নবাব বাহাদুরের বংশধর

হেমেন্দ্রকুমার রায়

ব্যাঘ্রাচার্য বৃহৎ-লাঙ্গুল!

চাঁদের দুধের ধারায় চারিদিক করছে ধবধব।

বইছে ফুলেল বাতাস, গাইছে সবুজ পাতার দল, ঝরছে ঝরঝর কুমারী ঝরনা!

নিশীথ রাত্রি। চলেছি গহন-বনের ভিতর দিয়ে নির্জন পথে। যেতে হবে গ্রামান্তরে, এখান থেকে কুড়ি মাইল দূর। চলেছি একাকী।

এমন সময়ে গভীর গর্জনে বনভূমি হল থরথর প্রকম্পিত!

ব্যাঘ্রচার্য বৃহৎ-লাঙ্গুল!

প্রকাণ্ড এক বাঘ—বাঘ যে এত বড়ো হয় আমি কখনো তা কল্পনাতেও আনতে পারিনি। জঙ্গল ভেদ করে সে বাইরে এসে দাঁড়াল। তারপর আমার দিকে আগুন-ভরা ক্রুদ্ধ দৃষ্টিপাত করে সামনের দিকে দুই থাবা পেতে মাটির উপরে বসে পড়ল।

বুকের ভিতর জাগল থরথর কম্পন! দুই পদ হয়ে উঠল চঞ্চল—দিকবিদিক জ্ঞানহারা হয়ে পলায়ন করবার জন্যে। তারপরেই বিশেষজ্ঞ শিকারিদের কথা মনের মধ্যে জেগে উঠল বিদ্যুতের মতন!—ব্যাঘ্র বা সিংহের সামনে গিয়ে পড়লে দৃষ্টি অন্যদিকে ফেরাতে নেই; এমনকী চোখের পাতা ফেলাও নাকি অনুচিত। তীব্র দৃষ্টিতে যদি শ্বাপদের দিকে নিষ্পলক নেত্রে তাকিয়ে থাকো, তাহলে তারা তোমাকে আক্রমণ করতে ভরসা করবে না।

একথা সত্যি কিনা জানি না, কিন্তু সেই বাঘটার দিকে চোখাচোখি খানিকক্ষণ তাকিয়ে থাকবার পরে, সে অস্ফুট স্বরে গর্জন করলে, তারপর অন্যদিকে মুখ ফিরিয়ে এমনভাবে আবার জঙ্গলের ভিতরে গিয়ে ঢুকল যে, যেন সে চোখের সামনে দেখতেই পায়নি আমার মতো মনুষ্যত্বের ক্ষুদ্র নমুনাকে!

কিন্তু আমি আশ্বস্ত হতে পারলুম না। বাঘ বনে ঢুকেছে বটে, কিন্তু আবার বেরিয়ে আসতে কতক্ষণ! সুতরাং তার পুনরাবির্ভাবের আগেই যথাসম্ভব দ্রুতবেগে পদযুগলকে চালনা করাই উচিত।

তাই করলুম। ছুটলুম। পাগলের মতন ছুটতে ছুটতে বনের ভিতরে—আরও ভিতরে গিয়ে পড়লুম। কাঁটাঝোপে সর্বাঙ্গ ক্ষতবিক্ষত হয়ে গেল, কিন্তু কাঁটাঝোপ আজ আমাকে কোনো যন্ত্রণাই দিতে পারলে না। নির্জন অরণ্যে, গভীর রাত্রে বাঘের সঙ্গে দেখা হলে মানুষের মনের যে কী অবস্থা হয়, সেটা কারুকে লিখে বোঝানো যাবে না। মানুষ তখন হয় উন্মাদগ্রস্ত!

