৬৫. সূর্য আর বাদল

সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়

সূর্য আর বাদল নেমন্তন্ন করতে বেরিয়েছে। ভবানীপুরে বড়বাবুর বড় মা’র বাড়িতে সূর্য আগে কখনও আসেনি। বাদলের মনে পড়ল অনেক দিন আগে এ বাড়িতে সে বড়বাবুর হাত ধরে একদিন এসেছিল। তখন মন্দাকিনী বেঁচে ছিলেন। বড়বাবুর সঙ্গে মন্দাকিনীর কী সব বিচিত্র কথাবার্তা হয়েছিল–বাদলের অস্পষ্ট মনে আছে এখনও। মন্দাকিনী ম্যাগনিফাইং গ্লাস নিয়ে মানুষের দিকে তাকাতেন, তার ঠোঁটে রক্ত মাখানো : থাকত, তার সামনে এসে বড়বাবু একেবারে শিশুর মতন হয়ে পড়তেন।

মন্দাকিনীর মৃত্যুর পর বাড়িটা অনেক বদলে গেছে। সেই গেট কিংবা বাগানে ফোয়ারা আর নেই। একতলায় সেই পুরনো কায়দায় সাজানো বৈঠকখানাটিও আর খুঁজে পাওয়া যাবে না–গোটা একতলা জুড়ে এখন একটা পাখা কোম্পানির অফিস।

জীমূত বাড়িতে নেই। জেল থেকে ছেড়ে দেবার পর তাকে দিল্লি পাঠিয়ে দেও হয়েছে। ওখানেই বাকি পড়াশুনো শেষ করবে। রাজনীতি থেকে দূরে সরিয়ে রাখার জন্য তার বাড়ির লোকের এই প্রয়াস।

সুরেশ্বর বড়বাবুর অসুখের সময় প্রায় প্রত্যেক দিন গিয়ে খোঁজখবর নিয়েছেন, শ্মশানেও গিয়েছিলেন। সূর্যকে জড়িয়ে ধরে তিনি আবার কিছুক্ষণ কাঁদলেন। তারপর একটু সামলে নিয়ে বললেন, অমরদার একটা ছবি আমাকে দিয়ো। উনি আমার বড়ভাইয়ের চেয়েও বেশি ছিলেন।

ওপর তলায় এসে একটা ব্যাপার দেখে বাদলের খুব অবাক লাগল। মন্দাকিনীর ঘরটা অবিকল ঠিক সেই আগের মতনই সাজানো রয়েছে। শুধু বিছানার ওপর মন্দাকিনীর ছোট্ট কোঁকড়ানো শরীরটা নেই। প্রায় বারো-তেরো বছর আগে বাদল এই ঘরখানা একই। রকম দেখেছিল, ওইখানে খাটের বাজুর পাশে বড়বাবু পঁাড়িয়ে ছিলেন। ঘরটাকে এ রকম ভাবে সাজিয়ে রাখার মানে কী? এক একটা বাড়িতে কী সব অদ্ভুত নিয়ম থাকে। অনেক মহাপুরুষের ঘর আর ব্যবহৃত জিনিসপত্র এ রকম ভাবে সাজিয়ে রাখতে দেখেছে। বাদল। হয়তো সুরেশ্বরের চোখে তার মা-ও সেই রকম।

চিররঞ্জন নিমন্ত্রিতদের লিস্ট বানিয়ে দিয়েছিলেন। এ-পাড়ার সবকটি বাড়ি সারা হয়ে যাবার পর ওরা গেল দীপ্তির বাড়িতে। বেলা প্রায় সাড়ে বারোটা বাজে। এই সময় দীপ্তি স্কুলে যান–বাড়িতে থাকার কথা নয়। কিন্তু তার ঘরের বাইরে দুটো তালা ঝুলতে দেখায় অস্বাভাবিক মনে হল। ওঁর ফ্ল্যাটে আর একটি যে মেয়ে থাকত–তার ইতিমধ্যে বিয়ে হয়ে গেছে কয়েক মাস ধরে দীপ্তিদি এখানে একাই ছিলেন।

তিনতলায় গিয়ে খবর নিয়ে জানা গেল, দীপ্তিদি দিন পনেরো আগে তার বাবা-মায়ের কাছে চলে গেছেন কাটিহারে। না, কোনও চিঠিপত্র আসেনি। স্কুল থেকে ছুটি নিয়েছেন বোধহয়।

সূর্য আর কোনও উচ্চবাচ্য করে সিঁড়ি দিয়ে নেমে এল। বাদল একটু ভয়ে ভয়ে আড়চোখে তাকাল তার দাদার মুখের দিকে। তার দাদাটির কী রকম মেজাজ তা তো সে জানে। কিন্তু সূর্যর মুখে কোনও ভাব বৈলক্ষণ নেই। খুব শান্ত ভাবে বলল, এবার কোন দিকে যাবি?

