, তার আনন্দ ও আরাম যখন পরিপূর্ণ হয়ে ওঠে তখন গামছা কাধে নিরুদ্দেশ যাত্রায় বার হই, ঠিক বিশ্বকবির কাব্যের নিরুদ্দেশ যাত্রা নয়, একটু আলাদা। সেটা শেষ হলে আবার একদিন ক্ষতবিক্ষত পায়ে নিজীব দেহে ঘরে ফিরে আসি। আদর-অভ্যর্থনার পালা শেষ হলে অভিভাবকেরা পুনরায় বিদ্যালয়ে চালান করে দেন, সেখানে আর একদফা সংবর্ধনা লাভের পর আবার বোধোদয়’ ‘পদ্যপাঠে’ মনোনিবেশ করি। আবার একদিন প্রতিজ্ঞা ভুলি, আবার দুষ্ট সরস্বতী কাধে চাপে। আবার সাগরেদি শুরু করি, আবার নিরুদ্দেশ যাত্রা, আবার ফিরে আসা, আবার আদর-আপ্যায়ন সংবর্ধনার ঘটা। এমনি বোধোদয়’, ‘পদ্যপাঠেও বাল্যজীবনের এক অধ্যায়.সাঙ্গ হল।’

এইটুকুর ভিতর থেকেই বালক শরৎচন্দ্রের অনেকখানি পরিচয় পাওয়া যাচ্ছে! তিনি সুবোধ বা শান্ত বালক ছিলেন না। লেখাপড়ায় তার মন বসত না। যখন পাঠশালায় যাবার কথা, শরৎচন্দ্র তখন পাড়ার আরও কতকগুলি তারই মতন শিষ্ট ছেলের সঙ্গে দুপুরের রোদে হাটে-বাটে-মাঠে টো-টো করে ঘুরে বেড়াতেন, কখনও ঘাটে বাঁধা নৌকো নিয়ে নদীর জলে ভেসে যেতেন, কখনও খালে-বিলে ছিপ ফেলে মাছ ধরতেন, কখনও যাত্রার দলে গিয়ে গলা সাধতেন, আবার কখনও বা নিরুদ্দেশ হয়ে কোথায় বেরিয়ে পড়তেন এবং গুরুজনরা দিনের পর দিন তার কোনও খোজ না পেয়ে ভেবে সারা হতেন। তারপর হঠাৎ একদিন দেখা যেত, ক্ষতবিক্ষত পায়ে, ধুলো-কাদা-মাখা গায়ে, উস্কযুদ্ধ চুলে দীনবেশে অপরাধীর মতো ঘরের ছেলে ঘরে ফিরে এসেছে। গুরুজনরা আদর-আপ্যায়নের পালা’ শুরু করলেন—অর্থাৎ ধমক, গালাগলি, উপদেশ, ঘুষি চড় কানমলা—হয়তো বেত্ৰাঘাতও তারপর বিদ্যালয়ে গিয়ে অনুপস্থিতির জন্যে গুরুমশাইয়ের কাছ থেকে আর একদফা আদর-আপ্যায়ন লাভ। অভ্যর্থনার গুরুত্ব দেখে শরৎচন্দ্র ভয়ে ভয়ে আবার কিছুদিনের জন্যে লক্ষ্মছেলের মতন ‘বোধোদয়’ খুলে বসতেন! কিন্তু মাথায় যার ‘অ্যাডভেঞ্চার’-এর ঘূর্ণি ঘুরছে ডানপিটের উদাম স্বাধীনতা একবার যে উপভোগ করেছে, এত সহজে সে-ছেলের বোধোদয় হবার নয়—ঝড়কে কেউ বাক্সবন্দি করে রাখতে পারে না! গায়ের ব্যথা মরার সঙ্গে সঙ্গে শরৎচন্দ্রের মন আবার উড়ু উড়ু করে, তখন কোথায় পড়ে থাকে ‘পদপাঠ’-এর শুকনো কালো অক্ষরগুলো, আর কোথায় অদৃশ্য হয়ে যায় গুরুজনের রক্তচক্ষুর বিভীষিকা! ইস্কুলের ঘন্টা বাজলে পর দেখা যায়, শরৎচন্দ্র তার জায়গায় হাজির নেই। শরৎচন্দ্রের প্রথম বাল্যজীবনের এই স্মৃতি থেকেই হয়তো তাঁর অতুলনীয় কথাসাহিত্যের কোনও কোনও অংশের উৎপত্তি! একটি বালিকাও নাকি দেবানন্দপুরে শরৎচন্দ্রের শৈশব লীলাসঙ্গিনী ছিল এবং তার কাহিনি তিনি পরে কোনও কোনও বন্ধুর কাছে কিছু কিছু বলেছিলেন। কিন্তু এই বালিকাটির নাম কেউ তার মুখে শোনেনি। সমবয়সী মেয়েদের সঙ্গে পুতুলের সংসার নিয়ে এই অনামা মেয়েটির খেলা করতে ভালো লাগত না, সেও গুরুজনদের শাসন না মেনে যাত্রা করত দুর্দান্ত ছেলে শরৎচন্দ্রের সঙ্গে বেপরোয়া খেলার জগতে,—যেখানে প্রচণ্ড রৌদ্রে বিপুল প্রান্তর দগ্ধ হয়ে যায়, যেখানে নিবিড় অরণ্যের ভয়ভরা অন্ধকারে দিনের আলো মূর্ছিত হয়ে পড়ে, যেখানে বর্ষার ধারারয় স্ফীত নদীর প্রবাহে শরৎচন্দ্রের নৌকা ঝোড়ো-হাওয়ার পাগলামির আবর্তে পড়ে দুলে দুলে ওঠে! মেয়েটির মন ছিল মেঘ-রৌদ্রে বিচিত্র—মুখ-চখ ঘুরিয়ে ঝগড়া করতেও জানত, আবার হেসে গায়ে পড়ে ভাব করতেও পারত। শরৎচন্দ্রের কথাসাহিত্যেও কোনও কোনও নারী-চরিত্রের মধ্যে নাকি এই মেয়েটির ছবি আঁকা আছে, কিন্তু কোন কোন চরিত্রে তা কেউ জানে না।

