নবারুণ ভট্টাচার্য
গত অধ্যায়ে একটি সাধুমার্কা কোটেশন ঝেড়ে পাঠকদের ডিরেক্ট চ্যালেঞ্জ জানানো হয়েছিল। কিন্তু জানাই ছিল যে, ঈশ্বর-বিমুখ বাঙালি পাঠকরা সে-চ্যালেঞ্জের মোকাবিলা করতে পারবে না। নিদেনপক্ষে কোনো ক্ষীণ প্রচেষ্টাও আশা করা গিয়েছিল। কিন্তু সে ভেলিগুড়ে বালুকার ঢল নামিয়াছে। ঘেন্না ধরে গেছে। আজ বাঙালি কথায় কথায় সেমিনারে বাখতিন, ফুকো ঝাড়ে, ভবানীপুর এলাকায় পাঞ্জাবি ও গুজরাটিদের দাপট ও রোয়াব সম্বন্ধে গ্রামসির হেজিমনি তত্ব আওড়ায়, বিগ ব্যাং হইতে স্মল ব্যাঙাচি সকলই তার নখের ডগায় ডগোমগো হইয়া রহিয়াছে, অথচ সে শালা পরমহংস শ্রী ১০৮ স্বামী নিগমানন্দ সরস্বতীদেবের বাণী সম্বন্ধে কিছুই জানে না। এবিষয়ে আমাদের কিছু করিবার নাই। হিসাব কষিলে দেখা যায় যে, আর কোনো জাতিতে এত সংখ্যক পরমহংস জন্মান নাই। রেলাবাজের সংখ্যাও ততোধিক। কিন্তু অধঃপতনে কোনো জাতই এত পটু নয়।
মহামতি সাহেবরা বাঙালিকে মানুষ করিবার একটি পরিকল্পনা করিয়াছিলেন যাহাকে বলা যায় — ‘বেবুন থেকে বাবু’। হল না। কিছু বেবুন থেকে গেল, কিছু মধ্যপথে বেবুনবাবু বা বাবুবেবুন এবং অবশ্যম্ভাবী কিছু বাবু। পরবর্তী ব্লু-প্রিন্ট বিবেকানন্দের। তিনি বললেন, শাস্ত্র-ফাস্ত্র গঙ্গাজলে ফেলে দিয়ে ফুটবল খেলতে। প্রথম দিকে বাঙালি তাঁর কথা শুনেওছিল। না শুনলে ১৯১১ সালে গোরা একাদশকে মোহনবাগান ক্যালাতে পারত না বা ইয়োরোপের করিন্থিয়ানরা ঢাকায় ল্যাজেগোবরে হত না। কিন্তু খচড়ামি যার রন্ধ্রে রন্ধ্রে তাকে বাঁচাবে কে? আজ বাঙালি অন্য নানা খেলার মতো ফুটবলেও কেলিয়ে পড়েছে এবং ক্রিকেট বা টেনিসে গুচ্ছের টাকা বলে বাঙালি বাপ-মায়েরা বাচ্চাগুলোকে হ্যাঁচকা টানে ঘুম থেকে তুলে মাঠে নিয়ে যাচ্ছে। সেখানে নাকি হুদো হুদো কোচ, যারা বরং কোচোয়ান হলে আরও ভালো হত। এরপর কংগ্রেস ভেবেছিল বাঙালিরা সবাই ডেকরেটারের ব্যবসা খুলবে এবং নানা কংগ্রেস সম্মেলনে তাকিয়া সাপ্লাই দিয়ে লাল হয়ে যাবে। নকশালদের কোনো পরিকল্পনা ছিল কি? থাকলেও আগেভাগেই তো তারা মরে গেল। এরপর এল সি. পি. এম.। এঁদের পরিকল্পনাটি খুবই মহতী। কারণ শিক্ষা, সাহিত্য, ব্যবসা, প্রোমোটারি ইত্যাদি বিভিন্ন মহলের কৃতী দিকপালদের পরামর্শের সঙ্গে অভ্রান্ত বিজ্ঞানের মিশ্রণ ঘটিয়ে এঁরা বাঙালির সামনে যে মডেলটি রাখলেন, তার নাম ‘বাঁদর থেকে সি. পি. এম.।’ মানেটা খুবই সহজ — প্রথমে বাঁদর, তারপর বনমানুষ। এইভাবে নিয়ানডারথাল-অস্ট্রেলোপিথেকাস-রামাপিথেকাস-পিকিং ম্যান হয়ে হোমো কোম্পানির নানা ঘাটে জল খেয়ে লাস্টে দৃপ্ত সি. পি. এম. — কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে বাঙালি পুরুষ ও নারী কোনো অজানা কিন্তু মায়াময় রক্তিম ভবিষ্যতের দিকে এগিয়ে চলেছে। পরিকল্পনাটি সাধু। যেমনই সরেস হল ‘বঙ্গ’ বা ‘কলকাতা’ বানানো। কিন্তু এর জন্যে সি পি এম-কে প্রথম যেটা বুঝতে হবে সেটা হল, এই বাঙালিকে দিয়ে অত খাটনির কাজ হবে না। দ্বিতীয়ত, যত ঘটা করেই ২৫ বৈশাখ আর ২২ শ্রাবণ হোক না কেন, বাঙালি মজ্জাগতভাবে ভালগার ও খিস্তিবাজ। যেখানে ভালগারিটির তিলমাত্র সুযোগ নেই, সেখানেও সে অপ্রতিরোধ্য। তা না হলে ইন্ডিয়ান স্ট্যাটিসটিক্যাল ইনস্টিটিউটের সামনে বাস দাঁড়ালে বাঙালি কন্ডাকটর ‘টেস্টিকেল! টেস্টিকেল!’ বলে চেঁচাবে কেন? কেনই বা বালিখালগামী বাসের কন্ডাকটর (অবশ্যই বাঙালি) বর্ণবিপর্যয় ঘটিয়ে ‘খালিবাল’ ‘খালিবাল’ বলে নান্দনিক পরিবেশ দূষিত করবে। কেনই বা বাঙালি রেসের বই বিক্রেতা বনেদিপাড়ায় সাইকেল নিয়ে ‘হোলরেস’ বা আরও সংক্ষেপে ‘হোল!’ ‘হোল!’ বলে গর্জন করবে? জানি না বাপু কি করে কী হবে। বাঙালি সম্বন্ধে তৃণমূলেরও নির্ঘাৎ একটি রমণীয় ছক রয়েছে, যা সম্বন্ধে সুচিন্তিত মন্তব্য করার সময় হয়নি এখনও। আর যে যাই বলুক, মুড়ি দিয়ে চা খাওয়াটা মোটেই নতুন কিছু নয়। বরং এর সঙ্গে তেলেভাজা জুড়লে প্রস্তাবটি জম্পেস আড্ডার প্রারম্ভিক পর্ব বলে ভাবাই যায়। এতই যখন হল, তখন বি. জে. পি-ই বাদ যায় কোন সুবাদে। রাধানাথ শিকদার এভারেস্ট মেপে নাম করেছিল। অপর এক সদাহাস্য শিকদারের কর্মসূচী খুবই সহজ, সরল ও অনাড়ম্বর — ‘মানুষ থেকে হনুমান।’
৩১ ডিসেম্বর, ১৯৯৯, যা অবধারিত তাই ঘটল। ঘটাং! ব্যাপারটি যে কী ঘনত্বের, সেটা বুঝতে গেলে এটুকু বুঝলেই হবে ইংরিজি বছরের শেষ দিনে পালে পালে, দঙ্গলে দঙ্গলে ভদির চেলার দল গুরুদেবকে নানা টাইপের মাল এবং চানাচুর, ডালমুট, মুড়ুক্কু, চিপকি ছোলা, ঝালবাদাম, কাজু ভেট দিতে এসে দেখেছিল ভদি নেই। নলেন হেভি ভলুমে এফ.এম রেডিও বাজাচ্ছে এবং ভদির উঠোনে ওল্ড স্টাইল মেমেদের পোশাক-পরা বেচামণি খুবই দক্ষতার সঙ্গে ব্যালে টাইপের কিছু নাচছে এবং তার হাত দুটির বেড় দেওয়ার ভঙ্গি থেকে বোঝা মোটেই কঠিন নয় যে, তার নাচের পার্টনারটি কোনো সাহেবের অদৃশ্য ভূত। নলেন সকলকেই বিষাদ ও হতাশায় নিমজ্জিত করে জানিয়ে দিল যে গত রাতেই জরুরি এত্তেলা পেয়ে সামরিক তৎপরতায় ভদিকে চলে যেতে হয়েছে।
— সেবার জন্যে যে যা এনেচো রেকে মানে মানে কেটে পড়ো। হুড়ুমতাল করেচো কি মরেচো। নতুন বছরে দেখা হবে বলে গেচে। আরও বলেচে …
— কী? কী?
