গ্লানিমুক্ত বাংলাদেশ (জুলাই ১৭, ২০১৩)

মুহম্মদ জাফর ইকবাল

গত সোমবার যুদ্ধাপরাধী গোলাম আযমের বিচারের রায় হওয়ার পর পুরো দেশে আশাভঙ্গের একটি দীর্ঘশ্বাসের শব্দ শোনা গেছে। তরুণ প্রজন্মের প্রতিক্রিয়াটি ছিল সবচেয়ে তীব্র। প্রথমে ক্রোধ, তারপর ক্ষোভ আর দুঃখ এবং সব শেষে হতাশা। আমার সঙ্গে পরিচয় আছে এ রকম অনেকের সঙ্গে ফোনে কথা বলে তাদের সান্ত্বনা দিতে হয়েছে, উৎসাহ দিতে হয়েছে।

বিচারের রায় নিয়ে হতাশার কারণ কী? গোলাম আযমের বিরুদ্ধে যুদ্ধাপরাধের যে অভিযোগগুলো আনা হয়েছে, এর প্রতিটি প্রমাণিত হয়েছে। সম্মানীত বিচারকরা পরিষ্কার করে বলেছেন, সর্বোচ্চ শাস্তিই তাঁর প্রাপ্য ছিল। শুধু বয়সের কারণে তাঁকে মৃত্যুদণ্ড না দিয়ে ৯০ বছরের জেলা দেওয়া হয়েছে। ৯১ বছরের একজন যুদ্ধাপরাধীর পরবর্তী ৯০ বছর জেলে থাকা মৃত্যুদণ্ড থেকে কোনো অংশে কম নয়। তাহলে কেন আমাদের দেশের তরুণ প্রজন্ম এত হতাশ? কেন তাদের মনে হচ্ছে, তারা ন্যায়বিচার পায়নি?

কারণটি খুব সহজ। বাংলাদেশের ইতিহাসের যা কিছু অশুভ, তার প্রতীক হচ্ছেন গোলাম আযম। স্বাধীনতাযুদ্ধে

এ দেশের বিরুদ্ধে সবচেয়ে বড় বিশ্বাসঘাতকতা করেছেন যে মানুষটি, রাজাকার, আলবদর আলশামস বাহিনী তৈরি করে তাদের হাতে অস্ত্র তুলে দিয়ে এ দেশের মানুষের বিরুদ্ধে লেলিয়ে দেওয়ার পরিকল্পনা আর প্ররোচনা করেছেন যে ব্যক্তি, তাঁর নাম গোলাম আযম। মুক্তিযুদ্ধের শেষে পরাজয় আসন্ন জেনে পাকিস্তানে পালিয়ে যাওয়া, বাংলাদেশের স্বাধীনতার পর এই নতুন দেশটির বিরুদ্ধে প্রচারণা করা, বঙ্গবন্ধুকে সপরিবারে হত্যা করে দেশের পটপরিবর্তন হওয়ার পর দেশে পাকিস্তানি নাগরিক হিসেবে ফিরে আসা, কূটকৌশলে বাংলাদেশের নাগরিকত্ব নিয়ে আবার জামায়াতে ইসলামীর নেতৃত্ব দেওয়া- এর কোনোটিই তো এ দেশের মানুষের অজানা নয়। পৃথিবীর সবচেয়ে বড় পাঁচটি গণহত্যার একটিতে নেতৃত্ব দিয়েও তার জন্য বুকের ভেতর কোনো দুঃখ নেই, অনুতাপ নেই। বরং সদম্ভে ‘একাত্তরে কোনো ভুল করিনি’ বলে নতুন একটি প্রজন্মকে বাংলাদেশের আদর্শের বিরুদ্ধে দাঁড় করানো, মুক্তিযুদ্ধকে ঘৃণা করে, সাম্প্রদায়িকতাকে গ্রহণ করে ষড়যন্ত্র করতে শেখানো, এর মূলে গোলাম আযম। আমাদের মহান মুক্তিযুদ্ধের বিরুদ্ধে সব অশুভ শক্তির প্রতীক গোলাম আযম। এ দেশের শিশুরা যখন একটি রাজাকারের ছবি আঁকার চেষ্টা করে, তারা যে মানুষটির চেহারা ফুটিয়ে তোলার চেষ্টা করে, সেই মানুষটি হলেন গোলাম আযম। তাই এ দেশের মানুষের আশা ছিল, দেশের বিরুদ্ধে থাকা সবচেয়ে বড় যুদ্ধাপরাধীর শাস্তিটিও হবে সর্বোচ্চ শাস্তি।

সেটি হয়নি। এই তরুণ প্রজন্মের মন খারাপ, কারণ তারা ইতিহাসের খাতায় লিখিয়ে যেতে পারল না, এ দেশে সবচেয়ে বড় যুদ্ধাপরাধীকে সবচেয়ে বড় শাস্তিটি পেতে হয়েছে। তাদের মন খারাপ তো হতেই পারে।

