১.১৪ সামনের একখানা ঘর

প্রফুল্ল রায়

একটু পর সামনের একখানা ঘর থেকে মাঝবয়সী একটি মেয়েমানুষ বেরিয়ে এল। তেলহীন রুক্ষ চুল তার। এই আশ্বিনেও গা-ভর্তি ঘামাচি, ফলে চামড়া খসখসে, খই-ওড়া। গাল ভাঙা, চোখের কোল বসে গেছে, রংটি এক সময় মাজা মাজাই হয়তো ছিল। পরনে ময়লা ডুরে শাড়ি ছাড়া কিছুই নেই। এসব সত্ত্বেও তাকে ঘিরে নিবু নিবু একটু লাবণ্য এখনও টিকে আছে।

মেয়েমানুষটার দু’ধারে লম্বা লাউয়ের মতো স্তন চুষতে চুষতে দু’টো তিন চার বছরের ন্যাংটো বাচ্চা ঝুলছিল। দেখে মনে হল, সবসময় ওরা ওই ভাবেই ঝোলে। সাঁকোর ওপর উঠে এসে মেয়েমানুষটি বলল, আ রে যুগইলা পোড়াকপাইলা, রোজই নি আমাগো বাড়িত আসস! বলে একমুখ হাসল।

বিব্রত যুগল তাড়াতাড়ি পাটাতনের তলা থেকে শালমাছ বার করে বলল, আইতে আইতে এই মাছটা মারলাম, ভাবলাম তগো দিয়া যাই।

হাত বাড়িয়ে মাছ নিতে নিতে মেয়েমানুষটি বলল, রোজই দেখি মাছ মাইরা দিয়া যাইতে আছস।

যুগল হাত কচলাতে কচলাতে বলতে লাগল, ভাইগনা-ভাগনীগো মাছ খাওয়াইতে বুঝিন সাধ যায় না আমার?

চোখের তারা নাচিয়ে, ঠোঁট উলটে দিয়ে বিচিত্র ভঙ্গি করল মেয়েমানুষটি, আহা লো সুনা (সোনা) লো, ভাইগনা-ভাগনীগো লেইগা বুকের ভিতরে এক্কেরে ফাত ফাত করে। আসলে কারে মাছ খাওয়াইতে আসো, হে কি বুঝি না?

যুগলের মুখচোখের চেহারা এই মুহূর্তে অবর্ণনীয়। ঘাড় ভেঙে মাথাটা নিচের দিকে ঝুলে পড়েছে। জড়সড় হয়ে সে বলতে লাগল, কারে আবার খাওয়াইতে আনি?

কমু?

মাথা আরও নুয়ে পড়েছে। আধফোঁটা গলায় যুগল কী বলল, বোঝা গেল না।

মেয়েমানুষটি এ ব্যাপারে আবার কী উত্তর দিতে গিয়ে, হঠাৎ চোখমুখ কুঁচকে তীক্ষ্ণ গলায় পেঁচিয়ে উঠল, খাইল, রাইক্ষইসা গুষ্টি আমারে চাইটা চাইটা শ্যাষ করল। যা মড়ারা, যা–বলে যে ছেলেদুটো ঝুলে ঝুলে স্তন চুষছিল, তাদের ঝেড়ে ফেলার মতো করে ঠেলে দিল। সঙ্গে সঙ্গে তারা গিয়ে পড়ল উঠোনের জলে।

বিনু নৌকোর মাঝখানে বসে ছিল। ভয়ে চোখ বুজে ফেলল। বুকটা খুব জোরে ঢিপ ঢিপ করতে লাগল। উঠোনে জল তো কম না, প্রায় এক মানুষের মতো। ছেলেদুটো যদি ডুবে যায়!

