বাল্যজীবন ও প্রথম যৌবন (১৮৮৬-১৮৯৬)

হেমেন্দ্রকুমার রায়

‘এলাম শহরে। একমাত্র ‘বোধোদয়’-এর নজিরে গুরুজনেরা ভর্তি করে দিলেন ছাত্রবৃত্তি ক্লাসে। তার পাঠ্য—‘সীতার বনবাস’, ‘চারুপাঠ’, ‘সদ্ভাব-সদগুরু’ ও মস্ত মোটা ব্যাকরণ। এ শুধু পড়ে যাওয়া নয়, মাসিকে সাপ্তাহিকে সমালোচনা লেখা নয়, এ পণ্ডিতের কাছে মুখোমুখি দাঁড়িয়ে প্রতিদিন পরীক্ষা দেওয়া। সুতরাং অসঙ্কোচে বলা চলে যে, সাহিত্যের সঙ্গে আমার প্রথম পরিচয় ঘটল চোখের জলে। তারপরে বহু দুঃখে আর একদিন সে মিয়াদও কাটল। তখন ধারণাও ছিল না যে মানুষকে দুঃখ দেওয়া ছাড়া সাহিত্যের আর কোনও উদ্দেশ্য আছে।’

ভাগলপুরের বাংলা ইশকুলে ঢুকে শরৎচন্দ্রের মনের ভাব হয়েছিল কী রকম, তার উপর-উদ্ধৃত উক্তি থেকেই সেটা বোঝা যাবে। ছাত্রবৃত্তি কেলাসে ভর্তি হয়ে শরৎচন্দ্র আবিষ্কার করলেন তার সহপাঠীরা তার চেয়ে অনেক বেশি অগ্রসর। কিন্তু জীবনে বা সাহিত্যে কারুর পিছনে পড়ে থাকবেন, এটা বোধহয় তার ধাতে ছিল অসহনীয়। লেখাপড়ায় তখনই তার ঝোঁক হল। একাগ্র মনে বিদ্যাচর্চা করে অল্পদিনের ভিতরেই তিনি তার সহপাঠীদের নাগাল ধরে ফেললেন।

স্বগ্রাম ছেড়ে এত দূরে দূরসম্পর্কীয় মামার বাড়িতে থেকে বিদ্যাশিক্ষা করার একটা প্রধান কারণও বোধহয় শরৎচন্দ্রের দারিদ্র্য। এই দারিদ্র্যের ভিতর দিয়েই শরৎচন্দ্রের যৌবনের অনেকখানি নষ্ট হয়ে গিয়েছিল এবং পরে আমরা দেখব যে, শরৎচন্দ্রের ওই দারিদ্র্যের জন্যে বাংলা সাহিত্যও কতখানি ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে!

ছাত্রবৃত্তি কেলাসে শরৎচন্দ্র ও তার সাঙ্গোপাঙ্গদের দুষ্টবুদ্ধি সম্বন্ধে একটি মজার গল্প আছে। ইশকুলের যে ঘড়ি দেখে ছুটি দেওয়া হত, শরৎচন্দ্র ও তার সঙ্গীরা রোজ র্কাধার্কাধি করে দেওয়ালের উপরে উঠে সেই বড়ো ঘড়িটার কাটা এত এগিয়ে দিতেন যে, অনেক সময়ে প্রধান শিক্ষক সেই বেঠিক ঘড়িকে বিশ্বাস করে এক ঘণ্টা আগেই ইশকুল বন্ধ করতে বাধ্য হতেন। শেষে যেদিন ছেলেরা ধরা পড়ল, সেদিন কিন্তু দোষীদের দলে শরৎচন্দ্রকে আবিষ্কার করা যায়নি। তিনি অভিমনু-জাতীয় বালক ছিলেন না, বিপদের মুহূর্তে বৃহভেদ করে সরে পড়তে পারতেন যথা সময়ে!

শরৎচন্দ্র ভাগলপুরের যে বাংলা ইশকুলে ঢুকে ১৮৮৭ অব্দে ছাত্রবৃত্তি পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হয়েছিলেন, সেটি নাকি এখনও বিদ্যমান। এর পর তিনি ওখানকারই তেজনারায়ণ জুবিলি কলিজিয়েট ইশকুলে ভর্তি হন। ওখানে গিয়ে নাকি তার পড়াশুনায় মতি হয়েছিল, কারণ ‘আনন্দবাজার পত্রিকা’ খবর দিয়েছেন, তিনি অল্পদিনের মধ্যেই শিক্ষকগণের প্রিয় হইয়া উঠেন। মনোযোগী ছাত্র হিসাবে তাহার বেশ সুনাম ছিল। ভারতবর্ষ-এর সংক্ষিপ্ত জীবনীতে প্রকাশ

‘এনট্রান্‌স পাস করিয়া সেই ইশকুলেরই সংযুক্ত কলেজে এফ-এ পড়িতে থাকেন। কিন্তু পরীক্ষার পূর্বে মাত্র ২০ টাকা ফি দিতে না পারিয়া তিনি বিরক্ত হইয়া কলেজ পরিত্যাগ করেন এবং প্রতিজ্ঞা করেন চৌদ্দ বৎসর ধরিয়া তিনি প্রতিদিন চৌদ্দ ঘণ্টা করিয়া বিদ্যাশিক্ষা করিবেন। সেই প্রতিজ্ঞ তিনি পালন করিয়াছিলেন।’

কুড়ি টাকার অভাবে তাঁর লেখাপড়া ছেড়ে দেওয়ার কথা আরও অনেকেই লিখেছেন। কিন্তু এ-কথার প্রতিবাদও বেরিয়েছে। তিনি নাকি চাকরি করে পিতার অর্থকষ্ট দূর করবার জন্যেই কলেজ ছেড়ে দিয়েছিলেন। শরৎচন্দ্র প্রবেশিকা পরীক্ষা দেন ১৮৯৪ অব্দে, সতেরো বৎসর বয়সে। কলেজ ছাড়বার কিছু পরেই (১৮৯৬) তিনি মাতৃহীন হন।

