বাঁদরের পা

হেমেন্দ্রকুমার রায়

অবনীবাবু বলেছিলেন, ‘আগ্রা থেকে আমি যখন ফতেপুর সিক্রিতে বেড়াতে গিয়েছি, সেই সময়ে এক ফকির এটা আমাকে দেয়। জিনিসটা আর কিছুই নয়—বাঁদরের একখানা পা।’

সুরেনবাবু আশ্চর্য হয়ে জিজ্ঞাসা করলেন, ‘বাঁদরের পা! সে আবার কী?’

অবনীবাবু বললেন, ‘বিশেষ কিছু নয়, বাঁদরের একখানা শুকনো পা। মিশরের লোকেরা যে-উপায়ে মানুষের মরা দেহকে শুকিয়ে রাখে, সেইরকম কোনো উপায়েই এই বাঁদরের পা-খানাকে শুকিয়ে রাখা হয়েছে—এই দেখুন,’ বলে তিনি পকেটের ভেতর থেকে একটা জিনিস বার করে দেখালেন।

সুরেনবাবুর স্ত্রী সুরমা কার্পেট বুনতে বুনতে মুখ তুলে শিউরে উঠে বললেন, ‘ম্যাগো, ওটাকে আপনি আবার পকেটে পুরে রেখেছেন? আপনার ঘেন্না করে না?’

সুরেনবাবু শুধোলেন, ‘এর গুণ কী?’

অবনীবাবু বললেন, ‘এর মহিমায় তিনজন লোকের তিনটি করে মনোবাঞ্ছা পূর্ণ হতে পারে।’

‘বলেন কী? এও কি সম্ভব?’

‘হ্যাঁ। প্রথম এক ব্যক্তি এই জিনিসটির গুণ পরীক্ষা করেছিল। তার প্রথম দুটি ইচ্ছার কথা জানি না, কিন্তু তৃতীয় বারে সে মরতে চেয়েছিল। তার সে ইচ্ছা পূর্ণ হয়েছে।’

‘কী ভয়ানক! আর কেউ এর গুণ পরীক্ষা করেছে?’

সুরেনবাবু একটা দুঃখের নিশ্বাস ফেলে বললেন, ‘হ্যাঁ, আমি করেছি। কিন্তু পরীক্ষা করে এইটুকুই বুঝেছি যে, অদৃষ্টে যা আছে তা ঘটবেই। নিয়তির বিরুদ্ধে কেউ যেতে পারে না। তাই এই জিনিসটাকে আজ আমি গঙ্গায় ফেলে দিতে যাচ্ছি।’

সুরেনবাবু বললেন, ‘সে কী কথা? আপনার কথা যদি সত্যি হয়, তাহলে তো বলতে হবে যে, এর শক্তি এখনও ফুরোয়নি! এখনও আর একজন লোক এর কাছে তিনটি ইচ্ছা প্রকাশ করতে পারে!’

‘তা পারে।’

‘তাহলে ওটা আমাকে দিন না কেন?’

সুরেনবাবু আঁতকে উঠে বললেন, ‘বলেন কী অবনীবাবু? আমি আপনার বন্ধু হয়ে এমন শত্রুর কাজ করতে পারব না!’

‘কেন?’

‘আপনি জানেন না, এ হচ্ছে কী সাংঘাতিক জিনিস! একে পরীক্ষা করা মানে হচ্ছে, অমঙ্গলকে ডেকে আনা।’

সুরেনবাবু সকৌতুকে হেসে বললেন, ‘আমি এসব গাঁজাখুরি কথা বিশ্বাসই করি না। তবু দেখাই যাক না, আপনার রূপকথার ভিতরে কতটুকু সত্য আছে। ওটাকে গঙ্গায় ফেলে না-দিয়ে আমার হাতেই দিয়ে যান।’

অবনীবাবু বললেন, ‘বেশ, আপনার কথাই থাকুক। কিন্তু যদি হিতে বিপরীত হয়, তাহলে শেষটা আমাকে যেন দুষবেন না। এই নিন—’

সুরমা বললেন, ‘হ্যাঁগো, এ যেন আরব্য উপন্যাসের আলাদীনের প্রদীপের গল্প! তোমার বন্ধুর মাথা খারাপ হয়ে গেছে।’

সুরেনবাবু বললেন, ‘আমারও তাই বিশ্বাস। তবু মজাটা একবার দেখাই যাক না কেন। প্রথমে কী ইচ্ছা প্রকাশ করি, বলো তো?’

