নব পুরাণ : মহিষাসুর / হুদুড়দুর্গা

নব পুরাণ : মহিষাসুর / হুদুড়দুর্গা

ব্রহ্মবৈবর্তপুরাণ অনুসারে দুর্গ নামক অসুর এবং মানবের সকল দুর্গতি নাশ করিবার জন্যই দেবীর নাম দুর্গা (প্রকৃতি খণ্ড ৫৭ অধ্যায়)। দুর্গ তৈরি করবার বিদ্যা অবিসংবাদীভাবে তথাকথিত ‘প্রাগ-আর্য’ অসুরদের, যদি দুর্গা বা ‘দুর্গী’ (তৈত্তিরীয় আরণ্যক ১০.১.৭), দুর্গ হতে উদ্ভব হয়ে থাকেন তাহলে অধুনা রাজনৈতিক প্রতিবাদ হিসাবে দলিত সমাজে যে অসুর উৎসব প্রচলিত হচ্ছে তার পুরাকাহিনিটা ভেবে দেখবার মতো। সেই কাহিনিতে অসুর অধিপতি হুদুড় দুর্গার সঙ্গে তার জাতিরই এক কন্যা বিশ্বাসঘাতকতা করেছিল, শত্রুর সঙ্গে হাত মিলিয়ে বিয়ের নামে তাঁকে বন্দি, ও অবশ করে। অস্ত্রহীন অবস্থায় শত্রুরা তাঁকে হত্যা করে। অন্যমতে এই কন্যা আর্য জাতীয়। হুদুড় দুর্গাকে হত্যায় সহায়তা করার জন্য এই কন্যাকে বিদেশি শত্রুরা দুর্গা নামে অভিহিত করে। স্কন্দপুরাণের কাহিনির সঙ্গে এর মিল অনস্বীকার্য, এই অসুর উৎসব ইদানীংকালে দলিত আন্দোলনের অঙ্গ হিসাবে কিছুটা প্রচার লাভ করার পর বিতর্কিত হয়েছে, বিশেষত JNU-কে কেন্দ্র করে, দেবী দুর্গাকে একটি আপত্তিকর শব্দে অভিহিত করার কারণে। আমার মনে হয় এখানে কিছু শব্দের গোলযোগ রয়েছে, মানে আধুনিক অর্থ প্রযুক্ত হওয়ার ফলে এরকম ভুল বোঝার সৃষ্টি হয়েছে। শব্দটি রাঁড়ি, যা থেকে রান্ডি শব্দটা এখনও চালু, কিন্তু সাঁওতাল ভাষায় রাঁড়ি শব্দের অর্থ বিধবা, এমনকি বাংলা ভাষাতেও এই অর্থে প্রচলন ছিল।

কৃত্তিবাসের রামায়ণ-এ রাবণ যখন পুত্র মহীরাবণকে যুদ্ধের জন্য ডেকে পাঠান, তখন পূর্ব ঘটনার বর্ণনা দিতে গিয়ে বলছেন-

পঞ্চবটী বনে বৈসে শ্রীরাম লক্ষ্মণ।
শূর্পণখা ভগ্নী গেলা তার দরশন।।
ভালোমতো জানো শূর্পণখার চরিত।
লোকধর্ম না মানে রাঁড়ি বলে বিপরীত।।
সেই রাঁড়ির নাক-কান কাটিলো লক্ষ্মণ।
[…] পাত্র লইয়া আমি ছিলাম লঙ্কাপুরী।
হেন কালে রান্ডি আইলো মোর বরাবরি।।

(সুখময় মুখোপাধ্যায় সম্পাদিত হ্যালডেন সংগৃহীত পুথি অনুসারী কৃত্তিবাসী রামায়ণ, ভারবি প্রকাশন)

