কাঙাল মালসাট – ১০

নবারুণ ভট্টাচার্য

দশ ও দেশের মুখোজ্জ্বল করার অভিসন্ধি নিয়েই ‘কাঙাল মালসাট’ শুরু হয়েছিল কিন্তু গত অধ্যায় বা কিস্তিটা ছাপার সময় ভূতের খপ্পর কাকে বলে তা বোধগম্য হল। গোটা ব্যাপারটার মধ্যে মানুষের কোনো হাত নেই। প্রথম প্রুফ যেই এল তখনই নজরে পড়ল যে শেষে যেখানে (চলবে) বলা থাকে সেখানে বেরিয়েছে (চলবে না)। সংশোধনের পরেও সেই আশাভঙ্গকারী ‘না’। কম্পিউটারের মাউস বা ক্যাট কেউই বাঁদরামি করছে না, তারা শুদ্ধ, ভাইরাস মুক্ত এবং যে পত্রিকায় এক এক পক্কড় করে ধরাশায়ী হচ্ছে সেখানেও কুচোকাচা কেউ ঢ্যামনামি করেনি। (চলবে না) — এর চেয়ে বরং ঢলবে না, টলবে না হলেও মুখরক্ষে হত কিন্তু (চলবে না) অবশ্যই অপমানজনক। লেখকের মধ্যে তখন খুবই প্রাকৃতিক ডাকের মতো যে উপলব্ধি পাওনা হল তা হল এ নিশ্চয়ই সম্পাদকের হারামিপনা। হয়তো তা প্রমাণিতও হত। এই নিয়ে বাদানুবাদের সময় সম্পাদক বরং শেষমেশ অপারগ হয়েই লেখকের দিকে পাণ্ডুলিপির জেরক্স ছুঁড়ে দিয়ে বলল — এটা কি আমার বাপের হাতের লেখা? লেখকের নিজেরই লেখা। অবিকল সেই হস্তাক্ষরে, নির্ভুল বানানে লেখা — (চলবে না)। সম্পাদকের কবুলতি হল চলুক বা না চলুক — কিছুতেই তার এক গাছাও ছেঁড়া যায় না। একই মত লেখকেরও। একইরকম গোঁ সব শালারই। রহস্য সায়ার মতোই রহস্যময়ী। আসল কারণ কেউই জানে না। প্রেতলোক অনেক সময়ই অটোমেটিক রাইটিং বা ওই জাতীয় কোনো ছলের আশ্রয় নিয়ে অপরিবর্তনীয় ভবিষ্যতের দিকে অঙ্গুলি নির্দেশ করে। কিন্তু মানুষের ধাতে ভূতের নির্দেশ মানার কোনো সদিচ্ছা নেই। অবধারিত নিয়তি এভাবেই নির্জন জলার কাছে, আলেয়ার হাপসু গ্যাসালো আলোর নিকটস্থ নীরবে অপেক্ষারত দক্ষ ঠ্যাঙাড়ের সান্নিধ্যে ভ্রাম্যমাণ পথিকবরকে নিয়ে যায়। অতএব বোঝা যাক যে এবারেও তার অন্যথা হবে না কিন্তু যতক্ষণ হাতেনাতে না হচ্ছে …

দুই খিলানের ওপরে নির্মিত বিশ্বের তৃতীয় বৃহত্তম ঝুলন সেতুটির টঙে বসে দাঁড়কাক কলকাতার এক একটি বিশিষ্ট এলাকা যেমন খিদিরপুর, ওয়াটগঞ্জ, গঙ্গা নদীর গায়ে ডক চত্বর, একগাছা লোমের মত মিলেনিয়াম পার্ক, ইডেন গার্ডেন, ময়দান, আখাম্বা মনুমেন্ট, চৌরঙ্গী এলাকার হিজিবিজি, ফ্রি স্কুল ষ্ট্রীটের ভার্জিন কলেজ-গার্লদের নগদা বাজার, ভবানীপুর, বিকট ধোঁয়াটে কুহকে ঢাকা উত্তর কলকাতা, বালীগজ্ঞের সেইসব এলাকা যেখান থেকে জীবনানন্দের গল্পের হেমেন প্রমুখ চরিত্ররা মোটা বউ নিয়ে বাসে উঠত বা ট্যাক্সি হাঁকাত তারপর ফারপোতে গিয়ে চপ-কাটলেট প্যাঁদাত, অথবা আরেকটু ঘাড় ঘুরিয়ে বাইপাস, সল্টলেক, কসবা কানেকটর ইত্যকার বিবিধ হুলিয়া ঘাড় ঘুরিয়ে ঘুরিয়ে দেখছিল আর খিস্তি করছিল।