ইশকুলের কেলাসে শরৎচন্দ্রের পাঠ্যপুস্তকভীতি হয়তো দূর হয়ে গিয়েছিল, হয়তো তিনি ‘গুড বয়’ খেতাবও পেয়েছিলেন। কিন্তু ইশকুলের বাইরে খেলাধূলার উৎসাহ তার কিছুমাত্র কমেনি এবং এ-বিভাগে তার দক্ষতাও ছিল নাকি যথেষ্ট। দল গড়ে নিজে দলপতি হবার শক্তিও যে তার হয়েছিল, সে পরিচয়ও আছে। তার মাতুল-সম্পৰ্কীয় বন্ধু ও সাহিত্যিক শ্ৰীযুক্ত সুরেন্দ্রনাথ গঙ্গোপাধ্যায় বলছেন

‘শৈশবে আমরা শরৎকে আমাদের খেলার দলের দলপতিরূপে পাইয়াছিলাম। ডাকাতের দলের সর্দারের দোষগুণ বিবৃতিতে সিক্ত হৃদয় যেমন যুগপৎ আনন্দে বিষাদে মথিত হইয়া ওঠে,—আজও আমাদের দলপতির কথা স্মরণ করিলে অন্তরের মধ্যে তেমনি হয়, ব্যথার সুর বাজিতে থাকে। একদিকে ইস্পাতের মতন কঠিন—অন্যদিকে নবনীকোমল। অন্যায়কে পদদলিত করিবার দুর্ধর্ষ সংকল্প, আবার দুর্বলের পরম কারুণিক আশ্রয়দাতা। বালক্কশরৎ রুদ্রতায় বজ্রের মতোই কঠোর ছিল। সময় সময় মনে হইত সে হৃদয়হীন। যাহারা সেই দিকের পরিচয় পাইল তাহারা তাহার শক্রই রহিয়া গেল; কিন্তু অশেষ স্নেহভাজনের দলের তো অভাব নাই।’

পরের জীবনেও তার এই স্বাতন্ত্র্য লক্ষ করা যায়। কোনওদিনই তিনি কোনও দলে মিশে দ্বিতীয় বা তৃতীয় স্থানে অবস্থান করাটা পছন্দ করতেন না। এমনকী যে দলে তার সমবয়সীর সংখ্যাইবেশি, সেখানেও যৌবন উত্তীর্ণ হবার আগেইশরৎচন্দ্র নিজেকে বুড়ো বলে মুরুঝিয়ানা করতে ভালোবাসতেন এবং দলপতি হবার কোনও কোনও গুণও তাঁর ছিল।

ভাগলপুরে গিয়েও অন্যান্য খেলাধূলার সঙ্গে থিয়েটারের আকর্ষণও তিনি এড়াতে পারেননি। কেউ কেউ লিখেছেন, তিনি নিজেও নাকি ভালো থিয়েটারি অভিনয় করতে পারতেন। বঙ্কিমচন্দ্রের মৃণালিনীতে তিনি নাকি একটি নারী-ভূমিকায় গানে ও অভিনয়ে সুনাম কিনেছিলেন থিয়েটারে শখের অভিনয় করবার জন্যে হয়তো শরৎচন্দ্রের আগ্রহের অভাব ছির না, হয়তো কোনও কোনও দলে গিয়ে ছোটখাটো ভূমিকায় তিনি মহলাও দিয়েছেন, কিন্তু প্রকাশ্যভাবে রঙ্গমঞ্চে নেমে অভিনয় করে তিনি অতুলনীয় নাম কেনননি নিশ্চয়ই। কারণ ও-বিভাগে তার চেয়ে শ্রেষ্ঠ ছিলেন রাজু। তার কথা পরে বলব।

তার নিজের মুখে আমরা এই গল্পটি শুনেছি ‘শখের থিয়েটারে স্টেজে উঠে যেদিন প্রথম কথা কইবার সুযোগ পেলুম, সেদিন সুযোগের সদ্ব্যবহার করতে পারিনি। আমার পার্টে কথা ছিল মোটে এক লাইন! আর-একটি ছেলের সঙ্গে আমি স্টেজে নামলুম। আগে তারই পার্ট বলবার কথা। কিন্তু সে তো নিজের পার্ট বললেই, তার উপরে আমি মুখ খোলবার আগেই আমার জন্যে নির্দিষ্ট এক লাইন কথাও অম্লানবদনে বলে গেল। আমি হাঁ করে দাঁড়িয়ে রইলাম।’

দুঃসাহসীডিানপিটে ছেলের যেসব খেলা, ভাগলপুরে গিয়ে বিদ্যাচর্চার অবকাশে সর্দার শরৎচন্দ্র তাঁর দুরন্ত ছেলের দলটি নিয়ে সেই সব খেলাতেও যে মেতে উঠতেন, তাতে আর সন্দেহ নেই। এই খেলার জগতে তিনি এক নূতন সঙ্গী ও বড়ো বন্ধুও লাভ করলেন। ছেলেটির নাম রাজু বা রাজেন্দ্র এবং সর্দারিতে তার আসন বোধ হয় শরৎচন্দ্রেরও উপরে ছিল। শরৎ ও রাজুর নায়কতায় যে দুষ্ট ছেলের দলটি ভাগলপুরের আকাশ বাতাস ও গঙ্গাতটকে মুখর করে তুলত, তখনকার বয়োবৃদ্ধদের পক্ষে তারা যে যথেষ্ট দুর্ভাবনার কারণ হয়ে উঠেছিল, এটুকু বুঝতে বেশি কল্পনাশক্তির দরকার হয় না। এই রাজু হচ্ছে একটি অত্যন্ত চিত্তাকর্ষক চরিত্র। গুণ্ডামি, ফুটবল-খেলা, ঘুড়ি-উড়ানো, সাঁতার,জিমনাস্টিক, হাতের লেখা, ছবি-আঁকা, পড়াশুনো, বশি হারমেনিয়াম বাজানো, গান-গাওয়া ও অভিনয় প্রভৃতি প্রত্যেকটি বিষয়ে রাজু ছিল অদ্বিতীয় প্রতিভার অধিকারী। বাল্যবয়সেই তার সাহস ও তেজের অসাধারণতা ছিল বিস্ময়কর। ভাগলপুরের এক সাহেবের শখের আমোদ ছিল, কালা-আদমির পৃষ্ঠদেশে চাবুক চালনা ইশকুলের জনৈক মাস্টার বারংবার তার বিলাতি চাবুকের আদরে কাতর হয়ে শেযটা রাজুর আশ্রয় গ্রহণ করলেন। রাজু তখনই তার দলবল নিয়ে ছুটে গিয়ে সাহেবের টমটম-সুদ্ধ ঘোড়াকে দড়ির ফাঁদে বন্দি করে সেই শ্বেতাঙ্গ অবতারকে এমন শিক্ষা দিয়ে এল যে, তারপর থেকে শখের চাবুক-চালনা একেবারে বন্ধ হয়ে গেল। পরিণত বয়সে শরৎচন্দ্র নাকি তার ‘শ্ৰীকান্ত’-এর ইন্দ্রনাথ চরিত্রে বাল্যবন্ধু রাজুকে অমর করে রাখবার চেষ্টা করেছেন। এ কথা সত্য হলে মানতে হয়, রাজুর ভিতরে অসাধারণ ব্যক্তিত্বের অভাব ছিল না। এবং সে রাজু আজ কোথায়? ইহলোকে, না পরলোকে? তবে এইটুকু মাত্র জানা গিয়েছে যে, রাজুর মনে তরুণ বয়সেই বৈরাগ্যের উদয় হয়েছিল। গঙ্গার তীরে নির্জন শ্মশানে গিয়ে সে ধ্যানস্থ হত, উপবাস করত, শিশু ছাড়া আর কারুর সঙ্গে কথাবার্তা কইত না এবং স্বচক্ষে ঈশ্বরের জ্যোতি দেখে খাতায় তা একে রাখত। তারপর একদিন সে ভাগলপুর থেকে অদৃশ্য হল এবং আজও তার সন্ধান কেউ জানে না। হয়তো রাজু আজ সন্ন্যাসী।

