৪৯. চিররঞ্জন শিয়ালদা স্টেশনে এসে

সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়

চিররঞ্জন শিয়ালদা স্টেশনে এসে অত্যন্ত বিব্রত হয়ে পড়লেন। আসবার আগে তাঁর দাদা প্রিয়রঞ্জন এবং বড়বাবুকে চিঠিতে জানিয়ে ছিলেন তাঁর কলকাতায় আসার কথা। তিনি আশা করেছিলেন কলকাতায় কারোকে দেখতে পাবেন। কিন্তু চিররঞ্জন তার স্বভাবসিদ্ধ দুর্বলতায় দুজনের কারওর কাছেই উল্লেখ করেননি যে ঠিক কার বাড়িতে উঠবেন। এর আগে বড়বাবুর কাছে থাকলেও প্রিয়রঞ্জন নিজের বাড়িতে চলে আসবার জন্য ভাইকে অনেক বার বলেছিলেন। চিররঞ্জন মনস্থির করতে পারেন না। বড়বাবুর সঙ্গেই তার মনের মিল–আবার নিজের দাদার ইচ্ছে-অনিচ্ছেও অগ্রাহ্য করতে পারেন না।

শিয়ালদা স্টেশনে নিজের ছোট্ট পরিবারটি নিয়ে চিররঞ্জন দাঁড়িয়ে ছিলেন। তিনি এই পরিবারের অধিপতি, কিন্তু এর ভার বহন করার মতন যোগ্যতা তিনি সারা জীবনে অর্জন করতে পারলেন না। সঙ্গে অসুস্থ মেয়ে, মুখভার করা স্ত্রী এবং ছটফটে কিশোর পুত্র এদের জন্য এই পৃথিবীতে একটি যোগ্য স্থান সংগ্রহ করার দায়িত্ব চিররঞ্জনেরই। তিনি অনুভূতিহীন মানুষ নন, এই দায়িত্বের কথা বোঝেন বেশ ভালো ভাবেই–এবং নিজের। অসামর্থ্যের জন্য দুঃখ তারই বেশি।

শিয়ালদা স্টেশনে তিনি নির্দিষ্ট করে কারোকে আসতে লেখেননি, অথচ কেউ আসেনি বলে তিনি দুঃখিত! এই ধরনের মানুষেরা সারা জীবন দুঃখ পেয়ে যায়।

যদিও দাদার বাড়িই স্টেশন থেকে বেশি কাছে, তবু চিররঞ্জন একটা থার্ড ক্লাস ঘোড়ারগাড়ি ভাড়া নিয়ে চললেন বিবেকানন্দ রোডের দিকে। হিমানীর মুখখানা থমথমে। কলকাতায় আসার একটুও ইচ্ছে ছিল না তার। তিনি বার বার চেয়েছিলেন বাপেরবাড়ি চলে যেতে–চিররঞ্জনের যদি সেখানে থাকতে ইচ্ছে না হয়, তা হলে তিনি একা কলকাতায় আসতে পারতেন! চিররঞ্জন এ-প্রস্তাবে রাজি হননি, মেয়েকে তিনি আর গ্রামে ফেলে রাখতে চান না–মেয়ের চিকিৎসা কলকাতাতেই হওয়া দরকার।

ঘোড়ারগাড়ির জানলা দিয়ে বাদল উৎসুক ভাবে কলকাতা শহর দেখছে। প্রথম যেবার সে কলকাতায় এসেছিল, তখন সে খুবই ছোট-সে কথা তার স্পষ্ট মনে পড়ে না। এবারের কলকাতাকে সে দু চোখ দিয়ে যেন গিলছে। কত চেনা আর কত আপন মনে হয়, এই শহর ছেড়ে সে কত দূরে চলে গিয়েছিল, ভেবেছিল আর বুঝি কোনও দিন ফেরাই হবে না এখানে। রাস্তার পাশে যত দোকানের সাইনবোর্ড সে পড়তে পড়তে যাচ্ছে। এটা একটা অদ্ভুত ব্যাপার, সাইনবোর্ডগুলোর দিকে তাকালে অক্ষরগুলো পড়তেই হয়। তাকাচ্ছি অথচ পড়ছি না–এ কিছুতেই হবে না। ট্রামের ঠন ঠন আওয়াজ, রিকশার ঠুং ঠাং, ঘোড়ারগাড়ির কপ কপ, সাইকেলের ক্রিং ক্রিং, বাসের পক পক, ফেরিওয়ালার লে লে বাবু ছ আনা, এইসব মিলিয়েই কলকাতা।