ভদি বানচোৎকে ধরে আড়ং ধোলাই দিতে হবে। এরকম একটা জালি, খুপরি খুপরি শহরে কোথায় গেরিলা হুজ্জুতি ধান্দা করবে, তা না, গাণ্ডুটা একেবারে আর্মির ঢঙে পজিশনাল ওয়ারের ছক কষছে। নুনুকামান দিয়ে পজিশনাল ওয়ার। এঁড়ে চোদা। বললুম লড়ালড়ি পরে করবি আগে লেখাপড়া কর। হদিশও দিলুম। মাও, গিয়াপ, চে, মারিঘেল্লা, টিটো — এগুলো একবার চোখ বুলিয়ে নে তারপর কাগজ কলম নিয়ে মাদুরের ওপরে পোঁদ উল্টে নিজের মত ছক কর। যুদ্ধ করা সোজা ব্যাপার! হাওদা, হাতি, মাহুত — সব নখদর্পণে থাকতে হবে। তা না ল্যাওড়া কেবল তড়পাবে। দেদারে তড়পাবে। আমার কি! উল্টোপাল্টা দেখলে বাংলা কথা — আমি নেই। এত যদি তোর আম্বা বেগম জনসনের কাছে আরলি যুদ্ধের স্টোরি শোন — টিপু কি করেছিল, হায়দার আলি কি খুঁচিয়েছিল, সিরাজ ফোর্ট উইলিয়ামের পুঁটকি মেরে দিল কিন্তু সাহেবদের সঙ্গে এঁটে উঠবে কি করে? তখন তারা জাহাজে করে মাঝ গঙ্গায় নোঙর মেরে ঘাপটি মেরে আছে। কেটে পড়, ছিপে যাও, তারপর যেই দেখবে এনিমি মাল মাগির ফোয়ারা খুলেছে ওমনি ‘শোলে’-র স্টাইলে ঝাড়, লোহে গরম হ্যায়, লাগা দো হাতোড়া। তা না বাঁড়া কেবল লম্ভ ঝম্ভ। টঙে বেশ ঠাণ্ডা তো। ডানা ঝাপটাবো? হাই অলটিচুড তো, ইংলিশ হাওয়া লাগছে। ওফ এই একটা জাত, কবে হাওয়া ছেড়ে কেটে পড়েছে, এখনও যেমন ফুরফুরে তেমন গন্ধ।

দাঁড়কাক ডানা ঝাপটাল। একটি পালক খসে উড়তে থাকল। পালকটিকে সাধারণ ক্রো ফেদার ভাবাটা বোধহয় ঠিক হবে না কারণ পালকটি পাক খেতে খেতে গঙ্গায় পড়ল এবং শুভ্র ধাবমান সিলভার জেটের গায়ে জলছবির মত আটকে বিনা পয়সায় হলদিয়া চলে গেল। হলদিয়া পেট্রোকেমিকেল কেন লাটে উঠছে তা বুঝতে হলে এই ঘটনাটিকে ধরেই এগোতে হবে। এখানেই রয়েছে ভাইট্যাল ক্লু। এর বেশি বলা বারণ আছে। কারণ আলিমুদ্দিনে খবরটা গেলেই গেঁতো গভরমেন্ট নড়ে চড়ে বসতে পারে। সে হ্যাপা সামলানো ‘কাঙাল মালসাট’-এর ধকে কুলোবে না। অবশ্য এতক্ষণে নিশ্চয়ই রটে গেছে যে আমরা আনন্দবাজার বা সি. পি. এম. অথবা তৃণমূল কিংবা ঘাড়ভাঙ্গা কংগ্রেস কোনো মালকেই খচাতে চাই না। কিন্তু নিজে নিজে, আপন গরজে কেউ যদি খচিয়ান হয়ে ওঠে আমাদের কিছুই করার নেই। এরা তো এলিতেলি — বিশ্বজোড়া যার রোয়াব ছিল সেই ব্রিটিশদেরও জীবনে এই আনন্দের পুড়কি তো পরক্ষণেই নেমে আসত বেদনা বিধূর মূর্ছনা। ভান্ডিভাস Wandi wash, আরকট, পলাশী, বক্সার বা সেরিঙ্গাপত্তনামে যুদ্ধ জয়ের সে কি উল্লাস! কিন্তু যেই ব্ল্যাক হোল (মহাবিশ্বের খতরনাক কৃষ্ণ গহ্বরের সঙ্গে গুলিয়ে না ফেলাই ভালো) বা পাটনা ম্যাসাকার, অমনি ত্রুদ্ধ ক্রন্দন ও পাঙ্খাওয়ালাকে খিস্তি। ইতিহাস সম্বন্ধে এই ট্র্যাজিকমিক বোধ জাগ্রত করার জন্য আমাদের ইভর এডওয়ার্ডস স্টুয়ার্ট নামধারী এক অতীব খচ্চর সাহেবের হাত ধরে বারংবার বেগম জনসনের গলতায় যেতে হবে কারণ বেগম জনসনই সেই দুর্বার মহিলা যিনি চারটি বিয়ে করার ফাঁক ফোকরে স্বচক্ষে সিরাজৌদ্দল্লাকে দেখেছিলেন, ক্লাইভ ও ওয়াটসনের মত প্রতিভাধরদের সঙ্গে গালগল্প চালিয়েছিলেন এবং গভীর আনন্দের সঙ্গে লক্ষ করেছিলেন যে হোলকার, সিন্ধিয়া ও এমনকি ভীতিপ্রদ মারাঠাও কিভাবে জন কোম্পানির সামনে সেঁতিয়ে গিয়ে ‘জো হুকুম জো হুকুম’ করছে। এই জন্য বেগম জনসনের কাছে আমাদের চিরকাল নতজানু হয়ে থাকতে হবে। অন্যটি হবার উপায় নেই।