এক্ষেত্রে রাঁড়ি বা রান্ডি শব্দ দুটি তথাকথিত বর্তমানের ‘চরিত্র’- বাচক অর্থে না ধরাই সমীচীন। কবি কল্পনায় রাবণ প্যাঁচে পড়ে খামোখা বোনকে গালি দিতেই পারেন, কিন্তু মনে রাখতে হবে শূর্পণখা ছিলেন বিধবা, রাবণের হাতেই শূর্পণখার স্বমনোনীত স্বামী রসাতল নিবাসী কালকেয় বংশীয় বিদ্যুৎজিহ্ব নিহত হন। শূর্পণখার এই শত্রুপক্ষীয় পতি নির্বাচনে রাবণ প্রথমে খুব রেগে যান, তারপর মন্দোদরীর মধ্যস্থতায় মেনে নেন। একসময় রাবণ দিগ্বিজয়ে বেরিয়ে রসাতলে পৌঁছে বোনের সঙ্গে দেখা করতে বিদ্যুৎজিহ্বর বাড়িতে যান। কিন্তু বিদ্যুৎজিহ্বর শূর্পণখাকে বিবাহ করার উদ্দেশ্য ছিল রাবণকে হত্যা, তিনি রাবণকে আক্রমণ করলে রাবণ আত্মরক্ষার্থে বিদ্যুৎজিহ্বকে হত্যা করতে বাধ্য হন। ‘রান্ডী’ শব্দটা আমরা মনসামঙ্গল-এও পাই

সনকার বচনে বেহুলা কোপে জ্বলে
যোড়হাত করিয়া শাশুড়ির আগে বলে
পাপকর্মের ফলে বিধাতা পাষণ্ডী
বিয়ার রাত্রে মৈল স্বামী, হৈলাম কাঁচা রান্ডী।।

বেহুলা নিশ্চয়ই শব্দটি কোনো গালাগাল অর্থে নিজের সম্পর্কে ব্যবহার করেননি। এখানেও বিধবা অর্থেই ব্যবহৃত হয়েছে। হুদুড় দুর্গার গল্পের বিশ্বাসঘাতিনী স্ত্রীর ক্ষেত্রেও এই শব্দটি বিধবা অর্থেই ব্যবহৃত হয়েছে বলে মনে হয়। যাই হোক এ বিষয়ে আমার বেশি কিছু বক্তব্য নেই কারণ আগে শুনেছিলাম এই দিনগুলি অসুর উপজাতির কাছে শোকের দিন। এখন নতুন করে সেটিকে পালন করতে গেলে যথারীতি কালের নিয়মে উৎসব হয়ে দাঁড়াবে। তবে ছোটো থেকে দেখেছি দুর্গামূর্তি তৈরির জন্য শুরুতে বেশ্যা দুয়ারের মাটি (কৃষ্ণনগরে মুক্তি-ডাক্তারের বাড়ির পাশের অধুনালুপ্ত ‘গলি’) নিয়ে আসা হত, এবিষয়ে প্রচলিত ব্যাখ্যা হল, মানুষ তার সব অর্জিত পুণ্য ওখানে ত্যাগ করে বেশ্যা গৃহে প্রবেশ করে, এই ব্যাখ্যা নেহাতই আধুনিক, ভিক্টোরিয় ঔপনিবেশিক বাঙালির তৈরি সেটা বেশ বোঝা যায়। কারণ হিন্দু সভ্যতায় গণিকারা চিরকালই যথেষ্ট উচ্চস্থান পেয়েছেন এমনকি স্বর্গেও গণিকারা রয়েছেন, যাঁদের অপ্সরা বলা হয়। আর এই প্রথাটি যদি ওই ব্যাখ্যার সমকালীন হত, তাহলে প্রথাটি চালুই হত না। কোনোরকম সন-তারিখের জটিলতায় না-গেলেও মৃন্ময়ী মূর্তি তৈরি করে দুর্গাপূজার অধিক প্রচলন হয় রাজা কৃষ্ণচন্দ্রের আমলে। তখনও যে এই বোকা-বোকা ঔপনিবেশিক শালীনতাবোধ বাঙালি জাতির মধ্যে তৈরি হয়নি তার কিছু প্রমাণ পূজাসংক্রান্ত বিষয়ে বলবার সময় ফিরে দেখব। তাই হতেই পারে এই প্রথার মাঝে কোনো গল্প লুকিয়ে আছে।