এই সময়েই বোধহয় শরৎচন্দ্র নিজের অজ্ঞাতসারেই ললিতকলার নানা বিভাগের দিকে আকৃষ্ট হয়েছিলেন। জড় লোহা নিশ্চয়ই জানে না, চুম্বক তাকে আকর্ষণ করে। ভবিষ্যতে যে শিল্পী হবে, তরুণ বয়সে সেও নিশ্চয় শিল্পী বলে নিজেকে চিনতে পারে না। তবু তার মনের গড়ন হয় এমনধারা যে, আর্ট তার মনকে টানবেই। এমনকী আর্টের যেসব বিভাগ পরে তার নিজের বিভাগ হবে না, সেসব ক্ষেত্রেও সে প্রাণের সাড়া পায়; কারণ সব আর্টেরই মূলরস হচ্ছে এক।

যাত্রা-থিয়েটারের দিকে শরৎচন্দ্রের ঝোঁক ছিল, কারণ ওটা হচ্ছে আর্টেরই আসর। তিনি নিজে বিখ্যাত অভিনেতা না হলেও পরে বাংলাদেশের নাট্যকলা তারই কথাসাহিত্যকে বিশেষ ভাবে অবলম্বন করে অল্প পুষ্টিলাভ করেনি। এবং সে হিসাবে তাকে অনায়াসেই নাট্যজগতের একজন বলে ধরে নেওয়া যায়। তারপর ভাগলপুরেই হয়তো শরৎচন্দ্রের সঙ্গীতকলার প্রতি অনুরাগ হয়। তিনি নিয়মিতভাবে কণ্ঠসাধনা করেছিলেন বলে প্রকাশ নেই; কিন্তু আমরা স্বকৰ্ণে শুনে জেনেছি যে, শরৎচন্দ্র ঈশ্বরদত্ত সুকণ্ঠের অধিকারী ছিলেন। তিনি নিজের চেষ্টায় শুনে এমন গান শিখেছিলেন এবং সে গান এমন কৌশলে গাইতে পারতেন যে, শ্রোতারা তন্ময় হয়ে শুনত। যন্ত্রসঙ্গীতেও তার হাত ছিল বলেই শুনেছি। এবং কিছু কিছু ছবি আঁকতেও পারতেন। (পাঠকরা লক্ষ করলে দেখবেন, রাজুর সঙ্গে শরৎচন্দ্রের মিল ছিল কতখানি) সাহিত্যক্ষেত্রে না এলে শরৎচন্দ্র পরে হয়তো শ্রেষ্ঠ গায়ক, বাদক বা চিত্রকররূপে আত্মপ্রকাশ করতেন; কারণ যথার্থ কলাবিদের স্বভাব নয় চিরদিন আত্মগোপন করে থাকা; আর্টের কোনও-না-কোনও পথ বেছে নিয়ে একদিন-না-একদিন তিনি বাইরে বেরিয়ে পড়বেনই। ব্রাহ্মণের গায়ত্রী মন্ত্রের মতো লুকিয়ে রাখবার জিনিস নয় আর্ট।

এবং ইতিমধ্যে অতি গোপনে চলছিল সাহিত্যচর্চা। মাতুলালয়ে থেকে শরৎচন্দ্র কেবল নিজেই লেখাপড়া করতেন না, বাড়ির ছেলেমেয়েদের পড়ানোরও ভার ছিল তার উপরে।

শরৎচন্দ্র পরে একাধিক বন্ধুর কাছে বলেছেন: ‘আমি অনেক দলে গিয়ে মিশেছি, অনেক ভালো-মন্দ সাধারণ লোকের সঙ্গে আমার আলাপ হয়েছে, কিন্তু কোথাও আমি নিজেকে হারিয়ে ফেলিনি। সর্বদাই আমার মনে হয়েছে, আমি ওদের কেউ নই!..এই যে মনে মনে নিজেকে আলাদা করে রাখা, এটা হচ্ছে বড়ো কলাবিদের লক্ষণ। দেবানন্দপুরের গরিবের ঘরের দামাল ছেলে শরৎচন্দ্র ভাগলপুরে এসে উচ্চতর কর্তব্যসাধনের জন্য নিজেকে যদি আলাদা করে না রাখতে পারতেন, তাহলে তাকেও আজ যবনিকার অন্তরালে বাস করতে হত। যে নদী সমুদ্রের ডাক শুনেছে, মাঝপথে নিজের শাখা-প্রশাখাকে অবলম্বন করে সমস্ত জলধারা সে নিঃশেষিত করে ফেলে না, তার প্রধান গতি হবে সমুদ্রের দিকেই। লোকে যাকে কবিতা বলে শরৎচন্দ্র তেমন কবিতা কখনও লেখেননি বটে, কিন্তু তার গদ্যরচনার মধ্যে কাব্যসৌন্দর্যের অভাব নেই কিছুমাত্র। অতি তরুণ বয়সেই—ভাগলপুরে থাকতেই—তার চিত্ত যে কাব্যরসে মিন্ধ হয়ে উঠেছিল শ্ৰীযুক্ত সুরেন্দ্রনাথ গঙ্গোপাধ্যায় শরৎচন্দ্রের বাল্যজীব বর্ণনা করতে গিয়ে তার সুন্দর পরিচয় দিয়েছেন:

