কাঙাল মালসাট – ৯

নবারুণ ভট্টাচার্য

যে সন্দেহ এইবার বার বার উঁকি মারিবে ও ফিক করিয়া হাসি করিয়া ফেলিবে তাহা হউক এই যে ‘কাঙাল মালসাট’ কপর্দকহীনদের জন্য এক ব্যাদড়া কুইজ নাকি অন্য কোনো অভিসন্ধিমূলক অভিযান? যে কোম্পানি এই অহৈতুকি ব্যবসা খুলিয়াছে তাহাদের মুখে হয় লুপ নয়তো কুলুপ। এমন কেন হল গো? এও কি চাকতির হুজ্জুতি। ইজ এনিবডি আউট দেয়ার? শুনশান। অনেকটা পায়খানার দরজায় আকুল ধাক্কার মতো? ভেতরে কে? সায়লেন্স। এই ঝুটঝামেলা অত সহজে মেটার নয়। এবং এর সমাধানের জন্য বঙ্গবালক ও বঙ্গবালিকাদের যে পদ্ধতি ইস্তেমাল করতে হবে তা যেমনই দুর্লভ তেমনই অনায়াস। ‘আট’-এর শ্বাস ওঠার সময় চন্দননগরের জনৈক বিখ্যাত বাঙালির একটি গুরুগম্ভীর প্রবন্ধের কিয়দংশ মুদ্রিত হয়েছিল যদি না প্রেসের ভুলে উড়ে যায়। সেই বাঙালিকে আমরা টুনি লাইটের আলোকসজ্জার মধ্যে গবাক্ষে হাস্যময় বলে ভাবতে পারি। তিনি ছিলেন অথবা হইলেন হরিহর শেট। ভবিষ্যতেও থাকিবেন। যেমন থাকিবে ডাইনোসরের ডিম, তবলার বিড়ের মতো দেখতে একটা জিনিস মাথায় বঙ্কিমচন্দ্রের ছবি ও পৃথিবীর নানান গলতায় প্রোথিত টাইম ক্যাপসুল। কারো কোনো ওজর আপত্তি ধর্তব্যে নেওয়া হবে না। এরই মধ্যে পুনরায় সেই পরিচিত ওঁয়া ওঁয়া ধ্বনি!

মালের ধুনকি যদি কাটে, বাগিচায় খোঁয়ারি যদি ভাঙে তাহলে সাহস সঞ্চয় করে পাঠককে ইন্টারোগেট করা যায় যে উপরোক্ত ওঁয়া ওঁয়া-র একটি আগাম সতর্কবাণী আগেই আছে এবং তা কোথায়? কোনো হাত ওঠে না কারণ সবগুলিই চুলকোতে ব্যস্ত। ধিক। শতাধিক। অক্টোবর’৯৯-এর শেষ হপ্তার মুখে ডি. এস-এর কবুলিতে কি জানা যায়নি যে তার বৌ-এর আট মাস চলছে। চলছে মানে শুরু হয়েছে এমনই বা না হবে কেন? বরং দশ মাস দশ দিন, চিনতে না পারলে গলায় দড়ির দাগ, মা হওয়া কি মুখের কথা — সব অঙ্ক মেলানোর জন্যে তেমনই হতে হবে। হলও।

২০০০-এর জানুয়ারিতে, আগেকার কথা মতো, ‘শিশুমার মেটারনিটি হোম’-এ, ড. গজেন্দ্রকুমার রায়চৌধুরি বা যে নামে তিনি অধিকতর পরিচিত সেই গায়নো গজার নার্সিং হোম-এ সিজারিয়ান পদ্ধতিতে ডি. এস.-এর কালো, মোটা, অল্প গোঁফওয়ালা ব্যাঙের মতো বৌ-এর পেট কেটে জালি বা আসলি (দ্বিমত আছে) সহস্রাব্দের প্রথম ফ্যাতাড়ু জুনিয়রকে বের করা হল। নার্সিং হোমটির নাম শুনলে অবধারিতভাবে মনে হবে যে এখানে শিশুদের মেরে ফেলাটাই বিশেষত্ব। তা কিন্তু নয়। ‘শিশুমার’ শব্দটির আভিধানিক অর্থ জলকপি বা শুশুক। গজেন্দ্রকুমার শিশুকালে বাবার কোলে বসে দেখেছিল গঙ্গাবক্ষে শুশুক হু হু করে উঠছে ও তলিয়ে যাচ্ছে। অর্থাৎ জলকপির দল এরকমই করেই চলেছে, করে চলেছেই। এই দৃশ্যটি গজেন্দ্রকুমারের শিশু মনে গভীর দাগ কাটে। এভাবেই তাঁর মধ্যে শুশুকের প্রতি দায়বদ্ধতা গড়ে ওঠে। তারই ফল পরিণামে হল ‘শিশুমার মেটারনিটি হোম।’

