এপার ওপার

রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর

যার সঙ্গে আমার সামান্য পরিচয় আছে মাত্র সে আমার পাশে বসে থাকলেও তার আর আমার মাঝখানে একটি সমুদ্র পড়ে থাকে–সেটি হচ্ছে অচৈতন্যের সমুদ্র, ঔদাসীন্যের সমুদ্র। যদি কোনোদিন সেই লোক আমার প্রাণের বন্ধু হয়ে ওঠে তখনই সমুদ্র পার হয়ে যাই। তখন আকাশের ব্যবধান মিথ্যা হয়ে যায়, দেহের ব্যবধানও ব্যবধান থাকে না, এমন কি, মৃত্যুর ব্যবধানও অন্তরাল রচনা করে না। যে অহংকার আমাদের পরস্পরের চারদিকে পাঁচিল তুলে পরস্পরকে অতিনিকটেও দূর করে রাখে, সে যার জন্যে পথ ছেড়ে দেয় সেই আমাদের আপন হয়ে ওঠে।

সেইজন্যে কাল বলেছিলুম সমুদ্র পার হওয়া কোনো একটা সুদূরে পাড়ি দেবার ব্যাপার নয়, সে হচ্ছে কাছের জিনিসকেই কাছের করে নেওয়া।

বস্তুত আমাদের যত কাছের জিনিস যত দূরে রয়েছে তার দূরত্বটাও ততই ভয়ানক। এই কারণেই, আমরা আত্মীয়কে যখন পর করি তখন পরের চেয়ে তাকে বেশি পর করি। যার ঘনিষ্ঠ সংস্রবে আছি তাকে যখন অনুভবমাত্র করি নে তখন সেই অসাড়তা মৃত্যুর অসাড়তার চেয়ে অনেক বেশি।

এই কারণেই, জগতের সকলের চেয়ে যিনি অন্তরতম তাঁকেই যখন দূর বলে জানি তখন তিনি জগতের সকলের চেয়ে দূরে গিয়ে পড়েন–যিনি আমাদের প্রাণের প্রাণ তিনি ওই স্থূল দেয়ালের চেয়ে দূরে দাঁড়ান–সংসারে তখন এমন কোনো দূরত্ব নেই যার চেয়ে দূরে তিনি সরে না যান। এই দূরত্বের বেদনা আমরা স্পষ্ট করে উপলব্ধি করি নে বটে কিন্তু এই দূরত্বের ভারে আমাদের প্রতিদিনের অস্তিত্ব, আমাদের ঘরদুয়ার, কাজকর্ম, আমাদের সমস্ত সামাজিক সম্বন্ধ ভারাক্রান্ত হয়ে পড়ে।

অথচ যে সমুদ্রপারের জন্যে আমরা কেঁদে বেড়াচ্ছি সে পারটা যে কত কাছে– এমন কি, এপারের চেয়েও যে সে কাছে, সে-কথা, যাঁরা জানেন, তাঁরা অত্যন্ত স্পষ্ট করেই বলেছেন। শুনলে হঠাৎ আমাদের চমক লাগে–মনে হয় এত কাছের কথাকেও আমরা এতই দূর করে জেনেছিলুম। একেই বলেছিলুম অগম্য, অপার, অসাধ্য।

যাঁরা সমুদ্র পার হয়েছেন তাঁরা কী বলেন। তাঁরা বলেন, এষাস্য পরমাগতিঃ এষাস্য পরমাসম্পৎ, এষোহস্য পরমোলোকঃ, এষোহস্য পরম আনন্দঃ। এষঃ মানে ইনি–এই সামনেই যিনি, এই কাছেই যিনি আছেন। অস্য মানে ইহার–সেও খুব নিকটের ইহার। ইনিই হচ্ছেন ইহার পরম গতি। যিনি যার পরম গতি তিনি তার থেকে লেশমাত্র দূরে নেই। এতই কাছে যে তাঁকে ইনি বলেলেই হয়, তাঁর নাম করবারও দরকার নেই–“এই যে ইনি” বলা ছাড়া তাঁর আর কোনো পরিচয় দেবার প্রয়োজন হয় না। ইনিই হচ্ছেন ইহার সমস্তই। ইনি যে কে এবং ইহার যে কাহার সে আর বলাই হল না। সমুদ্রের এপারে যে আছে সে তো ওপারের লোককে এষঃ বলে না, ইনি বলে না।

