সিন্ধুসভ্যতা / অসুরসভ্যতা

সিন্ধুসভ্যতা/অসুরসভ্যতা

অতুল সুর তাঁর সিন্ধু সভ্যতার নৃতাত্ত্বিক ভাষ্য বইটির এক জায়গায় বলেছেন: “সমস্ত ঋকবেদখানা পড়লে বুঝতে পারা যায় যে আর্যরা ছিল একটা হাঘরে জাত। ধর্মগ্রন্থ হিসেবে বেদের উৎপত্তি হলেও সমগ্র বেদখানাতে উলঙ্গভাবে প্রকটিত হয়েছে দেবতাদের কাছে তাদের বৈষয়িক প্রার্থনা—ঋক্বেদের প্রায় ১০,০০০ মন্ত্রের মধ্যে হাজারখানেকেতে শুধু একই কথা বলা হয়েছে—দাও আমাদের শত্রুর ধন, দাও আমাদের শত্রুর সম্পদ, দাও আমাদের শত্রুর গাভী, দাও আমাদের শত্রুর মেয়েছেলে ইত্যাদি। সর্বত্রই বলা হয়েছে—“আমার শত্রুকে ধ্বংস করো, তাদের সকল ধন আমাদের দাও, অন্য কাউকে দিও না। কেবলমাত্র আমার মঙ্গল করো।” (পৃ ২৯) ডক্টর অতুল সুর, ভারতের প্রত্নতত্ত্ব সমীক্ষার অধিকর্তা স্যার জন মার্শাল-এর আহ্বানে ১৯৩২ খ্রিস্টাব্দে মহেঞ্জোদারো যান এবং প্রমাণ করেন যে পরবর্তীকালের হিন্দু সভ্যতার গঠনে বারো আনা ছিল সিন্ধু সভ্যতার অবদান। ডক্টর দেবব্রত রামকৃষ্ণ ভান্ডারকারের মতে, “হিন্দু সভ্যতা যে আর্য ও অনার্য সভ্যতার মিশ্রণে উদ্ভুত এটা যে চারজন বিশিষ্ট প্রত্নতাত্ত্বিক প্রমাণ করেছেন তাঁরা হচ্ছেন স্যার জন মার্শাল, রায়বাহাদুর রমাপ্রসাদ চন্দ, ডক্টর স্টেলা ক্রামরিশ এবং শ্রীঅতুলকৃষ্ণ সুর।”

সেই অতুল সুর যখন বলেন, “মহাভারত অনুযায়ী বাংলা ওড়িশার জনসমূহ অসুর নৃপতি বলিরাজার মহিষী সুদেষ্ণার গর্ভজাত সন্তান। মঞ্জুশ্রীমূলকল্প নামক একখানি প্রাচীন বৌদ্ধ গ্রন্থে বাঙলার আর্যভাষাকে অসুর ভাষা বলা হয়েছে। গ্রিয়ারসন এর নাম দিয়েছিলেন Outer Arians-দের ভাষা। ঋকবেদের সর্বত্রই আমরা সিন্ধুবাসী অসুরদের উল্লেখ পাই। তাদের বৈশিষ্ট্য ছিল নগর নির্মাণ। অসুররা স্থাপত্যবিদ্যায় বিশেষ পারদর্শী ছিল তা আমরা ময়াসুরের কাহিনী থেকে জানতে পারি। সুতরাং সিন্ধুর অসুররা যে বাঙালীদের পূর্বপুরুষ তা সহজেই অনুমেয়”— তখন গর্ব হয় বৈকি! (পৃ ২৬) তবুও একটি তথ্য, অতুল সুরের বাঙালির নৃতাত্ত্বিক পরিচয় ১৯৪২-এ গান্ধীর ‘ভারতছাড়ো’ আন্দোলনের বিপ্রতীপে ‘হিন্দু মহাসভা’-র রাজনৈতিক উদ্দেশ্যপ্রণোদিত প্রকাশনা, হয়তো বাঙালিকে বিযুক্ত করে তৎকালীন ‘জাতীয়তাবাদ’কে দুর্বল করার উদ্দেশ্যে! ‘হিন্দু মহাসভা’ ও ‘মুসলিম লীগ’ উভয়েই ভারতছাড়ো আন্দোলনের বিরোধী ছিল।

