১.৩৩ রাজদিয়ায় দুর্গাপুজো

প্রফুল্ল রায়

রাজদিয়ায় দুর্গাপুজোর চাইতে লক্ষ্মীপুজোর সমারোহ অনেক বেশি। সারা শহরে দুর্গাঠাকুর আর ক’টা? বারোয়ারি-টারোয়ারি ধরে মোট সাতখানা। আর লক্ষ্মীপুজো? তার লেখাজোখা নেই। বারুইপাড়ায় যুগীপাড়ায় বামুন পাড়ায় কায়েতপাড়ায় সারা রাজদিয়াতে যেখানে যত বাড়ি, সব জায়গায় কোজাগরী পূর্ণিমার দিন ঘরদোর নিকিয়ে আলপনা এঁকে লক্ষ্মী এনে বসানো হয়। এখানে ঘরে ঘরে লক্ষ্মীবন্দনা। ধন-সম্পদ আর পরিপূর্ণতার এই দেবীর আরাধনা করতে কেউ ভোলে না।

রাজদিয়ায় দুর্গাপুজো হয় প্রতিমা বানিয়ে। লক্ষ্মীর বেলা কিন্তু অন্য নিয়ম। কেউ জলপূর্ণ ঘটে আম্রপল্লব আর শিষওলা ডাব বসিয়ে, তাতে সিঁদুরের ফোঁটা দিয়ে পুজো সারে। তবে বেশির ভাগ। লোকই কুমোরপাড়া থেকে লক্ষ্মীসরা কিনে আনে, জলচৌকি কিংবা মাটির বেদির ওপর বসিয়ে তার পুজো হয়।

বিনুরা লারমোরের গির্জায় গিয়েছিল একাদশীর সকালে। মাঝখানে তিনটে দিন। তারপরই কোজাগরী পূর্ণিমা অর্থাৎ লক্ষ্মীপুজো এসে গেল।

মাঝের তিনদিন নিশ্বাস ফেলার সময় ছিল না স্নেহলতার। শুধু কি স্নেহলতার? শিবানী-উমা গৌরদাসী, এ বাড়ির মানুষগুলো নাইতে-খেতে এমন কি চোখের পাতা এক করতেও ভুলে গিয়েছিল।

কাজ কি একটুখানি? দেড় মণ চালের মুড়ি ভাজা হয়েছে এর ভেতর, আধ মণ ধানের খই। চিড়েও কোটা হয়েছে মণখানেক। তার ওপর তিলের নাড়, ক্ষীরের নাড়, মুগের নাড়, নারকেলের সন্দেশ-চন্দ্রপুলি-ছাপা, মুড়ি-চিড়ে-খইয়ের মোয়া–এসব তো আছেই।

.

লক্ষ্মীপুজোর দিন সকালবেলা উঠেই ঘরদোর বোয়ামোছা শুরু করলেন স্নেহলতা। অবনীমোহন আর হেমনাথকে পুজোর বাজার করতে পাঠালেন সুজনগঞ্জের হাটে। বার বার বলে দিলেন হাটে গিয়ে যেন ফেরার কথা ভুলে না যান হেমনাথ। বিকেলের ভেতর এসে না পৌঁছলে পুজোই হবে না।

হেমনাথরা চলে গেলে স্নেহলতা সুধা সুনীতিকে ডাকলেন, এই যে দিদিভাইরা, তোদের কিন্তু আজ অনেক কাজ–

সুধা সুনীতি বলল, কী কাজ দিদা?

চালের গুঁড়ো গুলে রেখেছি, তাই দিয়ে সারা বাড়ি আলপনা দিতে হবে।

ওরে বাবা—

কী হল?

সুধা সুনীতি একসঙ্গে হাত নেড়ে বলতে লাগল, ওসব আমরা পারব না।

পারবি না কিরকম? চোখ কুঁচকে স্নেহলতা তাকালেন। একটু অপ্রসন্নই হেয়েছেন তিনি, পারতেই হবে–

বা রে–

কী?

আমরা কোনওদিন আলপনা দিয়েছি নাকি?