একটু পর ভয়ে ভয়ে চোখের পাতা অল্প ফাঁক করতেই বিনু অবাক। সেই ছেলেদু’টো সাঁতরে ওপরে উঠে পড়েছে। সাঁকো বেয়ে তারা মায়ের কাছে চলে এল এবং আগের মতো স্তনে মুখ দিয়ে ঝুলতে লাগল।

ওইটুকু ছেলে সাঁতার কাটতে পারে, নিজের চোখে দেখেও যেন বিশ্বাস করতে পারছে না বিনু। এমন বিস্ময়কর দৃশ্য আগে কখনও দেখে নি, চোখ বড় বড় করে সে তাকিয়ে থাকল। ওদের দেখতে দেখতে মনে পড়ল, এখনও সাঁতারটা শিখে উঠতে পারে নি। তাড়াতাড়ি শিখিয়ে দেবার জন্য কালই যুগলকে ধরতে হবে।

মেয়েমানুষটি এবার আর ছেলেদের জলে ছুঁড়ে দিল না। বিরক্ত, কটু গলায় গজ গজ করতে লাগল। খা খা, আমারে খাইয়া ঠান্ডা হ নিঃবইংশরা। প্যাটে যে কী কাল ধরছিলাম!

ছেলেদু’টোর ভ্রূক্ষেপ নেই। কুকুরছানার মতো চো চো করে তার দুধ খেতে লাগল।

ছেলেদের ছেড়ে আবার যুগলকে নিয়ে পড়ল মেয়েমানুষটি, পোড়াকপাইলা যুগইলা, আমারে চৌখে তুই ধূল-পড়া দিবি? কই তা হইলে, নামখান কই? পাখিরে মাছ খাওয়াইতে আনস।

যুগল বলতে লাগল, কী যে ক’স টুনি বইন, কী যে ক’স–

মেয়েমানুষটির নাম জানা গেল–টুনি। এ-ই তবে যুগলের পিসতুতো বোন। বিনু অবশ্য আগেই তা আন্দাজ করেছিল।

টুনি বলল, অবিয়াত (অবিবাহিত) মাইয়ারে রোজ রোজ মাছ খাওয়ান ক্যান? আ রে ড্যাকরা, আ রে যুগইলা, তর মনে কী আছে রে– শরীর বাঁকিয়ে চুরিয়ে হাসতে লাগল টুনি।

যুগলের মুখ লাল হয়ে উঠেছিল। ঘামতে ঘামতে সে বলল, অ্যামন কথা যদি কস, আমি আর আসুম না তগো বাড়িত্‌।

আবি আবি (আসবি আসবি), ঠিকই আবি। না আইসা কি পারবি সুনা?

ক্যান, পারুম না ক্যান?

পাখি যে তরে গুণ করছে।

হ, তরে কইছে!

টুনি আগের মতো হাসতে লাগল, কিছু বলল না।

পাখি কার নাম, কেমন করে সে যুগলকে গুণ করেছে, বুঝতে পারছিল না বিনু।

এদিকে আরেকটা ব্যাপার চলছিল। যুগল ঘামছিল, তার মুখ লাল হয়ে উঠেছিল–সবই ঠিক। তারই ভেতর চোরা চোখে এদিক সেদিক তাকিয়ে ব্যাকুলভাবে কাকে যেন খুঁজছিল।

তার এই আড়ে আড়ে তাকানোটা লক্ষ করেছিল টুনি। রঙ্গ করে বলল, টালুমালু কইরা চাইর দিকে দ্যাখস কী?

যুগল চমকে উঠল, কী আবার দেখি? কই, কিছু না—

কিছু না!

না-ই তো।

যারে বিচরাইতে আছস (খুঁজছিস), হে নাই। পাখি উড়াল দিছে।

নিমেষে মুখখানা অন্ধকার হয়ে গেল যুগলের। আবছা গলায় সে বলল, তার লেইগাই য্যান আইছি!

টুনি আবার কী বলতে যাচ্ছিল, হঠাৎ তার চোখ এসে পড়ল বিনুর ওপর। খানিক অবাক হয়ে সে বলল, পোলাটা কে রে যুগইলা? ক্যামন ফুটফুইটা!

কালো কালো যে ছেলেগুলো সাঁকোর ওপর বসে পা ঝুলিয়ে ঝুলিয়ে বড়শি বাইছিল তাদের ভেতর থেকে একজন বলল, কী ধলা (ফর্সা), এক্কেরে সাহেবগো লাখান।

আরেকটা ছেলে বললে, পিরানটা (জামাটা) দেখছস বেঙ্গা, দুইখান জেব (পকেট) আছে।

টুনি তাকে ফুটফুটে বলেছে, তার ছেলেরা বলেছে সাহেবের মতো। নিজের চেহারার এমন খোলাখুলি প্রশংসায় বিনু লজ্জা পেয়ে গেল। মুখ নামিয়ে সে নখ খুঁটতে লাগল।

যুগল বলল, উনি বাবুগো পোলা।

টুনি শুধলো, কুন বাবুগো?

