সংহরণ

রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর

আমাদের সাধনার দ্বিতীয় বড়ো বাধা হচ্ছে সাধনার অনভ্যাস। কোনোরকম সাধনাতেই হয়তো আমাদের অভ্যাস হয় নি। যখন যেটা আমাদের সমুখে এসেছে সেইটের মধ্যেই হয়তো আমরা আকৃষ্ট হয়েছি, যেমন-তেমন করে ভাসতে ভাসতে যেখানে-সেখানে ঠেকতে ঠেকতে আমরা চলে যাচ্ছি। সংসারের স্রোত আমাদের বিনা চেষ্টাতেই চলছে বলেই আমরা চলছি–আমাদের দাঁড়ও নেই, হালও নেই, পালও নেই।

কোনো-একটি উদ্দেশ্যের একান্ত অনুগত করে শক্তিকে প্রবৃত্তিকে চতুর্দিক হতে সংগ্রহ করে আনা আমরা চর্চাই করি নি। এইজন্যে তারা সকলেই হাতের বার হয়ে যাবার জো হয়েছে। কে কোথায় যে আছে তার ঠিকানা নেই–ডাক দিলেই যে ছুটে আসবে এমন সম্ভাবনা নেই। যে-সব খাদ্য তাদের অভ্যস্ত এবং রুচিকর তারই প্রলোভন পেলে তবেই তারা আপনি জড় হয়, নইলে কিছুতেই নয়।

নিজেকে চারিদিকে কেবল ছড়াছড়ি করাটাই অভ্যাস হয়ে গেছে। চিন্তাও ছড়িয়ে পড়ে, কর্মও এলিয়ে যায়, কিছুই আঁট বাঁধে না।

এরকম অবস্থায় যে কেবল সিদ্ধি নেই তা নয়, সত্যকার সুখও নেই। এতে আছে কেবল জড়তার তামসিক আবেশমাত্র।

কারণ, যখন আমাদের শক্তিকে প্রবৃত্তিকে কোনো উদ্দেশ্যের সঙ্গে যুক্ত করে দিই তখন সেই উদ্দেশ্যই তাদের বহন করে নিয়ে চলে। তখন তাদের ভার আর আমাদের নিজের ঘাড়ে পড়ে না। নতুবা তাদের বহন করে একবার এর উপর রাখছি, একবার তার উপর রাখছি, এমনি করে কেবলই টানাটানি করে নিয়ে বেড়াতে হয়। যখন কোথাও নামিয়ে রাখবার কোনো উপায় না পাই তখন কৃত্রিম উপায় সৃষ্টি করতে থাকি। কতই বাজে খেলা, বাজে আমোদ, বাজে উপকরণ। অবশেষে সেই কৃত্রিম আয়োজনগুলোও দ্বিতীয় বোঝা হয়ে আমাদের চতুর্দিকে চেপে ধরে। এমনি করে জীবনের ভার কেবলই জমে উঠতে থাকে, জীবনান্তকাল পর্যন্ত কোনোমতেই তার হাত থেকে নিষ্কৃতি পাই নে।

তাই বলছিলুম কেবলমাত্র সাধনার অবস্থাতেই একটা আনন্দ আছে, সিদ্ধির কথা দূরে থাক্‌। মহৎলক্ষ্য-অনুসরণে নিজের বিক্ষিপ্ততাকে একাগ্র করে এনে তাকে এক পথে চালনা করলে তাতেই যেন প্রাণ বেঁচে যায়। যেটুকু সচেষ্টতা থাকলে আমরা সাধনাকে আনন্দ বলে কোমর বেঁধে বক্ষ প্রসারিত করে প্রবৃত্ত হতে পারি সেটুকুও যদি আমাদের ভিতর থেকে খয়ে গিয়ে থাকে তবে বড়ো বিপদ। যেমন করে হোক, বারংবার স্খলিত হয়েও সেই সমস্ত শক্তিকে একাগ্র করবার চেষ্টাকে শক্ত করে তুলতে হবে। শিশু যেমন পড়তে পড়তে আঘাত পেতে পেতে চলতে শেখে, তেমনি করেই তাকে চলতে শেখাতে হবে। কেননা সিদ্ধিলাভে প্রথমে লক্ষ্যটা যে সত্য সেই বিশ্বাসটি জাগানো চাই, তার পরে লক্ষ্যটি বাইরে না ভিতরে, পরিধিতে না কেন্দ্রে সেটি জানা চাই, তার পরে চাই সোজা পথ বেয়ে চলতে শেখা। স্থৈর্য এবং গতি দুই চাই। বিশ্বাসে চিত্ত স্থির হবে–এবং সাধনায় চেষ্টা গতি লাভ করবে।