— ‘বলেচে এঁড়ে বাছুরের ছোট ঢুঁ-তে দোষ নেই। কিন্তু গুঁতোগুঁতি করলে শিং ভেঙে গুহ্যদ্বারে ঢুকিয়ে দেবে।’
— ‘বছরের শেষ দিনটায় প্রভুর অন্তর্ধান ঘটল। জাপটে ধরে রাখতে পারলে না?’
— ‘এইজন্যেই তো বোকাচোদা বলতে ইচ্ছে করে। যিনি কথায় কথায় সূক্ষ্মদেহ ধারণ করেন, তাঁকে কি জাপটে ধরে রাখা যায় রে পাগল!’
বেচামণি হঠাৎ খিলখিল হাসি-সহ অদৃশ্য ভূত পার্টনারের সঙ্গে ওয়ালজ-এর ঢঙে ঘুরপাক খায়। এটি একটি আত্মারাম সরকারের আশীর্বাদপুষ্ট ম্যাজিক আইটেম (ম্যাজিক রিয়ালিজম নয়) যার নাম গিলিগিলি পাম্প। কেন এই নাম তা কোনো গবেষক কোনোদিনও হদিশ করতে পারবে না। সে না হয় না পারল, কিন্তু ‘কাঙাল মালসাট’ যে রাবড়ির জালের থিওরিতে ঘ্যাঁতাচ্ছে সেটা লুক্কায়িত কর্মসূচি বা হিডেন এজেন্ডা থাকছে না। বুদ্ধিভ্রংশ পাঠক, তুমি বাবু লুচি বা নুচি কাহাকে বলে জানো? সেই লুচির ফোসকা দিয়ে রাবড়ি প্যাঁদানোর যে নারকীয় আনন্দ তাহা কখনই উপলব্ধি করিয়াছ? এই সান্ধ্য জলখাবারের পর যা অবশ্যকরণীয়, তা হল মাগীবাড়ি যাওয়া। পরের অধ্যায়ে দেখিবে যে সাক্ষী বড়িলাল কী অবলীলায় মাগীবাড়ি যাওয়া রপ্ত করিয়াছে। আরও দেখিবে যে, এমনও মানবশিশু আছে যাহারা ধরাধামে পা রাখিয়াই অধরা মস্করায় লীলাবান হয়। কখনও ঘুণাক্ষরেও ভুলিবে না যে পাগলের হাতে সংসার। যে-কোনো মোমেন্টে হাম্পু চলে যেতে পারে। পরে, আরও পরিপক্ব টুকটুকে মাকাল হইলে বুঝিবে সাহিত্যের শব্দসাধনা এক অলৌকিক ঠগবাজি যাহার পিছনে কাতিন অরণ্যে এন.কে. ভি. ডি দ্বারা নিহত ১৩,০০০ পোলদেশীয় অফিসার গুরুগম্ভীর মুখে বার্লিওজ-সৃষ্ট ‘সিম্ভনি ফ্যানতাস্তিক’-এর ‘মার্চ টু দা স্ক্যাফল্ড’ অংশটি শুনিতেছে, আলী সরদার জাফরি উদাত্ত কন্ঠে ‘লোহু কি পুকার’ হইতে আবৃত্তি করিতেছেন এবং রক্তস্নাত পেশোয়ার এক্সপ্রেস নিরন্তর শব বহন করিতেছে। লেখক বা পাঠক বা প্রকাশক বা সমালোচক — কেহই রেহাই পাইবে না। আপাতত — ঘটাং! কিন্তু তার আগে পায়খানা ধোলাই করার অ্যাসিডের সুইমিং পুলে যে লেখকরা বারমুডা পরিয়া লাফাইতে বদ্ধপরিকর, তাহাদের জন্য রচিত পুরন্দর ভাটের কয়েকটি অমোঘ লাইন —
আজ্ঞাবহ দাস, ওরে আজ্ঞাবহ দাস
সারা জীবন বাঁধলি আঁটি,
ছিঁড়লি বালের ঘাস,
আজ্ঞাবহ দাসমহাশয়, আজ্ঞাবহ দাস!
