সৌন্দর্যের সকরুণতা

রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর

প্রভাতের পূর্বগগনে আলোকের প্রথম বিকাশ যেমন মধুর, মানুষের জীবনের প্রথম প্রত্যুষের অরুণরেখা যেদিন জেগে ওঠে সেদিন শিশুর কণ্ঠে তার সংগীত তেমনি মধুর, তেমনি নির্মল। সমস্ত মানুষের জীবনের আরম্ভে এই মধুর সুরের উদ্‌বোধন লোকালয়ে ঘরে ঘরে দেখতে পাই। জীবনের সেই নির্মল সৌন্দর্যের ভূমিকাটি কেমন সুন্দর! জগৎসংসারে তাই যত মলিনতা থাক্‌, জরার দ্বারা মানুষ যেমনই আচ্ছন্ন হোক-না কেন, ঘরে ঘরে মনুষ্যত্ব নতুন হয়ে জন্মগ্রহণ করছে। আজ শিশুদের কণ্ঠে জীবনের সেই উদ্‌বোধনসংগীতের প্রথম কলকাকলি শুনতে পাচ্ছি– এ উদ্‌বোধন কে প্রেরণ করলেন। যিনি জীবনের অধীশ্বর তিনিই ঘরে ঘরে এই জাগরণের গীত পাঠিয়েছেন। আজ চিত্ত সেই গানে জাগ্রত হোক।

কিন্তু, এই উৎসবের সংগীতের মধ্যে একটি করুণ সুর, একটি কান্না রয়েছে; সকালের প্রভাতী রাগিণী সেই কান্না বুকের শিরা নিংড়ে নিংড়ে বাজছে। আনন্দের সুরের মধ্যে করুণার কোমল নিখাদ বাজছে। সে কিসের করুণা। পিতা ডাক দিয়েছেন, কিন্তু সকলের সময় হয়ে ওঠে নি। জাগে নি সবাই। অনন্ত শূন্যে প্রভাত-আলোকের ভৈরবী সুর করুণা বিস্তার করে যুগ হতে যুগে ধ্বনিত হচ্ছে, তিনি উৎসব-ক্ষেত্রে ডেকেছেন। অনাদিকালের সেই আহ্বান ধ্বনিত হচ্ছে; কিন্তু, তাঁর ছেলেমেয়েদের ঘুম ভাঙে নি। তারা কেউ বা উদাসীন, কারো বা কাজ আছে, কেউ বা উপহাস করছে, কাউকে বা অভ্যাসের আবরণ কঠিন করে ঘিরে আছে। তারা সংসারের কোলাহল শুনেছে, স্বার্থের আহ্বান শুনেছে, প্রতিদিনের প্রয়োজনের ডাক শুনেছে, কিন্তু আকাশের আলোকের ভিতরে আনন্দময়ের আনন্দভবনে উৎসবের আমন্ত্রণের আহ্বান শুনতে পায় নি।

প্রেমিকের ডাক প্রেমাস্পদের কাছে আসছে, মাঝখানে কত ব্যবধান! কত অবিশ্বাস, কত কলুষ, কত মোহ, কত বাধা! উৎসবের নহবত প্রভাতে প্রভাতে বাজছে, তারায় তারায় অন্ধকারের হৃদয় ভেদ করে বাজছে– সেই উৎসবালোকে ফুল ফুটছে, পাখি গান করছে, শ্যমল তৃণের আস্তরণ পাতা হয়েছে, তাঁর মালীরা ফুলের মালা গেঁথে ঝুলিয়ে রেখেছে। কিন্তু, এতই ব্যবধান, সেখানকার সংগীতকে এখানে আমাদের কাছে পৌঁছতে দিচ্ছে না। সেইজন্যই তিনি যে সৌন্দর্যের সংগীত বাজাচ্ছেন তার মধ্যে অমন কান্না রয়েছে। পৌঁছল না, সবাই এসে জুটল না, আনন্দসভা শূন্য পড়ে রইল। জগতের সৌন্দর্যের বুকের মধ্যে এই কান্না বাজছে। ফুল ফুটতে ফুটতে ঝরতে ঝরতে কত কান্নাই কাঁদল। সে বললে : যে প্রেমলিপি আমি আনলুম সে লিপিখানি কেউ পড়ল না।

