২১. মাঠের মধ্যে একটা মোটরগাড়ি

সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়

মাঠের মধ্যে একটা মোটরগাড়ি অপেক্ষা করছিল। সেই গাড়ি চেপে আধঘণ্টা আন্দাজ যাবার পর আবার নামা হল। চতুর্দিকে ঘুটঘুঁটে অন্ধকার। কোন জায়গায় এসেছে সূর্য। বুঝতে পারল না।

ওরা সবসুদ্ধ সংখ্যায় পাঁচজন। ব্রজগোপাল টর্চ জ্বেলে ঘড়ি দেখলেন, রাত প্রায় ।দেড়টা। আকাশের দিকে তাকালেন, জমাট কালো মেঘ। ফিসফিস করে বললেন, তোমরা সবাই আমার পেছন পেছন আসবে। বাড়িটার সামনের বাগানে কাঁটাতারের বেড়া আছে, ঢুকতে হবে সাবধানে। কুকুর নেই। ওবাড়িরই একটি ছেলে দরজা খুলে রাখবে। শংকরবাবু, আপনি দরজায় দাঁড়াবেন। আমরা ভেতরে ঢুকব। নেহাত দরকার না হলে কারোকে প্রাণে মারার দরকার নেই।

বাড়িটা কার?

আঢ্যিদের বাড়ি। প্রাণকৃষ্ণ আঢ্যি একের নম্বরের কঞ্জুষ। সোনাদানা, টাকাপয়সা বাড়িতেই রাখে। বাড়িতে বন্দুক আছে–সেটা আগে দেখা দরকার।

সূর্য অস্ফুট ভাবে বলল, ডাকাতি?

এতক্ষণ তাকে কেউ কিছু বলেনি। কিন্তু তারা যে দল মিলে ডাকাতি করতে আসছে–এটা কল্পনাও করেনি সে। তার মন বেশ দমে গেল। এত প্রস্তুতি, এত গোপনীয়তা–সে বিরাট কিছু কাজের কথা ভেবেছিল! ইউরোপিয়ান ক্লাব আক্রমণ কিংবা ট্রেন উড়িয়ে দেওয়া–এই রকমের কিছু।

ব্রজগোপাল সূর্যর দিকে ফিরে বললেন, সামনে আমাদের বিরাট যুদ্ধ। এখন আমাদের হাতে প্রচুর রসদ দরকার। টাকা চাই। যদি কারওর প্রাণের মায়া থাকে এখনও ফিরে যেতে পারো।

কেউ কোনও কথা বলল না।

ব্রজগোপাল আবার ঘড়ি দেখে বললেন, চলো! দশ মিনিটের মধ্যে সব শেষ করতে হবে!

গাড়ি থেকে দুটি শাবল বার করা হল। একটা কাপড়ের থলি। ব্রজগোপাল ও শংকরবাবুর হাতে পিস্তল। সূর্যর পিস্তলটা তার কোমরে গোঁজা–একদিন শোবার সময়েও সে ওটা হাতছাড়া করেনি৷

ঘাসের ওপর শিশির ঝরে আছে। হাঁটতে গিয়ে ওদের পা ভিজে যায়। মাঠের এক পাশে দু-একটা মাটির বাড়ি, সেখানে দুটি বিড়ালের খুব ডাকাডাকি চলছে। আরও দূরে কোথাও অবিকল শিশুর কান্নার মতন শকুনির বাচ্চার ডাক শোনা যায়।

বাড়িটা দোতলা ও গোল ধরনের। ব্রজগোপাল একবার টর্চ জ্বেলে সদর দরজাটা দেখে নিলেন। আস্তে ধাক্কা দিতেই দরজাটা খুলে গেল। একজন রুগণ চেহারার মধ্যবয়সি লোক সেখানে দাঁড়িয়ে–দেখলে মনে হয় বাড়ির বাজার সরকার কিংবা আশ্রিত। ব্রজগোপালের টর্চের আলোয় দেখা গেল, লোকটি থরথর করে কাঁপছে, মুখখানা একেবারে রক্তহীন। এই লোকটিই দরজা খুলে রেখেছে বোঝা যায়। ব্রজগোপালের ইঙ্গিতে যোগানন্দ দড়ি বার করে লোকটির হাত-পা বেঁধে ফেলল। লোকটি স্বেচ্ছায় তাতে রাজি। ব্রজগোপাল জিজ্ঞেস করলেন, বন্দুকটা কোথায়? লোকটি কোনওক্রমে বলল, দোতলায়, সিঁড়ি দিয়ে উঠে ডান দিকে।

