একটি ডিজিটাল বিপর্যয় (এপ্রিল ১৫, ২০১২)

মুহম্মদ জাফর ইকবাল

বর্তমান সরকার একটা বড় কাজ করেছে—এই দেশের সব মানুষকে ‘ডিজিটাল’ শব্দটি শিখিয়ে দিয়েছে। প্রথম প্রথম শব্দটা নিয়ে একটু বিভ্রান্তি ছিল, এখন সেই বিভ্রান্তি নেই। তবে ডিজিটাল সাফল্যের পাশাপাশি মাঝেমধ্যে ডিজিটাল বিপর্যয় হয়ে কিছু একটা যে বুমেরাং হয়ে ফিরে আসে না তা নয়। সর্বশেষ বুমেরাংটি হচ্ছে ডিজিটাল পদ্ধতিতে বিসিএস প্রিলিমিনারি পরীক্ষার আবেদন। পদ্ধতিটা নতুন নয়—আমাদের বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তিপরীক্ষার রেজিস্ট্রেশনের জন্য আমরা প্রথমবার এটি শুরু করেছিলাম—এখন বিষয়টি প্রায় রুটিনমাফিক সবাই ব্যবহার করে। কাজেই পিএসসি তাদের বিসিএস আবেদনের জন্য এটি ব্যবহার করেছে, তাতে অবাক হওয়ার কিছু নেই—কিন্তু এটি যেভাবে দেশে একটি বিপর্যয়ের জন্ম দিয়েছে তাতে অবাক হওয়ার একটা সুযোগ তৈরি হয়ে গেছে।
বিষয়টি ঘটেছে এভাবে: প্রার্থীদের আবেদনের শেষ সময় ছিল ৭ এপ্রিল ২০১২ তারিখের দিবাগত রাত ১২টা পর্যন্ত। কাজেই কোনো প্রার্থী যদি একেবারে শেষ মুহূর্তেও (রাত ১১টা বেজে ৫৯ মিনিট ৫৯ সেকেন্ড) আবেদন করেন তাহলে তাঁর আবেদনটি প্রক্রিয়া করতে হবে। সেটি করা হয়নি।
কেন করা হয়নি সেটি আমি আগেই অনুমান করতে পেরেছি, এই প্রতিবেদনটি লেখার আগে বিভিন্ন জায়গায় কথা বলে নিশ্চিত হয়েছি। ডিজিটাল পদ্ধতির ওপর সবার অনেক বিশ্বাস, তাই আমরা সব সময়ই দেখেছি একেবারে শেষ মুহূর্তে অসংখ্য আবেদনকারী আবেদন করে বসে থাকে। কেন অনেক সময় হাতে রেখে তারা ধীরেসুস্থে আবেদন না করে একেবারে শেষ মুহূর্তের জন্য বসে থাকে সেটি নিয়ে মনোবিজ্ঞানীরা গবেষণা করতে পারেন কিন্তু আমাদের এই সমস্যার কার্যকর সমাধান করতে হয়। যান্ত্রিক সীমাবদ্ধতার জন্য শেষ মুহূর্তের বিপুল সংখ্যক আবেদনকারীর আবেদন নির্দিষ্ট সময়ের মধ্যে প্রক্রিয়া করা না গেলেও আমরা সেটি নিয়ে মোটেও মাথা ঘামাই না—কারণ কারা ঠিক সময়ের ভেতর আবেদন করেছে তার নিখুঁত হিসাব আমাদের কাছে থাকে। (যারা একটু টেকনিক্যাল কথা শুনতে আপত্তি করবেন না তাদের বলা যায় টাকা জমা দেওয়ার জন্য সবাইকে পিন নম্বর দেওয়া হয়—যাদের কাছে সেই পিন নম্বরটি আছে তারা যে পিএসসির বেঁধে দেওয়া সময়ের মধ্যে আবেদন করেছেন তার একেবারে আইনসম্মত প্রমাণ আছে।) কাজেই বেঁধে দেওয়া সময় পার হলেও যারা ঠিক সময়ের মধ্যে আবেদন করেছে