কাঙাল মালসাট – ১২

নবারুণ ভট্টাচার্য

বিগত ‘এগারো’ নম্বর ঝটকাটিতে একটি ব্যাপার কোনো টাইপের নজর, তা সে শকুনেরই হোক বা পাতাখোরেরই হোক, এড়াতে পারে না। সেটা হল কড়াপড়া মোলায়েম ধাঁচে চোক্তার — ফ্যাতাড়ুস্ট্র্যাটেজিক অ্যালায়েন্স-এর যুদ্ধ ঘোষণা। জুতোর মধ্যে পেরেক ওঠার মতোই নিরীহ কিন্তু যথেষ্ট ঝামেলাদার। সরখেলের ফতোয়া সম্বন্ধে লালবাজারের গোয়েন্দা বিভাগের ওপরমহল যতই অবজ্ঞাসূচক মন্তব্য (পাগলাচোদা) করুক না কেন ব্যাপারটি নিরীহ ছিল না। বরং এরকম একটি আগাম হুঁশিয়ারি যে ছাড়া হবে তা নিয়ে কোর কমিটির যে মিটিং হয় সেখানে বৃদ্ধ দণ্ডবায়স, ভদি, বেচামণি, সরখেল, নলেন ও মদন ছিল। এবং দরজায় আড়ি পেতে পুরো মিটিং-এর চাপান-উতোর সবই ‘সাধু! সাধু’ মুখ করে শুনেছিল এবং ব্রেনে টেপ করে নিয়েছিল মহান সাক্ষী বড়িলাল। দীর্ঘকালব্যাপী সেই আলোচনায় ‘ইনসারেকশন’, ‘নামিয়ে দাও’, ‘পার্লামেন্টারি পোঁদ মারামারি’, ‘চট্টলার অস্ত্রাগার লুঠ’, ‘টেগরা’, ‘টুপামারো’, ‘১৯৬৯ তে কারলোস মারিঘেল্লার মৃত্য’, ‘কলম্বিয়াতে এফ. এ. আর. সি-র গেরিলা নীতি’, ‘আশু মজুমদার’, ‘রেজি দ্রেব্রে-র ফোকো ইনজারেসিওনাল বা অভ্যুত্থানের গলনচুল্লি’, ‘সুশীল ধাড়ার মৌন মিছিল’ — ইত্যাদি নানা চিত্তাকর্ষক শব্দবন্ধ ও বিষয় উঠেছিল। মিটিংটি যেহেতু গোপন তাই এর বেশি জানানো এখন সঙ্গত কারণেই ঠিক হবে না। বরং ‘জানি কিন্তু বলব না’ গোছের একটা ভাব দেখাতে হবে। এর সুবিধে ডবল। আগামঘোষিত সেই ক্যাচালে ‘কাঙাল মালসাট’ বড়িলালের কুস্তির ল্যাঙট ধার করে আঁট করে পরে নেমেও পড়তে পারে আবার বেগড়বাঁই দেখলে ‘আমি বনফুল গো …’ গাইতে গাইতে সাইডিং-এও ভিড়ে পড়তে পারে। সর্বত্রগামী না হলেও চলবে। তবে বিচিত্র পথে যাওয়ার সম্ভাবনা খুলে রাখতে হবে। এই প্রসঙ্গে বাঙালি বুদ্ধিজীবী ও লেখক-শিল্পীদের ঢ্যামনামি নেড়েচেড়ে দেখা যেতে পারে। সাঁতরাগাছির প্রসিদ্ধ ওল-অরণ্যে ‘ওলে! ওলে!’ শোনা যায় না। দমদমার নলবনে দুষ্টু শিশুদের মতো ডাক্তার-ডাক্তার খেলাতেও তারা প্রশিক্ষিত হতে চায় না। সব ব্যাটার ধান্দা হচ্ছে সেই শান্তিনিকেতনে একটি কম্পাউন্ড-ওলা বাড়ি বানানো এবং সেই বাড়ির ভেতরের বারান্দায় গুজরাটি দোলনা লাগিয়ে ফিসচুলা, ভগন্দর, নালি ঘা ও পদ্ম-কাঁটা শোভিত বহু-মারানো নিতম্বগুলিকে দোলানো। উইকেন্ড হলেই অল বোকাচোদাস বোলপুর চলল। এছাড়া পৌষ মেলা, দেদোল দোল, দাড়িপুজো, ভাঙা গানের তালে ফুটো খোল প্যাঁদানো — রবীন্দ্রনাথ কি জানতেন যে জ্যোৎস্না রাত হওয়ার জো নেই, আগেভাগেই ঢ্যামনার পাল গিয়ে ফরেস্ট পলিউট করবে! এ ব্যাপারে কিছুই কি করণীয় নেই? আছে। সেটা হল এখনও, দেদারে ঝাড় খাওয়ার পরেও, যে সাঁওতালরা আছে তাদের ক্ষেপিয়ে তোলা এবং বডি-ল্যাঙ্গুয়েজের ইঙ্গিতে সব সংগীত থামিয়ে দিয়ে বস্তা খুলে পাগলা বেড়াল ছেড়ে দেওয়া।। জাহাজী ইঁদুর হলেও চলবে। সাধু অভিপ্রায় নিয়ে যা শুরু হয়েছিল তা এখন খজড়ামির অভ্যাসে পরিণত হয়েছে। অতএব, যে ব্যামোর যা দাওয়াই। হাইলি কনজারভেটিভ বংদের একটি বৃহৎ অংশ এতে ‘কাঙাল মালসাট’-এর ওপরে খচবে। ‘কাঙাল মালসাট’ যাতে সদাশয় ছত্রাকের মতো পাঠক মনকে বিষমুক্ত করতে না পারে তার জন্য এজেন্ট-অরেঞ্জ ছড়ানো হবে। কিন্তু ডার্লিং, বালের থ্রেট নিয়ে চাকতির ঠেকদারেরা মাথা ঘামায় না। তাই এবার হতে আক্ষরিক অর্থেই মুণ্ডুপাত। মিখাইল বাখতিন (১৮৯৫-১৯৭৫) যুগ যুগ জিও। জালি রাজার মুকুটহরণ (আনক্রাউনিং) হচ্ছে সকল কার্নিভাল ও কার্নিভালের সমগোত্রীয় উৎসবের মূল উল্লাস।