সেই ঘরের দরজা খোলা ছিল। ভেতরে বিরাট পালঙ্কের ওপর একজন মোটাসোটা বৃদ্ধ ঘুমোচ্ছে। মেঝেতে আর একটা বিছানা পাতা–সেটা খালি। আলমারির মাথাতেই বন্দুকটা রাখা–খোঁজাখুঁজি করারও দরকার হল না। সিরাজুল বন্দুকটা নিজের কাছে রাখলেন।

ব্রজগোপাল খুব সন্তর্পণে বৃদ্ধের গায়ে হাত রেখে বললেন, এই যে, উঠুন!

বৃদ্ধটি গভীর ঘুমে মগ্ন। ভোঁস ভোঁস করে নিশ্বাস পড়ছে। যোগানন্দ ওর পা ধরে নাড়া দিতে যেতেই তিনি ঘুমের ঘোরেই যোগানন্দকে এক লাথি কষালেন। পাশেই টিপয়ে এক গেলাস জল ঢাকা দেওয়া ছিল–সেটা তুলে নিয়ে ব্রজগোপাল সবখানি জল ঢেলে দিলেন বৃদ্ধের চোখে-মুখে।

হতভম্ব বৃদ্ধ চোখ মেলতেই ব্রজগোপাল খুব বিনীত ভাবে বললেন, আঢ্যিমশাই, সিন্দুকের চাবি!

এইবার বৃদ্ধের সত্যিকারের ঘুমের ঘোর কাটল। অতবড় শরীর নিয়েও আশ্চর্য রকম দ্রুততায় উঠে বসেই ষাঁড়ের মতন চাঁচাতে লাগলেন, ওরে বাবারে, মেরে ফেলল! গোবিন্দ, রাখহরি–কে কোথায় আছিস, মেরে ফেললে–!

ব্রজগোপালের পাশেই দাঁড়িয়ে ছিলেন সিরাজুল–তিনি খপ করে চেপে ধরলেন বৃদ্ধের মুখ। যোগানন্দ হাতের শাবল তুলে বলল, টু শব্দ করলে খুন করে ফেলব। চাবি কোথায়?

বৃদ্ধের ওই চিৎকারেও কারওর ঘুম ভেঙেছে বলে মনে হল না। তবু সাবধানতার জন্য ওরা কয়েক জন ঘরের বাইরে গিয়ে জায়গা নিয়ে দাঁড়াল।

শেষ পর্যন্ত বৃদ্ধের দু’গালে দুটি চড় না মারা পর্যন্ত চাবি আদায় করা গেল না। কিন্তু সে ঘরের সিন্দুকে বেশির ভাগই কাগজপত্র, দলিল-দস্তাবেজ। আসল সিন্দুক দোতলারই অন্য ঘরে। বৃদ্ধকে নিয়ে যাওয়া হল সেখানে। বৃদ্ধ কম্পিত গলায় ডাকলেন, বউমা, দরজা খোলো!

সে-দরজা আর খোলে না। ভেতরের লোক জেগেছে, তবু দরজা খুলবে না। বৃদ্ধকে মেরে ফেলার হুমকি দেওয়া হল, তবু তাদের গরজ নেই। শেষ পর্যন্ত দুমদাম করে লাথি মারা হতে লাগল দরজায়।

ঘরের মধ্যে স্বামী-স্ত্রী ও দুটি সন্তান। একটি বারো-তেরো বছরের মেয়ে তখনও খাটের ওপরে অঘোরে ঘুমোচ্ছে, বছর পাঁচেকের একটি ছেলে জেগে উঠে চেয়ে আছে ফ্যালফ্যাল করে। বধূটি দরজা খুলে তাকিয়ে আছে বিস্ফারিত চোখে, স্বামীটিকে দেখলে মনে হয়–তার মতন বীরপুঙ্গব পৃথিবীতে আর দুটি নেই।

আঢ্যিমশাইয়ের ঘাড় ধরে ধাক্কা দিয়ে ঘরের মধ্যে ঢুকিয়ে ব্রজগোপাল জিজ্ঞেস করলেন, কোথায় সিন্দুক?