সুহৃদকুমার ভৌমিকের কথায় ফিরে আসি, তাঁর মতে— কোল জাতি ছিল প্রভাবশালী জাতিদের মধ্যে প্রধান ও প্রাচীনতম। তখন এই বিশাল কোল জাতি কতগুলি শাখায় বিভক্ত ছিল তা বলা শক্ত, তবে এখনকার ভাষার বৈশিষ্ট্য ধরে কোল ভাষাগোষ্ঠীকে নিম্নলিখিত শাখায় বিভক্ত করা যায়, অসুর, কড়ওয়া, করকু, করমালি, কোড়া, খেড়িয়া, গদব, তুরি, মাহালি, বীর হোড়, ভূমিজ, নাহালি, মুণ্ডা, যুয়াং, শবর, সাঁওতাল, হো। একটা জিনিস লক্ষ করার যে, এ সমস্ত উপজাতির বর্তমান আবাসস্থল বাঙলা, বিহার, ওড়িশা ও মধ্যপ্রদেশ, এক কথায় ছোটোনাগপুর অঞ্চলকে কেন্দ্র করে। কিন্তু ভাষা ও স্থান-নামের বিচারে ভারতীয় সভ্যতার উপাদান ও বৈশিষ্ট্য আলোচনা করলে দেখা যায়, এক সময়ে সারা ভারতে কোল বা অসুর সভ্যতার বিস্তার ঘটেছিল। অতি প্রাচীন যুগে ওই সমস্ত কোল গোষ্ঠীর মানুষ পরবর্তী কালে আগত দ্ৰাবিড়, যাযাবর বেদিয়া গোষ্ঠীর মানুষের সঙ্গে একত্র হয়ে যায়। ফলে বর্তমান কোল গোষ্ঠীর মানুষদের দেখে বিশাল কোল সভ্যতার মানুষ সম্বন্ধে ধারণা করা সম্ভব নয়। আসলে কোল সম্প্রদায়ের মানুষরা অন্যান্য গোষ্ঠীর সঙ্গে একাকার হয়ে ভারতীয় সভ্যতা ও সংস্কৃতি তৈরি করেছে। বর্তমান ক্ষুদ্র-ক্ষুদ্র দলে বিভক্ত কোল সম্প্রদায়ের সাঁওতালরা হল তাদের দলের প্রধান শাখা। আর অসুররা সংখ্যায় লঘু হলেও তারা তাদের ভাষা ও সংস্কৃতি, এক কথায় বৈশিষ্ট্যকে বজায় রেখেছে। বর্তমান অসুররা কৃষিকর্মকে জীবিকা হিসাবে নিলেও তাদের মৌলিক জীবিকা ছিল লৌহ আকর থেকে আগুন জ্বালিয়ে লোহা তৈরি করা। তৎকালীন কোল সমাজ এই অসুর সম্প্রদায়ের উপরই লৌহনির্মিত অস্ত্র তৈরির জন্য নির্ভর করত। লৌহ এবং অস্ত্রের নিয়ামক হিসাবে কোল সমাজে অসুর গোষ্ঠীই প্রাধান্য পেয়েছিল অথবা কোল (Austro-Asiatic) গোষ্ঠীর প্রধানরাই অসুর নামে খ্যাত হয়েছিল। ফলে অসুর শব্দের মৌলিক অর্থ হয়ে দাঁড়ায় দলপতি বা নেতা। সম্ভবত প্রাচীন যুগে কোল ভাষাগোষ্ঠীতে অসুর বা আসুর শব্দের অর্থ ছিল নেতা। কারণ সাঁওতালিতে আয়ুর শব্দের অর্থ নেতৃত্ব। ‘আয়ুরীঃচ’ অর্থাৎ নেতা। শব্দটি অসুর থেকে অহুর ও পরে আয়ুর হয়েছে, সন্দেহ নেই। সন্দেহ নেই যে, কোল গোষ্ঠীর সমস্ত মানুষই, বিশেষ করে নেতারা সর্বদাই অসুর নামে পরিচিত ছিল।