‘জয় মা গ্যাঞ্জেস’ বলে বিশাল দাঁড়কাক দ্বিতীয় সেতুর টঙ থেকে উড্ডয়ন করল এবং তখনই তার নজরে এল কয়েকটি উড়ন্ত চাকতি ঝাঁক বেঁধে খেলা করতে করতে হাওড়ার দিকে যাচ্ছে। বা খেলার ছলে হাওড়ায় চলেছে বললেও অতিকথন হয় না। উড়ন্ত চাকতির খেলা অনেকটা বাজারের আমিষ অংশের আকাশে মাছিদের ওড়াউড়িরই সামিল। কিন্তু কিছুক্ষণ এমত ক্রীড়ায় মাতোয়ারা হওয়ার পর মাছিরা কী করবে সেটা বলে দেওয়া যায় কিন্তু উড়ন্ত চাকতিদের যে কি মতলব তা বোঝা শিবের বাপেরও অসাধ্যি। হঠাৎ হয়ত ভাটিয়ালি গানে মুহ্যমান মাঝির দিকে তেড়ে গেল বা গঙ্গাতীরে স্নানরতা যুবতীদের দেখে মাঝ আকাশে দাঁড়িয়ে গেল। এর কোনটি যে হবে তা কেউ বলতে পারে না। শুধু কোয়ান্টাম জগত নয়, অন্যত্র এইভাবে ওয়ারনার হাইজেনবার্গ-এর আনসারটেনিটি প্রিন্সিপাল প্রয়োগ করে দেখা যেতে পারে। দাঁড়কাক উড়ন্ত অবস্থাতেই স্ট্যাটেজিক দক্ষতায় কিছুটা পূরিষ ত্যাগ করিল যা হাওয়ায় ডানা মেলে দিলেও মাধ্যাকর্ষণের অমোঘ টানে নেমে আসতে বাধ্য হয় এবং পড়বি তো পড় দুঁদে ট্র্যাফিক সার্জেন্টের গগলস-এর ওপরে। দুঁদে সার্জেন্ট ‘শিট’ বলিয়া আক্ষেপ করে ও মোটর সাইকেলটি সাইডে ভেড়ায়। কিছুটা মোটা ভুরুতে বাকিটা রেব্যান-এর গা গিয়ে গড়াচ্ছে। সার্জেন্ট-এর পরবর্তী ডায়লগ হল ‘ভালো রুমালটার গাঁড় মারা গেল।’ দীর্ঘ কালো চঞ্চুতে কৌতুকের ঝিলিক খেলিয়ে দাঁড়কাক উড়তে থাকে এবং আরও বেশ কিছুক্ষণ ফ্লাইটের পর ভিক্টোরিয়ার মাথায় পরীর পাশে নিখুত ল্যান্ডিং করে। সেই সময়েই ঝটকা বাতাস এলো এবং দীর্ঘদিন পরে কাছে আসার অভিমানে পরী মুখ ঘুরিয়ে নিল। বাংলা সাহিত্যের পাঠকের কাছে জায়গাটি অচেনা হবার কথা নয়। অবশ্য ত্রৈলোক্যনাথ আজকাল খুব বেশি পিস পড়ে না। গম্বুজের ওপরে পরী ও দাঁড়কাক। কিন্তু দাঁড়কাকের চোখে পড়ল এক কাণ্ড। এক তরফা গোলকায়নের সুলভ শৌচের পরিবেশে একদঙ্গল ব্রিটিশ টুরিস্ট নানরকম ক্যামেরা ও ভিডিওক্যাম সহ ভিক্টোরিয়া মেমোরিয়াল দেখে বেড়াচ্ছে এবং বাইরে যাবার নুড়ি মারানো পথে দাঁড়িয়ে ভিক্টোরিয়ায় কিউরেটর তাদের ড্যানিয়েল, জোফানি ও ভেরিশ্চেগিনের আঁকা ছবির মহিমা বর্ণনা করছে। ইনি শুধু ভিক্টোরিয়া মেমোরিয়ালের কিউরেটর তথা ডিরেক্টরই নন, কলকাতার স্বল্প দৈর্ঘ্যের ইতিহাসের ওপরে যারা ঘ্যাম তাদের মধ্যমণি বলা চলে। নিজের জীবনের উত্তরোত্তর উন্নতির বাঁকে বাঁকে তিনি জায়গা বুঝে একটিই কথা কখনো অস্ফুটে, কখনো সজোরে বলে এসেছেন — ‘সবই চার্নকের দয়া!’ আজও অন্যথা হল না। মূর্খ সাহেবদের দলটি হাহা হিহি করিয়া বিদায় গ্রহণের পর কিউরেটর মহাশয় এই ভাবিতে ভাবিতে নিজ কক্ষে ফিরিয়া আসিলেন যে প্রাচীন কলকাতায় মাগিবাড়ি সম্বন্ধে নানা তথ্য ইতস্তত ছত্রাকার হইয়া রহিয়াছে — সে গুলিকে একত্র করিয়া একটি পূর্ণাঙ্গ আকর গ্রন্থ সম্পাদনা করিতে বাধা কোথায় — এই গ্রন্থটি বাংলায় হইলে ভাল না যুগপৎ ভাবে ইংরেজি হওয়াও আবশ্যক — মালটাকে ডাগোর করে তুলতে হলে কত কাঠখড় পোড়াতে হবে — এই সাতপাঁচ ভাবনার শেষে চেয়ারে গা এলাইয়া দিয়া তিনি বলিলেন, ‘সবই চার্নকের দয়া’!

