১.১৯ কানের কাছে মুখ এনে

প্রফুল্ল রায়

কানের কাছে মুখ এনে কোমল গলায় কেউ যেন অনেকক্ষণ ধরে কিছু বলছে। স্বরটা বিনুর খুব চেনা, কিন্তু কথাগুলো সে বুঝতে পারছে না। চোখ মেলে তাকিয়ে যে দেখবে, তেমন শক্তিটুকুও তার নেই। গভীর ঘন ঘুম আঠার মতো চোখে জড়িয়ে আছে।

গলার স্বরটা ধীরে ধীরে স্পষ্ট হতে লাগল, সেই সঙ্গে হাতে মৃদু ধাক্কা অনুভব করল বিনু। এবার তার মনে হল, কান দিয়ে চুঁইয়ে চুঁইয়ে দু’একটা শব্দ ভেতরে ঢুকছে।

অনেক কষ্টে চোখের পাতা দুটো টেনে তুলল বিনু, আর তখনই দেখতে পেল হেমনাথ ঈষৎ ঝুঁকে তার দিকে তাকিয়ে আছেন।

এখনও ভাল করে ভোর হয় নি। ঘরের ভেতরটা আবছা। শিয়রের দিকে একটা জানালা খোলা রয়েছে। তার বাইরে যতদূর চোখ যায়, উঠোন-বাগান-পুকুর, ওপারের ধানবন–সব কিছু ঝাঁপসা, নিরাকার। ঝুপসি আমবাগানে আর ঢ্যাঙা সুপুরি গাছগুলোর পাতার ভেতর এখনও থোকা থোকা অন্ধকার।

চোখ মেলতেই হেমনাথ আরও একটু নিচু হলেন, দাদাভাই, উঠবি না?

আধবোজা ঘুমন্ত গলায় বিনু বলল, কেন?

বা রে, ভোর হয়ে গেছে। এক্ষুণি রোদ উঠে যাবে। তার আগে সূর্যস্তব সেরে নিতে হবে না?

রাজদিয়ায় আসার পর হেমনাথের সঙ্গে ভোরবেলায় উঠছে বিনু, নিয়মিত সূর্যবন্দনা করছে। কাল সমস্ত দিন যা ছোটাছুটি করেছে তাতে হাত-পাগুলো যেন আলগা হয়ে গেছে। বিনুর সারা গায়ে পুরো একটি দিনের ক্লান্তি মাখানো। রাত্তিরে ঘুমোতে ঘুমোতে সুজনগঞ্জের হাট থেকে রাজদিয়া। ফিরেছিল সে। সেই ঘুম কাটতেই চাইছে না। বিছানা ছেড়ে উঠতে একটুও ইচ্ছা করছে না।

হেমনাথ আবার তাড়া দিলেন, ওঠ দাদা, তাড়াতাড়ি ওঠ–

অনিচ্ছাসত্ত্বেও এবার উঠে বসল বিনু। দু’হাতে চোখ রগড়ে রগড়ে যতখানি পারল ঘুম তাড়াল, তারপর করুণভাবে একবার বিছানার দিকে তাকাতে গিয়েই দেখতে পেল, সেই মেয়েটা পাশ ফিরে ঘুমোচ্ছে। সেই মেয়েটা যার কোঁকড়া, কেঁকড়া চুল, জাপানি পুতুলের মতো মুখ, টলটলে কালো দুটো চোখের মণি, যার নাম ঝিনুক।

বিনুর মনে পড়ে গেল, কাল ঘুমের ঘোরে দাদুর বুকের ওপর থেকে এই হিংসুটি মেয়েটাই তার হাত ঠেলে সরিয়ে দিয়েছিল।

বিনু বলল, ঝিনুক বুঝি কাল এখানে শুয়েছিল?

হ্যাঁ। হেমনাথ মাথা নাড়লেন, তুই শুয়েছিলি আমার বাঁ ধারে, ঝিনুক ডান ধারে।

অপ্রসন্ন চোখে ঝিনুকের দিকে তাকিয়ে কী বলবে ভাবতে লাগল বিনু। সেই ফাঁকে হেমনাথ বললেন, আর দেরি করিস না দাদু, মুখটুখ ধুতে ধুতে কিন্তু রোদ উঠে যাবে।

নিঃশব্দে এবার বিছানা থেকে নেমে হেমনাথের পিছু পিছু ঘরের বাইরে চলে এল বিনু।

এই ভোরবেলায় ঠাণ্ডা হাওয়া দিয়েছে। এত ঠাণ্ডা, মনে হয়, আশ্বিনের সকালেই সেটা সারা গায়ে পৌষের মেজাজ নিয়ে এসেছে। বাতাসটা গায়ে লাগতে চামড়া কুঁকড়ে যাচ্ছে।

বারান্দার এক কোণে মাটির হাঁড়িতে জল আর নিমের দাঁতন ছিল। তাড়াতাড়ি মুখ ধুয়ে হেমনাথের সঙ্গে উঠোনের শেষ প্রান্তে এসে পুব দিকে মুখ করে দাঁড়াল বিনু।

এর মধ্যেই স্নেহলতা উঠে পড়েছেন। পুকুর থেকে চান সেরে এইমাত্র বাড়ি এসে ঢুকলেন তিনি এবং উঠোনে ভিজে পায়ের ছাপ আঁকতে আঁকতে উত্তরদুয়ারী ঘরের দিকে চলে গেলেন।

এ বাড়িতে স্নেহলতাই বোধহয় সবার আগে ওঠেন। ঘুম থেকে উঠবার পর কোনওদিন তাঁকে শুয়ে থাকতে দেখেনি বিনু। তার ভেতর হয় তার চান সারা হয়ে যায়, নতুবা চান সেরে ভিজে কাপড়ে পুকুর থেকে ফেরেন। সূর্যোদয়ের আগেই এই কাজটি স্নেহলতার চুকিয়ে ফেলা চাই।

আজ একা স্নেহলতাই বিনুদের আগে ওঠেন নি, শিবানীও উঠেছেন। হেমনাথের আশ্রিত দুটি বিধবাও উঠে পড়েছে।

এই মুহূর্তে শিবানী বাসি উঠোনে জলছড়া দিচ্ছেন। আর সেই বিধবা প্রৌঢ়া দুটি তকতকে করে ঘরের পিড়া (ভিত) লেপছে।

পুব দিকটা একেবারে ফাঁকা। যতদূর চোখ যায়, সেই দিগন্ত পর্যন্ত বাধা দেবার মতো কিছু নেই, অবশ্য দু’চারটে তাল সুপুরি ঢ্যাঙা পায়ে ডিঙি মেরে অনেক উঁচুতে কী দেখবার চেষ্ট করছে। ওই টুকু বাদ দিলে সব অবারিত।

এই বিশাল ব্যাপ্তির মুখোমুখি দাঁড়িয়ে চোখ বুজে হেমনাথের সঙ্গে গলা মিলিয়ে একসময় সূর্যবন্দনা শুরু করল বিনু, ওঁ জবাকুসুম–