না দিয়েছিস বেশ করেছিস। এখন দিতে হবে। স্নেহলতা বলতে লাগলেন, কলকাতায় থেকে থেকে তো মেমসাহেব হয়ে উঠেছ। যতই যাই হও, নাচো আর গাও, উর্দু পড় আর ফারসি পড় বাঙালির ঘরের মেয়ে তো। পুজোআর্চা, সংসারের কাজ, এ সব শিখতেই হবে। মেমসাহেবি করে দিন কাটালে চলবে না।

সুধা সুনীতি কিছু বলল না।

স্নেহলতা আবার বললেন, আমার কাছে যখন এসেই পড়েছ তখন আর নিস্তার নেই। দুপুরবেলা আমি আলপনা দিতে বসব। দেখে দেখে শিখে নেবে, বুঝলে?

সুধা-সুনীতি একসঙ্গে ঘাড় কাত করল, আচ্ছা।

আরেকটা কথা—

কী?

সকালবেলা কিছু খেয়েছিস?

না।

ভালই হয়েছে। কিছু খাস টাস নি। একেবারে পুজো হয়ে গেলে খাবি।

সুধা সুনীতি আঁতকে উঠল, পুজো তো হবে সেই রাত্তিরে!

স্নেহলতা তাকালেন, হ্যাঁ, তাতে কী হয়েছে?

অতক্ষণ উপোস দিয়ে থাকতে হবে?

কতক্ষণ আর, একটা বেলা তো মোটে।

দুই বোনে নাকে-কান্না জুড়ে দিল, রাত পর্যন্ত না খেয়ে থাকলে মরে যাব, এক্কেবারে মরে যাব।

স্নেহলতা ওদের কান্ড দেখে হেসে ফেললেন, মরে যাবি কি বেঁচে থাকবি দেখা যাবে’খন।

সুধা সুনীতির কাঁদুনির মধ্যে স্নেহলতা গলা তুলে ডাকলেন, বিনু—বিনু—বিনুদাদা–

ভেতর-বাড়ির উঠোনে দাঁড়িয়ে স্নেহলতারা কথা বলছিলেন, আর বাইরের দিকে দক্ষিণের ঘরের বারান্দায় বসে পড়ছিল বিনু। সেখান থেকে স্নেহলতাদের দেখতে পাচ্ছিল সে। কথাবার্তাও শুনতে পাচ্ছিল।

স্নেহলতার ডাক কানে যেতেই বিনু ছুটে এল। বলল, কী দিদা?

আজ আর পড়তে হবে না।

বিনু ভারি খুশি, তার চোখ চকচক করতে লাগল।

স্নেহলতা বললেন, একটা কাজ করতে পারবি?

কী কাজ না জেনেই বিনু তক্ষুনি রাজি। মাথা অনেকখানি হেলিয়ে বলল, হুঁ-উ উ—

হুঁ তো করলি। আমি যদি বলি আকাশের চাঁদ পেড়ে এনে দে, পারবি?

আহা–

আহা কী?

তুমি অমন কথা বলবেই না।

আমার ওপর খুব বিশ্বাস দেখছি।

আবার আগের মতো ঘাড় কাত করল বিনু, হুঁ–

স্নেহলতা এবার কাজের কথায় এলেন, একবার কুমোরপাড়ায় তোকে যেতে হবে দাদাভাই। বুধাই পালকে চিনিস তো। তাদের বাড়ি।

কেন?

আজ পুজো। লক্ষ্মীসরা আনতে হবে না?

লক্ষ্মীসরা কী দিদা?

কুমোরপাড়ায় গেলেই দেখতে পাবি। বুধাই পালকে বলবি, ভাল দেখে যেন সরা দেয়। বুঝলি?

আচ্ছা। এক্ষুনি যাব?

যা বলতে বলতে হঠাৎ কী মনে পড়ে গেল। একটু থেমে কী ভেবে নিলেন স্নেহলতা, তারপর বললেন, পাঠাব তো। কিন্ত যুগলটা ওদের সঙ্গে হাটে গেল।

বেরুবার মুখে পাছে বাধা পড়ে যায়, সেই ভয়ে বিনু তাড়াতাড়ি বলে উঠল, বুধাই পালের বাড়ি আমি চিনি, ঠিক চলে যেতে পারব।

কুমোরপাড়ায় দু’ভাবে যাওয়া যায়। নৌকোয় করে কিংবা পায়ে হেঁটে। হেঁটে গেলে অনেকখানি ঘুরতে হবে–সেই স্টিমারঘাটা বরফ কল, মাছের আড়ত বাঁয়ে ফেলে মাইলখানেক পাড়ি দিলে তবে কুমোরপাড়া। বিনু হেঁটে যাবার কথাই ভাবছিল।

স্নেহলতা বললেন, কিভাবে যাবি?