বড়বাবুর বাড়ির সামনে গাড়ি থামবার পর ওরা সবাই হকচকিয়ে গেল। বাড়িটা আর চেনাই যায় না। বসবার ঘরের দেওয়াল ভেঙে সেখান থেকে আর একটা দরজা বার করা। হয়েছে–সেখানে সিভিল সাপ্লাই অফিসের নানা লোক কাজে ব্যস্ত। ভাড়ারঘর, রান্নাঘরেও অফিস, উঠোনটা টিন দিয়ে ঢাকা, সেখানে অনেক মালপত্র উঁই করে রাখা। দোতলায় ওঠবার সিঁড়ির মুখে আর একটা নতুন লোহার দরজা বসেছে, সেটাতে মস্ত বড় তালা লাগানো।

সিভিল সাপ্লাই অফিসের লোকরা ওদের দিকে ভ্রুক্ষেপ করল না। জিজ্ঞেস করলেও কেউ কিছু বলতে পারে না। একটু বাদে একজন পুরনো চাকরের সন্ধান পাওয়া গেল, সে জানাল যে বড়বাবু কলকাতায় নেই। তিনি প্রায়ই আজকাল থাকেন না। সিঁড়ির দরজার তালার চাবি তার কাছে নেই, তবে পাশের বাড়িটাও খালি পড়ে আছে, সে বাড়িতে সে বাবুদের থাকার ব্যবস্থা করে দিতে পারে।

চিররঞ্জন তাকে জিজ্ঞেস করলেন, বড়বাবু কবে আন্দাজ ফিরতে পারেন?

এ-সম্পর্কেও চাকরটি কিছু জানে না। দু’দিন বাদেও ফিরতে পারেন, দশ দিন বাদেও ফিরতে পারেন। আজকাল এই রকমই চলছে।

এ রকম অনির্দিষ্ট অবস্থায় এখানে থাকার কোনও মানে হয় না। মালপত্র দু’চারটে যা নেমেছিল, আবার সেগুলো তুলে ঘোড়ারগাড়ি চলল তালতলায়। মালপত্র সমেত কোনও বাড়িতে এসে আবার সেখান থেকে ফিরে যাবার মধ্যে একটা দীনতা আছে। ওদের চোখে-মুখে এখন সেই দীনতার চিহ্ন–যা ট্রেন জার্নির ধকল ছাপিয়েও স্পষ্ট হয়ে ওঠে।

প্রিয়রঞ্জনের বাড়িতে এসে দেখা গেল, ওদের জন্য সেদিনকার রান্না পর্যন্ত হয়ে আছে। শিয়ালদা থেকে ওরা সোজা এ বাড়িতেই চলে আসবে–এইটাই তো স্বাভাবিক। চিররঞ্জন যে আগে বড়বাবুর বাড়িতে গিয়েছিলেন, সেটা আর উল্লেখ করলেন না।