আজ্ঞাবহ দাসবাবাজী, আজ্ঞাবহ দাস,
যতই তাকাস আড়ে আড়ে,
হঠাৎ এসে ঢুকবে গাঁড়ে,
বাম্বু-ভিলার রেকটো-কিলার,
গাঁট-পাকানো বাঁশ,
আজ্ঞাবহ দাস রে আমার, আজ্ঞাবহ দাস।
ঘটাং শব্দে মাটি খোঁড়ায় বাধাপ্রাপ্ত সরখেল আরও কয়েকবার শাবল চালাল কিন্তু মোদ্দা ফল হল শাবলের ডগা ভোঁতা, সরখেলের হাতে ফোসকা এবং গুবলেট। তখনই সরখেল পূর্ববর্ণিত টেলিকম যোগাযোগ ব্যবস্থায় ভদিকে খবর দেয় এবং ভদি সরখেলকে অবিলম্বে অপারেশন বন্ধ করতে বলে।
— ‘মাঁটি খোঁড়া বঁন্দ রাঁখো।’
— ‘তাঁরপঁর?’
— ‘অ্যাঁ দাঁতও বাঁদাবেঁ না। কীঁ যেঁ বাঁল বঁলো!’
— ‘বঁলচি, তারপঁর?’
— ‘চুঁপচাঁপ থাঁকো। আঁমি যাঁবো।’
— ‘কঁখন?’
— ‘ভোঁররাঁতে। যঁকন সঁব শাঁলা ঘুঁমোবে।’
— ‘আঁচ্চা!’
একে শীতকাল, তায় ভোররাত। আদিগঙ্গার ধারে তখন শামুক-পচা কুয়াশায় একপাল প্রায় ন্যাংটো মানুষ শুভ কাজে লিপ্ত। এরা প্রেতযোনি প্রাপ্ত নয়। ফ্যাতাড়ু নয়। চোক্তার নয়। স্রেফ মানুষ। এদের কাজ হল আদিগঙ্গার ফাঁকফোকর, নিমজ্জিত টায়ার, ইঁট, জুতো, মালসা, খুরি ইত্যাদির গা থেকে কুচো কেঁচো ধরে লাল-নীল মাছের দোকানে সাপ্লাই করা। এরা কখনো তালা, টাইমপিস ঘড়ি, মরচে-পড়া নেপালা ও চেম্বারও পায়। এরা চালু মাল। ওই জলে নামলে পা কেটে টুকরো হয়ে যেতে পারে। তাই এরা টায়ারের চটি বা শক্তপোক্ত কিছু পরে নেয়। আবার হয়তো দেখা যাবে, কারো পায়ে অ্যাডিডাস, লট্টো বা নাইকি-র স্নিকার। কীভাবে এত দামী জুতো এদের পায়ে আসে? আসলে সব সময় হিঁয়া থেকে হুঁয়া মাল লেনদেন হচ্ছে। জালি, আসলি, চোরাই, লুট — নানা মালে বাজার ছয়লাপ। এমনটিই তো হবে-হবে শোনা গিয়েছিল। হলও এবারে। ঠেলাটা বোঝো। আসলে সব রকমের ভবিষ্যদ্বাণী সম্বন্ধেই লোকের আইডিয়া হল হাতি পাদেগা, হাতি পাদেগা — ফুশ। উল্টোটা যখন হয় তখনও শালাদের চোখ খোলে না। কিন্তু তাহাতে আগচ্ছমান মহাহুলোর একগাছা লোমের ক্ষতিও হয় না।
ভোররাতে সরখেল ভদির পোশাক দেখে অবাক। একেবারেই সামরিক পোশাক। অলিভ গ্রিন প্যান্ট। পায়ে হান্টার জুতো। গায়ে ছোপ-ছোপ দাগ-মারা কম্যান্ডো উর্দি এবং তার ওপরে যে মিলিটারি জ্যাকেট, তা সিয়াচেন গ্লেসিয়ারে বেড়াবার সময় হামেশাই চোখে পড়ে।
— ‘নো হ্যাংকিপ্যাংকি। নো গাঁইগুঁই। প্রবলেমটা কী?’
