বিজ্ঞান অলিম্পিয়াড (জানুয়ারি ২৫, ২০১২)

মুহম্মদ জাফর ইকবাল

কিছুদিন আগে আমি হিসাব করে দেখলাম, আমাদের দেশে এখন অনেক অলিম্পিয়াড শুরু হয়েছে। গণিত অলিম্পিয়াড দিয়ে শুরু। তারপর দেখতে দেখতে বিজ্ঞান অলিম্পিয়াড, পদার্থবিজ্ঞান অলিম্পিয়াড, ইনফরমেটিক্স অলিম্পিয়াড, রসায়ন অলিম্পিয়াড, প্রাণরসায়ন অলিম্পিয়াড, অ্যাস্ট্রোনমি অলিম্পিয়াড, ভাষা অলিম্পিয়াড এবং এমনকি একেবারে শেষ সংযোজন দাবা অলিম্পিয়াড! সবটা যে একই রকম ও আকারে হচ্ছে, তা নয়। কিন্তু শুরু যে হয়েছে_ সেটাই সবচেয়ে বড় কথা। আন্তর্জাতিক গণিত আর ইনফরমেটিক্স অলিম্পিয়াড থেকে আমাদের ছেলেমেয়েরা এর মধ্যে রীতিমতো মেডেল নিয়ে এসেছে। অন্য কয়েকটাতে পৃথিবীর আসরে বাংলাদেশের নাম সম্মানসূচকভাবে উচ্চারিত হচ্ছে। আমাদের বড় বড় মানুষ, বড় বড় খেলোয়াড়রা যা পারেননি, বাচ্চা বাচ্চা ছেলেমেয়ে সেটা করে ফেলছে। কী চমৎকার একটা ব্যাপার!

এই চমৎকার ব্যাপারটার মাঝেও কিন্তু আমাদের খানিকটা ক্ষোভ রয়ে গেছে। বড় মানুষেরা যেটা দেশের জন্য করতে পারেননি, ছোট বাচ্চারা সেটা করে ফেলছে। তারপরও এই বিষয়গুলোতে কেন জানি সাহায্য-সহযোগিতা পাওয়া যায় না। সরকারের কথা ছেড়েই দিলাম, সামরিক বাহিনীর জন্য সরকারের বিশাল বাজেট। এবার মনে হয় সেটা আরও বেড়ে গেছে। আমাদের কোনো আপত্তি থাকত না, যদি দেখতাম আমাদের শিক্ষা খাতেও বাজেট একইভাবে বাড়ছে। কিন্তু আসলে সেটি ঘটেনি, শিক্ষা খাতে বাজেট কমেছে।

একটি ছাত্র যদি একটু কিছু শেখে, সঙ্গে সঙ্গে দেশ আরও একটু সম্পদশালী হয়ে ওঠে। কিন্তু তারপরও শিক্ষার বাজেট কমতে থাকে! আর শিক্ষার পাশাপাশি এই কার্যক্রমগুলো? সেগুলোর জন্য কোথাও কোনো অর্থ নেই! এক গণিত অলিম্পিয়াড ছাড়া অন্য কোনো অলিম্পিয়াডের ভদ্র কোনো বাজেট আছে বলে আমার জানা নেই। কেউ যদি খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে দেখেন, তাহলে তারা অবাক হয়ে দেখবেন, অনেক ক্ষেত্রেই একেবারে ব্যক্তিগত পর্যায়ে কিছু মানুষের অর্থ সাহায্যে এগুলো টিকে আছে! আমার কাছে ব্যাপারটা রহস্যের মতো মনে হয়_ শিশুদের জন্য টাকা খরচ করতে সবার এত কার্পণ্য কেন? একটি ব্যান্ড শো বা একটি ক্রিকেট খেলার জন্য আক্ষরিক অর্থে কোটি কোটি টাকা খরচ করা হয়। কিন্তু শিশুদের কার্যক্রম চালাতে উৎসাহী মানুষেরা বড় বড় কোম্পানি, বড় বড় প্রতিষ্ঠানের দ্বারে ঘুরতে থাকেন, কিন্তু কেউ ফিরেও তাকায় না। এই দেশের হর্তা-কর্তা-বিধাতারা এত শিশুবিদ্বেষী কেন? আমি তার অর্থ খুঁজে বের করতে পারি না! কেউ কি কখনও লক্ষ্য করেছেন ঈদে প্রায় কয়েকশ’ নাটক দেখানো হয়, তার মধ্যে বাচ্চাদের নাটক বলতে গেলে একটিও নেই! যদিও এ দেশে শুধু স্কুলের বাচ্চার সংখ্যাই তিন কোটি! ছোট বাচ্চাদের বিনোদনের কোনো সুযোগ নেই, তাদের জন্য আলাদা কোনো সিনেমা তৈরি হয় না, বই লেখা হয় না। কী আশ্চর্য!

