বাঘের চোখ

হেমেন্দ্রকুমার রায়

[অতঃপর যে অত্যাশ্চর্য কাহিনিটি বর্ণনা করব, বিখ্যাত শিকারিদের কাছে তা সুপরিচিত। কিন্তু আজ পর্যন্ত এই অরণ্য-রহস্যের কোনো হদিশ খুঁজে পাওয়া যায়নি।

কিছুকাল আগের কথা। ঘটনাস্থল হচ্ছে পূর্ণিয়ার চতুঃপার্শ্ববর্তী বনভূমি। তখন ও-অঞ্চলে নীল, চা ও পাটের ব্যবসার উপলক্ষ্যে অনেক ইংরেজ গিয়ে আস্তানা পেতেছিলেন। তাঁদেরই মধ্যে একজন কুঠিয়ালদের মুখে গল্পটি তোমরা শোনো।]

বেয়ারাদের মুখে খবর পেলুম, নিকটবর্তী ছোটো জঙ্গলে কোনো বাঘ একটা মহিষের বাচ্চা মেরে রেখে গিয়েছে। তখনি ঘোড়ায় চড়ে ঘটনাস্থলে গিয়ে হাজির হলুম। মড়ি বা পশুর মৃতদেহটা প্রায় অক্ষত অবস্থাতেই আছে। সেটাকে উদরস্থ করবার জন্যে বাঘ যে আবার ফিরে আসবে, তাতে আর সন্দেহ নেই।

এদিক-ওদিক তাকিয়ে মাচান বাঁধবার উপযুক্ত কোনো গাছ দেখতে পাওয়া গেল না।

কিন্তু মড়ি থেকে প্রায় বিশ ফুট দূরে জমি হঠাৎ ঢালু হয়ে একটা খাতের মতো জায়গা সৃষ্টি করেছে। তার চারদিকে কতগুলো কাঁটাগাছের ঝোপঝাপ সাজিয়ে দিলে লুকোবার কোনো অসুবিধাই হবে না। অনুচরদের সেই ব্যবস্থা করতে বলে তখনকার মতো বাংলোয় ফিরে এলুম।

সন্ধ্যার মুখেই কিছু খাবার, জল আর বন্দুক নিয়ে যথাস্থানে গিয়ে হাজির হলুম। সাঙ্গোপাঙ্গদের ওপরে নির্দেশ রইল, বন্দুকের শব্দ শুনলেই তারা যেন আবার এসে দেখা দেয়।

কাঁটাঝোপের মাঝখানে গিয়ে আমি আসন গ্রহণ করলুম। ঝোপের এক জায়গা অল্প ফাঁক করে রাখলুম—বন্দুক ব্যবহার করবার জন্যে। শুক্লপক্ষের রাত, চাঁদের আলো থাকবে, বাঘের আবির্ভাব হলেই জানতে পারব।

নিবে গেল দিনের আলো, সন্ধ্যার অন্ধকার ক্রমেই পুরু হয়ে গড়িয়ে চলল নিরালা রাত্রির বুকে। মনকে অভিভূত করে দিলে বন্য স্তব্ধতার রহস্য। চাঁদ উঠল, আমিও প্রস্তুত হলুম। এখন বাঘের দেখা পাওয়া যেতে পারে যেকোনো মুহূর্তে।

কিন্তু হঠাৎ বাঘের বদলে যাকে দেখলুম, আমার বিস্ময়ের সীমা রইল না। সেখানে এসে উপস্থিত হল প্রকাণ্ড এক বানর, ভাবটা তার নিতান্ত উদাসীন। এই রাতে, এমন জায়গায়, বানর? আমি জানতুম বানররা বাঘদের ভয় করে যমের মতো, অথচ এই বানরটা বাঘের রেখে যাওয়া মড়ির কাছে এসেছে একেবারে বেপরোয়া হয়ে। সত্যিই বিস্ময়জনক ব্যাপার!

তারপর যা হল, অধিকতর বিস্ময়কর। মড়ির কাছে এসেই বানরটার ভাবভঙ্গি একেবারে বদলে গেল। নিশ্চয় সে আমার গন্ধ পেয়েছে! মড়ির চারপাশে মণ্ডলাকারে ঘুরে সে সোজা এগিয়ে এল আমার দিকে। তারপর ঝোপের ফাঁক দিয়ে উঁকি মেরে আমাকে দেখেই তীব্র চিৎকার করতে করতে বেগে ছুটে অদৃশ্য হয়ে গেল!