— ‘সে তো আমার ঘটেও ঢুকচে না। হাত পাঁচেক খোঁড়ার পরেই ঘটাং।’
— ‘শাবল মেরে ডেপথ চার্জ-এর মতো উড়িয়ে দাও। সাবমেরিনকে যেভাবে ক্যালাতে হয়।’
— ‘হুঁ, শাবলই বলে উড়ে যাচ্চে। এই দ্যাখো না, হাতে গেলে-যাওয়া ফোসকা। বোরোলিন লাগিয়েচি।’
–‘ওরে, ব্যাটলফিল্ডে বোরোলিন-ফোরোলিন চলে না। যেখানে চোট লাগবে অ্যাম্পুট করো। হাত, পা, মুণ্ডু সব পড়ে থাক। শুধু এগিয়ে চলো।’
— ‘তুমি এগোবে তো এগোও। আমার আর ধকে কুলোচ্চে না। তার ওপর ভয়ও আচে।’
–‘কীসের ভয়? কাকে ভয়? যুদ্ধক্ষেত্রে ভয়! হাসালে তুমি আমাকে সরখেল!’
— ‘ওসব সোনাই দীঘি-মার্কা ডায়লগ আমিও দু-চারটে ছাড়তে পারি।
দূত এসে বলল, মহারাজ! মহারাজ! দুর্গে শত্রু-সৈন্য ঢুকে পড়েচে। মহারাজ বলল, এই রে, গাঁড় মারিয়েচে। প্রম্পটার প্রম্পট করে শোনা নাহি যায়। চলো রাণী, অন্তঃপুরে গিয়ে প্রস্রাব করি।’
ভদি চুলবুলিয়ে হেসে ওঠে। গড়ায়।
— ‘টপ! টপ! ওঃ সরখেল, সলিড ছেড়েচ। এইবার গা-টা গরম হয়েচে। বলো, ভয় পাচ্চো কেন গো?’
— ‘আমি ভাবচি মোটা লোহার পাইপ। হয় শালা ভেতরে ইলেকট্রিকের তার নয়তো সায়েবদের বসানো গু-মুতের লাইন। ভাঙতে গিয়ে হয় কারেন্ট, নয়তো নফর কুন্ডু কেস!’
— ‘শোনো, অনেক কাঠখড় পুড়িয়ে, অনেক খোঁজপত্তর করে তোমার বাড়ির এই স্পটটা বাছা হয়েছিল। এখান দিয়ে লাইন যেতে পারে না। জল না, কারেন্ট না, গু না, কিচ্ছু না।’
— ‘তবে, ঘটাং করল কীসে?’
দুজনকেই চমকে দিয়ে ফিকে অন্ধকারে কেউ বলে উঠল,
— ‘কামান।’
বিশাল দাঁড়কাক অন্ধকার মেখে এমনভাবে ঘাপটি মেরে আছে যে বোঝবার জো নেই।
— ‘বাবা!’
— ‘হ্যাঁগো ভদিসোনা।’
— ‘এই ঠান্ডায়, একেবারে আদুল গায়ে…’
–‘থাক, আর পিতৃভক্তি মারাতে হবে না। এবার যা বলচি শোন — আমার চোখে হঠাৎ নাইট-ভিশন এসে গেল — পষ্ট দেখলুম ওটা কামান।’
— ‘তাহলে কী হবে?’
— ‘ঘাবড়াবার কিছু নেই। কামানটা বড় নয়, ছোট। বলতে পারিস নুনুকামান।’
— ‘আঁজ্ঞে, দুমদাম কিছু হতে পারে?’