আচম্বিতে সামনে পেলুম অভাবিত আশ্রয়! গভীর অরণ্যের ছায়া যেখানে গাঢ় থেকে গাঢ়তর হয়ে উঠেছে, সেইখানে দেখলুম ভাঙাচোরা প্রকাণ্ড একখানা অট্টালিকা। তার সর্বাঙ্গে অশথ-বটের উপদ্রব এবং এক একটা গাছ এত বড়ো যে তার উপরে হয়তো একটা হস্তী আরোহণ করলেও শাখাপ্রশাখার কোনোই ক্ষতি হবে না। সেখানে উপর দিকে তাকিয়ে চন্দ্রপুলকিত আকাশকে পর্যন্ত দেখা যাচ্ছিল না এবং সেখানে নীচের দিকে তাকালে পায়ের তলায় সাপ আছে কী ব্যাঙ আছে তাও দেখতে পাওয়া যায় না।

সেই ব্যাঘ্রচার্য বৃহৎ-লাঙ্গুল আমার পশ্চাতে ধাবমান হয়েছিল কিনা আমি তা জানি না, কিন্তু আবার কানে লাগল প্রচণ্ড ব্যাঘ্রের গর্জন! এটা সেই বাঘের কিংবা অন্য বাঘের ডাক তা আমি বলতে পারি না, তা বলবার কোনো দরকার নেই; কারণ যে-বাঘই ডাকুক সে মানুষের বন্ধু হতে পারে না!

অতএব আর কোনো কথা না ভেবেই আমি পাগলের মতন সেই অট্টালিকার একটা ভাঙা জানলা বা দরজার মধ্য দিয়ে গিয়ে পড়লুম নিবিড় এক অন্ধকারের রাজ্যে!

কিছুক্ষণ স্তব্ধ হয়ে দাঁড়িয়ে রইলুম। বুকের কাঁপুনি এমন দ্রুত হয়ে উঠেছিল যে মনে হচ্ছিল এখনি বন্ধ হয়ে যাবে আমার শ্বাস-প্রশ্বাস। তখন ভালো লাগছিল আমার অন্ধকারকেই, মনে হচ্ছিল এই অন্ধকারের ভিতর থেকে কেউ আমাকে আর আবিষ্কার করতে পারবে না।

বাঘের ডাক আর শোনা গেল না। চারিদিকে নিদ্রিত নীরবতা। বাতাসের নিঃশ্বাস পর্যন্ত শোনা যাচ্ছে না এবং শোনা যাচ্ছে না গাছপালাদের কোনো মর্মর উক্তি।

কিন্তু শিকারিদের আর একটা কথাও মনে পড়ল। ব্যাঘ্রে বা সিংহরা অরণ্যের মধ্যে ঘন ঘন গর্জন করে বটে, কিন্তু যখন তারা শিকারের সন্ধান পায় তখন অবলম্বন করে একেবারে মৌনব্রত। এখনি যে বাঘটা ডাকছিল সে কি আমাকে দেখতে পেয়েছে? সে কি মৃত্যুর মতো নীরবে পায়ে পায়ে এগিয়ে আসছে আমার দিকে ধীরে ধীরে? যে পথ দিয়ে আমি এই অট্টালিকায় ঢুকেছি, সেই পথ দিয়ে সেও তো আসতে পারে আমার পিছনে পিছনে?

যাঁহাতক এই কথা মনে হওয়া তখনি শিউরে উঠল আমার সর্বাঙ্গ। কে জানে নিঃশব্দ পদসঞ্চারে এতক্ষণে সে প্রায় আমার কাছেই এসে হাজির হয়েছে কিনা! কে জানে এখনি সে আমার ঘাড়ে লাফিয়ে পড়বার জন্যে প্রস্তুত হচ্ছে কিনা! সেই নীরন্ধ্রে অন্ধকারের চতুর্দিকেই দেখতে লাগলুম মানুষের রক্তলোলুপ ব্যাঘ্রের ভয়াবহ মূর্তি! আর সেখানে দাঁড়িয়ে থাকতে ভরসা হল না।

কাছে ছিল একটি বিশেষ শক্তিশালী বৃহৎ টর্চ। একবার অন্ধকারের চারিদিকে বুলিয়ে নিলুম তার আলোক-হস্ত। যদিও কাছাকাছি কোথাও দেখতে পেলুম না কোনো ভয়ংকরকে, তবু মনে হল এ স্থান ত্যাগ করাই হচ্ছে বুদ্ধিমানের কার্য।

