কাঙাল মালসাট – ২

নবারুণ ভট্টাচার্য

প্রথম পর্বের মিলেনিয়াম অন্তে চারটি প্রশ্ন উঠেছিল। নেমে গেছে। অথবা সাফ সাফ জানিয়ে দেওয়াই হল মুরুব্বির কাজ- ওসব জবাব-ফবাব এখন হবে না। এখানে কেউ ইস্কুলের পরীক্ষা দিচ্ছে না যেখানে পরীক্ষার খাতার ওপরে টুকলিবাজদের জন্যে লেখাই থাকত, ‘মনে রাখিবে যে নিজে চেষ্টা করে ঈশ্বর তাহার সহায় হন’। তবে পাঠান ও মোগল সম্বন্ধে যাদের অনুসন্ধিৎসা প্রবল তাদের শ্রী বিমলাচরণ দেব সেই কবেই জানিয়ে রেখেছেন, ‘হুজ্জুত-এ-বাঙ্গালা, হিকমৎ-এ-চীন’ এর অর্থ- … ‘যদি হাঙ্গাম হুজ্জুতের কথা বল, তাহা হইলে বাংলাকে হারানো শক্ত, যদি শিল্পীর শিল্পচাতুর্যের কথা বল, তাহা হইলে চীনে কারিগরকে হারানো শক্ত’। আজ যে রাজ্য বনাম কেন্দ্রের লড়াই আমরা স্বচক্ষে দেখি তা সি.পি.এম. শুরু করেছে বলে অনেকেই মান্য করে। বাংলার রাজারা বরাবরই ডাকাবুকো টাইপের ছিল। মোগল-পাঠানদের হুকুমদারি মানত না। ‘একটা হাঙ্গাম ভালো করিয়া থামিতে না থামিতে আবার একটা হাঙ্গাম আরম্ভ হইত,’ বাংলার এ এক মহান ঐতিহ্য। ১৯৯৯-এর শেষ দিকটায় সেই একই কেলো। ম্যালিগন্যান্ট ম্যালেরিয়া ও চলচ্চিত্র উৎসবের রণবাদ্য শেষ হতে না হতে বাস চাপা ও বাস জ্বালানোর দামামা বেজে উঠল। ফাঁকফোকরে কিছু কিডন্যাপ, কবিতা উৎসব, মার্ডার আর তহবিল তছরুপের টুকটাক প্রোগ্রাম। এইসব থিতোতে না থিতোতে বিশ্ব বঙ্গ সম্মেলনের বিউগল ও ব্যাগপাইপ। বাজারে কানাঘুষো নতুন ইংরেজি বছর অবিরাম কেক-ভক্ষণ প্রতিযোগিতা দিয়ে শুরু হলেও আচমকা নাকি অন্যদিকে মোড় নেবে। তাই বুঝি কেমন একটা গা-ছমছমে, কী হয়- কী হয় ভাব। এই স্টেজে খোঁচাখুঁচি না করাই বুদ্ধির কাজ।

বড়িলাল বরাবরই ছোট সাইজের কিন্তু তাকে ঠিক বেঁটে মানুষ বলা যাবে না। হালদারপাড়ায় তার ছোট একটা দোকান আছে যেখানে রঙিন চক, নানা রঙের মার্বেল কাগজ, রাংতা, উপহারের প্যাকেট বাঁধার জরিদার ফিতে, পেন্সিল, নানা আকৃতির গন্ধওয়ালা ইরেজার, স্কেল, খুবই হালকা ও নানা রঙের প্লাস্টিকের বল, প্লাস্টিকের শাটল কক, কাগজের বাক্সে জালি বার্বি পুতুল, খোঁচা-ওঠা টিনের এরোপ্লেন, সেলফোন-সদৃশ পেন্সিল বাক্স, ক্রিকেট প্লেয়ারদের স্টিকার, মিনি ক্রিকেট ব্যাট, লুডো, প্লাস্টিকের ডাইনোসর সেট ‘জুরাসিক পার্ক’, সাবমেশিন গান, পিস্তল, পিচকিরি, একই বাক্সে রান্নাবাড়ি সেট, ঐ ডাক্তারি, টিকটিকি, তেঁতুল বিছে- এইসব ও আরো কত কী পাওয়া যায়। পুরো ঝাড় না হলেও দোকান খুব ভালো চলে না। বড়িলাল যা হয় তাতেই খুশি থাকে। ‘বর্তমান’ কেনে ও আদ্যোপান্ত পড়ে। বড়িলাল জানে যে লজেন্স, বাদাম-বিস্কুট, টফি, চকোলেট রাখলে বিক্রি বাড়বে। এ-বুদ্ধিটা অনেকেই তাকে দিয়েছে।