“এই অসুর সভ্যতা প্রাগৈতিহাসিক যুগে বাঙলায় সর্বাধিক বিস্তার লাভ করেছিল এবং এই সভ্যতা সম্পূর্ণ বিচ্ছিন্ন নয়। উৎখননের ফলে যে-সমস্ত লোহা-গলানো চুল্লি আবিষ্কৃত হয়েছে, সেগুলির সঙ্গে বর্তমান অসুর উপজাতির ব্যবহৃত চুল্লির কোন পার্থক্য নেই। লোহা গলানোর আদিম পদ্ধতিটিকে এখনও পর্যন্ত অসুর সম্প্রদায় কেন ফেলে দেয়নি, তার উত্তরে টাটার এক বিজ্ঞানী বলেছিলেন, এই আদিম পদ্ধতি খুবই বিজ্ঞানসম্মত। জ্বালানি ও লৌহ আকরকে একসঙ্গে রেখে উত্তাপ সৃষ্টি করলে তাপের প্রত্যক্ষ সংস্পর্শে দ্রুত লোহা গলানো সম্ভব। সে যুগে অতি উচ্চমানের তাপসৃষ্টির পদ্ধতি জানা না থাকায় মানুষ বাধ্য হয়ে তা-ই করত। ফলে একটি চুল্লি কিছু দিন ব্যবহার করার পর ধাতুর আবর্জনায় অকেজো হয়ে যেত। কারণ কাঠকয়লার ছাইপাশের সঙ্গে লোহার পরিত্যক্ত অংশ থেকে যেত। তখন তার পাশে আবার নতুন চুল্লি তৈরি হত। বেলপাহাড়ি, সিংভূম প্রভৃতি অঞ্চলে বিচ্ছিন্ন ভাবে ঐ লোহা-গলানো চুল্লির ধ্বংসাবশেষের সংবাদ পাওয়া গেলেও মেদিনীপুর ও সিংভূমের সীমান্ত অঞ্চলে বহড়াগড়া থানায় খাণ্ডামৌদা গ্রামে একেবারে পাশাপাশি লাগোয়া অসংখ্য চুল্লি আবিষ্কৃত হয়েছে। মনে হয়, এক সময়ে বহু সংখ্যক অসুর লোহা গলানো ও অস্ত্রনির্মাণের কাজে সেখানে নিযুক্ত ছিল। গ্রামটির নাম খাণ্ডামৌদা অর্থাৎ অস্ত্রের স্থান বা অস্ত্রাগার।”

সুহৃদকুমার ভৌমিকের ধারণা ওই একটি গ্রামেই, “কয়েক সহস্র চুল্লি মাটির তলায় লুকিয়ে আছে। ঐ চুল্লিগুলি আবিষ্কৃত না-হলে খাণ্ডামৌদা নামের তাৎপর্য বোঝা যেত না। চুল্লিগুলি মাটির যে-স্তরে অবস্থান করছে, তা তার প্রাচীনত্বকে প্রমাণ করে।” ওই অঞ্চলে নিবিড়ভাবে ঘুরে বেড়ানোর সুযোগে তিনি স্থানীয় লোকেদের কাছে জানতে পারেন একটি উপকথা- “এই গ্রাম ছিল কামারদের দ্বারা পরিপূর্ণ। দিনরাত টুংটুং শব্দে অঞ্চলটা জীবন্ত ছিল। তারপর এক দেবীর কু-দৃষ্টিতে কামাররা সব গেল মরে। এখনও কামারদের উপর দেবীর কু-দৃষ্টি সরে যায়নি। কামার জাতের কোন লোকের খাণ্ডামৌদা গ্রামে রাত কাটানোর অধিকার নেই। কেউ থাকতে চাইলেও গ্রামবাসীরা তাকে থাকতে দেয় না। তাতে গ্রামবাসী ও কামার, উভয়েরই বিপদ। এই কাহিনী শোনার পর স্বাভাবিক ভাবেই ধারণা হয় যে, লৌহ তৈরিতে যারা ব্যস্ত থাকত, কোন কারণে তারা এই গ্রাম ত্যাগ করেছিল। স্থানীয় অঞ্চলে লৌহ আকরিকের অভাবে, বা ডাইনির কু-দৃষ্টির ভয়ে, বা হঠাৎ বিদেশি শত্রুর আক্রমণে তারা চলে যেতে বাধ্য হয়। তারপর সেই অব্যবহৃত চুল্লিগুলির উপর গড়ে উঠেছে গোটা একটা গ্রাম। গ্রামের নাম কিন্তু থেকে গেছে সেই খাণ্ডামৌদা (অস্ত্রস্থান)। লোকে কামার জাতির কথা বললেও আসলে তারা কামার নয়, অসুর, এ সম্বন্ধে কোন সন্দেহ নেই। তখনই জানতে চেয়েছিলাম, অসুর শব্দের সঙ্গে তাদের কোন পরিচয় আছে কি না। স্থানীয় লোকেরা বলেছিল, সেখান থেকে প্রায় ৬-৭ মাইল দক্ষিণে সুবর্ণরেখার তীরে অসুরগড় বা অসুর হুড়া বলে এক বিস্তীর্ণ প্রান্তর পড়ে রয়েছে। গিয়ে দেখি, সে এক বিস্ময়ের ব্যাপার। স্থানটা বাঙলা ও বিহারকে নিয়ে সুবর্ণরেখার তীরে। তার যেখানে-সেখানে বিরাট-বিরাট উঁচু ঢিবি, ছড়িয়ে আছে পুরনো আমলের অনেক ইট। স্থানীয় লোকেদের বিশ্বাস, প্রাচীন যুগে কোন অসুর রাজার আবাসস্থল ছিল তা।”

