টিপাইমুখ: একটি প্রতিক্রিয়া (জানুয়ারি ০২, ২০১২)

মুহম্মদ জাফর ইকবাল

১৯৯০ সালে যুক্তরাষ্ট্রের টেক্সাস অঙ্গরাজ্যের গভর্নর পদের জন্য নির্বাচনে প্রার্থী হয়েছিলেন ক্লেটন উইলিয়ামস নামে এক ব্যক্তি। ভদ্রলোক নির্বাচনে জিততে পারেননি, কিন্তু পৃথিবীর অনেক মানুষ তাঁকে মনে রেখেছে তাঁর একটি উক্তির জন্য। তিনি বলেছিলেন, ধর্ষণ থেকে যদি রক্ষা পাওয়ার কোনো উপায় না থাকে, তাহলে চেষ্টা করা উচিত সেটা উপভোগ করা। (আমি যা-ই লিখি, ছোট বাচ্চারা নাকি সেটা পড়ে ফেলে—তাই ওপরের কথাগুলো লিখতে খুব খারাপ লাগছে।) ক্লেটন উইলিয়ামসের কথার মতো হুবহু একটা কথা ২৯ ডিসেম্বর ২০১১-এর প্রথম আলোয় পড়েছি। টিপাইমুখ সম্পর্কে মহিউদ্দিন আহমেদ লিখেছেন, ‘ভারত এই বাঁধ তৈরি করবেই, আমাদের কৌশল হওয়া উচিত এ থেকে আমরা কী সুবিধা নিতে পারব সেই চেষ্টা করা।’

এর কিছুদিন আগে গওহর রিজভী পত্রিকায় একটা লেখা লিখেছিলেন। সেই লেখাটিতে নানা রকম ভণিতা ছিল, দেশ, দেশের স্বার্থ—এই সব বড় বড় কথা ছিল এবং পুরো লেখাটিতে পাঠকদের উপদেশ দেওয়া হয়েছিল, তারা যেন আবেগের বশবর্তী হয়ে হঠকারী কাজকর্ম শুরু করে না দেয়। গওহর রিজভী সরকারের মানুষ, তাঁর লেখাটি পড়ে আমরা সবাই সরকারের ভূমিকাটা কী হবে, তা আঁচ করতে পেরেছিলাম।

আমি নদী বিশেষজ্ঞ নই, পানি বিশেষজ্ঞ নই, পরিবেশ বিশেষজ্ঞ নই। কিন্তু আমার গত ৫৯ বছরের অভিজ্ঞতায় একটা জিনিস শিখেছি, সেটা হচ্ছে পৃথিবীর জটিল থেকে জটিলতম বিষয়টিও কমন সেন্স দিয়ে প্রায় ৯০ ভাগ বুঝে ফেলা যায়। কাজেই বাংলাদেশের মানুষ টিপাইমুখের বিষয়টি শতকরা ৯০ ভাগ শুধু কমন সেন্স দিয়ে কিন্তু বুঝে ফেলেছে। বড় বড় বিশেষজ্ঞ কিউসেকের হিসাব, বর্ষা মৌসুম, শুষ্ক মৌসুম, বন্যা নিয়ন্ত্রণ, সেচব্যবস্থা নিয়ে চুলচেরা বিশ্লেষণ করতে থাকুন, আমরা সাধারণ মানুষ কিছু সাধারণ প্রশ্ন করি:

