বিশ্বব্যাপী

রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর

যো দেবোহগ্নৌ যোহপ্‌সু, য্যো বিশ্বং ভুবনমাবিবেশ,
য ওষধিষু, যো বনস্পতিষু, তস্মৈ দেবায় নমোনমঃ।

যে দেবতা অগ্নিতে, যিনি জলে, যিনি বিশ্বভুবনে প্রবিষ্ট হয়ে আছেন, যিনি ওষধিতে, যিনি বনস্পতিতে সেই দেবতাকে বার বার নমস্কার করি।

ঈশ্বর সর্বত্র আছেন এ-কথাটা আমাদের কাছে অত্যন্ত অভ্যস্ত হয়ে গেছে। এইজন্য এই মন্ত্র আমাদের কাছে অনাবশ্যক ঠেকে। অর্থাৎ এই মন্ত্রে আমাদের মনের মধ্যে কোনো চিন্তা জাগ্রত হয় না।

অথচ এ কথাও সত্য যে ঈশ্বরের সর্বব্যাপিত্ব সম্বন্ধে আমরা যতই নিশ্চিন্ত হয়ে থাকি না কেন, তস্মৈ দেবায় নমোনমঃ– এ আমাদের অভিজ্ঞতার কথা নয়, আমরা সেই দেবতাকে নমস্কার করতে পারি নে। ঈশ্বর সর্বব্যাপী এ আমাদের শোনা কথা মাত্র। শোনা কথা পুরাতন হয়ে যায়, মৃত হয়ে যায়। এ-কথাও আমাদের পক্ষে মৃত।

কিন্তু এ-কথা যাঁরা কানে শুনে বলেন নি– যাঁরা মন্ত্রদ্রষ্টা, মন্ত্রটিকে যাঁরা দেখেছেন তবে বলতে পেরেছেন– তাঁদের সেই প্রত্যক্ষ উপলব্ধির বাণীকে অন্যমনস্ক হয়ে শুনলে চলে না। এ বাক্য যে কতখানি সত্য তা আমরা যেন সম্পূর্ণ সচেতনভাবে গ্রহণ করি।

যে জিনিসকে আমরা সর্বদাই ব্যবহার করি, যাতে আমদের প্রয়োজনসাধন হয়, আমাদের কাছে তার তাৎপর্য অত্যন্ত সংকীর্ণ হয়ে যায়। স্বার্থ জিনিসটা যে কেবল নিজে ক্ষুদ্র তা নয়, যার প্রতি সে হস্তক্ষেপ করে তাকেও ক্ষুদ্র করে তোলে। এমন কি, যে মানুষকে আমরা বিশেষভাবে প্রয়োজনে লাগাই, সে আমাদের কাছে তার মানবত্ব পরিহার করে বিশেষ যন্ত্রের শামিল হয়ে ওঠে। কেরানি তার আপিসের মনিবের কাছে প্রধানত যন্ত্র, রাজার কাছে সৈন্যেরা যন্ত্র, যে চাষা আমাদের অন্নের সংস্থান করে দেয় সে সজীব লাঙল বললেই হয়। কোনো দেশের অধিপতি যদি এ-কথা অত্যন্ত করে জানেন যে সেই দেশ থেকে তাঁদের নানাপ্রকার সুবিধা ঘটছে, তবে সেই দেশকে তাঁরা সুবিধার কঠিন জড় আবরণে বেষ্টিত করে দেখেন– প্রয়োজন-সম্বন্ধের অতীত যে চিত্ত তাকে তাঁরা দেখতে পারেন না।

জগৎকে আমরা অত্যন্ত ব্যবহারের সামগ্রী করে তুলেছি। এইজন্য তার জলস্থল-বাতাসকে আমরা অবজ্ঞা করি– তাদের আমরা অহংকৃত হয়ে ভৃত্য বলি এবং জগৎ আমাদের কাছে একটা যন্ত্র হয়ে ওঠে।

এই অবজ্ঞার দ্বারা আমরা নিজেকেই বঞ্চিত করি। যাকে আমরা বড়ো করে পেতুম তাকে ছেটো করে পাই, যাতে আমাদের চিত্তও পরিতৃপ্ত হত তাতে আমাদের পেট ভরে মাত্র।

যাঁরা জলস্থলবাতাসকে কেবল প্রতিদিনের ব্যবহারের দ্বারা জীর্ণ সংকীর্ণ করে দেখেন নি, যাঁরা নিত্য নবীন দৃষ্টি ও উজ্জ্বল জাগ্রত চৈতন্যের দ্বারা বিশ্বকে অন্তরের মধ্যে সমাদৃত অতিথির মতো গ্রহণ করেছেন এবং চরাচর সংসারের মাঝখানে জোড়হস্তে দাঁড়িয়ে বলেছেন–

