হেমেন্দ্রকুমার রায়
গাছ হঠাৎ জন্মায় না। জন্মের পরেও গাছের বাড় ও স্বাস্থ্য নির্ভর করে সারালো জমির উপরে।
শরৎচন্দ্রও হঠাৎ বড়ো সাহিত্যিকরূপে জন্মগ্রহণ করেননি। সাহিত্যিক শরৎচন্দ্রের আবির্ভাবের জন্যে আগেকার সাহিত্যিকরা জমি তৈরি ও বীজ বপন করে গেছেন। আগে তারই একটু পরিচয় দি।
পৃথিবীর সব দেশেই একশ্রেণীর সাহিত্য দেখা দিয়েছে যাকে বলে রোমান্টিক সাহিত্য। বিলাতের স্যার ওয়াল্টার স্কটের, ফরাসি দেশের ভিক্টর হুগোও আলেকজান্দার ডুমাসের এবং বাংলাদেশের বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়ের অধিকাংশ উপন্যাস ওই ‘রোমান্টিক’ সাহিত্যের অন্তর্গত। ওঁদের উপন্যাসে অসাধারণ ঘটনার উপরেই বেশি জোর দেওয়া হয়েছে। এঁরা যেসব চরিত্রের ছবি এঁকেছেন, সাধারণত সেগুলি অতিরিক্ত রংচঙে। ওঁরা যে অস্বাভাবিক চরিত্র সৃষ্টি করেছেন, তা নয়; কিন্তু ওঁরা প্রায়ই রঙিন কাচের ভিতর দিয়ে চরিত্রগুলিকে দেখেছেন। তাই চরিত্রগুলির উপরে যে-রং পড়েছে তা তাদের স্বাভাবিক রং নয়।
পৃথিবীতে এখন যে-শ্রেণীর সাহিত্যের বেশি চলন তাকে বলে বাস্তব-সাহিত্য। বাংলাদেশে বিশেষভাবে এই সাহিত্য সৃষ্টি করেছেন সর্বপ্রথমে রবীন্দ্রনাথ। যদিও বঙ্কিম-যুগে—অর্থাৎ বাংলাদেশে বঙ্কিমচন্দ্রের পূর্ণ-প্রভাবের সময়ে রাজর্ষি ও বউঠাকুরানির হাট রচনাকালে তিনিও রোমান্টিক সাহিত্যকে অবলম্বন করেছিলেন।
বাস্তব-সাহিত্যের লেখকেরা মানুষকে যেমন দেখেন তেমনি আঁকেন। তাঁরা পক্ষপাতী নন এবং অসাধারণ ঘোরালো ঘটনারও উপরে বেশি ঝোক দেন না। রোজ আমরা যে-সংসারকে দেখি, তারই ছোটোখাটো সুখ-দুঃখ হাসি-কান্না নিয়ে সোজা ভাষায় সহজভাবে তাঁরা বড়ো বড়ো উপন্যাস লিখতে পারেন।
কিন্তু রবীন্দ্রনাথেরও আগে, বঙ্কিমচন্দ্রের রোমান্টিক সাহিত্যের পূর্ণ-প্রতিপত্তির দিনেই, আর একজন বাঙালি লেখক বাস্তব-সাহিত্য রচনা করে নাম কিনেছিলেন। তার নাম স্বর্গীয় তারকনাথ গঙ্গোপাধ্যায়। তার স্বর্ণলতা হচ্ছে বাংলা সাহিত্যের একখানি বিখ্যাত উপন্যাস। ঘরোয়া সুখ-দুঃখের হুবহু ছবি আঁকার দরুন তারকনাথের যশ শরৎচন্দ্রের মতোই হঠাৎ চারিদিকে ছড়িয়ে পড়ে এবং স্বর্ণলতা’র সংস্করণের পর সংস্করণ হতে থাকে। বঙ্কিম-যুগে আর কোনও লেখকের বই এত কাটেনি।
‘স্বর্ণলতা’র কাটতি দেখে বহু লেখক তারকনাথের নকল করতে লাগলেন। কিন্তু তাদের অনুকরণ স্বর্ণলতার মতন সফল হয়নি, কারণ নকলকে কেউ আসলের দাম দেয় না।
তারকনাথ আরও কিছু লিখে গেছেন। কিন্তু তার ক্ষেত্র বিস্তৃত ও শক্তি বড়ো ছিল না। বঙ্কিম-যুগে তার প্রতিভা স্ফুলিঙ্গের মতোই আমাদের চক্ষে পড়ে।