তারপরও আমাদের দেশের বাচ্চারা হচ্ছে আমাদের অনুপ্রেরণার সবচেয়ে বড় উৎস। বিশ্বসাহিত্য কেন্দ্র থেকে বই পড়ার একটা বিশাল কর্মযজ্ঞ চালানো হয়। যারা সেই কর্মযজ্ঞের সঙ্গে জড়িত, তারা জানেন সেখানে ছেলেমেয়েরা কী ম্যাজিক করে ফেলছে! বিভিন্ন অলিম্পিয়াডে যারা গিয়েছে, সেখানে বাচ্চাদের যারা একনজর দেখেছে, শুধু তারাই এ দেশের জন্য নতুন করে স্বপ্ন দেখতে পারবে।

এই শুক্রবার বিজ্ঞান অলিম্পিয়াডের জাতীয় অনুষ্ঠানটি উদযাপিত হতে যাচ্ছে। সারাদেশ থেকে ছোট ছোট ছেলেমেয়ে বিভাগীয় প্রতিযোগিতায় বিজয়ী হয়ে এখানে অংশ নেবে। যারা সেই অলিম্পিয়াডে অংশ নেয়, সেই শিশুরা বেশি আনন্দ পায়, নাকি আমরা যারা সেই শিশুদের দেখি তারা বেশি আনন্দ পাই_ সে ব্যাপারটি এখনও পরিষ্কার হয়নি! দেশ নিয়ে, পৃথিবী নিয়ে কতজনের কত অভিযোগ। কিন্তু এ রকম একটি অলিম্পিয়াডে এসে এই বাচ্চাদের একনজর দেখলে হঠাৎ মনে হয় কিসের দুঃখ, কিসের কষ্ট? যে দেশে এ রকম উৎসাহী শিশুরা এত আগ্রহ নিয়ে বিজ্ঞানচর্চা করে, সেই দেশ যদি মাথা তুলে না দাঁড়ায়, তাহলে কোন দেশ মাথা তুলে দাঁড়াবে?

বাংলাদেশ একাডেমী অব সায়েন্সের প্রতি কৃতজ্ঞতা এ রকম একটি অলিম্পিয়াড আয়োজন করার জন্য। সমকালের প্রতি কৃতজ্ঞতা এতে সঙ্গী হয়ে এগিয়ে আসার জন্য। আর দেশের শিশুদের কাছে কৃতজ্ঞতা আমাদের দেশকে নিয়ে স্বপ্ন দেখার সুযোগ করে দেওয়ার জন্য।