– রক্ষে করো বাবা! তারপর যকোন পিমড়ে-আঁশোলায় ছেঁকে ধরবে তকোন! এমনিতে তো গ্যাদাখানেক টিকটিকি চারদিকে হেগে ছয়লাপ করচে।

– তা সবাই যা করে তেমন মুখ বন্ধ বয়ামে রাখবে। মালকে মালও থাকল পোকামাকড়ও ঢুকলো না।

– ও তুমি চেনো না। ঠিক ফিকির করবে। শালারা খুব হারামি। আমার খুব ভালো আইডিয়া আছে।

– তোমার যত ফালতু ভয়! লোকে যেন করচে না।

– করবে না কেন? করচে। তেমন মরচে। ডাঁস, আঁশোলা, তারপর তোমার গিয়ে মাকড়সা, উইপোকা। এদের চেনো না। কেউ আড়ালে-আবডালে বই, কাপড় সব খাচ্ছে, টুঁ শব্দটা হচ্ছে না। কেউ-বা আবার চেটে দিল তো হয় ঘা নয় চুল উঠবে না।

মোটের ওপর বড়িলাল যে থিওরিতে দোকান চালায় তাকে স্মল ইজ বিউটিফুল হয়তো বা বলাই যায়। বড়িলাল বিয়ে করেনি। চেতলায় বাপের ভাগের একঘরে থাকে। হোটেলে খায়। কোনো ঝক্কি নেই। তবে ঘরে বজরংবলি হনুমানের ফটো আছে। সেখানে নকুলদানা, জল দেয়। ছোটবেলায় থানায় কনস্টেবলদের কুস্তি দেখে ঠিক করেছিল, কুস্তিগির হবে। তারকদার আখড়াতেও গিয়েছিল কয়েকদিন। আখড়ার দেওয়ালে গোবর গুহ, বড় গামা, ছোট গামা, জিবিস্কো ও স্যান্ডোর ছবি ছিল। দড়িতে সার দিয়ে মরা বাদুড়ের মতো ল্যাঙট ঝুলছে। হুপ-হাপ শব্দ। তারকদার রোগা প্যাঁটকা এক চেলার মিডিয়াম একটা রদ্দা খেয়ে বড়িলালের ঘাড় বেঁকে গিয়েছিল। কুস্তিগির না হয়ে শেষে দোকানদার। তবে হনুমানজীকে ছাড়েনি। তার অন্য কারণও আছে। হনুমানজী বাদে অন্য কোনো ঠাকুরের ভূত তাড়াবার ক্ষমতা নেই। বরং ভূতেরা এমনই খচ্চর যে যার যে ঠাকুর হয়তো সেই চেহারা নিয়েই হাজির হল। তুমি তো আহ্লাদের কাঁকুইদানা হয়ে ভাবছ যে, এমন ডাকা ডেকেছি যে ইষ্টদেবতা বাধ্য হয়েছেন দর্শন দিতে। ভূতেরা এইসব রগড় করে। উল্টোপড়িয়ে সব লন্ডভন্ড করে পালায়। তাছাড়া কিছু ঢ্যামনা লোকও আছে যারা ভূত পোষে। যার ওপর রাগ তাকে ভূত দিয়ে সাইজ করায়। অবশ্য এসবই বড়িলালের শোনা কথা। শোনা কথা যে সহসা সত্যি হয়ে যেতে পারে সেটা বড়িলাল জানত না। আমরাও। অজানাকে জেনে জেনেই আমাদের এগোতে হবে। পাঠক্ষেত্রটিও আখড়াবিশেষ। সেখানে নিয়তই পাছড়াপাছড়ি চলেছে। গাপ হয়ে রয়েছে বলে সবসময় বোধগম্য হয় না। যাই হোক, পোকামাকড় ও ভূত সম্বন্ধে সদাসতর্ক বড়িলালের মধ্যে কিন্তু কোনো মজ্জাগত গর্ভচেটবৃত্তি ছিল না। এই প্রথমে নির্বাক ও পরে সবাক শতকের হাফটাইমের বেশ কিছু আগে জন্মালেও বড়িলাল চাকর, খানসামা বা খিদমদগারের মনোভাব নিয়ে কোথা মনিব, কোথা মনিব বলে কেঁদে বেড়াত না। বরং হয়তো বড় পালোয়ান হয়ে একমনি লোহার মাদুলি পরে গঙ্গাতীরে প্রাতঃভ্রমণ করত বা পাড়ার গবা-ঘন্টে-পল্ট নদের একজোট করে শক্তিমন্ত্রে দীক্ষিত করত। জন্মের টাইমের হেরফেরে নানা হেরাফেরি হয়। এই কথা যে কত অকাট্য সত্য তা পরে জানা যাবে।