হেঁটে।

না–না। অতখানি রাস্তা হেঁটে যাওয়া-আসা সোজা নাকি। তোকে পাঠিয়ে শেষে একটা বিপদে পড়ি।

বিনু কী বলতে যাচ্ছিল, এই সময় এ বাড়ির দ্বিতীয় কামলা করিম এসে হাজির। তাকে পেয়ে সমস্যাটার সমাধান হয়ে গেল।

স্নেহলতা বললেন, এই করিম, তোর এখন কী কাজ?

করিম জানালো, বাগানের দক্ষিণ কোনায় যে লেবুবতী আমের গাছটা বাজে পুড়ে ভূতের চেহারা নিয়ে দাঁড়িয়ে আছে সেটা কেটে ফেলতে হবে। হেমনাথ তাই বলে গেছেন। গাছটা কাটবার জন্য একটা কুড়ুল যোগাড় করতে ভেতর-বাড়িতে এসেছিল সে।

স্নেহলতা বললেন, এখন তোর গাছ কাটতে হবে না। বিনুকে নিয়ে নৌকোয় কুরে একটু কুমোরপাড়ায় যা।

করিম চোখেমুখে ভয় ফুটিয়ে বলল, আরে সব্বনাশ।

কী হল?

গাছ না কাইটা অহন যদিন কুমারবাড়ি যাই, বড়কত্তায় আইসা আমারে শ্যাষ করব।

কিছু করবে না। তুই যা।

আপনে কিন্তুক দায়ী রইলেন। বড়কত্তায় যদিন কিছু কয় আপনে আমারে  বাঁচাইবেন।

স্নেহলতা বললেন, আচ্ছা, সে ভাবনা তোকে করতে হবে না। যা বলবার আমি তাকে বলব’খন। বিনুকে বললেন, যা দাদাভাই ওর সঙ্গে–

ছুটে দক্ষিণের ঘরের বারান্দায় চলে গেল বিনু। বইপত্র ছত্রাকার হয়ে ছিল। সেগুলো গুছিয়ে রেখে বেরুতে যাবে, সেই সময় কোত্থেকে ঝিনুক এসে পড়ল। তীক্ষ্ণ ধারাল চোখে বিনুকে দেখতে দেখতে বলল, কোথায় যাচ্ছ?

কুমোরবাড়ি। বলেই করিমের সঙ্গে চলতে শুরু করল বিনু।

কেন?

লক্ষ্মীসরা আনতে।

আমি যাব তোমার সঙ্গে।

না।

হ্যাঁ যাব।

মেয়েটা যেন আঠার মতো সব সময় পেছনে লেগে আছে। যেখানেই বিনু যাক, যা-ই করুক– তার চোখকে ফাঁকি দিয়ে কিচ্ছু হবার উপায় নেই। মনে মনে খুব বিরক্ত হচ্ছিল বিনু। বলল, না।

ঝিনুক সঙ্গ ছাড়ল না। পেছনে ছুটতে ছুটতে বলতে লাগল, নিয়ে চল না, নিয়ে চল না—

বিনুর সেই এক উত্তর, না।

আশায় আশায় পুকুরঘাট পর্যন্ত এল ঝিনুক। কিন্তু যখন দেখল সে উঠবার আগেই বিনুরা তাড়াতাড়ি উঠে নৌকো ছেড়ে দিয়েছে তখন কেঁদে ফেলল। কাঁদতে কাঁদতে জড়ানো গলায় বলল, সেই কথাটা তোমার মাকে বলে দেব।

সেই কথাটা বলতে জলে ডোবার ব্যাপারটা। বার বার একই অস্ত্র দেখিয়ে মেয়েটা তাকে হাতের মুঠোয় পুরে রাখবে, তা তো আর হয় না। তা ছাড়া অনেক দিন হয়ে গেছে, সেই ব্রহ্মাস্ত্রের ধারও আর তেমন নেই। তাচ্ছিল্যের সুরে বিনু বলল, বল গে–

কুমোরপাড়ার কাছাকাছি আসতেই বিনুরা দেখতে পেল, খালপাড়ে কত নৌকো যে এসে জমেছে তার লেখাজোখা নেই।

বিনু অবাক। শুধলো, এত নৌকো কিসের করিম?