টর্চের আলো এদিকে-ওদিকে ঘুরিয়ে ঘুরিয়ে দেখে বুঝলুম, আমি দাঁড়িয়ে আছি প্রকাণ্ড একটা উঠানের উপরে। উঠানের চতুর্দিকেই বড়ো বড়ো স্তম্ভ বা স্তম্ভের ধ্বংসাবশেষ। এবং উঠান জুড়ে বিরাজ করছে যতসব বড়ো বড়ো আগাছার সভা। খানিক তফাতে দরদালানের একপ্রান্তে দেখলুম, উপর দিকে উঠে গিয়েছে প্রশস্ত সোপানশ্রেণি।

আবার জাগ্রত হল অতি নিকটেই ব্যাঘ্রের ভৈরব গর্জন—থরথর কেঁপে উঠল যেন বনবাসী রাত্রির একান্ত স্তব্ধতা।

আমি পাগলের মতন দৌড় দিলুম সেই সোপানশ্রেণি লক্ষ করে।

বোধ হয় কয়েক ইঞ্চি পুরু ধুলোভরা সিঁড়ির উপর দিয়ে দ্রুত পদচালনা করে আমি উঠে গিয়ে দাঁড়ালুম দ্বিতলের দরদালানে। সামনের দিকে টর্চের আলোক নিক্ষেপ করে দেখলুম, সেই সুদীর্ঘ দালানটা চলে গিয়েছে আলোকশিখার বাইরে ক্রমবর্ধমান অন্ধকারের দিকে। এ বাড়িখানা কত বড়ো? এখানা কি আগে কোনো রাজবাড়ি ছিল?

কয়েক পদ অগ্রসর হয়েই ডানদিকে পেলুম বৃহৎ এক দরজা; যদিও সে দরজার একখানা পাল্লাও বর্তমান ছিল না। সেই পথ দিয়ে ভিতরে ঢুকে দেখলুম মস্ত বড়ো একখানা ঘর, তার মধ্যে কয়েক শত লোকের ঠাঁই হতে পারে অনায়াসেই। চারিদিকে ধুলা ও মলিনতার চিহ্ন, কিন্তু পঙ্খের কাজ-করা দেওয়ালের দিকে তাকিয়েই বুঝলুম, এ-বাড়ির যিনি মালিক ছিলেন তিনি নিশ্চয়ই সাধারণ লোক নন। তিনি কে? হয়তো আজ তিনি পরলোকে, কিন্তু তাঁর বংশধররা কোথায়? কেন তাঁরা এত বড়ো একখানা রাজভোগ্য অট্টালিকাকে বিসর্জন করে গিয়েছেন নির্জন অরণ্যের কবলে? এমন চমৎকার প্রাসাদের প্রতি এমন অবহেলার কারণ কী?

আচম্বিতে দূরে—বহুদূরে সেই রহস্যময় অট্টালিকার কোনো প্রান্ত থেকে জাগ্রত হল একটা অদ্ভুত ধ্বনি! এ ব্যাঘ্রের গর্জন নয়, এ যেন কোনো অমানুষিক কণ্ঠের হা-হা-হা-হা অট্টহাস্যের তরঙ্গ! এই অট্টহাস্যের মধ্যে ফুটে উঠেছে কোনো নিদারুণ ক্ষুধা, যেন কোনো মারাত্মক, হিংস্র ও উৎকট আনন্দ! সঙ্গে সঙ্গে মনে হল যেন বাড়ির উঠানের মধ্য থেকেই ডেকে উঠছে এক হত্যাকারী ব্যাঘ্রের নিষ্ঠুর কণ্ঠস্বর! বাঘ তাহলে মানুষের গন্ধ পেয়ে বাড়ির ভিতরে এসেই ঢুকেছে? কিন্তু অমন বীভৎস স্বরে কে করলে অট্টহাস্য? কেন সে হাসলে? তার হাসির অর্থ কী?