— ‘ভয়েতেই গেলি। ভেতরে গোলা নেই, বারুদ নেই। স্রেফ মাটি। হাত দেড়েক ছেড়ে বাঁদিকে ঝপাঝপ দুজনে মিলে খোঁড়। তাহলেই হারামিটাকে তোলা যাবে।’
ভদি শাবল চালায়। সরখেল ভাঙা গামলায় মাটি সরায়। ভদি ঘেমে গিয়ে জ্যাকেটটা খুলে ফেলে। ঘপাঘপ শাবল চালায়। এদিকে মাটিটা ঝুরঝুরে ছিল, তাই বেশি সময় লাগে না। শাবল ঢুকিয়ে বোঝা যায় যে কামানের একটা দিক শেষ হয়েছে।
— ‘মাথায় তোদের ভগবান বুদ্ধি বাদে সব দিয়েচে। এবার শাবলের কাজ আর নেই। শিক দিয়ে এপাশ ওপাশ আলগা কর। তারপর নেমে টেনে তোল।’
রোগা বলে সরখেলই নামে। কিন্তু শিক চালাবার পরেও কামান নড়াতে পারে না।
— ‘এ তো ঝকমারি হল! মাল নড়চে না।’
— ‘নড়বেও না। তলা দিয়ে দড়ি ঢোকা। তারপর ওপরে উঠে দুজন মিলে দু-দিক দিয়ে টান। ব্যাটা না উঠলেও কেৎরে দাঁড়িয়ে যাবে। তারপর তুলবি।’
আরো বেশ কিছুক্ষণ কসরত করার পরে হাত দুয়েক বেবি কামানটি ডাঙায় উঠে আসে। আকাশে বেশ আলো ধরেছে। রোজই ধরে।
সরখেল চেঁচে চেঁচে মাটি সরায়। গোড়ার দিক, মানে তোপ দাগার দিকটায় ডুমো মতো। মুখটা আবার সিংহের আদলে।
— ‘কাদের মাল এটা বুজলি?’
— ‘ধোয়া-মোছা করলে হয়তো লেখা-ফেখা কিছু বেরুবে।’
— ‘সে বেরুকগে। মালটা পোর্তুগীজ জলদস্যুদের। তখন তো আদিগঙ্গা ওখান দিয়ে বইত না। বিস্তর নৌকাও চলত। পোর্তুগীজ হার্মাদদের বোটে এই কামানগুলো থাকত। বজরা-ফজরা হলে এক গোলাতেই কুপোকাত। যে সে কামান নয়। খোদ লিসবনে বানানো।’
— ‘এখনও মালটা চালানো যাবে?’
— ‘যাবে না কেন? তবে যত্ন-মেহনত করতে হবে। বারুদ চাই। গোলা চাই।’
— ‘তাহলে কি মালটা আমরা স্টক করব?’
প্রশ্নটা সরখেলের। কারণ ভদি গোপনে যে অস্ত্রাগারটি বাড়িয়ে চলেছে তার দেখভাল সরখেলই করে।
— ‘যাদুঘর বা সায়েব ধরে বেচে দিলে ভালো মাল্লু পাওয়া যাবে। সব পুরনো মালের এখন হেভি বাজার।’
— ‘পাত্তি কিছু হবে কিন্তু এই লোহা, এই মেকদার আর হবে না। আমি বলি কি, মালটা ধোলাই-ফোলাই করে কেরোসিন দিয়ে পালিশ কর। আমাদের স্টকেই থাক। এখনও গুছিয়ে ঝাড়তে পারলে একশো হাত দুরে পুলিশভ্যানের বিচি উড়ে যাবে।’
— ‘বাবা যখন বলচেন সরখেল তকন আর কতা বাড়িয়ে লাভ নেই, মালটাকে আমরা স্টক করব।’
দাঁড়কাক ডানা ঝাপটাল।
— ‘তোরা বরং কামানটাকে রেডি কর। বছরের শেষ দিনে ভাল কাজ করলে ফল পাবি।’
— ‘আপনি থাকবেন না! তা হলে আমাদের গাইড করবে কে?’
