৫০. কাছাকাছি মানুষের প্রভাব

সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়

কাছাকাছি মানুষের প্রভাব আমার ওপর খুব বেশি পড়ে। যাকে একটু ভালো লাগে, অমনি তাকে অনুকরণ করা শুরু করে দিই। কয়েক দিনের মধ্যেই আমি প্রভাস জামাইবাবুর খুব ভক্ত হয়ে উঠলাম। উনি যেমন একটু সুর করে কথা বলেন, আমার কথার মধ্যেও সেই রকম টান এসে গেল। উনি বলেন, শোনো ও-ও-ও কিংবা বলো ও-ও-ও, বেশ মিষ্টি শোনায়।

গ্রাম থেকে আমি কয়েকটি খারাপ অভ্যেস নিয়ে এসেছিলাম। যেমন রাস্তায় গুলি খেলা কিংবা অন্য লোকের বাড়িতে জিজ্ঞেস না করে ঢুকে পড়া। গ্রামে কড়ি খেলার খুব চল ছিল, কলকাতায় দেখলাম আমাদের বাড়ির কাছেই খুব ছিপি খেলা হয়। নিয়ম একই। সোডার বোতলের ছিপি এক-এক জনের কাছে কুড়ি-পঁচিশটা করে থাকে– সেগুলো দূরে দাগের মধ্যে রেখে বাটখারা দিয়ে নির্দিষ্টটাকে মারতে হয়। দারুণ উত্তেজনার খেলা, ছিপি ফুরিয়ে গেলে কিনতে হয় সঙ্গীদের কাছ থেকে, চার পয়সায় দশটা। অর্থাৎ এটা জুয়া খেলার কিশোর সংস্করণ। আমার চরিত্রের মধ্যে একটা জুয়াড়ি গুপ্ত ভাবে ছিল বলেই বোধহয় আমি ওই খেলায় খুব মেতে উঠেছিলাম। জেতার আনন্দ এবং হারার দুঃখ, দুটোই ছিল তীব্র। মায়ের কাছে পয়সা চাইবারও দরকার হত না, আমার পইতের সময় পাওয়া টাকা তখনও কিছু অবশিষ্ট ছিল। সারা সকাল দুপুর বিকেল আমি ছিপি খেলে কাটাতাম বাড়ি ফেরার সময় আমার দু’পকেট ভরতি ছিপি ঝমঝম করত। এ ছাড়া একটু দূরে বস্তির মুখে ছিল গুলি খেলার আড্ডা।

বাড়ির কারওর শাসন তখন আমি গ্রাহ্য করি না। একমাত্র ভয় পাই জ্যাঠামশাইকে কিন্তু তিনি আমাদের কারওর ব্যাপারে মন দেবার সময়ই পান না। শেষ পর্যন্ত আমার ওই সব খেলার নেশা ঘুচিয়ে দিলেন প্রভাস জামাইবাবু। তিনি একদিন আমায় রাস্তায় ওইসব খেলাধুলোর মধ্যে ব্যস্ত দেখে এমন ভাবে মুখ করে থমকে দাঁড়ালেন, যেন নরকের দৃশ্য দেখছেন। কাছে ডেকে বললেন, ছি-ছি, তুমি এইসব করো? তা হলে আর অধঃপাতে যাবার বাকি রইল কী?

জামাইবাবুরা শ্বশুরবাড়িতে এসে হাসি-ঠাট্টা, আমোদ-আহ্লাদ করবেন, এইটাই নিয়ম। কিন্তু প্রভাসকুমার হাসি-ঠাট্টার ধার ধারেন না। বড়দির ছেলেমেয়ে না হওয়া পর্যন্ত তিনি কলকাতাতেই থাকবেন এবং এর মধ্যেই তিনি এখানে পড়াশুনো শুরু করে দিয়েছেন। আমার দিদির অসুখ এখন অনেকটা ভালো হয়ে গেছে, তাই প্রভাসকুমারের হাতে এখন অন্য কোনও কাজ নেই, তিনি আমাকে নিয়ে পড়লেন। বোধহয় কিশোর মনস্তত্ব সমীক্ষা করার ঝোঁক চাপল তাঁর, তিনি প্রায় সারা দিন আমাকে তার ঘরে আটকে রেখে নানা রকম কঠিন কঠিন প্রশ্ন জিজ্ঞেস করতে লাগলেন। দিনের পর দিন এই রকম চলল।