সমাজ-রাজনৈতিক প্রসঙ্গ জড়িত রয়েছে বলে এই আধুনিক পুরাণ সম্পর্কে সংক্ষিপ্ত আলোচনা প্রয়োজন মনে হয়। অসুর উপজাতি সম্পর্কে আমি বিস্তারিত জেনেছিলাম রামায়ণ পড়াকালীন Verrier Elwin লিখিত The Agaria নামক একটা ব‍ই থেকে, সেখানে লেখক আগারিয়া বা অসুর উপজাতির লোকেরা যারা লৌহ-নিষ্কাশনের কাজ করত আদিম পদ্ধতিতে, তাদেরই সংস্কৃত সাহিত্যের দেবাসুর যুদ্ধের অসুর হিসাবে চিহ্নিত করেন, তাদের সমাজব্যবস্থা, মিথ, আচার-অনুষ্ঠান সমস্ত কিছু নিয়ে এটি একটি সম্পূর্ণ নৃতাত্ত্বিক গ্রন্থ। ১৯৪২-এ প্রকাশিত গ্রন্থটির সূচনায় লেখক, অনন্তপ্রসাদ ব্যানার্জি-শাস্ত্রীর লেখা একটি প্রবন্ধের উল্লেখ করেন, যেখানে নাকি বলা হয়েছিল—পৌরাণিক সংগ্রামের ফলে অসুরেরা সিন্ধু অঞ্চল ত্যাগ করতে বাধ্য হয়। তারা মধ্যদেশ, দক্ষিণাঞ্চল, ও গাঙ্গেয় উপত্যকায় ছড়িয়ে পড়ে। অসুরদের প্রধান অংশ ছিল নাগগণ, তাদের পতনের সঙ্গে অসুরদের আধিপত্য শেষ হয়, তাদের বাসস্থানের নামের অবশেষ নাগপুর, ছোটোনাগপুর ইত্যাদি। বইটাতে আগারিয়া উপজাতির লোকগল্পে লোহাসুর, কয়লাসুর, অগ্ন্যাসুর এবং পদবি হিসাবে ‘অসুর’ শব্দ ব্যবহারকারী মানুষজনের কথা থাকলেও, হুদুড় দুর্গা বা দুর্গাসুরের কোনোই উল্লেখ ছিল না।

তারপর পিডিএফ-এর যুগে The Asur: A Study of Primitive Iron – Smelters নামে K. K. Leuva লিখিত একটি বই হাতে আসে। সেই বই থেকে আরও বেশ কিছু কথা জানতে পারি এই উপজাতি সম্পর্কে। সেখানেও হুদুড় দুর্গা সংক্রান্ত কিছু ছিল বলে মনে পড়ে না! সুহৃদকুমার ভৌমিক আর্য রহস্য নামক পুস্তিকায় অসুরদের এই পরিচয়কে সমর্থন করে কিছু ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতার কথা বলেছেন, সে প্রসঙ্গে একটু পরে আসছি। অসুর উপজাতির দুর্গাপুজোর সময় শোকপালনের কথা জানতে পারি ২০০৮ নাগাদ, একটি সংবাদপত্রের ছোট্ট রিপোর্টে, যেখানে দিনাজপুরের এক গাঁয়ে বসবাসকারী কয়েকটি পরিবারের কথা বলা হয়েছিল। গ্রামটিকে অসুর গ্রাম নামে চিহ্নিত করা হয়েছিল। ধীরে-ধীরে টুকরো-টাকরা অনেক রকম তথ্যের পরে ‘মূলনিবাসী’ নামে একটি সংগঠনের নাম শুনলাম। চরণ বেসরা নামে এক ভদ্রলোকের এই সংক্রান্ত ইন্টারভিউ দেখেছিলাম ইউটিউবে ২০১৪ নাগাদ। ২০১১ থেকে পুরুলিয়া জেলার ফালাওড়া গ্রামের আদিবাসীরা অসুর উৎসব পালন করছেন, তার পর থেকে বিভিন্ন দলিত, আদিবাসী ও অন্যান্য অনগ্রসর শ্রেণির মানুষের সংগঠন এই উৎসব পালন করছেন। যেমন মালদায় ‘মাজি পরগনা গাঁওতা’ এবং ‘মূলনিবাসী সমিতি’।

