আত্মার দৃষ্টি

রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর

বাল্যকালে আমার দৃষ্টিশক্তি ক্ষীণ হয়ে গিয়েছিল কিন্তু আমি তা জানতুম না। আমি ভাবতুম দেখা বুঝি এই রকমই–সকলে বুঝি এই পরিমাণেই দেখে। একদিন দৈবাৎ লীলাচ্ছলে আমার কোনো সঙ্গীর চশমা নিয়ে চোখে পরেই দেখি, সব জিনিস স্পষ্ট দেখা যাচ্ছে। তখন মনে হল আমি যেন হঠাৎ সকলের কাছে এসে পড়েছি, সমস্তকে এই যে স্পষ্ট দেখা ও কাছে পাওয়ার আনন্দ, এর দ্বারা বিশ্বভুবনকে যেন হঠাৎ দ্বিগুণ করে লাভ করলাম–অথচ এতদিন যে আমি এত লোকসান বহন করে বেড়াচ্ছি তা জানতুমই না।

এ যেমন চোখ দিয়ে কাছে আসা, তেমনি আত্মা দিয়ে কাছে আসা আছে। সেই রকম করে যারই কাছে আসি সেই আমার হাত তুলে ধরে বলে, তুমি এসেছ! এই যে জল বায়ু চন্দ্র সূর্য, আমাদের পরমবন্ধু, এরা আমাদের নানা কাজ করছে, কিন্তু আমাদের হাত ধরছে না, আনন্দিত হয়ে বলছে না, তুমি এসেছ! যদি তাদের তেমনি কাছে যেতে পারতুম, যদি তাদের সেই স্পর্শ সেই সম্ভাষণ লাভ করতুম তাহলে মুহূর্তের মধ্যে বুঝতে পারতুম, তাদের কৃত সমস্ত উপকারের চেয়ে এইটুকু কত বড়ো। মানুষের মধ্যে আমি চিরজীবন বাস করলুম কিন্তু মানুষ আমাকে স্পর্শ করে বলছে না, তুমি এসেছ! আমি একটা আবরণের মধ্যে আবৃত হয়ে পৃথিবীতে সঞ্চরণ করছি। ডিমের মধ্যে পক্ষিশিশু যেমন পৃথিবীতে জন্মেও জন্মলাভ করে না এও সেই রকম।

এই অস্ফুট চেতনার ডিমের ভিতর থেকে জন্মলাভই আধ্যাত্মিক জন্ম। সেই জন্মের দ্বারাই আমরা দ্বিজ হব। সেই জন্মই জগতে যথার্থরূপে জন্ম–জীবচৈতন্যের বিশ্বচৈতন্যের মধ্যে জন্ম। তখনই পক্ষিশিশু পক্ষিমাতার পক্ষপুটের সম্পূর্ণ সংস্পর্শ লাভ করে–তখনই মানুষ সর্বত্রই সেই সর্বকে প্রাপ্ত হয়। সেই প্রাপ্ত হওয়া যে কী আশ্চর্য সার্থকতা কী অনির্বচনীয় আনন্দ তা আমরা জানি নে কিন্তু জীবনে কি ক্ষণে ক্ষণে তার আভাসমাত্রও পাই নে!

আধ্যাত্মিকতায় আমাদের আর কিছু দেয় না আমাদের ঔদাসীন্য আমাদের অসাড়তা ঘুচিয়ে দেয়। অর্থাৎ তখনই আমরা চেতনার দ্বারা চেতনাকে, আত্মার দ্বারা আত্মাকে পাই। সেই রকম করে যখন পাই তখন আর আমাদের বুঝতে বাকি থাকে না যে সমস্তই তাঁর আনন্দরূপ।

তৃণ থেকে মানুষ পর্যন্ত জগতে যেখানেই আমার চিত্ত উদাসীন থাকে সেখানেই আমাদের আধ্যাত্মিকতা সীমাবদ্ধ হয়েছে এটি জানতে হবে। আমাদের চেতনা আমাদের আত্মা যখন সর্বত্র প্রসারিত হয় তখন জগতের সমস্ত সত্তাকে আমাদের সত্তার দ্বারাই অনুভব করি, ইন্দ্রিয়ের দ্বারা নয়, বুদ্ধির দ্বারা নয়, বৈজ্ঞানিক যুক্তির দ্বারা নয়। সেই পরিপূর্ণ অনুভূতি একটি আশ্চর্য ব্যাপার। এই সমুখের গাছটিকেও যদি সেই সত্তারূপে গভীররূপে অনুভব করি তবে যে আমার সমস্ত সত্তা আনন্দে পরিপূর্ণ হয়ে ওঠে। তাই দেখি নে বলে একে চোখ দিয়ে দেখবামাত্র এতে আমার কোনো প্রয়োজন নেই বলে এর সম্মুখ দিয়ে চলে যাই, এই গাছের সত্যে আমার সত্যকে জাগিয়ে তুলে আমাকে আনন্দের অধিকারী করে না। মানুষকেও আমার আত্মা দিয়ে দেখি নে– ইন্দ্রিয় দিয়ে যুক্তি দিয়ে স্বার্থ দিয়ে সংসার দিয়ে সংস্কার দিয়ে দেখি–তাকে পরিবারের মানুষ, বা প্রয়োজনের মানুষ, বা নিঃসম্পর্ক মানুষ বা কোনো একটা বিশেষ শ্রেণীভুক্ত মানুষ বলেই দেখি–সুতরাং সেই সীমাতেই গিয়ে আমার পরিচয় ঠেকে যায়–সেইখানেই দরজা রুদ্ধ–তার ভিতরে আর প্রবেশ করতে পারি নে–তাকেও আত্মা বলে আমার আত্মা প্রত্যক্ষ ভাবে সম্ভাষণ করতে পারে না। যদি পারত তবে পরস্পর হাত ধরে বলত, তুমি এসেছ!