— ‘আরে বাবা, এখন আমাকে এলিয়ট রোড যেতে হবে। সেখানে বেকারির পোড়া কেক খেয়ে সায়েবদের গোরস্থান। সেখান থেকে নিমতলা। এখন আমার দিনভর কাজ। পরে আমি আসব। এখন তো শুধু সাফসুরৎ করা। দুমদাম সব পরে।’
দণ্ডবায়স প্রশস্ত ডানা মেলিয়া উড়িয়া গেল। কাক, চড়াই, শালিখ ইত্যাদিরা ডাকাডাকি শুরু করিয়াছে। এই প্রভাত বড়ই মঙ্গলময়।
ভদি ও সরখেল পোর্তুগীজ কামানটি বহন করে দ্বিতলের কক্ষে নিয়ে যায়।
— ‘বাবা ঠিকই বলেচে। কত বছর মাটিতে পোঁতা ছিল কে জানে, কিন্তু কোনো মরচেফরচের বালাই নেই।’
— ‘পোর্তুগীজরা ভাল কামানিয়া ছিল বলতে হবে।’
— সে তো ছিলই। কোথায় এক একরত্তি দেশ। সাত সমুদ্দুর পেরিয়ে এসে আদি গঙ্গায় দমাদ্দম কামান দাগচে। টাকা, গয়না, মাগী — সব দুহাতে লুটচে। ভাবলেই ভয় করে।’
— ‘আমি একজন পোর্তুগীজ রংবাজের নাম জানি।’
— ‘কী?’
— ‘কারভালো।’
— ‘দুর! ও তো থিয়েটারের দেওয়া নাম। এককালে কারভালোর পার্ট বলে ভূমেন রায় হেভি নাম করেছিল।’
— ‘তা হবে।’
— ‘হবে না, হয়েচে। যাক আমি তো এদিকে ভেবে হাল্লাক হচ্চি যে মাটি খোঁড়া যদি ভেস্তে যায় তাহলে কীসের জোরে আমরা লড়ব?’
— ‘চিন্তাটা আমারও হয়েছিল। এত বড় একটা যুদ্ধের ছক।’
— ‘যাই হোক, ভগবান সহায়। বুজলে? তা না হলে শালা কিচুর মধ্যে কিচু নেই, হঠাৎ আমাদের হাতে পোর্তুগীজ কামান। ওফ, একেবারে কামাল করে দেব। লাগুক না একবার।’
— কী কী মাল আমাদের যোগাড় হল তার একটা লিস্ট করতে হবে। তবে আমার একটা খটকা লাগছে!’
— ‘কিসের আবার খটকা?’
— ‘বন্দুকের লাইনে আমরা কিন্তু বেশি কিছু করতে পারিনি। একটা দোনলা গাদা তাও সেই মান্ধাতার আমলের। আর দুটো ঢপের পিস্তল।’
— ‘কমটা কি হে? কামান, বন্দুক, পিস্তল।’ এরপর তোমার গিয়ে ছুরি, কাঁচি তারপর তোমার গিয়ে শাবল — সব এক করে ভাবো।’
— ‘কিন্তু যে প্ল্যান আমাদের….’
— ‘রোসো সরখেল, রোসো। কোনো মিলিটারি জানবে একদিনে তৈরি হয় না। আজ আমাদের অস্ত্রাগার দেখলে লোকে বলবে, হাসি পায় রিজিয়ার চাপদাড়ি দেখে। কিন্তু যখন দেকবে আদিগঙ্গায় ডুবোজাহাজের পেরিস্কোপ উঁকি মারচে, ঘাটে ঘাটে মাইন ভাসচে, জাহাজী সব ছ-ঘরা, দশ-ঘরা হাতে হাতে ঘুরচে তখন? ভয়তে পোঁদ শুকিয়ে যাবে। আর আর একটা জিনিস মনে রাখবে। মোক্ষম।
— কী?
— নিজেদের মাল তবিল নিয়ে এমন ক্যামপেন চালাবে যে শত্রুর কানে যখন পৌঁছবে তখন ব্যাটা চমকে উঠবে। কানাঘুঁষো শুরু করে দিতে হবে। তবে টাইম বুজে। যেমন, আমাদের বলতে হবে আর্মি, নেভি, এয়ারফোর্স — সব আমাদের আচে।
— নেভি? এয়ারফোর্স!
— ও কোনো ব্যাপারই না। একটু মাথা খাটালেই সাবমেরিন বানানো যায়। কিচুই না। নৌকো প্লাস ডুবসাঁতার ইজইকুয়ালটু সাবমেরিন।
— কিন্তু এয়ারফোর্স?