ঘোষদের পোড়োবাড়ির একধারে উত্তরদিকে গঙ্গার উপরেই একটা ঘরের পিছনে কয়েকটা নিম আর দাঁতরাঙ্গা গাছে একটুখানি ছোটো জায়গাকে অন্ধকারে নিবিড় করিয়া রাখিয়ছিল। নিমের গোলঞ্চ মদনের কাটা-লতা চারিদিক হইতে এই স্থানটিকে এমনভাবে বেড়িয়া থাকিত যে, তাহার মধ্যে মানুষ প্রবেশ করিতে পারে এ বিশ্বাস বড়ো কেহ করিতে পারিত না। এক একদিন দলপতি কোথাও উধাও হইয়া যাইত; জিজ্ঞাসা করিলে বলিত, তপোবনে ছিলাম।

হঠাৎ একদিন আমার সৌভাগ্যের উদয় হইয়াছিল বোধ করি। আমাকে ‘তপোবন’ দেখানো হইবে জানিতে পারিয়া আমার হৃদয় আনন্দে গুরগুর করিতে লাগিল। কিন্তু অবশেষে শরৎ বলিল, ‘তুই যদি আর কাউকে বলে দিস?’ পূর্বদিকে ফিরিয়া সূর্য সাক্ষ্য করিয়া বলিলাম, কাউকে বলব না। কিন্তু তাহাতে সে নিরস্ত হইল না, বলিল ‘উত্তরদিকে ফের, ফিরে গঙ্গা আর হিমালয়কে সাক্ষ্য করে বল’। তাহাও করিলাম। তখন সে আমাকে সঙ্গে করিয়া অতি সন্তপর্ণে লতার পর্দা সরাইয়া একটি সুপরিচ্ছন্ন জায়গায় লইয়া গেল। সবুজ পাতার মধ্যে দিয়া সূর্যের কিরণ প্রবেশ করার জন্য একটা স্নিগ্ধ হরিতাভ আলোয় সেই জায়গা চক্ষু ও মনকে নিমেষে শাস্ত করিয়া স্বপ্নলোকে উত্তীর্ণ করিয়া দেয়। প্রকাণ্ড একখানা পাথরের উপর উঠিয়া বসিয়া সে স্নেহভরে ডাক দিল—আয়। তাহার পাশে বসিয়া নীচে চাহিয়া দেখিলাম—খরস্রোতা গঙ্গা বহিয়া চলিয়াছে। দূরে —গঙ্গার ও-পারে—নীলাভ গাছপালার ধোঁয়াটে ছবি পাতার ফাঁকে ফাঁকে দেখা যায়। শীতল বাতাস ঝিরঝির করিয়া বহিতেছিল। সে বলিল, ‘এইখানে বসে বসে আমি সব বড়ো বড়ো কথা ভাবি।’ উত্তরে বলিলাম,— ‘তাইতে বুঝি তুমি অঙ্কেতে একশোর মধ্যে একশোই পাও?’ সে অবজ্ঞাভরে বলিল-‘দ্যুৎ!’

ফিরিবার সময় সে বলিল, কোনওদিন এখানে একলা আসিসনে—

কেন?—

ভয় আছে—

ভূত?—

সে গম্ভীর স্বরে বলিল, ভূত-টুত কিছু নেই।

তবে—

এখেনে সাপ থাকে।

এর আগেই আমরা দেখিয়েছি, ইতিমধ্যে একবার দেবানন্দপুরে গিয়ে শরৎচন্দ্র ইশকুলের বই ফেলে লুকিয়ে হরিদাসের গুপ্তকথা ও ভবানী পাঠক (ওদের লেখক ভুবনমোহন মুখোপাধ্যায় এক সময়ে বাঙালি পাঠকের কাছে অত্যন্ত জনপ্রিয় লেখক ছিলেন এবং তার একটি নিজস্ব স্টাইলও ছিল) প্রভৃতি পড়তে শুরু করে সাহিত্যচর্চার একটি পিচ্ছল সোপানের উপরে উঠেছেন। তারপরের কথাও শরৎচন্দ্রের নিজের মুখেই শুনুন

‘এইবার খবর পেলুম বঙ্কিমচন্দ্রের গ্রন্থাবলীর। উপন্যাস সাহিত্যে এর পরেও যে কিছু আছে তখন ভাবতেও পারতাম না! পড়ে পড়ে বইগুলো যেন মুখস্থ হয়ে গেল। বোধ হয় এ আমার একটা দোষ। অন্ধ অনুকরণের চেষ্ট না করেছি তা নয়। লেখার দিক দিয়ে সেগুলো একেবারে ব্যর্থ হয়েছে, কিন্তু চেষ্টার দিক দিয়ে তার সঞ্চয় মনের মধ্যে আজও অনুভব করি।

দেখা যাচ্ছে, বঙ্কিমচন্দ্রের গ্রন্থাবলীর মহিমায় শরৎচন্দ্রের নিজেরও লেখনী ধারণের লোভ হয়েছে! এইভাবে তরুণ বয়সে বঙ্কিমের কত পাঠক যে লেখকে পরিণত হয়েছে, তার খবর কেউ রাখে না। বঙ্কিমের লেখায় যে-যাদু আছে, শরৎচন্দ্র যে তার দ্বারা কতখানি অভিভূত হয়েছিলেন সেটাও লক্ষ করবার ও স্মরণ রাখবার বিষয়। শেষ জীবন পর্যন্ত বঙ্কিমের প্রভাব যে তিনি ভুলতে পারেননি, সে ইঙ্গিতও আছে। অতঃপর শুনুন

‘তারপরে এল ‘বঙ্গদর্শন’-এর নব-পর্যায়ের যুগ। রবীন্দ্রনাথের‘ চোখের বালি’ তখন ধারাবাহিকভাবে প্রকাশিত হচ্ছে। ভাষা ও প্রকাশভঙ্গির যেন একটা নূতন আলো এসে চোখে পড়ল। সেদিনের সেই গভীর ও সুতীক্ষ্ণ স্মৃতি আমি কোনওদিন ভুলব না। কোনও কিছু যে এমন করে বলা যায়, অপরের কল্পনার ছবিতে নিজের মনটাকে যে পাঠক এমন চোখ দিয়ে পায়, এর পূর্বে কখনও স্বপ্নেও ভাবিনি। এতদিন শুধু কেবল সাহিত্যের নয়, নিজেরও যেন একটা পরিচয় পেলাম। অনেক পড়লেই যে তবে অনেক পাওয়া যায়, এ-কথা সত্য নয়। ওই তো খানকয়েক পাতা, তার মধ্য দিয়ে যিনি এত বড়ো সম্পদ আমার হাতে পৌঁছে দিলেন, তাকে কৃতজ্ঞতা জানাবার ভাষা পাওয়া যাবে কোথায়?’