আঢ্যিমশাই ছেলের দিকে তাকিয়ে হাউহাউ করে উঠলেন, ওরে গোবিন্দ, সর্বনাশ হয়ে গেল! আজ সর্বস্বান্ত হয়ে গেলুম।

বধূটি নিজেই আঁচলের চাবি খুলে দিয়ে বললেন, আপনাদের যা খুশি নিয়ে যান। আমার ছেলেমেয়েদের কিছু বলবেন না।

আপনার গায়ের গয়না খুলে দিন!

বধূটির সব গয়না খোলা হল। আঢ্যিমশাইয়ের হাতের তিনটি আংটি। সে-ঘরের সিন্দুকে আশাতিরিক্ত জিনিস পাওয়া গেল। হাজার টাকার নোট এক তাড়া। বেশ কিছু গিনি। সোনার গয়না ভরি পঞ্চাশেক। ঘুমন্ত মেয়েটির গলা থেকে সরু হারটা যোগানন্দ খুলে নিল সাবধানে। যোগানন্দের হাতের থলিতেই সবকিছু রাখা হচ্ছে। এই সময় তার চোখ গেল আঢ্যিমশাইয়ের ছেলের দিকে। দেওয়ালের সঙ্গে মিশে কাঠ হয়ে দাঁড়িয়ে আছে। তার হাতের আংটি খুলে দিলেও ডান বাহুতে একটা বড় সোনার তাবিজ রয়েছে তখনও।

ব্রজগোপাল ধমক দিয়ে বললেন, ওটা খোলো!

এটা নেবেন না। আপনাদের পায়ে পড়ছি!

শিগগির খোলো।

এটাতে আমার মায়ের ছবি আছে।

যোগানন্দ বলল, মার না খেলে চলবে না, না? হাতের শাবলখানা দিয়ে সে সজোরে মারল লোকটির পিঠে। সেই মুহূর্তে সেই পাঁচ বছরের শিশুটি চিৎকার করে উঠল, বাবা! তারপরই সে ককিয়ে কেঁদে উঠল, বাবাকে মেরে ফেললে, বাবাকে মেরে ফেলছে।

ব্রজগোপাল সূর্যর দিকে তাকিয়ে ইঙ্গিত করল ছেলেটির মুখ চেপে ধরতে। সূর্যর বুকের মধ্যে ছ্যাঁৎ করে উঠল। এতক্ষণ সে সবকিছু দেখে যাচ্ছিল নির্বিকার ভাবে, কিন্তু এখন যেন তার দম আটকে আসছে। ওই শিশুটির চিৎকার সবকিছু অন্য রকম করে দিল। এই সবকিছুর মধ্যেই একটা শিশুর উপস্থিতি যেন বেমানান। ওইটুকু ছেলের সামনে তার বাবাকে মারা–এরচেয়ে বড় নিষ্ঠুরতা যেন আর নেই। যোগানন্দ এত নিষ্ঠুর! ব্রজগোপালের নির্দেশ পেয়ে সূর্য যন্ত্রচালিতের মতন গিয়ে শিশুটির মুখ চেপে ধরল।

বধূটি গিয়ে স্বামীকে আড়াল করে দাঁড়াল। নিজেই মাদুলিটা ছিঁড়ে নিয়ে ছুঁড়ে ফেলে দিল মাটিতে।

আঢ্যিমশাইয়ের ছেলে আর দাঁড়িয়ে থাকতে পারল না। শাবলের ঘা-টা বেশ জোরেই পড়েছিল–সে মাটিতে পড়ে গোঁ গোঁ করতে লাগল।

এই সময় হঠাৎ একজন প্রৌঢ় ঢুকে পড়ল ঘরের মধ্যে। লোকটির দুঃসাহস অবাক করে দেবার মতন। অন্য কারোকে গ্রাহ্য না করে সে যোগানন্দের সামনে এসে বলল, একী যোগানন্দ, তুমি? তুমি সত্যি যোগানন্দ?