নিমন্ত্রিতদের তালিকায় সূর্যর নিজস্ব বন্ধু বা চেনাশুনো বিশেষ কেউ নেই। চিররঞ্জন। অনেক বার জিজ্ঞেস করেছিলেন, সূর্য বলেছিল, না, সে রকম কারোকে তো মনে পড়ে না। জেলখানায় সূর্যর সঙ্গে যারা একসঙ্গে ছিলেন, তাঁদের মধ্যে প্রৌঢ় সত্যসুন্দর মুখোপাধ্যায় এখন পশ্চিম বাংলার মন্ত্রী–চিররঞ্জনের বিশেষ ইচ্ছে ছিল তাকে আনার সূর্য কোনও রকম উৎসাহ দেখায়নি।

ঘুরতে ঘুরতে ওরা চলে এল বিষ্ণুদের বাড়িতে। ওরা গেট দিয়ে ঢুকে ঠাকুরদালানের সামনের বারান্দাটায় দাঁড়িয়েছে, ঠিক তখনই সিঁড়ি দিয়ে নেমে আসছিল রেণু। তরতর করে নামতে নামতে হঠাৎ থমকে দাঁড়ানো রেণুর স্বভাব।

বাদলের মনে হল, এটা একটা আশ্চর্য যোগাযোগ হলেও এবাড়িতে সে যত বার এসেছে, প্রায় প্রত্যেক বারই সে রেণুকে সিঁড়ির ওপর দাঁড়ানো অবস্থাতেই দেখেছে। মনে মনে যখনই সে রেণুর কথা ভাবতে চেষ্টা করে, রেণুকে একটা সিঁড়ির ওপরে দাঁড়ানো অবস্থাতেই দেখতে পায়। যেন রেণু নিজেই নেমে আসবে, না বাদলকেই ওপরে উঠে রেণুর কাছাকাছি পৌঁছোতে হবে, তা এখনও ঠিক হয়নি। মোট কথা, সিঁড়িতে দাঁড়ানো অবস্থাতেই রেণুকে সবচেয়ে বেশি সুন্দর লাগে বাদলের চোখে।

রেণু ওদের দেখে বলল, দাঁড়াও, ছোড়দাকে ডাকছি। আবার ওপরে উঠে গেল সে। একটু বাদেই বিষ্ণু নেমে এল, কিন্তু রেণু ফিরল না। এটা পছন্দ হল না বাদলের। এ বাড়িতে এসে রেণুকে এক মুহূর্তের জন্য চোখের আড়াল করতে ইচ্ছে করে না, সব সময় অস্বস্তি হয়, অন্য কারওর সঙ্গে কথা বলার সময় মন বসে না। বিষ্ণু কয়েক দিন বাদেই বিদেশ চলে যাচ্ছে, তখন বাদলের এ বাড়িতে আসার উপলক্ষ কমে যাবে।

সেই দিনই ভোরে গঙ্গায় গিয়ে সূর্য ঘাট কামাই করে এসেছে। মসৃণ মাথায় সূর্যকে একেবারে অন্য রকম দেখাচ্ছে। বিষ্ণু এসে বলল, এ কী?