কইলকাতার বাবুগো। হ্যামকত্তার নাতি।

হ্যামকত্তার তো পোলামাইয়া নাই, তেনার আবার নাতি হইল কই থনে?

উনি হ্যামকত্তার ভাগনীর পোলা।

কইলকাতায় থাকে বুঝিন?

হ, কইলাম তো।

আইছে কবে?

তিন চাইর দিন হইল।

একলাই আইছে?

না। উইটুক মাইনষে একলা আইতে পারে?

তয়?

ওনার বাপ-মায়ের লগে আইছে।

টুনির কৌতূহল অসীম। বলতে লাগল, বাপ-মাই খালি আইছে নিকি?

যুগল মাথা নাড়ল, না। দু’গা বইনও আইছে।

থাকব কদ্দিন?

হে আমি কি জানি—

শোনস নাই?

না।

একটু কী ভেবে টুনি বলল, উই রে যুগইলা—

যুগল তক্ষুনি সাড়া দিল, কী?

বাবুগো পোলা নি আমাগো ঘরে আইসা বইব?

অহন না।

তয়?

আরেক দিন নিয়া আসুম।

আনিস কিলাম (কিন্তু), মাথা খাস।

বিরক্ত সুরে যুগল বলল, আনুম তো কইলাম।

টুনি বলল, ঘরে নাইকলের লাড় আছে, বাবুগো পোলারে নি দুইটা দিমু?

না।

আহত সুরে টুনি বলল, ক্যান রে?

যুগল বলল, কইলকাতার বাবুরা লাড় খায় না।

টুনির মুখখানা হঠাৎ ভারী হয়ে গেল। বিষঃ গলায় সে বলল, তাইলে কী খাইতে দেই ক’ দেখি–

অহন তরে কিছু দিতে হইব না।

টুনির মুখচোখের অবস্থা যা দাঁড়িয়েছে তাতে ভারি মায়া হতে লাগল বিনুর। একবার ইচ্ছে হল নাড় চেয়ে খায়, কিন্তু লজ্জায় বলতে পারল না।

ওদিকে টুনি আবার বলল, হ্যামকত্তার নাতি পেরথম দিন আইল, কিছুই হাতে দিতে পারলাম না।

রসগুল্লা পানিতুয়া আইনা রাখিস। আরেক দিন যহন নিয়া আসুম তহন দুটোবাবুরে দিস।

আননের আগে আমারে খবর দিবি কিলাম।

দিমু।

টুনির সব কথারই উত্তর দিচ্ছে যুগল, তবে কেমন যেন অন্যমনস্কের মতো। তার চোখদুটো খাঁচার পাখির মতো অনবরত দিগ্বিদিকে ছোটাছুটি করছে। বেশ বোঝা যায়, পিসতুতো বোন কিংবা তার মাগুর মাছের মত কালো কালো ছেলেমেয়েগুলোর জন্য বিশেষ উগ্রীব নয় যুগল। আসলে যার জন্য তার এ বাড়িতে আসা, তাকে এখনও খুব সম্ভব দেখতে পায় নি। ফলে ভেতরে ভেতরে খুব অস্থির এবং চঞ্চল হয়ে উঠেছে।

একটু ফাঁক পেয়ে যুগল বলল, অই লো টুনি বইন—

কী?

জামাইরে যে দেখি না–

হাটে গ্যাছে।

সুজনগুঞ্জের?

হ।

তগো বাড়িটা বড় নিঝ্‌ঝাম টুনি বইন–

ঠোঁটে ঠোঁট টিপে দুষ্টুমির সুরে টুনি বলল, হ। বড় নিঝ্‌ঝাম।

যুগল টুনির মুখভঙ্গি বা বলার ধরন লক্ষ করে নি। আপন মনে বলল, তর হউরে কই (তোর শ্বশুর কোথায়)?

উত্তরের ভিটির ঘরে বইসা তামুক খাইতে আছে।

হাউরিরেও (শাশুড়িকেও) তো দেখি না।

হে (সে) রইছে পুবের ভিটির ঘরে।

করে কী?

