১.৩০ গ্রীনরুমের ডানদিকে

প্রফুল্ল রায়

গ্রীনরুমের ডানদিকে ছোটখাটো ঝোঁপের মতো। জায়গাটা বেশ নিরিবিলি। দূরে একটা হ্যাঁজাক জ্বলছে, তার আলো এখানে এসে পৌঁছয়নি। ফলে আবছা অন্ধকারে চারদিক ছেয়ে আছে।

ঝোঁপের গা ঘেঁষে হিরণ এবং সুধা দাঁড়িয়ে ছিল। বিনুরা ছুটে আসতে আসতে তাদের দেখে থমকে গেল।

হিরণ বলছিল, তখন তো খুব বলেছিলেন, আপনার নাচ দেখলে লোকে ঢিল ছুড়বে। এখন?

সুধা ঠোঁট টিপে গরবিনীর মতো হাসল। উজ্জ্বল চোখে এক পলক হিরণকে দেখে নিয়ে বলল, এখন কী?

সবাই আপনাকে খোঁজাখুঁজি করছে।

কপট ভয়ের গলায় সুধা বলল, ও মা, কেন?

একটু রহস্য করে হিরণ বলল, কেন, আপনিই ভেবে দেখুন।

আমি ভাবতে পারছি না।

তবে আমিই বলি। তারা একবার খালি আপনাকে দেখতে চায়। রাজদিয়ার লোক একেবারে পাগলা হয়ে গেছে।

নাকি?

ইয়েস।

চোখের তারা ঘুরিয়ে ঘুরিয়ে এবার বেশ কিছুক্ষণ হিরণকে দেখল সুধা। চতুর সুরে বলল, আর আপনি?

আমি? ঘন আবেগের গলায় হিরণ বলতে লাগল, আমিও ম্যাড, বুঝলেন? এমন নাচ আগে আর কখনও দেখি নি।

খুব আস্তে সুধা বলল, দেখবেন, বেশি ম্যাড ট্যাড হবেন না। তাতে বিপদ আছে।

হিরণ শুনতে পেল কিনা, কে জানে। বলল, আমার কী ইচ্ছে জানেন?

মুখ তুলে সুধা বলল কী?

বললে আপনি হাসবেন।

হাসার মতো কিছু করবেন নাকি?

আগে শুনুন না—

আচ্ছা বলুন।

হিরণ বলল, ইচ্ছে হচ্ছে আপনাকে মাথায় তুলে সারা রাজদিয়া এক পাক ঘুরে আসি।

দুই চোখ কপালে তুলে সুধা বলল, দৃশ্যটা কিন্তু এই পর্যন্ত বলে চুপ করে গেল।

দৃশ্যটা কী?

খুব মনোরম হবে না।

না হোক।

তা ছাড়া–

আবার কী?

ঘাড় বাঁকিয়ে সুধা বলল, একটু আগে যা বলছিলেন তার লক্ষণ কিন্তু দেখা দিয়েছে। খুব সাবধান।

কপাল কুঁচকে কিছুক্ষণ ভাবল হিরণ। পরে বলল, অর্থাৎ পাগলামির?

ইয়েস স্যার।

দিক দেখা– সুধার কাছে আরেকটু নিবিড় হয়ে এল হিরণ। গাঢ় গলায় ডাকল, সুধা—

একটু দূরে বিনু আর ঝুমা দাঁড়িয়ে ছিল। ঝুমা ফিসফিস করে ডকাল। এই বিনুদা—

বিনু মুখ ফেরাল।

ঝুমা বলল, ওরা কারা? সুধাদি আর হিরণদা?

অন্যমনস্কের মতো বিনু বলল, হু। কী করছে?