শরৎচন্দ্র ভাষা ও রচনা পদ্ধতির জন্যে বঙ্কিমচন্দ্র ও রবীন্দ্রনাথের কাছে ঋণী বটে, কিন্তু নিজের লেখনীধারণের গুপ্তকথা এইভাবে তিনি ব্যক্ত করেছেন

‘আমার শৈশব ও যৌবন ঘোর দারিদ্র্যের মধ্যে দিয়ে অতিবাহিত হয়েছে। অর্থের অভাবেই আমার শিক্ষালাভের সৌভাগ্য ঘটেনি। পিতার নিকট হতে অস্থির স্বভাব ও গভীর সাহিত্যানুরাগ ব্যতীত আমি উত্তরাধিকারসূত্রে আর কিছুই পাইনি। পিতৃদত্ত প্রথম গুণটি আমাকে ঘরছাড়া করেছিল—আমি অল্প বয়সেই সারা ভারত ঘুরে এলাম। আর পিতার দ্বিতীয় গুণের ফলে জীবন ভরে আমি কেবল স্বপ্ন দেখেই গেলাম। আমার পিতার পাণ্ডিত্য ছিল অগাধ। ছোটগল্প, উপন্যাস, নাটক, কবিতা—এক কথায় সাহিত্যের সকল বিভাগেই তিনি হাত দিয়েছিলেন, কিন্তু কোনওটাই তিনি শেষ করতে পারতেন না। তার লেখাগুলি আজ আমার কাছে নেই—কবে কেমন করে হারিয়ে গেছে সেকথা আজ মনে পড়ে না। কিন্তু এখনও স্পষ্ট মনে আছে, ছোটোবেলায় কতবার তার অসমাপ্ত লেখাগুলি নিয়ে ঘণ্টার পর ঘণ্টা কাটিয়ে দিয়েছি। কেন তিনি এগুলি শেষ করে যাননি এই বলে কত দুঃখই না করেছি। অসমাপ্ত অংশগুলি কী হতে পারে ভাবতে ভাবতে আমার অনেক বিনিদ্র রজনী কেটে গেছে। এই কারণেই বোধহয় সতেরো বৎসর বয়সের সময় আমি লিখতে শুরু করি।

যদি শরৎচন্দ্রের স্মৃতির উপরে নির্ভর করি তাহলে বলতে হয় ১৮৯৩ খ্রিস্টাব্দের কাছকাছি কোনও সময়ে, পিতার অসমাপ্ত রচনাগুলি শেস করবার আগ্রহে সর্বপ্রথম তিনি কলম ধরেন এবং সম্ভবত তখন তিনি ইশকুলের প্রথম শ্রেণীতে পড়েন, কারণ শরৎচন্দ্র ১৮৯৪ খ্রিস্টাব্দে প্রবেশিকা পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হয়েছিলেন বলে প্রকাশ। শরৎচন্দ্র প্রকাশ্য সাহিত্যক্ষেত্রে স্বেচ্ছায় আত্মপ্রকাশ করেছিলেন ১৯১৯ খ্রিস্টাব্দে। তার প্রথম লেখনীধারণ ও আত্মপ্রকাশের মাঝখানে কেটে গিয়েছে প্রায় ছাব্বিশ-সাতাশ বৎসর।

যাঁরা বলেন শরৎচন্দ্র ধূমকেতুর মতো জেগে একেবারে সাহিত্যগগনকে আচ্ছন্ন করে ফেলেছিলেন, তারা ভ্রান্ত। দীর্ঘকাল ধরে প্রস্তুত না হলেও সাধনা না করলে সাহিত্যিক-শ্রেষ্ঠতা লাভ করা যায় না। শরৎচন্দ্ৰ সকলের চোখের সামনে ধীরে ধীরে পরিপূর্ণতা লাভ করেননি, অধিকাংশ সাহিত্যিকের—এমনকী বঙ্কিমচন্দ্র ও রবীন্দ্রনাথেরও সঙ্গেশরৎচন্দ্রের পার্থক্য হচ্ছে এইখানে এই সুদীর্ঘকালের মধ্যে শরৎচন্দ্র কখনও ভেবেছেন, কখনও কলম ধরেছেন এবং কখনও কলম ছেড়ে পড়েছেন—অর্থাৎসহিত্যেরও আর্টের অনুশীলন করেছেন এবং সেটাও চরম আত্মপ্রকাশের জন্যে প্রস্তুত হওয়া ছাড়া আর কিছুই নয়! হেটো আর বোকালোকেই বলবে, শরৎচন্দ্র কলম ধরেই সাহিত্য-রাজ্য জয় করে ফেললেন। আসলে যা বাইরের নয়, যা অন্তরের সত্য, শরৎচন্দ্র নিজেই তা এইভাবেই প্রকাশ করেছেন

‘এর পরই সাহিত্যের সঙ্গে হল আমার ছাড়াছড়ি, ভুলেই গেলাম যে জীবনে একটা ছত্রও কোনওদিন লিখেছি। দীর্ঘকাল কাটল প্রবাসে—ইতিমধ্যে কবিকে কেন্দ্র করে কী করে যে নবীন বাংলা সাহিত্য দ্রুতবেগে সমৃদ্ধিতে ভরে উঠল আমি তার কোনও খবরই জানিনে। কবির সঙ্গে কোনওদিন ঘনিষ্ঠ হবারও সৌভাগ্য ঘটেনি, তার কাছে বসে সাহিত্যের শিক্ষা গ্রহণেরও সুযোগ পাইনি, আমি ছিলাম একেবারেই বিচ্ছিন্ন। এইটা হল বাইরের সত্য, কিন্তু অস্তরের সত্য সম্পূর্ণ বিপরীত। সেই বিদেশে আমার সঙ্গে ছিল, কবির খানকয়েক বই— কাব্য ও কথাসাহিত্য। এবং মনের মধ্যে ছিল পরম শ্রদ্ধা ও বিশ্বাস। তখন ঘুরে ঘুরে ওই কখানা বইই বারবার করে পড়েছি। —কী তার ছন্দ, কটা তার অক্ষর, কাকে বলে Art, কী তার সংজ্ঞা, ওজন মিলিয়ে কোথায়ও কোনও ক্রটি ঘটেছে কিনা—এসব বড়ো কথা কখনও চিন্তাও করিনি—ওসব ছিল আমার কাছে বাহুল্য। শুধু সুদৃঢ় প্রত্যয়ের আকারে মনের মধ্যে এইটুকু ছিল যে, এর চেয়ে পূর্ণতর সৃষ্টি আর কিছু হতেই পারে না। কী কাব্যে, কী কথাসাহিত্যে, আমার এই ছিল পুঁজি।’