প্রায় সঙ্গে সঙ্গেই জানলার দিক থেকে জবাব এল, ‘কেন, তোর বাপ কী দোষ করল?’

এ এক রূপকথার দৃশ্য। ঘরের মধ্যে মহাপন্ডিত ও জানালার বাইরের অপ্রশস্ত অংশটির ওপরে কলকাতার ওলডেস্ট দাঁড়কাক ওরফে ভদির বাবা। মুখর মন্তব্যটি ছুঁড়ে দিয়েই দাঁড়কাকটি ঠোঁট চুলকোয়।

তবে কি দাঁড়কাকই কথা বলিল? না ভূত? কিউরেটর সাহেব লহমাভর এই চিন্তা করিলেন যে তিনি হয়তো বা অজান্তেই মৃত। কিয়ৎক্ষণ পূর্বেই জীবিত ছিলেন কিন্তু মৃত্যুর পর তাঁহার ভৌতিক জগতে প্রবেশাধিকার ঘটিয়াছে। প্রেতপুরীতে দাঁড়কাক কেন, মশা, ব্যাঙ, গোসাপ সকলেই অবলীলায় বোধগম্য বাক্য চালনা করে। এমত চিন্তা করিয়াই ধুরন্ধর মাথায় অন্য মতলব খেলিল। এমনও তো হইতে পারে যে আমি জীবিত দন্ডবায়সের মুখে হয়তো নিজেই কল্পিত উক্তি ভাবিয়া তামাশা ফাঁদিয়াছি। অতএব কেঁচে গন্ডুষ করে দেখাই যায়। তাই কিউরেটর ফের বলিলেন — ‘সবই চার্নকের দয়া!’