১৬ ফাল্গুন, ১৩১৫

সকল অধ্যায়

১. সংশয়
২. অভাব
৩. আত্মার দৃষ্টি
৪. পাপ
৫. দুঃখ
৬. ত্যাগ
৭. ত্যাগের ফল
৮. প্রেম
৯. সামঞ্জস্য
১০. কী চাই?
১১. প্রার্থনা
১২. বিকার-শঙ্কা
১৩. দেখা
১৪. শোনা
১৫. হিসাব
১৬. শান্তিনিকেতনে ৭ই পৌষের উৎসব
১৭. দীক্ষা
১৮. মানুষ
১৯. ভাঙা হাট
২০. উৎসবশেষ
২১. সঞ্চয়তৃষ্ণা
২২. পার করো
২৩. এপার ওপার
২৪. দিন
২৫. রাত্রি
২৬. প্রভাতে
২৭. বিশেষ
২৮. প্রেমের অধিকার
২৯. ইচ্ছা
৩০. সৌন্দর্য
৩১. প্রার্থনার সত্য
৩২. বিধান
৩৩. তিন
৩৪. পার্থক্য
৩৫. প্রকৃতি
৩৬. পাওয়া
৩৭. সমগ্র
৩৮. কর্ম
৩৯. শক্তি
৪০. প্রাণ
৪১. জগতে মুক্তি
৪২. সমাজে মুক্তি
৪৩. মত
৪৪. নির্বিশেষ
৪৫. দুই
৪৬. বিশ্বব্যাপী
৪৭. মৃত্যুর প্রকাশ
৪৮. নবযুগের উৎসব
৪৯. ভাবুকতা ও পবিত্রতা
৫০. অন্তর বাহির
৫১. তীর্থ
৫২. বিভাগ
৫৩. দ্রষ্টা
৫৪. নিত্যধাম
৫৫. পরিণয়
৫৬. তিনতলা
৫৭. বাসনা ইচ্ছা মঙ্গল
৫৮. স্বাভাবিকী ক্রিয়া
৫৯. পরশরতন
৬০. অভ্যাস
৬১. প্রার্থনা
৬২. বৈরাগ্য
৬৩. বিশ্বাস
৬৪. সংহরণ
৬৫. নিষ্ঠা
৬৬. নিষ্ঠার কাজ
৬৭. মরণ
৬৮. সত্যকে দেখা
৬৯. সৃষ্টি
৭০. মৃত্যু ও অমৃত
৭১. তরী বোঝাই
৭২. স্বভাবকে লাভ
৭৩. অহং
৭৪. নদী ও কূল
৭৫. আত্মার প্রকাশ
৭৬. আদেশ
৭৭. সাধন
৭৮. ব্রহ্মবিহার
৭৯. পূর্ণতা
৮০. নীড়ের শিক্ষা
৮১. ভূমা
৮২. ওঁ
৮৩. স্বভাবলাভ
৮৪. অখণ্ড পাওয়া
৮৫. আত্মসমর্পণ
৮৬. সমগ্র এক
৮৭. আত্মপ্রত্যয়
৮৮. ধীর যুক্তাত্মা
৮৯. শক্ত ও সহজ
৯০. নমস্তেহস্তু
৯১. মন্ত্রের বাঁধন
৯২. প্রাণ ও প্রেম
৯৩. ভয় ও আনন্দ
৯৪. নিয়ম ও মুক্তি
৯৫. দশের ইচ্ছা
৯৬. বর্ষশেষ
৯৭. অনন্তের ইচ্ছা
৯৮. পাওয়া ও না-পাওয়া
৯৯. হওয়া
১০০. মুক্তি
১০১. মুক্তির পথ
১০২. আশ্রম
১০৩. ছুটির পর
১০৪. বর্তমান যুগ
১০৫. ভক্ত
১০৬. চিরনবীনতা
১০৭. বিশ্ববোধ
১০৮. রসের ধর্ম
১০৯. গুহাহিত
১১০. দুর্লভ
১১১. জন্মোৎসব
১১২. শ্রাবণসন্ধ্যা
১১৩. দ্বিধা
১১৪. পূর্ণ
১১৫. মাতৃশ্রাদ্ধ
১১৬. শেষ
১১৭. সামঞ্জস্য
১১৮. জাগরণ
১১৯. আত্মবোধ
১২০. ব্রাহ্মসমাজের সার্থকতা
১২১. বর্ষশেষ
১২২. নববর্ষ
১২৩. বৈশাখী ঝড়ের সন্ধ্যা
১২৪. সত্যবোধ
১২৫. সত্য হওয়া
১২৬. সত্যকে দেখা
১২৭. বিশেষত্ব ও বিশ্ব
১২৮. পিতার বোধ
১২৯. সৃষ্টির অধিকার
১৩০. ছোটো ও বড়ো
১৩১. সৌন্দর্যের সকরুণতা
১৩২. অমৃতের পুত্র
১৩৩. যাত্রীর উৎসব
১৩৪. মাধুর্যের পরিচয়
১৩৫. একটি মন্ত্র
১৩৬. উদ্‌বোধন
১৩৭. মুক্তির দীক্ষা
১৩৮. প্রতীক্ষা
১৩৯. অগ্রসর হওয়ার আহ্বান
১৪০. মা মা হিংসীঃ
১৪১. পাপের মার্জনা
১৪২. সৃষ্টির ক্রিয়া
১৪৩. দীক্ষার দিন
১৪৪. আরো
১৪৫. আবির্ভাব
১৪৬. অন্তরতর শান্তি

নোট নিতে এবং টেক্সট হাইলাইট করতে লগইন করুন

লগইন