প্রথম প্রথম আমি অত্যন্ত চাঞ্চল্য প্রকাশ করলেও ক্রমশ তার অনুরক্ত হয়ে পড়লাম। আমার মনে হল, এ রকম বিদ্বান কিংবা এ রকম সুন্দর চেহারার মানুষ আমি আগে কখনও দেখিনি। আসলে কিন্তু প্রভাসকুমার সুপুরুষ ছিলেন না। তার গায়ের রং খুব। ফরসা ছিল, এ ছাড়া তার শরীরে কোনও সামঞ্জস্য ছিল না।

প্রভাসকুমারকে অনুকরণ করতে করতেই আমি পদ্য রচনা শুরু করলাম। প্রভাসকুমার যে একজন কবি-এর মধ্যে কোনও গোপনীয়তা ছিল না, বাড়িসুদ্ধ সবাই জানত। প্রভাসবুমার যখন ঘরের দরজা বন্ধ করে থাকতেন, তখন ছোটরা কেউ বাইরে চঁচামেচি করলেই জ্যাঠাইমা তাকে ধমক দিয়ে বলতেন, এই, তোরা গোলমাল করছিস কেন, তোদের জামাইবাবু এখন কবিতা লিখছেন না? একথা শুনে কেউ কখনও হাসেনি। প্রভাসকুমারের দ্বিতীয় কবিতার বই ছাপিয়ে দিয়েছেন তার শ্বশুর। জ্যাঠামশাই তার জামাইয়ের লেখা কবিতা-পুস্তক উপহার দিতেন অতিথিদের। অনেকেই সেই পদ্যগুলি পাঠ করে ধন্য ধন্য করেছেন। শুধু দু’এক জন এ রকম মুখের ভাব করেছেন, কাগজ ব্যবসায়ীর জামাই কবিতা টবিতা লিখে কেন কাগজ নষ্ট করছে এই দুর্মূল্যের বাজারে?

আমার মনে হল, জামাইবাবুর মতন অসাধারণ মানুষ হতে গেলে কবিতা না লিখে উপায় নেই। শুরু করে দিলাম সঙ্গে সঙ্গে।

কবিতা লেখার মধ্যে একটা মজার ব্যাপার আছে। যারা কবিতা লেখে না–তারা অনেকেই কখনও কবিতার কথা চিন্তা করে না কিংবা এটাকে একটা আজেবাজে ব্যাপার মনে করে। আবার অনেকের ধারণা, কবিতা লেখা বুঝি খুব একটা শক্ত ব্যাপার। কিন্তু যারা কোনওক্রমে একবার কবিতা লিখতে শুরু করে, তারা প্রথম চোটেই পৃথিবীর যে-কোনও বিষয় নিয়ে হুড়হুড় করে অজস্র কবিতা লিখে ফেলে। শিশুর প্রথম হাঁটতে শেখার মতন কিংবা ছাগলের নতুন শিং গজালে যেমন সে সর্বত্র ছুঁ মেরে বেড়ায়– তেমনি নবীন কবিও কোনও কিছুই বাদ দেয় না। কয়েক দিনের মধ্যেই আমি একটি খাতার পাতা ভরিয়ে ফেললুম। একটা কবিতা শেষ করে তক্ষুনি মনে হয় আর একটা লিখতে হবে! রাস্তার ছিপি-খেলোয়াড় থেকে আমি একেবারে কবি হয়ে উঠলাম এবং চুলে তেল-মাখা বন্ধ করে দিলাম।

কবিরা যে কত ঈর্ষাপরায়ণ, সেটাও টের পেলাম সেই সময়। জামাইবাবু এত কাব্যোৎসাহী হওয়া সত্ত্বেও তিনি আমার কবিতা রচনার ব্যাপারটা খুব সুনজরে দেখলেন। না। এক বাড়িতে দু’জন কবি থাকা ওঁর পছন্দ নয়। উনি আমাকে কবিতা লেখার জন্য কখনও তেমন উৎসাহ দেননি। আমি আমার সদ্য রচিত পদ্য ওঁকে পড়ে শোনালে উনি সামান্য ঠোঁট ফাঁক করে মৃদু হাস্যে শুধু বলতেন, বাঃ, আবার লেখো। যেন আমি ওঁকে হোম টাস্ক দেখাচ্ছি। তখন আমি অবশ্য ওই সামান্য মন্তব্যেই পুলকিত হতাম। আবার মা বা জ্যাঠাইমা যখন জামাইবাবুর কবিতার প্রশংসা করতেন, তখন আমি মনে মনে ভাবতুম, ওঁরা শুধু জামাইবাবুর কথা বলছেন কেন, আমিও ওঁর চেয়ে খারাপ লিখি না।