বাঘের ডাক থামল, কিন্তু সেই বিশ্রী অট্টহাসি আর থামল না। এবং বেশ বুঝলুম, সেই অট্টহাসি যেন রীতিমতো দ্রুতবেগেই আমার কাছে এগিয়ে আসছে—আর এগিয়ে আসছে— আর এগিয়ে আসছে!

প্রথমটা যেন আচ্ছন্ন হয়ে গেল আমার আপাদমস্তক। মনে হল আমি যেন আর এই পৃথিবীর মধ্যে নেই, অকস্মাৎ এসে পড়েছি কোনো অপার্থিব জগতে!

ওদিকে সেই অট্টহাস্য এগিয়ে আসছে আর এগিয়ে আসছে! প্রাণপণে নিজেকে সামলে নিলুম। তাড়াতাড়ি আবার চারিদিকে আলোক নিক্ষেপ করে দেখলুম, ঘরের মাঝখানে ছাদের ভার বহন করছে সারি সারি অনেকগুলো স্তম্ভ। একদিকের সর্বশেষ স্তূপটা ভেঙে পড়েছে এবং গৃহতলে পড়ে রয়েছে তার ইষ্টকরাশির স্তূপ। আমি দ্রুতপদে সেই ইষ্টকস্তূপের অন্তরালে গিয়ে আত্মগোপন করবার চেষ্টা করলুম।

নিজেকে যথাসম্ভব ছোটো করে ইষ্টকরাশির আড়ালে উবু হয়ে বসে আছি। আর শোনা যায় না বাঘের ডাক, কিন্তু সেই ভয়াবহ অট্টহাসির তরঙ্গ যেন অনন্ত! সেই নির্দয় হাস্যধ্বনি আসছে, আসছে, নিশ্চিত রূপেই এগিয়ে আসছে এই ঘরের দিকে। এমন হাসি যে হাসছে তার এতটা উৎকট আনন্দের কারণ কী? এরকম হাসি জীবনে আমি কোনো মানুষের কণ্ঠে শ্রবণ করিনি! তবে কি আমি এমন কোনো স্থানে এসে পড়েছি যেখানকার সঙ্গে পৃথিবীর মানুষের নেই কোনো সম্পর্কই? আছে কি এখানে এমন কোনো বহুযুগের উপবাসী প্রেতাত্মা, আজ হঠাৎ শরীরীর সন্ধান পেয়ে যে-অশরীরীর অতৃপ্ত ক্ষুধার আনন্দ জাগ্রত হয়ে উঠেছে অনেক দিনের পরে!

আসছে আর আসছে! এগিয়ে আসছে অট্টহাস্য! তারপর আমি শুনতে পেলুম যেন সেই অট্টহাস্যেরই প্রচণ্ড পদশব্দ! ধুপ, ধুপ, ধুপ! এই ভারী ভারী পদশব্দ যেন কোনো মত্তহস্তীর! যেন কোনো অতিকায় বীভৎস দানব দালান কাঁপিয়ে করছে পদচালনা!

আমার শ্বাস-প্রশ্বাস বন্ধ হয়ে এল। সেই অবস্থায় সভয়ে ইষ্টকস্তূপের আড়ালে উঁকি মেরে দ্বারপথ দিয়ে দেখলুম, পূর্ণিমার পরিপূর্ণ চাঁদের আলো এসে উজ্জ্বল করে তুলেছে সেইখানটা।

আচম্বিতে সেই আলোকসীমার মধ্যে আবির্ভূত হল কল্পনাতীত অপচ্ছায়ার মতন ভীষণ এক মূর্তি। উচ্চতায় সে সাত ফুটের কম হবে না এবং তার মাথা থেকে দেহের উপরে ঝুলে লটপট করছে বিষাক্ত সর্পের মতন কতকগুলো জটা! সেই অমানুষিক মূর্তি প্রবেশ করলে এই ঘরের ভিতরেই। নিবিড় অন্ধকার ভেদ করে দপ দপ করে জ্বলছে তার দুটো অগ্নিময়, বন্য দৃষ্টি। যেন কোনো হতভাগ্যকে অন্বেষণ করছে সেই দুটো নির্মম অগ্নিচক্ষু!