সূত্র: http://www.sadasidhekotha.com/article.php?date=2012-01-25

সকল অধ্যায়

১. শিক্ষা সফর
২. ‘ডিজিটাল টাইম’ এবং ঘোড়ার মৃতদেহ
৩. জাতি গ্লানিমুক্ত হোক
৪. নববর্ষের শপথ
৫. যুদ্ধাপরাধীর বিচার
৬. গ্লানিমুক্তির ডিসেম্বর
৭. সাদাসিধে কথা
৮. মায়েদের জন্য ভালোবাসা
৯. যারা এসএসসি দিয়েছে…
১০. মা, তোর বদনখানি মলিন হলে…
১১. সাক্ষাৎকার – সমকাল ‘কালের খেয়া’ থেকে (ডিসেম্বর ১৯, ২০১১)
১২. মানুষের ভালোবাসা অসাধারণ বিষয়
১৩. টিপাইমুখ: একটি প্রতিক্রিয়া (জানুয়ারি ০২, ২০১২)
১৪. বিজ্ঞান অলিম্পিয়াড (জানুয়ারি ২৫, ২০১২)
১৫. বই এবং বইমেলা (জানুয়ারি ২৯, ২০১২)
১৬. যারা এসএসসি দিয়েছে (মার্চ ২০, ২০১২)
১৭. একটি পুরোন লেখার নতুন পাঠ : কত দীর্ঘ এই লংমার্চ
১৮. একটি ডিজিটাল বিপর্যয় (এপ্রিল ১৫, ২০১২)
১৯. রাজনীতি নিয়ে ভাবনা (মে ১৯ , ২০১২)
২০. অসহায় মা অসহায় শিশু (জুন ১৪, ২০১২)
২১. মেডিকেল এবং অন্যান্য ভর্তি পরীক্ষা (আগস্ট ২৪, ২০১২)
২২. দুঃখ, লজ্জা এবং ক্ষোভ (অক্টোবর ০৯, ২০১৩)
২৩. ভাবনা এবং দুর্ভাবনা
২৪. প্রতিবন্ধী নই, মানুষ
২৫. ডিসেম্বরের প্রথম প্রহর (ডিসেম্বর ০৬, ২০১৩)
২৬. কোকাকোলা
২৭. তোমরা যারা শিবির করো (ডিসেম্বর ০৭, ২০১২)
২৮. বিশ্বজিতের লাল শার্ট (ডিসেম্বর ২০, ২০১২)
২৯. যুদ্ধাপরাধের বিচার ইস্যুতে সরকারের সঙ্গে থাকতে হবে
৩০. একটি ছোট প্রশ্ন (জানুয়ারি ০২, ২০১৩)
৩১. চলচ্চিত্রের নতুন প্রজন্ম তৈরি করছি
৩২. অন্য রকম ফেব্রুয়ারি
৩৩. আমাদের গণিত অলিম্পিয়াড
৩৪. একাত্তরের দ্বিতীয় পাঠ
৩৫. শাহবাগের প্রজন্ম চত্বরের মহাসমাবেশে তরুণ প্রজন্মের উদ্দেশে বক্তব্য
৩৬. প্রিয় সজল (মে ২৪, ২০১৩)
৩৭. সমাবর্তন বক্তার বক্তব্য (জুন ১১, ২০১৩)
৩৮. সাম্প্রতিক ভাবনা (জুন ৩০, ২০১৩)
৩৯. গ্লানিমুক্ত বাংলাদেশ (জুলাই ১৭, ২০১৩)
৪০. আমার বড় ভাই হুমায়ূন আহমেদ (জুলাই ১৯, ২০১৩)
৪১. মিথ্যা বলার অধিকার (আগস্ট ১৫, ২০১৩)
৪২. এই লজ্জা কোথায় রাখি (আগস্ট ৩০, ২০১৩)
৪৩. আমেরিকা নিয়ে এক ডজন
৪৪. অস্ট্রেলিয়ায় ঝটিকা সফর
৪৫. বিশ্ববিদ্যালয়ের ভর্তি পরীক্ষা
৪৬. সরকারের কাছে অনুরোধ
৪৭. গ্লানি মুক্তির বাংলাদেশ
৪৮. বিষণ্ন বাংলাদেশ : সাদাসিধে কথা
৪৯. এক দুই এবং তিন
৫০. বই বইমেলা এবং অন্যান্য
৫১. একজন অনয়ের গল্প
৫২. আমাদের জাতীয় সঙ্গীত নিয়ে
৫৩. স্বাধীনতার চুয়াল্লিশ বছর
৫৪. অভিভাবক যখন অভিশাপ
৫৫. ‘কান পেতে রই’
৫৬. কেউ কি আমাকে বলবেন?
৫৭. প্রশ্নপত্র ফাঁস কি অপরাধ নয়
৫৮. মাননীয় শিক্ষামন্ত্রীর কাছে অনুরোধ
৫৯. ভাঙ্গা রেকর্ড
৬০. কিছু একটা করি
৬১. কয়েক টুকরো ভাবনা
৬২. আমরা যারা স্বার্থপর
৬৩. ঈদ: এখন এবং তখন
৬৪. একটি অসাধারণ আত্মজীবনী
৬৫. গাড়ির চতুর্থ চাকা
৬৬. একটি দুঃখের গল্প
৬৭. দশ হাজার কোটি নিউরন
৬৮. ইতিহাসের ইতিহাস
৬৯. আমাদের ছেলেমেয়েদের দুঃখ কষ্ট যন্ত্রণা ও অপমান
৭০. একজন সাধাসিধে মা
৭১. শব্দকল্পদ্রুম

নোট নিতে এবং টেক্সট হাইলাইট করতে লগইন করুন

লগইন