২৫ অক্টোবর ২০১৫, ‘আনন্দবাজার’ ডিজিটাল এডিশনে নিজস্ব সংবাদদাতার বয়ানে, ‘পুজোয় মহিষাসুর স্মরণ’ শিরোনামে—‘চারদিকে যখন অসুরদলনী দুর্গার পুজো চলছিল, সেই সময় অন্য পুজো হল কাশীপুর থানার ভালাগোড়া উচ্চ বিদ্যালয় মাঠে। বৃহস্পতিবার পূজিত হলেন হুদুড় দুর্গা’– বাই লাইন নিয়ে একটি খবর প্রকাশিত হয়, সেখানে দেখা গেল—

‘শিকার দিশম খেড়ওয়াল বীর লাচার কমিটির তরফে অজিতপ্রসাদ হেমব্রমের কথায়, “দুর্গার হাতে নিহত হন আমাদের আদিপুরুষ হুদুড় দুর্গা। যিনি ঘোরাসুর বা মহিষাসুর নামেও পরিচিত। আমরা মনে করি নীতিহীন যুদ্ধে তাঁকে মারা হয়েছিল। তাতে ভারতের ভূমিপুত্র খেড়ওয়ালরা দেশের রাষ্ট্রীয় ক্ষমতা হারিয়েছিলেন। ঘোরাসুরকে এই যুদ্ধে পরাজিত করার পরে আর্যাবর্ত নামে আর্য সাম্রাজ্য প্রতিষ্ঠা করা হয়। তখন আর্যপক্ষ বিজয় উৎসবে মেতে উঠেছিল। সেই সময় সাঁওতাল, মুন্ডা, কোল, কুড়মি, মাহালি, কোড়া প্রভৃতি খেড়ওয়াল গোষ্ঠীর আদিবাসীরা বশ্যতা স্বীকার না করে নিজেদের নিজেদের মান বাঁচানোর উদ্দেশ্যে নারীর ছদ্মবেশে দাঁশাই নাচ, কাঠি নাচের মাধ্যমে অন্তরের দুঃখ নিয়ে আনন্দের অভিনয় করতে করতে সিন্ধু পাড় ছেড়ে আসম, কাছাড়, ওড়িশা, বঙ্গদেশ ও দক্ষিণ ভারতের বনে জঙ্গলে আশ্রয় নিয়েছিল।”’

তারপর ‘আয়নানগর’ (মে ২০১৭) পত্রিকায় প্রকাশিত ‘হুদুড় দুর্গা’ নামে অজিতপ্রসাদ হেমব্রম-এর একটি সাক্ষাৎকার থেকে যা জেনেছি তা এইরকম—”খেরওয়ালদের বিশেষ উৎসব দাশানি, বলা যায় দুঃখের উৎসব। দুঃখের, কারণ তাদের দেশ ধবংস হয়ে গেছে। প্রাচীনকালে খেরওয়ালদের এক মহান নেতা ছিলেন হুদুড় দুর্গা। তিনি আক্রমণকারী অনুপ্রবেশকারীদের বিরুদ্ধে লড়েছিলেন। শত্রুরা যুদ্ধে জিততে না-পেরে অন্যায় ভাবে হুদুড় দুর্গাকে খুন করে, তাই এই উৎসব একপ্রকার শোক পালন। হুদুড় দুর্গাকেই এখন মহিষাসুর বলা হয়, তাঁর রাজত্বে কোনো অভাব ছিল না। প্রাচীন চাইচম্পা নগরে সকলে সুখে- শান্তিতে, বড়ো বড়ো বাড়িতে বাস করত। আর্যরা আক্রমণ করলে হুদুড় দুর্গা তাদের প্রতিহত করেন। তখন তারা ফন্দি আঁটে, তারা জানত খেরওয়ালরা কখনো মেয়েদের গায়ে হাত তোলে না, এখনো নয়। তখন আর্যরা সেটাকে কাজে লাগায়—এক অপরূপ সুন্দরী আর্য রমণীকে পাঠিয়ে তার সঙ্গে হুদুড় দুর্গার বিবাহ দেয়, তারপর তার সহায়তায় হুদুড় দুর্গাকে হত্যা করে। চম্পানগরের সকলে পালিয়ে যায় প্রাণে বাঁচতে। এখন অনেকে মুর্মুর মতো অসুর পদবি ব্যবহার করছে, তারা পশ্চিমবঙ্গের বিভিন্ন জেলায় ছড়িয়ে ছিটিয়ে আছে, উত্তর ও দক্ষিণ দিনাজপুর এবং ঝাড়খণ্ডে বেশি। ওই দিনগুলোতে মহিলাবেশে নাচের প্রথা বহুকাল ধরে চালু আছে, হুদুড় দুর্গার সময়ে দাঁশাই নাচ ছিল আনন্দ উৎসব, পরে শোকপালন।”

