৩৬. নীচের তলায় খুটখাট

সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়

নীচের তলায় খুটখাট করে আওয়াজ হচ্ছে, বড়বাবু তিনতলা থেকে চেঁচিয়ে ডাকলেন, রতন, রতন?

কেউ কোনও সাড়া দিল না। গোটা বাড়িটা অন্ধকার। আলো জ্বালার উপায় নেই, বড়বাবু একটা টর্চ নিয়ে নেমে এলেন নীচে। বাড়িতে আর একটিও জনমনুষ্য নেই, পর পর ঘরগুলো তালাবন্ধ। রতনই একমাত্র সঙ্গী, ঠাকুর ও চাকরের কাজ করে– সে-ছোকরারও মাঝে মাঝে বাইরে রাত কাটানোর স্বভাব আছে। কোথায় নাকি সে যাত্রা শুনতে যায়–এই ব্ল্যাক আউটের মধ্যেও কোথায় যাত্রা হয় কে জানে। বড়বাবু দু’-এক বার ধমক দেওয়ায় সে এখন না বলেই যেতে শুরু করেছে। ছাড়িয়েও দেওয়া যায় না– এখন লোক পাওয়া বড় মুশকিল।

বড়বাবু একতলার ঘরগুলো ভাড়া দিয়েছেন সিভিল সাপ্লাই দপ্তরকে। রাত্রে ওদের কেউ থাকে না। বড়বাবু নীচে এসে দেখলেন, সদর দরজাটা ভেজানো–তালা খুলে বেরিয়ে গেছে রতন। এ রকম ভাবে এত রাত্রে দরজা খুলে রাখা যায় না চোর-ডাকাতের উপদ্রব ইদানীং খুব বেড়েছে। রতন বাইরেই থাক–তিনি দরজা বন্ধ করে দিলেন।

এত বড় বাড়িতে আর দ্বিতীয় মানুষ নেই–অদ্ভুত রকমের নিস্তব্ধ বড়বাবু নিজেই নিজের পায়ের আওয়াজ শুনতে পাচ্ছেন। দোতলার খুটখাট শব্দটা এখন থেমেছে–তবু একবার দেখা দরকার। মাত্র কয়েক মাস আগেও এ-বাড়ি লোকজনে ভরা ছিল, এই সময়টা আড্ডা হত খাবার ঘরে। এখন গোটা কলকাতাটাকেই মৃত শহর বলে মনে হয়।

চাবির তোড়া নিয়ে বড়বাবু একটার পর একটা ঘর খুলে দেখতে লাগলেন। এটাই ছিল প্রিয়রঞ্জনের ঘর–এখন সম্পূর্ণ খালি, কোনও আসবাবও নেই। চিররঞ্জনের ঘরে তবু কিছু কিছু জিনিসপত্র রয়ে গেছে। দেওয়ালে ঝুলছে বাদলের ঘুড়ি আর লাটাই। এগুলো সঙ্গে নেবার জন্য ছেলেটা অনেক কান্নাকাটি করেছিল, কিন্তু মালপত্র বেশি হয়ে যাওয়ায় তাকে নিতে দেওয়া হয়নি। জানলা-দরজা অনেক দিন বন্ধ বলে ঘরের হাওয়ায় একটা গুমোট গন্ধ। মেঝেতে ধুলো জমেছে, তার ওপর সরু সরু দাগ। বড় বড় ইঁদুরের উপদ্রব হয়েছে খুব। তারাই শব্দ করেফাঁকা বাড়িতে সামান্য শব্দও অনেক বেশি মনে হয়। টর্চের আলো ফেলে ফেলে বড়বাবু প্রত্যেকটা কোনা ঘুপচিও খুঁজে খুঁজে দেখলেন।

সূর্যর ঘরে তার জিনিসপত্র সবই ঠিকঠাক রয়েছে, তার বিছানা, তার বইখাতা, আলনায় ঝুলছে জামা-প্যান্ট–ছেলেটা প্রায় কিছুই সঙ্গে নিয়ে যায়নি। এত অল্প বয়সেই ছেলেটার এত অনাসক্তি। বড়বাবুর আজকাল প্রায়ই মনে হয়, সূর্যর সঙ্গে তার আর দেখা হবে না। আগে তিনি ছেলের কথা বিশেষ ভাবতেন না–গত কয়েক মাস ধরে বড্ড মায়া পড়ে গেছে–ওই বয়সে এসে ছেলেটা খুব উদভ্রান্ত, বড়বাবু নিজেও ঠিক ওই রকম ছিলেন।