প্রিয়রঞ্জনের বাড়ি একেবারে জমজমাট। যুদ্ধের বাজারে তার ব্যবসা একেবারে ফুলে ফেঁপে উঠেছে। কাগজের অনটনের ফলে লোকে এখন বালিকাগজ ব্যবহার করে। ইস্কুল কলেজে ছেলেমেয়েরা এখন পেনসিলে লেখা কাগজে আবার কলম দিয়ে লেখে। আলপিন পর্যন্ত বাজার থেকে উধাও, তার বদলে বাবলা কাটা দিয়ে কাজ চালানো হচ্ছে অফিসে অফিসে। প্রিয়রঞ্জনের ব্যবসায় কর্মচারী বেড়েছে, মৌলালিতে একটা বিরাট গুদাম নিয়েছেন, নিজের বাড়িতেই একটা অফিস খুলেছেন। প্রিয়রঞ্জন আর দোকানে যান না, বাড়িতেই বসেন, টেলিফোন এনেছেন, কর্মচারীরা অনবরত আসছে যাচ্ছে।

প্রিয়রঞ্জন ভাইকে সস্নেহ ধমক দিয়ে বললেন, এতদিন গ্রামে পড়েছিলি কেন? যুদ্ধের বাজারে কত দিকে কত কাজ–এ-সময়ে গ্রামে বসে থেকে কি হাড়ে দুর্বোর চাষ করছিলি? আজ থেকেই আমার অফিসে বসে যা। নিজের লোক থাকতেও আমাকে মাইনে করা লোকের ওপর ভরসা করতে হয়। বিশ্বাসী তোক পাওয়া কি চাট্টিখানি কথা?

প্রিয়রঞ্জনের মেয়ে-জামাই এসেছে খড়গপুর থেকে। সেই জন্য বাড়ির ওপরতলায় সব সময় একটা খুশির আবহাওয়া। কলের গান বাজিয়ে সিরাজদ্দৌল্লা পালা শোনা হচ্ছিল, বাদলদের আসবার খবর শুনে সবাই হইচই করে নেমে এল।

বিয়ের পর বাদল শ্রীলেখাকে এই প্রথম দেখল। একটু যেন বদলে গেছে শ্রীলেখা। আগের তুলনায় তাকে রোগা আর লম্বা দেখায়, সিঁথিতে মোটা করে আঁকা সিঁদুর। আরও কিছু একটা পরিবর্তন ছিল তার শরীরে, বাদল লক্ষ করেনি। শ্রীলেখা নিচু হয়ে প্রণাম করল চিররঞ্জন আর হিমানীকে হিমানী তার থুতনি ধরে বললেন, ওমা, তোর বাচ্চা হবে–একটা খবরও দিসনি? ক’ মাস?

শ্রীলেখা সান্ত্বনার দিকে তাকিয়ে চমকে উঠল। ব্যস্ত হয়ে জিজ্ঞেস করল এই, তোর কী হয়েছে? মুখখানা এত শুকনো কেন?

সান্ত্বনা খুব পরিষ্কার গলায় বলল, আমি পাগল হয়ে গেছি!

তাই শুনে শ্রীলেখার ছোট দুই বোন মান্তি আর পান্তি হেসে গড়িয়ে পড়ল। শ্রীলেখা হাসতে পারল না। তার মুখে শঙ্কার ছায়া। সে হিমানীকে জিজ্ঞেস করল, কাকিমা, ওর

কী হয়েছে? খুকু ও রকম করছে কেন?

হিমানী ফ্যাকাশে ভাবে হেসে বললেন, কিছু হয়নি। ও মেয়ের ওই রকম খেয়াল। জানিস তো কী রকম খেয়ালি।

শ্রীলেখা সান্ত্বনাকে টানতে টানতে নিয়ে গেল নিজের ঘরে। খাটে বসিয়ে নানা রকম প্রশ্ন করতে করতে হঠাৎ তার চোখ পড়ল দরজার কাছে বাদল দাঁড়িয়ে আছে। হাফপ্যান্ট, হাফশার্ট আর কেডসের জুতো পরা, হঠাৎ লম্বা হয়ে উঠছে বলে তার দাঁড়াবার ভঙ্গিটা একটু বিচিত্র।

শ্রীলেখা বলল, এই বাদলা, ওখানে দাঁড়িয়ে আছিস কেন, ভেতরে আয়!