লোকটিকে আর কোনও কথা বলার সুযোগ দেওয়া হল না। সিরাজুল পেছন থেকে। বন্দুকের বাঁট দিয়ে তার মাথায় আঘাত করে শুইয়ে ফেললে।

সবচেয়ে নাটকীয় ঘটনাটি অপেক্ষা করছিল নীচের তলায়। ওপরের ঘরগুলোতে মোটামুটি আর বিশেষ কিছু পাওয়া যায়নি। সিঁড়ি দিয়ে নামবার সময় ওদের খেয়াল হল, সিঁড়ির নীচেই একটা ঘর ভেতর থেকে খিলবন্ধ–সে-ঘরটা দেখা হয়নি।

তিনটি লাখি মারতেই সে-ঘরের দরজার খিল ভেঙে গেল। ভেতরের দৃশ্য দেখলে প্রথমটায় চমকে উঠতেই হয়।

ঘরটায় আসবাবপত্র কিছুই নেই। মেঝের ওপর মাদুর বিছানা পাতা। সেই বিছানার ওপর স্থির হয়ে বসে আছে একটি আঠারো-উনিশ বছরের মেয়ে, অসাধারণ সুন্দরী, তার সমস্ত শরীর অলংকারে মোড়া। দু’হাতে অন্তত দশ গাছা করে চুড়ি, তারপর বালা ব্রেসলেট; কানে কানবালা, কপালে টিকলি, গলায় পাথর বসানো হার। ব্রজগোপালের টর্চের আলোয় গয়নাগুলো ঝলমল করে উঠল। দৃশ্যটা হঠাৎ অলৌকিক মনে হয়। রাত্তিরবেলা ঘরের মধ্যে এত গয়না পরে বসে থাকার কোনও যুক্তি নেই।

মেয়েটির কোলে একটি পাঁচ-ছ’মাসের বাচ্চা, পাশে একজন বৃদ্ধাশোওয়ার ভঙ্গি দেখে মনে হয় অজ্ঞান।

দু’-এক মুহূর্ত সবাই থমকে গিয়েছিল। তারপর ব্রজগোপাল বললেন, মা, তোমার গয়নাগুলো খুলে দাও।

মেয়েটি তীব্র গলায় বলল, না!

আমাদের দেরি করার সময় নেই।

আমি দেব না!

দিতে তোমাকে হবেই, শুধু শুধু ঝামেলা করবে।

কিছুতেই দেব না!

ব্ৰজগাপাল পিস্তল উঁচিয়ে বললেন, উঠে দাঁড়াও!

মেয়েটি বাচ্চা কোলে নিয়েই উঠে দাঁড়াল। এমন রূপসি সচরাচর চোখে পড়ে না। কোমর ছাড়িয়ে নেমেছে চুল, মুখোনি প্রতিমার মতন, সর্বাঙ্গ লাবণ্যমাখা। অত অলংকার ছাড়াও তার চেহারা চোখ ধাধিয়ে দেবার মতন। তার চোখে-মুখে কোনও ভয়ের চিহ্ন নেই।

ব্রজগোপাল কর্কশ গলায় বললেন, গুলি করে তোমার মাথার খুলি উড়িয়ে দিয়ে তারপর তোমার গয়না নিতে হবে?

তাই নিন!

তার আগে আছাড় দিয়ে তোমার ওই বাচ্চাটাকে মেরে ফেলব!

মেরে ফেলুন!

তবু গয়নার জন্য এত লোভ? ভালো কথা বলছি, এখনও দাও!

আমি দেব না তো বলেছি।

তা হলে দেখো, তোমার বাচ্চাটা আগে মরুক!

ব্রজগোপাল অসম্ভব রাগত মুখে সূর্যর দিকে তাকিয়ে বললেন, যা তো, নিয়ে যা তো বাচ্চাটাকে! আছড়ে মেরে ফ্যাল!

সূর্য চুপ করে দাঁড়িয়ে ছিল, ব্রজগোপাল তাকে এক ধমক দিলেন। সূর্য এগিয়ে গেল মেয়েটার দিকে। মেয়েটি দু’-এক পলক তাকাল সূর্যের দিকে। তাকাতেই হবে–কেন না, ডাকাতের দলে এ রকম চেহারার ছেলে কেউ কোনও দিন দেখবে আশা করে না। মেয়েটি বলল, কেড়ে নেবে? নাও!