সেইজনেই আমরা বলেছি, বাংলাদেশে বিশেষভাবে বাস্তব-সাহিত্য এনেছেন রবীন্দ্রনাথই। ভিন্ন ভিন্ন উপন্যাসে তার বিষয়বস্তু ও চরিত্রগুলি ভিন্ন ভিন্ন রূপ ধারণ করেছে। বাস্তব সাহিত্যের ক্ষেত্রেও দৃষ্টিশক্তি তিনি বিস্তৃত করে তুলেছেন। কেবল নিত্য-দেখা সংসারকেই তিনি তুলে এনে আবার সাহিত্যের ভিতরে দেখাননি, তার সাহায্যে নব নব ভাব ও আদর্শকে খুঁজেছেন। তারকনাথ এসব পারেননি।
শরৎচন্দ্র যখন আত্মপ্রকাশ করেন, তখন রবীন্দ্রনাথকে বাদ দিলে বাংলাদেশে সত্যিকার বড়ো আর কোনও ঔপন্যাসিককেই দেখা যেত না। রবীন্দ্রনাথও কেবল উপন্যাস নিয়ে কোনওদিনই নিযুক্ত থাকেননি। কারণ তিনি কেবল ঔপন্যাসিক নন, একাধারে তিনি মহাকবি, নাট্যকার, গীতিকার, ছোটোগল্প লেখক, সন্দর্ভকার ও সমালোচক এবং প্রত্যেক বিভাগেই নব নব রসের স্রষ্টা। হিসাব করলে দেখা যাবে, তার নানাশ্রেণীর রচনার মধ্যে উপন্যাস খুব বেশি জায়গা জুড়ে নেই।
কাজেই বাস্তব-সাহিত্যের ভিতর দিয়ে বাংলার ঘরোয়া আলোছায়ার ছবি আঁকতে পারেন এবং কথাসাহিত্যের সাধনাই হবে যার জীবনের প্রধান সাধনা, দেশের তখন এমন একজন লোকের দরকার হয়েছিল। দেশের সেই প্রয়োজন মিটিয়েছেন শরৎচন্দ্র। তিনি একান্তভাবেই ঔপন্যাসিক।
শরৎচন্দ্রের উপরে রবীন্দ্রনাথের বাস্তব-সাহিত্যের প্রভাব পড়েছিল কতটা ভারতী’তে তাঁর প্রথম উপন্যাস প্রকাশের সময়েই সেটা জানা গিয়েছিল। গোড়ার দিকে বড়দিদি বেরুবার সময়ে লেখকের নাম প্রকাশ করা হয়নি। কিন্তু পাঠকেরা লেখা পড়ে ধরে নেন যে, রবীন্দ্রনাথই নাম লুকিয়ে ওই উপন্যাস লিখছেন। কেউ কেউ নাকি রবীন্দ্রনাথের কাছে গিয়েও জিজ্ঞাসা করেছিলেন।
শরৎচন্দ্রের কোনও কোনও গল্প ও উপন্যাসের বিষববস্তু দেখলে তারকনাথ গঙ্গোপাধ্যায়কে মনে পড়বেই। কিন্তু বলেছি, রবীন্দ্রনাথ বাস্তব-সাহিত্যের ক্ষেত্রসীমা ও দৃষ্টিশক্তি বিস্তৃততর করে তুলেছিলেন, তাই পরবর্তী যুগের লেখক শরৎচন্দ্রও তারকনাথকে ছাড়িয়ে এগিয়ে যেতে পেরেছিলেন ঢের বেশিদূর।
এখানে আর একটা কথাও বলে রাখা দরকার। শরৎ-সাহিত্যের খানিক অংশ রবীন্দ্রনাথ প্রভাবগ্রস্ত বটে, কোনও কোনও স্থলে তার বিষয়বস্তু তারকনাথকেও স্মরণ করিয়ে দেয়, কিন্তু তার অনেকটা অংশই একেবারে আনকোরা। সেখানে শরৎচন্দ্র নিজস্ব মহিমায় বিরাজ করছেন এবং সেটা হচ্ছে তার প্রতিভার সম্পূর্ণ নূতন দান। এই নূতনত্বের জন্যেই শরৎচন্দ্রের নাম অমর হয়ে রইল।
এইবারে আর একটি বিষয় নিয়ে কিছু বলব। স্টাইল বা রচনাভঙ্গির কথা। যে লেখকের নিজের রচনাভঙ্গি আছে, লেখার তলায় তার নাম না থাকলেও লোকে কেবল লেখা দেখেই তাকে চিনে নিতে পারে।