অনেকেই মনে মনে ভেবেছিল, সূর্য মাথা ন্যাড়া করবে না। এ ব্যাপারে তাকে কেউ খুব একটা জোর করারও সাহস পেত না। জোর করেওনি কেউ, হিমানী একবারমাত্র কথাটা উচ্চারণ করায় সূর্য রাজি হয়ে গিয়েছিল। একদিন কোনও কিছুতেই সে আপত্তি জানাচ্ছে না। বোধহয় সংসারের সব রকম বন্ধন ছিঁড়ে ফেলার আগে সে শেষ বারের। মতন সকলকে খুশি করে যাচ্ছে। মুণ্ডিত মস্তক, পরনে নতুন কোরা কাপড়, বিষণ্ণ গম্ভীর মুখ–সূর্যকে সবার মাঝখানে বেখাপ্পা মনে হয়।

প্রথাসিদ্ধ ভাবে নেমন্তন্ন করে সূর্য বলল, বিষ্ণু, তোমাদের সবাইকেই যেতে হবে। কিন্তু। তোমাকে যেতে হবে দু’ দিন। শ্মশানবন্ধুদের জলপানের সময়েও তোমাকে থাকতে হবে।

বিষ্ণু বলল, আমাকে এ ভাবে বলছেন কেন? আমি তো যাবই।

তোমার মা, বাবা, জ্যাঠাইমাদের আলাদা করে বলা উচিত নিশ্চয়ই।

চলুন না ওপরে।

এই সময় রেণু একটা ট্রেতে করে দু’গেলাস শরবত নিয়ে এল। উচ্ছল ভাবে বলল, সূর্যদাকে দেখে আমি প্রথমটায় একদম চিনতে পারিনি। আপনাকে কী রকম দেখাচ্ছে বলব?

বাদল রেণুর মুখের দিকে তাকাল। সে দৃষ্টির ইঙ্গিত দিয়ে বোঝাতে চায় যে সূর্যদার আজ মন ভালো নেই, তার সঙ্গে হালকা ভাবে কথা না বলা ভালো।

রেণু সেই ইঙ্গিত লক্ষ করল না। বলল, আপনাকে ঠিক বৌদ্ধ সন্ন্যাসীর মতন দেখাচ্ছে।

কাকে কখন কী রকম দেখায়, কোন পোশাকে কাকে কী রকম মানায়–তা মেয়েরাই বেশি লক্ষ করে। বাদল এতক্ষণ তার সূর্যদাকে কী রকম দেখাচ্ছে সে বিষয়ে মাথা ঘামায়নি। রেণুর কথা শুনে মনে হল, রেণুর বর্ণনাটা যেন ঠিক। বৌদ্ধ সন্ন্যাসী সে কোনও দিন দেখেনি–কিন্তু এই রকমই হওয়ার কথা।

সূর্য এ-কথা শুনে চুপ করে রইল। রেণু আবার বলল, আপনাকে অন্য সময় দেখলেও কেন যেন সন্ন্যাসীর মতন মনে হয়।

সূর্য এবার মুখ তুলে বলল, আমাকে? আগে তো কেউ কখনও বলেনি—

বলেনি? আমি একবার একজন বৌদ্ধ সন্ন্যাসীর ছবি দেখেছিলাম, হুবহু আপনার মতন।

সূর্য বলল, রেণু, তুমি হঠাৎ বড় হয়ে গেছ। লক্ষই করিনি!

আপনার মনে আছে, আপনি সেই যে বাদলের সঙ্গে একদিন আমাদের বাড়িতে এসেছিলেন, আপনার মাথা ফেটে গিয়েছিল–

তোমার সে কথাও মনে আছে?

আমার সব মনে থাকে।

বাদল বলল, তোর কি মনে আছে, বড়বাবু কবে এ বাড়িতে এসেছিলেন?

রেণু বলল, উনি এসেছিলেন কখনও? জানি না তো!

উনি এসেছিলেন, তোকে কোলে করে নিয়ে এসেছিলেন। তুই সেই যে গঙ্গার ঘাটে হারিয়ে গিয়েছিলি?

রেণু লজ্জা পেয়ে বলল, ধ্যাৎ!

বিষ্ণু বলল, তুই তখন এইটুকুনি পুঁচকে মেয়ে—

রেণু বলল, আমি মোটেই হারিয়ে যাইনি—

বাদল বলল, আ-হা-হা। আমি না দেখলে তোকে আর কোনও দিন খুঁজেই পাওয়া যেত না। এখনও তো তোর মধ্যে কী রকম যেন একটা হারাই হারাই ভাব!

রেণু বলল, বাদল, ভালো হবে না বলে দিচ্ছি!

বিষ্ণু বলল, এই রেণু, তোকে কত দিন বলেছি, তুই বাদলের নাম ধরে ডাকবি না। বাদলদা বলতে পারিস না?