সূর্য হাত বাড়াল। কিন্তু কেড়ে নিতে হল না–মেয়েটি নিজে থেকেই বাচ্চাটিকে দিয়ে দিল সূর্যর হাতে। বাচ্চাটা ঘুমিয়ে আছে। সূর্য খুব সাবধানে বাচ্চাটাকে ধরে নিয়ে গেল বাইরে। এইটুকু বাচ্চাকে সে কখনও কোলে করেনি, তার গা শিরশির করে। দরজার কাছে পাহারারত শংকরবাবুকে গিয়ে বলল, কী করব একে নিয়ে?

ওদিকে ঘরের মধ্যে মেয়েটিকে ব্রজগোপাল বললেন, এবার দেবে?

আমাকে আগে মেরে ফেলুন। তার আগে পাবেন না!

গা থেকে একটা একটা করে গয়না টেনে ছিঁড়ে নিতে হয়! লোভী মেয়েছেলে! এই, তাই নে তো!

যোগানন্দ এগিয়ে গিয়ে বলল, এখনও দাও বলছি!

মেয়েটি বলল, জোর করে নিতে হয় নিন।

ব্রজগোপালও এগিয়ে গেলেন, দাতে দাঁত ঘষে বললেন, তোমার মতন মেয়েছেলেকে চুলের মুঠি ধরে টানতে টানতে নিয়ে গেলে ভালো হবে, না?

মেয়েটি একটুও ভয় না পেয়ে সোজাসুজি ব্রজগোপালের চোখের দিকে তাকিয়ে রইল। ব্রজগোপাল তার গায়ে হাত তুলতে গিয়েও পারলেন না।

এই সময় বাচ্চাটা টা টা করে কেঁদে উঠতেই সূর্য ঘাবড়ে গিয়ে তাকে নিয়ে ফিরে এল ঘরে! ওইটুকু বাচ্চার কী গলার জোর-সূর্য ওকে নিয়ে একেবারে দিশেহারা হয়ে পড়ল। কারোকে কিছু জিজ্ঞেস না করেই বাচ্চাটাকে তুলে দিল মেয়েটির হাতে। মেয়েটি তাকে বুকে চেপে ধরল। মায়ের বুকের চেনা উত্তাপ পেয়েই বাচ্চাটা সঙ্গে সঙ্গে চুপ।

ব্রজগোপাল একটা হতাশ ভঙ্গি করলেন। একটু হাসলেন। বললেন, হরদা আমাদের অনেককিছু শিখিয়েছেন, কিন্তু একটা মেয়ের গা থেকে কী করে গয়না কেড়ে নিতে হয় সেটা শিখিয়ে যাননি। কী আর হবে, চলো!

যোগানন্দ বলল, এতগুলো গয়না ছেড়ে দিয়ে যাব?

ব্রজগোপাল বললেন, উপায় কী; মেয়েমানুষের গায়ে কে হাত দেবে? দেরি করে লাভ নেই, চলো সবাই–

সবাই ঘর থেকে বেরিয়ে আসবার আগে ব্রজগোপাল মেয়েটির দিকে ফিরে ঘৃণার দৃষ্টিতে বললেন, ছেড়ে দিলাম! ওই গয়না ধুয়ে জল খেয়ে সারা জীবন।

মেয়েটি এবার বাচ্চাটিকে বিছানায় নামিয়ে রেখে বলল, শুনুন! আমার একটা কথা শুনে যান।

কী?

আমার শ্বশুরবাড়ি বর্ধমান, ঠিকানা বলে দিচ্ছি–সেখানে কোনও দিন যাবেন, আমার যা আছে সব দেব।

নেমন্তন্ন?

আমি জানি, আপনারা স্বদেশি। সাধারণ ডাকাত নন!

কে বললে? আমি দেখেই বুঝেছি। আপনারা আমার ছেলেকে কিছুতেই মারতেন না!

ঠিক আছে, ঠিক আছে!

আমার শ্বশুররা বড়লোক। আমি গরিবের মেয়ে। এটা আমার বাপের বাড়ি নয়। একটু দূরে যে মাটির ঘর আছে, সেখানে আমাদের বাড়ি। চুরি-ডাকাতির ভয়ে রাত্তিরে এ বাড়িতে এসে থাকি। আমার যদি সব গয়নাগাঁটি যায়–শ্বশুরবাড়িতে আমার কথা কেউ বিশ্বাস করবে না। সবাই বলবে, আমার মা গরিব–তাই লোভ করে সব গয়না রেখে দিয়েছে। আমার মায়ের নামে অপবাদ হওয়ার চেয়ে আমার মৃত্যুও ভালো। এমনিতেই সব সময় তারা আমার মায়ের নামে খোটা দেয়। ওই দেখুন, আমার মা অজ্ঞান। হয়ে আছেন।

কী করেন তোমার শ্বশুর!

