নবাব কুঠির নর্তকী

হেমেন্দ্রকুমার রায়

এক

‘হ্যাঁ, এই হচ্ছে সেই নবাব কুঠি! সেকালে এক বিলাসী নবাব এখানে বাস করতেন। রোজ নাচ-গান আর আনন্দ কলরবে নিশীথ রাতের নীরবতা এখানে মুখরিত হয়ে উঠত। শোনা যায়—নবাবের এক নর্তকী ছিল, তার নাচের খ্যাতি ফিরত লোকের মুখে-মুখে। তারপর হঠাৎ একদিন কী কারণ জানি না, নবাব ক্রুদ্ধ হয়ে নর্তকীকে নিজের হাতে কেটে কুচি কুচি করে ফেলেন। আর সেই দিন রাত্রেই নাকি নবাবও গুপ্তঘাতকের হাতে প্রাণ দেন। তারপর থেকে এখানে আর কেউ বাস করে না। নবাবের বংশধররা আজও আছেন, কিন্তু তাঁরা এই প্রাসাদকে অভিশপ্ত বলে মনে করেন। তাই এই প্রাসাদের ওপরে আজ পাহারা দেয় কেবল নিবিড় অরণ্য, এর ছাদে বসে করুণস্বরে কাঁদে ঘুঘুর দল, এর ঘরে এসে বাসা বাঁধে বাদুড় আর প্যাঁচারা। এমনকী খুঁজে দেখলে এখানে দু-চারটে শেয়াল বা নেকড়ে বাঘের সন্ধানও মিলতে পারে।’

আমি আর বসন্ত পুজোর ছুটিতে নলিনদের দেশে বেড়াতে এসেছি। তারপর তাকে নিয়ে বেরিয়েছি পাখি শিকার করতে। তারপর গভীর জঙ্গলে ঢুকে পথ হারিয়ে ফেলি। সন্ধ্যার আবছায়ায় হঠাৎ যখন এই পরিত্যক্ত, স্তব্ধ প্রাসাদের সামনে এসে পড়লুম, নলিন তখন পথ চিনতে পারলে বটে, কিন্তু তখন আর গ্রামে ফেরবার উপায় নেই। কারণ এখনই অমাবস্যার আঁধার রাত এসে পৃথিবীকে গ্রাস করে ফেলবে আর গ্রামও নাকি এখান থেকে পনেরো মাইল দূরে! কাজেই স্থির করা গেল, আজকের রাতটা এই নবাব কুঠির মধ্যে বসেই কাটিয়ে দেব!

নলিনের মুখে নবাব কুঠির ছোট্ট ইতিহাস শুনে বসন্ত বললে, ‘এই ১৯৪১ খ্রিস্টাব্দে পৃথিবী থেকে ‘‘রোমান্সে’’-র গল্পটুকু পর্যন্ত উবে গিয়েছে! যাক, তবু যে একখানা ‘‘রোমান্টিক’’ বাড়ির খোঁজ পাওয়া গেল, এইটুকুই সৌভাগ্য!’

নলিন বললে, ‘সৌভাগ্যের ঠেলা একটু পরেই বুঝতে পারবে!’

‘কেন?’

‘রাতে খাবে কী? বাদুড়? চামচিকে? না কালো অন্ধকার?’

আমি বললুম, ‘নির্ভয় হও! দৈব দুর্ঘটনার জন্যে আমি প্রস্তুত হয়েই এসেছি। আমার ব্যাগের জঠরে আছে এক ডজন মর্তমান কলা, আধ ডজন ডিম আর দু-খানা বড়ো পাউরুটি।’

বসন্ত বললে, ‘আর আমার ‘‘ফ্লাস্কে’’ আছে গরম চা! ব্যস, আজ আর কিছু না থাকলেও চলবে! কর্মভোগের পর রাজভোগ! মন্দ কী!’

নলিন তবু খুঁত খুঁত করতে করতে বললে, ‘কিন্তু ঘুটঘুটে অন্ধকারে—’

আমি বললুম, ‘আমার কাছে একটা ‘‘টর্চ’’ আর দুটো মোমবাতি আছে, সুতরাং—’

বসন্ত বললে, ‘সুতরাং দুর্ভাবনায় জলাঞ্জলি দিয়ে এই কোণটা পরিষ্কার করে ফেলা যাক। এখানে যে ধুলো জমে আছে তার বয়স অন্তত এক-শো বছর!’