বাইরে দুরু দুরু বক্ষে অপেক্ষমান ডি. এস, মদন ও পুরন্দর ভাট। সেখানে আরো পাব্লিক রয়েছে। শীতের পোশাক কিন্তু উত্তেজনার গরম। ফুটের দোকান থেকে চা আনে পুরন্দর। সে নিজে আনে না। খাঁচাসদৃশ বস্তুটিতে গেলাস বসিয়ে আনে একটি পেটমোটা শিশু শ্রমিক। পুরন্দরের হাতে বাতিল লটারির টিকিটে মোড়ানো তিনটি বিস্কুট।

— ফার্স্ট বাপ হবে। মুখ দেখে মনে হচ্ছে বলির পাঁঠা।

— ‘আঃ পুরন্দর। সংসারধর্ম করনি তো। আলপটকা ওরকম বলা যায়। ডি. এস-এর অবস্থায় পড়লে বুঝতে।

— ক্ষ্যামোতা থাকলে একটা বিয়ে করেই ফেলো না। হিম্মত দেখি!

— তোমাকে হিম্মত দেখাতে গিয়ে গাঁড় মারাবার চক্করে আমি নেই। আর কবিদের কেসটা আলাদা। সব মনে মনে হয়।

— মানে?

— পরে একদিন বুঝিয়ে দেব। আরে বিস্কুটটা কামড়াবে তো!

— ভুলেই গেছি যে হাতে বিস্কুট।

— এরপর হাতে হ্যারিকেন ছাড়া আর কিছুই থাকবে না।

ঠিক এই সময়েই কালো পাথরের কানা উঁচু থালায় জল জমিয়ে ভদি উবু হয়ে বসে দেখছিল। নলেন জমাদারের সঙ্গে নালি পরিষ্কার করা নিয়ে ঝগড়া করছিল। বেচামণি স্নান সেরে পিঠের দিকে গামছা ধরে মাথা হেলিয়ে চুলে সপাট সপাট ঝাড়ছিল এবং ভদির বাবা ছাদের আলসেতে বলে দেখছিল যে বৌমা-র মাথা থেকে জলকণাগণ সহসা উড়িয়া উঠিতেছে ও রোদ্দুরে রামধনুর রং এই আছে, এই নেই।

— যাক বাবা, ভালোয় ভালোয় হয়ে গেল।

বেচামণি আপনসুখে বলে,

— কী হল গো ভালোয় ভালোয়?

— ডি. এস-এর বাচ্চা হল। তা না তো কি তোমার পিণ্ডি হবে?

— কতা বলার ও কী ধরণ গো?

দাঁড়কাক ঘ্যাঁক করে ওঠে,

— ভালো করে মুখ না ছুঁচোলে অমন হয়। ছেলে না মেয়ে হল সেটা বলবি তো?

— ছেলে হয়েচে! এই নাদাপেটা!

বেচামণি খিলখিলিয়ে ওঠে,

— আমি আগেই বলেছিলুম!

ভদি ফের খিঁচিয়ে উঠতে গিয়ে বাপের কথা ভেবে গুটিয়ে যায়।

দাঁড়কাক ডানা ঝাপটায়।

— বাবা কি চললেন নাকি?

— যাই, বনি বেবি হয়েচে, বেগম জনসনকে খপরটা দিয়ে আসি। আগে হলে গড়ের বাদ্যি বসত। হিজড়ের নাচ হত।

দাঁড়কাক উড়ে চলে গেল।

টাকলা ও. সি.-র টেবিলে ফোন বাজল।

— হ্যালো!