দারোগা।

তাই! দারোগা ছাড়া ছেলের বউকে এত গয়না এখন আর কে দেবে! ঠিক আছে, নেমন্তন্ন রইল, যাব একদিন।

মেয়েটি নির্ভয়ে, সারা গায়ের গয়না ঝলমলিয়ে ওদের এগিয়ে দিল দরজা পর্যন্ত।

বাড়ি থেকে বেরিয়ে কয়েক গজ যাওয়ামাত্রই চঁচামেচি শুরু হয়ে গেল। আঢ্যিমশাই আর তাঁর ছেলে বোধহয় এতক্ষণ জানলা দিয়ে দেখছিলেন, ডাকাতরা বাড়ি ছাড়া হতেই সাহস ফিরে এসেছে। চিৎকারের মাত্রা এখন এত বেশি যে দূরের মাটির বাড়িগুলোতেও তার প্রতিক্রিয়া দেখা গেল। জ্বলে উঠল দু-একটা হ্যারিকেন।

ব্রজগোপাল নির্দেশ দিলেন, তোমরা সবাই ছড়িয়ে পড়ো! প্রত্যেকে আলাদা ভাবে গাড়ির কাছে পৌঁছোবে। যত তাড়াতাড়ি সম্ভব। কেউ বাধা দিতে এলে বিনা দ্বিধায় গুলি করবে এখন।

সূর্য পিস্তলটা হাতে নিয়ে দৌড়োতে লাগল অন্ধকারের মধ্যে। কাঁটাতারের কথা তার মনে ছিল না–সেখানে ধাক্কা লেগে পড়ে গেল আছাড় খেয়ে। পিস্তলটা হাত থেকে খসে গিয়েছিল। পাগলের মতন খুঁজতে লাগল সেটাকে। ওদিকে লোকজনের গলার আওয়াজ বাড়ছে। সূর্যর হাঁটুর কাছে কেটে গেছে। হঠাৎ তার মনে হল, আকাশের সব মেঘ নীচে নেমে আসছে, আশেপাশের বাড়ি ও গাছপালা এগিয়ে আসছে তার দিকে, সে এবার ফঁদে পড়বে। চতুর্দিকের সমস্ত জড় পদার্থ পিষে মেরে ফেলবে তাকে। সূর্য দু-এক মুহূর্তের জন্য নার্ভাস হয়ে পড়েছিল। পিস্তলটা আবার খুঁজে পেতেই, বিনা প্রয়োজনে আকাশের দিকে গুলি ছুড়ল এক রাউন্ড। সেই সঙ্গে তার সাহস ফিরে এল। নেকড়ে বাঘের মতন দ্রুত ছুটে পৌঁছে গেল গাড়ির কাছে।

অন্যরা তার জন্য অপেক্ষা করছিল গাড়ির মধ্যে। সিরাজুল গাড়িতে স্টার্ট দিয়েছেন। ব্রজগোপাল বললেন, সবাই এসেছে? চলো!

শংকরবাবু ব্যাকুল ভাবে বলে উঠলেন, যোগানন্দ? যোগানন্দ কোথায়? অমর, তুমি তাকে দেখেছ?

সূর্য বলল, না তো!

যোগানন্দ এখনও এসে পৌঁছোল না!

সে তো এ রকম ভুল করে না!

কিছু কিছু লোকজন হইহই করে এ-দিকে ছুটে আসছে মনে হল। ব্রজগোপাল পিস্তল নিয়ে প্রস্তুত হয়ে বললেন, আমি হুকুম দিলে সবাই একসঙ্গে গুলি চালাবে!

সিরাজুল বললেন, দাদা, এত লোকের সঙ্গে কনফ্রন্টেশান করা কি ঠিক হবে!

যোগানন্দের জন্য অপেক্ষা করা হবে না তা হলে?

আপনি বলেছিলেন, কেউ কারওর জন্য অপেক্ষা করবে না।

সবার তাই মত?