আমি আবার আরও ছোটো হয়েই যেন ইষ্টকস্তূপের সঙ্গে মিলিয়ে যাবার চেষ্টা করলুম— উঁকি মেরে আর কিছু দেখবার ভরসা হল না।

এবং সেই অবস্থাতেই শুনলুম কার ভারী ভারী পায়ের শব্দ গৃহতলকে করে তুলছে প্রকম্পিত! কে যেন কাকে খুঁজে খুঁজে বেড়াচ্ছে, কিন্তু তাকে খুঁজে পাচ্ছে না!

প্রাণের আশা ছেড়ে দিয়ে মনে মনে জপ করছি ইষ্টমন্ত্র! কিন্তু আচম্বিতে আমাকে ইষ্টমন্ত্র ভুলিয়ে কানের খুব কাছেই আবার জাগ্রত হয়ে উঠল ভৈরব অট্টহাস্য! বেশ বুঝলুম সেই অমানুষিক ভয়ংকর একেবারে আমার পাশেই এসে যেন আমাকে দেখতে পেয়েই বিকট উল্লাসে অট্টহাস্য করে উঠছে! আমি প্রায় অজ্ঞানের মতো স্থির হয়ে পড়ে রইলুম—জীবনের সব আশা ছেড়ে দিয়ে।

তারপরে দুঃস্বপ্ন-লোকের মধ্যেই শুনতে পেলুম সেই নিবিড় অন্ধকারকে মন্থিত করে কার গুরু গুরু পদধ্বনি ধীরে ধীরে আবার চলে যাচ্ছে ঘরের বাইরের দিকে। ক্রমে দূরে মিলিয়ে গেল পায়ের শব্দ, যদিও তখনও শোনা যেতে লাগল আকাশ-ফাটানো বাতাস-কাঁপানো সেই অট্টহাস্যের পর অট্টহাস্যের তরঙ্গ!

আর আমার সেখানে থাকবার সাহস হল না। ওই বিরাট মূর্তি কারুকে যে খুঁজছে সে-বিষয়ে আর কোনোই সন্দেহ নেই। ও যে মানুষ নয়, তাও অনুমান করতে পারলুম। খুঁজতে খুঁজতে ওই মূর্তি যদি আবার এখানে ফিরে আসে! এবং এবারে এসে সে যদি আমাকে আবিষ্কার করে ফেলে! তাড়াতাড়ি সমস্ত জড়তা ত্যাগ করে দাঁড়িয়ে উঠলুম। নীচে বাঘ আছে? থাকগে বাঘ, বাঘ তো এই মানুষের পৃথিবীর জীব। মরতে হয় তো তার কবলে পড়েই মরব!

টর্চের আলো জ্বেলে ঘর থেকে বেরিয়ে এলুম উদভ্রান্তের মতো। তারপর বিদ্যুৎবেগে প্রায় পড়ি-পড়ি অবস্থায় সিঁড়ি দিয়ে নেমে এলুম একতলায়! এবং তারপর সেই অভিশপ্ত বাড়ি থেকে বেরিয়ে আবার গিয়ে পড়লুম নিস্তব্ধ জঙ্গলের মধ্যে!

সেইখান থেকেই শুনতে পেলুম বাঘের গর্জন নয়, আরও জোরে হেসে উঠল কে যেন বিকট অট্টহাসি হা-হা-হা-হা-হা-হা! এটা বুঝতেও দেরি হল না যে, সেই অসম্ভব অট্টহাসি উপর থেকে নেমে আসছে নীচের দিকে! এতক্ষণে সে যেন নিশ্চিতভাবেই আমার সন্ধান পেয়েছে।

প্রায় বাহ্যজ্ঞান হারিয়ে ছুটতে লাগলুম বনের ভিতর দিয়ে। অট্টহাসি যে তখনও আমার পিছনে পিছনে আসছে, সেটাও শুনতে পেলুম আমি!