নদীর কলস্রোতে নির্জন পর্বতশিখর থেকে যে সংগীতকে বহন করে সমুদ্রের দিকে চলেছে সেই সুরে কান্না রয়েছে : আমি যে নির্জন থেকে নির্জনের দিকে চলেছি সেই নির্জনের সুর গ্রামে গ্রামে লোকালয়ে ঘোষণা করেছি, কারো সময় হল না সে আহ্বান শুনবার। আকাশের সমস্ত তারা এমন ডাক ডাকল, কাননের সমস্ত ফুল এমন ডাক ডাকল– দরজা রুদ্ধ– কেউ শুনল না। এমন সুন্দর জগতে জন্মালুম, এমন সুন্দর আলোকে চোখ মেললুম, সেখানে কি কেবল কাজ! কাজ! কেবল প্রবৃত্তির কোলাহল! কেবল এই কলহ মাৎসর্য বিরোধ! সেখানে এরাই কি সকলের চেয়ে প্রধান! এই সুরেই কি সূর্য চন্দ্র সুর মেলাচ্ছে! এই সুরেই কি সুর ধরিয়েছিলেন যেদিন জননী শিশুকে প্রথম মুখচুম্বন করলেন! এত বড়ো আকাশ, তার এমন নির্মল নীলিমা! একে মানব না? পৃথিবীর এমন আশ্চর্য প্রাণবান গীতিকাব্য, একে মানব না! সেই-জন্যই জগতের সৌন্দর্যের মধ্যে এমন একটি চিরবিরহের করুণা। প্রেমিকের সঙ্গে প্রেমাস্পদের বিচ্ছেদ হয়েছে, মাঝখানে স্বার্থের মরুভূমি। সেই মরুভূমি পার হয়ে ডাক আসছে “এসো এসো’– সেই ডাকের কান্নায় আকাশ ভরে গেল, আলোক ফেটে পড়ল।

কিন্তু, যিনি উৎসবের দেবতা তিনি অপেক্ষা করতে জানেন। এই মরুভূমির ভিতর দিয়ে তিনিই পার করছেন, পথহারাদের ক্রমে ক্রমে পথে টেনে আনছেন। দুঃখের অশ্রুতে তাঁর মিলনের শতদল বিকশিত হচ্ছে। তিনি জানেন যে বধির সেও শুনবে, চিরযুগের রুদ্ধদ্বার একদিন খুলবে, পাষাণ গলবে। এই বাধা-বিরোধের ভিতর থেকে তিনি টেনে নেবেন।

মানুষের জাগরণ সহজ নয় বলেই তার মূল্য যে বেশি। এই জাগরণের জন্য যুগ যুগ যে অপেক্ষা করতে হয়। যেদিন জাগবে মানুষ সেদিন পাখির গানের চেয়ে তার গানের মূল্য অনেক বেশি হবে, ফুলের সৌন্দর্যের চেয়ে তার সৌন্দর্য অনেক বেশি হবে। মানুষ আজ বিদ্রোহ করছে; কিন্তু মেঘ যেমন শ্রাবণের ধারায় বিগলিত হয়ে তার বজ্রবিদ্যুৎকে নিঃশেষ করে মাটিতে লুটিয়ে গড়িয়ে পড়ে যায়, তেমনি বিদ্রোহী মানুষ যেদিন ঝোড়ো মেঘের মতো কেঁদে ঝরে পড়বে সেদিন মরুভূমিতে বিকশিত হবে ফুল– তার মূল্য যে অনেক বেশি। সেইজন্য যুগ যুগ রাত্রিদিন তিনি জেগে রইলেন, অপেক্ষা করে রইলেন, পাপীর পাপের মলিনতা ধৌত হয়ে কবে তার হৃদয় ফুলের মতো নির্মল হয়ে ফুটে উঠবে। বৎসরে বৎসরে উৎসব ব্যর্থ হয়; দিনের পর দিন আলোকদূত ফিরে ফিরে যায়; অন্ধকার নিশীথিনীর তারকারা রাত্রির পর রাত্রি একই আহ্বানের পুনরাবৃত্তি করতে থাকে, ক্ষান্ত হয় না, ক্লান্তি আসে না– কারণ, এই আশা যে জেগে রয়েছে যে যেদিন মানুষ ডাক শুনবে সেদিন সমস্ত সার্থক হবে।