বাদল বলল, বড়দি, তুমি এতক্ষণ আমার সঙ্গে একটাও কথা বলোনি?

শ্রীলেখা অবাক হয়েও হেসে ফেলল! তারপর বলল, ওমা, সেই জন্য আবার ছেলের রাগ হয়েছে বুঝি! তুই কেন আমার সঙ্গে আগে কথা বলিসনি? আমাকে প্রণাম করেছিস?

বাদল কাছে আসতেই শ্রীলেখা তাকে জড়িয়ে ধরে বলল, ইস, কত দিন তোদের দেখিনি রে!

প্রভাসকুমার এলেন একটু পরে। এমনিতেই তিনি স্বল্পভাষী, তা ছাড়া এ বাড়ির কারওর সঙ্গে তার কথা বলার মতন বিষয় বেশি নেই, তাই তিনি লাজুক মানুষের মতন চুপ করেই থাকেন আর সব সময় মুচকি মুচকি হাসেন। বাচ্চাদের সঙ্গেও তিনি সহজ ভাবে মিশতে পারেন না।

জামাইবাবু সম্পর্কে বাদলের একটু একটু ভয়ের ভাব ছিল। দু-তিন দিন কাটবার পর সে বুঝল, ভয় পাবার মতন কিছু নয়। ডবল এম এ পাশ লোকেরাও সাধারণ মানুষের মতন কথা বলে এবং গরম চা ডিশে ঢেলে খায়।

প্রভাসকুমার কৌতূহলি হয়ে উঠলেন সান্ত্বনা সম্পর্কে। তিনি সান্ত্বনার সামনে বসে ঘণ্টার-পর-ঘণ্টা জেরা করে যান। ভূতে পাওয়ার ব্যাপারটা তাঁকে খুবই আকৃষ্ট করেছে। তিনি দীর্ঘ দিন ধরে খুঁজছিলেন এমন একজনকে যে নিজের চোখে ভূত দেখেছে কিংবা ভূত সম্পর্কে প্রত্যক্ষ অভিজ্ঞতা আছে।

প্রভাসকুমারের এই বৈজ্ঞানিক গবেষণা কার্যটি অবশ্য খুব নিরিবিলিতে হয় না। বাড়িসুদ্ধ নোক সেই সময় ওদের ঘিরে থাকে। বাচ্চারা হাসে, গোলমাল করে। সান্ত্বনা কোনও কথারই প্রায় জবাব দিতে চায় না, চোখ সরু করে তাকিয়ে থাকে প্রভাসকুমারের দিকে। এক এক সময় সে এমন এক একটা কথা বলে যা শুনে সত্যিই হাসি সামলানো যায় না। যেমন সে বলল, দেশের সেই ভূতটা ছাগল সেজে কলকাতায় চলে এসেছে।

প্রভাসকুমার প্রশ্ন করলেন, কেন?

সান্ত্বনা বেশ দৃঢ় ভাবে বলল, আজ যে দেখলাম, একটা ছাগলের দাড়ি আছে! ‘‘

অন্যরা হাসলেও প্রভাসকুমার হাসেন না। তিনি একটা মোটা খাতা এনেছেন সঙ্গে। সান্ত্বনা কিছু একটা কথা বললেই তিনি শ্রীলেখাকে নির্দেশ দেন, লিখে রাখো। এটাও লিখে রাখো! লিখতে লিখতে শ্রীলেখা একসময় বিরক্ত হয়ে যায় কিংবা লজ্জা পায়। সে বাদলের হাতে খাতা কলম তুলে দিয়ে বলে, তুই লেখ তো!