আমার পক্ষে সম্ভব হলে আমি দেশের সব তরুণের কাছে গিয়ে বলতাম, তোমরা মন খারাপ কোরো না। হতাশ হয়ো না। আমরা যারা একাত্তরের ভেতর দিয়ে এসেছি, তারা জানি তখন কী ভয়ংকর একটা পরিবেশ ছিল। কিন্তু এর পরও এ দেশের মানুষ হতাশ হয়নি। তারা হতাশ হয়নি বলেই আমরা আমাদের দেশ পেয়েছি। একাত্তরের এই শিক্ষাটা সবাইকে নিতে হবে। রাগ হতে পারে, দুঃখ কিংবা ক্ষোভ হতে পারে; কিন্তু হতাশ হওয়া যাবে না। শহীদ জননী জাহানারা ইমাম যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের যে আন্দোলনের সূচনা করেছিলেন, সেক্টর কমান্ডার ফোরামের বীর মুক্তিযোদ্ধারা যেটাকে নতুন করে উজ্জীবিত করেছেন, সেটি শুরু হয়েছে শুধু তরুণ প্রজন্মের কারণে। তারা তীব্রভাবে এটা চেয়েছিল বলেই ৪০ বছর পর হলেও আমরা গ্লানিমুক্ত হতে চলেছি। তরুণ প্রজন্ম যদি তীব্রভাবে চায় তাহলে এ দেশে জামায়াত-শিবিরের রাজনীতিও নিষিদ্ধ হবে, সাম্প্রদায়িকতার বিষবাষ্প চিরদিনের জন্য মুছে যাবে। তারা যদি চায় তাহলে হেফাজতে ইসলামের মতো সংগঠনগুলোর তীব্র নারী বিদ্বেষ থাকার পরও এ দেশের নারী-পুরুষ পাশাপাশি দেশটাকে গড়ে তুলতে পারবে। শুধু তাদের এটা চাইতে হবে।

আমি জানি, তাদের ভেতর আরো একটা দুর্ভাবনা কাজ করছে। সেটি হচ্ছে, সরকার পরিবর্তন হলে কি যুদ্ধাপরাধীরা শাস্তি না পেয়েই বের হয়ে আসবে? বিষয়টি এত সহজ নয়। সবচেয়ে বড় কথা, এই সরকারের তিন-চতুর্থাংশ মেজরিটি নিয়ে তারা তো সংবিধানে একটা সংশোধনী করে যেতেই পারে, ভবিষ্যতে কোনোভাবেই যেন যুদ্ধাপরাধীরা মুক্ত হতে না পারে। হয়তো এখন আমাদের সেটাও দাবি করতে হবে।

যুদ্ধাপরাধী গোলাম আযমের বিচার প্রক্রিয়াটি আমি মনোযোগ দিয়ে লক্ষ্য করেছি। এ দেশের বিরুদ্ধে তাঁর অবস্থানটি গোপন কিছু নয়। সেটি নিয়ে কোনো অনুতাপ নেই, দোষ স্বীকার করা নেই, দুঃখ নেই, ক্ষমা ভিক্ষা নেই, তাহলে কেন মাথা উঁচু করে পাকিস্তানের জন্য আনুগত্যের কথা স্বীকার করে সত্যটি প্রকাশ করে দেওয়া হয় না? কেন মিথ্যাচার করে নিজেকে বাঁচানোর চেষ্টা করে ট্রাইব্যুনালের সামনে মাথা নিচু করে শাস্তি গ্রহণ করতে হয়?

আমার তখন রাজশাহীর রহনপুরের সেই তরুণ মুক্তিযোদ্ধার কথা মনে পড়ে। পাকিস্তানি সেনাবাহিনীর অফিসারের লেখা বইয়ে উল্লেখ আছে, একাত্তরের জুন মাসে সেনাবাহিনীর হাতে ধরা পড়ার পর যখন বুকে অস্ত্র ধরে তাকে হত্যা করার হুমকি দিয়েছিল, সে তখন গোলাম আযমের মতো মিথ্যাচার করে প্রাণ বাঁচানোর চেষ্টা করেনি। নিচু হয়ে মাতৃভূমির মাটিকে শেষবার চুমু খেয়ে উঠে দাড়িয়ে বলেছিল, আমি মৃত্যুর জন্য প্রস্তুত। আমার রক্ত আমার প্রিয় দেশটাকে স্বাধীন করবে।

এত রক্তে পাওয়া এই দেশ, এই দেশকে যুদ্ধাপরাধের গ্লানি থেকে মুক্ত করতেই হবে। একাত্তরে তরুণরা করেছিল, এখন আবার তরুণদেরই করতে হবে।