আমার পক্ষে তার এই ব্যবহার ছিল সম্পূর্ণ কল্পনাতীত! সে ঠিক মানুষের মতোই যেভাবে আমাকে আবিষ্কার করল, আমি তার মধ্যে পেলুম যেন কোনো অমঙ্গলের ইঙ্গিত! মনের ভিতরে অত্যন্ত অস্বস্তি অনুভব করতে লাগলুম।

যে জঙ্গলের ভেতর থেকে কাঁটাঝোপ এনে এখানে সাজানো হয়েছিল, সেখানটা এর চেয়ে নিরাপদ মনে হল। তাড়াতাড়ি আমি সেইখানে গিয়েই আত্মগোপন করলুম।

তারপর মিনিট দশেকের বেশি অপেক্ষা করতে হল না।

বানরটা যেদিকে অদৃশ্য হয়েছিল, ঠিক সেইদিক থেকেই জঙ্গলের বাইরে লাফিয়ে আত্মপ্রকাশ করল মস্তবড়ো এক বাঘ! কিছুমাত্র দ্বিধা না-করেই বেগে দৌড়ে সে বিকট গর্জন করে লাফিয়ে পড়ল আমার সেই সাজানো কাঁটাঝোপের ভেতরে! যেন সে আগে থাকতেই যেকোনোরকমে জানতে পেরেছে, ঠিক ওই ঝোপের মধ্যেই লুকিয়ে আছে এক দুষ্ট মানুষ! কিছুক্ষণ গজরাতে- গজরাতে ঝোপ তোলপাড় করে তুলে শিকারির পাত্তা না-পেয়ে সে আবার বাইরে এসে দাঁড়াল। তখন তার ভাবভঙ্গি দস্তুরমতো হতভম্বের মতো! যেন সে ভেবে পাচ্ছিল না শিকারিটা কেমন করে পালিয়ে গেল?

কিন্তু আমি তাকে বেশিক্ষণ ভাবনাচিন্তার অবসর দিলুম না। বাঘটাকে স্পষ্ট দেখতে পাচ্ছিলুম চোখের সামনে। সাবধানে লক্ষ্য স্থির করে বন্দুকের ঘোড়া টিপে দিলুম। এত কাছ থেকে লক্ষ্য ব্যর্থ হওয়া অসম্ভব—শূন্যে লাফ মেরে বাঘটা আবার মাটির ওপরে আছড়ে পড়ল। খানিকক্ষণ ছটফট করে নিশ্চেষ্ট হয়ে গেল।

কিছুক্ষণ অপেক্ষা করবার পর জঙ্গলের ভেতর থেকে বেরিয়ে এলুম। সন্তর্পণে মাটির একটা চাপড়া তুলে নিয়ে বাঘটাকে ছুড়ে মারলুম। তবু সে নড়ল না দেখে বোঝা গেল, বাঘটা আর বেঁচে নেই।

আচম্বিতে পিছনে শুনলুম ভগ্নস্বরে এক আর্তনাদ! সচমকে ফিরে দেখি, সেই ধেড়ে বানরটা দাঁত-মুখ খিঁচিয়ে তেড়ে আসছে আমার দিকে! বন্দুকের এক গুলিতে আমি তার আক্রমণ ব্যর্থ করে দিলুম।

কিন্তু মৃত্যুমুখে পড়েও বানরটা প্রাণপণে আরও একটু এগিয়ে বাঘের মৃতদেহের ওপরে গিয়ে লম্বমান হল!

ইতিমধ্যে বন্দুকের শব্দ শুনে আমার সাঙ্গোপাঙ্গরা এসে পড়ল। বাঘের সঙ্গে আলিঙ্গনবদ্ধ বানরের মৃতদেহ দেখে সকলের দৃষ্টি বিস্ফারিত হয়ে উঠল! তাদের মধ্যে ছিল সাঁওতাল জাতীয় এক বুড়ো শিকারি।

সঙ্গীদের দিকে ফিরে সে বললে, ‘দেখছিস তো, আমার কথা সত্যি কিনা? বাঘে মানুষ মারলে তার আত্মা বাঘের পিঠে চড়ে তাকে চালনা করে!’