তাদের আবেদন পরেও প্রক্রিয়া করা যায়, কিন্তু পিএসসি সেই সুযোগটি নেয়নি। চমৎকার কার্যকর একটি ডিজিটাল-প্রক্রিয়া—যেটি অন্য সবাই সাধারণ মানুষের জীবনকে সহজ করার জন্য ব্যবহার করেছে, তারা সেই একই প্রক্রিয়া দিয়ে মানুষের জীবনে একটা বিপর্যয় ঘটিয়ে দিয়েছে। আমি আইন খুব ভালো বুঝি না—কিন্তু এটুকু জানি, আইন কখনোই কমন সেন্সের বিপরীত হয় না এবং সাধারণ মানুষকে বিপদে ফেলার জন্য তৈরি হয় না। কাজেই পিএসসি নিশ্চিতভাবেই আইনসংগত কাজ করেনি। আমার দুশ্চিন্তা অবশ্য অন্য জায়গায়—দেশের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ প্রতিষ্ঠানের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ মানুষেরা যদি এ ধরনের একটি সহজ বিষয় বুঝতে না পারেন তাহলে আমরা কাদের ওপর ভরসা করব? এই বুমেরাংটি আমরা নিজেদের চোখে ছুটে আসতে দেখছি—আমাদের চোখের আড়ালে এ রকম বুমেরাং কি আরও ফিরে এসেছে?
যেহেতু এই প্রক্রিয়াটি আমাদের বিশ্ববিদ্যালয়ের পক্ষ থেকে টেলিটকের সাহায্য নিয়ে প্রথমবার করা হয়েছিল, তাই আমি নৈতিকভাবে খানিকটা চাপ অনুভব করে টেলিটকের সঙ্গে কথা বলেছি। তারা জানিয়েছে, সব তথ্য তাদের কাছে সংরক্ষিত আছে এবং অনুমতি দেওয়া হলে তারা প্রায় সাড়ে ১১ হাজার আবেদনকারীর আবেদন প্রক্রিয়া করে ফেলতে পারবে। আমার ধারণা, বিষয়টিকে হাইকোর্ট-রিট-মামলা এ রকম পর্যায়ে যেতে না দিয়ে কমন সেন্স ব্যবহার করে সমাধান করে ফেলা সবচেয়ে সহজ।
যেহেতু পিএসসি নিয়ে কথা হচ্ছে, এই সুযোগে সম্পূর্ণ অপ্রাসঙ্গিক একটা কথা বলে ফেলি। কোনো একটি বিসিএস প্রিলিমিনারি পরীক্ষার আগে আমি ট্রেনে ঢাকা যাচ্ছিলাম এবং আমার বগিতে অনেক পরীক্ষার্থী বসে ছিল। সবার হাতে এক ধরনের গাইড বই এবং সবাই গুনগুন করে সেই গাইড বই মুখস্থ করতে করতে যাচ্ছে। আমি কৌতূহলী হয়ে সেই গাইড বইটি এক নজর দেখে একেবারে হতভম্ব হয়ে গেলাম—সবাই নানা রকম তথ্য মুখস্থ করে যাচ্ছে। তথ্য মুখস্থ রাখার ক্ষমতা কি বিসিএস পরীক্ষার উদ্দেশ্য হতে পারে?
আমরা যখন একেবারে প্রাইমারি স্কুলের বাচ্চাদেরও কিছু মুখস্থ করতে না দিয়ে সৃজনশীল পদ্ধতিতে পরীক্ষা দিতে দিচ্ছি, সেই সময় দেশের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ পরীক্ষার্থীরা তথ্য মুখস্থ করে যাচ্ছে? তাদের মুখস্থবিদ্যার ক্ষমতা যাচাই না করে সৃজনশীল ক্ষমতা যাচাই করা কি এতই কঠিন? সেটি কি পিএসসির কেউ এখনো জানেন না?