কিন্তু সান্ত্বনার অসুখটা ঠিক হাসিঠাট্টার ব্যাপার নয়। সে জ্বলজ্বলে চোখে স্থির ভাবে তাকিয়ে থাকে। তারপর অদ্ভুত ভাবে হাসে এবং মাটিতে গড়িয়ে পড়ে। তখন তার দাঁতে দাঁত আটকে যায়।

প্রভাসকুমারের এক বন্ধুর দাদা ক্যাম্ববেল হাসপাতালের বড় ডাক্তার। তিনি প্রতিদিন আসছেন, সান্ত্বনার রোগটি মৃগী বলে সন্দেহ করছেন কিন্তু ওষুধে কাজ হচ্ছে না। অ্যালোপ্যাথিক চিকিৎসা, মনোবিশ্লেষণ সবই চলছে–সেইসঙ্গে একদিন হরি সংকীর্তনের আসরও বসে গেল।

প্রভাসকুমারের সঙ্গে বাদলের আস্তে আস্তে ভাব হল। বাদলের হাতের লেখা মেয়েলি ধরনের গোটা গোটা এবং বেশ স্পষ্ট। সেই হাতের লেখা প্রভাসকুমারের পছন্দ হল, তিনি নিজেই ডেকে বাদলকে পড়াশুনোবিষয়ে প্রশ্ন করতে লাগলেন। বাদল গল্পের বইটই বেশ পড়েছে, সে কথা ও কাহিনী’র একাধিক কবিতা নির্ভুল মুখস্থ বলতে পারে। অতি উৎসাহের সঙ্গে সে বন্দি বীর’আবৃত্তি করতে লাগল। প্রভাসকুমার তাকে দেখিয়ে দিলেন, উঁহু, ও ভাবে নয়, ও ভাবে নয়। আরও আস্তে আস্তে, আরও টেনে ‘পঞ্চনদীর তীরে’ বলবার সময় ডান হাতের পাঁচটা আঙুল ফাঁক করে দেখাবে, বেণী পাকাইয়া শিরে’ বলবার সময় মাথায় চুলের ওপর হাত দিয়ে বেণীর মতন দেখিয়ে।

আবৃত্তি শেষ হলে তিনি বাদলকে প্রশ্ন করলেন, তুমি বড় হয়ে কী হবে?

বাদল মাথা চুলকোতে লাগল। বড় হয়ে সে কী হবে? সে তো অনেক কিছু হবে। সে জাহাজে চেপে পৃথিবী ঘুরবে, সে এভারেস্টের চূড়ায় উঠবে, সে নতুন গ্রহতারকা আবিষ্কার করবে। আরও কত কী? এর মধ্যে কোনটা বলবে সে?

প্রভাসকুমার আবার বললেন, বড় হয়ে কী হবে, ঠিক করোনি?

বাদল আচমকা বলে ফেলল, ঘুড়ির দোকান করব!

বাদলের ঘুড়ি ওড়াবার খুব শখ। এবার আসবার পর কেউ তাকে ঘুড়ি-লাটাই কিনে দেয়নি। তার পুরনো লাটাই সুতো বড়বাবুর বাড়িতে রয়ে গেছে। তার ধারণা, বড় হয়ে ঘুড়ির দোকান করলে কোনও দিন আর ঘুড়ির অভাব হবে না।

প্রভাসকুমার তাকে বললেন, বয়সের তুলনায় তুমি অনেক ছোট আছ। ও-সব কথা বলে না। এখন থেকেই ঠিক করে রাখো তুমি মানুষের মতন মানুষ হবে। তোমার দাদার মতন হতে ইচ্ছে করে না? সূর্যদা?

বাদল চমকে উঠে জিজ্ঞেস করল, আপনি সূর্যদাকে চেনেন?

নিশ্চয়ই চিনি। তোমার সূর্যদা একজন বীর পুরুষ। একদিন সারা দেশের লোক ওকে চিনবে।

বাদল ঠিক যুক্তিটা জানে না, তার অবচেতন মনে এ রকম একটা আশা গড়ে উঠেছিল। যে সূর্যদা আর জামাইবাবুর পক্ষে পরস্পরকে সহ্য করা সম্ভব নয়। সূর্যদা ভীষণ রাগী, বড়দির বিয়ের সময় খুব রেগে গিয়েছিল, জামাইবাবুকে দেখলেই তো আরও রেগে যাবার কথা।

সূর্যদাকে আপনি কোথায় দেখলেন?