এইটুকুর মধ্যে রবীন্দ্রনাথের প্রতিশরৎচন্দ্রকেবল নিজের অপরিশোধ ঋণস্বীকারই করেননি, প্রকাশ করেছেন যে, দীর্ঘকাল প্রবাসে থেকেও এবং লেখনী ত্যাগ করেও পূর্ণতর সৃষ্টির জন্যে মনে মনে তিনি প্রস্তুত হয়ে উঠছিলেন। ১৩১৯ সালে কেউ কেউদৈবগতিকে তার আত্মপ্রকাশের উপলক্ষ হয়েছিলেন বটে, কিন্তু তারা না থাকলেও শরৎচন্দ্র আর বেশিদিন আত্মগোপন করতে পারতেন না। বড়ো নদীর স্রোতকেকেউ চারিদিকে পাথরের পাচিল তুলে একেবারে রুদ্ধ করতে পারে না। যত উচু পাচিলই তোলো, দুদিন পরে নদী বাধা ছাপিয়ে উপচে পড়বেই।

রবীন্দ্র-প্রতিভাকেই আদর্শরূপে সামনে রেখে শরৎচন্দ্র স্বদেশে ও প্রবাসে সাহিত্যসাধনা করেছিলেন। এ আদর্শ তার সুমুখ থেকে কখনও সরে গিয়েছিল বলে মনে হয় না, শরৎচন্দ্রের পরিণত বয়সেও তার রচনার ভাষা ও চরিত্রসৃষ্টির উপরে রবি-করের লীলা দেখা যায়। যখন বাংলার জনসাধারণের মাঝখানে তার আসন সুনির্দিষ্ট হয়ে গেছে, যখন তার অনেক শ্রেষ্ঠ রচনা বাইরের আলোকে এসেছে, তখনও (১৫-১১-১৯১৫) একখানি পত্রে তিনি তার কোনও বন্ধুকে লিখেছিলেন

‘আমি আবার একটা গল্প (উপন্যাস?) লিখছি। …এ গল্পটা গোরার ‘পরেশবাবু’র ভাব নেওয়া। অর্থাৎ নিজেদের কাছে বলতে অনুকরণ তবে ধরবার জো নেই।’

সুতরাং একথা স্বীকার করতেই হবে, সমগ্রভাবে না হোক, আংশিক ভাবেও শরৎসাহিত্যের উৎস খুঁজলে রবীন্দ্র-সাহিত্যকেই দেখা যাবে।

শরৎচন্দ্র যৌবনের প্রথমেই লেখকের আসনে এসে বসলেন। সেই সময়ে বা তার কিছু আগে-পরে শরৎচন্দ্র নিজের চারিপাশে কয়েকটি তরুণকে নিয়ে একটি লেখকগোষ্ঠী গঠন করে নিয়েছিলেন এবং তাদের দলপতির আসনে অধিষ্ঠিত করেছিলেন নিজেকেই। তাদের অধিকাংশই এখন বাংলা সাহিত্যে সুপরিচিত হয়েছেন, যেমন—শ্ৰীমতী নিরুপমা দেবী, শ্ৰীসৌরীন্দ্রমোহন মুখোপাধ্যায়, স্বর্গীয় গিরীন্দ্রনাথ গঙ্গোপাধ্যায়, শ্রীউপেন্দ্রনাথ গঙ্গোপাধ্যায়, শ্ৰীযুক্ত যোগেশ মজুমদার, শ্ৰীসুরেন্দ্রনাথ গঙ্গোপাধ্যায় ও শ্ৰীবিভূতিভূষণ ভট্ট প্রভৃতি। (যদিও সৌরীন্দ্রমোহন ও উপেন্দ্রনাথকে ভাগলপুরের সাহিত্য সভার নিয়মিত সভ্য না বলে ভবানীপুর সাহিত্য সমিতি’র সভ্য বলাই উচিত। সৌরীন ছিলেন কলকাতার ছেলে।)

তখনকার দিনের ওই তরুণের দল নিয়মিতভাবে যে-আসরে এসে সমবেত হতেন তার নাম ছিল নাকি ‘সাহিত্য সভা’। যারা প্রথম সাহিত্য-সেবাকেই জীবনের ব্রত করে তুলতে চান, তাদের পক্ষে এরকম আসরের দরকার হয় সত্য-সত্যই। এসব আসরে পরস্পরের সঙ্গে ঘনিষ্ঠ আলাপ-আলোচনার ফলে পাওয়া যায় সাহিত্যসৃষ্টির জন্যে নব নব প্রেরণা। উক্ত সভার মুখপত্রের মতন ছিল একখানি হাতে-লেখা মাসিকপত্র, নাম ছায়া’। শ্ৰীমতী অনুরূপা দেবী আর একখানি পত্রিকার নাম করেছেন—তরণী’। কিন্তু এই তরণী’ আত্মপ্রকাশ করে কলকাতার ভবানীপুরে। এবং তার নিয়মিত লেখক ছিলেন শ্ৰীযুক্ত সৌরীন্দ্রমোহন মুখোপাধ্যায়, শ্ৰীযুক্ত উপেন্দ্রনাথ গঙ্গোপাধ্যায়, শ্ৰীযুক্ত নলিনীমোহন শাস্ত্রী, শ্ৰীযুক্ত প্রমথনাথ সেন (সেন ব্রাদার্স), ও শ্রীযুক্ত শ্যামরতন চট্টোপাধ্যায় প্রভৃতি। ছায়া ও তরণী ছিল পরস্পরের প্রতিযোগী। ডাকযোগে তারা কলকাতা থেকে ভাগলপুরে কিংবা ভাগলপুর থেকে কলকাতায় আনাগোনা করত এবং ‘ছায়া’ করত তরণী’র লেখার উত্তপ্ত ও সুতিক্ত সমালোচনা এবং তরণী’তে ছায়া’র লেখা সম্বন্ধে যেসব মতামত থাকত তারও তীব্রতা কম ধারালো ছিল বলে মনে করবার কারণ নেই। ছায়া’র সযত্নে বাধানো খাতা পরে ‘যমুনা’র খোরাক জোগাবার জন্যে নিঃশেষে আত্মদান করেছিল। প্রতিযোগী ‘তরণী’ এখন আর কল্পনাসায়রে ভাসে না বটে, কিন্তু তার কিছু কিছু নমুনা নাকি আজও পাওয়া যায়।