সুধার কাছে হিরণ যখন ঘনিষ্ঠ হয়ে এল তখন থেকেই বিনুর মনে হচ্ছে, কেন হচ্ছে কে জানে, এখানে আর দাঁড়িয়ে থাকা ঠিক নয়। সে বলল, কী করছে, কে জানে। চল–

ঝুমাকে নিয়ে ঝোঁপের ওধারে যেতেই আবার সেই দৃশ্য, অবিকল একরকম। তবে পাত্র পাত্রী আলাদা। ওখানে ছিল সুধা হিরণ। এখানে আনন্দ সুনীতি। বিনুরা আগের মতো থমকে দাঁড়িয়ে পড়ল।

চাপা আবেগপূর্ণ গলায় আনন্দ বলছিল, আপনার মতো গাইতে আর কাউকে শুনি নি। মানুষ যে এমন গাইতে পারে, আমার ধারণা ছিল না।

‘শ্যামা’ নৃত্যনাট্যে নাচের ভূমিকা ছিল না সুনীতির, নেপথ্যে বসে সে গেয়েছিল। যাই হোক, সুনীতি লজ্জা পেয়ে গেল, মনে মনে খুশিও। আনন্দকে এক পলক দেখে নিয়ে বিচিত্র লীলাভরে বলল, ছাই গাইতে জানি।

আনন্দ এবার কিছু বলল না, সুনীতির কাছে আরেকটু এগিয়ে গেল।

বিনুর পাশ থেকে ঝুমা বলল, আমার মামা আর তোমার দিদি!

বিনু ঘাড় কাত করল, হুঁ—

অন্ধকারে ওরা কী করছে?

কে জানে।

আরও কিছুক্ষণ পর সবার সঙ্গে বাড়ি ফিরছিল বিনু। আগে আগে ছিলেন হেমনাথ অবনীমোহন সুরমা আর স্নেহলতা। মাঝখানে বিনু ঝিনুক গৌরদাসী এবং উমা। একেবারে পেছনে সুধা-সুনীতি যুগলরা।

সবাই প্রায় কথা বলছে। আজকের নৃত্যনাট্যে কার ভূমিকা কিরকম হল, কে কেমন নাচল, কেমন গাইল, তারই রসালো আলোচনা চলছে। ফাঁকে ফাঁকে লঘু পরিহাস, উচ্ছ্বাসময় সকৌতুক হাসি।

নদীপাড়ের পথ দিয়ে অন্যমনস্কের মতো হাঁটছিল বিনু। বরফকল, সারি সারি মাছের আড়ত, স্টিমারঘাট, কাঁচা বাঁশের বেড়ায় ছাওয়া মিষ্টির দোকানগুলো একে একে পেরিয়ে এসে এখন তারা বাঁকের মুখে। রাস্তাটা এখান থেকেই বাঁ দিকে ঘুরেছে। পথের দু’ধারের কোনও ছবি বিনুর চোখে পড়ছিল না। হেমনাথের হাসাহাসি, ঠাট্টা-টাট্টা কিংবা কণ্ঠস্বরও সে শুনতে পাচ্ছিল না। ঘুরে ঘুরে গ্রীনরুমের নিরালা ঝোঁপের অন্ধকারে সেই নিভৃত দৃশ্য দুটি চোখে ভেসে উঠছে। বার বার বিনুর মনে হচ্ছিল, সুধা সুনীতির কাছে হিরণ আর আনন্দ যেন দু’টো মুগ্ধ, লোভী পতঙ্গ।

সুধা সুনীতি মোটামুটি ভালই নাচে, ভালই গায়। কিন্তু তারা যে এমনই নিপুণা কলাবতী, সে কথা আনন্দ আর হিরণ গদগদ আবেগের গলায় না বললে কোনও দিনই জানতে পারত না বিনু।

নদীর বাঁক পেছনে ফেলে আরও অনেক দূর চলে এসেছে বিনুরা। সামনেই সেই কাঠের পুলটা। দু’ধারে গাছপালা-বনানীর ভেতর থোকা থোকা অন্ধকার জমে আছে, আর আছে জোনাকিরা। সপ্তমীর রাত্রিটাকে বিধে বিধে আলোর পোকাগুলো একবার জ্বলছে, একবার নিবছে। জ্বলা আর নেবার এই খেলা চলছে সেই সন্ধে থেকে। যতক্ষণ অন্ধকার আছে, এই খেলাও আছে।

হঠাৎ চাপা গলায় ঝিনুক ডেকে উঠল, বিনুদা—

সুধা-সুনীতি হিরণ-আনন্দর কথা ভাবতে ভাবতে সব ভুলে গিয়েছিল বিনু। চমকে ঝোঁপঝাড় জোনাকির দিক থেকে চোখ ফিরিয়ে তাকাল। বলল, ডাকছ কেন?