কবিতা লেখার কথা আমি আগে কখনও চিন্তা করিনি। কবিতা জিনিসটা মনে হত বইতেই শুধু ছাপা থাকে–কোনও জ্যান্ত মানুষ যে এগুলো লেখে–এ কথা মাথাতেই আসেনি এর আগে। চোখের সামনে প্রভাস জামাইবাবুকে টাটকা টাটকা কবিতা লিখতে দেখে ভেবেছিলাম, এটা তা হলে এমন কিছু কঠিন কাজ নয়, আমিও পারি। জামাইবাবুই বলেছিলেন যে উনি নিজে এবং রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর নাকি আমার চেয়েও কম বয়সে কবিতা লিখতে শুরু করেন। তা হলে তো আর কোনও কথাই নেই।

দিদিদের কিংবা মা-জ্যাঠাইমাকে আমি যখন কবিতা শোনাই, এমনকী, স্বভাব কবির মতন মুখে মুখে কবিতা বানাতেও আমার অসুবিধে হয় না। তা ছাড়া জামাইবাবু বলেছিলেন যে মডার্ন কবিতায় ছন্দ এবং মিল লাগে না। বাড়ির লোকেরা আমাকে দেখেই কানে হাত চাপা দিতে শুরু করল। কবিতা শুনিয়ে শুনিয়েই আমি আমার দিদির ভূত ছাড়িয়ে দিলাম বলতে গেলে, বহু দিন পর দিদির মুখে হাসি দেখা গেল।

প্রথম কবিতাটি লেখার সময়ই আমাকে বেশ কিছুক্ষণ চিন্তা করতে হয়েছিল, তারপর– তো এসে গেল গড়গড় করে। প্রথম কবিতাটি কষ্টকল্পিতই বলা যায়। কী নিয়ে যে লিখব, সেটাই ছিল সমস্যা। বহু চিন্তা ভাবনার পর আমার প্রথম কবিতাটি রচিত হয়েছিল কারাগার বিষয়ে। তাতে মোটামুটি এই ভাব প্রকাশ পেয়েছিল যে, কারাকক্ষের অন্ধকারে এক দিব্যজ্যোতি পুরুষ বসে আছেন, তার গা থেকে আলো বেরোচ্ছে, তিনি উঠে দাঁড়াতেই ঝনঝন করে শিকল ভেঙে পড়ল। একমাত্র বড়দিই আমার এই প্রথম কবিতাটি খুব পছন্দ করেছিল–আমি পরে অন্য কবিতা শোনাতে গেলে বড়দি বলেছে, তার থেকে বরং তোর সেই জেলখানায় কবিতাটা আর একবার পড়ে শোনা।

কবিতা রচনা ছিল তখন আমার কাছে ছেলেখেলা ও আমাদের ব্যাপার। যে-কোনও একটা কিছু নিয়ে আমার মেতে থাকা স্বভাব। ছিপি খেলা কিংবা ঘুড়ি ওড়ানোর বদলে। আমি কবিতা নিয়ে মেতেছিলুম। কবিতা লেখার মুহূর্তগুলিতে যে তীব্র বিষাদ আছে, তা টের পেতে আমার অনেক দিন সময় লেগেছিল।

রেণুদের বাড়িতে যখন আমি এবার এসে প্রথম বার গেলাম, তখন আমি পরিবর্তিত মানুষ। এখন তো আমি আর আগের সেই সাধারণ ছেলেটি নই–এখন আমি রীতিমতো একজন কবি। জামায় বোতাম লাগাই না, সিঁথি কেটে চুল আঁচড়াই না, কথা বলতে বলতে হঠাৎ অন্যমনস্ক হয়ে যাই এবং খাবারের প্লেট সামনে দিলে সঙ্গে সঙ্গে হাত বাড়াই না সে-দিকে।