আর কেউ কোনও সাড়াশব্দ করলে না। ব্রজগোপাল বললেন, ওরা কাছে এসে পড়ছে। তা হলে চলো!

দড়াম করে একটা ইট এসে পড়ল গাড়ির ওপরে। গাড়ি একটু ঝাঁকুনি খেয়েই হুস করে বেরিয়ে গেল।

মিনিট পাঁচেক পরে গাড়ি বড় রাস্তায় পড়ে যখন নিশ্চিন্তে ছুটছে তখন শংকরবাবু যেন হঠাৎ শারীরিক আঘাত পেয়ে চেঁচিয়ে উঠলেন, সর্বনাশ!

ব্রজগোপাল ব্যাকুল ভাবে জিজ্ঞেস করলেন, কী হল! আপনারা কেউ একটা ব্যাপার খেয়াল করেননি? গয়নার থলেটা যোগানন্দর কাছে! আঁ?

গয়না টাকাপয়সা, আজকের সবকিছুই তো ওর কাছে!

যোগানন্দই এ বাড়ির সন্ধান দিয়েছিল। সে আটকে পড়বে?

আচমকা গাড়ি ব্রেক কষে থমকে গেল। আজকের রাত্তিরের সবকিছুই পণ্ডশ্রম–এই উপলব্ধি ওদের অসাড় করে দেয়। অথচ আর ফিরে যাওয়াও যায় না।