আগের গলায় ঝিনুক বলল, তোমার ওপর আমি রাগ করেছি।

কেন।

তখন তোমায় অত করে ডাকলাম, তুমি শুনতেই পেলে না।

কখন আবার ডাকলে! বিনু সত্যি সত্যিই অবাক। দু’চোখে বিস্ময় ফুটিয়ে অন্ধকারে সে তাকিয়ে থাকল।

ওই যখন নাচ-গান হচ্ছিল—

তাই নাকি!

হুঁ– ঝিনুক ঘাড় কাত করল, আমি তোমার জন্যে জায়গা রেখে কত ডাকাডাকি করলাম আর তুমি কিনা ঝুমার কাছে গিয়ে বসলে?

বিনু অবাক হয়েই ছিল। তার বিস্ময় আরও বাড়ল, আমার জন্যে কোথায় জায়গা রেখেছিলে?

চেয়ারে।

সত্যি তোমাকে আমি দেখতে পাইনি, তোমার ডাকও শুনতে পাইনি।

হিংসের গলায় ঝিনুক বলল, ঝুমাকে কিন্তু ঠিক দেখতে পেয়েছিলে, কুমার ডাক ঠিক শুনতে পেয়েছিলে।

বিনু আর কিছু বলল না। দেখতে পেল, অন্ধকারে জাপানি পুতুলের মতো মেয়েটার চোখ জ্বলজ্বল করছে।

.

পরের দিন অর্থাৎ অষ্টমীর রাত্তিরে ‘বিজয়া’ নাটক।

আজ আসর আরও জমজমাট। সন্ধের আগে থেকেই পুজোমন্ডপের স্টেজটাকে ঘিরে যেন মেলা বসে গেছে। দূরদূরান্ত থেকে কোথায় বেতকা, কোথায় পাইকপাড়া, কোথায় কাজির পাগলা আর কোথায় মীরকাদিম-নৌকোয় করে দলে দলে লোক আসছে তো আসছেই। তা ছাড়া, রাজদিয়ার মানুষ তো আছেই। আজ আর এ শহরে কেউ বুঝি বাড়ি বসে নেই। পুজোমন্ডপের স্টেজটা হাতছানি দিয়ে তাদের ঘরের বার করে এনেছে।

শিশির-স্মৃতিরেখা-আনন্দরা তো এসেছেই, আজ রামকেশবকেও দেখা গেল। অধর সাহা, ভবতোষকে না এসেছেন। এমনকি লারমোরও বাদ নেই। কাল অবশ্য তাকে দেখা যায়নি।

কালকের মতো রাত করে হেমনাথরা আজ আসেননি, বেলা থাকতে থাকতেই এসে পড়েছেন। স্টেজের কাছাকাছি আসতেই লারমোরের সঙ্গে দেখা।

সবার আগে ছিলেন অবনীমোহন, একেবারে তোপের মুখে পড়ে গেলেন। লারমোর বললেন, এই যে অবনী, এর মানেটা কী?

অবনীমোহন হকচকিয়ে গেলেন, আজ্ঞে—

হেমনাথ ব্যাপারটা বুঝতে পেরেছিলেন, ঠোঁট টিপে হাসতে লাগলেন।

লারমোর বললেন, সপ্তমীর দিন আমার ওখানে তোমাদের যাবার কথা ছিল না?