— ওঁয়া! ওঁয়া!

— হ্যালো!

— ওঁয়া! ওঁয়া!

পার্টি অপিসে কমরেড আচার্য-র ফোনও ডেকে ওঠে। কিন্তু কমরেড আচার্য না থাকাতে ফোন বেজে বেজে থেমে যায়। কমরেড আচার্য, আপনি আগামী সম্মেলনের জন্যে খচড়া প্রস্তাব রচনায় লেগে থাকুন। ওদিকে যা হওয়ার তা হয়ে গেল। এর দাম আপনাকে দিতে হবে। আপনি চান বা না চান চোক্তাররা চমকাবে এবং ফ্যাতাড়ুদের বংশবৃদ্ধি ঘটবে। চাকতি উড়বে। বেগম জনসন গ্র্যান্ড পার্টি ডাকবেন। পাতিয়ালার মহারাজা ১০০১ টা নীলচে সাদা হীরের ব্রেস্টপ্লেট পরে উদোম ন্যাংটো হয়ে বছরে একবার করে নগর পরিক্রমায় বেরোবেন। জন স্টুয়ার্ট মিল এই সিদ্ধান্তে উপনীত হবেন যে ভারত একটি vast system of outdoor relief for Britain’s upper classes হয়ে উঠেছে। চার্চিল বলবেন, I hate Indians, they are absolutely beasty people with a beastly religion. কাপুরথালায় একবার পালে পালে পঙ্গপাল ঢুকে ফসলের দফা রফা করে দিয়েছিল। এখন যেমন পঙ্গপাল ছাড়াই কাজটা হয়। তখন প্রজাদের হাঁউ মাউ কান্না শুনে কাপুরথালার মহা মাগিবাজ মহারাজা বলেছিলেন, Let the locasts dance, we are going to dance in Paris. কমরেড আচার্য, আপনি খচড়া প্রস্তাব লিখতে থাকুন। আমরা তা অক্ষরে অক্ষরে পালন করব। আপনি আমাদের ওপর ভরসা রাখতে পারেন। আমরা চোরাবালির মতোই মমতাময়।

গোলাপি লিপিস্টিক চুলবুলে ঠোঁট আবছা ফাঁক করে ট্রেইনি নার্স মিস চাঁপা এসে ফিসফিসিয়ে উঠল,

— মিঃ ডি. এস কে আছেন?

— অ্যাঁ

— আপনি মিঃ ডি. এস?

— ইয়েস।

— ডক্টর রেচাউড্রে কথা বলবেন। প্লিজ কাম উইথ মি।

ডি. এস ঘামতে ঘামতে মিস চাঁপার সঙ্গে গিয়ে দেখে গায়নো গজার হাল খুবই বেসামাল। মালটা ঠ্যাংদুটো টেবিলে উঠিয়ে দিয়ে চেয়ারে কেলিয়ে রয়েছে। মাথায় ভিজে তোয়ালে দেওয়া। এবং সিনিয়র মেট্রন মিসেস পোড়েল গজার বাঁহাতটা মালিশ করচে।

— আপনি?

— কী?

— না, মানে, ঐ যে ছেলেটা হল সেটার বাপ আপনি?

— ছেলে হয়েছে?

— ওপর ওপর দেখে তো তাই মনে হচ্ছে। আচ্ছা, আপনি, তারপর গিয়ে আপনার বৌ — আপনারা কী বলুন তো?

— মানে?

— মানে, সোজা, আপনারা কি মানুষ না ভূত-ফুৎ কিছু?

— কেন বলুন তো?

— কেন? দুনিয়ায় যত বাচ্চা পয়দা হয় সব কেঁদে ওঠে। আপনার ছেলে খ্যাঁক খ্যাঁক করে হাসতে লাগল আর নাভি কাটার পরই, লাইক আ বার্ড, উড়তে শুরু করল —

— কেমন আছে ওরা?

— ভালো আছে। মা-র জ্ঞান ফিরবে একটু পরেই। কিন্তু…

ডি. এস কিছু বলার আগেই পেছন থেকে মদন আর পুরন্দর ঢুকে পড়ে।

— কোনো কিন্তু ফিন্তু নয়। মা, বাচ্চার কোনো এদিক ওদিক হলে কিন্তু গায়নো কোম্পানির তেশ মেরে দেব।

— আপনারা?