রেণুদের ওখানে গিয়ে দেখলাম, ওদের বাড়িটা বদলে গেছে আরও অনেক বেশি। আমি মাত্র দেড় বছর কলকাতা ছেড়ে ছিলাম, এর মধ্যে অনেক কিছুই বদলে গেছে। রেণুর বাবা মারা গেছেন, এটা আমি ঘুণাক্ষরেও জানতাম না। শেষের কয়েক মাস ওরা কোনও চিঠি লেখেনি আমাকে। বিধবা হওয়ার জন্য রেণুর মাকে হঠাৎ বুড়ির মতন দেখায়। সাদা থান-পরা ওঁর চেহারা দেখে আমার চোখে জল এসে গিয়েছিল। রেণুও যেন হঠাৎ বড় হয়ে গেছে, ওর এখন দশ বছর মোটে বয়স, এর মধ্যেই চশমা নিয়েছে। চশমা-পরা রেণুকে আমি প্রথমটায় চিনতেই পারিনি।

বিষ্ণু কিছু দিন টাইফয়েডে খুব ভোগার ফলে এখনও রোগা আর দুর্বল। বিষ্ণুর মা তাকে ঘর থেকে বেরোতেই দেন না। আমি ওর বিছানায় বসতে গেছি, ওর মা বললেন, একটু দূরে বসো, তোমার তো রাস্তার জামাকাপড়!

দীপ্তির বিয়ে ঠিক হয়ে ছিল অনেক আগেই, কী কারণে যেন সেই বিয়ে ভেঙে গেছে। দীপ্তিদের সঙ্গে বিষ্ণুদের কথা বন্ধ। এ বাড়ির ছেলেমেয়েরা এখন আর সকলে সকলের ঘরে যায় না। বড়দের মধ্যে ঝগড়া ও মনকষাকষি অনেক পরিব্যপ্ত। বাড়িটির অবস্থাও আরও জরাজীর্ণ, কেন না সারাবার দায়িত্ব কোনও শরিকই নেবে না–এবং গেটের সামনেই ব্যাল ওয়াল তোলা হয়েছে বলে আরও কদাকার দেখায়। প্রথম যখন এ বাড়িতে আসি, তখন অদ্ভুত আনন্দময় পরিবেশ মনে হয়েছিল। কিংবা তখনও বোধহয় এই রকমই ছিল–আমার বয়স আরও কম থাকার জন্য চোখ পড়েনি।

এইসব বনেদি একান্নবর্তী পরিবারগুলির শেষ ঘণ্টা তখন বেজে উঠেছে, প্রাসাদগুলির গায়েও সেই নিয়তির লেখা।

বিষ্ণুর সঙ্গে আমার গল্প আর ফুরোয় না। বিষ্ণু সব কথাই ভারী সুন্দর করে বলতে পারে। ও আমাকে রেণুর বাবার মৃত্যুর কথা শোনাল। রেণুর বাবাকে আমি দেখেছি অনেক বার কিন্তু কোনও দিন কথা বলিনি। খুব গম্ভীর ধরনের মানুষ ছিলেন এবং দিনের বেশির ভাগ সময়েই বাড়ির বাইরে থাকতেন। তিনি মারা যান হঠাৎ হার্ট ফেল করে। মাঝ রাত্তিরে ঘুম থেকে উঠে বুকে ব্যথার কথা বলেন, ডাক্তার ডেকে আনার আগেই ওঁর শেষ নিঃশ্বাস বেরিয়ে যায়। মৃত্যুর ঠিক আগে ওঁর কথা বন্ধ হয়ে গিয়েছিল, শুধু জল পড়ছিল চোখ দিয়ে। সেই চোখের জল বিষ্ণুকে খুব আশ্চর্য করেছে। ও বার বার বলছিল, জ্যাঠামশাইকে কাঁদতে দেখব, কখনও ভাবিনি। জ্যাঠামশাই কি ভয় পাচ্ছিলেন। মরতে কি মানুষ ভয় পায়?