আজ পর্যন্ত এমন বড়ো বা ভালোলেখক জন্মাননি, যার নিজস্ব রচনাভঙ্গি নেই। ফরাসিদেশে ফ্লবেয়ার নামে একজন লেখক ছিলেন, তিনি অমর হয়ে আছেন প্রধানত তাঁর রচনাভঙ্গির গুণেই। এক-একজন বড়ো লেখকের রচনাভঙ্গি আবার এতটা বিশিষ্ট ও শক্তিশালী যে, তা সাহিত্যের এক-একটা বিশেষ যুগকে প্রকাশ করে। কারণ সেই যুগের অন্যান্য লেখকদেরও উপরে তাদের রচনাভঙ্গির প্রভাব দেখা যায় অল্পবিস্তর।
বাংলাদেশে দুইজন প্রধান লেখকের রচনাভঙ্গি সাহিত্যের দুইটি বিশেষ যুগকে চিনিয়ে দেয়। তারা হচ্ছেন বঙ্কিমচন্দ্র ও রবীন্দ্রনাথ। সাহিত্যের আলোচনায় প্রায়ই বঙ্কিম-যুগও ‘রবীন্দ্ৰ-যুগের’ কথা শোনা যায়, বঙ্কিম ও রবীন্দ্রের বিশিষ্ট রচনাভঙ্গির প্রাধানের জন্যেই ওই দুই যুগের নামকরণ হয়েছে। বঙ্কিম-যুগের অধিকাংশ লেখকের রচনাভঙ্গির উপরেই বঙ্কিমচন্দ্রের কম-বেশি ছাপ পাওয়া যায়। রবীন্দ্ৰ-যুগ সম্বন্ধেও ওই কথা। এখনকার কোনও লেখকই জ্ঞাত বা অজ্ঞাতসারে রবীন্দ্রনাথের রচনাভঙ্গির প্রভারের ভিতরে না গিয়ে পারেন না। কেউ কেউ পুরোদস্তুর নকলিয়া। সাহিত্যে তাঁদের ঠাঁই নেই।
কোনও লেখকই গোড়া থেকে সম্পূর্ণ নিজস্ব রচনাভঙ্গির অধিকারী হতে পারেন না, কারণ বহু সাধনার ফলে ধীরে ধীরে নিজস্ব রচনাভঙ্গি গড়ে ওঠে। এমনকী রবীন্দ্রনাথেরও প্রথম বয়সের কবিতায় কবি বিহারীলাল চক্রবর্তীর রচনাভঙ্গি আবিষ্কার করা যায়। কিন্তু অদ্বিতীয় প্রতিভার অধিকারী বলে রবীন্দ্রনাথ খুব শীঘ্রই বিহারীলালের প্রভাব থেকে মুক্ত হয়েছিলেন। বিহারীলালের সব শিষ্য এটা পারেননি। কবি অক্ষয়কুমার বড়ালের লেখায় শেষ পর্যন্ত বিহারীলালের রচনাভঙ্গি বিদ্যমান ছিল।
শরৎচন্দ্রের রচনাভঙ্গি কী-রকম? তার রচনাভঙ্গি বঙ্কিমচন্দ্র কি রবীন্দ্রনাথের রচনাভঙ্গির মতন অতুলনীয় ছিল না; সমসাময়িক যুগের অধিকাংশ লেখকের রচনাকে বঙ্কিমচন্দ্র ও রবীন্দ্রনাথ যেমন আপন আপন রচনাভঙ্গির দ্বারা আচ্ছন্ন করে রেখেছিলেন, শরৎচন্দ্র সেভাবে বহু লেখককে আকৃষ্ট করে কোনও নুতন যুগসৃষ্টি করতে পারেননি। তবু তার লেখবার ধরনের মধ্যে এমন একটা কিছু ছিল যা সম্পূর্ণরূপে তারই নিজের জিনিস।
শরৎচন্দ্রকে দুই যুগপ্রবর্তক বিরাট প্রতিভার আওতায় কলম ধরতে হয়েছিল। প্রথমে বঙ্কিমচন্দ্র, তারপর রবীন্দ্রনাথ। শরৎচন্দ্রের প্রথম বয়সের রচনাভঙ্গির উপরে বঙ্কিমচন্দ্রের প্রভাব বেশ স্পষ্ট। পরে বঙ্কিমের প্রভাব কমে যায় এবং রবীন্দ্রনাথের প্রভাব বেড়ে ওঠে। কিন্তু কী বঙ্কিমচন্দ্র আর কী রবীন্দ্রনাথ, কেহই শরৎচন্দ্রকে বিশেষ বা সমগ্রভাবে অভিভূত করতে পারেননি। যারা রঙের কারখানায় কাজ করে তারা গায়ে মুখে জাম-কাপড়ে নানা রঙের প্রলেপ মেখে