অবনীমোহন অপ্রস্তুত। বিব্রত, লজ্জিত মুখে বললেন, একেবারে ভুলে গিয়েছিলাম। কেউ আমায় মনেও করিয়ে দেয়নি। আপনি আমায় ক্ষমা করুন লালমোহন মামা।

ক্ষুব্ধ গলায় লারমোর বললেন, সপ্তমীর দিন সকাল থেকে পথের দিকে চেয়ে আছি, এই আসো এই আসো। শেষ পর্যন্ত এলে আর না। ওদিকে কত মাছটাছ যোগাড় করেছিলাম–

এতক্ষণে হেমনাথ কথা বললেন, সত্যি খুব অন্যায় হয়ে গেছে। আজ তো অষ্টমী। দশমীর পরদিন অবনীরা তোমার ওখানে যাবে, আমি ওদের সঙ্গে করে নিয়ে যাব।

ঠিক তত? আবার ভুলে যাবে না?

না না, তুমি নিশ্চিন্ত থাকো।

কালকের মতো হিরণরা স্টেজের সামনে দাঁড়িয়ে অপেক্ষা করছিল না। গ্রীনরুমে ছিল। হেমনাথদের আসার খবর পেয়ে ছুটতে ছুটতে বেরিয়ে এল। সুধা সুনীতি-অবনীমোহন বাদে সবাইকে দর্শকদের চেয়ারে বসিয়ে বলল, আপনারা বসুন, আমি আমার আর্টিস্টদের নিয়ে যাচ্ছি?

স্নেহলতা বললেন, আজ তোদের প্লে কখন শুরু হচ্ছে?

তাড়াতাড়িই। সাতটার ভেতর।

শেষ ক’টায়?

সাড়ে-দশটা এগারটা হবে।

সে তো মাঝ রাত।

হিরণ হাসল, অত বড় বই, তার আগে কী করে শেষ করব! বলে আর দাঁড়াল না। সুধা সুনীতিদের নিয়ে সাজঘরের দিকে চলে গেল। হেমনাথরা বসে বসে গল্প করতে লাগলেন।

হোমনাথ শুধোলন কাল নৃত্যনাট্য দেখতে এসেছিলে লালমোহন?

লারমোর বললেন, না।

জিনিসটা চমৎকার হয়েছিল।

শুনলাম। সুধাদিদি নাকি চমৎকার নেচেছে?

হ্যাঁ। সুনীতি আর রুমা খুব ভাল গেয়েছে।

তাও শুনেছি। শুনে আর লোভ সামলাতে পারি নি, আজ ছুটে এসেছি।

ওধারে রামকেশব বসে ছিলেন। বললেন, কাল আমিও আসি নি। আজ আর ঘরে বসে থাকতে পারলাম না।

স্নেহলতা বললেন, ছেলেমেয়েগুলো যা কান্ড করছে! এমন আনন্দের ব্যাপার রাজদিয়াতে আর কখনও হয় নি। আমার মাথায় যে অত বড় সংসার, আমিও কি বাড়ি বসে থাকতে পেরেছি? দুদিন ধরে নাচতে নাচতে চলে আসছি।

এদিকে আরও একটা মজার খেলা চলছিল। আজ আর সাজঘর কি স্টেজের কাছে ঘোরাঘুরি করতে পারে নি বিনু। প্রথম থেকেই ঝিনুক নিজের কাছে তাকে বসিয়ে রেখেছে। একটু দূরে স্টেজের ঠিক তলায় কালকের মতো বসে ছিল ঝুমা। সমানে বিনুকে ডাকাডাকি করছে সে আর হাতছানি দিচ্ছে, বিনুদা, বিনুদা–এখানে এস। তোমার জন্যে জায়গা রেখেছি।

স্টেজের খুব কাছে বসে নাটক দেখতে ভারি লোভ হচ্ছিল বিনুর। সে উঠতে যাচ্ছিল, চাপা গলায় ঝিনুক বলল, তুমি যাবে না।

চোখ কুঁচকে বিনু বলল, কেন?