২৪ অক্টোবর, রবিবার, ১৯৯৯ সকালে বড়িলাল দেখল তার সামনে তিনটি সম্ভাবনা। সে সিনেমা দেখতে যেতে পারে। বেলঘরিয়াতে তার একমাত্র বোন করবী-র শ্বশুরবাড়িতে যেতে পারে। অথবা কিছুটা আত্মনির্ভর হওয়ার জন্য ক্যাওড়াতলায় গিয়ে মানবাকৃতির জারিজুরি ফাঁক স্টাডি করতে পারে। কোনো গোপন কারণে বড়িলাল দেখল, ক্যাওড়াতলাই তাকে টানছে। বড়িলাল সেই টানে বডি ছেড়ে দিল।

ক্যাওড়াতলা শ্মশানে কোনো গাইডেড ট্যুরের ব্যবস্থা নেই। ‘এবারে পুজোয় ক্যাওড়াতলায় চলুন’ বা ‘চলুন, সবান্ধবে ক্যাওড়াতলা ঘুরে আসি’ বলে কোনো ট্রাভেল এজেন্সি বিজ্ঞাপনও দেয় বলে জানা নেই। কিন্তু বড়িলাল দেখেছে যে, অদৃশ্য কোনো গাইড জীবন্ত দর্শকদের প্রথমেই অবধারিত ভাবে শ্মশানের সেই অংশে নিয়ে যায় যেখানে বিদ্যুৎচুল্লি বডির সাইজ ও ওজন অনুযায়ী হাঁ ও কপাৎ, হাঁ ও কপাৎ করে চলেছে। অবশ্য বিগড়ে না গেলে। এবং কখনোই সব চুল্লি একসঙ্গে চালু এরকম অলৌকিক দৃশ্য কেউ দেখেনি। অন্যদিকে মড়ার কোনো কমতি নেই। এক এক সময় এমন লাইন পড়ে যায় যে, ক্যাওড়াতলায় হাউসফুল দেখে মড়ারা শিরিটি বা গড়িয়ায় বোড়ালে গিয়ে অবয়বমুক্ত হয়। দর্শকরা বিদ্যুৎচুল্লি দেখেই শ্মশান দেখার তৃপ্তি ও মানব-জীবনের অকিঞ্চিৎকর তাৎপর্য সম্বন্ধে অবহিত হয়ে দৃপ্ত পদক্ষেপে খাবারদাবারের দোকানের দিকে এগিয়ে যায়। অথচ আগে লোকে মরলে কাঠেই পুড়ত। বিদ্যুৎচুল্লি তো সেদিনের ব্যাপার। এখন অবশ্য মাইক্রোওয়েভ ওভেন নামে ঐ চুল্লিরই একটি মিনি সংস্করণ সম্পন্ন গৃহে গৃহে জায়গা করে নিয়েছে। অবশ্য এই চুল্লি ছাইভস্ম তৈরি করে না, রোস্ট, তন্দুর, গ্রিল, বেক ইত্যাদি করে। এবং সচরাচর মানুষকে নয়। বড়িলাল কখনোই ঐ অদৃশ্য গাইডের ইঙ্গিতে সম্মোহিত হয়ে পড়ে না। সে চেতলা ব্রিজ দিয়ে নেমে রাস্তা পার হয় এবং উল্টোদিকের পানের দোকান থেকে বিড়ি কিনে দড়ি থেকে ধরায় ও ফের রাস্তা পেরিয়ে কাঠের চুল্লির অঙ্গনের দিকে অগ্রসর হয়।