মহিষাসুর সম্পর্কে এই প্রবন্ধেই সুহৃদবাবু তাঁর মতামতে বলেছেন, “খ্রীস্টজন্মের বহু পূর্বেই এ দেশে বিরাট এক সভ্যতা গড়ে উঠেছিল, যাতে যাযাবর আর্যদের কোন উপাদান ছিল না। দ্রাবিড় গোষ্ঠী ও তার পূর্ব্ববর্তী কোল গোষ্ঠীর মিলিত রূপে গড়ে উঠেছিল এই প্রাচীন সভ্যতা। যাযাবররা তাদের আগ্রাসী মনোভাবে সেই সভ্যতাকে আত্মসাৎ করে এবং এই তিন মৌলিক জনগোষ্ঠীর সমবায়ে গড়ে ওঠে ব্রাহ্মণ্য সংস্কৃতি। এই ব্রাহ্মণ্য সংস্কৃতি তৈরি করে এক সু-পরিকল্পিত সমাজব্যবস্থা। সিন্ধু নদের তীরেই বিদেশিরা এই সভ্যতার সাক্ষাৎ পেয়েছিল বলে পরবর্তী কালে তা সিন্ধু সভ্যতা বা হিন্দু সভ্যতা নামে পরিচিত হয়। এই সমাজব্যবস্থা বিস্তৃত অঞ্চলে ছড়িয়ে পড়ে। পরবর্তী কালে এই মিশ্রিত সভ্যতার মানুষ বিশুদ্ধ দ্রাবিড়দের রাক্ষস ও অস্ট্রিকদের অসুর বলত। যদিও এই দুটি শব্দ মহৎ ও শ্রেষ্ঠ অর্থে প্রথমত ব্যবহৃত হয়েছিল, পরবর্তী কালে তা হীনার্থে রূপান্তরিত হয়েছে। দক্ষিণ ভারত দ্রাবিড় ও পূর্ব ভারত অস্ট্রিক জাতি অধ্যুষিত ছিল বা এখনও আছে। সেই সূত্রে জরাসন্ধ, কংস, কংসের ভাগ্নে শ্রীকৃষ্ণ সকলেই অস্ট্রিক বা কোল গোষ্ঠীর বা অসুর গোষ্ঠীর। শ্রীকৃষ্ণ সকল সংস্কৃতি মিলিয়ে অখণ্ড ভারত সভ্যতা গড়তে চেয়েছিলেন। আর কংসাসুর প্রভৃতি আপন বিশিষ্ট সংস্কৃতি ও বিচ্ছিন্নতাবাদে বিশ্বাসী ছিল। যা-ই হোক, মহিষাসুরও সেই অর্থে ভারতীয়। […] মহিষাসুর তথা শ্রেষ্ঠ অসুর বা নেতা ছিলেন ব্রাহ্মণ্য সভ্যতা বিরোধী কোন রাজা, বাঙলাকে কেন্দ্র করে তিনি পূর্বভারত স্বতন্ত্র রেখেছিলেন। তার এতই প্রতাপ ছিল যে মিশ্রিত আর্য সভ্যতা পূর্বভারতে সহজে এগোতে পারেনি। ব্রাহ্মণ্য সমাজের প্রচারক ও প্রধানরা এই প্রবল শক্তিসম্পন্ন শাসনকর্তাকে পরাজিত করতে দীর্ঘ সময় নিয়েছিল এবং যুদ্ধ পরিচালিত হয়েছিল দুর্গার নামে। দুর্গা মূলত বিদেশি দেবী। দুর্গাবিরোধী অসুর রক্তের মানুষ যাতে দুর্গাকে সহজে স্বীকার করে নেয়, সেই জন্যই পুরোহিত সমাজ দুর্গা, কালী ও চণ্ডীকে একই শক্তি বলে কল্পনা করেছেন। বাঙালির সম্পূর্ণ অপরিচিত জন্তু সিংহের পিঠে চেপে আসা ‘সিংহবাহনা’ দুর্গা সম্ভবত ব্যাবিলনের বিখ্যাত রণজয়ী (war-goddess) ননা।”