হাতে-লেখা পত্রিকায় শরৎচন্দ্রের প্রথম বয়সের অনেক রচনা প্রকাশিত হয়েছিল। বাগান নামে অন্য খাতায় অন্যান্য রচনাও তোলা ছিল। কী কী রচনা, তার সঠিক হিসাব পাওয়া যায়নি, নানা জনে নানা লেখার নাম উল্লেখ করেছেন, হয়তো নামের তালিকা নির্ভুল নয়। বিভিন্ন ব্যক্তির কাছ থেকে আমরা এতগুলি লেখার নাম পেয়েছিঃ ‘কাক-বাসা’, ‘অভিমান’, (ইস্টলিনের ছায়ানুসরণ), ‘পাষাণ’, (Mighty Atom-এর অনুসরণ), ‘বোঝা’, ‘কাশীনাথ’, ‘অনুপমার প্রেম’, ‘কোরেল’, ‘বড়দিদি, ‘চন্দ্রনাথ’, ‘দেবদাস’, ‘শুভদা’, ‘বালা’, ‘শিশু’, ‘সুকুমারের বাল্যকথা’, ‘ছায়ার প্রেম’, ‘ব্রহ্মদৈত্য’, ও ‘বামন ঠাকুর’ প্রভৃতি। হয়তো এদের কোনও কোনওটি ওই হাতে-লেখা কাগজের সম্পত্তি নয়, স্বাধীন উপন্যাস বা গল্পের আকারেই আত্মপ্রকাশ করেছে। কোনও-কোনওটি হয়তো শরৎচন্দ্রের ভাগলপুর ত্যাগের পর লিখিত। দেখছি, শরৎচন্দ্রের তখনকার রচনার মধ্যে একাধিক অনুবাদও ছিল। কিন্তু পরের বয়সে অনুবাদ-সাহিত্য সম্বন্ধে শরৎচন্দ্রের মত পরিবর্তিত হয়েছিল। কারণ তাকে বলতে শোনা গেছে—অনুবাদ করা আর পণ্ডশ্রম করা একই কথা। ও আমার ভালো লাগে না। শরৎচন্দ্রের পূর্বোক্ত রচনাগুলির কয়েকটি পরে যমুনা ও সাহিত্য প্রভৃতি পত্রিকায় প্রকাশিত হয়েছিল। কোনও-কোনওটি হারিয়ে বা নষ্ট হয়ে গেছে। সৌরীন্দ্রমোহন বলেন, শরৎচন্দ্র তখন নাকি এই নাম ব্যবহার করতেন—St.c, Laraঅর্থাৎ St—শরৎ;c–চন্দ্র; এবং Laraঅর্থেশরৎচন্দ্রের ডাকনাম নাড়া’ –অপূর্ব ছদ্মনাম! .

‘কাক-বাসা’ সম্বন্ধে শ্ৰীযুক্ত সুরেন্দ্রনাথ গঙ্গোপাধ্যায় লিখেছেন উপন্যাস লেখার এই বোধ করি আদি চেষ্টা এখনি পড়বার সুযোগ ঘটে নাই, কিন্তু সে-সময় এখনি লিখিতে তাহাকে বহু সময় ব্যয় করিতে দেখিয়াছি। ঘণ্টার পর ঘণ্টা কোথা দিয়া কাটিয়া যাইত—সে মহানিবিষ্ট মনে লিখিয়াই চলিয়াছে!…লেখা পছন্দ হয় নাই বলিয়া সে এই বইখানি ফেলিয়া দিয়াছিল।

সুরেনবাবুর শেষ কথাগুলি পড়লে অধিকাংশ সাধারণ নূতন লেখকের সঙ্গে শরৎচন্দ্রের পার্থক্য বোঝা যায়। সাধারণত নিম্নশ্রেণীর লেখকরা নিজেদের লেখার সম্বন্ধে হন অন্ধ, তাঁদের বিশ্বাস তারা যা লেখেন সবই অমূল্য রত্ন, সমজদার সুখ্যাতি না করলে তাদের দ্বিতীয় রিপু হয় প্রবল। কিন্তু প্রথম বয়স থেকেই নিজের রচনার ভালো-মন্দ সম্বন্ধে শরৎচন্দ্র ছিলেন সচেতন, যা লিখতেন তাইই তার মনের মতো হত না এবং পছন্দ না হলে নির্মমভাবে তাকে ত্যাগ করতেও পারতেন। এটা হচ্ছে প্রতিভাধরের লক্ষণ, তার বিচারনিপুণ মন নিজের কাজেও তৃপ্ত নয়! .

আজকালকার নূতন লেখকদের দেখি, প্রথম লিখতে শিখেই মাসিক সাহিত্যের আসরে আত্মপ্রকাশ করবার জন্যে তাঁরা মহাব্যস্ত হয়ে ওঠেন। কিন্তু সব আর্টের মতন সাহিত্যের আসরেও যে শিক্ষাকাল আছে, এটা হয়তো তারা বিশ্বাস করতে রাজি নন। গত যুগের অধিকাংশ সাহিত্যিকই কোনও সদগুরুর শিষ্যত্ব গ্রহণ বা কোনও বড়ো আদর্শকে সামনে রেখে হাতমকশো করতেন, কাগজে কালির আঁচড় কাটতে শিখেই মাসিকপত্রের আফিসের দিকে ছুটতেন না। শরৎচন্দ্রও এই নীতি মেনে চলতেন। তাই তার প্রথম জীবনের প্রত্যেক রচনার দৌড় ছিল হাতে-লেখা পত্রিকার আসর পর্যন্ত। সে সময় তিনি যে বাতিল হবার মতন লেখা লিখতেন না তার প্রমাণ, তার তখনকার অনেক লেখাই বহুকাল পরে প্রকাশ্য সাহিত্যের দরবারে এসে অসাধারণ সম্মান ও জনপ্রিয়তা অর্জন করেছে।