কাল তুমি ওখানে বসেছ, আজ এখানে বসবে।

দুর্বিনীত ঘাড় বাঁকিয়ে বিনু বলল, আমি এখানে বসব না। এখান থেকে ভাল দেখা যায় না।

ঝিনুক বলল, ওখানে গেলে সেই কথাটা তোমার মাকে বলে দেব।

কোন কথাটা?

সেই যে জলে ডুবে গিয়েছিলে।

বার বার একই অস্ত্র দেখিয়ে মেয়েটা তাকে হাতের মুঠোয় পুরে রাখবে, তা তো হতে পারে না। হাত-পা ছুঁড়ে বিনু চেঁচিয়ে উঠল, বিল গে। আমি তোমার কাছে কিছুতেই বসব না। বলল বটে বসবে না, কিন্তু বসেই থাকল।

হিরণ বলেছিল, সাতটার ভেতর নাটক শুরু করবে। আরম্ভ করতে করতে সাড়ে আটটা বেজে গেল। শেষ হল বারটায়।

বিজয়া’ নাটকে বিজয়ার ভূমিকায় অভিনয় করেছে সুধা, হিরণ করেছে নরেনের রোল। সুনীতি হয়েছে নলিনী, অবনীমোহন দয়াল। সবার অভিনয়ই চমৎকার। দুতিন হাজার লোক মুগ্ধ হয়ে দেখেছে।

নাটক শেষ হলে হেমনাথরা বাড়ি ফিরতে চেয়েছিলেন, রামকেশব ফিরতে দিলেন না। বললেন, এত রাত্তিরে আর ফিরতে হবে না হেমদাদা। ভোর হতে কতক্ষণই বা বাকি! এই ক’ঘন্টা আমার ওখানেই থেকে যান।

হেমনাথ বললেন, কিন্তু—

কিন্তু টিন্তু না।

বাড়িটা যে খালি পড়ে থাকবে।

রাজদিয়ার হেমকর্তার বাড়িতে চোর আসবে না। ধনদৌলত, সোনাদানা উঠোনে ফেলে রাখলেও কেউ সেদিকে তাকাবে না। আপনি আসুন তো।

এরকম জোর করেই হেমনাথদের নিজের বাড়ি নিয়ে তুললেন রামকেশব। তারপর হই হই করতে করতে রান্নাবান্না, খাওয়া। খাওয়ার পালা চুকতেই শোবার ব্যবস্থা হল। দোতলার ঘরে ঘরে ঢালা বিছানা পড়ল।

বিনুরা এসেছে, তাদের বাড়ি রাত্তিরে থাকবে। ঝুমা ভারি খুশি। সে বলল, চল, আমরা ওপরে গিয়ে শুয়ে পড়ি।

বিনু বলল, চল।

ঝিনুকটা আশেপাশে কোথায় ছিল। তাড়াতাড়ি বলে উঠল, আমিও তোমাদের সঙ্গে যাব।

ঝুমার তাতে আপত্তি নেই, এস না।

তিনজনে দোতলায় এসে ঢালা বিছানায় শুয়ে পড়ল।

মাথার দিকের জানালাগুলো ভোলা। সেখানে সারি সারি সুপারিগাছ একপায়ে দাঁড়িয়ে, আশ্বিনের এলোমলো বাতাস পাতার ভেতর খেলে বেড়াচ্ছে। এই মধ্যরাতে আকাশের মাঝখানে চাঁদ দেখা দিয়েছে। আবছা আলোয় সুপারিগাছের ছায়া এসে পড়েছে ঘরে। ওধারে কোথায় যেন শিউলি ফুটেছে, তার গন্ধে বাতাস আকুল।

পাশাপাশি শুয়ে কত কথা যে বলছে ঝুমা। আবোল বোল হাজার রকমের গল্প। বিনুও সমানে বকবক করে যাচ্ছে। ঝিনুক কিন্তু একেবারে চুপ।

গল্প করতে করতে একসময় বিনু আর ঝুমার গলা জড়িয়ে এল। গাঢ় গভীর ঘুম সরোবর হয়ে তাদের যেন অতলে টানতে লাগল।