করিম বলল, মনে লাগে, পিতিমা টিতিমা নিতে আইছে।

খালের ধারে সারি সারি বইন্যা গাছ। তাদের একটার ডালে নৌকো বেঁধে করিম আর বিনু ওপরে উঠে এল।

কুমোরপাড়ায় ঢুকতেই দেখা গেল, মেলা বসে গেছে। দূরদূরান্ত থেকে কত মানুষ যে লক্ষ্মীসরা কিনতে এসেছে! পটুয়াদের ঘিরে ধরে সমানে তাড়া দিয়ে যাচ্ছে। কেউ বলছে, পালমশয় আমারে আগে দ্যান—

আরেক জন অমনি বলে উঠল, না পালমশয়, আমারে আগে। হেই ভোর রাইতে আইছি, বেলা দুফার হইতে চলল।

অন্য একজন বলল, পালমশয়, আমার কথাখান বিবেচনা করেন। আমারে যাইতে হইব হেই গিরিগুঞ্জে। যাইতে যাইতে বিকাল হইয়া যাইব।

পটুয়ারা কেউ বসে নেই, রং তুলি দিয়ে বড় বড় মাটির সরার উলটো পিঠে লক্ষ্মীর চিত্র এঁকে চলেছে। ঝড়ের গতিতে তাদের হাত চলছে। এত ব্যস্ততা যে হুঁকোতে দুটো টান দেবারও ফুরসত পাচ্ছে না।

বুধাই পালের বাড়িতেও সেই একই দৃশ্য। তাকে ঘিরে প্রায় শ’খানেক লোক উদ্গ্রীব বসে আছে।

বুধাই পাল তার তিন ছেলেকে নিয়ে সরা চিত্তির করছিল। একা কেউ সবটা করছে না। কেউ হয়তো হাত-পা মুখ আঁকছে, কেউ চোখ ফোঁটাচ্ছে, কেউ পাচাটা বসাচ্ছে। প্রথম ছেলের হাত থেকে দ্বিতীয় ছেলের হাতে, তারপর তৃতীয় ছেলের হাত ঘুরে বাপের কাছে এসে ছবিটা সম্পূর্ণ হচ্ছে।

একেকটা সরা শেষ হলে তৎক্ষণাৎ সেটা কিনে নিয়ে একেক জন খদ্দের চলে যাচ্ছে। বিনুরা একটুক্ষণ দাঁড়িয়ে থাকল। সরা থেকে যে চোখ তুলবে তেমন ফাঁকই পাচ্ছে না বুধাই পাল। পেলে নিশ্চয়ই তাদের দেখতে পেত।

কতক্ষণ আর দাঁড়িয়ে থাকা যায়? করিম হঠাৎ ডাকল, পালমশয়–

এবার তাকাল বুধাই পাল। তাকিয়েই বিনুকে দেখে অত্যন্ত ব্যস্ত হয়ে পড়ল, ওরে ক্যাঠা আছস। রে, একখান জলচকি লইয়া আয়। হ্যামকত্তার নাতি আইছে।

তক্ষুনি একখানা জলচৌকি চলে এল। বিনুকে তার ওপর বসিয়ে বুধাই বলল, কী মনে কইরা নাতিবাবু?

বিনু বলল, লক্ষ্মীসরা নিতে এসেছি।

অন্য কাজ ফেলে, সবাইকে বসিয়ে রেখে খুব যত্ন করে একখানা সরা চিত্তির করল বুধাই পাল। গোটা সরাটা একাই আঁকল সে, ছেলেদের কিছুই করতে দিল না।

অন্য খদ্দেররা অসন্তুষ্ট। চাপা গলায় তারা বলতে লাগল, এইটা ক্যামন বিচার। আমরা এতক্ষণ বইসা আছি–

বুধাই পাল বলল, বিচার টিচার বুঝি না। হ্যামকত্তার নাতি আইছে। তারটা আগে কইরা দিতেই হইব। যদি তোমরা গুসা (রাগ) কর, আমার কিছুই করনের নাই।

লোকগুলো কেউ আর কিছু বলল না।

সরাটা আঁকা হলে বিনুর হাতে দিতে দিতে বুধাই পাল বলল, ধরেন নাতিবাবু—

হাতে নিয়ে বিনু অবাক। লক্ষ্মীর ছবিই না, বুধাই পাল সরার ওপর দুর্গা মূর্তিও এঁকেছে। অবশ্য কার্তিক-গণেশ-সরস্বতীর মতো লক্ষ্মীও তাতে আছে। বিনু বলল, এ কি, এটা যে দুর্গা ঠাকুর।

বুধাই পাল হাসল, হ, দুগগাঠাকুরই। কোজাগরীতে আপনের দাদুর বাড়ি এই সরাই পূজা হয়।

কিন্তু–

কী?