দু’চারটে অক্ষর সবে উচ্চারণ করেছে, সেই সময় পেছন থেকে কচি গলার ডাক শোনা গেল, দাদু, ও দাদু–

হেমনাথ ফিরেও তাকালেন না। তন্ময় হয়ে সূর্যস্তব আবৃত্তি করে যেতে লাগলেন। ডাকটা আবার শোনা গেল, দাদু, ও দাদু, ও দাদু– এবার কণ্ঠস্বর খুবই অস্থির, অসহিষ্ণু।

কে ডাকছে, বিনু বুঝতে পারল। চোখের পাতা অল্প ফাঁক করে একবার হেমনাথকে দেখে নিল সে। হেমনাথের চোখ আগের মতোই বোজা, আগের মতোই ধ্যানস্থ হয়ে আছেন তিনি। পেছনের ডাকটা শুনতে পেয়েছেন বলে মনে হল না।

সূর্যস্তব আওড়াতে আওড়াতে টুক করে একবার মাথা ঘুরিয়ে পেছন দিকে দেখে নিল বিনু। যা ভেবেছিল, ঝিনুক-ঝিনুকই ওখানে দাঁড়িয়ে আছে। তার চোখ কোঁচকানো, মুখ থমথমে।

এক পলক ঝিনুককে দেখে নিয়ে আবার চোখ বুজে সামনের দিকে তাকাল বিনু, এবং হেমনাথের সঙ্গে সূর্যস্তব আবৃত্তি করতে লাগল। আর পেছনে ঝিনুকের গলার সেই ডাকটা একটানা শোনা যেতে লাগল।

সূর্যবন্দনা শেষ হতে হতে আলোর আভা ফুটে গেল। সারারাত সূর্যটা কোথায় ছিল, কে জানে। দিগন্তের তলা থেকে সোনার গোল ঘটের মতো হঠাৎ লাফ দিয়ে উঠে এল। তার উদ্দেশে প্রণাম জানিয়ে হেমনাথ ঘুরে দাঁড়ালেন। বললেন, কি রে, অত ডাকাডাকি কেন?

ভারী গলায় ঝিনুক বলল, তোমার সঙ্গে আমি কথা বলব না। কক্ষনো না, কিছুতেই না।

কেন? কী হয়েছে?

না না, কথা বলব না। বলেই দুপদাপ পা ফেলে ঘরের দিকে চলল ঝিনুক। বোঝা গেল, খুব রাগ করেছে সে।

হেমনাথের দেখাদেখি সূর্যপ্রণাম করে বিনুও ঘুরে দাঁড়িয়েছিল। এই সকালবেলায় ঝিনুকের এত রাগের কারণ সে বুঝতে পারল না। অবাক চোখে তাকিয়ে থাকল বিনু।

লম্বা পায়ে ছুটে গিয়ে ঝিনুককে ধরে ফেললেন হেমনাথ, তারপর টপ করে একেবারে কোলে তুলে নিলেন।

ঝিনুক সমানে হাত-পা ছুঁড়তে লাগল, ছেড়ে দাও, আমায় ছেড়ে দাও বলছি। তোমার কোলে আমি উঠব না, তোমার সঙ্গে কথা বলব না।

হেমনাথ ছাড়লেন না। বরং কোলের ভেতর ঝিনুককে চেপেচুপে রেখে হেসে হেসে ছড়া কাটতে লাগলেন :

রাগ করছেন রাগুনি,
রাঙা মাথায় চিরুনি,
বর আসবে এক্ষুনি
নিয়ে যাবে তক্ষুনি।

ঝিনুকের দাপাদাপি আর হাত-পা ছোঁড়া আরও বেড়ে গেল। অনেক কষ্টে বুঝিয়ে সুঝিয়ে গায়ে মাথায় হাত বুলিয়ে তাকে শান্ত করলেন হেমনাথ। বললেন, সকালবেলায় ঝিনুক দিদির এত রাগ কেন, এবার বল দিকি?

ঝিনুক বলল, তুমি আমায় ডেকে তোল নি কেন?

কখন রে?

একটু আগে।

তখন তুই ঘুমোচ্ছিলি যে—

কোঁকড়ানো চুল আঁকিয়ে ঝিনুক বলল, উঁহু-উঁহু–

হেমনাথ সবিস্ময়ে বললেন, ঘুমোচ্ছিলি না!

না। ঝিনুক বিনুকে দেখিয়ে বলতে লাগল, তুমি ওকে ডাকলে, আমাকে ডাকলে না।

ওকে ডেকেছি, তুই জানিস?

হ্যাঁ, জানি। একশ’ বার জানি।

জানিস যদি, উঠে পড়লি না কেন?

উঠব না, কিছুতেই না। ঝিনুক বলতে লাগল, ওকে ডেকে তুলবে আর আমাকে ডাকবে! না ডাকলে উঠব কেন?

এবার ব্যাপারটা খানিক আন্দাজ করতে পারলেন হেমনাথ। চোখ বড় বড় করে সকৌতুকে বললেন, বিনু দাদাকে ডাকলে তোকেও ডাকতে হবে, এই তো?

হ্যাঁ।

বেশ, কাল থেকে ভোরবেলা উঠবি। ডাকামাত্র উঠে পড়তে হবে।

আচ্ছা।

একটু নীরবতা। তারপর ঝিনুকের চিবুক আঙুল দিয়ে ঠেলে তুলে হেমনাথ বললেন, পেট বোঝাই তোমার হিংসে।

দেখতে দেখতে রোদ উঠে গেল। খানিক আগেও আমবাগান, পুকুর, ধানবন, সুদূর আকাশ সব কিছু ঝাঁপসা হয়ে ছিল। সারাটা বর্ষার জলে ধুয়ে ধুয়ে এই আশ্বিনে আকাশখানি বড় উজ্জ্বল, বড় ঝকমকে। এক দিগন্ত থেকে আরেক দিগন্ত পর্যন্ত নীল চাদোয়া টাঙানো রয়েছে।

.

এ বাড়িতে এখন আর কেউ ঘুমিয়ে নেই। অবনীমোহন সুরমা সুধা সুনীতি, সবাই উঠে পড়েছে।

পুবের ঘরের বারান্দায় সিঁড়ি পেতে বসে এই মুহূর্তে সকালবেলার খাওয়ার পর্ব চলছে।

খেতে খেতে হেমনাথ বললেন, কাল রাত্তিরে ঝিনুকের কথা কী যেন বলছিলে, ঠিক খেয়াল

করিতে খেতে হেমনাথ লড়ি পেতে বসে এই মুন্ত সুরমা সুধা সুনীতি,

স্নেহলতা বললেন, ও এখন কিছুদিন এখানে থাকবে।

বেশ তো।

ঝিনুক বাড়ি থাকলে ভবতোষ কোথাও বেরুতে টেরুতে পারে না। বেরুলেও সঙ্গে সঙ্গে নিয়ে ঘুরতে হয়। ছেলেটা ভারি মুশকিলে পড়ে গেছে।

একটু চুপ করে থেকে হেমনাথ বললেন, কাল কখন ঝিনুককে দিয়ে গেছে?