বিষ্ণু আরও বলল, ওর যখন টাইফয়েড হয়েছিল, তখন ওর খুব ভালো লাগত। অসুখ হওয়া খুব আনন্দের ব্যাপার। বিষ্ণু বলল, জানিস বাদল, যখন ভীষণ জ্বর হতজ্বরের ঘোরে খানিকটা অজ্ঞান অবস্থা, তখন কত রকম স্বপ্ন দেখতাম। দেখতাম, আমি যেন কোথায় চলে গেছি, অচেনা সব সুন্দর সুন্দর জায়গা, একটা সাদা রঙের পাহাড়, তার। ওপরে একটা মন্দির। সেখানে নীল শাড়ি পরে একজন দাঁড়িয়ে আছেন। প্রথমে মনে হল আমার মা, তারপর আবার দেখি মা তো নয়, অন্য কেউ। বোধহয় কোনও দেবতা–অথচ ঠিক মানুষের মতন–মুখখানা একটু দুঃখী দুঃখী, কিন্তু যেই হাসলেন, এত সুন্দর হাসি আমি কখনও দেখিনি। ইস, আবার যে কবে তাঁকে দেখতে পাব! আর একবার দেখলাম অসংখ্য জিরাফের পাল, একটা মাঠ ধু ধু করছে, তার মধ্যে জানিস তো, জিরাফরা গলা দিয়ে শব্দ করতে পারে না, তাই সেখানে কোনও শব্দ নেই-পাশ দিয়ে একটা নদী।…এখন আর সেই সব স্বপ্ন একটাও দেখি না।

আমি গোপন খবর দেবার মতন বিষ্ণুকে বললাম, এই জানিস, আমি এখন কবিতা লিখি।

বিষ্ণু জিজ্ঞেস করল, কেন?

আমি বললাম, লিখি, মানে এমনিই। আমি লিখতে পারি।

বিষ্ণু রেগে গিয়ে বলল, ট্রেইটার?

বাঃ, আমি কী করেছি?

কথা ছিল না আমরা দুজনে এক্সপ্লোরার হব? নতুন নতুন জায়গা আবিষ্কার করব?

কবিতা লিখলে বুঝি এক্সপ্লোরার হওয়া যায় না?

না। কোনও এক্সপ্লোরার কবিতা লেখে না।

তুই জানিস?

নিশ্চয়ই জানি। স্কট, এমান্ডসেন, ডঃ লিভিংস্টোন এরা কখনও কবিতা লিখেছে? বিষ্ণুর তুলনায় এসব বই আমি কম পড়েছি, তাই কোনও উত্তর দিতে পারলাম না। ঘুরিয়ে প্রশ্ন করলাম, এক্সপ্লোরাররা কবিতা না লিখতে পারে, কিন্তু কবিরা কি এক্সপ্লোরার হতে পারে না?

বিষ্ণু বলল, না, কবিটবিদের দিয়ে এসব শক্ত কাজ হয় না।

জামাইবাবুর অনুকরণ করতে গিয়ে বিষ্ণুর কথা আমার মনে ছিল না। কিন্তু বিষ্ণু আমার প্রাণের বন্ধু, তার মনে আমি আঘাত দিতে পারি না। আমি ভয়ে ভয়ে বললাম, তা হলে কবিতা লেখা ছেড়ে দেব?

বিষ্ণু গম্ভীর ভাবে অনুমতি দেবার সুরে জানাল, ঠিক আছে, যতদিন না আমরা বড় হচ্ছি, ততদিন লিখতে পারিস। বাড়ি থেকে একবার বেরিয়ে পড়লে আর ওসব চলবে না।

রেণুর বাবা মারা গেছে বলে বেণুকে আমার এখন অন্য রকম লাগে। আমার যা যা আছে, অন্য কারওর তা নেই–এ যেন কিছুতেই বিশ্বাস হয় না। সূর্যদার মা নেই, একথা আমরা ছেলেবেলা থেকেই জানতাম, সেই জন্যই সূর্যদা অন্য রকম। কিন্তু রেণু তো আমাদেরই মতন অথচ তার বাবা থাকবে না কেন? রেণুর ভাই অংশুর সঙ্গে আমার বরাবরই ঝগড়া হয়, এখন সেই অংশুকে দেখেও মায়া হতে লাগল। আমি অংশুর সঙ্গে ভালো ব্যবহার করতে চাইছিলাম। অংশু কিন্তু প্রথমেই আমাকে বলল, কী রে বাঙাল, কবে এলি?

আমাকে কেউ বাঙাল বললে এখন আমার রাগ হয়। পূর্ব বাংলায় আমাকে সবাই ঘটি কিংবা ক্যালসেশিয়ান বলত, কারণ আমার কথার উচ্চারণ অন্য রকম হয়ে গেছে। আর এখানে এখন আমাকে বাঙাল বলার কোনও মানে হয়? অংশু আমার জামার ফাঁক দিয়ে পইতেটা উঁকি মারছিল দেখে বলল, এটা কী? তুই বামুন হয়েছিস নাকি? আমাদের বাড়িতে রান্না করবি? আমাদের ঠাকুর পালিয়ে গেছে!