কাইল রাইতে জ্বর আইছিল, কাথা মুড়ি দিয়া শুইয়া শুইয়া কোকাইতে আছে (ককাচ্ছে)।

ইস–

কী হইল?

হাউরিরে ডাক্তর দেখাইছস?

ঘাড় বাঁকিয়ে গালে একখানা হাত রাখল টুনি, অই রে কালামুইখা যুগইলা, ক’স কী তুই?

যুগল চকিত হল, কী কই?

একদিনের জ্বরে ডাক্তর দেখামু, আমরা নি ত্যামন বড় মানুষ! আমাগো নি ত্যামন সুখের শরীল! জ্বর আইছে, আবার যাইব গা। হের (তার) লেইগা ডাক্তার কিয়ের (কিসের? ওষুধ কিয়ের? শুনালি একখান কথা যুগইলা! বাপের জম্মে একখান কথা শুনলাম।

যুগল বলল, কী এমুন কইলাম যা বাপের জন্মে শোনস নাই?

তুই চুপ যা তো ছ্যামরা। মায়ের পোড়ে না, বাপের পোড়ে না, মাসির বুক জ্বইলা যায়। আপন কেউ না, পিসাতো বইনের হাউরির লেইগা আমাগো যুগইলার পরাণ ফাত ফাত করে। অই রে যুগইলা, অই রে ড্যাকরা–

কী?

হউর-হাউরি থুইয়া আসল কথাখান ক। তর পরানে যা আছে ক। যার বিহনে এই পুরী নিঝাম লাগে হের কথা ক।

কার বিহনে আবার এই পুরী নিঝ্‌ঝাম?

পরের মুখে নামখান শুনতে বুঝিন মিঠা লাগে? তা হইলে কই–পাখি, পাখি, পাখি—

যুগল বলল, আমার পিছনে যদি অ্যামন কইরা লাগস তয় কিলাম যামু গা।

কপট দীর্ঘশ্বাস ফেলে টুনি বলল, পাখি নাই, থাইকা আর কী করবি সুনা? আইজ বিহান বেলায় অর বাপের লগে গ্যাছে গা।

যুগলের মুখ আরও কালো হয়ে গেল। আবছা গলায় সে বলল, বার বার উই কথা কইলে সত্যসত্যই যামু গা, আর কুনোদিন আসুম না।

বলছে বটে, যাবার কোনও লক্ষণই কিন্তু দেখা যাচ্ছে না। এমনকি সাঁকোর বাঁশে নৌকোটা যে বেঁধে রেখেছিল যুগল, সেটা বাধাই আছে। দড়িটা পর্যন্ত খোলে নি।

এই সময় একটা ছেলে বলে উঠল, না গো যুগলামামা, পাখি পিসি যায় নাই। মায় তোমারে ভাটকি দিছে (মিথ্যে বলে ঠাট্টা করেছে)।

খুব নির্লিপ্ত মুখে যুগল বলল, থাউক যাউক, হেয়াতে আমার কী?

টুনি বলল, আ লো আমার সুনা লো, কিচ্ছু বুঝি হয় না তর? পাখি গ্যাছে গা শুইনা তো বুকখানে ঢেকির পাড় পড়তে আছিল। বলেই গলা চড়িয়ে ডাকতে লাগল, পাখি-পাখি—পাখি–

সাড়াশব্দ পাওয়া গেল না।

টুনি আবার ডাকল, আ লো ছেমরি আয়, লাজ শরম বষ্যার জলে ভাসাইয়া আইসা পড়। পরানের বান্ধব তরে না দেইখা কিলাম এইবার মূচ্ছা যাইব।

টুনি তার এক ছেলেকে বলল, যা রে বেঙ্গা, পাখি পিসিরে ধইরা নিয়া আয়।

সব চাইতে বড় ছেলেটা ছিপ টিপ একধারে গুটিয়ে উত্তর দিকের উঁচু ঘরখানায় চলে গেল। একটু পর ফিরে এসে বলল, পিসি আইব না।

টুনি শুধলো, ক্যান, আইব না ক্যান?

বেঙ্গা বলল, চাউলের মটকিগুলার (জালাগুলোর) পিছে পলাইয়া রইছে।

টুনি চেঁচিয়ে চেঁচিয়ে বলল, আ লো ছেমরি, আয় আয়। লাজে তো তুই গেলি!