রেণু বলল, এতদিন পরে আবার নতুন করে বলা যায় বুঝি?

বাদল বলল, মোটেই নতুন করে না। আগে তুই তো আমাকে বাদলদাই বলতি। মাঝখানে হঠাৎ খুব বড় বড় ভাব দেখাতে লাগলি তো–

রেণু বলল, কেন, নাম ধরে ডাকলে আপত্তি কী আছে?

সূর্য বলল, রেণু, তোমার চোখে চশমা ছিল দেখেছিলাম না—

এখন আর পরতে হয় না। আমার চোখ ভালো হয়ে গেছে।

বিষ্ণু বলল, দেখুন না–রেণুর চোখ ভালো হয়ে গেল–কিন্তু আমাকে এবার চশমা নিতে হবে।

বাদল বলল, তুই খুব মোটা কালো ফ্রেমের চশমা নিবি। তোকে মানাবে। আমারও খুব চশমা পরার শখ।

রেণু বলল, থাক, অত শখে কাজ নেই।

কত সহজে কথার প্রসঙ্গ বদলে যায়। যৌবনের চাঞ্চল্য কখনও এক বিষয়ে থেমে থাকতে পারে না। দশ মিনিটের মধ্যে দেখা গেল ওরা সম্প্রতি কলকাতার আকাশে দেখতে পাওয়া ধূমকেতু বিষয়ে কথা বলছে। বিষ্ণু বলতে লাগল হ্যাঁলির ধূমকেতু সম্পর্কে তথ্য। তার একটু পরে সূর্যকে নিয়ে ওরা ওপরে গেল বাড়ির অন্যদের নেমন্তন্ন করতে। ফিরে আসার সময় রেণু খুব গোপনে একটা চিঠি দিয়ে দিল বাদলের হাতে। বাদল সঙ্গে সঙ্গে পকেটে পুরে দিল হাতটা।

ওরা বাড়ি ফেরার পর থেকেই শ্রীলেখা সুযোগ খুঁজতে লাগল বাদলের সঙ্গে আড়ালে কথা বলার। বাদল বিকেলের দিকে তাড়াহুড়ো করে বাড়ি থেকে বেরিয়ে যাচ্ছিল, শ্রীলেখা একতলায় দরজার কাছে তাকে ধরে বলল, এই শোন! দীপ্তিদি কী বলল রে? আসবে তো?

বাদল বলল, দীপ্তিদির সঙ্গে তো দেখাই হল না। দীপ্তিদি নেই এখানে, বাবার কাছে চলে গেছেন।

এটা যেন শ্রীলেখার কাছে একটা ব্যক্তিগত দুঃসংবাদ–শ্রীলেখার মুখখানা সেই রকম ফ্যাকাশে হয়ে গেল। অস্ফুট ভাবে বলল, দেখা হল না? কোথায় গেছেন?

বাদল বলল, কাটিহার না কালনা কী যেন একটা জায়গা।

কোনও খবরও দিয়ে যায়নি?

না।

ব্যাপারটা কী বল তো? কী হয়েছে?

বাদল বড়দিকে রীতিমতন একটা ধমক দিয়ে বলল, তুমি এ নিয়ে এত মাথা ঘামাচ্ছ। কেন? বলে দেব প্রভাসদাকে সব কথা।

কী বলবি? এই বাঁদর ছেলে, কী বলবি রে!

সে যা বলার আমি বলব।

বড্ড পাকা হয়েছিস। শোন, তুই একটা কাজ করতে পারবি? আমি আরও সাত-আট দিন থাকব এখানে। দীপ্তির বাড়ি কোথায় খোঁজ নিয়ে তুই সেখান থেকে একবার ঘুরে আয় না। আমি তোকে ভাড়ার টাকা দেব।

বাদল হাসতে হাসতে বলল, তুমি ভাড়া দিলে আমার বেড়িয়ে আসতে কোনও আপত্তি নেই। কিন্তু তোমার এত আগ্রহ কেন বলো তো?

আমার খুব দেখতে ইচ্ছে করে দীপ্তিদিকে। তা ছাড়া সূর্যদা মনখারাপ করে থাকবে সব সময় এটা আমার ভালো লাগে না।

ঠিক আছে। সূর্যদাকে জিজ্ঞেস করতে হবে তো?