বেরিয়ে আসে বটে, কিন্তু তাই বলে কেউ তাদের চিনতে ভুল করে না— কারণ তাদের আসল চেহারা অবিকৃতই থাকে। বঙ্কিমচন্দ্র ও রবীন্দ্রনাথের সাহিত্যের কারখানায় গিয়ে শরৎচন্দ্র যে প্রথমে শিক্ষানবিসি করেছিলেন, তার রচনাভঙ্গির ভিতরে কেবল সেই চিহ্নই আছে—জগতে এমন কোনও লেখক নেই, পূর্ববর্তী ওস্তাদ-লেখকের কাছ থেকে যিনি শিক্ষা গ্রহণ করেননি; আসলে শরৎচন্দ্রের সংলাপ, চরিত্র-চিত্রণ ও বর্ণনা-পদ্ধতির ভিতরে তার নিজস্ব ব্যক্তিত্বের প্রভাবই বেশি। রবীন্দ্রনাথের রচনার মধ্যে শরৎচন্দ্রের যে কোনও রচনা না জানিয়ে রেখে দেওয়া হোক; যার তীক্ষ্ণদৃষ্টি আছে সে শরৎচন্দ্রের রচনাকে বেছে নিতে ভুল করবে না।
শরৎচন্দ্রের বড়দিদি ‘ভারতী’ পত্রিকায় বেরিয়েছিল লেখকের অজ্ঞাতসারেই। কিন্তু তিনি নিজে আত্মপ্রকাশ করেছিলেন তারও কয়েক বছর পরে, ১৩১৩ অব্দে।
সে সময়ে মাসিক-সাহিত্যের মধ্যে প্রধান ছিল‘ ভারতী’ ‘সাহিত্য’ ‘প্রবাসী’ ‘নব্যভারত’ ও ‘মানসী” কথাসাহিত্যে তখন রবীন্দ্রনাথের বাস্তব-উপন্যাসগুলির বিপুল প্রভাব। নাট্যসাহিত্যে তখন গিরিশচন্দ্র, অমৃতলাল, ক্ষীরোদপ্রসাদ ও দ্বিজেন্দ্রলালের লেখনী চলেছে; বিশেষ করে দ্বিজেন্দ্রলালের ঐতিহাসিক নাটকগুলি নিয়ে তখন যথেষ্ট আলোচনা হচ্ছে। কাব্যসাহিত্যে প্রধানদের মধ্যে রবীন্দ্রনাথ, দ্বিজেন্দ্রলাল, দেবেন্দ্রনাথ সেন, অক্ষয়কুমার বড়াল ও গোবিন্দচন্দ্র দাস এবং নবীনদের মধ্যে সত্যেন্দ্রনাথ দত্ত, যতীন্দ্রমোহন বাগচী ও করুণানিধান বন্দ্যোপাধ্যায়ের নাম করা যায়। নানা শ্রেণীর অন্যান্য লেখকদের মধ্যে লিপিকুশলতা, রচনাভঙ্গি ও চিন্তাশীলতার জন্যে তখন খ্যাতি অর্জন করেছেন দ্বিজেন্দ্রনাথ ঠাকুর, অবনীন্দ্রনাথ ঠাকুর, প্রমথ চৌধুরি বা বীরবল, অক্ষয়কুমার মৈত্রেয়, রামেন্দ্রসুন্দর ত্রিবেদী, সুরেন্দ্রনাথ মজুমদার, প্রভাতকুমার মুখোপাধ্যায়, সুধীন্দ্রনাথ ঠাকুর ও পাঁচকড়ি বন্দোপাধ্যায় প্রভৃতি। বাংলা সাহিত্যের অধিকাংশ লেখকের মতো শরৎচন্দ্রেরও আবির্ভাব মাসিক সাহিত্যক্ষেত্রে এবং ও-ক্ষেত্রে সম্পাদকরূপে তখন সুরেশচন্দ্র সমাজপতির নাম খুব বেশি। সুরেশচন্দ্র মিষ্ট ভাষা ও বিশিষ্ট রচনাভঙ্গির জন্যেও বিখ্যাত ছিলেন; কিন্তু দুঃখের বিষয়, স্থায়ী সাহিত্যের জন্যে তিনি বিশেষ কিছু রেখে যানননি।
খুব সংক্ষেপেই তখনকার সাহিত্যের অবস্থার ও তার সঙ্গে শরৎচন্দ্রের সম্পর্কের কথা নিয়ে আলোচনা করা হল। আমাদের স্থান অল্প, তাই এখানে বিস্তৃতভাবে কিছু বলা শোভনও হবে না। তবে আমাদের ইঙ্গিতগুলি মনে রাখলে শরৎচন্দ্রকে বোঝা হয়তো সহজ হবে।
নোট নিতে এবং টেক্সট হাইলাইট করতে লগইন করুন
লগইন