পতনের গতি কারও দ্রুত অতি, কারও কিঞ্চিৎ ঢিমা

সীমা শেষে গিয়া সব হবে ‘হিরোশিমা’।

পরিণামে এক শ্মশানে সবারি ঘর

সাথে রবে শুধু তুমি শ্মশানেশ্বর,

লয়ের আঁধার হতে ফুটাইবে সৃষ্টির অরুণিমা।

জয়, শ্মশানের জয়। জয়, জয়, চাকতির জয়। জয় চোক্তার ফ্যাতাড়ুর জয়। জয়, কুমুদরঞ্জন মল্লিকের জয়।

এবারে একটি মিহি ইন্টেলেকচুয়াল সমস্যা টুক করে ছুঁয়ে নেওয়া যায়। প্রেতাত্মা, স্পিরিট (মেথিলেটেড নহে) বা গোভূত – কাদের চুতিয়াপনা এর পেছনে আছে আমরা সহমত নহি — ‘কাঙাল মালসাট’ ক্রমেই কিন্তু জাগতিক সময়, ভর, মাইধ্যাকর্ষণ, চুদিট্রন -এসবের আওতায় আর থাকতে চাইছে না। ওয়ের্নার হাইজেনবার্গ নামধারী এক ঘ্যাম জার্মান পদার্থবিদের আত্মজীবনীর মলাট-নাম হল ‘ফিজিক্স অ্যান্ড বিয়ন্ড’। ভূতিয়া ললাট-লিখনের ফলে ‘কাঙাল মালসাট’-এ ‘বিয়ন্ড’ এর টান ধরেছে। সে আর ফিজিক্স এর আওতায় থাকিতে চাহিতেছেনা। লেখা বা ছাপা অক্ষরে যেন সে অধরা হইয়া পড়িতে চাহে। ছিল বাড়ির বউ, হয়ে যেতে পারে খানকি। অতএব চরিত্রবান পাঠকেরা সাবধান। রেট-ফেট জেনে ওসব পাড়ায় যেতে হয়। ধারা থেকে মান্ডু-গান্ডুদের তীর্থযাত্রা চলুক। আমাদের পথ ও গন্তব্য অন্য।