একসময় বাড়িটা গমগম করত, এখন সবাই চলে গেছে। বড়বাবুর কোথাও যাবার নেই। জীবনটা যদি ফাঁকা হয়ে যায় তা হলে যেখানেই যাও, সবই তো এক রকম।

কোনও ঘরেই কিছু নেই, সুতরাং ইঁদুরেই শব্দ করছে এই সিদ্ধান্ত নিয়ে বড়বাবু ঘরগুলোর দরজায় আবার তালা লাগিয়ে উঠে এলেন ওপরে। খানিকটা পরেই আবার শুনতে পেলেন সেই রকম খুটখাট খুটখাট আওয়াজ–ইঁদুর বা বেড়ালের চেয়েও বেশি সবল কোনও প্রাণীর উপস্থিতির মতন। বড়বাবু খানিকক্ষণ কান খাড়া করে শুনলেন, কিন্তু গ্রাহ্য করলেন না। ফঁকা বাড়িতে এ রকম অনেক শব্দই হয়–হয়তো ভূত-প্রেতই আসে, আসুক, আর তো কিছু করছে না তারা।

এতগুলো ঘর খালি থাকা সত্ত্বেও বড়বাবু তিনতলায় নিজস্ব ঘরটা ছাড়েননি। রতন কখনও সারা রাত বাইরে থাকলে তিনি নিজেই ভোরবেলা এখানে স্পিরিট ল্যাম্প জ্বেলে চা তৈরি করে নেন। বয়স বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে ঘুম কমে গেছে। অনেক রাত না হলে ঘুম আসতে চায় না–আবার ঘুম ভেঙে যায় খুব ভোরে। বড়বাবু বালিশে আধো-হেলান দিয়ে বই খুলে বসলেন। ঘরের সমস্ত জানলা বন্ধ, আলোয় ঠুলি পরানো সামান্য আলোর রশ্মি বাইরে গেলেই এ আর পি’র ছেলেরা হুইল দেয়, চঁচামেচি করে। হাতিবাগানের পর খিদিরপুরে আর একবার এলোপাথাড়ি বোমা ফেলে জাপানিরা চুপ। করে গেছে।

বড়বাবুর সময় আর কাটতেই চায় না। সারা দিনটা এখন প্রায় তিনি বাগবাজারের অনাথ আশ্রমেই কাটান। তত্ত্বাবধায়করা অনেকেই পালিয়েছে–ছেলেগুলোর খুবই দুরবস্থা। যুদ্ধের বাজারে অজস্র চাকরি, বড়বাবু কিছু কিছু ছেলেকে চাকরির ব্যবস্থা করে দিচ্ছেন। সন্ধ্যার পর তাকে বাড়ি ফিরে আসতেই হয়–এমনিতেই তিনি একটু রাতকানা, এখন এই অন্ধকারের মধ্যেই একা একা রাস্তায় হাঁটা তার পক্ষে অসম্ভব। তারপর সন্ধ্যা থেকে মধ্য রাত পর্যন্ত এত বড় ফাঁকা বাড়িতে তাকে একা থাকতে হয়। একে একে সবাই যখন চলে যাচ্ছে–তখন এত বড় বাড়ির আর দরকার কী-যুদ্ধ থেমে গেলে তিনি এ-বাড়ি বিক্রি করে দেবেন। এখন এ বাড়ি কেনার খদ্দের নেই।

একসময় বিরক্ত হয়ে বড়বাবু হাতের বইখানা ছুঁড়ে ফেলে দিলেন। এত কম আলোয় তার পড়তে অসুবিধে হচ্ছে–তা ছাড়া মায়া ও ইনকাদের সভ্যতা বিষয়ক যে বইটি তিনি পড়ছিলেন, তার লেখক ইনিয়েবিনিয়ে বার বার প্যাগানদের সঙ্গে ক্রিশ্চিয়ানিটির তুলনা না করে পারছেন না।