বিনুরা প্রায় ঘুমিয়েই পড়েছিল, হঠাৎ শিয়রের দিক থেকে কে যেন ডেকে উঠল, ছুটোবাবু ছুটোবাবু–

প্রথমে আবছাভাবে কানে এসেছিল। তারপরেই চট করে ঘুমটা ভেঙে গেল বিনুর। চমকে মাথার দিকে তাকাতেই চোখে পড়ল, সব চাইতে কাছের সুপারি গাছটায় উঠে কেউ বসে আছে। ভয় পেয়ে কাঁপা গলায় বিনু চেঁচিয়ে উঠল, কে। কে ওখানে?

ইতিমধ্যে ঝুমাও উঠে পড়েছে। ঝিনুকের কিন্তু নড়াচড়ার লক্ষণ নেই। বিছানার একধারে অসাড় পড়ে আছে সে।

সুপারি গাছে চড়ে দোতলা পর্যন্ত যে উঠেছে সে তাড়াতাড়ি বলে উঠল, আমি যুগইলা। ডর নি পাইছেন ছুটোবাবু?

ভয় সত্যিই পেয়েছিল বিনু। যুগলের কথায় উত্তর না দিয়ে সে বলল, তুমি ওখানে উঠেছ কেন?

আপনের লেইগা—

আমার জন্যে! বিনু অবাক।

হ। অন্ধকারে মাথা নাড়ল যুগল।

কেন?

আপনেরে একখান কথা দিছিলাম, মনে আছে?

কী কথা?

ছুটোবাবুর কিছুই মনে থাকে না। কইছিলাম না, পূজার সোময় আপনেরে যাত্রা দেখামু।

এইবার মনে পড়ে গেল। উৎসাহের গলায় বিনু বলল, হ্যাঁ হ্যাঁ, কিন্তু দেখালে না তো।

হেই লেইগাই তো দুফার রাইতে গাছ বাইয়া আপনারে ডাকতে আইছি। আইজ সুজনগঞ্জে ভাল পালা আছে। যাইবেন?

প্রস্তাবটা লোভনীয়। কিন্তু যাবার পথে যে হাজার কাঁটা ছড়ানো। বাবা-মা এত রাত্তিরে কিছুতেই যেতে দেবেন না। অথচ সুদূর সুজনগঞ্জ থেকে আলোকোজ্জ্বল যাত্রার আসরটা তাকে অবিরত হাতছানি দিতে লাগল।

তার মনোভাবটা যেন বুঝতে পারল যুগল। বলল, আপনি কি আপনের বাপ-মা’র কথা ভাবেন?

হ্যাঁ।

ভাবনের কিছু নাই। নিচে নাইমা পাছ-দুয়ার দিয়া আইসা পড়েন। এহানে খাল আছে, আমি নাও আইনা রাখছি। আপনে আইলে বাদাম খাটাইয়া দিমু। চোখের পাতা পড়তে না পড়তে সুজনগুঞ্জ পৌঁছাইয়া যামু।

কিন্তু—

কী?

বাবা-মা?

তাগো কওয়ার দরকার নাই। লুকাইয়া আইসা পড়েন।

দ্বিধাটা তবু কাটল না। বিনু বলল, কিন্তু–

আবার কী?

বাবা-মা যখন জানতে পারবে?

আইজ রাইতে তো আর জানতে আছে না।

কাল যখন জানবে?