যো দেবোহগ্নৌ যোহপ্‌সু, যো বিশ্বং ভুবনমাবিবেশ,
য ওষধিষু, যো বনস্পতিষু তস্মৈ দেবায় নমোনমঃ।

তাঁদের উচ্চারিত এই সজীব মন্ত্রটিকে জীবনের মধ্যে গ্রহণ করে ঈশ্বর যে সর্বব্যাপী এই জ্ঞানকে সর্বত্র সার্থক করো। যিনি সর্বত্র প্রত্যক্ষ, তাঁর প্রতি তোমার ভক্তি সর্বত্র উচ্ছ্বসিত হয়ে উঠুক।

বোধশক্তিকে আর অলস রেখো না, দৃষ্টির পশ্চাতে সমস্ত চিত্তকে প্রেরণ করো। দক্ষিণে বামে, অধোতে ঊর্ধ্বে, সম্মুখে পশ্চাতে চেতনার দ্বারা চেতনার স্পর্শলাভ করো। তোমার মধ্যে অহোরাত্র যে ধীশক্তি বিকীর্ণ হচ্ছে, সেই ধীশক্তির যোগে ভূর্ভুবঃস্বর্লোকে সর্বব্যাপী ধীকে ধ্যান করো– নিজের তুচ্ছতা-দ্বারা অগ্নি জলকে তুচ্ছ কোরো না। সমস্তই আশ্চর্য, সমস্তই পরিপূর্ণ। নমোনমঃ, নমোনমঃ– সর্বত্রই মাথা নত হোক, হৃদয় নম্র হোক এবং আত্মীয়তা প্রসারিত হয়ে যাক। যাকে বিনা মূল্যে পেয়েছ তাকে সচেতন সাধনার মূল্যে লাভ করো, যে অজস্র অক্ষয় বাহিরে রয়েছে তাকে অন্তরে গ্রহণ করে ধন্য হও।

য ওষধিষু যো বনস্পতিষু তস্মৈ দেবায় নমোনমঃ– পূর্বছত্রে আছে যিনি অগ্নিতে, জলে, যিনি বিশ্বভুবনে প্রবিষ্ঠ হয়ে আছেন। তার পরে আছে যিনি ওষধিতে বনস্পতিতে তাঁকে বারবার নমস্কার করি।

হঠাৎ মনে হতে পারে প্রথম ছত্রেই কথাটা নিঃশেষ হয়ে গেছে– তিনি বিশ্বভুবনেই আছেন– তবে কেন শেষের দিকে কথাটাকে এত ছোটো করে ওষধি বনস্পতির নাম করা হল।

বস্তুত মানুষের কাছে এইটেই শেষের কথা। ঈশ্বর বিশ্বভুবনে আছে এ-কথা বলা শক্ত নয় এবং আমরা অনায়াসেই বলে থাকি, এ-কথা বলতে গেলে আমাদের উপলব্ধিকে অত্যন্ত সত্য করে তোলার প্রয়োজন হয় না। কিন্তু তার পরেও যে-ঋষি বলেছেন তিনি এই ওষধিতে এই বনস্পতিতে আছেন সে-ঋষি মন্ত্রদ্রষ্টা। মন্ত্রকে তিনি কেবল মননের দ্বারা পান নি, দর্শনের দ্বারা পেয়েছেন। তিনি তাঁর তপোবনের তরুলতার মধ্যে কেমন পরিপূর্ণ চেতনভাবে ছিলেন, তিনি যে-নদীর জলে স্নান করতেন সে স্নান কী পবিত্র স্নান,কী সত্য স্নান, তিনি যে-ফল ভক্ষণ করেছিলেন তার স্বাদের মধ্যে কী অমৃতের স্বাদ ছিল, তাঁর চক্ষে প্রভাতের সূর্যোদয় কী গভীর গম্ভীর কী অপরূপ প্রাণময় চৈতন্যময় সূর্যোদয়– সে-কথা মনে করলে হৃদয় পুলকিত হয়।

তিনি বিশ্বভুবনে আছেন এ-কথা বলে তাঁকে সহজে বিদায় করে দিলে চলবে না– কবে বলতে পারব তিনি এই ওষধিতে আছেন, এই বনস্পতিতে আছেন।