আমি দেখলাম, কাউকে কাউকে শুধু লক্ষ্মী এঁকে দিলেন–

তাগো হেই নিয়ম। হ্যামকত্তার বাড়ির নিয়ম হইল কোজাগরীতে দুগ্‌গামূত্তি পূজা। আপনে নিচ্চিন্ত মনে লইয়া যান–

লক্ষ্মীসরা নিয়ে বাড়ি ফিরতে ফিরতে দুপুর। পুকুরঘাটে নেমে বাগান আর বাইরের দিকের উঠোন পেরিয়ে সবে বিনু ভেতর-বাড়িতে পা দিয়েছে, সুরমা ছুটতে ছুটতে এসে তার কান টেনে ধরলেন, হারামজাদা বাঁদর–

এইরকম একটা অভ্যর্থনা কল্পনাই করে নি বিনু। প্রথমটা হতভম্ব, তার পরেই চেঁচিয়ে উঠল, কী করেছি আমি? কী করেছি?

কী করেছি? বলেই এক চড় কষালেন সুরমা, কেন, কেন তুই ঝিনুককে নিয়ে গেলি না? জানিস না মেয়েটার কত কষ্ট!

বিনু লক্ষ করল, মায়ের ঠিক পিছনেই ঝিনুক দাঁড়িয়ে। রাজদিয়াতে আসার দিন থেকেই মেয়েটার প্রতি মায়ের পক্ষপাতিত্ব। নিশ্চয়ই এমন করে সে লাগিয়েছে যাতে মা রেগে গেছেন।

ঝিনুকের দিকে তাকিয়ে মাথার ভেতরটা যেন জ্বালা করতে লাগল বিনুর, তারপরেই লজ্জায় অপমানে চোখের মণিদু’টো ফেটে জল বেরিয়ে এল।

আরও দু-চারটে চড়টড় হয়তো পড়ত, তার আগেই এ ঘর ও ঘর থেকে সুধা-সুনীতি-স্নেহলতা শিবানী–সবাই ছুটে এলেন। সুরমার হাত থেকে বিনুকে ছাড়িয়ে নিতে নিতে স্নেহলতা বকাবকি করতে লাগলেন, এই পুজোর দিনে ছেলেটার গায়ে হাত তুললি! কী যে তোদের রাগ, বুঝি না। ঝিনুককে দেখিয়ে বললেন, আর ওই এক মেয়ে হয়েছে—

.

সন্ধের পর চন্দনের পাটার মতো কোজাগরীর পরিপূর্ণ চাঁদ উঠল। আলোয় আলোয় চরাচর ভেসে যেতে লাগল। তার একটু পর এল পুরুত। আয়োজন সম্পূর্ণ করে রেখেছিলেন স্নেহলতা। পুরুত এসেই পুজোয় বসে গেল।

পুজোটুজো হয়ে গেলে প্রসাদ বিতরণের পালা। রাতদুপুর পর্যন্ত রাজ্যের লোক এসে প্রসাদ খেয়ে গেল।

একটা ব্যাপার বিনু লক্ষ করেছে, দুপুরবেলা সেই মারধোরের পর থেকে সারাদিন অপরাধীর মতো মুখ করে তার পেছনে ঘুর ঘুর করেছে ঝিনুক। বিনু কিন্তু নিজের মনকে পাষাণ করে ফেলেছে, একটি কথাও বলে নি। চোখাচোখি হলে তক্ষুণি অন্য দিকে মুখ ফিরিয়ে নিয়েছে। যতই ঘুরুক, যতই মুখ চুন করে থাকুক, বিনু আর তার দিকে ফিরেও তাকাচ্ছে না।

রাত্রিবেলা এক বিছানায় শুয়ে ঝিনুক ফিসফিস করে ডাকল, বিনুদাদা—

বিনু সাড়া দিল না।

ঝিনুক বলতে লাগল, আর কক্ষণো মাসিমার কাছে তোমার নামে কিছু বলব না।

বিনু এবারও চুপ।

ঝিনুক কাঁদো কাঁদো গলায় বলল, তুমি আমার সঙ্গে কথা বলবে না?

