১.২৩ শিশিররা যখন যান

প্রফুল্ল রায়

শিশিররা যখন যান তখনও একটু রোদ ছিল। শরৎকালের বেলাশেষের কুণ্ঠিত আলো। দেখতে দেখতে সেটুকুও আর থাকল না। লাটাইতে সুতো গুটনোর মতো গাছপালার মাথা থেকে, ঝকঝকে নীলাকাশ থেকে, তুলোর পাহাড়ের মতো ভারহীন মেঘেদের গা থেকে, কেউ যেন অতি দ্রুত অবেলার রোদ টেনে নিতে লাগল। তারপরেই সমস্ত চরাচর জুড়ে একখানা কালচে রঙের অদৃশ্য জাল এসে ছড়িয়ে পড়ল। দেখতে দেখতে রৌদ্রময় আকাশ, গাছগাছালি, দূরের জলপূর্ণ প্রান্তর–সব কিছু ঝাঁপসা হয়ে গেল। আশ্বিনের সন্ধে লম্বা পায়ে নেমে আসতে লাগল।

ঝাঁঝরির ফাঁক দিয়ে যেমন জল ঝরে যায় তেমনি করে হইচই, হুল্লোড়, ছোটাছুটির ভেতর দিয়ে দিনটা কখন ফুরিয়ে গেছে টের পাওয়া যায়নি। সন্ধের পর যখন আকাশের দূর প্রান্তে এক টুকরো চাঁদ উঠল, আবছা আলোয় অন্ধকারটাকে জলো কালির মতো মনে হতে লাগল, ধানের খেতে জোনাকি জ্বলতে লাগল মিটমিটিয়ে, আর আবনীমোহনদের গল্প, সুধা সুনীতির লঘু সুরের পরিহাস জমে উঠতে লাগল, সেই সময় চোখের পাতা জুড়ে এল বিনুর। বসে বসেই ঢুলতে লাগল সে।

স্নেহলতা দেখতে পেয়েছিলেন। বললেন, এই দাদাভাই–

চোখ পুরোপুরি মেলে তাকাতে চেষ্টা করল বিনু, পারল না। আধবোজা দৃষ্টিতে একবার তাকিয়েই আবার চোখ বুজল।

স্নেহলতা বললেন, ঘুম পেয়েছে?

হুঁ– অস্ফুটে উত্তর দিয়ে আস্তে করে মাথা নাড়ল বিনু।

সুরমা বললেন, ঘুম পাবে না তো কী। সারা দিনে এক মুহূর্তও কি পা পেতে বসে! সবসময় খালি হুড়োহুড়ি, হুটোপুটি। সন্ধে হলে আর তাকিয়ে থাকতে পারে না।

অবনীমোহন বললেন, রাজদিয়া আসা থেকে তো বইটইয়ের সঙ্গে সম্পর্ক ঘুচে গেছে। পড়া নেই শোনা নাই, ফিরে গিয়ে অ্যানুয়াল পরীক্ষাটা তো দিতে হবে। বলতে বলতে স্ত্রীর দিকে ফিরলেন, বাক্স থেকে ওদের বই বার করেছ?

সুরমা বললেন, না।

আজ রাত্তিরেই বার করে রাখবে।

হেমনাথ বললেন, হ্যাঁ হ্যাঁ, খালি বেড়ালেই চলবে না, পড়াশোনাও করতে হবে। চর্চা না থাকলে সব ভুলে যাবে। কাল থেকে সকালবেলাটা শুধু লেখাপড়া।

স্নেহলতা বললেন, কালকের কথা কালকে হবে। আয় রে দাদাভাই, ঝিনুকও আয়। তোদের খাইয়ে বিছানায় পাঠিয়ে দিই।

ঘুমের ঘোরেই খেয়ে নিল বিনু। অস্পষ্টভাবে টের পেল তার পাশে বসে ঝিনুকও খাচ্ছে, নিজে খাচ্ছে না, কেউ খাইয়ে দিচ্ছে। কে দিচ্ছে, বোঝা গেল না। বুঝতে চেষ্টা করল না বিনু।

রাত্তিরে বিনু আর ঝিনুক পুবের ঘরে হেমনাথের কাছে শোয়। দু’জনকে খাইয়ে দাইয়ে সেখানে দিয়ে গেলেন স্নেহলতা। হেমনাথের শুতে এখনও অনেক দেরি। হাতমুখ ধোবেন, কিছুক্ষণ বই টই পড়বেন। তারপর তো শোওয়া।

স্নেহলতার সঙ্গে ঢুলতে ঢুলতে এ ঘরে এসেছিল বিনু। চোখ দুটো জুড়েই ছিল। বিছানায় পড়ামাত্র রাজ্যের ঘুম চারদিক থেকে তাকে ঘিরে ধরল।