এমনি বারকয়েক পলায়ন ও প্রত্যাগমনের পর মতিলাল ছেলেকে নিয়ে গ্রাম ছাড়লেন। ভাগলপুরে ছিল শরৎচন্দ্রের দূরসম্পৰ্কীয় মাতুলালয়। এর পরে সেইখানেই শরৎচন্দ্রের আবির্ভাব। তার সঙ্গে আমরাও দেবানন্দপুরের কাছ থেকে বিদায়গ্রহণ করছি। দেবানন্দপুরের জল-মাটি শরৎচন্দ্রের দেহকে যেভাবে গঠিত ও পরিপুষ্ট করে তুলেছিল, তার ভিতর থেকেই ভবিষ্যতে আত্মপ্রকাশ করেন বঙ্গসাহিত্যের শরৎচন্দ্র। শিশু-শরৎচন্দ্রের কথা আরও ভালো করে জানা থাকলে তার সাহিত্যজীবনের ভিত্তির কথাও আরও ভালো করে বলতে পারা যেত। কিন্তু শিশু-শরৎচন্দ্রকে সজ্ঞানে দেখেছে এমন কোনও লোকও আজ বর্তমান নেই এবং গরিব বামুনের এক দুরন্ত ছেলের ভাবপ্রবণতার ভিতর থেকে উল্লেখযোগ্য কিছু আবিষ্কার করবার আগ্রহও কারুর তখন হয়নি। দেবানন্দপুরে শরৎচন্দ্রের বাল্যজীবনের সম্পূর্ণইতিহাস সংগ্রহ করা অত্যন্ত কঠিন।

দেবানন্দপুর থেকে বিদায় নিচ্ছি বটে, কিন্তু কিছুকাল পরে শরৎচন্দ্রকে আবার কিছুদিনের জন্যে দেবানন্দপুরে ফিরতে হয়েছিল। তখন ভাগলপুর থেকে তিনি বালকের পক্ষে অপাঠ্য পুস্তক পাঠের ঝোক নিয়ে এসেছেন। এ সম্বন্ধে তিনি বলছেন

‘কিন্তু এবারে আর ‘বোধোদয়’ নয়, বাবার ভাঙা দেরাজ খুলে বার করলাম ‘হরিদাসের গুপ্তকথা’। আর বেরোল ‘ভবানী পাঠক’। গুরুজনদিগের দোষ দিতে পারিনে, স্কুলের পাঠ্য তো নয়, ওগুলো বদছেলের অপাঠ্য পুস্তক। তাই পড়বার ঠাই করে নিতে হল আমাকে বাড়ির গোয়ালঘরে। সেখানে আমি পড়ি, তারা শোনে। এখন আর পড়িনে, লিখি। সেগুলো কারা পড়ে, জানিনে। একই স্কুলে বেশি দিন পড়লে বিদ্যা হয় না, মাস্টারমশাই একদিন স্নেহবশে এই ইঙ্গিতটুকু দিলেন। অতএব আবার ফিরতে হল শহরে। বলা ভালো, এর পরে আর স্কুল বদলাবার প্রয়োজন হয়নি।’

এইখানে প্রকাশ পাচ্ছে, দ্বিতীয়বার দেবানন্দপুরে এসে শরৎচন্দ্রের দৃষ্টি ফিরেছে সাহিত্যের দিকে। তখন দেশে শিশুপাঠ্য সাহিত্য ছিল না। তাই শরৎচন্দ্রের মতো আরও বহু বিখ্যাত সাহিত্যিককেই প্রথম মনের খোরাক যুগিয়েছে ওই ‘হরিদাসের গুপ্তকথা’ বা ওই-শ্রেণীরই পুস্তকাবলী। আরও দেখা যাচ্ছে, তখন কলম না ধরলেও নিষিদ্ধ পুস্তকের পাঠক বা কথক শরৎচন্দ্র গোয়ালঘরে কতকগুলি শ্রোতা জুটিয়েছেন। তারা কারা? হয়তো যারা স্কুলে বন্দি হওয়ার চেয়ে শরৎচন্দ্রের টো-টো কোম্পানিতেই ঢুকে হাটে-মাঠে পথে-অপথে বেড়াবার জন্যে অধিকতর আগ্রহ প্রকাশ করত। সে-দলের কারুর পাকা মাথার সন্ধান যদি আজ পাওয়া যায়, তাহলে শরৎচন্দ্রের দুর্লভ বাল্যজীবনের বহু উপকরণই সংগৃহীত হতে পারে। আশা করি, শরৎচন্দ্রের বৃহত্তর জীবনীর লেখক এ-চেষ্টা করতে ভুলবেন না।

দেবানন্দপুরে শরৎচন্দ্রের পৈতৃক বাস্তুভিটা এখন অন্য লোকের হস্তগত। সে ভিটার সঙ্গে তাঁর শৈশব-স্মৃতির অনেক মধুর সুখ-দুঃখ জড়িত আছে বলে পরিণত বয়সে শরৎচন্দ্র বাড়িখানি আবার কেনবার চেষ্টা করেছিলেন; কিন্তু চেষ্টা সফল হয়নি।

সকল অধ্যায়

নোট নিতে এবং টেক্সট হাইলাইট করতে লগইন করুন

লগইন