আজ সে অঙ্গনে নজর করে দেখল, ভোররাতে কেউ কাঠে পুড়িয়েছে কারণ ব্যাপক ভস্মের মধ্যে কয়েকটি পোড়া কাঠ থেকে ধোঁয়া বেরিয়ে সেই প্রসিদ্ধ ভারতীয় দড়ির খেলা দেখাচ্ছে এবং পাশেই এত পুরনো, কালো ও অংশত ভেজা একটি ফাটা তোষক পড়ে যে কেউ আর নিয়ে ঝামেলা বাড়ায়নি। সাইড দিয়ে অঙ্গনটি অতিক্রম করে বড়িলাল শ্মশানপ্রান্তের গেট দিয়ে ঢুকে ঘাটের আগেই বাঁদিকে ঢুকল। ইতস্তত জল জমে আছে। গুমোট গন্ধ। দুটি কুকুর আপসে কামড়াকামড়ি করছে। ডানদিকে তাকাতেই,

স্মরণীয়

স্যার আশুতোষ মুখোপাধ্যায়

জন্ম মৃত্যু

১৭ই আষাঢ় ১০ই জ্যৈষ্ঠ

১২৭১ সন ১৩৩১ সন।

হায়, রয়াল বেঙ্গল টাইগার। হায়, কলিকাতা বিশ্ববিদ্যালয়। হায়, কলকাতা কর্পোরেশন। কী হাল সমাধিমন্দিরের। নোংরা, রংচটা, ফাটল-ধরা, পক্ষীপুরীষে চিত্রিত। ওপরে একটি ধেড়ে বটগাছ। তারই একটি ছানা তলায় গজিয়েছে এবং লোকচক্ষুর অন্তরালে বট কোম্পানির অমোঘ বিধ্বংসী শেকড় গুঁড়ি মেরে মেরে এগোচ্ছে। হায় বাংলার বাঘ যিনি সন্দেশের মাংস খেতে বড়ই ভালোবাসতেন। হালুম!

অবশ্য আশুতোষকে আর বাংলার বাঘ বলা ঠিক নয়। কারণ নিত্যযাত্রীরা অবশ্যই অবহিত যে, ল্যান্সডাউন-পদ্মপুকুর সংযোগস্থলে দুটি বাম্বুতে লাগানো বোর্ডে দীর্ঘ, দীর্ঘ দিন লেখা ছিল,

বাংলার বাঘ

সোমেন মিত্র

জিন্দাবাদ।

এখন লিখন অন্যরূপ-

সোনার বাংলার

সোনার ছেলে

সোমেন মিত্র জিন্দাবাদ।

এরই নাম ম্যাজিক। এই ছিল বাঘ। সাট করে সোনার ছেলে হয়ে গেল। আজ যিনি শার্দূল কাল তিনিই গৌরাঙ্গ। বোঝাই যায় যে, কংগ্রেসিদের মাথার জায়গায় যে লক্ষ্মীর ভাঁড় ছিল সেখানে মা ভবানী গেঁড়ে বসেছেন।

মরুক গে যাক। স্যার আশুতোষের উল্টোদিকে মুখোমুখি রাজেন্দ্রনাথ মুখোপাধ্যায়। এনার কেসও গোলমেলে। পাতাখোর ভ্যান্ডালরা বেদি ফাটিয়ে শেকল ঝেড়ে দিয়েছে। খুব যদি ভুল না হয় তা হলে এঁর সম্বন্ধেই শ্রী সুবলচন্দ্র মিত্র লিখেছিলেন, ‘শ্বেতাঙ্গ বণিক সম্প্রদায়ের মধ্যে ইঁহার ন্যায় মর্যাদা ও প্রতিপত্তি কোনো বাঙালীরই নাই।’। শ্বেতাঙ্গ তো দূরের কথা, লর্ড লেডিদের বাদ দেওয়াই ভালো, কৃষ্ণাঙ্গ নেটিভ লুম্পেনরা অবধি এখন তাঁকে পাত্তা দেয় না। এঁর মাথায় একটি ঘোড়ানিম।