— চোপ। কোনো বেগড়বাঁই নেহি চলেগা। আপনি ঠিকই ধরেচেন। আমরা মানুষ। কিন্তু আবার মানুষও নই। দেখবেন ছোট করে একটা ঘুঘুচক্কর?

ড. রায়চৌধুরি ওরফে গায়নো গজা, মিসেস পোড়েল এবং মিস চাঁপার বিস্ফারিত চোখের সামনে তিন ফ্যাতাড়ুই টেক অফ করল এবং হাত পাঁচেক উঠে হেলিকপটারের মতো দাঁড়িয়ে গেল। দুপাশে হাতগুলো ডানার মতো ওঠা নামা করছে। তিনজনেই দাঁত কেলিয়ে দিয়েছে। ডাঙায়ও তিনজন। তাদের প্রায় দাঁতকপাটির যোগাড়। ছটি স্তম্ভিত চোখের সামনে তিনজনেই ল্যান্ড করল।

ডঃ রায়চৌধুরির নির্দেশে তড়িঘড়ি মিসেস পোড়েল ও মিস চাঁপা কেটে পড়ল।

— কদিন লাগবে?

– হপ্তাখানেক তো বটেই। মানে মাদার, একটু বেশি বয়েস তো তাই ভাবছি …

— ও সে যা ভাবাভাবির আপনি করে ফেলুন। আমাদের কিছুটি বলার নেই। ডাক্তারি ব্যাপারে আমরা নাক-ফাক গলাচ্ছি না।

— ‘ডাক্তারি করে ডাক্তার

মোক্তারি করে মোক্তার

ফ্যাতাড়ুরা খেলে হারামির হাটে

চোক্তারি করে চোক্তার।’

কী বুঝলেন?

— আমার বুঝে কাজ নেই। যা বলার আপনারাই বলুন।

— তার মানে আনকন্ডিশনাল সারেন্ডার।

— শুনুন। অপরাধ নেবেন না। আমাদের হাতে পয়াকড়ি হেভি টাইট বুঝলেন। এদিকে আমাদের আগেভাগেই তো গাঁড়ে হনুমানের বাচ্চা চলে যাওয়ার যোগাড়। আপনার ছুরি ধরা, ও. টি চার্জ, বেড ভাড়া, আয়া — অত খরচা আমরা দিতে পারব না।

— পারলেও দেব না।

গরিবের গাঁড় যারা মারে।

ফ্যাতাড়ুরা হাগে তার ঘাড়ে।

— দোহাই, ঐ টি করবেন না। আমি তো আপনাদের কোনো কথাতেই না বলিনি। আপনাদের যা প্রাণ চায় দেবেন। আমার কিছু বলার নেই।

— আমাদেরও আর কিছু বলার নেই।

— আপনি কি মাল খান?

— আমি?

— হ্যাঁ, তবে কি আমরা?

— আঁজ্ঞে, দিনান্তে সামান্য একটু ধরুন পেগ দেড়েক ব্রান্ডি!

— খুব ভালো। আপনাকে ভালো মাল খাওয়াব, ফরেন। মা বাচ্চাকে ভালো করে দেখুন। দেখবেন আপনার জন্যে কেমন জান লড়িয়ে দেব। কোনো অসুবিধা হবে না। এরপর একদিন আপনাকে ভদিদার ঠেকে নিয়ে যাব। দেখবেন ছপ্পড় খুলে যাবে। মাটাডোরে করে টাকা নিয়ে যেতে হবে। যা কিছু হচ্চে সবই ভদিদার কৃপা।

— যাব। নিশ্চয়ই যাব। ওঁর কি কোনো আশ্রম আছে?

— আরে ওসব ভগবানের বাচ্চা ধরার কেস নয়। ভদিদা হল আপনার আমার মতোই। তবে হেভি কৃপা।

— নিশ্চয় যাব। আসবেন যখন ইচ্ছে।

— না, অন্যায়টা আমাদের করতে বলবেন না। ভদিদার বারণ আছে। আমরা ভিজিটিং আওয়ারেই আসব। বেটাইমে আসতে যাব কেন?