“নতুন করে অসুর উৎসব পালনের প্রতি বিশেষ নজর দেওয়ার কারণ, অসুর হুদুড় দুর্গাকে নিধনে সহায়তা করার জন্যই সেই রমণীকে দুর্গা নামে আখ্যায়িত করা হয়। ভারতীয় মূলনিবাসীদের বীর যোদ্ধাকে নিধন করার আনন্দে আর্য সংস্কৃতির উত্তরসূরি ব্রাহ্মণ্যবাদীরা সপ্তমী থেকে দশমী পর্যন্ত দুর্গোৎসবের নামে আনন্দে মেতে ওঠে। অপরদিকে সপ্তমীর দিন থেকে শোকের প্রতীক হিসাবে দাঁশাই নাচ বা ভুয়াং নাচের মাধ্যমে শুরু হয়ে যায় আদিবাসীদের শোকযাত্রা, আদিবাসী পুরুষেরা মহিলাদের পোশাকে রাস্তায় দাঁশাই নাচ ও গানের মাধ্যমে ‘হায় হায়’ করে তাদের বীরযোদ্ধা দলপতির স্মৃতিতে শোক প্রকাশ করে। তাই দাঁশাই গানের শুরু আর শেষে হায় হায়—ব্যবহার হয়। দাঁশাই নাচে অংশ নিতে প্রতিটি পুরুষ রংবেরঙের কাপড় পরিধান করে, মাথায় ময়ূরপুচ্ছ লাগিয়ে মহিলাবেশ ধারণ করে, আদিবাসী যোদ্ধারা যেভাবে পালিয়ে গিয়েছিলেন সেটিকে স্মরণ করে। ভারতের মূল বাসিন্দা আদিবাসীদের জীবনে অসুর দুর্গা ন্যায় পরায়ণ মহান যোদ্ধা এবং দেশপ্রেমিক শহিদ আর দুর্গা আর্য সংস্কৃতি তথা ব্রাহ্মণ্যবাদের ছল-কাপট্যের প্রতীক।”

‘উদ্দীপন’ নামে একটি ব্লগে শরদিন্দু উদ্দীপন ২৬ সেপ্টেম্বর ২০১৭, লিখেছেন, “দেবীপুরাণে যে ঘোড়াসুরের বর্ণনা পাওয়া যায় তা হুদুড়দুর্গাকেই স্মরণ করিয়ে দেয়। ‘সাবর্ণি’ নামে অষ্টম মনুর মন্বন্তরের সময় যখন পুরন্দর দেবতাদের ইন্দ্র হয়েছিলেন (মার্কণ্ডেয় পুরাণ ৮০ অঃ) সেই সময় রম্ভাসুরের পুত্র ঘোড়াসুর কুশদীপের অধিপতি ছিলেন। সেই ঘোড়াসুরই মহিষাসুর নামে খ্যাত (দেবীপুরাণ, ১ম অঃ)। তিনি নিজে বাহুবলে জম্বুদ্বীপ, ক্রোঞ্চদ্বীপ, শাল্মদ্বীপ, পুস্করদ্বীপ, মানসদ্বীপ (স্বর্গ) ও নাগরাজ (পাতাল) জয় করে সপ্তদ্বীপ ও সপ্তসমুদ্রের অধিপতি ছিলেন। তিনি যেমন ছিলেন বলবান, বীর্যবান, বুদ্ধিমান ও সর্বিদ্যায় পারদর্শী তেমনি ছিলেন ধর্মপরায়ণ, সংযমী, বিলাসহীন, ন্যায়নিষ্ঠ ও মানবতাবাদের আদর্শে প্রজাহিতৈষী। প্রজাগণ শ্রদ্ধার সঙ্গে তার নাম বুকের মধ্যে খোদাই করে রাখত (দেবী পুরাণ-২ ও ১৬ তম অঃ)। পরস্ত্রীকে তিনি সর্বদা কন্যা ও মাতা হিসেবে বিবেচনা করতেন। (দেবী পুরাণ ষোড়শ অধ্যায় শ্লোক নং ২-১২)”