সুরমা বললেন, ‘আমাদের তো কোনোই অভাব নেই। ছেলের ভালো চাকরি হয়েছে, তুমি পেনশন পাচ্ছ, আমরা তো সুখেই আছি। তবে হ্যাঁ, আমার একটি ইচ্ছা আছে বটে। আমাদের বাড়িখানা অনেকদিন মেরামত হয়নি, আর বাগানের দিকে খানতিনেক ঘর তৈরি করলে ভালো হয়। এজন্যে হাজার পাঁচেক টাকার দরকার।’

সুরেনবাবু হো-হো করে হেসে বললেন, ‘হাজার পাঁচেক টাকা দরকার? তা আবার ভাবনা কী, এখনি তোমাকে দিচ্ছি।’—বলেই তিনি বাঁদরের সেই শুকনো পা-খানাকে হাতের উপরে রেখে বললেন, ‘আমাদের হাজার পাঁচেক টাকা দরকার—বুঝেছ, পাঁচ হাজার টাকা।’ তারপরেই তিনি আর্তনাদ করে বাঁদরের পা-খানাকে টেবিলের উপরে ফেলে দিলেন।

সুরমা ব্যস্ত হয়ে বললেন, ‘ওকী! অমন করে উঠলে কেন?’

সুরেনবাবু সভয়ে বললেন, ‘আমার ঠিক মনে হল, বাঁদরের ওই পা-খানা আমার হাতের ভিতরে নড়ে উঠল।’

সুরমা বললেন, ‘ও তোমার মনের ভুল। চলো, রাত হল, এখানে বসে আর পাগলামি করে না, খাবে চলো।’

সেই রাত্রে ঘুমিয়ে ঘুমিয়ে সুরেনবাবু স্বপ্ন দেখলেন, একটা বাঁদর যেন তাঁর পাশে শুয়ে আছে। তিনি তাড়া দিতেই সে বিছানা থেকে লাফিয়ে পড়ে পালিয়ে গেল। সুরেনবাবু দেখলেন, তার একখানা পা নেই!

পরদিন সকাল বেলায় চা পান করতে বসে সুরেনবাবু সুরমার কাছে কালকের রাতের স্বপ্নের কথা বলছিলেন।

সুরমা হেসে বললেন, ‘কিন্তু আজ ঘুম থেকে উঠে তুমি বিছানাটা ভালো করে খুঁজে দেখেছ তো? বাঁদরটা হয়তো আমাদের টাকা দিতে—’ বলতে বলতে থেমে পড়ে সুরমা চমকে উঠে সন্ত্রস্ত স্বরে বললেন—‘দেখো, দেখো!’

বাগানের একটা বট গাছের ঘন পাতার ভিতর থেকে একটা বানর মুখ বাড়িয়ে বসে আছে।

সুরেনবাবু সহজভাবেই বললেন, ‘পাড়ার ঘোষেদের বাড়িতে দুটো বাঁদর আছে জানো না? একটা কোনোগতিকে পালিয়ে এসেছে আর কী!’

বানরের মুখখানা আবার অদৃশ্য হয়ে গেল।

সুরমা বললেন, ‘আমার যেন কেমন ভয় ভয় করছে!’

সুরেনবাবু কী বলতে যাচ্ছিলেন এমন সময় ডাকপিয়োনের গলা পাওয়া গেল—‘রেজিস্টারি চিঠি আছে বাবু।’

সুরেনবাবু নীচে গিয়ে সই করে চিঠি নিয়ে এলেন। খামের উপরটা দেখেই তিনি বুঝলেন, চিঠিখানা এসেছে, রেল-অফিস থেকে। তাঁর পুত্র অমিয়কুমার রেল-অফিসের একজন বড়ো অফিসার।

চিঠির বক্তব্য এই:

 প্রিয় মহাশয়,

 আপনার পুত্র অমিয়কুমার সেন রেলের কোনো কাজে হাজারিবাগে গিয়েছিলেন। সেখানে জঙ্গলে পাখি শিকার করতে গিয়ে দুর্ভাগ্যক্রমে তিনি এক ব্যাঘ্রের দ্বারা আক্রান্ত ও নিহত হয়েছেন। অনেক অন্বেষণ করেও তাঁর দেহ পাওয়া যায়নি।

 এই শোচনীয় দুর্ঘটনার জন্যে আমরা অত্যন্ত দুঃখিত!