বড়িলালের আরো বাঁদিকে ঘোরার পরিকল্পনা বাতিল করতে হল কারণ বমি, শ্যাওলা, গু ইত্যাদির সংগ্রহ পেরোতে হবে। উপচে পড়া ঐ সমাহারের দিক থেকেই একটা বাতাসের ঝলক আসাতে বড়িলাল ওখান থেকে কেটে পড়াই যুক্তিসঙ্গত মনে করল। বড়িলাল জানে, এখন কী করতে হবে। ডানদিকে গেট তালাবন্ধ। তারা মার মন্দিরে চাবি থাকত। ডুপ্লিকেট শ্মশানের অফিসে। কিন্তু ক্যাওড়াদের ভয়ে এখানে আর চাবিই রাখা হয় না। অতএব ঘাটের পাশ দিয়ে ওপরে উঠে বড়িলালকে ব্যাঁকাত্যাড়া রেলিং টপকাতে হবে। পথের দাবি মেটানো বড়ই দুরূহ।

ঘাটের দুধারে বসার রোয়াক। বাঁ-দিকটাতে তিনজন বসেছিল। একজন ঢ্যাঙা, একজন বেঁটে-মোটা আর তিননম্বরকে দেখলেই বোঝা যায় পাগলাখ্যাঁচা। উল্টোদিকে লুঙ্গি আর হলদে স্যান্ডো গেঞ্জি পরা একটা তাগড়াই মাল চোখ বন্ধ করে বিড়ি টানছিল। বোঝাই যায় যে, লোকটা এলিতেলি নয়। ‘আমাকে ঘাঁটিও না, আমিও ঘাঁটাব না’ ধাঁচের। বড়িলাল ডানদিকে ওপরে উঠে গেল। গঙ্গায় জল বাড়ছে। এবারে টপকাতে হবে। কুঁচকিতে খিঁচ না লেগে গেলেই হল।

এই ফাঁকে বলে নেওয়া যাক যে, বাঁ-দিকের তিনজন হল ফ্যাতাড়ু যারা গোপন একটি মন্ত্রের বলে উড়তে পারে এবং নানা ধরনের অনুষ্ঠান বা সুখের সংসারে ব্যাগড়া দিয়ে থাকে। ফ্যাতাড়ু আরো অনেক আছে। কিন্তু আপাতত এই তিনজনকে চিনলেই কাফি। ঢ্যাঙা মালটা হল মদন। ওর ফলস দাঁত পকেটে থাকে। বেঁটে-কালো-মোটাটা হল ডি. এস। ঐ নামে একটি হুইস্কি আছে – ডিরেক্টরস স্পেশাল। ওর তোবড়ানো-মচকানো ব্রিফকেসের দু-পাশে নাম ও পদবীর আদ্যাক্ষর সাঁটা আছে যদিও পড়া কঠিন। তিন নম্বর স্যাম্পেলটা হল কবি পুরন্দর ভাট। এরা মোটের ওপরে আমোদগেঁড়ে। পুরন্দর বলে উঠল,

কত না ফুলের তোড়া
কত ফটো তোলাতুলি
ভাঙিলে লাগে না জোড়া
কত বৃথা কোলাকুলি।
জয় গঙ্গা, জয় রাম
কবি পুরন্দর দ্যাখে
মড়া আসে অবিরাম।
টুটিছে কত না জোড়া
ফুটিছে কত না শাঁখা
বড়বাবু ও বেয়ারা
দেখি পাশাপাশি রাখা।
মড়া আসে অবিরাম
কবি পুরন্দর বলে
জয় গঙ্গা, জয় রাম।

এই এলিজি গোছের কবিতাটি শুনে ডি. এস ঘাবড়ে গিয়ে খিঁচিয়ে উঠল,

-একটু ঝিমুনি ধরব-ধরব করছিল! কিছুর মধ্যে কিছু নেই — মড়ার কেত্তন শুরু করল।

– তা শ্মশানে মড়ার কেত্তন হবে না তো কি বিয়ের পদ্য লেখা হবে? যেমন তুমি তেমন তোমার আক্কেল।

মদনের ঝাড় খেয়ে ডি. এস. একটু চুপসে গেল।

– না, সে কারণে বলিনি।

– তো কী কারণে বলেছ?