হাজার ডাকাডাকিতেও পাখি এল না।

অগত্যা হতাশ, বিমর্ষ যুগল অনেকখানি গলা তুলে বলল, যাই গা টুনি বইন, যাই গা– এবার সত্যি সত্যি নৌকোর বাঁধন খুলে ফেলল সে।

টুনি হেসে গড়িয়ে পড়তে পড়তে বলল, আরেটু জোরে চিল্লা যুগইলা, যারে শুনাইতে চাস হে (সে) শোনে নাই।

কইলাম তো তরে, আর কাউরে শুনাইতে চাই না।

টুনি হাসি থামিয়ে এবার অন্য কথা পাড়ল, অখন যাবি কই?

হাটে।

সুজনগুঞ্জে?

হ। হ্যামকায়, লালমোহন সাহেব আর এই ছুটোবাবুর বাবায় আরেক নায়ে আগেই গ্যাছে গা। আমরা গিয়া তাগো ধরুম।

হাটে গ্যালে তোগো জামাইর লগে দেখা হইব।

হ।

পাটাতনের তলা থেকে বৈঠাখানা বার করে বাইতে শুরু করল যুগল।

সাঁকোর ওপর থেকে টুনি আরেক বার বলল, বাবুগো পোলারে একদিন নিয়া আবি, নিয্যস আনবি।

আনুম।

টুনিদের উঠোন থেকে বেরিয়ে নৌকোটা বাইরের অথৈ, অসীম, জলপূর্ণ প্রান্তরে এসে পড়ল।

আস্তে আস্তে নৌকো বাইছে আর পেছন ফিরে ব্যাকুলভাবে বার বার কী দেখছে যুগল। টুনিদের বাড়ি ছাড়িয়ে খুব বেশি দূর এখনও যায় নি, হঠাৎ যুগলের হাতের বৈঠা থেমে গেল। তার চোখের তারায় আলো নাচতে লাগল।

দ্রুত ঘুরে বসে টুনিদের বাড়ির দিকে তাকিয়ে তাকিয়ে হাতছানি দিতে লাগল যুগল। তার হাতের দিকে লক্ষ করতেই বিনু দেখতে পেল, টুনিদের উত্তরের ভিটের ঘরখানার পেছনের দরজায় কোমরখানি ঈষৎ বাঁকিয়ে একটি মেয়ে দাঁড়িয়ে আছে–নিশ্চয়ই পাখি।

দরজার ফ্রেমের ভেতর প্রথমটা মনে হল ছবি। কত বয়স হবে পাখির, যোল সতেরর বেশি নয়।

গায়ের রংখানি মাজা মাজা। চামড়া এত টান টান, মসৃণ এবং চকচকে যে মনে হয়, মেয়েটির সারা গায়ে প্রতিমার মতো ঘামতেল মাখানো। হাত-পায়ের শক্ত শক্ত গড়নের মধ্যে লাবণ্য যত, তার চাইতে ঢের বেশি বলশালিতা। ঘন পালকে-ঘেরা বড় বড় চোখ, তার মাঝখানে কুচকুচে কালো মণি দুটো যেন ছায়াচ্ছন্ন সরোবর। চোখ দুটি সর্বক্ষণ যেন জগতের সব কিছুর দিকে তাকিয়ে অবাক হয়ে আছে। মোটা ঠোঁট, সরু চিবুক, ছোট্ট কপালের ওপর থেকে ঘন চুলের ঘের শুরু হয়ে পিঠের ওপর নিবিড় মেঘের মতো সেই চুল ছড়িয়ে আছে। ছোট হলেও নাকটিতে ধারাল টান আছে, তার বাঁধারের পাটায় সবুজ পাথর বসানো নাকছাবি। হতে লাল বালা আর একগোছা রুপোর চুড়ি, কানে কুমারী মাকড়ি।

কাছাকাছি বসে সবই স্পষ্ট দেখতে পাচ্ছিল বিনু। আলাদা আলাদা করে দেখলে নাকে-মুখে হাতে পায়ে হাজারটা খুঁত বার করা যাবে। কিন্তু সব মিলিয়ে তাকে ঘিরে কোথায় যেন অলৌকিকের একটুখানি ছোঁয়া আছে যা চোখ এবং মন একসঙ্গে জুড়িয়ে দেয়।