আজ উসবের প্রাঙ্গণে আমরা এসেছি; এ দিন সকলের উৎসবের দিন কি না তা জানি না। সম্বৎসর তিনি ফুল ফুটিয়েছেন, প্রতিদিনই আমাদের ডেকেছেন। আজ কি আমরা নিজের হাতের তৈরি এই উৎসবক্ষেত্রে তাঁর সেই প্রতি নিমেষের সাড়া দিচ্ছি। হে উৎসবের দেবতা, তোমার উৎসবের ক্ষেত্র ব্যর্থ হবে না। তুমি সাজিয়েছ, আমরা এসেছি। আমরা বললুম “পিতা নোহসি’; তুমি পিতা এই কথা স্বীকার করলুম। বলুম নমস্তেহস্তু, নমস্কার সত্য হোক। নমস্কার তো সত্য হয় নি। সংসারের মধ্যে নমস্কার সত্য হয় নি। তেমাকে বঞ্চনা করেছি। ক্ষমতার পায়ে, ধনের পায়ে নমস্কার করেছি। হে আমার উৎসবদেবতা, আজ একটুখানি নমস্কার বাঁচিয়ে এনেছি– আজ আসবার সময় ধনমানের কাছ থেকে কুড়িয়ে-বাড়িয়ে একটু নমস্কার আনতে পেরেছি– সে না হতে পারে প্রতিদিনের নমস্কার, না হতে পারে সমস্ত জীবনের নমস্কার, কিন্তু এই ক্ষণকালের নমস্কার তুমি নাও, সমস্ত জীবনের অসাড়তা অচৈতন্য দূর হোক, তুমি নিজের হাতে জাগাও–