ভারতের মোক্ষপ্রাপ্তির ইতিহাসে লাল-বাল-পালের যে গৌরবোজ্জ্বল ও ইতিবাচক অনুঘটকের ভূমিকা তেমনই ভূমিকা হল কলকাতার ক্ষেত্রে নগরপালদের। অর্থাৎ পুলিশ কমিশনার সাহেবদের। আগে তাঁহারা পকেটমার প্যাঁদাইতেন, রহস্যময় বেলুনে আরাকান হইতে অহিফেন প্রেরণের চক্রান্ত ভন্ডুল করিতেন, তালতলা ও অন্যান্য থানায় কমিউনিস্টদের ওপর হিংস্র কনস্টেবল-লেঠেল ছাড়িয়া মজা দেখিতেন (রণদিভে পর্বে), পরে নকশালপন্থীদের ওপরে টর্চার করিবার জন্য ইজ্রায়েলী, দক্ষিণ আফ্রিকান ও সি.আই.এ-র গোপন টর্চার ম্যানুয়াল অধ্যয়ন করিতেন এবং সেই শিক্ষা কাজে লাগাইবার নির্দেশ দিতেন-আজকাল এসবের ফাঁকে ফাঁকে তাঁহারা নৃত্যনাট্য, হাফ-ন্যাংটো কেলো বা জীবনমুখো গান, কবি-সম্মেলন কিংবা যৌন-কর্মীদের শুয়ে আঁকো প্রতিযোগিতা -এসবও করেন। কেউ কেউ আরো কয়েক ধাপ অগ্রসর হইয়াছেন। সেসব ঘেঁটে পেটিকেসে ফেঁসে না যাওয়াই ভালো। পাঠকরাও নগরপালদের কর্মকুশলতা সম্বন্ধে সন্দিহান হয়ে পড়তে পারে। মালদার কেউ নিজেকে স্ব-নিযুক্ত নগরপাল বলে ভাবতেও শুরু করতে পারে। ডাক-বিভাগের পাশে যেমন কুরিয়ার সার্ভিস। আগে টেররিস্টদের বা বে-আইনি বিপ্লবী রাজনীতিতে কুরিয়ার হইত, আজকাল ঘরে ঘরে কুরিয়ার। তাহাদের মধ্যে আবার যাহারা হেকড়বাজ তাহারা ডাকবিভাগের ঘাড়ে হাগে।

আধপোড়া একটি মাঝারি ল্যাটামাছ। মাথা থেকে ল্যাজা সিঁদুর মাখানো। একটি আঁশবটি। ধুনুচি হতে বিদঘুটে গন্ধওলা ধোঁয়ার অন্তিম কুন্ডলি। সাতিশয় আগ্রহে অপেক্ষমান দন্ডবায়স, ভদি, সরখেল ও নলেনের আটখানি (?) চোখ। ভদির বাবাই সেই নারকীয় নিস্তব্ধতার মধ্যে অপার্থিব কন্ঠস্বরে বলে উঠল,

— খাপে খাপ, কেদারের বাপ! নাও, কাটো!

ভদি চেঁচিয়ে উঠল,

— জয়! জয় চাকতির জয়!

সমস্বরে একই রব। দরজার ফুটোয় চোখ লাগানো বড়িলাল বাদে।

বেচামণি ঘ্যাচাং করে ল্যাটামাছটির ধড় হইতে মুন্ডটি বিচ্ছিন্ন অর্থাৎ অ্যালিয়েনেটেড করিয়া ফেলিল। তখন রাত আধো আধো।

সেই আধো আধো রাতেই দোতলায় প্রশস্ত ভেরান্দায় হুইস্কির গেলাস হাতে ক্যালকাটার নগরপাল মি. জোয়ারদার ভাবছিলেন যে, ওয়েস্টবেঙ্গলে পিপলস ওয়ার ও এম. সি. সি.-র অনুপ্রবেশের সিক্রেট রির্পোটটা তিনি সি. এম-কে কি এখনই দেখাবেন না কয়েকটা দিন ঘাপটি মেরে থাকবেন। হঠাৎ তিনি দেখলেন, লাইক আ বোল্ট ফ্রম দ্য ব্লু বা কঠিন করে বললে বিনিমেঘে বজ্রপাতের মতোই (বীর্যপাত নয়) একটি ফ্লাইং সসার (দ্ব) অক্ষরের মতো অবাঙালি শব্দ করতে করতে তাঁর সাধের লনে ডাইভ মারল। লন সিকিউরিটির প্রয়োজনেই হ্যালোজেন আলোয় আলোকিত। সেই আলোয় মি. জোয়ারদার ওরফে নগরপাল দেখলেন লেটে ফোটা ডালিয়া, হলিহক, পিটুনিয়া — সব ওয়ান্ডার ফুলকেই চাকতিটি কচুকাটা করছে। পুলিশের অভিজ্ঞ ব্রেনে তখনই খেলে গেল নির্ঘাৎ এটি তাঁর একমাত্র ও স্প্যাস্টিক ছেলের জন্যে হংকং-এর মামার পাঠানো কোনো রিমোট নিয়ন্ত্রিত টয়! তাই কি? না কি ড্রোন-জাতীয় কোনো মাল! এই ধন্দ কাটার সময় হয়নি। হুস করে চাকতি লন এবং গার্ডেনের ভুষ্টিনাশ করে হেলায় দোতলার ভেরান্দায় উঠে এল এবং লেসার রশ্মি যেমন চুপিসাড়ে বড় বড় কর্ম ফতে করে তেমনই দক্ষতায় কুচ করে তাঁর মুণ্ডুটি কেটে অন্তরীক্ষে উধাও হয়ে গেল। ড. গিলোটিন (এটি সঠিক ফরাসি উচ্চারণ নয়) দেখিলে অবশ্যই কবুল করিতেন যে খুবই পাকা হাতের কাজ।