ইনি হচ্ছেন ইহার পরমাগতি। আমরা যে চলি, আমাদের চালায় কে? আমরা মনে করি টাকা আমাদের চালায়, খ্যাতি আমাদের চালায়, মানুষ আমাদের চালায়; যিনি পার হয়েছেন তিনি বলেন ইনিই ইহার গতি–এঁর টানেই এ চলেছে–টাকার টান, খ্যাতির টান, মানুষের টান, সব টানের মধ্যে পরম টান হচ্ছে এঁর–সব টান যেতে পারে কিন্তু সে টান থেকেই যায়–কেননা সব যাওয়ার মধ্যেই তাঁর কাছে যাওয়ার তাগিদ রয়েছে। টাকাও বলে না তুমি এইখানেই থেকে যাও, খ্যাতিও বলে না, মানুষও বলে না–সবাই বলে তুমি চলো–যিনি পরমাগতি তিনিই গতি দিচ্ছেন, আর কেউ যে পথের মধ্যে বরাবরের মতো আটক করে রাখবে এমন সাধ্য আছে কার?

আমারা হয়তো মনে করতে পারি পৃথিবী যে আমাকে টানছে সেটা পৃথিবীরই টান, কিন্তু তাই যদি হবে, পৃথিবীকে টানে কে? সূর্যকে কে আকর্ষণ করছে? এই যে বিশ্বব্যাপী আকর্ষণের জোরে গ্রহতারানক্ষত্রকে ঘোরাচ্ছে, কাউকে নিশ্চল থাকতে দিচ্ছে না। সেই বিরাট কেন্দ্রাকর্ষণের কেন্দ্র তো পৃথিবীতে নেই। একটি পরমাগতি আছে, যা আমারও গতি, পৃথিবীরও গতি, সূর্যেরও গতি।

এই পরমাগতির কথা স্মরণ করেই উপনিষৎ বলেছেন “কোহ্যেবান্যাৎ কঃ প্রাণ্যাৎ যদেষ আকাশ আনন্দো ন স্যাৎ’–কেই বা কোনোপ্রকারের কিছুমাত্র চেষ্টা করত যদি আকাশ পরিপূর্ণ করে সেই আনন্দ না থাকতেন। সেই আনন্দই বিশ্বকে নন্তগতি দান করে রয়েছেন–আকাশপূর্ণ সেই আনন্দ আছেন বলেই আমার চোখের পাতাটি আমি খুলতে পারছি।

তাই আমি বলছি, আমার পরমাগতি দূরে নেই, আমার সকল তুচ্ছ গতির মধ্যেই সেই পরমাগতি আছেন। যেমন আপেল ফলটি মাটিতে পড়ার মধ্যেই বিশ্বব্যাপী কেন্দ্রাকর্ষণশক্তি আছে। আমার শরীরের সকল চলা এবং আমার মনের সকল চেষ্টার যিনি পরমাগতি, তিনি হচ্ছেন এষঃ, এই ইনি। সেই গতির কেন্দ্র দূরে নয়–এই যে এইখানেই।

তার পরে যিনি আমাদের পরম সম্পৎ, আমাদের পরম আশ্রয়, আমাদের পরম আনন্দ–তিনি আমাদের প্রতিদিনের সমস্ত সম্পদ, প্রতিদিনের সমস্ত আশ্রয় এবং প্রতিদিনের সমস্ত আনন্দের মধ্যেই রয়েছেন। আমাদের ধনজন, আমাদের ঘরদুয়ার, আমাদের সমস্ত রসভোগের মধ্যেই যিনি পরমরূপে রয়েছেন তিনি যে এষঃ–তিনি যে ইনি–এই যে এইখানেই।

আমার সমস্ত গতিতে সেই পরম গতিকে, আমার সমস্ত সম্পদে সেই পরম সম্পদকে, আমার সমস্ত আশ্রয়ে সেই পরম আশ্রয়কে আমার সমস্ত আনন্দেই সেই পরম আনন্দকে এষঃ বলে জানব–একেই বলে পার হওয়া।