[…] “ভীল আদিবাসীরা দাবী করেন দুর্গা তাদের মেয়ে। দেবতারা তাকে শিবিরে নিয়ে গিয়ে মহিষাসুরকে হত্যা করার জন্য প্রশিক্ষণ দেয়। দেবীর আর এক নাম চণ্ডী। হাঁড়ি সম্প্রদায়ের দাবী চণ্ডী তাঁদের মেয়ে। দেবতারা তাকে দিয়ে তাঁদেরই রাজাকে হত্যা করে। এখনো হাঁড়ি সম্প্রদায়ের চণ্ডী পূজায় কোন ব্ৰাহ্মণ ব্যবহার করা হয় না।”

“সাঁওতালরা দাঁশায় গানের মধ্য দিয়েই প্রকাশ করেন যে হুদুড়দুর্গা বা মহিষাসুরকে অন্যায় ভাবে হত্যা করে ইন্দ্র চাইচম্পাগড় বা হরপ্পা থেকে আদিবাসীদের বিতাড়িত করেন। তাঁরা প্রাণ বাঁচাতে নারীর ছদ্মবেশ ধারণ করে “ইয়ায় নায়ে দিশম চাম্পা” বা সপ্ত নদীর দেশ হরপ্পা থেকে গাঙ্গেয় উপত্যকা অঞ্চলে ছড়িয়ে পড়ে। স্বদেশ হারানোর যন্ত্রণা বুকে নিয়ে আজও তাঁরা বুক চাপড়ে ও হায়রে-ও হায়রে আওয়াজ করে ভুয়াং নাচের মাধ্যমে তাঁদের রাজাকে খুঁজে বেড়ায়। দেবী দুর্গার হাতে হুদুড়দুর্গা বা মহিষাসুরের হত্যার কাহিনী এভাবেই লোকায়ত হয়ে আছে আদিবাসীদের মধ্যে। আদিবাসী সত্তায় রাজত্ব হারানোর স্মৃতি এখনও সমান ভাবেই বর্তমান।”

সব পুরাকাহিনি লোককাহিনির মতোই এরও বহু রকমফের শোনা যাচ্ছে তবে এই অনুষ্ঠান মূলত নব্য হিংস্র ব্রাহ্মণ্যবাদী হিন্দুত্বের রাজনীতির বিরুদ্ধে দলিত আদিবাসী অনগ্রসরদের প্রতিবাদ, যাঁরা আজকাল উত্তর-পশ্চিম ভারতে ঘনঘন মব- লিঞ্চিং-এর শিকার হচ্ছেন। ওই হিন্দুত্ববাদীদের এক শাখা বঙ্গদেশে ‘জন্মভিত্তিক জাতি ও বর্ণ’র বদলে সনাতন কর্মভিত্তিক বর্ণ বিভাজনের পুনঃপ্রবর্তনের গল্প শুনিয়ে অনগ্রসর ও তালিকাভুক্ত জাতিদের ভোট জমা করছেন, আর ওদিকে লোকসভার স্পিকার বামুনেরা জন্মগতভাবেই উচ্চাসনের দাবিদার বলে মতপ্রকাশ করছেন, বক্তৃতা ও সামাজিক মাধ্যমে!