আলো নিবিয়ে বড়বাবু বেরিয়ে এলেন ছাদে। গতকাল পূর্ণিমা ছিল, আজও জ্যোৎস্নায় ভেসে যাচ্ছে আকাশ। ব্ল্যাক আউটের উদ্দেশ্য অনেকটা ব্যর্থ করে দিচ্ছে। বড়বাবু কিছুক্ষণ পায়চারি করলেন অন্যমনস্ক ভাবে, তারপর ছাদের এক কোণে এসে থেমে গেলেন। কার্নিশ থেকে একটা অশখের চারা উঠেছে। কিছু দিন আগে একবার এখান থেকে একটা অশথ গাছ কেটে দিয়েছিলেন কিন্তু এই গাছ বড় জেদি আবার উঠেছে মাথা ফুড়ে। বাড়িটা এমন কিছু পুরনো নয়–তবু কি এবা টের পেয়ে গেছে যে এটার পোড়ো বাড়ির দশা হতে আর দেরি নেই!বড়বাবু হাত দিয়ে টেনে অশত্থ গাছটাকে উপড়ে ফেলার চেষ্টা করলেন। পারলেন না। বয়স অনেক হল, এখন আর হাতে তেমন জোর পান না–তা ছাড়া এ-গাছগুলোর শিকড়ে সাঙ্ঘাতিক জোর।

বয়স অনেক হল, এবার কোনও একদিন পৃথিবী ছেড়ে চলে যেতে হবে। যেতে হবেই, মায়া বাড়িয়ে তো আর লাভ নেই। দুঃখ করারও কিছু নেই তাতে। অনেকগুলো বছর তো কাটল। জন্মরাত্রেই যে-ছেলের মা মারা যায়, সেই ছেলের তো বেঁচে থাকার কথা ছিল না। তার বদলে সে পেয়েছে বিশাল একখানা জীবন এবং অনেক কিছু। বড়বাবুর মনে হল এই রকম কোনও রাত্রে যদি তিনি হঠাৎ খুব অসুস্থ হয়ে পড়েন–তা হলে কী হবে? দেখবার কেউ নেই, মরতে হবে একা একা। সদর দরজা বন্ধ, রতন ঢুকতে পারবে না। তার মৃতদেহটা পড়ে থাকবে–পিঁপড়ে ঘুরে বেড়াবে তাঁর চোখে, ইঁদুর-আরশোলারা তার শরীর কুরে কুরে খাবে। শেষ পর্যন্ত সিভিল সাপ্লাই অফিসের লোকেরা যদি কোর্টের ইনজাংকশন নিয়ে দরজা খুলে ঢোকে। এই চিন্তায় বড়বাবু মোটেই ভয় পেলেন না বরং একটু মুচকি হাসলেন। হাসপাতালে গিয়ে ভুগে ভুগে মরার চেয়ে, তিনি তাঁর মৃত্যুটাকে একটু নাটকীয় করে দেখতে চাইছেন।

আকস্মিক ভাবে বুলবুলের মৃতদেহটা ভেসে উঠল তার চোখের সামনে। বুলবুল, যার পোশাকি নাম ছিল নাসিম আরা বানু, সূর্যর মা। বুলবুল বিষ খেয়ে আত্মহত্যা করেছিল। মৃত্যুর পরও বুলবুলের চেহারা একটুও বদলায়নি। ঘুমের থেকেও প্রগাঢ় মৃত্যু তার রূপকে যেন একটা মহিমা দিয়েছিল। অসহ্য সুন্দর ছিল বুলবুল, এ যেন ঘঁচে গড়া মানুষ নয়–আলাদা কোনও শিল্পীর বহু যত্নের সৃষ্টি। মৃত বুলবুলকে দেখে মনে হচ্ছিল ঠিক যেন গল্পের সেই স্নো হোয়াইটের মতন, কোনও রাজকুমারের স্পর্শে আবার জেগে উঠবে। অমরনাথ তাকে আর জাগাতে পারেননি। বুলবুলের হাত ধরে বার বার ঝাঁকানি দিতে দিতে জিজ্ঞেস করেছিলেন, বুলবুল, এ কী করলে, এ কী করলে!