এরকম ঘটনা অর্থাৎ মুণ্ডচ্ছেদের অনুষ্ঠান যে নানাবিধ আরবদেশে ঘটে থাকে সেখানে দেখা যায় যে মুণ্ডুটি হাবাগোবার মতো পড়ে আছে। বরং ধড়টিই ছটফট করছে। অবশ্য আলাদা হবার পর মাথাটির মুখ এক আধবার হাঁ করে জিভ ভ্যাঙাতে পারে। ইউ-ছাঁট সহ উত্তমকুমার ভোরের কুয়াশাময় ময়দানে যে মুণ্ডচ্ছেদ দেখেছিলেন তার আগে অবশ্য ফায়ার করা হয়েছিল। সেই ঘটনার বহু বৎসর পরে মনোহরদাস তড়াগ হইতে একটি মুণ্ডহীন স্কেলিটনও পাওয়া যায়। এফ. এম. রেডিওতে তখন রাত দশটায় শুরু হচ্ছিল ‘আজ রাতে’। আজকের বিষয় ‘সমকাম’। প্রথমেই একটি গান — ‘এই কূলে আমি আর ঐ কূলে তুমি …’

স্তম্ভিত হয়ে নগরপাল দেখলেন যে মুণ্ডচ্ছেদের পরেও উপরোক্ত অনুচ্ছেদে যা কিছু লেখা সেগুলো তাঁরই চিন্তা এবং তিনি নিজের দুই কান অর্থাৎ দোকান দিয়েই এফ. এম অনুষ্ঠান শুনছেন। হাতে হুইস্কির গেলাসও ধরা আছে। চুমুক দেওয়ার চেষ্টা করলেন কিন্তু গেলাসটি অবলীলায় মুণ্ডুর ফাঁকা জায়গায় ব্যালেরিনার মতো গেল ও এল। তখন গেলাসটি রেখে মি. জোয়ারদার নিজের মুণ্ডুটি কুড়িয়ে ধড়ের উপরে বসালেন এক হাতে মুণ্ডুটি ধরে রেখে বাকি হুইস্কিটুকু চোঁ করে মেরে দিলেন। নামলও। কোনো ডিফিকালটি নেই। কিন্তু হাত ছাড়তেই মুণ্ডুটি ফের পড়ে গেল। এবং কী নিষ্ঠুর কাকতাল যে ঐ মোমেন্টেই মিসেস জোয়ারদার ভেরান্দায় প্রবেশ করেছিলেন। প্রথম মুণ্ডুপাতটি তিনি মিস করেন। কিন্তু দ্বিতীয়টি নয়। বলাই বাহুল্য, তিনি এই গ্রোটেস্ক ও ম্যাকাবর দৃশ্য দেখে কেলিয়ে পড়ে গেলেন।

– ‘ললি! ললিতা। উফ ফেন্ট করে গেল। ন্যাকামির একটা লিমিট আছে। বিহেডেড হলুম আমি আর উনি হয়ে গেলেন সেন্সলেস। লুক, হানি, আই অ্যাম পারফেক্টলি নরম্যাল। শুধু হেডপিসটা মানে মাথাটা হোল্ড করতে হচ্ছে। ললি! ল … লি!’

ভলাদিমির নবোকভ-এর ‘লোলিটা’-র (১৯৫৫) প্রসঙ্গ কারও মনে পড়তে পারে। বিশেষত মধ্যবয়স্ক পুরুষ যাঁরা অজান্তেই হয়তো ‘লোলিটা সিনড্রোম’-এর শিকার। হতেই পারে বা হলেই হল। আটকাচ্ছে কে? হায় কোই রুখনেওয়ালা?