তুমি আপনি জাগাও মোরে তব সুধাপরশে।

প্রাতঃকাল। ১১ মাঘ ১৩২১

ফাল্গুন ১৩২১

সকল অধ্যায়

১. সংশয়
২. অভাব
৩. আত্মার দৃষ্টি
৪. পাপ
৫. দুঃখ
৬. ত্যাগ
৭. ত্যাগের ফল
৮. প্রেম
৯. সামঞ্জস্য
১০. কী চাই?
১১. প্রার্থনা
১২. বিকার-শঙ্কা
১৩. দেখা
১৪. শোনা
১৫. হিসাব
১৬. শান্তিনিকেতনে ৭ই পৌষের উৎসব
১৭. দীক্ষা
১৮. মানুষ
১৯. ভাঙা হাট
২০. উৎসবশেষ
২১. সঞ্চয়তৃষ্ণা
২২. পার করো
২৩. এপার ওপার
২৪. দিন
২৫. রাত্রি
২৬. প্রভাতে
২৭. বিশেষ
২৮. প্রেমের অধিকার
২৯. ইচ্ছা
৩০. সৌন্দর্য
৩১. প্রার্থনার সত্য
৩২. বিধান
৩৩. তিন
৩৪. পার্থক্য
৩৫. প্রকৃতি
৩৬. পাওয়া
৩৭. সমগ্র
৩৮. কর্ম
৩৯. শক্তি
৪০. প্রাণ
৪১. জগতে মুক্তি
৪২. সমাজে মুক্তি
৪৩. মত
৪৪. নির্বিশেষ
৪৫. দুই
৪৬. বিশ্বব্যাপী
৪৭. মৃত্যুর প্রকাশ
৪৮. নবযুগের উৎসব
৪৯. ভাবুকতা ও পবিত্রতা
৫০. অন্তর বাহির
৫১. তীর্থ
৫২. বিভাগ
৫৩. দ্রষ্টা
৫৪. নিত্যধাম
৫৫. পরিণয়
৫৬. তিনতলা
৫৭. বাসনা ইচ্ছা মঙ্গল
৫৮. স্বাভাবিকী ক্রিয়া
৫৯. পরশরতন
৬০. অভ্যাস
৬১. প্রার্থনা
৬২. বৈরাগ্য
৬৩. বিশ্বাস
৬৪. সংহরণ
৬৫. নিষ্ঠা
৬৬. নিষ্ঠার কাজ
৬৭. মরণ
৬৮. সত্যকে দেখা
৬৯. সৃষ্টি
৭০. মৃত্যু ও অমৃত
৭১. তরী বোঝাই
৭২. স্বভাবকে লাভ
৭৩. অহং
৭৪. নদী ও কূল
৭৫. আত্মার প্রকাশ
৭৬. আদেশ
৭৭. সাধন
৭৮. ব্রহ্মবিহার
৭৯. পূর্ণতা
৮০. নীড়ের শিক্ষা
৮১. ভূমা
৮২. ওঁ
৮৩. স্বভাবলাভ
৮৪. অখণ্ড পাওয়া
৮৫. আত্মসমর্পণ
৮৬. সমগ্র এক
৮৭. আত্মপ্রত্যয়
৮৮. ধীর যুক্তাত্মা
৮৯. শক্ত ও সহজ
৯০. নমস্তেহস্তু
৯১. মন্ত্রের বাঁধন
৯২. প্রাণ ও প্রেম
৯৩. ভয় ও আনন্দ
৯৪. নিয়ম ও মুক্তি
৯৫. দশের ইচ্ছা
৯৬. বর্ষশেষ
৯৭. অনন্তের ইচ্ছা
৯৮. পাওয়া ও না-পাওয়া
৯৯. হওয়া
১০০. মুক্তি
১০১. মুক্তির পথ
১০২. আশ্রম
১০৩. ছুটির পর
১০৪. বর্তমান যুগ
১০৫. ভক্ত
১০৬. চিরনবীনতা
১০৭. বিশ্ববোধ
১০৮. রসের ধর্ম
১০৯. গুহাহিত
১১০. দুর্লভ
১১১. জন্মোৎসব
১১২. শ্রাবণসন্ধ্যা
১১৩. দ্বিধা
১১৪. পূর্ণ
১১৫. মাতৃশ্রাদ্ধ
১১৬. শেষ
১১৭. সামঞ্জস্য
১১৮. জাগরণ
১১৯. আত্মবোধ
১২০. ব্রাহ্মসমাজের সার্থকতা
১২১. বর্ষশেষ
১২২. নববর্ষ
১২৩. বৈশাখী ঝড়ের সন্ধ্যা
১২৪. সত্যবোধ
১২৫. সত্য হওয়া
১২৬. সত্যকে দেখা
১২৭. বিশেষত্ব ও বিশ্ব
১২৮. পিতার বোধ
১২৯. সৃষ্টির অধিকার
১৩০. ছোটো ও বড়ো
১৩১. সৌন্দর্যের সকরুণতা
১৩২. অমৃতের পুত্র
১৩৩. যাত্রীর উৎসব
১৩৪. মাধুর্যের পরিচয়
১৩৫. একটি মন্ত্র
১৩৬. উদ্‌বোধন
১৩৭. মুক্তির দীক্ষা
১৩৮. প্রতীক্ষা
১৩৯. অগ্রসর হওয়ার আহ্বান
১৪০. মা মা হিংসীঃ
১৪১. পাপের মার্জনা
১৪২. সৃষ্টির ক্রিয়া
১৪৩. দীক্ষার দিন
১৪৪. আরো
১৪৫. আবির্ভাব
১৪৬. অন্তরতর শান্তি

নোট নিতে এবং টেক্সট হাইলাইট করতে লগইন করুন

লগইন