দুই

তখনও ভালো করে সন্ধ্যার আসর বসেনি। পশ্চিম দিকের বড়ো বড়ো জানলাগুলো দিয়ে যেটুকু ম্লান আলো আসছিল, তাইতেই ঘরের ভিতরটা দেখা যাচ্ছিল আবছা আবছা।

এ হচ্ছে একটা মস্তবড়ো হলঘর। এর মধ্যে অনায়াসে এক-শো জন লোকের জায়গা হতে পারে। কেবল মেঝের সমস্তটাই নয়—চারদিকের দেওয়ালও শ্বেতপাথরে বাঁধানো। অযত্নে ও কালের প্রভাবে মার্বেলের শুভ্রতা মলিন হয়ে গেছে বটে, তবু তার ভেতর থেকেই নবাবি ঐশ্বর্যের যে দীপ্তি ফুটে উঠেছিল তা মুগ্ধ করে দিলে আমাদের নয়ন মনকে। মাঝে মাঝে রঙিন পাথরের লতা-পাতা-ফুল বসিয়ে দেওয়ালকে অলংকৃত করা হয়েছে, সে কারুকার্যও অনুপম।

আমি বললুম, ‘বোধ হয় এইটেই ছিল নবাব বাহাদুরের নাচঘর?’

বসন্ত কবিত্ব প্রকাশের চেষ্টা করে বললে, ‘হায় কী দুর্ভাগ্য! আজ নবাবি নাচঘর স্তব্ধ, নর্তকীর নূপুরে বাজবে না আর কবিতার ছন্দ, ঘরের হাওয়ায় দুলবে না আর ফুলের মালার গন্ধ!—সব ‘‘রোমান্স’’ মাটি!’

হঠাৎ ওধারের একটা দরজা খুলে গেল সশব্দে!

নলিন চমকে উঠল।

আমি হেসে বললুম, ‘ব্যাপার কী নলিন? তোমার মুখ দেখে মনে হচ্ছে, তুমি যেন ভয় পাওয়ার জন্যে প্রস্তুত হয়েই আছ।’

নলিনও হেসে বলল, ‘একে বাড়িটার নামডাক ভালো নয়, তার ওপরে আচমকা দরজাটা খুলে গেল কিনা!’

বসন্ত বললে, ‘দমকা হাওয়ায় দরজা খুলে গেল, তাতে হয়েছে কী? তুমি কি ভাবছ দরজা খুলে কোনো বাইজি আমাদের নাচ দেখাতে আসছে? আহা, তা যদি আসত! আমি প্যালা দিতে রাজি!’

নলিন বললে, ‘এখানে ওসব কথা আমার ভালো লাগছে না। বসন্ত আলো জ্বালো— খাবার বার করো।’

আমি বাতি জ্বাললুম।

তিন

বাতির আলোতে ঘরের একটা কোণ কিঞ্চিৎ উজ্জ্বল হয়ে উঠল বটে, কিন্তু হাত কয়েক এগিয়ে পরিপূর্ণ অন্ধকারের মধ্যে হারিয়ে গেল সেই ক্ষীণ আলোর ধারা।

পরিত্যক্ত প্রাসাদ, বিজন বন, অন্ধরাত্রি! কিন্তু এরা কেউ স্তব্ধ নয়। রাত্রির কালো আঁচলের ভেতর থেকে কতরকম চিৎকার করছে কত জাতের পশুপক্ষী, কীটপতঙ্গ, গাছের ডালে-পাতায় বাতাসের হুড়োহুড়ি, বাড়ির ভেতরে চঞ্চল হয়ে উঠেছে যেন সমস্ত দরজা-জানলা!

একখানা এনামেলের ডিশের ওপরে ডিমগুলো রেখে আমি পাউরুটি কাটতে লাগলুম। নলিন কলার খোসা ছাড়াতে বসল। বসন্ত ‘ফ্লাস্ক’ থেকে চা ঢালতে উদ্যত হল। আমি বললুম, ‘চা পরে ঢেলো, আগে ডিমগুলোর খোলা ছাড়িয়ে নাও।’

বসন্ত কাছে এসে বলল, ‘কোথায় ডিম?’

‘ওই ডিশে।’

‘ডিশে ঘোড়ার ডিম আছে!’ বলেই সে খালি ডিশখানা আমার দিকে ঠেলে দিলে।

আমি বললুম, ‘চালাকি হচ্ছে? আমি এইমাত্র ছ-টা ডিম ডিশে নিজের হাতে রেখেছি।’

‘তোমার দিব্যি সুরেন, ডিশে আমি একটাও ডিম দেখিনি!’

ডিমগুলো কি আমি ভুলে মাটিতে রেখেছি, আর সেগুলো গড়িয়ে দূরে চলে গেছে? দুটো বাতিই জ্বেলে এবং ‘টর্চে’র আলো নিয়ে তিনজনে মিলে ঘরে চারদিক খুঁজতে লাগলুম, কিন্তু একটাও ডিম আবিষ্কার করতে পারলুম না।

চার

মাথা চুলকোতে চুলকোতে বললুম, ‘তবে কি কোনো জন্তু-টন্তু আমাদের অজান্তে এসে ডিমগুলো নিয়ে পালিয়ে গেছে?’