ওকে জিজ্ঞেস করার দরকার কী?

ওরে বাবা, সূর্যদাকে জিজ্ঞেস না করলে কী রকম মেজাজ করবে কে জানে! তুমি ওর কাছ থেকে পারমিশন করিয়ে নাও, আমার যেতে কোনও আপত্তি নেই।

বাদল বেরিয়ে যাবার পর শ্রীলেখা গেল সূর্যর কাছে। চিররঞ্জন তখন নেমন্তন্নর এসটিমেট করছিলেন প্রভাস, মিহির আর সূর্যর সঙ্গে। এই আলোচনা সহজে শেষ হয় না। শ্রীলেখা দরজার কাছে দাঁড়িয়ে রইল, সূর্যর সঙ্গে একবার চোখাচোখি হতেই হাতছানি দিয়ে ডাকল তাকে।

সূর্য উঠে এসে বলল, কী?

বারান্দার প্রান্তে সরে এসে শ্রীলেখা বলল, সূর্যদা, তোমার খুব মনখারাপ, না?

সূর্য একটু অবাক হয়ে বলল, কেন?

দীপ্তিদি তোমাকে খবর না দিয়ে চলে গেছেন–

তাতে কী হয়েছে। নিশ্চয়ই কিছু জরুরি কাজ ছিল। কিংবা বাড়ি থেকে বোধহয় কোনও চিঠি এসেছে–

আগে কখনও গিয়েছেন এই রকম?

তা না হলেই বা। কী হয়েছে তাতে?

যত জরুরি কাজই থাক–এ রকম কোনও খবর না দিয়ে কেউ যায় না।

সূর্য ভুরু কুঁচকে তাকাল শ্রীলেখার দিকে। শ্রীলেখার চোখে-মুখে একটু উত্তেজনার চিহ্ন। তার ব্যবহারের মানে বোঝা যাচ্ছে না।

সূর্য বলল, বাড়িতে এত কাজকর্ম–এখন আমার এসব কথা নিয়ে মাথা ঘামাবার সময়ই নেই।

শ্রীলেখা তবু কিছু বলতে যাচ্ছিল, বলা হল না। কারণ এই সময় সান্ত্বনা ছাদ থেকে নেমে এল কাঁপতে কাঁপতে। সে ছাদের ঘরে বড়বাবুকে দেখেছে!

সান্ত্বনা এই নিয়ে তিন বার ভূত দেখল। ছেলেবেলায় একবার তার যে মাথার গোলমালের মতন দেখা গিয়েছিল, সেটা সেরে গেলেও মাঝে মাঝে হঠাৎ দু’-একটা উদ্ভট ব্যাপার বেরিয়ে পড়ে। এর আগের দিন সে ভূত দেখার কথাটা শুধু তার মাকে বলেছিল। হিমানী সঙ্গে সঙ্গে সেটা চাপা দিয়ে দিয়েছেন।

এবার সান্ত্বনা সবার সামনে চেঁচিয়ে বলতে লাগল, তোমরা দেখবে এসো–ছাদের। ঘরে বড়বাবু ইজিচেয়ারে বসে আছেন, আমাকে দেখে হাসলেন–তোমরা তো আমার। কথা বিশ্বাস করো না–

সবাই দুদ্দাড় করে উঠে এল ছাদে।

সান্ত্বনার উৎসাহই সবচেয়ে বেশি, চিররঞ্জন শক্ত করে তার হাত ধরে রাখলেন। সান্ত্বনা বড়বাবুর ঘরে শূন্য ইজিচেয়ারের দিকে আঙুল দেখিয়ে বলল, ওই দেখো, ওই যে–।

সবাই সেদিকে তাকিয়ে বলল, কই?