আধ্যাত্মিক সাধনার যে চরম লক্ষ্য কী তা উপনিষদে স্পষ্ট লেখা আছে–

তে সর্বগং সর্বতঃ প্রাপ্য ধীরা যুক্তাত্মানং সর্বমেবাবিশন্তি।

ধীর ব্যক্তিরা সর্বব্যাপীকে সকল দিক থেকে পেয়ে যুক্তাত্মা হয়ে সর্বত্রই প্রবেশ করেন।

এই যে সর্বত্র প্রবেশ করবার ক্ষমতাই শেষ ক্ষমতা। প্রবেশ করার মানেই হচ্ছে যুক্তাত্মা হওয়া। যখন সমস্ত পাপের সমস্ত অভ্যাসের সংস্কারের আবরণ থেকে মুক্ত হয়ে আমাদের আত্মা সর্বত্রই আত্মার সঙ্গে যুক্ত হয় তখনই সে সর্বত্র প্রবেশ করে–সেই আত্মায় গিয়ে না পৌঁছোলে সে দ্বারে এসে ঠেকে–সে মৃত্যুতেই আবদ্ধ হয়,অমৃতং যদ্বিভাতি, অমৃতরূপে যিনি সকলের মধ্যেই প্রকাশমান সেই অমৃতের মধ্যে আত্মা পৌঁছোতে পারে না–সে আর সমস্তই দেখে কেবল আনন্দরূপমমৃতং দেখে না।

এই যে আত্মা দিয়ে বিশ্বের সর্বত্র আত্মার মধ্যে প্রবেশ করা এই তো আমাদের সাধনার লক্ষ্য। প্রতিদিন এই পথেই যে আমারা চলছি এটা তো আমাদের উপলব্ধি করতে হবে। অন্ধভাবে জড়ভাবে তো এটা হবে না। চেতন ভাবেই তো চেতনার বিস্তার হতে থাকবে। প্রতিদিন তো আমাদের বুঝতে হবে একটু একটু করে আমাদের প্রবেশপথ খুলে যাচ্ছে আমাদের অধিকার ব্যাপ্ত হচ্ছে। সকলের সঙ্গে বেশি করে মিলতে পাচ্ছি, অল্পে অল্পে সমস্ত বিরোধ কেটে যাচ্ছে–মানুষের সঙ্গে মিলনের মধ্যে, সংসারের কর্মের মধ্যে, ভূমার প্রকাশ প্রতিদিন অব্যাহত হয়ে আসছে। আমিত্ব বলে যে সুদুর্ভেদ্য আবরণ আমাকে সকলের সঙ্গে অত্যন্ত বিভক্ত করে রেখেছিল তা ধীরে ধীরে ক্ষীণ হয়ে আসছে, ক্রমেই তা স্বচ্ছ হয়ে তার ভিতর থেকে নিখিলের আলো ক্রমে ক্রমে স্ফুটতর হয়ে দেখা যাচ্ছে–আমি আমার দ্বারা কাউকে আচ্ছন্ন কাউকে বিকৃত করছি নে, আমার মধ্যে অন্যের এবং অন্যের মধ্যে আমার বাধা প্রত্যহই কেটে যাচ্ছে।