বসন্ত বললে, ‘অসম্ভব!’

‘তবে?’

‘সেইটেই হচ্ছে প্রশ্ন। এ-বাড়িতে আমরা ছাড়া নিশ্চয় আরও কোনো মানুষ আছে। হতভাগা চোরকে এখনই আমি খুঁজে বার করব!’

আচম্বিতে আমিও অনুভব করলাম, ঘরের ভেতরে আমরা ছাড়া যেন বাইরের কোনো লোক এসে হাজির হয়েছে। কোনোখানে পুরু অন্ধকারে গা ঢেকে সে যেন অদৃশ্য চক্ষের ছুরির মতন তীক্ষ্ণ দৃষ্টি হেনে আমাদের প্রত্যেক ভাবভঙ্গি লক্ষ করছে!

মনে মনে শিউরে বলে উঠলুম, ‘বসন্ত, বসন্ত, এই বাড়িতে নিশ্চয়ই কোনো রহস্য আছে! এখান থেকে আমরা বেরিয়ে পড়ি চলো!’

বসন্ত ক্রুদ্ধ স্বরে বললে, ‘না, না—কীসের ভয়ে পালিয়ে যাব? আগে আমি চোরটাকে ধরে শিক্ষা দিতে চাই!’ সে হেঁট হয়ে বন্দুকটা তুলে নিলে।

নলিন সচকিত স্বরে বললে, ‘দ্যাখো, দ্যাখো। ওই কোণে সাদা মতন কী রয়েছে দ্যাখো!’

ঘরের দক্ষিণ কোণে মেঝের ওপরে সত্যই শ্বেতবর্ণ কী যেন অস্পষ্টভাবে দেখা যাচ্ছে! টর্চের আলো তার ওপরে পড়তেই দৃষ্টি স্তম্ভিত হয়ে গেল!

একজোড়া পা! রক্তমাংসের পা নয়—একেবারে অস্থিসার কঙ্কালের পা! তার চেয়েও ভয়াবহ হচ্ছে, দুই কঙ্কাল পদের ওপরে বাঁধা রয়েছে একজোড়া নূপুর!

বসন্ত বললে, ‘ও হাড় দু-খানা নিশ্চয়ই ওখানে ছিল, এতক্ষণ আমরা দেখতে পাইনি!’

নলিন কাঁপতে কাঁপতে বললে, ‘না, না! এতক্ষণ ওখানে কিছুই ছিল না!’

আমি বললুম, ‘নলিন, সেকালের সেই নবাব নাকি তাঁর নর্তকীর দেহকে কেটে কুচি-কুচি করে ফেলেছিলেন?’

নলিন আমার কথার জবাব না দিয়ে, আর একদিকে অঙ্গুলি নির্দেশ করে রীতিমতো কান্না স্বরে বললে, ‘ও আবার কী বসন্ত, ও আবার কী?’

চকিতে ফিরে দাঁড়িয়ে দেখলুম আর এক রোমাঞ্চকর দৃশ্য!

এতক্ষণ আমরা ঘরের যেখানে বসেছিলুম ঠিক সেইখানেই পাথরের দেওয়ালের ওপর জ্বলজ্বল করে জ্বলছে দুটো আশ্চর্য চক্ষু! চোখ দুটো গড়া যেন লাল টকটকে পদ্মরাগ মণি দিয়ে এবং তাদের ভেতর থেকে ঠিকরে ঠিকরে পড়ছে যেন মৃত্যুভীষণ দুর্দান্ত ক্ষুধা!

বিনা বাক্যব্যয়ে বসন্ত বন্দুক তুলে চোখ দুটোকে লক্ষ্য করে ঘোড়া টিপে দিলে—বন্দুকের বিষম গর্জনে ঘর যেন ফেটে গেল; কিন্তু সেই বীভৎস রক্তাক্ত চোখ দুটো জ্বলতে লাগল ঠিক তেমনি জ্বলজ্বল করেই।

ওদিকে বন্দুকের ধ্বনি-প্রতিধ্বনি ভালো করে মিলিয়ে যেতে-না-যেতেই ঘরের মধ্যে আর একটা অদ্ভুত শব্দ জেগে উঠে আমাদের সর্বশরীর আচ্ছন্ন করে দিলে!

ঠক-ঠক-ঠকা-ঠক-ঠক—ঝুনুঝুনু ঝুম-ঝুম-ঝুম! ঠক-ঠক-ঠকা-ঠক-ঠক—ঝুনু-ঝুনু ঝুম-ঝুম-ঝুম!