দাঁড়কাক চোখ পাল্টায়।

— একটা ঠোক্কর খেলেই বুঝবি কার দয়ায় করে খাচ্চিস। হারামির হাঁড়ি কোথাকার। যা, অভিশাপ দিলুম তুই পরের জন্মে গুয়ের পোকা হয়ে জন্মাবি। তাও, এখেনে নয়। ধর বর্ধমান বা মানকুণ্ডুতে। গুয়ের ডাব্বায় গুয়ের পোকা। গু খাবি, গু মাখবি তারপর একদিন গুয়ে ডুবেই পটলে যাবি।

কিউরেটর ভাবিয়াছিল সজোরে একটা পেপারওয়েট ছুঁড়িবে কিন্তু সাহসে কুলায় নাই।

— বুঝেছি আপনি বুলি কপচাতে শিখেচেন। কিন্তু জন্ম-জন্মান্তরে মানুষ যে সুপারম্যানের দিকে এগিয়ে চলেছে সে বিষয়ে কিছুই আপনি জানেন না। অবশ্য কাক-ফাকের এসব জানারও কথা নয়।

— বটে! কাক-ফাক! তাহলে শুনে রাখ, এই শালা কাকই তোর ঐ গণ্ডাকয়েক অরবিন্দ আর নীটশেকে ট্যাঁকে রাখতে পারে। সুপারম্যান মারাচ্চে। সুপার গুয়ের পোকা আগে হ, তারপর সুপার বাল, তারপর সুপারম্যান হবি। তোর মত ছকবাজ যত কম জন্মায় ততই মঙ্গল। সবই চার্নকের দয়া! এক ঝাপড়া মারব ফের ঐ নাম মুখে আনলে! চার্নক! ফাক চার্নক!

— চার্নক ওয়াজ আ গ্রেট ম্যান। উনি না এলে কলকতা হত? কলকাতার তিনশো বছরে ঘোড়ার টানা ট্রাম চলত? অত পত্র-পত্রিকার স্পেশাল ইস্যু বেরোত? অত সেমিনার হত? এবং সব জায়গাতেই আমি আমার অগাস্ট প্রেজেন্স নিয়ে হাজির থাকতাম? কোথাও সভাপতি, কোথাও প্রধান কোথাও বিশেষ, ভেরিয়াস টাইপের অতিথি — বলুন এসব হত? সব ইমপরট্যান্ট মিনিস্টারদের সঙ্গে।

-চার্নক ওয়াজ এ গ্রেট বাল। ঐ বোকাচোদা এল আর গঙ্গার পাড়ে হেগে কলকাতার পত্তন করল — তোর মতো হারামি না হলে ঐ লুটেরা মাগিবাজটাকে আদিপিতা বলে চালানো যেত? ছাগলের দেশে রামছাগল যা বলে সেটাই অকাট্য যুক্তি। আর তোদের গভরমেন্টেরও বলিহারি যাই। কলকাতার জন্মদিন মারাচ্চে। তেমন তোদের সব মিনিস্টার। তেমন তুই। পাঁঠার সভার সভাপণ্ডিত ! রামপাঁঠা!

— সে আপনি যা বলেন বলুন, তাতে চার্নকের গ্রেটনেসে এতটুকুও আঁচড় লাগে না। যা ট্রুথ আমি তাই তুলে ধরেছি।

— চোপ! ট্রুথ তুলে ধরতে হয় না। ট্রুথ ঝুলঝাড়ু নয়। ট্রুথ শেখাচ্ছে। জোসেফ টাউনসেন্ডের নাম জানিস?

— আজ্ঞে, শোনা শোনা মনে হচ্ছে …

— ঢপ দিস না। টাউনসেন্ড ছিল রেণ্ডিবাজ এক গ্যাঞ্জেস পাইলট। চার্নকের সাগরেদ। মাগিবাজিতে এ বলে আমায় দেখ, ও বলে আমায়।

— আই প্রোটেস্ট। এ কথাটা আপনি আগেও বলেছেন। চার্নক সতীদাহ থেকে একজন বিধবাকে উদ্ধার করে তাকে বিয়ে করেছিলেন! আর তার নামে…

— বেশি প্যাঁক প্যাঁক করিসনাতো। পোঁদে নেই ইন্দি, ভজরে গোবিন্দি। বিধবা উদ্ধার! তবে শুনবি? ভাইটাল একটা হিস্টোরিকাল ডকুমেন্ট। কবিতার ফর্মে। নে, লিখে নে। অ্যাঁঃ টেপ করবি? তো ক্যাসেট লাগা। ডবকা ফিমেল, ঢলো ঢলো ভাব ঐ মাল চার্নক জিন্দা থাকতে পুড়িয়ে নষ্ট করবে? মাগি কি যুঁইতুবড়ি না নসরিন?