সান্ত্বনা চেঁচিয়ে বলল, তোমরা দেখতে পাচ্ছ না? উনি হাসছেন।

সান্ত্বনার মুখে বিন্দু বিন্দু ঘাম, চোখদুটি বিস্ফারিত–কৌতুক করার ইচ্ছে কিংবা মিথ্যে বলার কোনও লক্ষণই সেখানে নেই। সে সত্যি দেখতে পাচ্ছে।

হিমানী তাড়াতাড়ি ওপরে উঠে এসে সান্ত্বনাকে জড়িয়ে ধরে বললেন, তুই নীচে চল। শিগগির নীচে চল।

সান্ত্বনা কাঁদতে কাঁদতে বলল, বড়বাবু বসে আছেন, তোমরা কেউ দেখতে পাচ্ছ না? তোমরা কী? এর মধ্যেই বড়বাবুকে ভুলে গেলে।

হিমানী জোর করে সান্ত্বনাকে নীচে নিয়ে গেলেন। সে এখন সন্তানসম্ভবা, এই সময় ভয়টয় পেলে কত বড় বিপদ হয়ে যাবে। তা ছাড়া, জামাই যদি কিছু মনে করে।

পরের কয়েক দিন হিমানী সর্বক্ষণ সান্ত্বনাকে আগলে রাখলেন। অন্য কোনও কাজে মন দিতে পারলেন না। সুতরাং বড়বাবুর শ্রাদ্ধের নেমন্তন্ন কোনওক্রমে সারা হল।

সবকিছু মিটে যাবার পর চিররঞ্জন সূর্যকে নিভৃতে বললেন, এবার বিষয়সম্পত্তির ব্যাপারটা একটু দেখাশোনা করা দরকার। তোমাকেই তো সব বুঝে নিতে হবে।