১২ পৌষ

সকল অধ্যায়

১. সংশয়
২. অভাব
৩. আত্মার দৃষ্টি
৪. পাপ
৫. দুঃখ
৬. ত্যাগ
৭. ত্যাগের ফল
৮. প্রেম
৯. সামঞ্জস্য
১০. কী চাই?
১১. প্রার্থনা
১২. বিকার-শঙ্কা
১৩. দেখা
১৪. শোনা
১৫. হিসাব
১৬. শান্তিনিকেতনে ৭ই পৌষের উৎসব
১৭. দীক্ষা
১৮. মানুষ
১৯. ভাঙা হাট
২০. উৎসবশেষ
২১. সঞ্চয়তৃষ্ণা
২২. পার করো
২৩. এপার ওপার
২৪. দিন
২৫. রাত্রি
২৬. প্রভাতে
২৭. বিশেষ
২৮. প্রেমের অধিকার
২৯. ইচ্ছা
৩০. সৌন্দর্য
৩১. প্রার্থনার সত্য
৩২. বিধান
৩৩. তিন
৩৪. পার্থক্য
৩৫. প্রকৃতি
৩৬. পাওয়া
৩৭. সমগ্র
৩৮. কর্ম
৩৯. শক্তি
৪০. প্রাণ
৪১. জগতে মুক্তি
৪২. সমাজে মুক্তি
৪৩. মত
৪৪. নির্বিশেষ
৪৫. দুই
৪৬. বিশ্বব্যাপী
৪৭. মৃত্যুর প্রকাশ
৪৮. নবযুগের উৎসব
৪৯. ভাবুকতা ও পবিত্রতা
৫০. অন্তর বাহির
৫১. তীর্থ
৫২. বিভাগ
৫৩. দ্রষ্টা
৫৪. নিত্যধাম
৫৫. পরিণয়
৫৬. তিনতলা
৫৭. বাসনা ইচ্ছা মঙ্গল
৫৮. স্বাভাবিকী ক্রিয়া
৫৯. পরশরতন
৬০. অভ্যাস
৬১. প্রার্থনা
৬২. বৈরাগ্য
৬৩. বিশ্বাস
৬৪. সংহরণ
৬৫. নিষ্ঠা
৬৬. নিষ্ঠার কাজ
৬৭. মরণ
৬৮. সত্যকে দেখা
৬৯. সৃষ্টি
৭০. মৃত্যু ও অমৃত
৭১. তরী বোঝাই
৭২. স্বভাবকে লাভ
৭৩. অহং
৭৪. নদী ও কূল
৭৫. আত্মার প্রকাশ
৭৬. আদেশ
৭৭. সাধন
৭৮. ব্রহ্মবিহার
৭৯. পূর্ণতা
৮০. নীড়ের শিক্ষা
৮১. ভূমা
৮২. ওঁ
৮৩. স্বভাবলাভ
৮৪. অখণ্ড পাওয়া
৮৫. আত্মসমর্পণ
৮৬. সমগ্র এক
৮৭. আত্মপ্রত্যয়
৮৮. ধীর যুক্তাত্মা
৮৯. শক্ত ও সহজ
৯০. নমস্তেহস্তু
৯১. মন্ত্রের বাঁধন
৯২. প্রাণ ও প্রেম
৯৩. ভয় ও আনন্দ
৯৪. নিয়ম ও মুক্তি
৯৫. দশের ইচ্ছা
৯৬. বর্ষশেষ
৯৭. অনন্তের ইচ্ছা
৯৮. পাওয়া ও না-পাওয়া
৯৯. হওয়া
১০০. মুক্তি
১০১. মুক্তির পথ
১০২. আশ্রম
১০৩. ছুটির পর
১০৪. বর্তমান যুগ
১০৫. ভক্ত
১০৬. চিরনবীনতা
১০৭. বিশ্ববোধ
১০৮. রসের ধর্ম
১০৯. গুহাহিত
১১০. দুর্লভ
১১১. জন্মোৎসব
১১২. শ্রাবণসন্ধ্যা
১১৩. দ্বিধা
১১৪. পূর্ণ
১১৫. মাতৃশ্রাদ্ধ
১১৬. শেষ
১১৭. সামঞ্জস্য
১১৮. জাগরণ
১১৯. আত্মবোধ
১২০. ব্রাহ্মসমাজের সার্থকতা
১২১. বর্ষশেষ
১২২. নববর্ষ
১২৩. বৈশাখী ঝড়ের সন্ধ্যা
১২৪. সত্যবোধ
১২৫. সত্য হওয়া
১২৬. সত্যকে দেখা
১২৭. বিশেষত্ব ও বিশ্ব
১২৮. পিতার বোধ
১২৯. সৃষ্টির অধিকার
১৩০. ছোটো ও বড়ো
১৩১. সৌন্দর্যের সকরুণতা
১৩২. অমৃতের পুত্র
১৩৩. যাত্রীর উৎসব
১৩৪. মাধুর্যের পরিচয়
১৩৫. একটি মন্ত্র
১৩৬. উদ্‌বোধন
১৩৭. মুক্তির দীক্ষা
১৩৮. প্রতীক্ষা
১৩৯. অগ্রসর হওয়ার আহ্বান
১৪০. মা মা হিংসীঃ
১৪১. পাপের মার্জনা
১৪২. সৃষ্টির ক্রিয়া
১৪৩. দীক্ষার দিন
১৪৪. আরো
১৪৫. আবির্ভাব
১৪৬. অন্তরতর শান্তি

নোট নিতে এবং টেক্সট হাইলাইট করতে লগইন করুন

লগইন