না। চেষ্টা করলেও অংশুর সঙ্গে আমার ভাব হবে না। অংশুর মা ছেলেকে বকলেন। রেণু আমাকে বলল, তুই আমাদের বাড়িতে আর আসিস না কেন রে?

আমি বললাম, বাঃ, আমরা তো এখানে ছিলাম না।

কত দিন আগে ফিরেছিস?

চোদ্দো-পনেরো দিন।

তা হলে এর মধ্যে আসিসনি কেন?

এখন তো অনেক দূরে থাকি।

ওর মা বললেন, এই রেণু, তুই বাদলকে তুই তুই বলিস কেন? এখন বড় হয়েছিস না? এখন থেকে ওকে বাদলদাদা বলবি।

রেণু বলল, ইস, মোটে তত তিন বছরের বড়। দাদা বলব না ছাই বলব। এই বাদল, তোদের নতুন বাড়িতে আমাকে নিয়ে যাবি না?

নতুন বাড়ি নয়, জ্যাঠামশাইয়ের বাড়ি।

আমি সেখানে যাব।

মা বললেন, কার সঙ্গে যাবি?

আমি সঙ্গে সঙ্গে বললাম, আমি নিয়ে যেতে পারি। বাসে করে সোজা ওয়েলিংটন, কোথাও বদলাতে হয় না।

রেণু আমার সঙ্গে যাবার জন্য খুব বায়না ধরে বসল। কিন্তু দারোয়ান না থাকায় ওর মা কিছুতেই ওকে ছাড়বেন না। আমি নিয়ে গেলেও ফিরিয়ে আনবে কে! তা ছাড়া আমার সঙ্গে ছেড়ে দেবার প্রশ্নই ওঠে না।

আমার মনে হল, রেণু, অংশু কিংবা বিষ্ণুর চেয়ে আমি অনেক স্বাধীন! আজকাল আমি বাড়ি থেকে একলা একলা বেরোতে পারি, কেউ নিষেধ করে না। এখন আমি বাসের নম্বরও জেনে গেছি। রেণুকে আমার সঙ্গে নিয়ে গেলে বেশ হত–সারা দিন ওর সঙ্গে গল্প করতাম। ওর মা দৃঢ় ভাবে মানা করায় আমি চুপ করে গেলাম। আমি যদি ম্যাজিক জানতাম, এক্ষুনি অদৃশ্য হয়ে রেণুকে নিয়ে উড়ে চলে যেতাম। কোথায়? সারা জীবন ধরে আমি সেই উত্তর খুঁজেছি। কোথায় নিয়ে যাব?

রেণুকে বললাম, বিষ্ণু সেরে উঠুক, তারপর তোরা সবাই মিলে একদিন আমাদের বাড়িতে আসবি।

রেণু বলল, না, আজই যাব।

ওর মা এবার ওকে বেশ কড়া করে ধমক দিলেন।

রেণু বড় জেদি মেয়ে, শেষ পর্যন্ত কান্নাকাটি শুরু করে দিল। রেণুকে সেই অবস্থায় রেখেই চলে আসতে হল আমাকে।

সিঁড়ির কাছে দীপ্তির সঙ্গে দেখা। আমাকে হাতছানি দিয়ে ডেকে নিয়ে গেল সিঁড়ির পাশে একটা ছোট ঘরে। এই ঘরটা আগে খালি পড়ে থাকত–এখন এখানে অনেক জিনিসপত্তর, একটা খাটবিছানাও রয়েছে। শুনলাম, বিষ্ণুর জন্য নিযুক্ত মাস্টারমশাই ওখানে থাকেন, দিনেরবেলা বাইরে চাকরি করেন, সকালেসন্ধ্যাবেলা পড়ান।

দীপ্তি বলল, কী রকম বেড়িয়ে এলি বল? আমার সঙ্গে কথা বললি না কেন রে?

তখন তো তোকে দেখলাম, তুই এলি না কেন বিষ্ণুদের ঘরে?

ওই হিংসুটের ঘরে আমি যাই না।

বিষ্ণুকে হিংসুটে বলবি না।

ও নয়, ওর মা-টা!