খড়্গপুরে আমাদের বাড়িতে এসে তো ছিল কয়েক দিন। আমার কথা যদি শুনত, তা হলে পুলিশে ওকে ধরতেও পারত না।

সূর্যদাকে কি জেলখানায় মেরে ফেলেছে?

যাঃ পাগল, মেরে ফেলবে কেন! ওর এখনও বিচার চলছে।

বাদল ছুটে চলে এল শ্রীলেখার কাছে। উত্তেজিত ভাবে জিজ্ঞেস করল, বড়দি, সূর্যদা তোমাদের বাড়িতে গিয়েছিল?

শ্রীলেখা এস্তে এদিক-ওদিক তাকিয়ে বলল, চুপ, আস্তে কথা বলতে পারিস না? তোকে কে বলল?

জামাইবাবু।

হ্যাঁ গিয়েছিল। শোন, সূর্যদার কথা জোরে জোরে সবাইকে শুনিয়ে বলতে নেই এখন।

কেন, কী হয়েছে।

সূর্যদাকে তো পুলিশে ধরেছে। এখন সূর্যদার কথা অন্য কেউ আলোচনা করলে তাদেরও পুলিশে ধরে নিয়ে যাবে। বাবা ওর কথা বলতে বারণ করেছেন।

সূর্যদা তোমাদের বাড়িতে গিয়েছিল, আর তুমি ওকে আটকে রাখতে পারলে না, কেন ওকে পুলিশে ধরল?

শ্রীলেখা স্থির দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইল বাদলের দিকে। ক্রমশ ভারী হয়ে এল দৃষ্টি। খুব আস্তে আস্তে বলল, সূর্যদা কি কারওর কথা শোনে?

সূর্যদা কি মরে যাবে? ফাঁসি হবে?

না, না, ছিঃ, ওকথা উচ্চারণ করতে নেই।

শ্রীলেখা আর নিজেকে সামলাতে পারল না, দু ফোঁটা জল নেমে এল তার চোখ দিয়ে। আঁচল দিয়ে মুখ মুছে বলল, বাদল, তুই আর আমি ছাড়া এ বাড়িতে আর কেউ সূর্যদাকে ভালোবাসে না! উঃ, আমাদের বাড়িতে যখন এল, কী চেহারা হয়েছিল, তুই দেখে চিনতেই পারতিস না। আস্তে আস্তে একটু ভালো হয়েছিল, সব ব্যবস্থা করা হয়েছিল, পুলিশে ধরা পড়ার কোনও কথাই ছিল না, তবু ও একদিন চলে গেল।

কেন চলে গেল?

আমার জন্য।

তুমি সূর্যদাকে তাড়িয়ে দিয়েছিলে?

না রে। আমি ওকে ধরে রাখতে চেয়েছিলুম, সেই জন্যই ও জোর করে চলে গেল। তুই এটা বুঝবি না।

বাদল সেই বয়সে বার বার অনেকের মুখে শুনেছে, তুই এখন এসব বুঝবি না। এই কথাটা শুনলেই মনটা উতলা হয়ে যায়, জলের মধ্যে প্রবল আলোড়নের মতন বোধের সীমানাগুলো কেঁপে ওঠে। বাদল এইটুকু অন্তত বুঝেছিল, তার বড়দি আর সূর্যদা কী যেন একটা অদৃশ্য বন্ধনের মধ্যে রয়েছে–ওরা পরস্পরের কাছে ভীষণ ভাবে আসতে চায় কিন্তু অন্যরা আসতে দেবে না। সূর্যদা বড়দিকে কাদাবে আবার নিজেও কষ্ট পাবে।

ওরা সূর্যদাকে নিষ্ঠুর ভাবে মেরে মেরেও কোনও কথা বার করতে পারেনি।

ওরা সূর্যদাকে মারে? ইস, আমি যদি একটা বন্দুক পেতাম!