আমরা কি প্রকৃতিকে নিয়ন্ত্রণ করব, নাকি প্রকৃতির সঙ্গে সহাবস্থান করব? একেবারে ছোট শিশুটিও জানে পৃথিবীতে প্রযুক্তি এখনো প্রকৃতিকে নিয়ন্ত্রণ করার জায়গায় পৌঁছায়নি, কোনো ভূমিকম্প থামানো যায় না, কোনো ঘূর্ণিঝড় বন্ধ করা যায় না, পাহাড় থেকে নেমে আসা পানির ঢল আটকানো যায় না। ঠিক সে রকম একটা নদীকে বন্ধ করা যায় না, গতিপথ ঘুরিয়ে দেওয়া যায় না। নির্বোধ মানুষ যে চেষ্টা করে না তা নয়, পৃথিবীর অনেক জায়গাতেই করা হয়েছে; কিন্তু সেটা মানুষের ওপর অভিশাপ হয়ে নেমে এসেছে। ভবদহের কথা আমরা ভুলিনি, ফারাক্কা আমাদের চোখের সামনেই আছে। কাজেই গওহর রিজভী কিংবা মহিউদ্দিন আহমেদের মতো বিশেষজ্ঞরা যতই বলুন ‘যত তাড়াতাড়ি সম্ভব এই বাঁধ তৈরি করে’ বাংলাদেশকে সুজলা-সুফলা, শস্য-শ্যামলা করে ফেলতে হবে আমি সেই কথা বিশ্বাস করি না। আমাদের দেশে কাপ্তাই বাঁধ দিয়ে বিশাল এলাকা পানিতে ডুবিয়ে দেওয়া হয়েছিল, অসংখ্য অসহায় আদিবাসী মানুষকে রাতারাতি গৃহহারা করা হয়েছিল। এখন সেই চেষ্টা করা হলে বাংলাদেশের মানুষ কোনো দিন সেটা হতে দিত না, কোনো সরকারের সেই দুঃসাহস দেখানোর সাহস হতো না।
কাজেই বিশেষজ্ঞরা যতই বলতে থাকুন টিপাইমুখ বাঁধ বাংলাদেশের জন্য অত্যন্ত শুভ উদ্যোগ, আমি সেটা বিশ্বাস করি না। যারা প্রকৃতিকে ক্ষতিগ্রস্ত করে, আসলে তারা পৃথিবীর ভালো চায় না। তারা বাংলাদেশের মানুষ হোক, ভারত বা চীন যে দেশেরই হোক, তাদের ধিক্কার দিতে হবে। তারা হচ্ছে পৃথিবীর দুর্বৃত্ত।

গওহর রিজভী এবং মহিউদ্দিন আহমেদ দুজনই টিপাইমুখ বাঁধের সুফল নিয়ে ভালো ভালো কথা বলেছেন, তার বেশির ভাগ নিয়ে বিশেষজ্ঞরা তর্ক-বিতর্ক করতে থাকুন। আমি শুধু একটা বিষয় নিয়ে কথা বলতে চাই, সেটা হচ্ছে বন্যা। তাঁরা দুজনেই দাবি করেছেন এই বাঁধ দিয়ে বন্যার প্রকোপ কমানো যাবে। আমি সিলেটে থাকি, আমার বিশ্ববিদ্যালয় থেকে সুরমা নদীর দূরত্ব এক কিলোমিটারও নয়। আমি এখানে ১৭ বছর ধরে আছি, শুধু একবার (২০০৪ সালে) সুরমা নদীর পানি উপচে এসেছিল, আমি তো আর কখনো সুরমা নদীর পানিকে তীর ভেঙে আসতে দেখিনি! হাওর অঞ্চল তো প্রতিবছর পানিতে ডুবে যায়, ডুবে যাওয়ারই কথা, সেটাই হচ্ছে এর প্রাকৃতিক বৈচিত্র্য। সেটা তো বন্যা নয়। তাহলে তাঁরা কোন বন্যাকে ঠেকানোর কথা বলছেন? যে বন্যার অস্তিত্ব নেই, সেই বন্যার প্রকোপ থামানোর কথা বললে আমরা যদি বিশেষজ্ঞদের দিকে ভুরু কুঁচকে তাকাই কেউ আমাকে দোষ দিতে পারবে? এই বন্যা নিয়ে তাঁদের বিশেষজ্ঞ মতামত আমার কাছে অর্থহীন মনে হয়—ঠিক সে রকম তাঁদের অন্যান্য বিশেষজ্ঞ মতামতও যে অর্থহীন নয়, সেই গ্যারান্টি আমাকে কে দেবে?

মহিউদ্দিন আহমেদ বলেছেন, ‘ভারত এই বাঁধ তৈরি করবেই’, তিনি তার বিরোধিতা করতেও রাজি নন। কোনো রকম চেষ্টা না করে পরাজয় স্বীকার করার মধ্যে কোনো গৌরব নেই। টিপাইমুখ বাঁধ বন্ধ করার চেষ্টাকে এ মুহূর্তে তাঁর কাছে এবং সম্ভবত আরও অনেকের কাছে খুব কঠিন কাজ মনে হচ্ছে। সারা দেশে টিপাইমুখের বিরুদ্ধে একটা আন্দোলন গড়ে তোলা এই মানুষগুলোর কাছে একটা অযৌক্তিক এবং অসম্ভব কাজ বলে মনে হচ্ছে। কাজেই তাঁরা এর জন্য চেষ্টা করতেও রাজি নন।