দীপ্তির কথা বলার ধরন বরাবরই খারাপ। আমার মনে পড়ল, পাড়ার ছেলেরা আমার হাত দিয়ে দীপ্তিকে চিঠি পাঠাত। দীপ্তি কখনও কখনও আমাকে জড়িয়ে ধরে চুমো খেত–আমার খুব বিশ্রী লাগত তখন। এখন কিন্তু দীপ্তিকে দেখে আমার একটুও খারাপ লাগছে না। আমি একদৃষ্টিতে দেখতে লাগলাম দীপ্তিকে। আমি এখন কবি হয়েছি তো, তাই এ রকম ভাবে দেখতে হয়। মনে হল, দীপ্তিকে নিয়েও অনায়াসে কবিতা লেখা যায়। দীপ্তি যদি আজ আমায় আদর করে, তা হলে ওকে নিয়ে আজই কবিতা লিখব। দীপ্তির সঙ্গে ঘনিষ্ট হয়ে বসা কিংবা ওর শরীরের একটু ছোঁয়া পাবার জন্য আমার মনের মধ্যে আকুলিবিকুলি করছিল। এটা আমার নতুন অভিজ্ঞতা। আমি নিজেই অবাক হয়ে যাচ্ছিলাম। দীপ্তিকে আমার পছন্দ হয় না অথচ ওর সামনে বসে থাকতে আমার ভালো লাগছে, বার বার তাকাতে ইচ্ছে করছে ওর শরীরের দিকে। এর মানে কী?