চুপ, এসব কথা কারোকে বলিসনি।

তুমি কী করে জানলে?

বড়বাবু বলেছেন। আমি বড়বাবুর সঙ্গে দেখা করতে গিয়েছিলাম। বড়বাবু তো এ বাড়িতে আজকাল আর আসেন না।

বড়বাবু তো নেই কলকাতায়।

বড়বাবু সূর্যদাকে দেখতে গেছেন। প্রত্যেক সপ্তাহে যান।

আমি বড়বাবুর সঙ্গে যাব!

পারবি? বড়বাবুকে জোর করে বলতে পারবি? আমি তো মেয়ে, আমি অনেক কিছু পারি না। তুই ইচ্ছে করলে পারিস, বড়বাবুকে যদি খুব করে বলিস–

পারব, নিশ্চয়ই পারব।

সকল অধ্যায়

১. ০১. মাঝে মাঝে মনে হয়
২. ০২. অমরনাথ যখন বাদলকে নিয়ে
৩. ০৩. ভালো করে ভেবে দেখতে গেলে
৪. ০৪. ফুলবাড়ি নামের জায়গাটি
৫. ০৫. বয়স মানুষ খুব দ্রুত হারিয়ে ফেলে
৬. ০৬. রেণুদের বাড়ি গ্রে স্ট্রিটে
৭. ০৭. চিররঞ্জন হেরে যাওয়া মানুষ
৮. ০৮. সূর্যকুমার বছরে একবার কলকাতায়
৯. ০৯. সূর্য পড়াশুনোতে ভালোই ছিল
১০. ১০. চিত্তরঞ্জন দাশের মৃত্যুর পর
১১. ১১. দলের নেতার নাম হরকুমার
১২. ১২. গরমের ছুটিতে বিষ্ণু
১৩. ১৩. সকালবেলা খবরের কাগজ
১৪. ১৪. রসময় চক্রবর্তীর বাড়িতে
১৫. ১৫. ওদিকে সূর্যদা
১৬. ১৬. মন্দাকিনী খবর পাঠিয়েছেন
১৭. ১৭. এক একটা দিন এমন চমৎকার
১৮. ১৮. সূর্য ঘন্টাখানেক ধরে রাস্তায়
১৯. ১৯. শ্রীলেখার সঙ্গে যে সূর্যর মেলামেশা
২০. ২০. হাওড়া স্টেশনে সূর্যর সঙ্গে
২১. ২১. মাঠের মধ্যে একটা মোটরগাড়ি
২২. ২২. ন্যায়-অন্যায়ের যে সূক্ষ্ম সীমারেখা
২৩. ২৩. ফিটন থেকে একজন
২৪. ২৪. সূর্য প্রকাশ্যে জানিয়ে দিল
২৫. ২৫. একজন জটাজুটধারী সন্ন্যাসী
২৬. ২৬. যদু পণ্ডিতের পাঠশালা
২৭. ২৭. বড়দির বিয়ের দিন
২৮. ২৮. দ্বিতীয় মহাযুদ্ধের প্রথম দু-তিনটি বছর
২৯. ২৯. জাপানিরা আসছে
৩০. ৩০. ট্রেনে চেপে খুলনা
৩১. ৩১. নৌকো থেকে যেখানে নামা হল
৩২. ৩২. ব্রজগোপাল সূর্যকে নিয়ে নামলেন
৩৩. ৩৩. সূর্যকে শুতে দেওয়া হয়েছিল
৩৪. ৩৪. তমোনাশ ডাক্তার একে একে
৩৫. ৩৫. এই এলাকায় তমোনাশ
৩৬. ৩৬. নীচের তলায় খুটখাট
৩৭. ৩৭. বিয়ের পর শ্রীলেখা
৩৮. ৩৮. মুর্শিদের চরে কয়েক দিন