নীল ডোরা-দেওয়া হলুদ শাড়ি আর খাটো লাল জামা আঁটোসাঁটো করে পরা। মেয়েটির চোখেমুখে বেশবাসে আশ্বিনের টলমলে সোনালি রোদ এসে পড়েছে। ফলে তাকে এ জগতের মানবী মনে হয় না।

মেয়েটা যেখানে দাঁড়িয়ে, তার ঠিক তলাতেই জল। নীলচে কাঁচের মতো স্বচ্ছ টলমলে জলের আরশিতে তার ছায়া কাঁপছে।

সমানে হাতছানি দিয়ে যাচ্ছে যুগল, আর মেয়েটাও তার একখানি হাত বুক পর্যন্ত তুলে নেড়ে নেড়ে ইশারায় না না করে চলেছে। তার ঠোঁটে, চোখের তারায় সরল মধুর হাসির ছটা ঝিকমিক। করছে।

যুগল হাত নেড়ে নেড়ে ডাকল, আসো মেয়েটি বলল, না। নাও নিয়া তোমার কাছে যামু?

চকিতে ঘাড় ফিরিয়ে বাড়ির ভেতরটা দেখে নিল মেয়েটা। মুখচোখের চেহারা সন্ত্রস্ত হয়ে উঠল। বিব্রভাবে বলল, না–না-না, কেউ দেইখা ফেলব।

যুগল বলল, দেখুক–

তার কথা শেষ হতে না হতেই সেই উঁচু দরজার ভেতর থেকে জলে ঝাঁপ দিল মেয়েটা। ঝপাং করে একটা শব্দ হল, জল ছিটকে ছড়িয়ে পড়ল চারদিকে। বিনু দেখতে পেল, কখনও পানকৌড়ির মতো, কখনও লাল-হলুদ অলৌকিক একটা মাছের মতো পাখনা মেলে সাঁতার কাটতে কাটতে নিমেষে নৌকোর কাছে চলে এসেছে মেয়েটা।

যুগলের চোখে যে আলো খেলছিল সেটা চকমক করতে লাগল। মেয়েটার দিকে হাত বাড়িয়ে বলল, আসো–

যুগলের হাত ধরে মেয়েটা নৌকোর ওপরে উঠে এল। যুগল বলল, ইস, এক্কেরে ভিজা গেলা। নাও লইয়া কাছে গ্যালে আর ভিজতে হইত না।

মেয়েটি বলল, ভিজছি, বেশ করছি। আমরা মন হইছে, তাই ভিজছি। নাও লইয়া গ্যালে কেও দেইখা ফেলাইলে আমি গলায় দড়ি দিতাম।

মেয়েটার শাড়ি থেকে, জামা থেকে, চুল থেকে জল ঝরে ঝরে নৌকোর পাটাতন ভেসে গেল। সে ব্যস্তভাবে বলতে লাগল, নাওটা এটু দূরে লইয়া যাও মাঝি।

যুগলকে তা হলে মাঝি’ বলে মেয়েটা। যুগল বলল, দূরে যামু ক্যান?

বাড়িত্ থনে এই জাগাখান (জায়গাটা) দেখা যায়।

দ্যাখনের ডর?

হ।

আমাগো কথা হগলে জানে।

জানুক। তুমি নাওখান দূরে লইয়া যাও। নাইলে–

নাইলে কী?

আমি কিলাম ফির বাড়িত যামু গা।

আইচ্ছা আইচ্ছা—

চারধারে পদ্মবন, শাপলা আর শালুকের অরণ্য। নৌকো বেয়ে অনেকটা দূরে চলে এল যুগল। তারপর বলল, টুনি বইনে তখন অত কইরা ডাকল, আইলা না ক্যান?

মেয়েটা বলল, আমার বুঝিন শরম লাগে না?

থুইয়া দ্যাও তোমার শরম। আমি খুব গুসা করছি।

শুদাশুদি গুসা কইরো না মাঝি। আমি নি মাইয়ামানুষ, তোমাগো যা সাজে মাইয়া মাইনষের নি তা মানায়!