যুগল এবার অসহিষ্ণু হয়ে উঠল, তা হইলে ঘুমান, আমি যাই। বলে তর তর করে সুপারি গাছ বেয়ে খানিকটা নেমেও গেল যুগল। নামতে নামতে বলল, রাইত কইরা নদীর উপুর দিয়া নায়ে (নৈৗকোয়) যাওন, হে যে কী মজা, বুঝতে পারলেন না ছুটোবাবু। আপনে পইড়া পইড়া ঘুমান।

মুহূর্তে সব দ্বিধা কেটে গেল। কাল ধরা পড়লে কী হবে, কাল দেখা যাবে। খোলা নদীর ওপর দিয়ে বাদাম টাঙিয়ে যাওয়া, আবছা আবছা জ্যোৎস্না, যাত্রার আসর–এসব ছাড়া চোখের সামনে এখন আর কিছুই নেই। সব একাকার হয়ে বিনুকে যেন তারা আচ্ছন্ন করে ফেলল, তারপর জাদুকরের মতো কী এক আমোঘ আকর্ষণে টানতে লাগল।

বিছানায় আর বসে থাকতে পারল না বিনু। ছুটে জানালার কাছে চলে গেল। ততক্ষণে যুগল অনেক নিচে নেমে গেছে।

বিনু ডাকল, যুগল–

তলা থেকে সাড়া এল, কী কন?

একটু দাঁড়াও, আমি আসছি।

সত্যই যাইবেন?

হ্যাঁ।

তাইলে তরাতরি আহেন।

জানালার কাছ থেকে এধারে আসতেই ফিস ফিস করে ঝুমা বলল, আমিও যাব।

একটু ভেবে নিল বিনু। দু’জনে গেলে মার-টার বকুনি-টকুনিগুলো ভাগাভাগি করে নেওয়া যাবে, নইলে পুরোটাই একার ওপর এসে পড়বে। সে বলল, আচ্ছা চল। বলেই কী মনে পড়তে গলাটা অনেক নিচুতে নামাল, যাচ্ছি যে, ঝিনুক যেন টের না পায়। বলতে বলতে আপনা থেকে তার মাথাটা ডানদিকে ঘুরল।

কী আশ্চর্য। বিছানাটা একেবারে খালি, ঝিনুক নেই। একটু আগেই তো মেয়েটা ছিল, নিঃসাড়ে ঘুমোচ্ছিল। এর ভেতরে কোথায় গেল সে?

একটুক্ষণ চুপ করে থেকে বিনু বলল, ভালই হয়েছে। চল, এই বেলা বেরিয়ে পড়ি। ঝিনুক দেখতে পেলে সবাইকে বলে দেবে, আর যাওয়া হবে না।

পা টিপে টিপে খুব সন্তর্পণে দু’জনে একতলায় এল। বাঁদিকে লম্বা বারান্দা। শেষ প্রান্তে রান্নাঘর। সেখানে আলো জ্বলছে, অবনীমোহনদের গলাও ভেসে আসছে। ওঁরা এখনও শুতে যান নি।

বিনুরা ডান দিকে ঘুরে পেছনের দরজা দিয়ে বাইরে এসে পড়ল। আসতেই যুগলের সঙ্গে দেখা।

যুগল বলল, আহেন, আহেন–

তার পিছু পিছু ঝোঁপঝাড়ের ভেতর দিয়ে একসময় খালপাড়ে এসে পড়ল বিনুরা। একটু আগে যুগল নৌকোর কথা বলেছিল, সেটা জলের ওপর ভাসছে।

যুগল বলল, নায়ে ওঠেন–

উঠতে গিয়ে থমকে গেল বিনু, তার পেছনে ঝুমাও। নৌকোর ঠিক মাঝখানে কে যেন বসে আছে। বিনু চেঁচিয়ে উঠল, কে?