কোনও উত্তর দেয়নি বুলবুল, তার মৃত্যুর কোনও কারণ রেখে যায়নি। বুলবুলের মৃত্যুতেও কাঁদতে পারেননি অমরনাথ, কান্নার চেয়েও আরও বেশি কিছু জমে ছিল বুকের মধ্যে, তাই বুকে অসহ্য ব্যথা। সেই অসহ্য ব্যথায় বার বার অজ্ঞান হয়ে পড়েছিলেন, কিন্তু চোখ দিয়ে এক ফোঁটা জুল পড়েনি। সূর্যর তখন তিন বছর বয়স, মায়ের মৃত্যু সম্পর্কে তার কোনও বোধই হল না।

পূর্ণিমাকে ছেড়ে বুলবুলকে ভালোবেসে হয়তো সামাজিক ভাবে একটা অপরাধ করে ছিলেন অমরনাথ কিন্তু এ ছাড়া তার উপায় ছিল না। বাল্যকাল থেকেই তিনি পরের ঘরে মানুষ, পরের দয়ায় স্নেহে প্রতিপালিত হয়েছেন নিজের রক্তের সম্পর্কের কারোকে দেখেননি কখনও। তবু তিনি হেরে যাননি, মিশে যাননি সাধারণ ম্যাটমেটে মানুষের ভিড়ে। প্রথম যৌবনে পূর্ণিমাকে ভালো লেগেছিল, সমাজকে তুচ্ছ করে বিয়ে করেছিলেন পূর্ণিমাকে। তিনি বুঝেছিলেন, আধুনিক মানুষের সমাজ অর্থের কাছে। নতজানু। সুতরাং তার অর্থ চাই। প্রথম থেকেই চাকরিবাকরির জন্য লালায়িত না হয়ে ব্যবসায় মন দিয়েছিলেন। একসময় উপার্জন করেছেন অগাধ অর্থ–অমনি সমাজ তাকে। মাথায় তুলে নাচতে চেয়েছে। কেউ তার পূর্ব পরিচয় সম্পর্কে প্রশ্ন করেনি। বরং উপযাচক হয়ে এসেছে ক্লাবের সভাপতি করতে, শ্রাদ্ধ-বিবাহের অনুষ্ঠানে তার জন্য বিশেষ শ্রদ্ধার আসন।

তবু অমরনাথের মনে হয়েছিল, এরপর কী? মানুষের আর কি কিছু পাওয়ার নেই? তৃপ্তি পাননি কখনও অমরনাথ। পূর্ণিমাও আর তাকে ঠিক সঙ্গ দিতে পারছিল না। প্রথম যৌবনে পূর্ণিমার মনটা ছিল খুব কল্পনাপ্রবণ, অমরনাথকে ঘিরে তার অনেক স্বপ্ন ছিল। কিন্তু অমরনাথের যত অর্থ প্রতিপত্তি বাড়তে লাগল–ততই সেই মোহে জড়িয়ে পড়ল পূর্ণিমা। বাল্য বয়সে বিধবা হয়ে অনেক লাঞ্ছনা গঞ্জনা সহ্য করেছে পূর্ণিমা তাই সামাজিক সম্মান পাবার জন্য একটা কাঙালপনা ছিল তার মধ্যে। একসময় পূর্ণিমা ঘোট ছোট কবিতা রচনা করত–সেসব ছেড়েছুঁড়ে উৎসব নেমন্তন্নে এক-গা গয়না পরে যাওয়াই তার কাছে বেশি গর্বের ছিল। অমরনাথ পূর্ণিমার এই ছেলেখেলা দেখে তাকে রাশি রাশি গয়না দিয়েছেন, দেখতে চেয়েছেন শেষ পর্যন্ত আশা মেটে কি না। মেটেনি।

পূর্ণিমার আর একটা দুঃখ ছিল সন্তান সম্পর্কে। একবার একটি মেয়ে হয়ে মারা যায়। আর কোনও সন্তান হয়নি। অমরনাথ ব্যাপারটা স্বাভাবিক ভাবে মেনে নিতে বলেছিলেন, পারেনি পূর্ণিমা! পূর্ণিমার সেই দুঃখ ক্রমশ অস্বাস্থ্যকর হয়ে উঠল–অমরনাথ সরে গেলেন তার কাছ থেকে।

তারপর কিছু দিন সাধুসন্ন্যাসীর সঙ্গ করলেন অমরনাথ। নকল সাধু ছেড়ে খুঁজে বেড়িয়েছেন আসল সাধু। সবাই তাকে বলেছেন, অত প্রশ্ন কোরো না, মেনে নাও। মেনে নেওয়াতেই শান্তি। কিন্তু অমরনাথের প্রশ্ন থামেনি। একসময় বিরক্ত হয়ে ওদের পরিত্যাগ করলেন। গানবাজনার চর্চা করতেন ছেলেবেলা থেকেই, কিছু দিন তাতেই মেতে উঠলেন আবার। সেই সূত্রে বুলবুলের সঙ্গে দেখা।