সেইসঙ্গে শুনতে পেলুম আর একটা শব্দ। অদূরে সমস্বরে গান গাইছে একদল লোক। সেই সম্মিলিত কণ্ঠের সংগীতের মধ্যে ফুটে উঠেছে এক জীবন্ত পৃথিবীর আশা আার ভাষা! ছুটতে ছুটতে বন গেল ফুরিয়ে, আবার পেলুম মানুষের পায়ে-চলা প্রকাশ্য পথ।

পূর্ণিমার জ্যোতির্ময় আশীর্বাদে সমুজ্জ্বল আকাশ এবং পৃথিবী। বনপ্রান্তের পথ দিয়ে চলেছে একসঙ্গে গান গাইতে গাইতে পনেরো-ষোলোজন লোক।

স্রোতে ডুবন্ত মানুষ যেমন হঠাৎ ভাসন্ত ভেলা পেলে প্রাণপণে তাকে জড়িয়ে ধরে, সেইভাবেই আমি তাদের ভিতর গিয়ে পড়ে একজনকে সজোরে জড়িয়ে ধরে বলে উঠলুম, ‘বাঁচাও, আমাকে বাঁচাও!’

তাদের গান গেল থেমে।

সবিস্ময়ে সকলে চারিদিক থেকে আমাকে ঘিরে দাঁড়াল, একজন হিন্দি ভাষায় জিজ্ঞাসা করলে, ‘কী হয়েছে বাবুজি, কী হয়েছে?’

‘আগে বাঘ, তারপর ভূতে আমাকে তাড়া করেছে! তোমরা মানুষ, আমাকে রক্ষা করো!’

অল্পক্ষণের স্তব্ধতা…

তারপর তাদের একজন শুধোলে, ‘কী বলছেন বাবুজি? এ বনে বাঘ আছে জানি, সেইজন্যেই সকলে মিলে চেঁচিয়ে গান গেয়ে বাঘকে জানিয়ে দিতে দিতে চলেছি, দলে আমরা দস্তুরমতো ভারী! কিন্তু ভূত কোথায়? আপনি ভূতের কথা কী বলছেন?’

খানিকক্ষণ স্তব্ধ হয়ে নিজের চঞ্চলতা ও অধীরতাকে দমন করলুম। তারপর সংক্ষেপে আজকের সমস্ত কথা বলে গেলুম।

তখন একজন লোক বললে, ‘ও, আপনি বুঝি নবাব বাহাদুরের বাড়িতে গিয়ে পড়েছিলেন?’

আমি জিজ্ঞাসা করলুম, ‘নবাব বাহাদুর কে?’

‘এই বনের ভেতরে মস্ত একখানা বাড়ি আছে। আপনি কি সেই বাড়িতেই গিয়েছিলেন?’

‘হ্যাঁ।’

‘তাহলে সবই বোঝা যাচ্ছে। ও বাড়িখানা হচ্ছে নবাব বাহাদুরের বাড়ি। প্রায় এক-শো বছর আগে এ-অঞ্চলে নবাব বাহাদুরের মতো ধনী আর শক্তিশালী লোক আর কেউই ছিলেন না। নবাব বাহাদুরের মৃত্যুর পর থেকেই তাঁর বংশের অধঃপতন আরম্ভ হয়। এখন ওই বংশের শেষ অধিকারী অর্থাভাবে পাগল হয়ে গিয়েছেন। কিন্তু সেই উন্মত্ত অবস্থাতেও তিনি ওই বাড়ির ভিতরেই বাস করেন। কী করে যে তাঁর দিন চলে আমরা তা জানি না, কিন্তু ওই বাড়ির ভিতরে দৈবগতিকে বাইরের কোনো লোক গেলে তিনি তাকে হিংস্র পশুর মতন আক্রমণ করেন। আপনার খুব বরাত জোর, তাই সেখান থেকে প্রাণ নিয়ে ফিরে আসতে পেরেছেন।’

আমি বললুম, ‘কিন্তু যে মূর্তি আমি দেখেছি তা পৃথিবীর কোনো নবাব বাহাদুরের বংশধরের মূর্তি নয়। এত বড়ো অমানুষিক মূর্তি জীবনে আমি আর কখনো দেখিনি!’