যাই হোক, হচ্ছিল ললিতা জোয়ারদারের কথা। পুলিশের বউ। এরা হল অন্য মেকদারের পয়দা। ধড়, মুণ্ডু, ডাকাতি, চপার, রামপুরিয়া, বস্তায়þ খণ্ড খণ্ড যুবতী, কিডন্যাপ, গুম শুনে এরা নিজেরাই দুঁদে মাল হয়ে উঠেছে। অচিরেই বরফজলের ছিটে ও একটি পাতিয়ালা পেগ ললিতাকে ধাতস্থ করে তুলল। অতি অল্প সময়েই তিনি দু পিস স্বামীর সম্বন্ধে নিজেকে খাপ খাইয়ে নিলেন। সম্ভবত এই কারণেই হয়তো দাঁড়কাক বলেছিল-খাপে খাপ, কেদারের বাপ।

ডিনার টাইম হয়ে গেছে। নিচে বার্বুচি গং বাজাল। প্রথমে নামলেন মিসেস জোয়ারদার। তিনি পরে আছেন একটি ইংলিশ হাউসকোট। পায়ে জাপানি ঘাসের চটি। পেছনে সিল্কের ওপরে বুটিকের কাজ করা লুঙ্গি ও ফিনফিনে ফতুয়া পরা নগরপাল। কিন্তু ও কী?

নগরপাল সিঁড়ি দিয়ে নামছেন — দুহাত দিয়ে দুটি কান ধরা। মনে হচ্ছে ব্যাদড়া বাচ্চাকে কান ধরিয়ে হেডমিস্ট্রেস স্কুলে দেখিয়ে বেড়াচ্ছেন। বার্বুচিরা এই দৃশ্যে খুবই ভয়চকিত হয়ে উঠল। হওয়ারই কথা। এর আগে বিবিধ কারণে অকারণে নগরপালকে তারা বউ-এর কাছে ঝাপড়া খেতে দেখেছে। কিন্তু এরকম কোনো দৃশ্য তারা দুঃস্বপ্নেও ভাবেনি। এবং এর পরে যা ঘটল তা রোমহর্ষক। নগরপাল চামচ ধরে সুপের ঝোলের দিকে ঝুঁকতেই তাঁর মাথাটি নাক বরাবর সুপের ওপরে ঝাঁপ দিল। চেয়ারে কবন্ধ। দুজন বাবুর্চি ও কুক, তখনই অজ্ঞান হয়ে পড়ল। কারপেটে ট্রে, কাটলারি, রোস্ট চিকেন ও গ্রেভি।

মিসেস জোয়ারদার খেঁকিয়ে উঠলেন।

– ‘হোয়াট স্টুপিডিটি। দুহাতে মাথা অ্যাডজাস্ট করেই তোমাকে চুমুক লাগাতে হবে। ফরগেট কবে স্পুন বা ফর্ক ব্যবহার করেছ। কান থেকে হাত ছাড়া চলবে না। কাল দেখব টুপি, দড়ি এইসব দিয়ে যদি ম্যানেজ করা যায়। নিজের ঝামেলা নিজে সামলাও। সুপটুপ ছিটকে, লোকজনকে ভয় দেখিয়ে — ডিজগাস্টিং।

– ‘সরি ললি! মাথাটা টপল করে যাবে বুঝতে পারিনি। কী যে সব হচ্ছে! প্রোভোকেশন নেই, প্রায়ার কোনো রিপোর্ট নেই — বিহেডেড হয়ে গেলুম।’

– ‘যা হয়েছে, হয়েছে। কালকের আগে যখন কিছু করা যাবে না তখন ফালতু কনজেকচার করে লাভ নেই। দু হাতে কান ধরে স্ট্রেট বসে থাকো। আমি খাইয়ে দিচ্ছি।’

– ‘দেবে! সেই ভালো। সুপটা বড় ব্ল্যান্ড করেছে আজ। একটু সস মিশিয়ে দাও তো।’

– দাঁড়াও আগে মুখটা মুছে দিই। একজনকে তো খাইয়ে নাইয়ে না দিলে হয় না। আরেকজন বাড়ল। এই মাদারিং করতে করতেই লাইফটা গেল। কোথায় নিজের দিকে একটু নজর দেব।

সস্নেহেই কথাগুলো বলছিলেন মিসেস জোয়ারদার কিন্তু নগরপাল মনে মনে বলছিলেন

– ‘ঐ তো বালের চেহারা। তার দিকে আবার নজর। ভুরু প্লাক করে ডিমের মতো মুখ। তাতে আবার কী সব মাখবে। তাইওয়ান থেকে ক্রিম আনছে! শিশির ওপরে আবার প্রজাপতি আঁকা। কী বিদঘুটে গন্ধ। বিউটি মারাচ্ছে। সেদিনই তো তাজবেঙ্গলে টাবুকে দেখলুম। কী জিনিস। কী ঠোঁট? আর একে দ্যাখো। তাকিয়া। একজ্যাক্টলি তাকিয়া। আগে তাও বয়স কম ছিল। চলত। বান্টি, মিসেস সেন, তারপর গিয়ে হোম সেক্রেটারির বউ হিমানী সোম — এখনও! এখনও! আরে বাবা যে এজে যেমন। আর ইনি, কিলো কিলো এজ-ডিফাইং ক্রিম মাখছেন। এই মাথা-কাটাই তোর জুটবে। বুঝলি? হুমদো মাগী কোথাকার!