— বেটাইমে এলে দারোয়ান দাঁত খিঁচোবে। আমরাও বেকার খচে লাথ-ফাত ঝেড়ে দেব। মধ্যে থেকে আপনার নার্সিং হোমের বদনাম। কোনো ক্যাচালে আমরা নেই।

— আজ তাহলে আমরা আসি?

— আসুন ভাই। আসুন। কী কপাল যে আপনাদের দেখা পেলাম। ভদিদাকে আমার সাষ্টাঙ্গ প্রণাম জানাবেন। একটু যদি কৃপা করে দেন। তেতলায় একটা এ. সি. ওয়ার্ড খুলব বলে মনে ভেবেছি। মাড়োয়ারিরা এ.সি. চায়। পলিটিকাল লিডাররাও।

— সব হয়ে যাবে। ভদিদা একটু ছোট করে একটা মুচকি দিলেই কারো বাপ ঠেকাতে পারবে না।

শিশু ফ্যাতাড়ু ফড়ফড় করিয়া উড়িয়া বেড়ায় ও শূন্যে ডিগবাজি খায়। ডি. এস.-এর বউ-এর জ্ঞান আসে এবং সিজার কেসে সচরাচর যা হয় তেমন নয়। কোনো ককানি ফকানি নয়। বেদনায় কাতর মুখমণ্ডল নয়। উড়ন্ত শিশুর দিকে হাসিমুখে মা দুহাত বাড়িয়ে দেয়। অমনি সেই শিশু বোঁ করিয়া দুধভরা মাই লক্ষ করিয়া ডাইভ মারে।

কলকাতার পোজিশনাল অ্যাস্ট্রোনমি সেন্টারের তারাবীক্ষণ যন্ত্রে সহসা বহুত সংখ্যায় উড়ন্ত চাকি দেখা গিয়েছিল। সেন্টারের ডিরেক্টর মিঃ সিকদার স্বচক্ষে একাধিক চাকতি দেখেছিলেন। কিন্তু মানেননি। কারণ আসলি বিজ্ঞান উড়ন্ত চাকি-ফাকি মানে না। কল্পবিজ্ঞান বা পরাবিজ্ঞানকে আসলি মালের সঙ্গে ঘেঁটেঘুঁটে পয়মাল করে দেওয়ার যে অব্যর্থ চক্রান্ত চালু হয়েছে মিঃ সিকদার তার বিরুদ্ধে গর্জে ওঠেন। নানা সেমিনারে, বিতর্ক সভায় ও টিভিতে তাঁর হুংকারে চমকে ওঠার সৌভাগ্য আমাদের হয়েছে। অবশ্য এই ‘আমাদের’ মধ্যে বিজ্ঞানমনস্ক পাঠকরাও কি পড়েন? ছোট্ট বন্ধুদের মধ্যে কেউ বলতে পারবে? ছোট্ট বন্ধুরাই বা কারা? আসরেই কি সব পাওয়া যায়? গল্পদাদুর বউ কি গল্পদিদিমা? এরকম ২০০০টি অসমাধিত হেঁয়ালির বই ‘আনি মানি জানি না’-র চর্তুদশ সংস্করণের কয়েকটি কপি এখনও পুস্তকরাজির ছাইভষ্মের মধ্যে ছুপা রুস্তম হয়ে গা ঢাকা দিয়ে আছে। ‘এটির মধ্যে ওটি দিয়ে, মাগভাতারে রইল শুয়ে।’ এর মানে কিন্তু যা ভাবা স্বাভাবিক তা নয়। এর অর্থ হল খিল। হেঁয়ালির জট খুবই জটিল। রুবিকের কিউব যেমন। ওপথে মহাজনদের শনৈঃ শনৈঃ যাওয়া আসা চলতে থাকুক। রাত বেড়েছে। চাদরমুড়ি দিয়ে বড়িলাল এই শীতের রাতে কোথায় যায়? কেন যায়? কেচ্ছার চান্সটা যেহেতু এই দিকেই তাই সেই দিকেই মনোনিবেশ করা যেতে পারে।