– পুরন্দরের কবিতায় একটা বি. জে. পি. লাইন চলে আসছে, তাই বললাম।

এতক্ষণ পুরন্দর কিছু বলেনি। সে ‘যাঃ বাঁড়া’, বলে স্বগতোক্তি করে একটা বিড়ি ধরাল। বিড়ির প্যাকেটের খচর-মচর শুনে ডি. এস. বলল,

– বেঙ্গল বিড়ি! দেখি একটা ছাড়ো তো!

উল্টোদিকে হলদে স্যান্ডো গেঞ্জি একধারে হেলে প্রবল নাদে এক বাতকর্ম করে উঠে চলে গেল।

– বুড়ীমা-র চকোলেট বোম!

মদন ফের খ্যাঁক করে উঠল,

– সবকিছু নিয়ে কিছু বলতেই হবে।

পুরন্দর এই তালে ঝাল মিটিয়ে নিল।

– মদনদা, ডি. এস.-এর কিন্তু কোনো দোষ নেই। ওরকম হবেই।

– মানে?

– হাফছুটির বারবেলায় পয়দা হলে ওরকম হয়।

বড়িলাল শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়ের সমাধি-মন্দিরের সামনে দাঁড়াল। বাঙালি জাত ও বাংলা সাহিত্যের দশা এমনই। ধুলোমাখা শরৎচন্দ্রের মাথাটির সামনে গ্রিল না থাকলে গলা কেটে উঠিয়ে নিয়ে যেত। কারো কারো যেমন নিয়ে গেছে। অবজ্ঞা, অপমান ও উপেক্ষার অন্ত নেই। ডানদিকে চোখ রেখে সবই দেখছেন। গলায় একটি শুকনো গাঁদাফুলের মালা। সেই মালা থেকে মাকড়সার জাল ছড়িয়েছে। ভেতরটা ঝুল নোংরায় ভর্তি। সৌধের সামনের দিকটা ভাঙাচোরা। ভেতরটি একটি সংগ্রহশালা বিশেষ। ভাঙা বাঁখারির টুকরো, মরা পায়রার সাদা পালক, শুকনো পাঁচটা মালা, পাতা, কাগজ, পানপরাগের প্যাকেট এবং হাজার হাজার কালো পিঁপড়ের আনাগোনা। এদিকটায় বন্ধ থাকলেও অনেকগুলো কুকুর। এদের সকলেরই নাম ‘ভেলু’ দেওয়া হল।

শরৎচন্দ্রের পাশেই শ্রীশ্রীমৎ বিশুদ্ধানন্দ পরমহংসদেব-এর শ্মশানসৌধ। মহামহোপাধ্যায় গোপীনাথ কবিরাজের গুরুদেবের ভাগ্য অপেক্ষাকৃত ভালো। গন্ধবাবার ভক্তজন আছেন কারণ গ্রিলটি রুপোলি রং করা। তারপর আবার সেই উপেক্ষিতের স্মৃতি। পরপর। হেমেন্দ্রনাথ দাশগুপ্ত। পরেরটি কার, বোঝার উপায় নেই। চারুচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়। দেশপ্রেমিক কৃষ্ণকুমার চট্টোপাধ্যায়। অজিতেশ্বর ভট্টাচার্য। সুরেন্দ্রনাথ মল্লিক। সুরবালা ঘোষ। চারদিকে ছড়িয়ে-ছিটিয়ে সোনালি জরি, গাঁজার কলকে, মিষ্টির বাক্স, ডাবের খোলা, প্লাস্টিকের জলের বোতল ও গ্লাস ও অসংখ্য নোংরা পলিব্যাগ। এবং সর্বত্রই সেই বিচিত্র গন্ধ।