এবারে নগরপাল বললেন, মনে মনে নয়,

– আঃ ফিস কাবাবটা ছোট ছোট পিস করে দেবে তো। আস্ত মুখে ঢুকিয়ে দিচ্ছে। গলার কানেকশনটা আনস্টেডি, বুঝতে পারছ না? আবার কী ফ্যাচাং লেগে যাবে!’

– আই অ্যাম সরি ডার্লিং।

– এই আইটেমটাতে নো ফাইভ স্টার ক্যান বিট আবদুল। রোজ খাই। কিন্তু পুরোনো হয় না।

– আমারই মতো। বলো?

– উঁ … ম।

সেই ভয়াল রাতেই মদন স্বপ্নে দেখল বাজারে তাকে মাছের মুড়ো আর ব্রয়লারের চোখ বন্ধ মুণ্ডুর ঝাঁক কামড়াবে বলে তাড়া করেছে। বোয়াল, আড়, শোল ইত্যাদি বিকট মাছের হাঁ মুখে সারি সারি দাঁত। চুনোপুঁটির মুণ্ডুও বাকি নেই। তারাও পায়ে ঠোকরাচ্ছে। ঘুম ভেঙে মদন উঠে পড়ল। অন্ধকারে হাতড়ে বোতলটা খুঁজে নিট বাংলা খানিকটা ঘ্যাঁক করে মেরে দিতে অস্বস্তিটা যেন জুড়োল। ঘটনাচক্রে সেই ভয়ালু রাতে কবি পুরন্দর ভাটও মদনের ঘরে মালফাল খেয়ে গামছা পরে তাঁবু খাটিয়ে ঘুমোচ্ছিল। নিদ্রার ঘোরেও তার কাব্য রচনায় ক্ষান্তি নেই। মদন তার মুখের কাছে কান নিয়ে গিয়ে শুনতে পেল, শ্যামাসংগীতের ঢঙেই —

মুণ্ডুমালা পরলো শ্যামা

গাত্রে না হোক পরলি জামা

ভাট কবিতায় পুজব বলে

মুণ্ডু আনি ধামা ধামা।

শ্যামা মায়ের ঠোঁটে হাসি

মুণ্ডু পরতে ভালোবাসি

পুরন্দরের মন যে বলে

পঞ্চাশৎটি বর্ণ দোলে।

মুণ্ডু দেখে যায় না বোঝা

কোনটা ডাকাত, কোনটা ওঝা

কোনটা তাপী, কোনটা পাপী

কোনটা ভাগ্নে, কোনটা মামা

মুণ্ডু আনি ধামা ধামা …

মদন কয়েকবার পুরন্দরকে থাবড়ে যখন দেখল থামবে না তখন বাধ্য হয়ে ঘুমিয়ে পড়ল।

সেই ভয়েল রাতেই পাশে শোয়া মোটা বউ ও গাঁদা বাচ্চা থাকাতেই স্বপ্নে হেলেনের নাচ দেখে ডি. এস-এর স্বপ্নদোষ হল।

বড়িলালের ঘরে রাস্তার আলো ঢোকে বলে সে চোখের ওপর ল্যাঙট চাপা দিয়ে ঘুমোচ্ছিল। তার ওসব কিছু হয়নি।

সেই অস্থির তাড়সে কেঁপে কেঁপে ওঠা রাতেই চোখে চাঁদের স্পট পড়ায় ঘুম ভেঙে মিসেস ললিতা জোয়ারদার দেখলেন বালিশের ওপরে নগরপালের মুণ্ডুর নাক ডাকছে কিন্তু ধড়টি আলাদা হয়ে উপুড় হয়ে ঘুমোচ্ছে। ধড় একবার, ঘুমন্ত অবস্থাতেই,বাতকর্মও করল। চাঁদের সামনে মেঘের মিড কার্টেন পড়তে মিসেস জোয়ারদারও পুনরায় ঘুমন্ত স্টেজে চলে গেলেন।