— বলুন, কী হিস্টোরিকাল ডকুমেন্ট?

— বলচি, এটা পড়বি, ভাববি। বলে আমি চলে যাব। তিনদিন পরে আসব। তখন বলবি। নে বোতাম টেপ! জোসেফ টাউনসেন্ডের কবরের ওপরে লেখা — আটটি লাইন, ইংরাজিটা একটু আর্কেইক তবে তোর মত খচড়া ঠিক ধরতে পারবি — নে…

“Shoulder to shoulder, joe my boy,

Into the crowd like a wedge!

Out with the hangers, messmates,

But do not strike with the edge!

Cries Charnock scatter the faggots,

Double that Brahmin in two.

The tall pale widow is mine joe,

The little brown girls for you,”

দাঁড়কাক ঝটিতি উড়িয়া গেল। কিউরেটর টেপ বন্ধ করিলেন। ক্যাসেট রিওয়াইন্ড করিলেন। প্লে লেখা বোতাম টিপিলেন, দাঁড়কাকের গলায় জোসেফ টাউনসেন্ডের এপিটাফ ধ্বনিত হইল। কিউরেটর ঢোঁক গিলিলেন। জলপান করিলেন।

— অ্যাসটাউন্ডিং!

পরক্ষণেই তাঁহার মনে ঝিলিক দিল যে, পরজন্মে তাঁকে গুয়ের ডাব্বায় গুয়ের পোকা হইয়া জন্মাইতে হইবে।

নলেনের কাছে দুঃখজনক সংবাদটি শুনে ভদি বমকে গেল। চারটে ঘরের মধ্যে মাত্র একটা ভাড়া হয়েছে। তাও এসেছে পাগলাখ্যাঁচা টাইপের একটা পাবলিক এবং তার সঙ্গে নাকি মালসা-ফালসা ছিল।

— এঃ চুলপোড়ার গন্ধ ছড়াচ্ছে। বানচোৎ করচেটা কী?

— হবে তুকতাক। পোড়াচুলের ধোঁয়া শিশিতে ধরচে বোধহয়। ফুটো দিয়ে দেকব?

— দেকে আয়। চুল পোড়ালে ভালো। তবে গায় না আগুন দেয়।

নলেন প্রতিটি ঘরের দরজাতেই সংলগ্ন গোপন ছিদ্রের একটিতে উবু হয়ে বসে চোখ লাগায়। এবং বিশেষ ঐ অবস্থান গ্রহণ করার জন্যই সম্ভবত একটি সহিংস বাতকর্ম ঘটে যায়। অমনি ভেতর থেকে সেই পাগলাখ্যাঁচা খেঁকিয়ে ওঠে,

— দরজায় আড়ি পেতে পাদা হচ্ছে! এরপরে ভাড়া চাওয়ার সময় বুঝিয়ে দেব। চুতিয়া কোথাকার।

নলেন চলে এসেছে ছিটকে। এবং মুখ দেখে বোঝা যায় যে চমকেছে। ভদি মিষ্টি হাসে,

— পয়মন্ত খদ্দের। টনক আচে। দেকলি কিছু?

— ঐ যা ভেবেছিলুম। হোমোপাথির ছোট ছোট শিশিতে চুলপোড়া ধোঁয়া ধরচে আর ছিপি দিয়ে দিয়ে বন্ধ করচে

— ঐ ধোঁয়া দিয়ে কী হয় জানিস?

— কী আবার? তুকতাক!

— কিন্তু স্পেশাল। ঐ ধোঁয়া কোনো বেধবা মাগির ঘরে ছাড়লে তেরাত্তিরের মধ্যে চুম্বকের টানে আলপিনের মতো চলে আসবে। এক এক শিশি হেভি দামে ঝাড়বে। আর খদ্দেরের অভাব নেই। হাজার হাজার লোক বেওয়া মাগি তাক করচে।

— কিন্তু টেনে আনা এক জিনিস আর জব্দ করা, সে তো খুবই ঝামালা। কতায়ই তো বলেচে, গলায় দড়ির গিঁট আর বিধবা মাগের হিট।