আমরা জানি, সিন্ধুসভ্যতার বসবাসকারী মানুষদের মেলুহা বা মিল-এচ বা ম্লেচ্ছ বলা হত। কিরীটি মাহাত তাঁর সিন্ধু সভ্যতার ভাষা ও কুড়মালি নামক পুস্তিকায় বলেছেন, “চৈত্র সংক্রান্তিতে শিবগাজনে শিবকে মেলুহা নামেই অভিহিত করা হয়। বাংলাদেশের বিস্তীর্ণ অঞ্চলে মহিষাসুরের অপর নাম মেলুহা।”

পুরাণে যাই থাকুক-না কেন আমরা আমাদের মস্তিষ্কে দেবাসুরের দ্বন্দ্বটাকে একটা অদ্ভুত ধৰ্মীয় মৌলবাদী রূপ দিয়ে দিয়েছি সে ব্যাপারে সন্দেহ নেই। রামায়ণ থেকে একটা ছোট্ট উদাহরণ দেওয়া যায়, কারণ এর শিশুপাঠ্য গল্পটুকু অন্তত সব্বাই জানেন, লক্ষ্মণ হলেন আদর্শ ভাই, সে সর্বদা দাদার পাশে, প্রয়োজনে প্রাণ দিতে প্রস্তুত, নিজের স্ত্রীকে ছেড়ে দাদা বউদিকে পরিচর্যা করার জন্য স্বেচ্ছায় বনবাসে ব্রহ্মচারী, তার বউদিকে ধরে নিয়ে গেছে দুরাত্মা রাক্ষস রাবণ, তাই সে রাবণের পুত্র ইন্দ্ৰজিৎকে যজ্ঞগৃহে প্রবেশ করে নিরস্ত্র অবস্থায় খুন করে, দাদার শত্রু নিধনে এহেন অপকর্মে তার কোনো পাপ হয় না, তিনি উন্নতচরিত্র অনুকরণীয় ভ্রাতার আদর্শ পালন করেন, আজও এই ভারতবর্ষে রাম-লক্ষ্মণ আদর্শ ভ্রাতা। অথচ রাবণের ভাই বিভীষণ, রাক্ষস কুলে একমাত্র বিশ্বাসঘাতক, শত্রুপক্ষে যোগ দিয়ে পরবর্তীতে রাজা হন, তিনিও নাকি পরম ধার্মিক! এই দুটো একসঙ্গে যে যুক্তিতে একই মস্তিষ্কে সঠিক হতে পারে তা একটি মৌলবাদী মস্তিষ্ক।

এছাড়াও পৌরাণিক বেশকিছু বিষয়ে আমাদের অশিক্ষা প্রসূত ভ্রান্ত আধুনিক ধারণা আছে। অথবা জানলেও বিচার করার সময় সেগুলো আমরা খেয়াল রাখি না। সাধারণভাবে এগুলি আব্রাহামিক ধর্মের পরোক্ষ প্রভাব। কিন্তু বিষয়গুলোকে যথাযথ ভাবে বুঝতে গেলে এই সমস্ত ভুল ধারণাগুলোকে কাটিয়ে ওঠা দরকার। আমি মাত্র দুটি উদাহরণ দিচ্ছি—