 রেলের ‘প্রভিডেন্ট-ফান্ডে’ আপনার পুত্রের পাঁচ হাজার টাকা জমা হয়েছে। এই টাকা নিয়ে যাবার ব্যবস্থা করবেন।

সুরেনবাবু পাগলের মতন চেঁচিয়ে বলে উঠলেন, ‘পাঁচ হাজার টাকা! পাঁচ হাজার টাকা!’ বলতে বলতে তিনি অজ্ঞান হয়ে গেলেন।

একমাস কেটে গেছে।

গভীর রাত্রি। সুরেনবাবু আর সুরমা পাথরের মূর্তির মতন বসে আছেন, তাঁদের চোখে ঘুম নেই।

অমাবস্যার রাত—আকাশ অন্ধকার। বাগানের বড়ো বড়ো গাছগুলো দমকা হাওয়ায় যেন কেঁদে-কেঁদে উঠছিল।

হঠাৎ সুরমা বলে উঠলেন, ‘ওগো! সেই বাঁদরের পা-টা কোথায় গেল?’

বাঁদরের পায়ের কথা সুরেনবাবু একেবারেই ভুলে গিয়েছিলেন। টেবিলের দিকে তাকিয়ে দেখলেন, সেইখানেই সেটা পড়ে রয়েছে। তিনি স্ত্রীকে বললেন, ‘ওই যে! কিন্তু ওর কথা জিজ্ঞাসা করছ কেন?’

সুরমা বললেন, ‘ওর কাছে এখনও তুমি দুটো ইচ্ছা প্রকাশ করতে পারো।’

সুরেনবাবু বললেন, ‘না, না। আর কোনো ইচ্ছা প্রকাশ করবার দরকার নেই। ওসব বাজে আজগুবি ব্যাপার।’

সুরমা বললেন, ‘না, না—আমি আমার ছেলেকে দেখতে চাই!’

সুরেনবাবু বললেন, ‘কী তুমি আবোল-তাবোল বকছ? কোথায় আমাদের অমিয়? বেঁচে থাকলে সে আপনিই আসত!’

সুরমা মাথা নেড়ে বললেন, ‘না, না, না। আমি তাকে দেখবই—তুমি ইচ্ছা করলে সে এখনি আসবে!’

সুরেনবাবু বললেন, ‘শোকে তোমার মাথা খারাপ হয়ে গেছে। আমার প্রথম ইচ্ছাটা ফলেছে দৈবগতিকে, বাঁদরের পায়ের জন্য নয়। ওর কোনো গুণ নেই। অসম্ভব কখনো সম্ভব হয় না!’

সুরমা কাঁদতে কাঁদতে বললেন, ‘তাহলে তুমি আমার কথা রাখবে না? আমার অমিয়কে দেখাবে না?’

সুরেনবাবু নাচার হয়ে বললেন, ‘বেশ, তুমি যখন কিছুতেই বুঝবে না, তখন কী আর করি বলো!’—এই বলে এগিয়ে গিয়ে টেবিলের উপর থেকে বাঁদরের পা-টা তুলে নিয়ে বললেন, ‘আমি আমার ছেলে অমিয়কে দেখতে চাই!’

বাইরে একটা প্যাঁচার চিৎকারের সঙ্গে সঙ্গে ঝোড়ো হাওয়া গোঁ গোঁ করে উঠল।

একটা টিকটিকি দেয়ালের উপরে টিক টিক করে ডাকলে।

তারপর সব স্তব্ধ।

সুরেনবাবু বললেন, ‘দেখলে তো, ও বাঁদরের পায়ের কোনো গুণই নেই? আমি এখন শুতে যাই, তুমিও এসো।’

সুরেনবাবু দুই পা অগ্রসর হলেন—সঙ্গে সঙ্গে সদর দরজাটা দুম করে খুলে যাবার শব্দ হল।

সুরমা ধড়মড় করে উঠে দাঁড়ালেন। ব্যগ্র স্বরে বললেন, ‘ও কে দরজা খুললে?’

সুরেনবাবু বিবর্ণ মুখে বললেন, ‘ও কেউ নয়, ঝোড়ো হাওয়ায় দরজাটা খুলে গেছে!’