এপ্রিল ১৫, ২০১২

সূত্র: http://www.sadasidhekotha.com/article.php?date=2012-04-15

সকল অধ্যায়

১. শিক্ষা সফর
২. ‘ডিজিটাল টাইম’ এবং ঘোড়ার মৃতদেহ
৩. জাতি গ্লানিমুক্ত হোক
৪. নববর্ষের শপথ
৫. যুদ্ধাপরাধীর বিচার
৬. গ্লানিমুক্তির ডিসেম্বর
৭. সাদাসিধে কথা
৮. মায়েদের জন্য ভালোবাসা
৯. যারা এসএসসি দিয়েছে…
১০. মা, তোর বদনখানি মলিন হলে…
১১. সাক্ষাৎকার – সমকাল ‘কালের খেয়া’ থেকে (ডিসেম্বর ১৯, ২০১১)
১২. মানুষের ভালোবাসা অসাধারণ বিষয়
১৩. টিপাইমুখ: একটি প্রতিক্রিয়া (জানুয়ারি ০২, ২০১২)
১৪. বিজ্ঞান অলিম্পিয়াড (জানুয়ারি ২৫, ২০১২)
১৫. বই এবং বইমেলা (জানুয়ারি ২৯, ২০১২)
১৬. যারা এসএসসি দিয়েছে (মার্চ ২০, ২০১২)
১৭. একটি পুরোন লেখার নতুন পাঠ : কত দীর্ঘ এই লংমার্চ
১৮. একটি ডিজিটাল বিপর্যয় (এপ্রিল ১৫, ২০১২)
১৯. রাজনীতি নিয়ে ভাবনা (মে ১৯ , ২০১২)
২০. অসহায় মা অসহায় শিশু (জুন ১৪, ২০১২)
২১. মেডিকেল এবং অন্যান্য ভর্তি পরীক্ষা (আগস্ট ২৪, ২০১২)
২২. দুঃখ, লজ্জা এবং ক্ষোভ (অক্টোবর ০৯, ২০১৩)
২৩. ভাবনা এবং দুর্ভাবনা
২৪. প্রতিবন্ধী নই, মানুষ
২৫. ডিসেম্বরের প্রথম প্রহর (ডিসেম্বর ০৬, ২০১৩)
২৬. কোকাকোলা
২৭. তোমরা যারা শিবির করো (ডিসেম্বর ০৭, ২০১২)
২৮. বিশ্বজিতের লাল শার্ট (ডিসেম্বর ২০, ২০১২)
২৯. যুদ্ধাপরাধের বিচার ইস্যুতে সরকারের সঙ্গে থাকতে হবে
৩০. একটি ছোট প্রশ্ন (জানুয়ারি ০২, ২০১৩)
৩১. চলচ্চিত্রের নতুন প্রজন্ম তৈরি করছি
৩২. অন্য রকম ফেব্রুয়ারি
৩৩. আমাদের গণিত অলিম্পিয়াড
৩৪. একাত্তরের দ্বিতীয় পাঠ
৩৫. শাহবাগের প্রজন্ম চত্বরের মহাসমাবেশে তরুণ প্রজন্মের উদ্দেশে বক্তব্য
৩৬. প্রিয় সজল (মে ২৪, ২০১৩)
৩৭. সমাবর্তন বক্তার বক্তব্য (জুন ১১, ২০১৩)
৩৮. সাম্প্রতিক ভাবনা (জুন ৩০, ২০১৩)
৩৯. গ্লানিমুক্ত বাংলাদেশ (জুলাই ১৭, ২০১৩)
৪০. আমার বড় ভাই হুমায়ূন আহমেদ (জুলাই ১৯, ২০১৩)
৪১. মিথ্যা বলার অধিকার (আগস্ট ১৫, ২০১৩)
৪২. এই লজ্জা কোথায় রাখি (আগস্ট ৩০, ২০১৩)
৪৩. আমেরিকা নিয়ে এক ডজন
৪৪. অস্ট্রেলিয়ায় ঝটিকা সফর
৪৫. বিশ্ববিদ্যালয়ের ভর্তি পরীক্ষা
৪৬. সরকারের কাছে অনুরোধ
৪৭. গ্লানি মুক্তির বাংলাদেশ
৪৮. বিষণ্ন বাংলাদেশ : সাদাসিধে কথা
৪৯. এক দুই এবং তিন
৫০. বই বইমেলা এবং অন্যান্য
৫১. একজন অনয়ের গল্প
৫২. আমাদের জাতীয় সঙ্গীত নিয়ে
৫৩. স্বাধীনতার চুয়াল্লিশ বছর
৫৪. অভিভাবক যখন অভিশাপ
৫৫. ‘কান পেতে রই’
৫৬. কেউ কি আমাকে বলবেন?
৫৭. প্রশ্নপত্র ফাঁস কি অপরাধ নয়
৫৮. মাননীয় শিক্ষামন্ত্রীর কাছে অনুরোধ
৫৯. ভাঙ্গা রেকর্ড
৬০. কিছু একটা করি
৬১. কয়েক টুকরো ভাবনা
৬২. আমরা যারা স্বার্থপর
৬৩. ঈদ: এখন এবং তখন
৬৪. একটি অসাধারণ আত্মজীবনী
৬৫. গাড়ির চতুর্থ চাকা
৬৬. একটি দুঃখের গল্প
৬৭. দশ হাজার কোটি নিউরন
৬৮. ইতিহাসের ইতিহাস
৬৯. আমাদের ছেলেমেয়েদের দুঃখ কষ্ট যন্ত্রণা ও অপমান
৭০. একজন সাধাসিধে মা
৭১. শব্দকল্পদ্রুম

নোট নিতে এবং টেক্সট হাইলাইট করতে লগইন করুন

লগইন