তাঁদের সবাইকে মনে করিয়ে দেওয়া যায় ১৯৭১ সালের ২৫ মার্চ পাকিস্তান সেনাবাহিনী যখন এই দেশে গণহত্যা শুরু করেছিল তখন কোনো মানুষ যদি যুক্তিতর্ক দিয়ে বিবেচনা করত তাহলে তারা নিশ্চিতভাবেই ধরে নিত বাংলাদেশের স্বাধীনতা অর্জন করা একটা পুরোপুরি অবাস্তব বিষয়। মার্চ মাসে শুরু করে মে মাসের মাঝামাঝি পুরো দেশটা পাকিস্তান সেনাবাহিনী দখল করে নিয়েছিল। এখন যাদের যুদ্ধাপরাধী হিসেবে বিচার করা হচ্ছে তারা সেই পাকিস্তান সেনাবাহিনীর পদলেহী অনুচর। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র এবং চীনের মতো দেশ পাকিস্তানের পক্ষে, পৃথিবীর মুসলমান দেশগুলোও পাকিস্তানের পক্ষে, এক কোটি মানুষ দেশছাড়া, যারা দেশে আছে তাদের বাড়িঘর পুড়িয়ে, খুন করে সারা দেশে হাহাকার। দেশের কিছু কম বয়সী ছেলেমেয়ে মুক্তিযুদ্ধ করতে গিয়েছে, তাদের হাতে অস্ত্র নেই, যুদ্ধের অভিজ্ঞতা নেই, পেশাদার বাহিনী বিশৃঙ্খল, যাঁরা নেতৃত্ব দেবেন তাঁদের মধ্যেও কোন্দল—এ রকম একটা পরিবেশ দিয়ে শুরু করে আমরা স্বাধীন একটা দেশ ছিনিয়ে আনতে পারব সেটা কি কেউ কল্পনা করেছিল? করেনি। কিন্তু তার পরও এই দেশের মানুষ দেশপ্রেমের যুক্তিহীন আবেগকে মূলধন করে এই দেশকে স্বাধীন করে ছেড়েছিল।

কাজেই যাঁরা এই দেশের হর্তাকর্তা-বিধাতা তাঁরা এই দেশের মানুষের ‘যুক্তিহীন’ আবেগকে খাটো করে দেখবেন না। প্রকৃতিকে নিয়ন্ত্রণ করতে হয় না, তার সঙ্গে সহাবস্থান করতে হয়। টিপাইমুখের বেলায়ও হুবহু একই কথা বলা যায়—দেশের মানুষের আবেগকে নিয়ন্ত্রণ করার বৃথা চেষ্টা করবেন না, তাদের সঙ্গে সহাবস্থান করুন।

সূত্র: http://www.sadasidhekotha.com/article.php?date=2012-01-02

সকল অধ্যায়

১. শিক্ষা সফর
২. ‘ডিজিটাল টাইম’ এবং ঘোড়ার মৃতদেহ
৩. জাতি গ্লানিমুক্ত হোক
৪. নববর্ষের শপথ
৫. যুদ্ধাপরাধীর বিচার
৬. গ্লানিমুক্তির ডিসেম্বর
৭. সাদাসিধে কথা
৮. মায়েদের জন্য ভালোবাসা
৯. যারা এসএসসি দিয়েছে…
১০. মা, তোর বদনখানি মলিন হলে…
১১. সাক্ষাৎকার – সমকাল ‘কালের খেয়া’ থেকে (ডিসেম্বর ১৯, ২০১১)
১২. মানুষের ভালোবাসা অসাধারণ বিষয়
১৩. টিপাইমুখ: একটি প্রতিক্রিয়া (জানুয়ারি ০২, ২০১২)
১৪. বিজ্ঞান অলিম্পিয়াড (জানুয়ারি ২৫, ২০১২)
১৫. বই এবং বইমেলা (জানুয়ারি ২৯, ২০১২)
১৬. যারা এসএসসি দিয়েছে (মার্চ ২০, ২০১২)
১৭. একটি পুরোন লেখার নতুন পাঠ : কত দীর্ঘ এই লংমার্চ
১৮. একটি ডিজিটাল বিপর্যয় (এপ্রিল ১৫, ২০১২)
১৯. রাজনীতি নিয়ে ভাবনা (মে ১৯ , ২০১২)
২০. অসহায় মা অসহায় শিশু (জুন ১৪, ২০১২)
২১. মেডিকেল এবং অন্যান্য ভর্তি পরীক্ষা (আগস্ট ২৪, ২০১২)
২২. দুঃখ, লজ্জা এবং ক্ষোভ (অক্টোবর ০৯, ২০১৩)
২৩. ভাবনা এবং দুর্ভাবনা
২৪. প্রতিবন্ধী নই, মানুষ
২৫. ডিসেম্বরের প্রথম প্রহর (ডিসেম্বর ০৬, ২০১৩)
২৬. কোকাকোলা
২৭. তোমরা যারা শিবির করো (ডিসেম্বর ০৭, ২০১২)
২৮. বিশ্বজিতের লাল শার্ট (ডিসেম্বর ২০, ২০১২)
২৯. যুদ্ধাপরাধের বিচার ইস্যুতে সরকারের সঙ্গে থাকতে হবে
৩০. একটি ছোট প্রশ্ন (জানুয়ারি ০২, ২০১৩)
৩১. চলচ্চিত্রের নতুন প্রজন্ম তৈরি করছি
৩২. অন্য রকম ফেব্রুয়ারি
৩৩. আমাদের গণিত অলিম্পিয়াড
৩৪. একাত্তরের দ্বিতীয় পাঠ
৩৫. শাহবাগের প্রজন্ম চত্বরের মহাসমাবেশে তরুণ প্রজন্মের উদ্দেশে বক্তব্য
৩৬. প্রিয় সজল (মে ২৪, ২০১৩)
৩৭. সমাবর্তন বক্তার বক্তব্য (জুন ১১, ২০১৩)
৩৮. সাম্প্রতিক ভাবনা (জুন ৩০, ২০১৩)
৩৯. গ্লানিমুক্ত বাংলাদেশ (জুলাই ১৭, ২০১৩)
৪০. আমার বড় ভাই হুমায়ূন আহমেদ (জুলাই ১৯, ২০১৩)
৪১. মিথ্যা বলার অধিকার (আগস্ট ১৫, ২০১৩)
৪২. এই লজ্জা কোথায় রাখি (আগস্ট ৩০, ২০১৩)
৪৩. আমেরিকা নিয়ে এক ডজন
৪৪. অস্ট্রেলিয়ায় ঝটিকা সফর
৪৫. বিশ্ববিদ্যালয়ের ভর্তি পরীক্ষা
৪৬. সরকারের কাছে অনুরোধ
৪৭. গ্লানি মুক্তির বাংলাদেশ
৪৮. বিষণ্ন বাংলাদেশ : সাদাসিধে কথা
৪৯. এক দুই এবং তিন
৫০. বই বইমেলা এবং অন্যান্য
৫১. একজন অনয়ের গল্প
৫২. আমাদের জাতীয় সঙ্গীত নিয়ে
৫৩. স্বাধীনতার চুয়াল্লিশ বছর
৫৪. অভিভাবক যখন অভিশাপ
৫৫. ‘কান পেতে রই’
৫৬. কেউ কি আমাকে বলবেন?
৫৭. প্রশ্নপত্র ফাঁস কি অপরাধ নয়
৫৮. মাননীয় শিক্ষামন্ত্রীর কাছে অনুরোধ
৫৯. ভাঙ্গা রেকর্ড
৬০. কিছু একটা করি
৬১. কয়েক টুকরো ভাবনা
৬২. আমরা যারা স্বার্থপর
৬৩. ঈদ: এখন এবং তখন
৬৪. একটি অসাধারণ আত্মজীবনী
৬৫. গাড়ির চতুর্থ চাকা
৬৬. একটি দুঃখের গল্প
৬৭. দশ হাজার কোটি নিউরন
৬৮. ইতিহাসের ইতিহাস
৬৯. আমাদের ছেলেমেয়েদের দুঃখ কষ্ট যন্ত্রণা ও অপমান
৭০. একজন সাধাসিধে মা
৭১. শব্দকল্পদ্রুম

নোট নিতে এবং টেক্সট হাইলাইট করতে লগইন করুন

লগইন