শরৎচন্দ্রের জনপ্রিয়তা দেখেই যে পরে তার প্রথম বয়সের রচনা সাহিত্যের মতো বিখ্যাত পত্র প্রকাশ করতে রাজি হয়েছিল, তা নয়; তার মধ্যে বাস্তবিকই বস্তু ছিল। এরও প্রমাণ আছে। ‘ভারতী’ও ছিল একখানি প্রথম শ্রেণীর মাসিক পত্রিকা। ভারতী যখন লেখকের অজ্ঞাতসারে যেচে বড়দিদিকে গ্রহণ করেছিল, তখন শরৎচন্দ্র নামক সাহিত্যিকের অস্তিত্বও জনসাধারণের জানা ছিল না এবং প্রথমে শরৎচন্দ্রের নাম পর্যন্ত ভারতী’তে প্রকাশ করা হয়নি। তবু সাধারণ পাঠকদের উপভোগের পক্ষে বড়দিদিই হয়েছিল আশাতীতরূপে যথেষ্ট। কিন্তু শরৎচন্দ্রের নিজের বিচারে বড়দিদি প্রভৃতি তার আদর্শের কাছে গিয়ে পৌছোতে পারেনি, তাই তখনকার মতো তারা হস্তলিখিত পত্রিকার মধ্যেই বন্দি হয়ে রইল, বন্ধুরা বহু অনুরোধ করেও তাদের কোনওটিকে প্রকাশ্য সহিত্যক্ষেত্রে হাজির করবার অনুমতি পেলেন না! এবং আত্মরচনা বিচার করতে বসে শরৎচন্দ্রের ভুল হয়েছিল বলেও মনে করি না। কারণ তার আত্মপ্রকাশের যুগের রচনাগুলির সঙ্গে মিলিয়ে দেখলেই বেশ বোঝা যায় যে, প্রকাশভঙ্গি, রচনারীতি ও চরিত্র-চিত্রণের দিক দিয়ে পূর্ববর্তী গল্প বা উপন্যাসগুলি সত্য-সতাই অপেক্ষাকৃত নিম্নশ্রেণীর! এ থেকেই প্রমাণিত হয়, জনসাধারণের বিচার আর শিল্পীর বিচার এক নয়!

আসল কথা, শিল্পী শরৎচন্দ্রের মনের ভিতরে সহিত্যের সৌন্দর্য তখন পরিপূর্ণ মহিমায় বিকশিত হয়ে উঠেছে; সে আর অল্পে তুষ্ট হতে পারছে না। তিনি এমন কিছু সৃষ্টি করতে চাইছেন, তার প্রাথমিক শক্তি যাকে প্রকাশ করতে অক্ষম। তার সাহিত্য-সাধনার ধারা তখন যদি অব্যাহত থাকতে পারত, তাহলে অনতিকাল পরেই হয়তো বাংলাদেশে আমরা শরৎচন্দ্রের প্রকাশ্য আবির্ভাব দেখবার সুযোগলাভ করতুম। কিন্তু শরৎচন্দ্রের যে দরিদ্র্যের কথা আমরা আগেই উল্লেখ করেছি, সেই দারিদ্র্যের দুর্ভাগের জন্যেই তাকে ভাগলপুর পরিত্যাগ করতে হল। তারও পরে কিছুকাল তিনি লেখনীকে একেবারে তুলে রাখেননি বটে, কিন্তু নানাস্থানী হয়ে তার নিয়মিত সাহিত্যচর্চার সুবিধা বোধহয় হত না। দারিদ্র্য বহু শিল্পীর সর্বনাশ করেছে এবং শরৎচন্দ্রের দান থেকেও দীর্ঘকাল বাংলাদেশকে বঞ্চিত রেখেছে। নইলে শরৎচন্দ্রের গ্রন্থাবলীর আকার আরও কত বড়ো হত কে তা বলতে পারে?

এই অধ্যায় শেষ করবার আগে মানুষ-শরৎচন্দ্রের চরিত্রের আর একদিকে একবার দৃষ্টিপাত করতে চাই। দেখি, ছেলেবেলা থেকেই তিনি কোনও একটা নির্দিষ্ট জায়গায় স্থির হয়ে বেশিদিন থাকতে পারেন না। এমনকী যে-বয়সে মায়ের কোলই ছেলেদের সবচেয়ে নিরাপদ আশ্রয়, তখনও তিনি মাঝে মাঝে নিরুদ্দেশ যাত্রায় বেরিয়ে পড়েছেন! শোনা যায়, তিনি নাকি একবার পায়ে হেঁটে পুরীতেও গিয়েছিলেন। রেঙ্গুনে পালাবার আগে তিনি যে কতবার কত জায়গায় ঘোরাঘুরি করেছেন, কারুর কাছে তার সঠিক হিসাব আছে বলে জানা নেই। এমনকী মাঝে মাঝে তিনি দস্তুরমতো সন্ন্যাসী সেজেও ডুব মেরেছেন। রেঙ্গুন থেকে ফিরে এসেও তিনি তার সাহিত্যিক যশের লীলাক্ষেত্র কলকাতায় দীর্ঘকাল ধরে বাস করতে পারেননি। কখনও থেকেছেন পানিত্ৰাসে, কখনও থেকেছেন বেনারসে, কখনও ছুটেছেন উত্তর-পশ্চিম ভারতে, শেষ-জীবনে কালাপানি লঙ্ঘন করবারও চেষ্টায় ছিলেন—বৃদ্ধ বয়সেও তার ঘর-পালানো মন তাকে অচলায়তনের মধ্যে বাধা পড়তে দেয়নি। এটা ঠিক প্রতিভার অস্থিরতা নয়, কারণ পৃথিবীর অনেক প্রতিভাই স্বদেশের সীমা ছাড়িয়ে বাইরে বেরুতে রাজি হয়নি। যদিও বাংলাদেশের আর এক বিরাট প্রতিভার মধ্যে বিচিত্র অস্থিরতা দেখা যায় এবং তিনি হচ্ছেন রবীন্দ্রনাথ।

সকল অধ্যায়

নোট নিতে এবং টেক্সট হাইলাইট করতে লগইন করুন

লগইন