স্নেহলতা বললেন, তোমরাও হাটে বেরিয়েছ, ওরাও এসেছে।

ভবতোষ আর কী বললে?

কী ব্যাপারে?

বৌমার কোনও খবর আছে?

না। ও মেয়ে সংসার করবার মেয়ে নয়। চলে যে গেছে, সে একরকম ভালই হয়েছে।

খানিক গাঢ় বিষাদ আশ্বিনের এই ঝলমলে সকালটাকে যেন নিমেষে মলিন করে দিল।

কিছুক্ষণ নীরবতা। তারপর একেবারে ভিন্ন প্রসঙ্গে চলে গেলেন হেমনাথ। সুরমার দিকে ফিরে বললেন, কদিন যেন এখানে এসেছিস–

সুরমা বললেন, তিন চার দিন।

বলতে নেই, এই ক’দিনে তোকে বেশ ভাল দেখাচ্ছে। সেই ফ্যাকাসে রুগ্ণ ভাবটা নেই। স্টিমার থেকে যখন নামলি মুখখানা এই এতটুকু। গায়ে রক্ত নেই, হাঁটতে গিয়ে হাঁপিয়ে পড়ছিলি।

স্নেহলতা এই সময় ঝংকার দিয়ে উঠলেন, বলতে নেই বলতে নেই করে তো সবই বলে ফেললে। ভাল ভাল বলে রোগা মেয়েটার দিকে নজর দিতে হবে না।

হেমনাথ হেসে ফেললেন, বেশ, আর বলব না। নজরও দেব না।

সুরমা বললেন, কেন বলবে না, নিশ্চয়ই বলবে। ভাল হলে ভাল বলবে না? সত্যি, আগের চাইতে কিছুটা সুস্থ লাগছে।

হেমনাথ বাড়িয়ে কিছু বলেন নি। সামান্য কয়েক দিনে সুরমার চেহারায় সোনার কাঠির ছোঁয়া লেগে গেছে যেন। তাকে রীতিমত উজ্জ্বল আর সজীব দেখাচ্ছে। পরিবর্তনটা চোখে পড়ে।

অবনীমোহন এতক্ষণ চুপ করে খেয়ে যাচ্ছিলেন। এবার বললেন, রাজদিয়া সত্যি সত্যি টনিকের কাজ করতে শুরু করেছে।

আসবার সময় স্টিমারে টনিকের কথা অবনীমোহন বলেছিলেন। সুরমা হাসলেন, কিছু বললেন না।

হঠাৎ হেমনাথের কী মনে পড়ে যেতে তাড়াতাড়ি বলে উঠলেন, ভাল কথা—

স্নেহলতা জিজ্ঞাসু চোখে তাকালেন, কী?

দু’দিন ধরে সেই বাঁদরটাকে তো দেখছি না। কোথায় গা ঢাকা দিলে সে?

কার কথা বলছ?

কার আবার, আমার প্রতিদ্বন্দ্বী সেই হিরণ ছোঁড়ার। বলে আড়ে আড়ে সুধার দিকে একপলক তাকিয়ে নিলেন।

সুধা সুনীতি আর বিনু একধারে বসে খাচ্ছিল। বিনু শুনতে পেল, চাপা গলায় সুনীতি সুধাকে বলছে, দাদু তোর দিকে কেমন করে যেন তাকাচ্ছে।

মুখ নিচু করে সুধা বলল, তাকাগ গে।

সেই বাঁদরটা কোথায় গেছে জানিস?

ঠোঁট উলটে সুধা বলল, জানতে বয়ে গেছে।

মুখ টিপে, সুর টেনে টেনে সুনীতি বলল, তাই নাকি?

হ্যাঁ হ্যাঁ, তাই।

এই সময় স্নেহলতা বলে উঠলেন, সত্যিই তো, ছেলেটা গেল কোথায়? রোজ দু’বেলা হাজিরা দিচ্ছিল। হঠাৎ হল কী? বলতে বলতে গলা চড়িয়ে ডাকতে লাগলেন, যুগল, যুগল–

আশেপাশে কোথাও ছিল যুগল। ছুটতে ছুটতে সামনে এসে দাঁড়াল, কী ক’ন ঠাউরমা?

হিরণদের বাড়ি একবার যা, ওকে সঙ্গে করে নিয়ে আসবি।

যুগল তক্ষুনি ছুটল।

এরপর সুজনগঞ্জের হাটের কথা উঠল, লালমোরের কথা হল, কালকের সেই মজার ঢেঁড়াটার কথা নিয়ে অনেক হাসাহাসি চলল। এ সবের ফাঁকে হেমনাথ টুক করে একবার বললেন, ভাবছি, আমিও একটা ঢেঁড়া দেব কিনা।

হাসতে হাসতে থমকে গেলেন স্নেহলতা। কিছু একটা আন্দাজ করেছেন তিনি। তীক্ষ্ণ দ্রুকুটিতে স্বামীকে বিদ্ধ করতে করতে বললেন, তুমি আবার কিসের ঢেঁড়া দেবে?

এখনই শুনবে?

এখনই শুনব।

নির্ভয়ে বলি?

খালি প্যাকনা (ন্যাকামো)।

হেমনাথ বললেন, ঢেঁড়াটা হবে এইরকম। জেলা ঢাকা, থানা মুন্সিগঞ্জ, শহর রাজদিয়ার শ্ৰীহেমনাথ মিত্রের বড় বিপদ। কী বিপদ? না চল্লিশ বছর ঘর করার পরও সে তার বউর মন পায় নি। আপনারা জেনে রাখুন–মিঞা ভাইরা, হিন্দু ভাইরা–হেমকর্তার ধর্মপত্নীর মন অন্য পুরুষে মজেছে।

কথাটা শেষ হতে না হতেই হাসির ধুম পড়ে গেল। অবনীমোহন আর সুরমা অবশ্য মুখ টিপে হাসছেন, ভেতরের উচ্ছ্বসিত কৌতুকটাকে বেরিয়ে আসতে দিচ্ছেন না। সুধা সুনীতি কিন্তু হেসে একেবারে গড়িয়ে পড়ছে। বিনু প্রায় কিছুই না বুঝে আর সবার দেখাদেখি বিজ্ঞের মতো হাসছে।

আড়ে আড়ে সুধা সুনীতির দিকে একবার তাকিয়ে হেমনাথ বললেন, ঢেঁড়ার কথা কিন্তু শেষ হয় নি, আরও একটু আছে।

হাসতে হাসতেই সুধা সুনীতি বলল, আরও কী?