পাতাল সম্পর্কে আমাদের সাধারণ ধারণা সেটা অত্যন্ত খারাপ জায়গা। কিন্তু পদ্মপুরাণের পাতালখণ্ডে লিখিত আছে পাতাল সাতটি, প্রথমে অতল, তারপর পর্যায়ক্রমে বিতল, সুতল, তলাতল, মহাতল, রসাতল, পাতাল। এই সপ্তপাতাল স্বর্গের অধিক সুখকর স্থান। এইজন্য ইহাকে মুনিগণ বিলস্বৰ্গ বলিয়া অভিহিত করেন। ইহারা শতযোজন বিস্তৃত। এই পাতাল সমৃদ্ধভবন, উদ্যান, বিহার, আক্রীড়, চত্বর প্রভৃতি দ্বারা সুসজ্জিত, ইত্যাদি। বিষ্ণুপুরাণে আছে এই সকল পাতাল স্বৰ্গলোক হইতে রমণীয়, এইখানে দিবাভাগে সূর্যকিরণ আতপ বিস্তার করে না এবং রাত্রিকালে চন্দ্র শীতকিরণ প্রদান করেন না, কেবলমাত্র আলোক দান করিয়া থাকেন। দেবীভাগবতে আছে পাতাল সমূহের জলরাশি নানাজাতীয় বিহঙ্গবর্গে বিমণ্ডিত, হ্রদ সকল স্বচ্ছ সলিলে পরিপূর্ণ। দিবা বা রাত্রি কোনো কালেই তথায় কোনো প্রকার ভয়ের সম্ভাবনা নাই। বলীপলিত, জ্বর, জীর্ণতা, বিবর্ণতা, প্রভৃতি বয়োঃবস্থা এখানকার অধিবাসীদিগকে কোনোরূপ ক্লেশ প্রদান করিতে সমর্থ হয় না। ষষ্ঠ পাতাল রসাতল বিখ্যাত স্থান, এখানে দৈত্য-দানব ও পাণি নামক অসুরগণ বাস করেন, ইহা ভিন্ন এখানে হিরণ্যপুর নিবাসী নিবাতকবচগণ এবং দেবগণের প্রতিদ্বন্দ্বী কালকেয় নামক অসুর সকল বাস করে। শ্রীনগেন্দ্রনাথ বসু সংকলিত বিশ্বকোষ, একাদশ ভাগে বিস্তারিত বর্ণনা পাওয়া যাবে। প্রাচীনকালে আমেরিকাকে পাতাল বলা হত একথাও শোনা যায়!

সত্ত্ব ও তম গুণ সম্পর্কে আমাদের ধারণা তৈরি করা হয়েছে সত্ত্ব ও তম যেন ভালো-মন্দের মতো দুটি বিপরীতমুখী গুণ, কিন্তু এটি সম্পূর্ণ ভুল। অথচ সকলেই জানেন জগৎ ত্রিগুণাত্বক, সত্ত্ব রজ তম। গুণ সাম্য হলে লয় হয়, গুণ বৈষম্যে সৃষ্টি। বায়ুপুরাণে বলা হয়, গুণক্ষোভ থেকেই তিনদেবতার সৃষ্টি হয়েছে। এঁরা সর্বজীবকে আশ্রয় করে রয়েছেন। রজ ব্রহ্মা, তম অগ্নি, সত্ত্ব বিষ্ণু। রজ প্রকাশ করে থাকেন যে ব্রহ্মা, তিনি স্রষ্টা রূপে, তম প্রকাশ করেন যে অগ্নি তিনি কালরূপে আর সত্ত্ব প্রকাশ করেন যে বিষ্ণু তিনি উদাসীন রূপে। এঁরা তিনলোক, এঁরাই তিনবেদ আর এঁরাই তিন অগ্নি। এঁরা পরস্পর পরস্পরকে আশ্রয় করে থাকেন, এঁরা একে অপরের অনুরক্ত একে অপরের সাহায্যে থেকে পরস্পরকে ধারণ করে থাকেন। এঁরা ক্ষণের জন্যও পরস্পরকে ছেড়ে থাকেন না। অগ্নি, রুদ্র এবং শিব তম। দেবী চণ্ডীতে সত্ত্বগুণে ব্রহ্মার গৃহিণী বাগদেবী, রজোগুণে বিষ্ণুর পত্নী লক্ষ্মী এবং তমোগুণে শিব বনিতা পার্বতী। বিষ্ণু সত্ত্ব বলে বিষ্ণুপন্থীদের অপব্যখ্যায় সত্ত্বকে ‘উৎকৃষ্ট’ প্রমাণ করার প্রচেষ্টা আছে, আমরা গীতব্যাখ্যায় তার শিকার। ‘দর্শন’ বা ফিলজফিকে রিলিজিয়ন রূপে দাঁড় করাতে গেলে যে মৌলবাদী অর্থসংকোচন ঘটে এটি তার প্রমাণ।

সকল অধ্যায়

নোট নিতে এবং টেক্সট হাইলাইট করতে লগইন করুন

লগইন