যে কথা কইছিল সে বললে, ‘ঠিক তাই। নবাব বাহাদুরের শেষ বংশধরের মূর্তি হচ্ছে সাত ফুটের চেয়েও লম্বা! শুধু দীর্ঘতা নয়, চওড়াতেও সে মূর্তি হচ্ছে আশ্চর্য! রাতের আবছায়াতে সেই উন্মত্তের বিপুল দেহ দেখলে কেউ মানুষের মূর্তি বলে ভাবতেই পারে না।’

আমি আর কোনো কথা বললুম না। আজকের অদ্ভুত ঘটনা আমার জীবনে হয়ে থাকবে চিরস্মরণীয়।

সকল অধ্যায়

১. পোড়োবাড়ি
২. ছায়া, না কায়া?
৩. জীবন মৃত্যু
৪. স্বপ্ন হলেও সত্য
৫. ভৌতিক চক্রান্ত
৬. জুজুর ভয়
৭. ভূতের ভয়
৮. ভূত যখন বন্ধু হয়
৯. গঙ্গার বিভীষিকা
১০. এথেন্সের শেকল বাঁধা ভূত
১১. বাদশার সমাধি
১২. কে?
১৩. মূর্তি
১৪. অভিশপ্ত নীলকান্ত
১৫. মিসেস কুমুদিনী চৌধুরি
১৬. কী?
১৭. পোড়ো মন্দিরের আতঙ্ক
১৮. চিলের ছাতের ঘর
১৯. ওলাইতলার বাগানবাড়ি
২০. আয়নার ইতিহাস
২১. খামেনের মমি
২২. বাঁদরের পা
২৩. রামস্বামীর উপল মণি
২৪. ক্ষুধিত জীবন
২৫. বাড়ি
২৬. বাড়ি, বুড়ো, বুট
২৭. শয়তান
২৮. বন্দি আত্মার কাহিনি
২৯. আধখাওয়া মড়া
৩০. ভেলকির হুমকি
৩১. জ্বলন্ত চক্ষু
৩২. আজও যা রহস্য
৩৩. শয়তানি-জুয়া
৩৪. কোর্তা
৩৫. রহস্যময় বাড়ি
৩৬. বাঘের চোখ
৩৭. জীবন্ত মৃতদেহ
৩৮. মানুষ, না পিশাচ
৩৯. জাগ্রত হৃৎপিণ্ড
৪০. অভিশপ্ত মূর্তি
৪১. ঐন্দ্রজালিক
৪২. টেলিফোন
৪৩. ভূতের রাজা
৪৪. অভিশপ্তা
৪৫. সূর্যদেবতার পুরোহিত
৪৬. অদৃশ্যের কীর্তি
৪৭. নসিবের খেলা
৪৮. ভৌতিক, না ভেলকি?
৪৯. ছায়া—কায়া—মায়া
৫০. বিছানা
৫১. ‘বাজলে বাঁশি কাছে আসি’!
৫২. কঙ্কাল-সারথি
৫৩. লোটা
৫৪. মাঝরাতের ‘কল’
৫৫. এক রাতের ইতিহাস
৫৬. কিন্তু
৫৭. পেপির দক্ষিণ পদ
৫৮. কিসমৎ
৫৯. কায়া কি ছায়া কি মায়া
৬০. নবাব কুঠির নর্তকী
৬১. ডাকবাংলো
৬২. তবে
৬৩. মামূর্তের দানব-দেবতা
৬৪. দিঘির মাঠে বাংলো
৬৫. নবাব বাহাদুরের বংশধর
৬৬. মুক্তি
৬৭. পিশাচ
৬৮. মৃতদেহ
৬৯. নবাবগঞ্জের সমাধি
৭০. ভীমে-ডাকাতের বট
৭১. নরকের রাজা
৭২. কলকাতার বিজন দ্বীপে
৭৩. রুদ্রনারায়ণের বাগানবাড়ি

নোট নিতে এবং টেক্সট হাইলাইট করতে লগইন করুন

লগইন