বুলবুলকে যখন তিনি প্রথম দেখেন, তাঁর মনে হয়েছিল মানুষ নয়, একটা পুতুল। প্রথম প্রথম বেশি আকৃষ্ট হননি তার দিকে, বরং তার নাচের লয়ে কোথাও কোথাও ভুল হলে তিনি বিরক্তি প্রকাশ করেছেন। বড়লোকের অশিক্ষিত ছেলেরাই বেশি মাতামাতি করত বুলবুলকে নিয়ে এবং সেই সব হইহল্লাই বেশি ভালোবাসত বুলবুল। একদিন কী কারণে যেন বুলবুলের মনখারাপ ছিল, তার সেই বিষণ্ণ মুখখানা দেখে অমরনাথ যেন একটা ধাক্কা খেলেন। বুলবুলকে এ রকম অবস্থায় কখনও দেখা যেত না–তাই বোঝা যায়নি, বিষণ্ণ হলে তাকে কত সুন্দর দেখায়। অমরনাথের মনে হয়েছিল, যেন রূপের ঝাঁপটা এসে লাগছে তাঁর গায়। তিনি টের পেলেন, রূপেরও একটা পরিশুদ্ধ করার ক্ষমতা আছে। রূপের সামনে এসে সব সময় যে শুধু রক্ত জ্বলে ওঠে তাই নয়, অনেক সময় মনটা অনেক শান্ত হয়ে যায়, অনুভূতি অনেক সূক্ষ্ম হয়। এই রূপকে নিজের হাতে পাবার একটা তীব্র ইচ্ছে, কারওর কারওর ক্ষেত্রে নিজেকে মানুষ হিসেবে মহত্তর করে তোলার বাসনাও জাগায়। দুবৃত্তরা চায় রূপ কেড়ে নিতে কেউ কেউ চায় তা পাওয়ার যোগ্য হয়ে উঠতে–যে-যোগ্যতার কোনও মাপকাঠি নেই। অমরনাথ মনস্থির করে ফেললেন।

পূর্ণিমাকে তিনি খোলাখুলিই বলেছিলেন সব। এ-প্রস্তাবও দিয়েছিলেন যে, পূর্ণিমা ইচ্ছে করলে বাপেরবাড়ি গিয়ে থাকতে পারে তাকে তিনি বিষয়সম্পত্তির একটা বড় অংশ দিয়ে দেবেন। পূর্ণিমা রাজি হয়নি। একবার বিধবা ছিল, দ্বিতীয়বার স্বামী-পরিত্যক্তা হতে চায়নি–অন্তঃসারশূন্য সম্পর্ক নিয়েও বাইরের ঠাট বজায় রাখতে চেয়েছিল।

ইয়ারবকশিদের হাত থেকে বুলবুলকে ছাড়িয়ে নিতে কম হাঙ্গামা পোয়াতে হয়নি অমরনাথকে। সেই কারণেই তাকে এলাহাবাদের বাস তুলে দিয়ে গোয়ালিয়ারে চলে আসতে হয়। কাছাকাছি পাবার পর দেখা গেল, বুলবুল অত্যন্ত জেদি আর অভিমানী, ভেতরটা তার শিশুর মতন অপরিণত। অমরনাথকে পেয়ে সে আর সবকিছু ছাড়ল, নাচের মুজরো নেবার বদলে সে বুঝতে পারল তাকে আরও শিখতে হবে। শেখার শেষ নেই। নিছক নর্তকীর বদলে সে শিল্পী হয়ে উঠল আস্তে আস্তে।

পূর্ণিমা কোনও দিন বুলবুলের মুখ দর্শন করতে চায়নি, কিন্তু বুলবুলের সন্তান হবার পর পূর্ণিমা নিজে থেকে তার বাড়িতে গিয়েছিল ছেলের মুখ দেখতে। তাতে বুলবুল একেবারে অভিভূত হয়ে পড়ে। পূর্ণিমা কেনই বা নিজে থেকে গেল, কেনই বা বুলবুল তাতে এত অভিভূত–এটা বুঝতে পারেননি অমরনাথ। সন্তানের ব্যাপারে মেয়েদের মনের এই জটিল গতি কোনও দিন তার পক্ষে বোঝা সম্ভব হয়নি। এরপর থেকেই বুলবুল অনেক বদলে গেল–তার সঙ্গে এমন ভাব হয়ে গেল যে, যেন অমরনাথ আর কেউ না। তার সঙ্গে কথা বলারও সময় নেই।