যুগল কী উত্তর দিতে গিয়ে হঠাৎ বিনুর সম্বন্ধে সচেতন হল। এতক্ষণ বিনুর কথা বুঝি তার খেয়াল ছিল না। তাড়াতাড়ি মেয়েটাকে দেখিয়ে সে বলে উঠল, ছুটোবাবু, এই হইল পাখি।

মেয়েটা যে পাখি, আগেই তা আন্দাজ করেছিল বিনু। সে একদৃষ্টে পাখির দিকে তাকিয়ে থাকল। যুগল এবার বিনুকে দেখিয়ে পাখিকে শুধলো, এনি কে, জানো?

জানি– পাখি ঘাড় হেলিয়ে দিল।

কে?

তুমি যে বাড়িত্ থাকো হেই বাড়ির বাবুর নাতি। কইলকাতা থনে আইছে।

তুমি জানলা ক্যামনে?

উত্তরের ঘরের দরজার ফাঁক দিয়া দেখছি।

একটুক্ষণ নীরবতা। তারপর গাঢ় গলায় পাখি ডাকল, মাঝি—

কও– যুগল মুখ তুলল।

পূজার সোময় বাপে আমারে নিতে আইব।

যুগল চমকে উঠল, যাইবা গিয়া?

চোখ নামিয়ে নখ খুঁটতে খুঁটতে পাখি বলল, নিতে আইলে থাকুম ক্যামনে? তয়–

তয় কী?

কেও যদি জোর কইরা ধইরা রাখত, থাইকা যাইতাম।

বিনুর অস্তিত্ব সম্পূর্ণ অগ্রাহ্য করে পাখির কানের কাছে মুখ নামাল যুগল। ফিসফিস গলায় বলল, রাখুম, জোর কইরাই ধইরা রাখুম।

আবার কিছুক্ষণ চুপচাপ। তারপর পাখিই প্রথম কথা বলল, মাঝি–

কী?

হেই, হেইদিন তুমার টুনি বইনের যেদিন পোলা হইল, রয়ানি গীত শুনাইছিলা, মনে আছে?

আছে।

কতকাল তোমার গীত শুনি না, আইজ একখান শুনতে সাধ লয়।

শুনবা?

হ।

মনে মনে সুর ভেঁজে যুগল শুরু করে দিল :

চাঁদনী তুই লো আমার
জীয়ন মরণ কাঠি,
তোরে না দেখিলে পরে
মরি লো বুক ফাটি।
তালুক মুলুক তুই লো আমার,
তুই লো ট্যাহার তোড়া,
নামাবলী তুই লো আমার
তুই লো ভাঙ্গা বেড়া।
তুই যে আমার রসগুল্লা
মোন্ডা মিঠাই ছানা,
শীতের কথা তুই যে আমার
রইদের মিছরি পানা।
বষ্যাকালে তুই লো আমার
তালপাতার ছাতি,
তরে পাইলে ফস্যা হয় লো
ঘোর আন্দার রাতি।
চাঁদনী তুই লো আমার—

গান শেষ হবার পরও অনেকক্ষণ দূরবিসারী পদ্মবনের ওপর তার রেশ দুলতে লাগল।

একসময় পাখি বলল, এইবার যাই গা মাঝি।

যুগল বলল, আরেষ্টু বস।

না। কতক্ষণ আইছি খেয়াল আছে? তোমরা হাটে যাইবা না?

হ হ– যুগল ব্যস্ত হয়ে উঠল, চল, তোমারে বাড়ি দিয়া আসি।

না মাঝি, তোমারে আর দিয়া আইতে হইব না। নিজেই যাইতে পারুম। বলেই জলে ঝাঁপ দিল পাখি।

তারপর নৌকো থেকে বিনু আর যুগল দেখল, পানকৌড়িও না, নীল-হলুদ অলৌকিক মাছও নয়, স্বপ্নলোকের জলপরীর মতো পদ্মবনের ভেতর দিয়ে সাঁতার কেটে দূরে, আরও–আরও দূরে চলে যাচ্ছে পাখি। যতক্ষণ তাকে দেখা গেল, একদৃষ্টে বিনুরা তাকিয়ে থাকল।