সূর্য বলল, আপাতত আপনিই সব দেখুন। আমি এখন কিছু দিন কলকাতায় থাকব না।

দু দিন পরেই সূর্য কলকাতা ছেড়ে চলে গেল। কোথায় গেল, বলে গেল না কারোকে।

সকল অধ্যায়

১. ০১. মাঝে মাঝে মনে হয়
২. ০২. অমরনাথ যখন বাদলকে নিয়ে
৩. ০৩. ভালো করে ভেবে দেখতে গেলে
৪. ০৪. ফুলবাড়ি নামের জায়গাটি
৫. ০৫. বয়স মানুষ খুব দ্রুত হারিয়ে ফেলে
৬. ০৬. রেণুদের বাড়ি গ্রে স্ট্রিটে
৭. ০৭. চিররঞ্জন হেরে যাওয়া মানুষ
৮. ০৮. সূর্যকুমার বছরে একবার কলকাতায়
৯. ০৯. সূর্য পড়াশুনোতে ভালোই ছিল
১০. ১০. চিত্তরঞ্জন দাশের মৃত্যুর পর
১১. ১১. দলের নেতার নাম হরকুমার
১২. ১২. গরমের ছুটিতে বিষ্ণু
১৩. ১৩. সকালবেলা খবরের কাগজ
১৪. ১৪. রসময় চক্রবর্তীর বাড়িতে
১৫. ১৫. ওদিকে সূর্যদা
১৬. ১৬. মন্দাকিনী খবর পাঠিয়েছেন
১৭. ১৭. এক একটা দিন এমন চমৎকার
১৮. ১৮. সূর্য ঘন্টাখানেক ধরে রাস্তায়
১৯. ১৯. শ্রীলেখার সঙ্গে যে সূর্যর মেলামেশা
২০. ২০. হাওড়া স্টেশনে সূর্যর সঙ্গে
২১. ২১. মাঠের মধ্যে একটা মোটরগাড়ি
২২. ২২. ন্যায়-অন্যায়ের যে সূক্ষ্ম সীমারেখা
২৩. ২৩. ফিটন থেকে একজন
২৪. ২৪. সূর্য প্রকাশ্যে জানিয়ে দিল
২৫. ২৫. একজন জটাজুটধারী সন্ন্যাসী
২৬. ২৬. যদু পণ্ডিতের পাঠশালা
২৭. ২৭. বড়দির বিয়ের দিন
২৮. ২৮. দ্বিতীয় মহাযুদ্ধের প্রথম দু-তিনটি বছর
২৯. ২৯. জাপানিরা আসছে
৩০. ৩০. ট্রেনে চেপে খুলনা
৩১. ৩১. নৌকো থেকে যেখানে নামা হল
৩২. ৩২. ব্রজগোপাল সূর্যকে নিয়ে নামলেন
৩৩. ৩৩. সূর্যকে শুতে দেওয়া হয়েছিল
৩৪. ৩৪. তমোনাশ ডাক্তার একে একে
৩৫. ৩৫. এই এলাকায় তমোনাশ
৩৬. ৩৬. নীচের তলায় খুটখাট
৩৭. ৩৭. বিয়ের পর শ্রীলেখা
৩৮. ৩৮. মুর্শিদের চরে কয়েক দিন
৩৯. ৩৯. দূর থেকে আসছে একটা মিছিল
৪০. ৪০. সূর্য চলে যাবার পর
৪১. ৪১. সরকারি হিসেব মতনই
৪২. ৪২. যারা লম্বা তালগাছের ওপরে
৪৩. ৪৩. যদিও শ্রীলেখা সব সময়ই
৪৪. ৪৪. প্রভাসকুমারদের পরিবারটি
৪৫. ৪৫. সেবারের দূর্গাপূজোর
৪৬. ৪৬. যে-কোনও কারণেই হোক
৪৭. ৪৭. শ্রীলেখার সঙ্গে সান্ত্বনার
৪৮. ৪৮. মেদিনীপুর সেন্ট্রাল জেলের গেট
৪৯. ৪৯. চিররঞ্জন শিয়ালদা স্টেশনে এসে
৫০. ৫০. কাছাকাছি মানুষের প্রভাব
৫১. ৫১. বেয়াল্লিশ সালের গোড়ায়
৫২. ৫২. আমরা অনেক মৃত্যু দেখেছি
৫৩. ৫৩. সকালবেলা ঘণ্টাখানেকের জন্য
৫৪. ৫৪. স্কুল ছাড়ার আগে
৫৫. ৫৫. যদিও সুর্যর যাবজ্জীবন কারাদণ্ড
৫৬. ৫৬. দু-এক দিনের মধ্যেই সূর্য
৫৭. ৫৭. সেই সময় একটা কথা
৫৮. ৫৮. আমাদের বাড়ির বাজার করার ভার
৫৯. ৫৯. জুন মাসের তিন তারিখে
৬০. ৬০. ও-বাড়িতে আমার টিউশানি
৬১. ৬১. কলেজের সোস্যাল ফাংশান
৬২. ৬২. পর পর অনেকগুলো ট্রাম
৬৩. ৬৩. বাদল বাইরের ঘরে
৬৪. ৬৪. দুদিনের মধ্যে সান্ত্বনা
৬৫. ৬৫. সূর্য আর বাদল
৬৬. ৬৬. হিরোসিমাতে যে-দিন অ্যাটম বোমা
৬৭. ৬৭. কাটিহারে গিয়ে দীপ্তিদির বাড়ি
৬৮. ৬৮. সূর্যর চালচলন ক্রমশ
৬৯. ৬৯. রেণুর একটা নিজস্ব জগৎ
৭০. ৭০. হিমানীর বাবা-মা এবং দাদারা
৭১. ৭১. সূর্য অনেকটা উদ্দেশ্যহীন
৭২. ৭২. এলাহাবাদের সেই বাঙালি ছেলেগুলি
৭৩. ৭৩. যুবকটি সূর্যর চেয়ে
৭৪. ৭৪. অনেক দিন বাদে সূর্যকে
৭৫. ৭৫. রেণুর কাছ থেকে অনুমতি
৭৬. ৭৬. কলকাতায় ফিরেই শুনলাম
৭৭. ৭৭. কিছুক্ষণ ছোটার পর
৭৮. ৭৮. বুলবুল চেয়েছিল সূর্যকে নিয়ে
৭৯. ৭৯. ভারতের যে-কোনও শহরেই
৮০. ৮০. বাবাকে উত্তেজিত এবং খুশি দেখা গেল
৮১. ৮১. জাহাজ ছাড়বে কোচিন থেকে
৮২. ৮২. মহীশূরে সুব্রতদাদের বাড়িতে
৮৩. ৮৩. সূর্য কলকাতায় এসে পৌঁছোল
৮৪. ৮৪. রেণু এল পরদিন সকালবেলা
৮৫. ৮৫. বরানগর-আলমবাজারের দিকে
৮৬. ৮৬. গা ছুঁয়ে প্রতিজ্ঞা
৮৭. ৮৭. কৃষ্ণনগর শহরের রাস্তা
৮৮. ৮৮. পাহাড়ে দ্রুত উঠতে নেই

নোট নিতে এবং টেক্সট হাইলাইট করতে লগইন করুন

লগইন