এরপর বুলবুল আবার জেদ ধরল যে অমরনাথ শুধু পূর্ণিমাকে নিয়েই থাকুক, সে অন্য কোথাও চলে যাবে। পূর্ণিমার প্রতি অবিচার করা হচ্ছে–এতে তার পাপ হবে। অমরনাথ কিছুতেই বোঝাতে পারলেন না, এককথায় এ রকম ফেরা যায় না। তা ছাড়া, তিনি স্বার্থপর–নিজের ভালো লাগা মন্দ লাগার মূল্যই তাঁর কাছে সবচেয়ে বেশি। বুলবুল তখন ইচ্ছে করে অমরনাথকে আঘাত দেবার জন্য বাড়িতে আসর বসাতে শুরু করল–রাজপরিবার থেকে তার ডাক আসায় সে অমরনাথের কথা অগ্রাহ্য করে সগর্বে চলে গেল সেখানে নাচতে। অমরনাথ প্রত্যেক দিন তার কাছে যান, বুলবুল তাকে ফিরিয়ে দেয়। নারীর মন বড় বিচিত্র–এ বোঝা সহজ কাণ্ড নয়, অমরনাথ বুঝতে পারলেন না বুলবুলকে। একদিন তিনি সত্যিই বুলবুলের কাছে যাওয়া বন্ধ করলেন, মনস্থির করে ফেললেন যে, এবার বুলবুলকে ভুলে যেতে হবে। আর পাঁচজনের সঙ্গে এক আসরে বসে বুলবুলের নাচ দেখা তার পক্ষে সম্ভব নয়।

এত করে নিজেকে দূরে সরিয়ে নিতে চাইছিল বুলবুল, কিন্তু সত্যিই যে-দিন দেখল অমরনাথ তাকে ছেড়েছে, সে-দিন খুব খানিকটা কাঁদল তারপর ছেলেকে পূর্ণিমার কাছে পাঠিয়ে দিয়ে নিজে বিষ খেল। যেন একটা ছেলেখেলা। যেন বিষের নাম অভিমান, কেউ এসে তার মান ভাঙাবে। কবরখানার অন্ধকার গহ্বরে চলে গেল বুলবুল।

বড়বাবু সেই নিস্তব্ধ বাড়ির ছাদে দাঁড়িয়ে আকাশের দিকে তাকালেন। যেন এই মৃতের শহরে তিনি একা জেগে আছেন। সারা জীবন তিনি মানুষের সঙ্গ চেয়েছিলেন, ঈশ্বরকে চেয়ে নিরালা হয়ে যাননি–তবু সবাই একে একে তাকে ছেড়ে চলে গেল। আকাশের দিকে তাকিয়ে তিনি মনে মনে বললেন–একটা জীবন কেটে গেল, তবু আমি মানুষের। জীবনের মর্ম কী তা বুঝতে পারলাম না। সত্যিই কি কোনও মর্ম আছে, না কোনওক্রমে দিন কাটিয়ে যাওয়াই সব?