সুরমা বললেন, ‘না গো না, আমার অমিয় আসছে, আমার অমিয় আসছে! আমি তার পায়ের আওয়াজ চিনি, সিঁড়িতে তার পায়ের শব্দ শুনছ না?’ বলতে বলতে তিনি ছুটে ঘরের বাইরে বেরিয়ে গেলেন।

সুরেনবাবু আড়ষ্ট হয়ে দাঁড়িয়ে রইলেন। কাঠের সিঁড়ির উপরে কার পায়ের শব্দ হচ্ছে বটে। হয়তো, ও-শব্দটা করছে তাঁর প্রকাণ্ড কুকুরটা।…কিন্তু যদি তা না হয়? যদি সত্যই অমিয় আসে? তাহলে সে কী মূর্তিতে আসবে? বাঘের আক্রমণে সর্বাঙ্গ ক্ষতবিক্ষত, মুণ্ডহীন, রক্তাক্ত দেহ—

সুরেনবাবু আর ভাবতে পারলেন না। শিউরে উঠে টেবিলের উপরে ঝাঁপিয়ে পড়ে বাঁদরের পা-টা আবার তুলে নিয়ে তাড়াতাড়ি তিনি তাঁর তৃতীয় বা শেষ ইচ্ছা প্রকাশ করলেন, ‘আমার ছেলে অমিয়কে আর আমি দেখতে চাই না!’

সিঁড়ির উপরে আর শব্দ শোনা গেল না।

খানিক পরে সুরমা নিরাশ মুখে ঘরে ফিরে এলেন।

সুরেনবাবু হাঁপাতে হাঁপাতে বললেন, ‘কী দেখলে?’

শ্রান্তভাবে চেয়ারের উপরে বসে পড়ে সুরমা বললেন, ‘বাইরে কেউ নেই, কিন্তু সদর দরজাটা খোলা!’

সকল অধ্যায়

১. পোড়োবাড়ি
২. ছায়া, না কায়া?
৩. জীবন মৃত্যু
৪. স্বপ্ন হলেও সত্য
৫. ভৌতিক চক্রান্ত
৬. জুজুর ভয়
৭. ভূতের ভয়
৮. ভূত যখন বন্ধু হয়
৯. গঙ্গার বিভীষিকা
১০. এথেন্সের শেকল বাঁধা ভূত
১১. বাদশার সমাধি
১২. কে?
১৩. মূর্তি
১৪. অভিশপ্ত নীলকান্ত
১৫. মিসেস কুমুদিনী চৌধুরি
১৬. কী?
১৭. পোড়ো মন্দিরের আতঙ্ক
১৮. চিলের ছাতের ঘর
১৯. ওলাইতলার বাগানবাড়ি
২০. আয়নার ইতিহাস
২১. খামেনের মমি
২২. বাঁদরের পা
২৩. রামস্বামীর উপল মণি
২৪. ক্ষুধিত জীবন
২৫. বাড়ি
২৬. বাড়ি, বুড়ো, বুট
২৭. শয়তান
২৮. বন্দি আত্মার কাহিনি
২৯. আধখাওয়া মড়া
৩০. ভেলকির হুমকি
৩১. জ্বলন্ত চক্ষু
৩২. আজও যা রহস্য
৩৩. শয়তানি-জুয়া
৩৪. কোর্তা
৩৫. রহস্যময় বাড়ি
৩৬. বাঘের চোখ
৩৭. জীবন্ত মৃতদেহ
৩৮. মানুষ, না পিশাচ
৩৯. জাগ্রত হৃৎপিণ্ড
৪০. অভিশপ্ত মূর্তি
৪১. ঐন্দ্রজালিক
৪২. টেলিফোন
৪৩. ভূতের রাজা
৪৪. অভিশপ্তা
৪৫. সূর্যদেবতার পুরোহিত
৪৬. অদৃশ্যের কীর্তি
৪৭. নসিবের খেলা
৪৮. ভৌতিক, না ভেলকি?
৪৯. ছায়া—কায়া—মায়া
৫০. বিছানা
৫১. ‘বাজলে বাঁশি কাছে আসি’!
৫২. কঙ্কাল-সারথি
৫৩. লোটা
৫৪. মাঝরাতের ‘কল’
৫৫. এক রাতের ইতিহাস
৫৬. কিন্তু
৫৭. পেপির দক্ষিণ পদ
৫৮. কিসমৎ
৫৯. কায়া কি ছায়া কি মায়া
৬০. নবাব কুঠির নর্তকী
৬১. ডাকবাংলো
৬২. তবে
৬৩. মামূর্তের দানব-দেবতা
৬৪. দিঘির মাঠে বাংলো
৬৫. নবাব বাহাদুরের বংশধর
৬৬. মুক্তি
৬৭. পিশাচ
৬৮. মৃতদেহ
৬৯. নবাবগঞ্জের সমাধি
৭০. ভীমে-ডাকাতের বট
৭১. নরকের রাজা
৭২. কলকাতার বিজন দ্বীপে
৭৩. রুদ্রনারায়ণের বাগানবাড়ি

নোট নিতে এবং টেক্সট হাইলাইট করতে লগইন করুন

লগইন