যোগানন্দ সে-দিন ধরা পড়েনি। আর কোনও দিন ফিরেও আসেনি ওদের কাছে।

সকল অধ্যায়

১. ০১. মাঝে মাঝে মনে হয়
২. ০২. অমরনাথ যখন বাদলকে নিয়ে
৩. ০৩. ভালো করে ভেবে দেখতে গেলে
৪. ০৪. ফুলবাড়ি নামের জায়গাটি
৫. ০৫. বয়স মানুষ খুব দ্রুত হারিয়ে ফেলে
৬. ০৬. রেণুদের বাড়ি গ্রে স্ট্রিটে
৭. ০৭. চিররঞ্জন হেরে যাওয়া মানুষ
৮. ০৮. সূর্যকুমার বছরে একবার কলকাতায়
৯. ০৯. সূর্য পড়াশুনোতে ভালোই ছিল
১০. ১০. চিত্তরঞ্জন দাশের মৃত্যুর পর
১১. ১১. দলের নেতার নাম হরকুমার
১২. ১২. গরমের ছুটিতে বিষ্ণু
১৩. ১৩. সকালবেলা খবরের কাগজ
১৪. ১৪. রসময় চক্রবর্তীর বাড়িতে
১৫. ১৫. ওদিকে সূর্যদা
১৬. ১৬. মন্দাকিনী খবর পাঠিয়েছেন
১৭. ১৭. এক একটা দিন এমন চমৎকার
১৮. ১৮. সূর্য ঘন্টাখানেক ধরে রাস্তায়
১৯. ১৯. শ্রীলেখার সঙ্গে যে সূর্যর মেলামেশা
২০. ২০. হাওড়া স্টেশনে সূর্যর সঙ্গে
২১. ২১. মাঠের মধ্যে একটা মোটরগাড়ি
২২. ২২. ন্যায়-অন্যায়ের যে সূক্ষ্ম সীমারেখা
২৩. ২৩. ফিটন থেকে একজন
২৪. ২৪. সূর্য প্রকাশ্যে জানিয়ে দিল
২৫. ২৫. একজন জটাজুটধারী সন্ন্যাসী
২৬. ২৬. যদু পণ্ডিতের পাঠশালা
২৭. ২৭. বড়দির বিয়ের দিন
২৮. ২৮. দ্বিতীয় মহাযুদ্ধের প্রথম দু-তিনটি বছর
২৯. ২৯. জাপানিরা আসছে
৩০. ৩০. ট্রেনে চেপে খুলনা
৩১. ৩১. নৌকো থেকে যেখানে নামা হল
৩২. ৩২. ব্রজগোপাল সূর্যকে নিয়ে নামলেন
৩৩. ৩৩. সূর্যকে শুতে দেওয়া হয়েছিল
৩৪. ৩৪. তমোনাশ ডাক্তার একে একে
৩৫. ৩৫. এই এলাকায় তমোনাশ
৩৬. ৩৬. নীচের তলায় খুটখাট
৩৭. ৩৭. বিয়ের পর শ্রীলেখা
৩৮. ৩৮. মুর্শিদের চরে কয়েক দিন
৩৯. ৩৯. দূর থেকে আসছে একটা মিছিল
৪০. ৪০. সূর্য চলে যাবার পর
৪১. ৪১. সরকারি হিসেব মতনই
৪২. ৪২. যারা লম্বা তালগাছের ওপরে
৪৩. ৪৩. যদিও শ্রীলেখা সব সময়ই
৪৪. ৪৪. প্রভাসকুমারদের পরিবারটি
৪৫. ৪৫. সেবারের দূর্গাপূজোর
৪৬. ৪৬. যে-কোনও কারণেই হোক
৪৭. ৪৭. শ্রীলেখার সঙ্গে সান্ত্বনার
৪৮. ৪৮. মেদিনীপুর সেন্ট্রাল জেলের গেট
৪৯. ৪৯. চিররঞ্জন শিয়ালদা স্টেশনে এসে
৫০. ৫০. কাছাকাছি মানুষের প্রভাব
৫১. ৫১. বেয়াল্লিশ সালের গোড়ায়
৫২. ৫২. আমরা অনেক মৃত্যু দেখেছি
৫৩. ৫৩. সকালবেলা ঘণ্টাখানেকের জন্য
৫৪. ৫৪. স্কুল ছাড়ার আগে
৫৫. ৫৫. যদিও সুর্যর যাবজ্জীবন কারাদণ্ড
৫৬. ৫৬. দু-এক দিনের মধ্যেই সূর্য
৫৭. ৫৭. সেই সময় একটা কথা
৫৮. ৫৮. আমাদের বাড়ির বাজার করার ভার
৫৯. ৫৯. জুন মাসের তিন তারিখে
৬০. ৬০. ও-বাড়িতে আমার টিউশানি
৬১. ৬১. কলেজের সোস্যাল ফাংশান
৬২. ৬২. পর পর অনেকগুলো ট্রাম
৬৩. ৬৩. বাদল বাইরের ঘরে
৬৪. ৬৪. দুদিনের মধ্যে সান্ত্বনা
৬৫. ৬৫. সূর্য আর বাদল
৬৬. ৬৬. হিরোসিমাতে যে-দিন অ্যাটম বোমা
৬৭. ৬৭. কাটিহারে গিয়ে দীপ্তিদির বাড়ি
৬৮. ৬৮. সূর্যর চালচলন ক্রমশ
৬৯. ৬৯. রেণুর একটা নিজস্ব জগৎ
৭০. ৭০. হিমানীর বাবা-মা এবং দাদারা
৭১. ৭১. সূর্য অনেকটা উদ্দেশ্যহীন
৭২. ৭২. এলাহাবাদের সেই বাঙালি ছেলেগুলি
৭৩. ৭৩. যুবকটি সূর্যর চেয়ে
৭৪. ৭৪. অনেক দিন বাদে সূর্যকে
৭৫. ৭৫. রেণুর কাছ থেকে অনুমতি
৭৬. ৭৬. কলকাতায় ফিরেই শুনলাম
৭৭. ৭৭. কিছুক্ষণ ছোটার পর
৭৮. ৭৮. বুলবুল চেয়েছিল সূর্যকে নিয়ে
৭৯. ৭৯. ভারতের যে-কোনও শহরেই
৮০. ৮০. বাবাকে উত্তেজিত এবং খুশি দেখা গেল
৮১. ৮১. জাহাজ ছাড়বে কোচিন থেকে
৮২. ৮২. মহীশূরে সুব্রতদাদের বাড়িতে
৮৩. ৮৩. সূর্য কলকাতায় এসে পৌঁছোল
৮৪. ৮৪. রেণু এল পরদিন সকালবেলা
৮৫. ৮৫. বরানগর-আলমবাজারের দিকে
৮৬. ৮৬. গা ছুঁয়ে প্রতিজ্ঞা
৮৭. ৮৭. কৃষ্ণনগর শহরের রাস্তা
৮৮. ৮৮. পাহাড়ে দ্রুত উঠতে নেই

নোট নিতে এবং টেক্সট হাইলাইট করতে লগইন করুন

লগইন