সকল অধ্যায়

১. ০১. মাঝে মাঝে মনে হয়
২. ০২. অমরনাথ যখন বাদলকে নিয়ে
৩. ০৩. ভালো করে ভেবে দেখতে গেলে
৪. ০৪. ফুলবাড়ি নামের জায়গাটি
৫. ০৫. বয়স মানুষ খুব দ্রুত হারিয়ে ফেলে
৬. ০৬. রেণুদের বাড়ি গ্রে স্ট্রিটে
৭. ০৭. চিররঞ্জন হেরে যাওয়া মানুষ
৮. ০৮. সূর্যকুমার বছরে একবার কলকাতায়
৯. ০৯. সূর্য পড়াশুনোতে ভালোই ছিল
১০. ১০. চিত্তরঞ্জন দাশের মৃত্যুর পর
১১. ১১. দলের নেতার নাম হরকুমার
১২. ১২. গরমের ছুটিতে বিষ্ণু
১৩. ১৩. সকালবেলা খবরের কাগজ
১৪. ১৪. রসময় চক্রবর্তীর বাড়িতে
১৫. ১৫. ওদিকে সূর্যদা
১৬. ১৬. মন্দাকিনী খবর পাঠিয়েছেন
১৭. ১৭. এক একটা দিন এমন চমৎকার
১৮. ১৮. সূর্য ঘন্টাখানেক ধরে রাস্তায়
১৯. ১৯. শ্রীলেখার সঙ্গে যে সূর্যর মেলামেশা
২০. ২০. হাওড়া স্টেশনে সূর্যর সঙ্গে
২১. ২১. মাঠের মধ্যে একটা মোটরগাড়ি
২২. ২২. ন্যায়-অন্যায়ের যে সূক্ষ্ম সীমারেখা
২৩. ২৩. ফিটন থেকে একজন
২৪. ২৪. সূর্য প্রকাশ্যে জানিয়ে দিল
২৫. ২৫. একজন জটাজুটধারী সন্ন্যাসী
২৬. ২৬. যদু পণ্ডিতের পাঠশালা
২৭. ২৭. বড়দির বিয়ের দিন
২৮. ২৮. দ্বিতীয় মহাযুদ্ধের প্রথম দু-তিনটি বছর
২৯. ২৯. জাপানিরা আসছে
৩০. ৩০. ট্রেনে চেপে খুলনা
৩১. ৩১. নৌকো থেকে যেখানে নামা হল
৩২. ৩২. ব্রজগোপাল সূর্যকে নিয়ে নামলেন
৩৩. ৩৩. সূর্যকে শুতে দেওয়া হয়েছিল
৩৪. ৩৪. তমোনাশ ডাক্তার একে একে
৩৫. ৩৫. এই এলাকায় তমোনাশ
৩৬. ৩৬. নীচের তলায় খুটখাট
৩৭. ৩৭. বিয়ের পর শ্রীলেখা
৩৮. ৩৮. মুর্শিদের চরে কয়েক দিন
৩৯. ৩৯. দূর থেকে আসছে একটা মিছিল
৪০. ৪০. সূর্য চলে যাবার পর
৪১. ৪১. সরকারি হিসেব মতনই
৪২. ৪২. যারা লম্বা তালগাছের ওপরে
৪৩. ৪৩. যদিও শ্রীলেখা সব সময়ই
৪৪. ৪৪. প্রভাসকুমারদের পরিবারটি
৪৫. ৪৫. সেবারের দূর্গাপূজোর
৪৬. ৪৬. যে-কোনও কারণেই হোক
৪৭. ৪৭. শ্রীলেখার সঙ্গে সান্ত্বনার
৪৮. ৪৮. মেদিনীপুর সেন্ট্রাল জেলের গেট
৪৯. ৪৯. চিররঞ্জন শিয়ালদা স্টেশনে এসে
৫০. ৫০. কাছাকাছি মানুষের প্রভাব
৫১. ৫১. বেয়াল্লিশ সালের গোড়ায়
৫২. ৫২. আমরা অনেক মৃত্যু দেখেছি
৫৩. ৫৩. সকালবেলা ঘণ্টাখানেকের জন্য
৫৪. ৫৪. স্কুল ছাড়ার আগে
৫৫. ৫৫. যদিও সুর্যর যাবজ্জীবন কারাদণ্ড
৫৬. ৫৬. দু-এক দিনের মধ্যেই সূর্য
৫৭. ৫৭. সেই সময় একটা কথা
৫৮. ৫৮. আমাদের বাড়ির বাজার করার ভার
৫৯. ৫৯. জুন মাসের তিন তারিখে
৬০. ৬০. ও-বাড়িতে আমার টিউশানি
৬১. ৬১. কলেজের সোস্যাল ফাংশান
৬২. ৬২. পর পর অনেকগুলো ট্রাম
৬৩. ৬৩. বাদল বাইরের ঘরে
৬৪. ৬৪. দুদিনের মধ্যে সান্ত্বনা
৬৫. ৬৫. সূর্য আর বাদল
৬৬. ৬৬. হিরোসিমাতে যে-দিন অ্যাটম বোমা
৬৭. ৬৭. কাটিহারে গিয়ে দীপ্তিদির বাড়ি
৬৮. ৬৮. সূর্যর চালচলন ক্রমশ
৬৯. ