যুদ্ধাপরাধীর বিচার

মুহম্মদ জাফর ইকবাল

ডিসেম্বর মাসটি একটি অন্যরকম মাস। আটত্রিশ বছর পরেও আমার মনে হয় এই বুঝি সেদিনের ঘটনা। বিজয়ের আনন্দ উপভোগ করার আগেই শুনতে পেয়েছিলাম আলবদর বাহিনীর ঠাণ্ডামাথায় বুদ্ধিজীবী হত্যার খবর। শুনেও বিশ্বাস হতে চায় না_ আমাদের পরিচিত শিক্ষকদের খুন করেছে আলবদর বাহিনী_ খবরের কাগজে যখন বদর বাহিনীর খুনীদের নাম ছাপা হয়েছে সেখানেও আছে আমার পরিচিত সহপাঠী, জামায়াতে ইসলামীর ছাত্র সংগঠন ইসলামী ছাত্র সংঘের সদস্য। ১৪ ডিসেম্বর তারিখটি তাই বুদ্ধিজীবীদের স্মরণে আলাদা করে রাখা আছে, তার দুদিন পরেই বিজয় দিবস। শোক আর আনন্দ পাশাপশি, দুদিন এদিক ওদিক।

একাত্তর সালে কতজন মানুষকে হত্যা করা হয়েছিল তার সঠিক পরিসংখ্যান নেই। আমরা অনুমান করে নিই সংখ্যাটি ত্রিশ লাখ। যাদের হত্যা করা হয়েছে, যারা যুদ্ধের মারা গেছে, শরণাথর্ী শিবিরে রোগে শোকে যারা মারা গেছে তাদের সবার সংখ্যা যোগ করলে প্রকৃত সংখ্যাটি আরও বেশি হতে পারে। আমি জানি এই প্রজন্মের কাছে সেটা অবিশ্বাস্য মনে হয়, কিন্তু আমরা যারা একাত্তরের ভেতর দিয়ে এসেছি শুধু তারাই জানি মৃতু্য তখন কী একটা সহজ বিষয় ছিল! নয় মাসে ত্রিশ লাখ লোক মারা গেলে দৈনিক হাজার দশেক মানুষকে হত্যা করা হয়েছে_ সেই হিসেবে একাত্তরের নয় মাসের প্রতিটি দিনই কিন্তু একটি শহীদ দিবস, একটি শোক দিবস। যখন আমরা এই দেশের প্রত্যেকটি বধ্যভূমিকে চিহ্নিত করে সঠিক ইতিহাসটি লিপিবদ্ধ করব তখন সবার কাছে সেটি আরও অনেক স্পষ্ট হবে।

একাত্তর সালে পাকিস্তানী সেনাবাহিনী এত দক্ষতার সাথে সাধারণ মানুষদের হত্যা করতে পেরেছিল কারণ তারা তাদের পাশে পেয়েছিল এই দেশের কিছু পদলেহী বিশ্বাসঘাতক। রাজাকার-আলবদর নামে তাদের পরিচয় আর এই শব্দগুলোর চাইতে ঘৃণিত কোন শব্দ এই দেশে আর কখনো জন্ম নেবে বলে মনে হয় না। সেই কুখ্যাত বদর বাহিনীর প্রধানের নাম ছিল মতিউর রহমান নিজামী_ সেদিন হঠাৎ করে খবরের কাগজে তার একটা বক্তব্য চোখে পড়ল। বক্তব্যটি এরকম : যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের কথা বলে এই সরকার আসলে দেশকে ইসলামহীন করার পাঁয়তারা করছে!

মতিউর রহমান নিজামী না হয়ে অন্য যে কোন মানুষ হলে এই কথাটি পড়ে আমি তার জন্য এক ধরনের মায়া অনুভব করতাম_ কারণ দেশ পৃথিবী সমাজ সম্পর্কে বিন্দুমাত্র কোন ধারণা না থাকলেই শুধু একজন মানুষ এরকম মন্তব্য করতে পারে। ডুবে যাওয়া মানুষের খড়কুটো আঁকড়ে ধরার মতো একটি ঘটনা প্রাক্তন বদর বাহিনীর প্রধান এখনও বিশ্বাস করে ‘ইসলাম গেলো’ ‘ইসলাম গেলো’ রব তুললেই সব মানুষ বুঝি হাতে নাঙ্গা তলোয়ার নিয়ে তার পিছনে এসে দাঁড়াবে_ বিষয়টি আর সেরকম নেই। উনিশ শ’ একাত্তর সালের পর প্রায় চার দশক পার হয়ে গেছে তার মাঝে সম্ভাব্য সবরকম সরকার আমরা দেখেছি। “মিলিটারি+তত্ত্বাবধায়ক” এই হাইব্রিড সরকারটি আমাদের দেখা বাকি ছিল। ২০০৭-২০০৮ এ আমরা সেটাও দেখে ফেলেছি। এই নানা ধরনের সরকারের আমলে নানা ধরনের শাসন হয়েছে যার বৈচিত্র্যের কোন শেষ নেই, দেশের মানুষ তার খুটিনাটি সবকিছু ভাল করে বুঝেছে কী না জানি না, কিন্তু অন্তত একটা জিনিস বুঝেছে যে এই দেশের মাটিতে তাদের ধর্ম কর্ম করতে কোন সরকার কখনও বাধা দেয়নি। মুসলমান না হয়ে অন্য ধর্মের হলে তাদের ভোগান্তি হয়নি সেটি সত্যি নয়_ কিন্তু কোন মুসলমান ধর্ম পালন করতে পারেনি সেই কথাটি কেউ বলবে না। এই দেশে ইসলাম কখনও ধ্বংস হয়নি।

কাজেই বদর বাহিনীর প্রধান মতিউর রহমান নিজামীর মুখ থেকে যখন উচ্চারিত হয় যে যুদ্ধাপরাধীদের বিচার করার ছলে দেশকে ইসলামহীন করে দেয়া হচ্ছে তখন সবাই কথাটি ভাল করে বুঝতে চায়। যুদ্ধাপরাধীর বিচার করে ইসলামকে ধ্বংস করা না বলে যদি বলা হতো যে জামায়াতে ইসলামী নামক রাজনৈতিক দলটিকে ধ্বংস করে দেয়া হচ্ছে তাহলে অনেক মানুষই হয়তো কথাটিকে গুরুত্ব দিত। সম্ভবত তাদের দাবি যে এই দেশে তারা ইসলাম ধর্মের এজেন্সি নিয়েছে এবং এই দলটি ধ্বংস হলে ইসলামও ধ্বংস হয়ে যাবে! কারণ উনিশ শ’ একাত্তর সালের যুদ্ধাপরাধের সবচেয়ে বড় অপরাধীদের মধ্যে রয়েছে এই দলটির প্রবীণ নেতারা। বিচার কাজ শুরু হওয়া মাত্রই তাদের অতীত ইতিহাস একটি একটি করে বের হয়ে আসবে। আমাদের দেশে এখন রয়েছে অত্যন্ত ক্ষমতাশীল চৌকস একটি সংবাদ মাধ্যম, কাজেই অতীতের সেই নৃশংস ঘটনাগুলো চোখের পলকে এই দেশের মানুষ, পৃথিবীর মানুষ নতুন করে জানতে পারবে। কাজেই এটি সত্যি কথা_ জামায়াতে ইসলামী নামক দলটি মহাবিপদের মধ্যে আছে, সত্যি সত্যি তাদের ধ্বংস হবার সম্ভাবনা আছে।

বিচারের রায় কী হবে আমরা কেউ জানি না, কিন্তু অন্তত একটি জিনিস জানি, এই বিচার প্রক্রিয়া চলার সময় এই যুদ্ধাপরাধী এবং তাদের রাজনৈতিক দলের জন্যে মানুষের ভেতর নূতন করে যে ঘৃণার জন্ম হবে সেটি হবে বিচারের রায় থেকেও অনেক শক্তিশালী একটি ব্যাপার।

একটা রাজনৈতিক দল চালাতে হলে সেখানে নতুন প্রজন্মকে যোগ দিতে হয়। পুরাতন নেতারা অবসর নেয়ার পর নতুন নেতারা তাদের স্থান দখল করে নিতে থাকে।

প্রাক্তন বদর বাহিনীর দল জামায়াতে ইসলামীতে সেটি কেমন করে ঘটে দেখার জন্যে আমি অনেক আগ্রহ নিয়ে অপেক্ষা করছি। যে দলটি মুক্তিযুদ্ধের বিরোধিতা করে বাংলাদেশকে টুঁটি চেপে হত্যা করতে চেয়েছে, মুক্তিযোদ্ধাদের হত্যা করেছে, বুদ্ধিজীবীদের হত্যা করেছে, সেই দলটিতে এই দেশের নতুন প্রজন্ম আর যোগ দেবে আমার সেই বিশ্বাস নেই। এই দেশের তরুণ সমাজ এত বড় বেইমান নয়।

এই দেশের তরুণ প্রজন্মকে আমি চিনি। অতীতে তাদের ধোঁকা দিয়ে যুদ্ধাপরাধীদের দলে টেনে নেয়া গেছে ভবিষ্যতে আর নেয়া যাবে না।

আধুনিক পৃথিবীতে সব ধরনের দল টিকে থাকতে পারে কিন্তু যুদ্ধাপরাধীর দল টিকে থাকতে পারে না। পৃথিবীর কোথাও টিকে নেই।

সকল অধ্যায়

১. শিক্ষা সফর
২. ‘ডিজিটাল টাইম’ এবং ঘোড়ার মৃতদেহ
৩. জাতি গ্লানিমুক্ত হোক
৪. নববর্ষের শপথ
৫. যুদ্ধাপরাধীর বিচার
৬. গ্লানিমুক্তির ডিসেম্বর
৭. সাদাসিধে কথা
৮. মায়েদের জন্য ভালোবাসা
৯. যারা এসএসসি দিয়েছে…
১০. মা, তোর বদনখানি মলিন হলে…
১১. সাক্ষাৎকার – সমকাল ‘কালের খেয়া’ থেকে (ডিসেম্বর ১৯, ২০১১)
১২. মানুষের ভালোবাসা অসাধারণ বিষয়
১৩. টিপাইমুখ: একটি প্রতিক্রিয়া (জানুয়ারি ০২, ২০১২)
১৪. বিজ্ঞান অলিম্পিয়াড (জানুয়ারি ২৫, ২০১২)
১৫. বই এবং বইমেলা (জানুয়ারি ২৯, ২০১২)
১৬. যারা এসএসসি দিয়েছে (মার্চ ২০, ২০১২)
১৭. একটি পুরোন লেখার নতুন পাঠ : কত দীর্ঘ এই লংমার্চ
১৮. একটি ডিজিটাল বিপর্যয় (এপ্রিল ১৫, ২০১২)
১৯. রাজনীতি নিয়ে ভাবনা (মে ১৯ , ২০১২)
২০. অসহায় মা অসহায় শিশু (জুন ১৪, ২০১২)
২১. মেডিকেল এবং অন্যান্য ভর্তি পরীক্ষা (আগস্ট ২৪, ২০১২)
২২. দুঃখ, লজ্জা এবং ক্ষোভ (অক্টোবর ০৯, ২০১৩)
২৩. ভাবনা এবং দুর্ভাবনা
২৪. প্রতিবন্ধী নই, মানুষ
২৫. ডিসেম্বরের প্রথম প্রহর (ডিসেম্বর ০৬, ২০১৩)
২৬. কোকাকোলা
২৭. তোমরা যারা শিবির করো (ডিসেম্বর ০৭, ২০১২)
২৮. বিশ্বজিতের লাল শার্ট (ডিসেম্বর ২০, ২০১২)
২৯. যুদ্ধাপরাধের বিচার ইস্যুতে সরকারের সঙ্গে থাকতে হবে
৩০. একটি ছোট প্রশ্ন (জানুয়ারি ০২, ২০১৩)
৩১. চলচ্চিত্রের নতুন প্রজন্ম তৈরি করছি
৩২. অন্য রকম ফেব্রুয়ারি
৩৩. আমাদের গণিত অলিম্পিয়াড
৩৪. একাত্তরের দ্বিতীয় পাঠ
৩৫. শাহবাগের প্রজন্ম চত্বরের মহাসমাবেশে তরুণ প্রজন্মের উদ্দেশে বক্তব্য
৩৬. প্রিয় সজল (মে ২৪, ২০১৩)
৩৭. সমাবর্তন বক্তার বক্তব্য (জুন ১১, ২০১৩)
৩৮. সাম্প্রতিক ভাবনা (জুন ৩০, ২০১৩)
৩৯. গ্লানিমুক্ত বাংলাদেশ (জুলাই ১৭, ২০১৩)
৪০. আমার বড় ভাই হুমায়ূন আহমেদ (জুলাই ১৯, ২০১৩)
৪১. মিথ্যা বলার অধিকার (আগস্ট ১৫, ২০১৩)
৪২. এই লজ্জা কোথায় রাখি (আগস্ট ৩০, ২০১৩)
৪৩. আমেরিকা নিয়ে এক ডজন
৪৪. অস্ট্রেলিয়ায় ঝটিকা সফর
৪৫. বিশ্ববিদ্যালয়ের ভর্তি পরীক্ষা
৪৬. সরকারের কাছে অনুরোধ
৪৭. গ্লানি মুক্তির বাংলাদেশ
৪৮. বিষণ্ন বাংলাদেশ : সাদাসিধে কথা
৪৯. এক দুই এবং তিন
৫০. বই বইমেলা এবং অন্যান্য
৫১. একজন অনয়ের গল্প
৫২. আমাদের জাতীয় সঙ্গীত নিয়ে
৫৩. স্বাধীনতার চুয়াল্লিশ বছর
৫৪. অভিভাবক যখন অভিশাপ
৫৫. ‘কান পেতে রই’
৫৬. কেউ কি আমাকে বলবেন?
৫৭. প্রশ্নপত্র ফাঁস কি অপরাধ নয়
৫৮. মাননীয় শিক্ষামন্ত্রীর কাছে অনুরোধ
৫৯. ভাঙ্গা রেকর্ড
৬০. কিছু একটা করি
৬১. কয়েক টুকরো ভাবনা
৬২. আমরা যারা স্বার্থপর
৬৩. ঈদ: এখন এবং তখন
৬৪. একটি অসাধারণ আত্মজীবনী
৬৫. গাড়ির চতুর্থ চাকা
৬৬. একটি দুঃখের গল্প
৬৭. দশ হাজার কোটি নিউরন
৬৮. ইতিহাসের ইতিহাস
৬৯. আমাদের ছেলেমেয়েদের দুঃখ কষ্ট যন্ত্রণা ও অপমান
৭০. একজন সাধাসিধে মা
৭১. শব্দকল্পদ্রুম

নোট নিতে এবং টেক্সট হাইলাইট করতে লগইন করুন

লগইন