— সে যার চিন্তা তার চিন্তা। আগে মদনানন্দ মোদক খেত, ইয়াকুতি হালুয়া খেত, হাকিম বাড়ি যেত। এখন শুনচি আমেরিকা থেকে কী একটা ট্যাবলেট আনচে। এক বাক্স কিনতেই ফতুর। তবে হ্যাঁ, একটা টপ করে গিলে ফেললেই হল। কলকাতার যেমন মনুমেন্ট তেমন তোরও হয়ে যাবে। যেই যে দাঁড়াবে আর শোওয়া বসা নেই।

বিস্ময়ে নলেনের মুখ হাঁ হয়ে যায়,

— সেও তো বিপদ।

— বিপদ বলে বিপদ। ঘোর বিপদ। যা হোক ঐ মালটাকে আর ঘাঁটাসনি। এরপরে বেইমানির ওজর তুলে ভাড়া দিতে গাঁইগুঁই করবে।

— ও আমি ঠিক সাইজ করে নেবখন।

— নিস। আমি এট্টু বেরুচ্চি। জয় বাবা দন্ডবায়সের জয়! জয়, ঘুরঘুরে চাকতির জয়।

ভদি বেরিয়েই যাচ্ছিল কিন্তু বেচামণি ডাকল,

— এই নলেন, এট্টু ডাক তো!

— সেই পিছু ডাকলে। যা ভয় করেছিলুম তাই।

— বৌ পিছু ডাকলে কিছু হয় না। কী বল নলেন।

নলেন গাণ্ডুর মতো মাথা নাড়ে।

– এসব নকড়া ছাড়ো তো। কী বলবে বলো, ঝটপট বলো দিকি।

— বলচিলুম ঠাণ্ডা পড়েচে। চামড়ায় টান ধরচে। গাল চড়চড় করচে। একটা গ্লিসারিন সাবান আনবে তো মনে করে!

— কেন? তেল মেকে হচ্চে না? কী আমার কাননবালা রে, গ্লিসারিন সাবান না হলে চলচে না। একেই মাগগির বাজার। ওসব সায়েবসুবোরা মাখে। কত দাম জানো? মাত্র এক ঘর ভাড়া হয়েচে।

— তোমার ক-ঘরে লোক বসল আমার জেনে দরকার নেই। ও আমি ঢের দেকেচি। এরপর কিন্তু কিস খাবার সময়ে বলবে না যে — বেচু, তোর গালটা অমন খসখসে কেন রে?

নলেন ফিকফিকিয়ে হাসে। চুলপোড়া ধোঁয়ায় সকলেরই নাক জ্বালা করছে। ভদির মুখটা দেখে মনে হচ্ছে হিট উইকেট হয়েছে।

— মুখের একটা আব্রু নেই। ঘরের বৌ কেউ বলবে?

— তো কী বলবে? বলো! লোককে জিগ্যেস করেই দেখো না। কী বলবেটা কী? বাজারখোলার খানকি? একটা গ্লিসারিন সাবান চেইচি, তাই কত চোপা!

বেচামণি যে ভ্যাঁ করে ককিয়ে উঠবে সেটা ভদি ঠিক আন্দাজ করেনি। উপরন্তু ধারে-কাছে দাঁড়কাক বাবা আছে কিনা সে ভয়ও আছে। খচে গিয়ে হয়তো মাথার মাঝখানে ঠুকরে দেবে বা জোড়া ডানার ঝাপড়া।

— আঃ, য্যাতো দিন যাচ্চে তত খুকিপনা বাড়চে। আমি কি বলেচি যে গ্লিসারিন সাবান আনব না? ঠাট্টা বটকেরা কিচুই বুজবে না।

বেচামণি ফোঁপায়।

— থাক। আর সোহাগ দেখিয়ে অ্যাদিক্যেতা করতে হবে না। নলেন, আমি গেলুম। খুকিকে চোকে চোকে রাকিস। চুলপোড়াও না পালায়। কোতায় একটা দরকারি কাজে বেরোব না হাঁউমাউ করে সব ঘেঁটে দিল। গ্লিসারিন সাবান! কত বাঁড়া গ্লিসারিন সাবান দেখলুম।

ভদি চলে যেতে নলেন বেচামণিকে মক বকাঝকা করে।

— আর তুমিও পারো বাবা বৌদিদিমণি। জানো তো, লোকটার মুকই ঐরকম। কিন্তু অন্তরটা। জানবে যে লোকের মুখে মধু তার অন্তরের বিষ কেউ টের পায় না। দাদাবাবুর হল উল্টোটা। ছোবলাবে কিন্তু মধু ঢেলে দেবে।

— সে না হলে কবেই বাপের বাড়ি চলে যেতুম।

— বালাই ষাট! অমন কথা বলতে আচে?