উত্তর না দিয়ে বিনু ঝিনুকের দিক থেকে এ পাশ ফিরে শুল।

সকল অধ্যায়

১. ১.০২ স্টিমারঘাটের বাইরে
২. ১.০৩ হেমনাথের নৌকো
৩. ১.০৪ রান্নাবান্না শেষ হতে দুপুর
৪. ১.০৫ স্নেহলতা ঝিনুকের পিছু পিছু
৫. ১.০৬ বাড়ির ভেতরে এসে
৬. ১.০৭ ঘুমটা ভাঙে নি
৭. ১.০৮ অবনীমোহনের সঙ্গে কথা
৮. ১.০৯ ভেতর-বাড়ির উঠোনে
৯. ১.১০ হিরণ আর সুধা
১০. ১.১১ কতক্ষণ ঘুমিয়েছিল
১১. ১.১২ কাল শুতে শুতে অনেক দেরি
১২. ১.১৩ খুব বেশিক্ষণ ঝিনুকের কথা
১৩. ১.১৪ সামনের একখানা ঘর
১৪. ১.১৫ পদ্ম আর শাপলার বনে
১৫. ১.১৬ নৌকোঘাট থেকে যুগলের সঙ্গে
১৬. ১.১৭ আগে আগে চলেছেন অবনীমোহন
১৭. ১.১৮ লারমোর বললেন
১৮. ১.১৯ কানের কাছে মুখ এনে
১৯. ১.২১ একা একা জল ঠেলে
২০. ১.২২ পুকুরের মাঝখান থেকে
২১. ১.২৩ শিশিররা যখন যান
২২. ১.২৪ কাল রাত্তিরেই বই বার করে
২৩. ১.২৫ রঙিন প্রজাপতি হয়ে
২৪. ১.২৬ প্রথম ঘটনাটির কথা
২৫. ১.২৭ মহালয়ার পর থেকেই পড়াশোনা
২৬. ১.২৮ কমলাঘাটের বন্দর
২৭. ১.২৯ মহালয়ার পর থেকে দিনগুলো
২৮. ১.৩০ গ্রীনরুমের ডানদিকে
২৯. ১.৩১ কিছুক্ষণ থ হয়ে দাঁড়িয়ে
৩০. ১.৩২ দশমীর পর একাদশী
৩১. ১.৩৩ রাজদিয়ায় দুর্গাপুজো
৩২. ১.৩৪ লক্ষ্মীপুজোর পরদিন
৩৩. ১.৩৫ লক্ষ্মীপুজোর পর থেকে
৩৪. ১.৩৬ দুর্গাপুজোর পর কোজাগরী
৩৫. ১.৩৭ ঝিনুক আর বিনুও সেদিকে
৩৬. ১.৩৮ ভবতোষ চলে গেছেন
৩৭. ১.২০ অপটু হাতে নৌকো
৩৮. ১.০১ ভাল করে সকাল হয় নি
৩৯. ২.০১-০৫ অবনীমোহনের ধারণা
৪০. ২.০৬-১০ অবনীমোহন কলকাতা থেকে ফিরে
৪১. ২.১১-১৫ ধানকাটার মধ্যে
৪২. ২.১৬-২০ কাল হেমনাথ বলে গিয়েছিলেন
৪৩. ২.২১-২৫ গত বছর পুজোর ছুটির পর
৪৪. ২.২৬-৩০ সেটেলমেন্ট অফিস
৪৫. ২.৩১-৩৫ আমেরিকান টমি
৪৬. ২.৩৬-৪০ চিনি কেরোসিন আর কাপড়
৪৭. ২.৪১-৪৫ অবনীমোহনের সঙ্গে একদিন হাটে
৪৮. ২.৪৬-৫০ মাঘের শেষ তারিখে
৪৯. ২.৫১-৫৬ তামাকহাটা মরিচহাটা আনাজহাটা
৫০. ৩.০১-০৫ আশ্বিনের মাঝামাঝি
৫১. ৩.০৬-১০ ভোরে সূর্যোদয়ের আগে
৫২. ৩.১১-১৫ সূর্য এখন সোজাসুজি
৫৩. ৩.১৬-২০ উদ্বাস্তুদের নিয়ে স্পেশাল ট্রেন
৫৪. ৩.২১-২৫ সুনীতির শ্বশুরবাড়ি
৫৫. ৩.২৬-৩০ পুরো দুটো দিন ভুগিয়ে
৫৬. ৩.৩১-৩৫ দু’আড়াই বছর কলকাতায়
৫৭. ৩.৩৬-৪০ খাওয়াদাওয়ার পালা

নোট নিতে এবং টেক্সট হাইলাইট করতে লগইন করুন

লগইন