এরপর যা অবশ্যম্ভাবী তাই হবে। কোনো গেঁড়ে নির্ঘাৎ প্রশ্ন তুলবে যে ‘পঞ্চাশৎ’ বর্ণ বা মুণ্ডুর রহস্যটা কী? সবই কি বাংলা টেনে ঢপবাজি? এর প্রথম উত্তরটি হল মুচকি হেসে স্পিকটি নট। দ্বিতীয় উত্তরটি হল-বাবা মা যখন পয়দা করে কাঁচা ড্রেনে না ফেলে দিয়ে পয়াকড়ি খরচ করে পড়িয়েচে তখন একবারটি বাপু ২ টাকা ৫০ পয়সার মাধুকরীর বদলে ডক্টর মহানামব্রত ব্রহ্মচারীর ‘জগজ্জননী কালীমাতার তত্ব’ বইটি বগলদাবা করে পড়ে ফ্যালো দিকিনি। দুইগোটা সম্ভাব্য উত্তরের কোনটি ইস্তেমাল করা উচিত? কতিপয় গেঁড়েকে মাইনাস করিয়া বাকি পাঠকরা কী বলে?

পরদিন সকালে এগারোটা বাইশে সি. এম তাঁর পি. এ মারফৎ নগরপালকে ডেকে পাঠালেন। আই. এস. আই. কলকাতায় কী খেল খেলছে সে বিষয়ে তিনি কথা বলতে চান। এইসব এজেন্টরা যেহেতু বনবাদাড়ে ঠেক বানায় ও বীরাপ্পনের স্টাইলে অপারেট করতে পারে তাই বনমন্ত্রী বনবিহারী তা এবং গৃহমন্ত্রী ও আমাদের পূর্বপরিচিত কমরেড আচার্যকেও ডাকা হয়েছে। উর্দি চাপালেই চলবে না। মাথাটিও স্বস্থানে রাখার ব্যবস্থা করতে হবে। স্ত্রীবুদ্ধিই নগরপালকে এ যাত্রা বাঁচাল। এক মৃদু ঝাড়েই মোটরসাইকেলওলা ঢ্যাঙা সার্জেন্ট তার ‘স্টাড’ লেখা হেলমেটটি দিয়ে কেটে পড়ল। এবং সেটি পরে দেখা গেল নগরপালের মুণ্ডু যথাস্থানে থাকছে এবং তদুপরি দুটি হাতই তিনি অবলীলায় নাড়াচাড়া করতে পারছেন। অর্থাৎ মাথা কাটা অবস্থাতেও তিনি প্রতিবন্ধী নন। বেরোবার মুখে, দরজার দোরগোড়ায়, ললিতা নগরপালকে একটি পিঙ্ক রঙের গোলাপ দিলেন। এবং ছোট সাইজের একটি খাম। সিল করা।

– পিংক রোজ ইজ অলরাইট। কিন্তু এই খামে কী আছে?

মিসেস জোয়ারদার মুখ টিপে হাসেন।

– সি. এম-এর সঙ্গে মিটিং সেরে বেরিয়ে লালবাজারে যাবে তখন দেখবে। আগে নয়।

– লে হালুয়া।

সি. এম তো নগরপালকে দেখে থ!

– এ কী? তুমি আবার মোটর রেসিং ফেসিং শুরু করলে নাকি?

– না, স্যার। ঘাড়ে ব্যথা। কলার নেব। কিন্তু টাইম পাচ্ছি না। ডক্টরের সঙ্গে দুটো অ্যাপয়েন্টমেন্ট ফেল করেছি। তাই এটা দিয়েই কাজ চালাচ্ছি।

– ‘কী জানি বাপু। ঐ স্পেসটেসে যারা যায় তাদের কী যেন বলে।’

বনবিহারী তা বলে ফেলে,

– ঠিক বলেছেন সার, পাইলটের মতো।

গৃহমন্ত্রী খিঁচিয়ে ওঠে,

– যা জানো না তা নিয়ে কমেন্ট করো কেন? উনি বলছেন মি. জোয়ারদারকে কসমোনটদের মতো লাগছে।

– ওই হল। পাইলটও ওড়ে, কসমোনটও ওড়ে।

– থামবে তোমরা? ডি. জি-র সঙ্গে পরে আমি মিট করব। তোমার কাছ থেকে শুনতে চাই। বনবাদাড়ে অনেক ঘুরেছ। হোয়াট ইজ ইয়োর রিডিং।

– তাহলে সার, একটু ডিটেলেই বলি। কাঠমাণ্ডুর ওই আই. এ. সি প্লেন হাইজ্যাকিং-এর পর থেকেই লক্ষ করছি যে,

ফোন বাজে, অফ হোয়াইট ফোনটা তোলেন সি. এম।

– হুঁ? ইউনিয়ন হোম মিনিস্টার ওয়ান্টস টু স্পিক টু মি। আস্ক হিম টু রিং আফটার সামটাইম। আই অ্যাম বিজি। যত্ত সব। চলো।