সকল অধ্যায়

১. সংশয়
২. অভাব
৩. আত্মার দৃষ্টি
৪. পাপ
৫. দুঃখ
৬. ত্যাগ
৭. ত্যাগের ফল
৮. প্রেম
৯. সামঞ্জস্য
১০. কী চাই?
১১. প্রার্থনা
১২. বিকার-শঙ্কা
১৩. দেখা
১৪. শোনা
১৫. হিসাব
১৬. শান্তিনিকেতনে ৭ই পৌষের উৎসব
১৭. দীক্ষা
১৮. মানুষ
১৯. ভাঙা হাট
২০. উৎসবশেষ
২১. সঞ্চয়তৃষ্ণা
২২. পার করো
২৩. এপার ওপার
২৪. দিন
২৫. রাত্রি
২৬. প্রভাতে
২৭. বিশেষ
২৮. প্রেমের অধিকার
২৯. ইচ্ছা
৩০. সৌন্দর্য
৩১. প্রার্থনার সত্য
৩২. বিধান
৩৩. তিন
৩৪. পার্থক্য
৩৫. প্রকৃতি
৩৬. পাওয়া
৩৭. সমগ্র
৩৮. কর্ম
৩৯. শক্তি
৪০. প্রাণ
৪১. জগতে মুক্তি
৪২. সমাজে মুক্তি
৪৩. মত
৪৪. নির্বিশেষ
৪৫. দুই
৪৬. বিশ্বব্যাপী
৪৭. মৃত্যুর প্রকাশ
৪৮. নবযুগের উৎসব
৪৯. ভাবুকতা ও পবিত্রতা
৫০. অন্তর বাহির
৫১. তীর্থ
৫২. বিভাগ
৫৩. দ্রষ্টা
৫৪. নিত্যধাম
৫৫. পরিণয়
৫৬. তিনতলা
৫৭. বাসনা ইচ্ছা মঙ্গল
৫৮. স্বাভাবিকী ক্রিয়া
৫৯. পরশরতন
৬০. অভ্যাস
৬১. প্রার্থনা
৬২. বৈরাগ্য
৬৩. বিশ্বাস
৬৪. সংহরণ
৬৫. নিষ্ঠা
৬৬. নিষ্ঠার কাজ
৬৭. মরণ
৬৮. সত্যকে দেখা
৬৯. সৃষ্টি
৭০. মৃত্যু ও অমৃত
৭১. তরী বোঝাই
৭২. স্বভাবকে লাভ
৭৩. অহং
৭৪. নদী ও কূল
৭৫. আত্মার প্রকাশ
৭৬. আদেশ
৭৭. সাধন
৭৮. ব্রহ্মবিহার
৭৯. পূর্ণতা
৮০. নীড়ের শিক্ষা
৮১. ভূমা
৮২. ওঁ
৮৩. স্বভাবলাভ
৮৪. অখণ্ড পাওয়া
৮৫. আত্মসমর্পণ
৮৬. সমগ্র এক
৮৭. আত্মপ্রত্যয়
৮৮. ধীর যুক্তাত্মা
৮৯. শক্ত ও সহজ
৯০. নমস্তেহস্তু
৯১. মন্ত্রের বাঁধন
৯২. প্রাণ ও প্রেম
৯৩. ভয় ও আনন্দ
৯৪. নিয়ম ও মুক্তি
৯৫. দশের ইচ্ছা
৯৬. বর্ষশেষ
৯৭. অনন্তের ইচ্ছা
৯৮. পাওয়া ও না-পাওয়া
৯৯. হওয়া
১০০. মুক্তি
১০১. মুক্তির পথ
১০২. আশ্রম
১০৩. ছুটির পর
১০৪. বর্তমান যুগ
১০৫. ভক্ত
১০৬. চিরনবীনতা
১০৭. বিশ্ববোধ
১০৮. রসের ধর্ম
১০৯. গুহাহিত
১১০. দুর্লভ
১১১. জন্মোৎসব
১১২. শ্রাবণসন্ধ্যা
১১৩. দ্বিধা
১১৪. পূর্ণ
১১৫. মাতৃশ্রাদ্ধ
১১৬. শেষ
১১৭. সামঞ্জস্য
১১৮. জাগরণ
১১৯. আত্মবোধ
১২০. ব্রাহ্মসমাজের সার্থকতা
১২১. বর্ষশেষ
১২২. নববর্ষ
১২৩. বৈশাখী ঝড়ের সন্ধ্যা
১২৪. সত্যবোধ
১২৫. সত্য হওয়া
১২৬. সত্যকে দেখা
১২৭. বিশেষত্ব ও বিশ্ব
১২৮. পিতার বোধ
১২৯. সৃষ্টির অধিকার
১৩০. ছোটো ও বড়ো
১৩১. সৌন্দর্যের সকরুণতা
১৩২. অমৃতের পুত্র
১৩৩. যাত্রীর উৎসব
১৩৪. মাধুর্যের পরিচয়
১৩৫. একটি মন্ত্র
১৩৬. উদ্‌বোধন
১৩৭. মুক্তির দীক্ষা
১৩৮. প্রতীক্ষা
১৩৯. অগ্রসর হওয়ার আহ্বান
১৪০. মা মা হিংসীঃ
১৪১. পাপের মার্জনা
১৪২. সৃষ্টির ক্রিয়া
১৪৩. দীক্ষার দিন
১৪৪. আরো
১৪৫. আবির্ভাব
১৪৬. অন্তরতর শান্তি

নোট নিতে এবং টেক্সট হাইলাইট করতে লগইন করুন

লগইন