হঠাৎ সুপ্রকাশদা এসে পড়ায় দীপ্তিকে নিয়ে সেদিন আমার কবিতা লেখা হয়নি।

সকল অধ্যায়

১. ০১. মাঝে মাঝে মনে হয়
২. ০২. অমরনাথ যখন বাদলকে নিয়ে
৩. ০৩. ভালো করে ভেবে দেখতে গেলে
৪. ০৪. ফুলবাড়ি নামের জায়গাটি
৫. ০৫. বয়স মানুষ খুব দ্রুত হারিয়ে ফেলে
৬. ০৬. রেণুদের বাড়ি গ্রে স্ট্রিটে
৭. ০৭. চিররঞ্জন হেরে যাওয়া মানুষ
৮. ০৮. সূর্যকুমার বছরে একবার কলকাতায়
৯. ০৯. সূর্য পড়াশুনোতে ভালোই ছিল
১০. ১০. চিত্তরঞ্জন দাশের মৃত্যুর পর
১১. ১১. দলের নেতার নাম হরকুমার
১২. ১২. গরমের ছুটিতে বিষ্ণু
১৩. ১৩. সকালবেলা খবরের কাগজ
১৪. ১৪. রসময় চক্রবর্তীর বাড়িতে
১৫. ১৫. ওদিকে সূর্যদা
১৬. ১৬. মন্দাকিনী খবর পাঠিয়েছেন
১৭. ১৭. এক একটা দিন এমন চমৎকার
১৮. ১৮. সূর্য ঘন্টাখানেক ধরে রাস্তায়
১৯. ১৯. শ্রীলেখার সঙ্গে যে সূর্যর মেলামেশা
২০. ২০. হাওড়া স্টেশনে সূর্যর সঙ্গে
২১. ২১. মাঠের মধ্যে একটা মোটরগাড়ি
২২. ২২. ন্যায়-অন্যায়ের যে সূক্ষ্ম সীমারেখা
২৩. ২৩. ফিটন থেকে একজন
২৪. ২৪. সূর্য প্রকাশ্যে জানিয়ে দিল
২৫. ২৫. একজন জটাজুটধারী সন্ন্যাসী
২৬. ২৬. যদু পণ্ডিতের পাঠশালা
২৭. ২৭. বড়দির বিয়ের দিন
২৮. ২৮. দ্বিতীয় মহাযুদ্ধের প্রথম দু-তিনটি বছর
২৯. ২৯. জাপানিরা আসছে
৩০. ৩০. ট্রেনে চেপে খুলনা
৩১. ৩১. নৌকো থেকে যেখানে নামা হল
৩২. ৩২. ব্রজগোপাল সূর্যকে নিয়ে নামলেন
৩৩. ৩৩. সূর্যকে শুতে দেওয়া হয়েছিল
৩৪. ৩৪. তমোনাশ ডাক্তার একে একে
৩৫. ৩৫. এই এলাকায় তমোনাশ
৩৬. ৩৬. নীচের তলায় খুটখাট
৩৭. ৩৭. বিয়ের পর শ্রীলেখা
৩৮. ৩৮. মুর্শিদের চরে কয়েক দিন
৩৯. ৩৯. দূর থেকে আসছে একটা মিছিল
৪০. ৪০. সূর্য চলে যাবার পর
৪১. ৪১. সরকারি হিসেব মতনই
৪২. ৪২. যারা লম্বা তালগাছের ওপরে
৪৩. ৪৩. যদিও শ্রীলেখা সব সময়ই
৪৪. ৪৪. প্রভাসকুমারদের পরিবারটি
৪৫. ৪৫. সেবারের দূর্গাপূজোর
৪৬. ৪৬. যে-কোনও কারণেই হোক
৪৭. ৪৭. শ্রীলেখার সঙ্গে সান্ত্বনার
৪৮. ৪৮. মেদিনীপুর সেন্ট্রাল জেলের গেট
৪৯. ৪৯. চিররঞ্জন শিয়ালদা স্টেশনে এসে
৫০. ৫০. কাছাকাছি মানুষের প্রভাব
৫১. ৫১. বেয়াল্লিশ সালের গোড়ায়
৫২. ৫২. আমরা অনেক মৃত্যু দেখেছি
৫৩. ৫৩. সকালবেলা ঘণ্টাখানেকের জন্য
৫৪. ৫৪. স্কুল ছাড়ার আগে
৫৫. ৫৫. যদিও সুর্যর যাবজ্জীবন কারাদণ্ড
৫৬. ৫৬. দু-এক দিনের মধ্যেই সূর্য
৫৭. ৫৭. সেই সময় একটা কথা
৫৮. ৫৮. আমাদের বাড়ির বাজার করার ভার
৫৯. ৫৯. জুন মাসের তিন তারিখে
৬০. ৬০. ও-বাড়িতে আমার টিউশানি
৬১. ৬১. কলেজের সোস্যাল ফাংশান
৬২. ৬২. পর পর অনেকগুলো ট্রাম
৬৩. ৬৩. বাদল বাইরের ঘরে
৬৪. ৬৪. দুদিনের মধ্যে সান্ত্বনা
৬৫. ৬৫. সূর্য আর বাদল
৬৬. ৬৬. হিরোসিমাতে যে-দিন অ্যাটম বোমা
৬৭. ৬৭. কাটিহারে গিয়ে দীপ্তিদির বাড়ি
৬৮. ৬৮. সূর্যর চালচলন ক্রমশ
৬৯. ৬৯. রেণুর একটা নিজস্ব জগৎ
৭০. ৭০. হিমানীর বাবা-মা এবং দাদারা
৭১. ৭১. সূর্য অনেকটা উদ্দেশ্যহীন
৭২. ৭২. এলাহাবাদের সেই বাঙালি ছেলেগুলি
৭৩. ৭৩. যুবকটি সূর্যর চেয়ে
৭৪. ৭৪. অনেক দিন বাদে সূর্যকে
৭৫. ৭৫. রেণুর কাছ থেকে অনুমতি
৭৬. ৭৬. কলকাতায় ফিরেই শুনলাম
৭৭. ৭৭. কিছুক্ষণ ছোটার পর
৭৮. ৭৮. বুলবুল চেয়েছিল সূর্যকে নিয়ে
৭৯. ৭৯. ভারতের যে-কোনও শহরেই
৮০. ৮০. বাবাকে উত্তেজিত এবং খুশি দেখা গেল
৮১. ৮১. জাহাজ ছাড়বে কোচিন থেকে
৮২. ৮২. মহীশূরে সুব্রতদাদের বাড়িতে
৮৩. ৮৩. সূর্য কলকাতায় এসে পৌঁছোল
৮৪. ৮৪. রেণু এল পরদিন সকালবেলা
৮৫. ৮৫. বরানগর-আলমবাজারের দিকে
৮৬. ৮৬. গা ছুঁয়ে প্রতিজ্ঞা
৮৭. ৮৭. কৃষ্ণনগর শহরের রাস্তা
৮৮. ৮৮. পাহাড়ে দ্রুত উঠতে নেই

নোট নিতে এবং টেক্সট হাইলাইট করতে লগইন করুন

লগইন