পূর্বেল্লিখিত উদ্দীপন নামক ব্লগে ‘ঘোড়াসুর’ নাম থাকলেও, দেবীপুরাণ-এ অসুরের নামটি ঘোরাসুর, যে উল্লেখ এবং কাহিনিটি অত্যন্ত চমকপ্রদ। বিশদে উল্লেখ জরুরি।

দেবীপুরাণ-এ ১ থেকে ২০ অধ্যায় ঘোরাসুর-এর কাহিনি বর্ণিত হয়েছে। কুশদ্বীপের চন্দ্রশোভাপুর ছিল তাঁর রাজধানী। ঘোরাসুর ত্রিভুবনবিজয়ী সৎ সদাচারী পরমজ্ঞানী প্রজাবৎসল রাজা ছিলেন বলে দেবতাদের রাজনৈতিক বদবুদ্ধিতে নারদ মুনি এসে তাঁকে ভোগ, যথা নিত্য ষোড়শী নারী সম্ভোগ জাতীয় কুমন্ত্রণা দেন। তাতে সফল না হয়ে প্রজাদের উপকারের দোহাই দিয়ে বৃদ্ধা পত্নী সঙ্গম না করে বিন্ধ্যবাসিনী দেবীকে বিবাহের প্রস্তাব দেন, তারপর ঘোরাসুরকে সৈন্যসামন্তসহ সেখানে নিয়ে যান। সেখানে নারদ দেবীকে বলেন ঘোরাসুরকে হত্যা করতে।

দেখা যাচ্ছে হুদুড় দুর্গা আর দেবী দুর্গার সবচেয়ে কাছাকাছি পৌরাণিক গল্প এটাই। দেবীপুরাণ-এর চতুর্থ অধ্যায়ে বিষ্ণু ঘোরাসুরের পূর্বকাহিনি ব্যক্ত করছেন—আগে তিনি ছিলেন দুন্দুভি নামক এক অসুর, উমাকে কামনা করলে শিব তাকে ভষ্ম করেন। আর সেই ভষ্ম দেবীর গায়ে মাখিয়ে দেন, সেই ভষ্ম একটি বর্ত্তি(!!)-র আদল নিয়ে আবার দেবীকে কামনা করলে দেবী ক্রুদ্ধ হয়ে তাকে মর্তে জন্মাবার অভিশাপ দেন। শত্ৰুকে শেষ না- করে এইভাবে বাঁচিয়ে রাখায় শিব অত্যন্ত ক্রুদ্ধ হয়ে দেবীকে ‘মন্দবুদ্ধে সদা বালে স্ত্রীস্বভাবেন’ বলে তিরস্কার করেন কারণ তাঁকেই আবার মর্তে গিয়ে এই অসুরকে মারতে হবে। (সাদা বাঙলায় ভাবানুবাদ করলে ‘বোকা মেয়েছেলে সাধে কি এগারো হাত শাড়িতে কাছা হয় না’ এইরকম গোছের কিছু হয়তো)। এতে দেবী রেগেচটে বলে ওঠেন মর্তে জন্মে বিষ্ণুভক্ত হয়ে এই অসুর ত্রিভুবন জয়ী হবে, দেবরাজ ইন্দ্রকেও একে মেনে চলতে হবে, কেউ হারাতে পারবে না, তুমিও না। এই কাণ্ডে স্বাভাবিক ভাবেই শিব আরও ক্রুদ্ধ হয়ে দেবীকে অভিশাপ দেন, তাহলে তোমাকেও মর্তে জন্মাতে হবে আর তখনও এই অসুর তোমায় বিয়ে করতে যাবে। দেবী তখন বলেন, তাহলে কাউকে লাগবে না, তিনি নিজেই সিংহবাহিনী হয়ে অসুরকে হত্যা করবেন। সেই অসুর হলেন ঘোরাসুর।

বাবা-মায়ের ঝগড়ায় সন্তানদের কান দিতে নেই আর রৌরবের ভয়ে কথ্য বাঙলায় কাণ্ডটা বিস্তারিত না-লেখাই ভালো, পুরাণপাঠ সর্ব্বদাই পুণ্যের কাজ তার উপর এমন গপ্পো, এই অংশ সরাসরি পড়ে নেওয়া যাক্ দেবীপুরাণ-এর পাতা থেকে। প্রাপ্তবয়স্ক প্রাপ্তমনস্ক পাঠক নিজ অভিজ্ঞতানুযায়ী কল্পনায় তর্জমা করে নেবেন।

সকল অধ্যায়

নোট নিতে এবং টেক্সট হাইলাইট করতে লগইন করুন

লগইন