অথৈ ঘুমে ডুবে যেতে যেতে হঠাৎ বিনুর মনে হল, ছোট ছোট হাত দিয়ে কেউ তাকে কঁকুনি দিচ্ছে। সমানে বলছে, অ্যাই-অ্যাই-অ্যাই–

এ ঘর প্রায় অন্ধকার। মাথার দিকের টেবিলে একটা হেরিকেন নিবু নিবু হয়ে জ্বলছে। স্নেহলতা যাবার সময় চাবি ঘুরিয়ে ঘুরিয়ে ওটার জোর কমিয়ে দিয়ে গেছেন।

অস্পষ্ট আলোয় চোখ মেলে একবার দেখে নিল বিনু। এমনিতে হেমনাথ মাঝখানে শোন, তার দু’ধারে তারা দু’জনে থাকে। আজও মাঝখানে হেমনাথের জায়গা রেখে বিনুরা শুয়েছিল। কিন্তু এখন দেখা যাচ্ছে, ঝিনুকটা অনেকখানি কাছে সরে এসেছে। সে-ই তাকে ধাক্কা দিচ্ছে, ডাকাডাকি করছে।

চোখ মেলতেই চোখাচোখি হয়ে গিয়েছিল। ঝিনুক বলল, তোমার বড্ড ঘুম, ভেঁস ভেঁস করে খালি নাক ডাকে।

বিরক্ত, জড়ানো গলায় বিনু বলল, ঠেলছ কেন?

তখন তো মা কালীর দিব্যি বললে না—

বিনু ভুলে গিয়েছিল। বলল, মা কালীর দিব্যি বলব কেন?

ঝিনুক অবাক, বা রে, মনে নেই?

উহুঁ–

ঝুমার সঙ্গে কাউফল পাড়তে গিয়ে কী হয়েছিল, জিজ্ঞেস করলাম। তুমি বললে, কিছুই হয় নি। তখন মা কালীর দিব্যি দিতে বললাম। এবার মনে পড়ছে?

বিনু হতভম্ব। কী শয়তান মেয়ে রে! কথাটা একদম ভোলে নি, কঁচা ঘুম ভাঙিয়ে মনে করিয়ে দিচ্ছে।

ঝিনুক বলল, বল, মা কালীর দিব্যি বল–

মা কালীর নামে দিব্যি করতে বিনুর খুব আপত্তি। দেবতাদের মধ্যে কালীকেই তার সব চাইতে বেশি ভয়। হাতে খড়গ, গলায় অসুরমুন্ডের মালা–এই ভয়ঙ্করী দেবীটি সম্বন্ধে অনেক সাঙ্ঘাতিক গল্প বিনুর জানা। সেই জন্যই তাকে ঘাঁটাতে চায় না সে।

বিনু বলল, শুধু শুধু দিব্যি কাটব কেন? তোমাকে তো বললাম, কাউ পাড়তে গিয়ে কিছু হয় নি।

চাপা গলায় ঝিনুক বলল, বুঝেছি।

কী?

দিব্যি দিতে ভয় পাচ্ছ। নিশ্চয়ই কাউ পাড়তে গিয়ে কিছু হয়েছে। শিগগির আমাকে বল, নইলে–

নইলে কী?

আমি তোমার মা বাবাকে বলে দেব।

বিনু চমকে উঠল, কী বলবে?

ঝিনুক বলতে লাগল, তোমার চুলগুলো আর জামা প্যান্ট কেমন দেখাচ্ছিল। আমার মনে হয়, তুমি জলে পড়ে গিয়েছিলে।

কাজেই আর গোপন রাখা গেল না। কাউফল পাড়ার সময় যা যা ঘটেছিল, সব বলে ফেলল বিনু।

সমস্ত শুনে ঝিনুক বলল, খুব তো লুকিয়ে রাখতে চেয়েছিলে। পারলে?

বিনু চুপ।

ঝিনুক আবার বলল, জানো, আমায় কেউ ফাঁকি দিতে পারে না।

কথাটা যে হাজার বার সত্যি, মনে মনে বিনুকে তা মানতেই হল।

ঝিনুক বলল, আর কখনও আমাকে ফাঁকি দেবে না, বুঝলে?

আচ্ছা– সুবোধ ছেলের মতো ঘাড় কাত করল বিনু।

দিতে চেষ্টা করলে কিন্তু ঠিক ধরে ফেলব।

একটু চুপ করে থেকে করুণ অনুনয়ের সুরে বিনু বলল, তোমায় সব বললাম। জলে পড়ার কথাটা মা-বাবাকে বলো না কিন্তু–

বললে কী হবে?

খুব মারবে।

আচ্ছা বলব না। তবে–

কী?

আমি যা বলব তাই করবে তো?