৩৯. ৩৯. দূর থেকে আসছে একটা মিছিল
৪০. ৪০. সূর্য চলে যাবার পর
৪১. ৪১. সরকারি হিসেব মতনই
৪২. ৪২. যারা লম্বা তালগাছের ওপরে
৪৩. ৪৩. যদিও শ্রীলেখা সব সময়ই
৪৪. ৪৪. প্রভাসকুমারদের পরিবারটি
৪৫. ৪৫. সেবারের দূর্গাপূজোর
৪৬. ৪৬. যে-কোনও কারণেই হোক
৪৭. ৪৭. শ্রীলেখার সঙ্গে সান্ত্বনার
৪৮. ৪৮. মেদিনীপুর সেন্ট্রাল জেলের গেট
৪৯. ৪৯. চিররঞ্জন শিয়ালদা স্টেশনে এসে
৫০. ৫০. কাছাকাছি মানুষের প্রভাব
৫১. ৫১. বেয়াল্লিশ সালের গোড়ায়
৫২. ৫২. আমরা অনেক মৃত্যু দেখেছি
৫৩. ৫৩. সকালবেলা ঘণ্টাখানেকের জন্য
৫৪. ৫৪. স্কুল ছাড়ার আগে
৫৫. ৫৫. যদিও সুর্যর যাবজ্জীবন কারাদণ্ড
৫৬. ৫৬. দু-এক দিনের মধ্যেই সূর্য
৫৭. ৫৭. সেই সময় একটা কথা
৫৮. ৫৮. আমাদের বাড়ির বাজার করার ভার
৫৯. ৫৯. জুন মাসের তিন তারিখে
৬০. ৬০. ও-বাড়িতে আমার টিউশানি
৬১. ৬১. কলেজের সোস্যাল ফাংশান
৬২. ৬২. পর পর অনেকগুলো ট্রাম
৬৩. ৬৩. বাদল বাইরের ঘরে
৬৪. ৬৪. দুদিনের মধ্যে সান্ত্বনা
৬৫. ৬৫. সূর্য আর বাদল
৬৬. ৬৬. হিরোসিমাতে যে-দিন অ্যাটম বোমা
৬৭. ৬৭. কাটিহারে গিয়ে দীপ্তিদির বাড়ি
৬৮. ৬৮. সূর্যর চালচলন ক্রমশ
৬৯. ৬৯. রেণুর একটা নিজস্ব জগৎ
৭০. ৭০. হিমানীর বাবা-মা এবং দাদারা
৭১. ৭১. সূর্য অনেকটা উদ্দেশ্যহীন
৭২. ৭২. এলাহাবাদের সেই বাঙালি ছেলেগুলি
৭৩. ৭৩. যুবকটি সূর্যর চেয়ে
৭৪. ৭৪. অনেক দিন বাদে সূর্যকে
৭৫. ৭৫. রেণুর কাছ থেকে অনুমতি
৭৬. ৭৬. কলকাতায় ফিরেই শুনলাম
৭৭. ৭৭. কিছুক্ষণ ছোটার পর
৭৮. ৭৮. বুলবুল চেয়েছিল সূর্যকে নিয়ে
৭৯. ৭৯. ভারতের যে-কোনও শহরেই
৮০. ৮০. বাবাকে উত্তেজিত এবং খুশি দেখা গেল
৮১. ৮১. জাহাজ ছাড়বে কোচিন থেকে
৮২. ৮২. মহীশূরে সুব্রতদাদের বাড়িতে
৮৩. ৮৩. সূর্য কলকাতায় এসে পৌঁছোল
৮৪. ৮৪. রেণু এল পরদিন সকালবেলা
৮৫. ৮৫. বরানগর-আলমবাজারের দিকে
৮৬. ৮৬. গা ছুঁয়ে প্রতিজ্ঞা
৮৭. ৮৭. কৃষ্ণনগর শহরের রাস্তা
৮৮. ৮৮. পাহাড়ে দ্রুত উঠতে নেই

নোট নিতে এবং টেক্সট হাইলাইট করতে লগইন করুন

লগইন