মন্দিরের পেছনের গলি দিয়ে বেরিয়ে বড়িলাল কিন্তু থমকে গেল। আদিগঙ্গার দিক থেকে একটা আঁশটে ঠাণ্ডা বাতাস আসছে। কিন্তু সে কারণে বড়িলাল দাঁড়ায়নি। একটা ভারি গাড়ির আওয়াজ জোরে হচ্ছিল। আর একটা হেডলাইট জ্বলছিল বলে ফুটপাথের এক সাইডেই বেশি আলো এবং হবি তো হ বড়িলাল পড়েছিল সেই দিকেই। গোঁ গোঁ, ঝড়র লঝড় শব্দ আর কার হতে পারে? ক.পু-র একটি ভ্যান যা কালবিলম্ব না করে ওজন দরে ঝেড়ে দিলেও গরিব ও বঞ্চিত সরকারের ঘরে কয়েকটা পয়সা আসবে। ভেতরে ড্রাইভারের পাশে বসে টাকলা ও. সি। পেছনে তিনটে ঝিম মারা কনস্টেবল। এদিকটায় আনকা যারা মাগিবাড়িতে যায় তাদের ডবল ছেনতাই হয় — ছেনতাইবাজরা ঝেড়েঝুড়ে নেওয়ার পরে পুলিশের হাতসাফাই। এসব জৈব ভয় বড়িলালের না থাকলেও সে স্ট্যাচু হয়ে রইল এবং একচোখো ভ্যানটিকে নিরাপদ দূরত্ব অবধি যেতে দিল। চাদরমুড়ি বড়িলালের কাঁধে একটি বিবর্ণ বুদ্ধিজীবী ব্যাগ যার মধ্যে কাগজে জড়ানো একটি রামের পাঁইট। অতিবিশেষ অনুষ্ঠান ছাড়া বড়িলাল মালমুল টাচ করে না কিন্তু যখন খায় তখন ছ্যাঁচোড়ের মতো খায় না। বড়িলালের এই হিসেবী সংযম নিশ্চয়ই পাঠকদের একাংশ অনুকরণীয় বলে মনে করবেন। কিন্তু এই প্রস্তাব পাঁড় ও টপভুজঙ্গদের অন্তরে কোনো বিবেচনার ঢেউ তুলবে না। তার কারণ কিন্তু হারামিপনা নয়। দেদারে যারা মাল প্যাঁদায় তাদের গুরু ও লঘু মস্তিস্কে কিছু ভাইটাল রদবদল ঘটতে থাকে। সেই নিউরন-সমাহারগুলি অলস তাসা পার্টির সঙ্গে তুলনীয় যারা বায়না ফিরিয়ে দেয়। এর পরিণতি বিবেচনাবোধের হ্রাস, গতরাতের বাওয়াল ভুলে যাওয়া ইত্যাদি নানাবিধ সিনড্রোম যা নিয়ে আর গবেষণা করার কিছু নেই। তবে হ্যাঁ, গাঁজা নিয়ে গবেষকরা কিন্তু একমত নন। এ পর্যন্ত এর বেশি কেউ জানে না। আর অত জেনেই বা কী বালটা হবে?

কয়েক ঘরের শীতার্ত মাগিপাড়া। সব খানকির পাকা ঘরও নাই। বড়িলাল কিন্তু যে ঘরটির সামনে দাঁড়াইল সেটি কাঁচাপাকা। নানদিক হইতে ত্যারচা গোয়েন্দা আলো ও এলোমেলো তস্কর ছায়া এসে এক অনির্বচনীয় মিশেলের সৃষ্টি করেছে। বড়িলাল দরজায় দুইবার টুকটুক করিয়া গাঁট্টা মারিল এবং অনুচ্চ স্বরে ডাকিল,

— কালী! কা…লী…

ঘুমচোখে যে দরজা খোলে সেই কালী তা আবার নাই বা বলা হল।

— এসো। ভাবলুম আর না হয় এলে না। বসে বসে ঘুম ধরে গেল।

কালী ম্রিয়মান হ্যারিকেনটির শিখা উস্কাইয়া দিল। ফলে অপ্রশস্ত দেওয়ালে নানা ঠাকুর দেবতার ছবির ওপর বড়িলালের রাক্ষুসে ছায়া পড়ল।