হেমনাথ বলতে লাগলেন, মিঞা ভাইরা, হিন্দু ভাইরা–সাকিন রাজদিয়ার হেমকর্তা এই বিপদে তো চুপ করে বসে থাকতে পারে না। তাই সে ঠিক করেছে পুরনো বউকে তালাক দিয়ে আগামী অঘ্রাণ মাসে একজোড়া তরুণী ভার্যা ঘরে তুলবে। তাদের একজনের নাম সুধামুখি, আরেক জনের। নাম সুনীতিলতা।

স্নেহলতা মধুর কৌতুকময় হেসে বললেন, ঢেঁড়াতে আমার আপত্তি নেই।

হেমনাথ বললেন, প্রস্তাবটা তা হলে অনুমোদন করছ?

করছি।

এদিকে সুধা সুনীতির হাসি থেমে গিয়েছিল। তারা ঝংকার দিয়ে উঠল, বুড়োর ভার্যা হতে আমাদের বয়ে গেছে।

করুণ মুখে হেমনাথ বললেন, বুড়ো বলে দাগা দিলে দিদিরা! সত্যিই কিন্তু আমি বুড়ো হই নি। এই দেখ, একটাও দাঁত পড়ে নি, মাড়ি কী মজবুত!

সুধা বলল, বুড়ো তো হন নি, তবে চুল সাদা হল কী করে?

বয়েসের জন্যে না রে দিদি, কুপিত বায়ুর দোষে।

আর চামড়া কোঁচকালো কেন?

হজমের গোলমালে।

গল্পে গল্পে, হাসাহাসি আর লঘু কৌতুকে সকালটা কাটতে লাগল। খাওয়ার পালা যখন শেষ হয়ে এসেছে সেই সময় বাইরে বাগানের দিক থেকে একটা গলা ভেসে এল, জেঠামশায়– জেঠামশায়–

হেমনাথ ঘুরে বসে সাড়া দিলেন, কে রে?

আমি শিশির!

আয় আয়- হেমনাথ ব্যস্ত হয়ে উঠোনে নামলেন।

একটু পর শিশিররা ভেতরে চলে এলেন। দেখা গেল, শিশির একাই নন, তার সঙ্গে স্মৃতিরেখা, রুমা ঝুমা এবং তাদের মামা আনন্দও এসেছে।

শিশির বললেন, আপনার বৌমাদেরও দিয়ে এলাম।

আনবিই তো। আনতেই তো বলেছিলাম। এস, এস সবাই–

এদিকে বারান্দার আরেক কোণে একটা মজার ব্যাপার চলছিল। বিনু দেখতে পেল, আনন্দকে দেখিয়ে সুধা সুনীতিকে বলছে, দিদি, সেই ভদ্রলোক এসেছে। যার দিকে

ভুরু কুঁচকে সুনীতি বলল, যার দিকে কী?

ঠোঁটের ফাঁকে প্রগলভ একটি হাসি টিপে রেখে সুধা বলল, যার দিকে তাকিয়ে সেদিন তুই একেবারে মুগ্ধ–মুগ্ধ–মুগ্ধ—মুগ্ধ–

কথা শেষ হবার আগেই সুধার পিঠে দুম করে কিল পড়ল।

হেমনাথ বললেন, এখানে না। চল ঘরে গিয়ে বসি—

শিশিরদের সঙ্গে নিয়ে সামনের বড় ঘরখানায় গিয়ে ঢুকলেন হেমনাথ। স্নেহলতা সুরমা অবনীমোহনরাও পিছু পিছু এলেন। সুধা সুনীতি ঝিনুক কিংবা বিনু বাইরে বসে থাকল না, তারাও এল।

স্নেহলতা আর শিবানী শিশিরকে চেনেন, স্মৃতিরেখাকে চেনেন, রুমা ঝুমাকে চেনেন। না চিনে যাবেন কোথায়? এই রাজদিয়ারই তো ছেলে শিশির, ছেলেবেলা থেকে তাকে দেখে আসছেন। চাকরির খাতিরেই না হয় ক’বছর দেশছাড়া শিশির।

স্নেহলতা এবং শিবানী আনন্দকে চিনতেন না, হেমনাথ তাদের সঙ্গে পরিচয় করিয়ে দিলেন। সুরমা কাউকেই চেনেন না, তার সঙ্গেও ওর আলাপ করিয়ে দেওয়া হল। আর অবনীমোহনদের সঙ্গে শিশিরদের তো আগেই আলাপ হয়ে গেছে।

এ ঘরে ঢালা তক্তপোশ পাতা। হেমনাথ বললেন, বসো সব, বসো–

সবাই বসলে শিশির স্নেহলতা আর শিবানীর উদ্দেশে বললেন, কেমন আছেন পিসিমা? কেমন আছেন জেঠাইমা?

শিবানী বললেন, ভাল আছি বাবা। তোরা সবাই ভাল তো?

শিশির বললেন, হ্যাঁ।

স্নেহলতা বললেন, আমি কিন্তু ভাল নেই শিশির।

ঈষৎ উদ্বেগের সুরে শিশির শুধোলেন, কেন?

ছেলেরা যদি দেশের বাড়ি ছেড়ে দূরে গিয়ে থাকে, মা-জেঠিরা ভাল থাকতে পারে না।

মুখখানা কাচুমাচু করে শিশির বললেন, কী করব, চাকরি। চাকরির জন্যেই দূরে গিয়ে থাকতে হয়। নইলে আপনাদের ছেড়ে কলকাতায় থাকতে কি আমার ভাল লাগে?

স্নেহলতা হাসলেন, বুঝলাম। একটু থেমে আবার বললেন, তোর ওপর আমি কিন্তু খুব রাগ করেছি।

শিশির তটস্থ হয়ে উঠলেন, কেন?

খবর পেয়েছি চার পাঁচ দিন আগে রাজদিয়া এসেছিস। এতদিনে আমার সঙ্গে দেখা করার সময় হল বুঝি?

বিব্রতভাবে শিশির বললেন, রোজই ভাবি আসব। বেরুবার মুখে কেউ না কেউ এসে পড়ছে, এ বাড়িতে আসাই আর হচ্ছে না। আজ তাই ভোরবেলা উঠেই বেরিয়ে পড়েছি।

শিবানী বললেন, কেউ এসে পড়বার আগেই, না রে?

শিশির হাসলেন, হ্যাঁ।

স্নেহলতা কিন্তু এই কৈফিয়তে খুশি হলেন না। অভিমানের সুরে বললেন, দায় সারতে যখন এসেছিস তখন বোস, আমি আসছি। দরজা পর্যন্ত গিয়ে ঘুরে দাঁড়িয়ে বললেন, দুপুরবেলা দয়া করে এখানে দুটি খেয়ে যাবার সময় হবে তো?

তাড়াতাড়ি মাথা নেড়ে শিশির বলে উঠলেন, হ্যাঁ হ্যাঁ, আপনি না বললেও খাব। না খেয়ে এখান থেকে যাচ্ছি না।

খুব ব্যস্তভাবে এইসময় স্মৃতিরেখা কী বলতে যাচ্ছিলেন, ইশারায় তাকে থামিয়ে দিলেন শিশির।

স্নেহলতা চলে গেলেন।

আস্তে আস্তে স্মৃতিরেখা স্বামীকে বললেন, তুমি কী বল তো! আজ এখানে থেকে বেরিয়ে গুহদের বাড়ি যাবার কথা ছিল না? সেদিন ওরা অত করে বলে গেল!