নগরপাল গলা খাঁকারি দিয়ে শুরু করতে যাবেন কিন্তু বেল বাজল এবং পি. এ. টু সি. এম মি. ঘোষাল ঘরে ঢুকে পড়লেন।

– সার! সার! কাল তো মিস ক্যালকাটা কনটেস্ট ছিল।

কমরেড আচার্য গজরে ওঠেন।

– মিস ক্যালকাটা নয়, মিস কলকাতা।

– আঃ বড় ইন্টেরাপ্ট করো। বলো।

– সার, সেই কম্পিটিশনের সব বিউটিরা একবার আপনার কাছে এসেছে।

– আমার কাছে? হোয়াই? কী চায় ওরা?

– কিছু না সার। আজ বলছে মানে আপনার হল গিয়ে ভ্যালেনটাইনস ডে। ফুল দিয়ে আপনাকে গ্রিট করতে চায়।

– আসতে বলো। আফটারঅল অ্যা গ্রুপঅফ ইয়ং বিউটিজ। বিউটি ইজ ট্রুথ।

চার্পিং পাখির দলের মতোই খিলখিলিয়ে নটি বিউটিরা ঘরে ঢোকে। এর মধ্যে গোলাপের তোড়া যার হাতে সেই হল মিস ক্যালকাটা -রোজা কাপাদিয়া। ওরা সকলকেই ফুল দেয় ও মন্ত্রীদের গম্ভীর মুখগুলিতে মৃদু হাসি কুঁড়ির মতো ফুটে ওঠে।

– জোয়ারদার, তোমার হেডগিয়ারটা খুললে না? মিনিমাম এটিকেট। ঘাড়ে ব্যথা বলে …

ইয়েস সার।

জোয়ারদার পা ঠুকে দাঁড়িয়ে উঠে বাঁ হাত দিয়ে হেলমেটটি ওপরে তোলেন। ফলে মুণ্ডুসমেত হেলমেটটি ওপরে উঠে যায় ও ফুলের গোছা নেবার জন্যে কবন্ধ ডানহাতটি বাড়িয়ে দেয়। রোজা ও অন্য সুন্দরীরা গোলাপের মতোই ঝরে যায়। মানে সহসা ক্লোরোফর্ম করা হল এরকম ভাব দেখিয়ে চোখ উল্টে ধুপ ধাপ পড়তে থাকে। মি. ঘোষাল চিৎকার করে ওঠেন।

– মাথা নেই। সার, মাথা নেই। ভূত!

হেলমেটের ভেতর থেকে জোয়ারদারের মুণ্ডু বেরিয়ে পড়তে যাওয়ার মুখে ডান হাত দিয়ে জোয়ারদার তাকে ধরে ফেলে এবং চুলের মুঠি ধরে গলায় বসায়।

– ভূত-ফুত নয় সার। মাইনর একটু অ্যাডজাস্টমেন্ট হলেই কি হয়ে যাবে।

সি. এম চটে যান।

– এই অবস্থায় ডিউটি করছেন আপনি? মাথা আলাদা অবস্থায়। এ জিনিস আমি কখনোই সহ্য করব না।

জোয়ারদার হেলমেট ফেলে দেন। বাঁ হাত দিয়ে বাঁ কান ধরে মাথাটি ধরে রাখেন। ডান হাত দিয়ে স্যালুট করেন।

-হেড অর নো হেড, জোয়ারদার কখনও ডিউটিতে ফল্টার করে না।

– দ্যাটস লাইক আ ব্রেভ পুলিশম্যান, বাট …

ঘোষাল ঘর থেকে বেরিয়ে মানে পালিয়ে গিয়েছিলেন। এবার তিনি ডি. জি.-কে নিয়ে ঢোকেন।

কমরেড আচার্য বলেন,

– এসব কী হচ্ছে বলুন তো? আমি রিপোর্ট চাই।

বস্তুত ডি. জি-র দিকে না তাকিয়েই তিনি রিপোর্ট তলব করেছিলেন।

ডি. জি-ও নগরপালের মতোই হেলমেট পরা।

নগরপালের বুক পকেটে মিসেস জোয়ারদারের ভ্যালেন্টাইনস ডে-র কার্ড খামবন্দী। তাতে আঁকা ছিল একটি লাল হৃদয় এবং তলায় দুটি নীল রঙের ফিমেল ঠোট। তলায় লেখা ‘পাগলী’।

সকল অধ্যায়

নোট নিতে এবং টেক্সট হাইলাইট করতে লগইন করুন

লগইন