ঠিক যেন দু-খানা নূপুর-পরা হাড়ের পা মেতে উঠেছে নাচের আনন্দে!

পরমুহূর্তে বিকট এক আর্তনাদ করে নলিন ছুটল বাইরের দরজার দিকে!

ঠক-ঠক-ঠকা-ঠক-ঠক—ঝুনু-ঝুনু ঝুম-ঝুম-ঝুম!—বেশ বুঝতে পারলুম, নূপুর-পরা হাড়ের পা এগিয়ে আসছে আমাদের দিকেই! পিছন ফিরে দেখতে ভরসা হল না—এতক্ষণে হয়তো সেখানে আবির্ভূত হয়েছে কোনো ভয়াবহ কঙ্কালমূর্তি!

বসন্ত চিৎকার করে বললে, ‘কাপুরুষ! কীসের ভয়ে ও পালাল? এসব হচ্ছে ‘‘হ্যালিউসিনেশন!’’ মিথ্যা মরীচিকা!’

তার হাত ধরে প্রাণপণে টানতে টানতে বাইরের দিকে অগ্রসর হয়ে আমি বললুম, ‘পাগলামি কোরো না বসন্ত—শিগগির বেরিয়ে এসো, এ প্রাসাদ মানুষের পৃথিবীর বাইরে!’

সকল অধ্যায়

১. পোড়োবাড়ি
২. ছায়া, না কায়া?
৩. জীবন মৃত্যু
৪. স্বপ্ন হলেও সত্য
৫. ভৌতিক চক্রান্ত
৬. জুজুর ভয়
৭. ভূতের ভয়
৮. ভূত যখন বন্ধু হয়
৯. গঙ্গার বিভীষিকা
১০. এথেন্সের শেকল বাঁধা ভূত
১১. বাদশার সমাধি
১২. কে?
১৩. মূর্তি
১৪. অভিশপ্ত নীলকান্ত
১৫. মিসেস কুমুদিনী চৌধুরি
১৬. কী?
১৭. পোড়ো মন্দিরের আতঙ্ক
১৮. চিলের ছাতের ঘর
১৯. ওলাইতলার বাগানবাড়ি
২০. আয়নার ইতিহাস
২১. খামেনের মমি
২২. বাঁদরের পা
২৩. রামস্বামীর উপল মণি
২৪. ক্ষুধিত জীবন
২৫. বাড়ি
২৬. বাড়ি, বুড়ো, বুট
২৭. শয়তান
২৮. বন্দি আত্মার কাহিনি
২৯. আধখাওয়া মড়া
৩০. ভেলকির হুমকি
৩১. জ্বলন্ত চক্ষু
৩২. আজও যা রহস্য
৩৩. শয়তানি-জুয়া
৩৪. কোর্তা
৩৫. রহস্যময় বাড়ি
৩৬. বাঘের চোখ
৩৭. জীবন্ত মৃতদেহ
৩৮. মানুষ, না পিশাচ
৩৯. জাগ্রত হৃৎপিণ্ড
৪০. অভিশপ্ত মূর্তি
৪১. ঐন্দ্রজালিক
৪২. টেলিফোন
৪৩. ভূতের রাজা
৪৪. অভিশপ্তা
৪৫. সূর্যদেবতার পুরোহিত
৪৬. অদৃশ্যের কীর্তি
৪৭. নসিবের খেলা
৪৮. ভৌতিক, না ভেলকি?
৪৯. ছায়া—কায়া—মায়া
৫০. বিছানা
৫১. ‘বাজলে বাঁশি কাছে আসি’!
৫২. কঙ্কাল-সারথি
৫৩. লোটা
৫৪. মাঝরাতের ‘কল’
৫৫. এক রাতের ইতিহাস
৫৬. কিন্তু
৫৭. পেপির দক্ষিণ পদ
৫৮. কিসমৎ
৫৯. কায়া কি ছায়া কি মায়া
৬০. নবাব কুঠির নর্তকী
৬১. ডাকবাংলো
৬২. তবে
৬৩. মামূর্তের দানব-দেবতা
৬৪. দিঘির মাঠে বাংলো
৬৫. নবাব বাহাদুরের বংশধর
৬৬. মুক্তি
৬৭. পিশাচ
৬৮. মৃতদেহ
৬৯. নবাবগঞ্জের সমাধি
৭০. ভীমে-ডাকাতের বট
৭১. নরকের রাজা
৭২. কলকাতার বিজন দ্বীপে
৭৩. রুদ্রনারায়ণের বাগানবাড়ি

নোট নিতে এবং টেক্সট হাইলাইট করতে লগইন করুন

লগইন