এই ইন্টিমেট, ট্রাসপারেন্ট ও টাচিং কথোপকথনের মধ্যে ঘটাস ঘটাস করে ঘর খুলে, গলা খাঁকারি দিয়ে, কাঁধে ঝোলা, পাগলাখ্যাঁচা টাইপটা বেরিয়ে আসে। ঝোপজাড়ওয়ালা পরপুরুষকে দেখে বেচামণি বড় করে ঘোমটা দিয়ে অন্যদিকে চলে যায় এবং তার পায়ে পরা রুপোর গয়না থেকে ঘুঙুরমার্কা ছমছমা শব্দ হয়। পাগলাখ্যাঁচা আড়চোড়ে বেচামণির ব্যাকটি সার্ভে করে নেয়। এরকম অবশ্য যারা পাগলাখ্যাঁচা নয় তারাও করে থাকে।

পাগলাখ্যাঁচা তেলচিটে বুকপকেট থেকে টাকা বের করে। দুটো কুড়ি টাকা আর ছটা দশ টাকার নোট গুণে গুণে নলেনকে দেয়। ওর ঝোলার মধ্যে শিশিতে ঘষা খেয়ে মিহি কিঁচমিচে শব্দ হয়। নলেন একটা কুড়ি টাকার নোট ফিরিয়ে দেয়।

– কী হল?

– ও জোড়া টাকা চলবে না।

– কোথায় জোড়া?

– মাঝখানে এটা কী? কাগজ সাঁটা জ্বলজ্বল করচে।

— ও ওরকম থাকে। সব চলে।

— চলুক। এখানে চলে না।

— নাও বাবা, পাল্টে দিচ্ছি। মালিক আর মালকিনে খিঁট চলছে বলে ঠাহর হচ্ছে। কী ঠিক বলিনি? এই নাও। ধরো। ভালো টাকা। কী, ঠিক বলিনি?

— টগরগাছতলায় ঐ খেঁটোটা দেখতে পাচ্ছ? ঐটা যখন গাঁড়ে ঢুকিয়ে দেব তখন টের পাবে কী চলছে?

— যাঃ বাঁড়া। কী বললুম আর কী বুঝল?

— ঠিকই বুঝেছি। বাল পুড়োনো ধোঁয়াতে কী হয় জানো?

— আমার আর জেনে দরকার নেই বাবা। পাগলাখ্যাঁচা আর কালবিলম্ব না করে কেটে পড়ে। নলেন এগিয়ে দরজার হুড়কোটা লাগিয়ে দেয়। অন্তরীক্ষে একই সঙ্গে বোয়িং এরোপ্লেন ও চাকতির শব্দ। বোয়িং সেভেন ফোর সেভেনের পাইলট উড়ন্ত চাকতির উন্মত্ত ও স্বচ্ছল খেলা দেখে বিস্মিত হয়। গ্রাউন্ড কন্ট্রোলের সঙ্গে যোগাযোগ করে!

এই যে অত্যন্ত ভূতুড়ে মহাকাশ আমাদের প্রায়ই অনন্ত নশ্বরতার বোধে আকুল করে তোলে এবং হালকা হাতছানি দিয়ে ‘আয়! আয়!’ বলে ডাকে তাতে ওড়াউড়ি করার অধিকার যেমন বোয়িং-এর আছে তেমন ভদির ঘরের উড়ন্ত চাকতিদেরও আছে। ঠিক এই কথা বলার জন্যে না হলেও বাংলার এক কবি লিখেছিলেন,

ক্ষিত্যপতেজব্যোম ও মরুৎ

সকলেরই তরে এই পঞ্চভূত।

এই বলেই তিনি ক্ষান্ত হননি, বরং কয়েক ফার্লং এগিয়ে গিয়ে, – সাম্যের আদর্শে বলীয়ান হয়ে, অপারেশন বর্গার কত আগেই বলেছিলেন,

আকাশ – আলো – জল – বায়ু — চার

— এ সকলে যদি থাকে অধিকার

সব মানুষের, ভূমিতে কেবল

দু-চারজনের রহিবে দখল?

লড়াকু মনোভাবে ভরপুর এই মহান কবিতাটির শিরোনাম — ‘সবৈ ভুমি গোপাল কী’। কিন্তু সেই কবির নাম কী? মালটাকে কেউ আইডেনটিফাই করতে পারবে?

সকল অধ্যায়

নোট নিতে এবং টেক্সট হাইলাইট করতে লগইন করুন

লগইন