সকল অধ্যায়

১. ১.০২ স্টিমারঘাটের বাইরে
২. ১.০৩ হেমনাথের নৌকো
৩. ১.০৪ রান্নাবান্না শেষ হতে দুপুর
৪. ১.০৫ স্নেহলতা ঝিনুকের পিছু পিছু
৫. ১.০৬ বাড়ির ভেতরে এসে
৬. ১.০৭ ঘুমটা ভাঙে নি
৭. ১.০৮ অবনীমোহনের সঙ্গে কথা
৮. ১.০৯ ভেতর-বাড়ির উঠোনে
৯. ১.১০ হিরণ আর সুধা
১০. ১.১১ কতক্ষণ ঘুমিয়েছিল
১১. ১.১২ কাল শুতে শুতে অনেক দেরি
১২. ১.১৩ খুব বেশিক্ষণ ঝিনুকের কথা
১৩. ১.১৪ সামনের একখানা ঘর
১৪. ১.১৫ পদ্ম আর শাপলার বনে
১৫. ১.১৬ নৌকোঘাট থেকে যুগলের সঙ্গে
১৬. ১.১৭ আগে আগে চলেছেন অবনীমোহন
১৭. ১.১৮ লারমোর বললেন
১৮. ১.১৯ কানের কাছে মুখ এনে
১৯. ১.২১ একা একা জল ঠেলে
২০. ১.২২ পুকুরের মাঝখান থেকে
২১. ১.২৩ শিশিররা যখন যান
২২. ১.২৪ কাল রাত্তিরেই বই বার করে
২৩. ১.২৫ রঙিন প্রজাপতি হয়ে
২৪. ১.২৬ প্রথম ঘটনাটির কথা
২৫. ১.২৭ মহালয়ার পর থেকেই পড়াশোনা
২৬. ১.২৮ কমলাঘাটের বন্দর
২৭. ১.২৯ মহালয়ার পর থেকে দিনগুলো
২৮. ১.৩০ গ্রীনরুমের ডানদিকে
২৯. ১.৩১ কিছুক্ষণ থ হয়ে দাঁড়িয়ে
৩০. ১.৩২ দশমীর পর একাদশী
৩১. ১.৩৩ রাজদিয়ায় দুর্গাপুজো
৩২. ১.৩৪ লক্ষ্মীপুজোর পরদিন
৩৩. ১.৩৫ লক্ষ্মীপুজোর পর থেকে
৩৪. ১.৩৬ দুর্গাপুজোর পর কোজাগরী
৩৫. ১.৩৭ ঝিনুক আর বিনুও সেদিকে
৩৬. ১.৩৮ ভবতোষ চলে গেছেন
৩৭. ১.২০ অপটু হাতে নৌকো
৩৮. ১.০১ ভাল করে সকাল হয় নি
৩৯. ২.০১-০৫ অবনীমোহনের ধারণা
৪০. ২.০৬-১০ অবনীমোহন কলকাতা থেকে ফিরে
৪১. ২.১১-১৫ ধানকাটার মধ্যে
৪২. ২.১৬-২০ কাল হেমনাথ বলে গিয়েছিলেন
৪৩. ২.২১-২৫ গত বছর পুজোর ছুটির পর
৪৪. ২.২৬-৩০ সেটেলমেন্ট অফিস
৪৫. ২.৩১-৩৫ আমেরিকান টমি
৪৬. ২.৩৬-৪০ চিনি কেরোসিন আর কাপড়
৪৭. ২.৪১-৪৫ অবনীমোহনের সঙ্গে একদিন হাটে
৪৮. ২.৪৬-৫০ মাঘের শেষ তারিখে
৪৯. ২.৫১-৫৬ তামাকহাটা মরিচহাটা আনাজহাটা
৫০. ৩.০১-০৫ আশ্বিনের মাঝামাঝি
৫১. ৩.০৬-১০ ভোরে সূর্যোদয়ের আগে
৫২. ৩.১১-১৫ সূর্য এখন সোজাসুজি
৫৩. ৩.১৬-২০ উদ্বাস্তুদের নিয়ে স্পেশাল ট্রেন
৫৪. ৩.২১-২৫ সুনীতির শ্বশুরবাড়ি
৫৫. ৩.২৬-৩০ পুরো দুটো দিন ভুগিয়ে
৫৬. ৩.৩১-৩৫ দু’আড়াই বছর কলকাতায়
৫৭. ৩.৩৬-৪০ খাওয়াদাওয়ার পালা

নোট নিতে এবং টেক্সট হাইলাইট করতে লগইন করুন

লগইন