সাঁওতালিদের ধারণা, মানুষখেকো বাঘের পিঠে বসে নিহত মানুষের প্রেতাত্মা তাকে চালনা করে বলেই সে শিকারিদের চেষ্টা ব্যর্থ করে দেয়।

এইবার আসল রহস্যের কথা বলা যাক।

মৃত বাঘের চামড়া ও মাথাটা পাঠিয়ে দেওয়া হল চর্ম-সংরক্ষণের দোকানে। সেখান থেকে খবর এল, জীবন্ত অবস্থায় বাঘটা ছিল অন্ধ!

এইখানেই সমস্যা। ধরলুম, যা অসম্ভব, তাই হয়েছে সম্ভবপর; অর্থাৎ বনের বাঘের সঙ্গে হয়েছে বানরের বন্ধুত্ব। এবং ধরলুম, কাঁটাঝোপের মধ্যে শত্রুর অস্তিত্বের কথা বানরই কোনোরকমে ঠারেঠোরে বাঘকে জানিয়ে দিয়েছিল।

কিন্তু বাঘ অন্ধ, চোখে দেখতে পায় না এবং বানরের ভাষাও তার পক্ষে জানা অসম্ভব। তবে কাঁটাঝোপের মধ্যে আমি আছি—এ কথা তার মাথায় ঢুকল কেমন করে?

সকল অধ্যায়

১. পোড়োবাড়ি
২. ছায়া, না কায়া?
৩. জীবন মৃত্যু
৪. স্বপ্ন হলেও সত্য
৫. ভৌতিক চক্রান্ত
৬. জুজুর ভয়
৭. ভূতের ভয়
৮. ভূত যখন বন্ধু হয়
৯. গঙ্গার বিভীষিকা
১০. এথেন্সের শেকল বাঁধা ভূত
১১. বাদশার সমাধি
১২. কে?
১৩. মূর্তি
১৪. অভিশপ্ত নীলকান্ত
১৫. মিসেস কুমুদিনী চৌধুরি
১৬. কী?
১৭. পোড়ো মন্দিরের আতঙ্ক
১৮. চিলের ছাতের ঘর
১৯. ওলাইতলার বাগানবাড়ি
২০. আয়নার ইতিহাস
২১. খামেনের মমি
২২. বাঁদরের পা
২৩. রামস্বামীর উপল মণি
২৪. ক্ষুধিত জীবন
২৫. বাড়ি
২৬. বাড়ি, বুড়ো, বুট
২৭. শয়তান
২৮. বন্দি আত্মার কাহিনি
২৯. আধখাওয়া মড়া
৩০. ভেলকির হুমকি
৩১. জ্বলন্ত চক্ষু
৩২. আজও যা রহস্য
৩৩. শয়তানি-জুয়া
৩৪. কোর্তা
৩৫. রহস্যময় বাড়ি
৩৬. বাঘের চোখ
৩৭. জীবন্ত মৃতদেহ
৩৮. মানুষ, না পিশাচ
৩৯. জাগ্রত হৃৎপিণ্ড
৪০. অভিশপ্ত মূর্তি
৪১. ঐন্দ্রজালিক
৪২. টেলিফোন
৪৩. ভূতের রাজা
৪৪. অভিশপ্তা
৪৫. সূর্যদেবতার পুরোহিত
৪৬. অদৃশ্যের কীর্তি
৪৭. নসিবের খেলা
৪৮. ভৌতিক, না ভেলকি?
৪৯. ছায়া—কায়া—মায়া
৫০. বিছানা
৫১. ‘বাজলে বাঁশি কাছে আসি’!
৫২. কঙ্কাল-সারথি
৫৩. লোটা
৫৪. মাঝরাতের ‘কল’
৫৫. এক রাতের ইতিহাস
৫৬. কিন্তু
৫৭. পেপির দক্ষিণ পদ
৫৮. কিসমৎ
৫৯. কায়া কি ছায়া কি মায়া
৬০. নবাব কুঠির নর্তকী
৬১. ডাকবাংলো
৬২. তবে
৬৩. মামূর্তের দানব-দেবতা
৬৪. দিঘির মাঠে বাংলো
৬৫. নবাব বাহাদুরের বংশধর
৬৬. মুক্তি
৬৭. পিশাচ
৬৮. মৃতদেহ
৬৯. নবাবগঞ্জের সমাধি
৭০. ভীমে-ডাকাতের বট
৭১. নরকের রাজা
৭২. কলকাতার বিজন দ্বীপে
৭৩. রুদ্রনারায়ণের বাগানবাড়ি

নোট নিতে এবং টেক্সট হাইলাইট করতে লগইন করুন

লগইন