বড়িলাল ঘাটে এসে দেখল, ভুঁড়ো একটা লোক নানা সাইজের বিলিতি মালের বোতলে গঙ্গাজল ডুগবুগ-ডুগবুগ করে ভরে একটা বিগশপার ব্যাগে ভরছে ও বাঁ-দিকের রোয়াক থেকে বেঁটে-মোটাটা দেদারে আওয়াজ দিচ্ছে।

– ঐ, ঐ পলকাটা বোতলটা হল স্কচ-হুইস্কির। এক বোতল কিনতে গেলে গাঁড় ফেটে যাবে। শালা, কত আর দেখব। মালের গন্ধ যায়নি, ওর মধ্যেই গঙ্গাজল ভরছে। এই, এইটা হল হারকিউলিস রামের। ডিফেন্সের ঝাড়া মাল।

মদন কিন্তু এবারে আপত্তি করেনি। বরং মুচকি-মুচকি হাসছিল।

– ওরে, তোর মনিবটা তো জব্বর মাল। কোনো পাঁইট, নিপ এসবের কারবার নেই। সব বোতল। এত জল দিয়ে কী করবি? হেভি চোদনা টাইপের লোক তো! এত বলছি, কিন্তু রা কাড়ার নাম নেই। ভালো-মন্দ কিছু একটা বল। না হয় দুটো খিস্তিই কর। তিনজনে আছি বলে ভাবছিস, ক্যালাব? শালা, বোধহয় জন্মবোবা। নয়তো হাড়হারামি।

ভুঁড়োর শেষ বোতলটি ভরা হয়ে গেল। বোতলটা বিগ শপারে ভরে সে উঠে দাঁড়াল। অতগুলো জল-ভরা বোতল কিন্তু কোনো ক্যাঁ-কোঁ নেই। যেন তাকিয়া বগলে আসরে চলেছে। লোকটা ব্যাগ হাতে ঘাট থেকে সিঁড়ি ভেঙে ওপরে উঠতেই অদ্ভুত কাণ্ডটা হল। ঠিক দড়ি-বাঁধা কুকুর যেমন হ্যাঁচকা মেরে মনিবমুখো হয় তেমনই তিনজন ঝাঁকুনি খেয়ে রোয়াক থেকে নীচে নামল। তারপর লোকটার পেছনে সুড়সুড় করে রওনা দিল। মুখে কোনো শব্দ নেই। উল্টোদিকে একটা মেয়ে এসে পড়েছিল বলে ভুঁড়ো ডানদিকে হেলল। ঐ তিনটেও ডাঁয়া ভাঁজ মারল। বড়িলাল ওদের ফলো করতে শুরু করল। মড়া নিয়ে একটা কাচের গাড়ি এল। পেছনে দুটো টেম্পো-ভরা লোক। নলেন নমস্কার করল। ওরাও নমস্কার করল। নলেন বাঁদিকের দাবনা চুলকোতে চুলকোতে রাস্তা পেরোল। মদন, ডি. এস. ও পুরন্দর ভাটও নিজের নিজের বাঁদিকের দাবনা চুলকোতে চুলকোতে রাস্তা পার হল। তারপর এ-গলি, সে-গলি পেরিয়ে একটা বড় উঠোনের মতো জায়গা ফেলে, নর্দমা টপকে, হরিণঘাটার দুধ দেওয়ার ভাঙা খাঁচা বাঁ-দিকে রেখে ফের একটা গলিতে ঢুকে যে বাড়িটার দিকে নলেন চলল সেটা যে ভদির একতলা ন্যাড়াছাদ-ওলা বাড়ি তা আমরা জানি। বাড়ির ওপরে একটি লজঝড়ে অস্পষ্ট সাইনবোর্ড কেতরে ঝুলছে। একটু ঘাড় কেলিয়ে পড়তে হয়। বড়িলাল দেখল, লেখা আছে এবড়ো-খেবড়ো অক্ষরে, ‘বিবিধ অশুভ অনুষ্ঠানে ঘর ভাড়া দেওয়া হয়’।

‘ঐ বুঝি করে হাঁ নাহি যার নাম’।

সকল অধ্যায়

নোট নিতে এবং টেক্সট হাইলাইট করতে লগইন করুন

লগইন