যে কোনও শর্তেই এখন বিনু রাজি। তক্ষুনি ঘাড় কাত করল সে, হ্যাঁ।

একটু ভেবে ঝিনুক বলল, আমার ঘুম পেয়েছে, আর কথা বলতে পারছি না।

বিনু বলল, আমিও।

এস, ঘুমিয়ে পড়ি।

ঘুমিয়ে পড়তে পড়তে বিনুর মনে হল, ঝিনুকের কাছে কিছুই গোপন রাখা যাবে না। যে সিন্দুকেই পুরে রাখুক না, কুলুপ ভেঙে মেয়েটা সেটি ঠিক বার করে নেবেই।

সকল অধ্যায়

১. ১.০২ স্টিমারঘাটের বাইরে
২. ১.০৩ হেমনাথের নৌকো
৩. ১.০৪ রান্নাবান্না শেষ হতে দুপুর
৪. ১.০৫ স্নেহলতা ঝিনুকের পিছু পিছু
৫. ১.০৬ বাড়ির ভেতরে এসে
৬. ১.০৭ ঘুমটা ভাঙে নি
৭. ১.০৮ অবনীমোহনের সঙ্গে কথা
৮. ১.০৯ ভেতর-বাড়ির উঠোনে
৯. ১.১০ হিরণ আর সুধা
১০. ১.১১ কতক্ষণ ঘুমিয়েছিল
১১. ১.১২ কাল শুতে শুতে অনেক দেরি
১২. ১.১৩ খুব বেশিক্ষণ ঝিনুকের কথা
১৩. ১.১৪ সামনের একখানা ঘর
১৪. ১.১৫ পদ্ম আর শাপলার বনে
১৫. ১.১৬ নৌকোঘাট থেকে যুগলের সঙ্গে
১৬. ১.১৭ আগে আগে চলেছেন অবনীমোহন
১৭. ১.১৮ লারমোর বললেন
১৮. ১.১৯ কানের কাছে মুখ এনে
১৯. ১.২১ একা একা জল ঠেলে
২০. ১.২২ পুকুরের মাঝখান থেকে
২১. ১.২৩ শিশিররা যখন যান
২২. ১.২৪ কাল রাত্তিরেই বই বার করে
২৩. ১.২৫ রঙিন প্রজাপতি হয়ে
২৪. ১.২৬ প্রথম ঘটনাটির কথা
২৫. ১.২৭ মহালয়ার পর থেকেই পড়াশোনা
২৬. ১.২৮ কমলাঘাটের বন্দর
২৭. ১.২৯ মহালয়ার পর থেকে দিনগুলো
২৮. ১.৩০ গ্রীনরুমের ডানদিকে
২৯. ১.৩১ কিছুক্ষণ থ হয়ে দাঁড়িয়ে
৩০. ১.৩২ দশমীর পর একাদশী
৩১. ১.৩৩ রাজদিয়ায় দুর্গাপুজো
৩২. ১.৩৪ লক্ষ্মীপুজোর পরদিন
৩৩. ১.৩৫ লক্ষ্মীপুজোর পর থেকে
৩৪. ১.৩৬ দুর্গাপুজোর পর কোজাগরী
৩৫. ১.৩৭ ঝিনুক আর বিনুও সেদিকে
৩৬. ১.৩৮ ভবতোষ চলে গেছেন
৩৭. ১.২০ অপটু হাতে নৌকো
৩৮. ১.০১ ভাল করে সকাল হয় নি
৩৯. ২.০১-০৫ অবনীমোহনের ধারণা
৪০. ২.০৬-১০ অবনীমোহন কলকাতা থেকে ফিরে
৪১. ২.১১-১৫ ধানকাটার মধ্যে
৪২. ২.১৬-২০ কাল হেমনাথ বলে গিয়েছিলেন
৪৩. ২.২১-২৫ গত বছর পুজোর ছুটির পর
৪৪. ২.২৬-৩০ সেটেলমেন্ট অফিস
৪৫. ২.৩১-৩৫ আমেরিকান টমি
৪৬. ২.৩৬-৪০ চিনি কেরোসিন আর কাপড়
৪৭. ২.৪১-৪৫ অবনীমোহনের সঙ্গে একদিন হাটে
৪৮. ২.৪৬-৫০ মাঘের শেষ তারিখে
৪৯. ২.৫১-৫৬ তামাকহাটা মরিচহাটা আনাজহাটা
৫০. ৩.০১-০৫ আশ্বিনের মাঝামাঝি
৫১. ৩.০৬-১০ ভোরে সূর্যোদয়ের আগে
৫২. ৩.১১-১৫ সূর্য এখন সোজাসুজি
৫৩. ৩.১৬-২০ উদ্বাস্তুদের নিয়ে স্পেশাল ট্রেন
৫৪. ৩.২১-২৫ সুনীতির শ্বশুরবাড়ি
৫৫. ৩.২৬-৩০ পুরো দুটো দিন ভুগিয়ে
৫৬. ৩.৩১-৩৫ দু’আড়াই বছর কলকাতায়
৫৭. ৩.৩৬-৪০ খাওয়াদাওয়ার পালা

নোট নিতে এবং টেক্সট হাইলাইট করতে লগইন করুন

লগইন