— সাবান আর একটা কাচা কাপড় দে।

বড়িলাল উঠানে গিয়া অর্ধ গোলার্ধের ন্যায় কাপড় কাচা সাবানে হাত, পা, মুখ ধুইয়া কক্ষে ফিরিল এবং চৌকাঠে শায়িত চটের টুকরোটিতে পা ঘসিয়া মুছিল। এবং ঘরে আসিয়া নিজের কর্মক্লান্ত বেশভূষা ছাড়িয়া কালীর কাচা কাপড়টি যাহার নমনীয়তা মায়াময় এবং কেমন চাঁদ চাঁদ গন্ধ, লুঙ্গি করিয়া পরিল।

ইতিমধ্যে কালী দুইখানি গ্লাস ও একটি রেকাবিতে ছোট চিংড়ির মাথা ভাজা ও বড় বোতলে জল সাজাইয়া বসিয়াছিল। বড়িলাল কালীর চিরুনি দিয়া চুল আঁচড়াইল। তাহার পর কালীর মেঝেতে পাতা ঢালাও বিছানাতে আধশোয়া হইয়া রহিল। হাতের উপর মাথাটি রাখিয়াছিল বলিয়া তাহার বাইসেপটি ফুলিয়া ওঠে। কালী বলে,

— হাত ব্যতা করবে। ঐ কোলবালিশটা টেনে নাও।

কালী মাপ করিয়া ওল্ড অ্যাডভেঞ্চারার রাম ঢালে। জলের বোতল ধরে।

— আমার দিকে কী দেকচ? জল ঢালচি দেকবে তো!

আমরা জানি যে কালীকে যৌনকর্মী বলা উচিত না উচিত নয় তা নিয়ে সমাজের চিন্তাশীল অংশের মধ্যে বিতর্ক, বাদানুবাদ ও বিতণ্ডা প্রায়ই ঘটে। দুপক্ষই এমন লড়াকু যে পারে তো এখনই এ উহার গুহ্য মারিয়া দেয়। এই ঘোলা জলে ইচ্ছা করিলে দু একটি মৎস্যও যে ধরা যায় না তা নয়। কেবল একটি খ্যাপলা জাল রেডি রাখতে হবে।

কালীর ঘরে লন্ঠন ওরফে হ্যারিকেনের আলো কমিয়া গেল। ‘শিশুমার মেটারনিটি হোম’ হইতে ওঁয়া ওঁয়া শোনা যায়। রাজ্যে যে শান্তি বিরাজমান তা রক্ষা করার দায়িত্ব সকলেরই হইলেও রাজাদেরই বেশি।

এই সত্য উপলব্ধি করিয়াই আলমোড়া হইতে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর ত্রিপুরায় মহারাজকুমার শ্রী ব্রজেন্দ্রকিশোর দেববর্মা বাহাদুরকে লিখিয়াছিলেন ‘তোমাদের রাজ্যের হিতসাধনের প্রতি লক্ষ্য রাখিয়া তোমাকে অত্যন্ত সহিষ্ণু হইতে হইবে। ঘটনাক্রমে অনেক অন্যায় অবিচারও তোমাকে আঘাত করিতে উদ্যত হইবে-তখন তোমার তেজস্বিতা যেন তোমাকে আত্মবিস্মৃত না করে। নীরবে অনেক আঘাত সহ্য করিতে হইবে — নিজের দিকে না তাকাইয়া নিজের কর্ত্তব্যের দিকেই লক্ষ্য রাখিবে। তোমাদের রাজাকে ও রাজ্যকে যাহাতে কোনো প্রকার দুর্বলতা আক্রমণ করিতে না পারে — ক্রমে ক্রমে সুযোগ বুঝিয়া যাহাতে সমস্ত জঞ্জাল দূর করিতে পার সে জন্য তোমাকে অত্যন্ত সতর্কভাবে চেষ্টা করিতে হইবে। হঠাৎ যাহাতে কোনো বিপ্লব বাধিয়া না উঠে, সে জন্যও বিশেষ সাবধান হওয়া আবশ্যক হইবে।’

ওঁয়া ওঁয়া

সকল অধ্যায়

নোট নিতে এবং টেক্সট হাইলাইট করতে লগইন করুন

লগইন