— কেন? চাকতি তো উড়চেই। কী ফোর্স! তারপর ফ্যাতাড়ুরা যদি হাই অল্টিচুড থেকে পেটো ড্রপ করে! বাবা আচেন।
— তাইতো। ভুলেই গিয়েছিলাম।
— এইতো সরখেল, নিজের তাগৎ নিজেকে জানতে হবে। এটা হল যুদ্ধের একেবারে গোড়ার কতা। অন্যটি করেচো কি মরেচো। এরপর হল প্ল্যান। শত্রু হয়তো ঢুকচে। আয় বাবা, আয় বাবা করে তুমি ঢুকতে দিচ্চো। সে বানচোৎও ভাবচে যে কেল্লা ফতে করে এনিচি। আচমকা শালা সাঁড়াশি থিওরিতে দুপাশ থেকে ধুমা কেলাও। এইরকম আর কী। আসল ব্যাপার হল ঘটে মাল থাকতে হবে। ইতিহাসে দেকবে বড় বড় সব দেশ — ইয়া আর্মি, তারপর গিয়ে উড়োজাহাজ — ছোট কোনো দেশের পোঁদে লাগতে গেল। তারপর হেগেমুতে একসা। এইসা ঝাড় যে ছোঁচানোর টাইম অব্দি দেবেনা।
কথাবার্তার এই ধাঁচের মধ্যে ক্রমশ সত্যই কি প্রতীয়মান হয় না যে চোক্তারদের পরিকল্পনায় সম্মুখসমর বা ঐ জাতীয় কিছু ভালোভাবেই রয়েছে? তবে এখনই পাঠক কি জানতে চায় যে পোজিশনাল ওয়ারফেয়ার না গেরিলা সংঘর্ষ — কোনদিকে ‘কাঙাল মালসাট’ চলেছে? মাও, লিন পিয়াও, টিটো, গিয়াপ, ফিদেল, চে — কোন কায়দায় লড়াই হবে? দুপক্ষই কি বাঙালি হবে না বিদেশি ভাড়াটে সেনারাও আসরে নামবে? আর যদি সত্যিই একটা বেধড়ক ক্যালাকেলি শুরু হয়ে যায় তাহলে পাঠক কোন দিকে ভিড়বে? এই সব ক-টি প্রশ্নই খুবই খুবই মুল্যবান, মাল্যবান ও জরুরি। কিন্তু এই হিমভোরে সদ্য কামান বেরোবার ঘটনায় রণনীতি বা কৌশল সম্বন্ধে যার তিলমাত্র ধারণাও আছে সে-ই অনুধাবন করবে উপরোক্ত অবস্থান কতটা যুক্তিসঙ্গত। এই বোধ যদি ঘরে ঘরে জাগ্রত হত তাহলে বেঙ্গল রেজিমেন্ট, বেঙ্গল রেজিমেন্ট বলে হেদিয়ে মরতে হত না। বাপ বাপ বলে বেঙ্গল রেজিমেন্ট তৈরি হত এবং বীরত্বে সকলকে ধুড় বানিয়ে ছাড়ত।
চন্দননগরের জনৈক বিখ্যাত বাঙালি একবার লিখেছিলেন,
‘হারান চক্রবর্তী মহাশয় যথেষ্ট বলশালী ছিলেন। তিনি উদয়চাঁদ নন্দীর বাগানে একটি বড় লিচু গাছ বিনা অস্ত্রসাহায্যে ফেলিয়া দিয়াছিলেন। দুই জনে সজোরে তাঁহার গলা চাপিয়া ধরিলেও তিনি একটি রম্ভা গলাধঃকরণ করিতে পারিতেন। গগনচন্দ্র বন্দ্যোপাধ্যায় দুরন্ত ঘোড়াকে ভূমি হইতে শূন্যে তুলিয়াছিলেন। প্রায় চল্লিশ বৎসর পুর্বে পালপাড়ার বীরচাঁদ বড়ালের বাটীতে পালপাড়ার দলের উদ্যোগে ফরাসী গভর্নর বাহাদুরকে দেখাইবার জন্য ব্যায়ামক্রীড়ার ব্যবস্থা হইয়াছিল। লাটসাহেব তাহা দেখিয়া বাঙালীর ছেলের বল ও সাহসের ভূয়সী প্রশংসা করিয়াছিলেন।’
কে তিনি? তিনি কে গো? কে গা? এর একমাত্র জবাব বাঙালির নিরবচ্ছিন্ন নীরবতা। লজ্জায় আর কত অধোবদন হইতে হইবে?
নোট নিতে এবং টেক্সট হাইলাইট করতে লগইন করুন
লগইন