শিশির বললেন, এখান থেকে না খেয়ে যাবার সাধ্য আমার নেই। গুহদের বাড়ি আরেক দিন। যাওয়া যাবে।

বেশ বললে! ওঁরা আমাদের জন্যে বসে থাকবেন না?

আমি খবর পাঠিয়ে দিচ্ছি। বলে শিশির হেমনাথের দিকে তাকালেন, জেঠামশায়, আপনাদের সেই ছেলেটা কোথায়? কী যেন নাম–

হেমনাথ বললেন, যুগলের কথা বলছিস?

হ্যাঁ, যুগল—

ওকে হিরণদের বাড়ি পাঠিয়েছি। অনেকক্ষণ গেছে, এখুনি ফিরে আসবে।

হেমনাথের কথা শেষ হতে না হতেই যুগল এসে পড়ল। ছুটতে ছুটতে এসেছে, ফলে হাঁপাচ্ছিল। বলল, হিরণদাদায় বাড়ি নাই।

হেমনাথ শুধোলেন, গেছেন কোথায় বাবু?

বিষ্যুদবার মানিকগুঞ্জে গ্যাছে, অহন তরি (পর্যন্ত) ফিরে নাই।

কবে ফিরবে, বলে গেছে?

না।

হেমনাথ বললেন, আচ্ছা, এখন শিশির কী বলছে শোন–

শিশির যুগলকে গুহদের বাড়ি পাঠালেন। বলে দিলেন, দু’তিন দিন পর তাদের ওখানে যাবেন। বলমাত্র যুগল তীরের মতো ছুটল।

একটু পর বড় বড় কাঁসার থালায় চিড়ের মোয়া, কদমা, পাতক্ষীর, সন্দেশ আর দোভাজা চিড়ে, নারকেল কোরা দিয়ে সাজিয়ে নিয়ে এলেন স্নেহলতা। একা তো আর অতগুলো থালা আনা যায় না। সেই বিধবা দুটিও ক’টা থালা নিয়ে এসেছে।

এ ঘরে ঢুকেই স্নেহলতা বললেন, যুগলের গলা পাচ্ছিলাম যেন

হ্যাঁ– হেমনাথ মাথা নাড়লেন।

গেল কোথায়?

যুগল কোথায় গেছে, হেমনাথ বললেন।

স্নেহলতা শুধোলেন, হিরণের খবর কী?

মানিকগঞ্জে গেছে।

হঠাৎ মানিকগঞ্জে?

কি জানি, যুগল কিছু বলত পারল না।

বাবুর কবে ফেরা হবে?

হিরণই জানে। বাড়িতে কিছু বলে যায় নি।

এ প্রসঙ্গে আর কোনও প্রশ্ন করলেন না স্নেহলতা। রুমা ঝুমা-আনন্দ, সবার হাতে হাতে একটা করে কাঁসার থালা দিয়ে যেতে লাগলেন। দেওয়া হয়ে গেলে স্মৃতিরেখাকে ডাকলেন, বৌমা–

স্মৃতিরেখা তাকালেন। চোখে চোখ পড়তে স্নেহলতা বললেন, তোমার কাছে আমার একটা অভিযোগ আছে।

স্মৃতিরেখা হকচকিয়ে গেলেন, কী ব্যাপারে?

তোমারই ব্যাপারে। এই বয়েসে তোমরা কি আমার ঘর ভাঙাতে চাও?

মুখচোখ লাল হয়ে উঠল স্মৃতিরেখার। শিথিল কাঁপা গলায় বললেন, আপনি কী বলছেন, বুঝতে পারছি না।

ঘরের অন্য সবাই অবাক হয়ে গিয়েছিল। স্নেহলতার স্বভাব এত কোমল, এত মধুর যে সরাসরি এমন আক্রমণ করে বসতে পারেন, তা যেন ভাবাই যায় না।

স্নেহলতা বললেন, বুঝতে যখন পারছ না তখন বুঝিয়ে দিচ্ছি। রুমা ঝুমাকে দেখিয়ে বললেন, এই সব সুন্দর সুন্দর পরীদের সামনে এনে ধরছ, এরপর আমার ওপর বুড়োর মন কি থাকবে? বলে হেমনাথের দিকে আড় চাহনির বাণ হানলেন।

এতক্ষণে ব্যাপারটা পরিষ্কার হয়ে গেল। সবাই উঁচু গলায় শব্দ করে হেসে উঠল।

হাসির শব্দটা মিলিয়ে যেতে না যেতে স্নেহলতা আবার বললেন, রমু তো আগেই আমার সর্বনাশ করে রেখেছে। ওই দুটিকে নিয়ে এসেছে– আঙুল বাড়িয়ে সুধা-সুর্নীতিকে দেখিয়ে বলতে লাগলেন, সব সময় ওদের ভয়ে আমি কাঁটা হয়ে আছি। তা ছাড়া ওই পুচকেটাকে দেখ–

স্নেহলতার আঙুল অনুসরণ করে সবার দৃষ্টি পড়ল ঝিনুকের ওপর।

স্নেহলতা বললেন, উনিও কম যান না। আমার সতীন হতে চান।

হাসতে হাসতে হেমনাথ বললেন, ভাবছি এদের নিয়ে একটা মোগল হারেম খুবই খুলব। তুমি হবে হেড বেগম, বাকি সবাই তোমার বাঁদী।

কথাটা শেষ হল কি হল না, তার আগেই ঘরময় চেঁচামেচি শুরু হয়ে গেল। রুমা ঝুমা-সুধা সুনীতি একসঙ্গে গলা মেলাল, বাঁদী হতে আমাদের বয়ে গেছে। কক্ষনো না, কক্ষনো না।

হালকা হাওয়ায় সবাই যখন রঙিন প্রজাপতিটি হয়ে ভেসে চলেছে সেইসময় ঝিনুককে দেখিয়ে শিশির বললেন, এই মেয়েটা কে, জেঠামশায়?

হেমনাথ বললেন, তোদের বলি নি বুঝি?

আজ্ঞে না।

ও হল ভবতোষের মেয়ে–

লাহিড়ী বাড়ির ভবতোষ?

হ্যাঁ।

সে এখানকার কলেজে প্রফেসরি করে না?

হেমনাথ মাথা নাড়লেন।

ভবতোষের মেয়ে এখানে যে?

হেমনাথ বললেন, ও মাঝে মাঝে এখানে এসে থাকে। মেয়েটাকে নিয়ে ভব বড় মুশকিলে পড়েছে।

শিশির কৌতূহলী হলেন, কিসের মুশকিল?

হেমনাথ লক্ষ করলেন, একদৃষ্টে তার দিকে তাকিযে. আছে বিনু। ঈষৎ স্বলিত স্বরে বললেন, ব্যাপারটা ভারি স্যাড। এখন না, তোকে পরে বলব।

একটু নীরবতা। তারপর প্রসঙ্গটাকে অন্য দিকে ঘুরিয়ে দেবার জন্য স্ত্রীর দিকে ফিরে হেমনাথ তাড়াতাড়ি বলে উঠলেন, তোমাকে একটা খবর দেওয়া হয় নি।

স্নেহলতা জিজ্ঞাসু চোখে তাকালেন, কী?

আনন্দ মস্ত শিকারি। সুন্দরবনে গিয়ে বড় বড় বাঘ মেরে এসেছে।

তাই নাকি!

হ্যাঁ- হেমনাথ মাথা হেলিয়ে বলতে লাগলেন, সেদিন শিশিরদের বাড়ি গিয়েছিলাম আনন্দর নিজের মুখে শিকারের গল্প শুনে এসেছি।

স্নেহলতা এবার পরিপূর্ণ চোখে আনন্দের দিকে তাকালেন, বাঘ মেরেছে, এমন লোক আগে আর দেখি নি। এই প্রথম দেখলাম।

আনন্দ হাসল।

স্নেহলতা আবার বললেন, অবশ্য মুখে বাঘ ভাল্লুক মারে, এমন মানুষ সর্বক্ষণই দেখছি। বলে চোরা চোখের দৃষ্টি হেনে স্বামীকে বিদ্ধ করলেন।

হেমনাথও কম যান না। আনন্দর উদ্দেশে বললেন, তোমাকে দেখবার ঢের আগেই আমি বাঘশিকারি দেখেছি, আর তাকে নিয়েই সারাজীবন–

আনন্দ শুধলো, সারা জীবন কী?

ঘর করছি।

কৌতুকের একটি ফোয়ারা কোথায় কোন অদৃশ্যে যেন ফুটি ফুটি করছে।

যে কোনও মুহূর্তে সহস্র ধারায় সেটা ফিনকি দিয়ে বেরিয়ে আসবে। সবাই তা টের পেয়ে গেছে। বুঝি, আর গেছে বলেই তাদের ঠোঁটে চোখে হাসি ছলকে যাচ্ছে।

স্নেহলতা ভুরু কুঁচকে বললেন, তাই নাকি? আমি বাঘ মেরেছি?

নিশ্চয়ই– হেমনাথ বললেন, বিয়ের আগে বাঘই ছিলাম গো।

তারপর?

তুমি এসে সেই বাঘটাকে মেরে একেবারে পোষা বেড়াল করে ছেড়েছ। তোমার কথায় সে এখন ওঠে, বসে। তোমার পায়ে পায়ে ঘুর ঘুর করে। চোখ পাকালে ভ্যাক করে কেঁদে ফেলে পর্যন্ত।

যে হাসিটা এতক্ষণ আধোগোপন ছিল, এবার তা আতসবাজির মতো ফস করে জ্বলে উঠল।

স্নেহলতা কপট রাগে আরেক বার প্রভঙ্গ করতে গিয়ে নিজেও হেসে ফেললেন। বাইরে বিব্রত, অথচ তলায় সুখী–এমন একটা ভাব করে বললেন, হয়েছে, খুব হয়েছে।

হাসিটা খানিক স্তিমিত হয়ে এলে স্নেহলতা আনন্দকে বললেন, বাঘ মারার গল্প আমাকেও কিন্তু বলতে হবে।

আনন্দ খুব সপ্রতিভ ছেলে। তাড়াতাড়ি বলে উঠল, নিশ্চয়ই বলব। এখুনি শুনবেন?

স্নেহলতা কিছু বলতে যাচ্ছিলেন, তার আগেই সুধা বলল, হ্যাঁ, এখনই আমরা শুনব। জানেন–

সুধা-সুনীতি-বিনু এবং ঝিনুক শিশিরদের সঙ্গে ঘরের ভেতর পর্যন্ত আসে নি, দরজার কাছটায় দাঁড়িয়ে ছিল। আনন্দ মুখ ফিরিয়ে সুধার দিকে তাকাল।

সুধা বলল, দিদি না–

কথাটা শেষ হল না। সুধার একটা হাত ধরে জোরে টান লাগাল সুনীতি। চাপা গলায় বলল, ভাল হবে না কিন্তু সুধা।

সুধা গ্রাহ্যও করল না। আড়ে আড়ে সুনীতিকে একবার দেখে নিয়ে খুব নিরীহ মুখ করে বলল, সেদিন শিকারের গল্প শুনে দিদি না একেবারে বিভোর হয়ে গিয়েছিল। আপনার খুব ভক্ত হয়ে উঠেছে। বলুন, শিকারের যত গল্প আপনার জানা আছে বলে যান।

হাসিভরা উজ্জ্বল চোখে সুনীতিকে এক পলক দেখে নিল আনন্দ, কিছু বলল না।

লজ্জায় সুনীতির মুখ এখন আরক্ত, কারোর দিকে তাকাতে পারছিল না সে। নতচোখে ফিসফিসিয়ে শুধু বলতে পারল, বাঁদর মেয়ে, ওরা যাক। তারপর তোমার একদিন কি আমার একদিন।

সুধা গলা নামিয়ে বলল, তখন বুঝি মনে ছিল না?

সুনীতি বলল, কী?

হিরণবাবুর নাম করে আমার পেছনে লেগেছিলি।

শোধ তুললি বুঝি?

নিশ্চয়ই। জানিস না ঢিলটি মারলে পাটকেলটি খেতে হয়।

জানতাম, মনে ছিল না।

এখন থেকে মনে রাখিস।

এদিকে স্নেহলতা বললেন, এখন তো আমি বসতে পারব না, রান্নাবান্না আছে। ওদের সঙ্গে গল্পটল্প কর আনন্দ। আমি পরে শুনে নেব।

আচ্ছা– আনন্দ মাথা নাড়ল।

স্নেহলতা শিবানী আর সেই বিধবা মেয়ে দুটিকে নিয়ে চলে যাচ্ছিলেন। হঠাৎ তার খেয়াল হল, এখন পর্যন্ত কেউ খাবারের থালায় হাত দেয় নি। ব্যস্তভাবে তিনি বললেন, ওই দেখ, তোমাদের শুধু বকিয়েই মারছি। খাও, খাও’ বলে চলে গেলেন।

অবনীমোহন উৎসাহের সুরে বললেন, খেয়েদেয়ে একটা ভাল দেখে শিকার কাহিনী আরম্ভ কর আনন্দ।

আনন্দ নিঃশব্দে হাসল, অর্থাৎ এ প্রস্তাবে তার আপত্তি নেই। ওদিকে আরেকটা ব্যাপার চলছিল। খুব তাড়াতাড়ি খেয়ে যাচ্ছিল ঝুমা আর বাঁ হাত দিয়ে সমানে বিনুকে ইশারা করছিল।

প্রথমটা লক্ষ করে নি বিনু। হঠাৎ একসময় চোখে পড়ে গেল। চোখাচোখি হতেই জোরে হাতছানি দিতে লাগল ঝুমা।

একটুক্ষণ দাঁড়িয়ে থাকল বিনু, তারপর পায়ে পায়ে ঝুমার কাছে এসে দাঁড়াল।

ঝুমা এই বয়সেই বেশ পাকা। সে বলল, বারে, তোমাদের বাড়ি এলাম, আর তুমিই ওখানে দাঁড়িয়ে আছ!

বিনু বলল, তুমি খাচ্ছিলে কিনা—

ঝুমা খেতে খেতে বলল, তোমার ওপর আমি খুব রাগ করেছি।

কেন?

তুমি তো আমাদের বাড়ি গেলে না। তোমার জন্যে এয়ার-গান ঠিক করে রেখেছিলাম। ক্যারম খেলব ভেবেছিলাম, লুডো খেলব ভেবেছিলাম–

আমি তো তোমাদের বাড়ি চিনি না।

চোখ বড় করে, টেনে টেনে ঝুমা বলল, চেনো না!

না।

সেদিন গেলে না?

মোটে তো একদিন। বলতে বলতে কী মনে হতে অদূরে দরজার কাছটায় তাকাল বিনু। দেখল, সুধাও সুনীতির গা ঘেঁষে দাঁড়িয়ে তার দিকেই একদৃষ্টে তাকিয়ে আছে ঝিনুক। চোখের পাতা পড়ছে না মেয়েটার।

ঝুমা গম্ভীর গলায় বলল, একদিন গেলেই চিনে রাখা যায়। এই যে আজ তোমাদের বাড়ি এলাম, আর আমাকে চিনিয়ে দিতে হবে না। দেখবে, ঠিক চলে এসেছি।

ঝিনুকের দিক থেকে চোখ ফিরিয়ে বিনু বলল, দাদুকে বলব, তোমাদের বাড়ি নিয়ে যেতে–

কণ্ঠস্বরে লম্বা টান দিয়ে ঝুমা বলল, এ মা—

বিনু অবাক। বলল, কী হল?

বুড়ো ধাড়ি ছেলে, একা একা যেতে পারবে না। আবার দাদুকে সঙ্গে চাই! নাক কুঁচকে ধিক্কার দিয়ে দিয়ে হেসে উঠল ঝুমা।

মুখ লাল হয়ে গেল বিনুর। কী বলতে চেষ্টা করল, পারল না।

এদিকে আনন্দর খাওয়া হয়ে গিয়েছিল। অবনীমোহন যেন উন্মুখ হয়েই ছিলেন। বললেন, শিকার কাহিনী শুরু করে দাও।

ঝুমা বিনুর দিকে আরেকটু এগিয়ে এসে নিচু গলায় ডাকল, এই—

ঘাড় ফিরিয়ে তাকাল বিনু।

আগের স্বরেই ঝুমা বলল, চল, আমারা পালাই—

আধফোঁটা গলায় বিনু শুধলো, কোথায়?

ওই বাগান টাগানে সামনের দিকে আঙুল বাড়িয়ে দিল ঝুমা।

শিকারের গল্প শুনবে না?

আমরা ঢের শুনেছি।

বিনুর যেতে ইচ্ছে করছিল না। সে বলল, আমি তো শুনি নি।

তোমাকে পরে বলে দেব। এখন ওঠ তো। ঝুমা তাড়া লাগল, ওঠ না–

বিনু উঠতে যাবে, তার কানে ঝুমা ফিসফিস করল, মামার গল্প একদম বিশ্বাস করবে না।

অপার বিস্ময়ে বিন বলল, কেন?

দিদি বলে, মামা মশা ছারপোকা ছাড়া কোনও দিন কিছু মারে নি।

আড়চোখে একবার রুমাকে দেখে নিয়ে বিনু বলল, তা হলে এই সব গল্প—

একেবারে গাঁজা। বানিয়ে বানিয়ে বলে। নাও, এখন চল–

ঝুমার সঙ্গে বেরিয়ে পড়ল বিনু। যেতে যেতে দরজার কাছটায় সে লক্ষ করল, ঝিনুক সেইরকম পলকহীন তাকিয়ে আছে। তার পাশ দিয়ে বিনুরা উঠোনে নেমে গেল।

উঠোনের শেষ মাথায় এসে মনে হতে লাগল, আলতোভাবে তার পিঠটা কেউ ছুঁয়ে যাচ্ছে। তাড়াতাড়ি ঘুরে দাঁড়াতেই দেখতে পেল, কেউ না। শুধু দূরে দরজার ওপর ডিঙি মেরে দাঁড়িয়ে আছে ঝিনুক, তেমনি একইভাবে তাকিয়ে রয়েছে। এখনও মেয়েটার চোখে পলক পড়ে নি।

বাগানে এসে ঝুমার সঙ্গে ছোটাছুটি করে ফড়িং ধরল বিনু। কোথায় কোন অলক্ষ্যে বসে ঝিঁঝিরা একটানা করুণ সানাই বাজিয়ে যাচ্ছিল, তাদের খুঁজে বার করতে চেষ্টা করল, পারল না অবশ্য। করমচা ফুলের কুঁড়ি ছিঁড়ল রাশি রাশি, জামরুল পাতা কুচিকুচি করে হাওয়ায় উড়িয়ে দিতে লাগল। ডুমুর গাছের মগডালে জোড়া জোড়া মোহনচূড়া পাখি বসে ছিল, তাদের দিকে ঢিল ছুঁড়ল। অনেক উঁচুতে সুপুরি গাছের মাথায় বসে ছিল কয়েকটা হলদিবনা। সবটুকু জোর দিয়ে ঢিল ছুঁড়েও যখন নাগাল পাওয়া গেল না, তখন হুস হুস শব্দ করে চেঁচিয়ে তাদের উড়িয়ে দিল।

গাছপালা তছনছ করে, পতঙ্গ আর পাখিদের রাজ্যে আতঙ্ক ছড়াতে ছড়াতে হঠাৎ ঝুমার নজর গেল পুকুরঘাটের দিকে। খুশি গলায় সে চেঁচাল, এই–

কী? বিনু তাকাল ঝুমার দিকে।

ওই দেখ কী মজা। বলে আঙুল বাড়িয়ে দিল ঝুমা।

বিনু দেখল, পুকুরঘাটে নৌকো বাঁধা রয়েছে–নতুন নৌকো। কাল হাট থেকে হেমনাথ এটা কিনে এনেছেন।

হাততালি দিতে দিতে ঝুমা বলল, চল, নৌকো চড়ব—

বিনু ভয়ে ভয়ে বলল, নৌকো তো চড়বে, চালাবে কে?

কেন, তুমি আর আমি।

আমি নৌকো চালাতে পারি না।

আমিও পারি নাকি?

তা হলে?

চালাতে চালাতে শিখে যাব।

কুমার তর সইছিল না। বিনুর একটা হাত ধরে টানতে টানতে অস্থির গলায় বলল, চল না–

ঝুমার সঙ্গে যেতে যেতে বিনু বলল, যদি আমরা নৌকো থেকে জলে পড়ে যাই?

পড়ে গেলে সাঁতরে উঠে পড়বে। তুমি সাঁতার জানো না?

ওইটুকু পুচকে মেয়েটা সাঁতার জানে, আর সে জানে না, এই কথাটা কিছুতেই বলতে পারল না বিনু। মনে মনে ভাবল, যুগলকে আর ছাড়াছাড়ি নেই, সাঁতারটা তাকে শিখে নিতেই হবে।

বিনু সাঁতার জানে কি জানে না, শুনবার সময় নেই ঝুমার। জোর করে মেয়েটা তাকে নৌকোয় নিয়ে তুলল। তারপর দড়ির বাঁধন খুলে, বৈঠা দিয়ে অপটু হাতে চালাতে শুরু করল।

জল ঠেলে ঠেলে একসময় মাঝপুকুরে নৌকোটাকে নিয়ে এল ঝুমা।

এর আগে যদিও একবার নৌকোয় উঠেছে, তবু ভয় করতে লাগল বিনুর। সে পাটাতনের মাঝখানে কাঠ হয়ে বসে আছে। আশ্বিনের শান্ত জলেও নৌকোটা টলমল করছে।

ঝুমা বলল, ভারি মজা, না?

বিনু চুপ।

ঝুমা বলল, জানো, এই আমি প্রথম নৌকোয় চড়লাম। তুমি এর আগে চড়েছ?

বিনু আস্তে করে বলল, চড়েছি।

হঠাৎ কী মনে পড়ে যেতে ঝুমা বলল, বা রে, আমি একাই বাইব নাকি? তুমিও একটা বৈঠা নাও।

কথামতো অরেকটা বৈঠা তুলে নিল বিনু। ঝুমা নামের এই মেয়েটা সাঙ্ঘাতিক, কিছুতেই তার অবাধ্য হওয়া যায় না। ইচ্ছায় হোক, অনিচ্ছায় হোক, সে যা বলে তা না করে যেন উপায় নেই।

দুই আনাড়ি সমানে বৈঠা চালাচ্ছে। বাইতে বাইতে বিনুর মনে হল, ঝুমা তাকে গভীর জলের কোনও অজানা রহস্যের দিকে নিয়ে চলেছে।

সকল অধ্যায়

১. ১.০২ স্টিমারঘাটের বাইরে
২. ১.০৩ হেমনাথের নৌকো
৩. ১.০৪ রান্নাবান্না শেষ হতে দুপুর
৪. ১.০৫ স্নেহলতা ঝিনুকের পিছু পিছু
৫. ১.০৬ বাড়ির ভেতরে এসে
৬. ১.০৭ ঘুমটা ভাঙে নি
৭. ১.০৮ অবনীমোহনের সঙ্গে কথা
৮. ১.০৯ ভেতর-বাড়ির উঠোনে
৯. ১.১০ হিরণ আর সুধা
১০. ১.১১ কতক্ষণ ঘুমিয়েছিল
১১. ১.১২ কাল শুতে শুতে অনেক দেরি
১২. ১.১৩ খুব বেশিক্ষণ ঝিনুকের কথা
১৩. ১.১৪ সামনের একখানা ঘর
১৪. ১.১৫ পদ্ম আর শাপলার বনে
১৫. ১.১৬ নৌকোঘাট থেকে যুগলের সঙ্গে
১৬. ১.১৭ আগে আগে চলেছেন অবনীমোহন
১৭. ১.১৮ লারমোর বললেন
১৮. ১.১৯ কানের কাছে মুখ এনে
১৯. ১.২১ একা একা জল ঠেলে
২০. ১.২২ পুকুরের মাঝখান থেকে
২১. ১.২৩ শিশিররা যখন যান
২২. ১.২৪ কাল রাত্তিরেই বই বার করে
২৩. ১.২৫ রঙিন প্রজাপতি হয়ে
২৪. ১.২৬ প্রথম ঘটনাটির কথা
২৫. ১.২৭ মহালয়ার পর থেকেই পড়াশোনা
২৬. ১.২৮ কমলাঘাটের বন্দর
২৭. ১.২৯ মহালয়ার পর থেকে দিনগুলো
২৮. ১.৩০ গ্রীনরুমের ডানদিকে
২৯. ১.৩১ কিছুক্ষণ থ হয়ে দাঁড়িয়ে
৩০. ১.৩২ দশমীর পর একাদশী
৩১. ১.৩৩ রাজদিয়ায় দুর্গাপুজো
৩২. ১.৩৪ লক্ষ্মীপুজোর পরদিন
৩৩. ১.৩৫ লক্ষ্মীপুজোর পর থেকে
৩৪. ১.৩৬ দুর্গাপুজোর পর কোজাগরী
৩৫. ১.৩৭ ঝিনুক আর বিনুও সেদিকে
৩৬. ১.৩৮ ভবতোষ চলে গেছেন
৩৭. ১.২০ অপটু হাতে নৌকো
৩৮. ১.০১ ভাল করে সকাল হয় নি
৩৯. ২.০১-০৫ অবনীমোহনের ধারণা
৪০. ২.০৬-১০ অবনীমোহন কলকাতা থেকে ফিরে
৪১. ২.১১-১৫ ধানকাটার মধ্যে
৪২. ২.১৬-২০ কাল হেমনাথ বলে গিয়েছিলেন
৪৩. ২.২১-২৫ গত বছর পুজোর ছুটির পর
৪৪. ২.২৬-৩০ সেটেলমেন্ট অফিস
৪৫. ২.৩১-৩৫ আমেরিকান টমি
৪৬. ২.৩৬-৪০ চিনি কেরোসিন আর কাপড়
৪৭. ২.৪১-৪৫ অবনীমোহনের সঙ্গে একদিন হাটে
৪৮. ২.৪৬-৫০ মাঘের শেষ তারিখে
৪৯. ২.৫১-৫৬ তামাকহাটা মরিচহাটা আনাজহাটা
৫০. ৩.০১-০৫ আশ্বিনের মাঝামাঝি
৫১. ৩.০৬-১০ ভোরে সূর্যোদয়ের আগে
৫২. ৩.১১-১৫ সূর্য এখন সোজাসুজি
৫৩. ৩.১৬-২০ উদ্বাস্তুদের নিয়ে স্পেশাল ট্রেন
৫৪. ৩.২১-২৫ সুনীতির শ্বশুরবাড়ি
৫৫. ৩.২৬-৩০ পুরো দুটো দিন ভুগিয়ে
৫৬. ৩.৩১-৩৫ দু’আড়াই বছর কলকাতায়
৫৭. ৩.৩৬-৪০ খাওয়াদাওয়ার পালা

নোট নিতে এবং টেক্সট হাইলাইট করতে লগইন করুন

লগইন