৫ মাঘ

সকল অধ্যায়

১. সংশয়
২. অভাব
৩. আত্মার দৃষ্টি
৪. পাপ
৫. দুঃখ
৬. ত্যাগ
৭. ত্যাগের ফল
৮. প্রেম
৯. সামঞ্জস্য
১০. কী চাই?
১১. প্রার্থনা
১২. বিকার-শঙ্কা
১৩. দেখা
১৪. শোনা
১৫. হিসাব
১৬. শান্তিনিকেতনে ৭ই পৌষের উৎসব
১৭. দীক্ষা
১৮. মানুষ
১৯. ভাঙা হাট
২০. উৎসবশেষ
২১. সঞ্চয়তৃষ্ণা
২২. পার করো
২৩. এপার ওপার
২৪. দিন
২৫. রাত্রি
২৬. প্রভাতে
২৭. বিশেষ
২৮. প্রেমের অধিকার
২৯. ইচ্ছা
৩০. সৌন্দর্য
৩১. প্রার্থনার সত্য
৩২. বিধান
৩৩. তিন
৩৪. পার্থক্য
৩৫. প্রকৃতি
৩৬. পাওয়া
৩৭. সমগ্র
৩৮. কর্ম
৩৯. শক্তি
৪০. প্রাণ
৪১. জগতে মুক্তি
৪২. সমাজে মুক্তি
৪৩. মত
৪৪. নির্বিশেষ
৪৫. দুই
৪৬. বিশ্বব্যাপী
৪৭. মৃত্যুর প্রকাশ
৪৮. নবযুগের উৎসব
৪৯. ভাবুকতা ও পবিত্রতা
৫০. অন্তর বাহির
৫১. তীর্থ
৫২. বিভাগ
৫৩. দ্রষ্টা
৫৪. নিত্যধাম
৫৫. পরিণয়
৫৬. তিনতলা
৫৭. বাসনা ইচ্ছা মঙ্গল
৫৮. স্বাভাবিকী ক্রিয়া
৫৯. পরশরতন
৬০. অভ্যাস
৬১. প্রার্থনা
৬২. বৈরাগ্য
৬৩. বিশ্বাস
৬৪. সংহরণ
৬৫. নিষ্ঠা
৬৬. নিষ্ঠার কাজ
৬৭. মরণ
৬৮. সত্যকে দেখা
৬৯. সৃষ্টি
৭০. মৃত্যু ও অমৃত
৭১. তরী বোঝাই
৭২. স্বভাবকে লাভ
৭৩. অহং
৭৪. নদী ও কূল
৭৫. আত্মার প্রকাশ
৭৬. আদেশ
৭৭. সাধন
৭৮. ব্রহ্মবিহার
৭৯. পূর্ণতা
৮০. নীড়ের শিক্ষা
৮১. ভূমা
৮২. ওঁ
৮৩. স্বভাবলাভ
৮৪. অখণ্ড পাওয়া
৮৫. আত্মসমর্পণ
৮৬. সমগ্র এক
৮৭. আত্মপ্রত্যয়
৮৮. ধীর যুক্তাত্মা
৮৯. শক্ত ও সহজ
৯০. নমস্তেহস্তু
৯১. মন্ত্রের বাঁধন
৯২. প্রাণ ও প্রেম
৯৩. ভয় ও আনন্দ
৯৪. নিয়ম ও মুক্তি
৯৫. দশের ইচ্ছা
৯৬. বর্ষশেষ
৯৭. অনন্তের ইচ্ছা
৯৮. পাওয়া ও না-পাওয়া
৯৯. হওয়া
১০০. মুক্তি
১০১. মুক্তির পথ
১০২. আশ্রম
১০৩. ছুটির পর
১০৪. বর্তমান যুগ
১০৫. ভক্ত
১০৬. চিরনবীনতা
১০৭. বিশ্ববোধ
১০৮. রসের ধর্ম
১০৯. গুহাহিত
১১০. দুর্লভ
১১১. জন্মোৎসব
১১২. শ্রাবণসন্ধ্যা
১১৩. দ্বিধা
১১৪. পূর্ণ
১১৫. মাতৃশ্রাদ্ধ
১১৬. শেষ
১১৭. সামঞ্জস্য
১১৮. জাগরণ
১১৯. আত্মবোধ
১২০. ব্রাহ্মসমাজের সার্থকতা
১২১. বর্ষশেষ
১২২. নববর্ষ
১২৩. বৈশাখী ঝড়ের সন্ধ্যা
১২৪. সত্যবোধ
১২৫. সত্য হওয়া
১২৬. সত্যকে দেখা
১২৭. বিশেষত্ব ও বিশ্ব
১২৮. পিতার বোধ
১২৯. সৃষ্টির অধিকার
১৩০. ছোটো ও বড়ো
১৩১. সৌন্দর্যের সকরুণতা
১৩২. অমৃতের পুত্র
১৩৩. যাত্রীর উৎসব
১৩৪. মাধুর্যের পরিচয়
১৩৫. একটি মন্ত্র
১৩৬. উদ্‌বোধন
১৩৭. মুক্তির দীক্ষা
১৩৮. প্রতীক্ষা
১৩৯. অগ্রসর হওয়ার আহ্বান
১৪০. মা মা হিংসীঃ
১৪১. পাপের মার্জনা
১৪২. সৃষ্টির ক্রিয়া
১৪৩. দীক্ষার দিন
১৪৪. আরো
১৪৫. আবির্ভাব
১৪৬. অন্তরতর শান্তি

নোট নিতে এবং টেক্সট হাইলাইট করতে লগইন করুন

লগইন