সকল অধ্যায়

১. শিক্ষা সফর
২. ‘ডিজিটাল টাইম’ এবং ঘোড়ার মৃতদেহ
৩. জাতি গ্লানিমুক্ত হোক
৪. নববর্ষের শপথ
৫. যুদ্ধাপরাধীর বিচার
৬. গ্লানিমুক্তির ডিসেম্বর
৭. সাদাসিধে কথা
৮. মায়েদের জন্য ভালোবাসা
৯. যারা এসএসসি দিয়েছে…
১০. মা, তোর বদনখানি মলিন হলে…
১১. সাক্ষাৎকার – সমকাল ‘কালের খেয়া’ থেকে (ডিসেম্বর ১৯, ২০১১)
১২. মানুষের ভালোবাসা অসাধারণ বিষয়
১৩. টিপাইমুখ: একটি প্রতিক্রিয়া (জানুয়ারি ০২, ২০১২)
১৪. বিজ্ঞান অলিম্পিয়াড (জানুয়ারি ২৫, ২০১২)
১৫. বই এবং বইমেলা (জানুয়ারি ২৯, ২০১২)
১৬. যারা এসএসসি দিয়েছে (মার্চ ২০, ২০১২)
১৭. একটি পুরোন লেখার নতুন পাঠ : কত দীর্ঘ এই লংমার্চ
১৮. একটি ডিজিটাল বিপর্যয় (এপ্রিল ১৫, ২০১২)
১৯. রাজনীতি নিয়ে ভাবনা (মে ১৯ , ২০১২)
২০. অসহায় মা অসহায় শিশু (জুন ১৪, ২০১২)
২১. মেডিকেল এবং অন্যান্য ভর্তি পরীক্ষা (আগস্ট ২৪, ২০১২)
২২. দুঃখ, লজ্জা এবং ক্ষোভ (অক্টোবর ০৯, ২০১৩)
২৩. ভাবনা এবং দুর্ভাবনা
২৪. প্রতিবন্ধী নই, মানুষ
২৫. ডিসেম্বরের প্রথম প্রহর (ডিসেম্বর ০৬, ২০১৩)
২৬. কোকাকোলা
২৭. তোমরা যারা শিবির করো (ডিসেম্বর ০৭, ২০১২)
২৮. বিশ্বজিতের লাল শার্ট (ডিসেম্বর ২০, ২০১২)
২৯. যুদ্ধাপরাধের বিচার ইস্যুতে সরকারের সঙ্গে থাকতে হবে
৩০. একটি ছোট প্রশ্ন (জানুয়ারি ০২, ২০১৩)
৩১. চলচ্চিত্রের নতুন প্রজন্ম তৈরি করছি
৩২. অন্য রকম ফেব্রুয়ারি
৩৩. আমাদের গণিত অলিম্পিয়াড
৩৪. একাত্তরের দ্বিতীয় পাঠ
৩৫. শাহবাগের প্রজন্ম চত্বরের মহাসমাবেশে তরুণ প্রজন্মের উদ্দেশে বক্তব্য
৩৬. প্রিয় সজল (মে ২৪, ২০১৩)
৩৭. সমাবর্তন বক্তার বক্তব্য (জুন ১১, ২০১৩)
৩৮. সাম্প্রতিক ভাবনা (জুন ৩০, ২০১৩)
৩৯. গ্লানিমুক্ত বাংলাদেশ (জুলাই ১৭, ২০১৩)
৪০. আমার বড় ভাই হুমায়ূন আহমেদ (জুলাই ১৯, ২০১৩)
৪১. মিথ্যা বলার অধিকার (আগস্ট ১৫, ২০১৩)
৪২. এই লজ্জা কোথায় রাখি (আগস্ট ৩০, ২০১৩)
৪৩. আমেরিকা নিয়ে এক ডজন
৪৪. অস্ট্রেলিয়ায় ঝটিকা সফর
৪৫. বিশ্ববিদ্যালয়ের ভর্তি পরীক্ষা
৪৬. সরকারের কাছে অনুরোধ
৪৭. গ্লানি মুক্তির বাংলাদেশ
৪৮. বিষণ্ন বাংলাদেশ : সাদাসিধে কথা
৪৯. এক দুই এবং তিন
৫০. বই বইমেলা এবং অন্যান্য
৫১. একজন অনয়ের গল্প
৫২. আমাদের জাতীয় সঙ্গীত নিয়ে
৫৩. স্বাধীনতার চুয়াল্লিশ বছর
৫৪. অভিভাবক যখন অভিশাপ
৫৫. ‘কান পেতে রই’
৫৬. কেউ কি আমাকে বলবেন?
৫৭. প্রশ্নপত্র ফাঁস কি অপরাধ নয়
৫৮. মাননীয় শিক্ষামন্ত্রীর কাছে অনুরোধ
৫৯. ভাঙ্গা রেকর্ড
৬০. কিছু একটা করি
৬১. কয়েক টুকরো ভাবনা
৬২. আমরা যারা স্বার্থপর
৬৩. ঈদ: এখন এবং তখন
৬৪. একটি অসাধারণ আত্মজীবনী
৬৫. গাড়ির চতুর্থ চাকা
৬৬. একটি দুঃখের গল্প
৬৭. দশ হাজার কোটি নিউরন
৬৮. ইতিহাসের ইতিহাস
৬৯. আমাদের ছেলেমেয়েদের দুঃখ কষ্ট যন্ত্রণা ও অপমান
৭০. একজন সাধাসিধে মা
৭১. শব্দকল্পদ্রুম

নোট নিতে এবং টেক্সট হাইলাইট করতে লগইন করুন

লগইন