নৌকো থেকে উত্তর এল, আমি ঝিনুক।

সকল অধ্যায়

১. ১.০২ স্টিমারঘাটের বাইরে
২. ১.০৩ হেমনাথের নৌকো
৩. ১.০৪ রান্নাবান্না শেষ হতে দুপুর
৪. ১.০৫ স্নেহলতা ঝিনুকের পিছু পিছু
৫. ১.০৬ বাড়ির ভেতরে এসে
৬. ১.০৭ ঘুমটা ভাঙে নি
৭. ১.০৮ অবনীমোহনের সঙ্গে কথা
৮. ১.০৯ ভেতর-বাড়ির উঠোনে
৯. ১.১০ হিরণ আর সুধা
১০. ১.১১ কতক্ষণ ঘুমিয়েছিল
১১. ১.১২ কাল শুতে শুতে অনেক দেরি
১২. ১.১৩ খুব বেশিক্ষণ ঝিনুকের কথা
১৩. ১.১৪ সামনের একখানা ঘর
১৪. ১.১৫ পদ্ম আর শাপলার বনে
১৫. ১.১৬ নৌকোঘাট থেকে যুগলের সঙ্গে
১৬. ১.১৭ আগে আগে চলেছেন অবনীমোহন
১৭. ১.১৮ লারমোর বললেন
১৮. ১.১৯ কানের কাছে মুখ এনে
১৯. ১.২১ একা একা জল ঠেলে
২০. ১.২২ পুকুরের মাঝখান থেকে
২১. ১.২৩ শিশিররা যখন যান
২২. ১.২৪ কাল রাত্তিরেই বই বার করে
২৩. ১.২৫ রঙিন প্রজাপতি হয়ে
২৪. ১.২৬ প্রথম ঘটনাটির কথা
২৫. ১.২৭ মহালয়ার পর থেকেই পড়াশোনা
২৬. ১.২৮ কমলাঘাটের বন্দর
২৭. ১.২৯ মহালয়ার পর থেকে দিনগুলো
২৮. ১.৩০ গ্রীনরুমের ডানদিকে
২৯. ১.৩১ কিছুক্ষণ থ হয়ে দাঁড়িয়ে
৩০. ১.৩২ দশমীর পর একাদশী
৩১. ১.৩৩ রাজদিয়ায় দুর্গাপুজো
৩২. ১.৩৪ লক্ষ্মীপুজোর পরদিন
৩৩. ১.৩৫ লক্ষ্মীপুজোর পর থেকে
৩৪. ১.৩৬ দুর্গাপুজোর পর কোজাগরী
৩৫. ১.৩৭ ঝিনুক আর বিনুও সেদিকে
৩৬. ১.৩৮ ভবতোষ চলে গেছেন
৩৭. ১.২০ অপটু হাতে নৌকো
৩৮. ১.০১ ভাল করে সকাল হয় নি
৩৯. ২.০১-০৫ অবনীমোহনের ধারণা
৪০. ২.০৬-১০ অবনীমোহন কলকাতা থেকে ফিরে
৪১. ২.১১-১৫ ধানকাটার মধ্যে
৪২. ২.১৬-২০ কাল হেমনাথ বলে গিয়েছিলেন
৪৩. ২.২১-২৫ গত বছর পুজোর ছুটির পর
৪৪. ২.২৬-৩০ সেটেলমেন্ট অফিস
৪৫. ২.৩১-৩৫ আমেরিকান টমি
৪৬. ২.৩৬-৪০ চিনি কেরোসিন আর কাপড়
৪৭. ২.৪১-৪৫ অবনীমোহনের সঙ্গে একদিন হাটে
৪৮. ২.৪৬-৫০ মাঘের শেষ তারিখে
৪৯. ২.৫১-৫৬ তামাকহাটা মরিচহাটা আনাজহাটা
৫০. ৩.০১-০৫ আশ্বিনের মাঝামাঝি
৫১. ৩.০৬-১০ ভোরে সূর্যোদয়ের আগে
৫২. ৩.১১-১৫ সূর্য এখন সোজাসুজি
৫৩. ৩.১৬-২০ উদ্বাস্তুদের নিয়ে স্পেশাল ট্রেন
৫৪. ৩.২১-২৫ সুনীতির শ্বশুরবাড়ি
৫৫. ৩.২৬-৩০ পুরো দুটো দিন ভুগিয়ে
৫৬. ৩.৩১-৩৫ দু’আড়াই বছর কলকাতায়
৫৭. ৩.৩৬-৪০ খাওয়াদাওয়ার পালা

নোট নিতে এবং টেক্সট হাইলাইট করতে লগইন করুন

লগইন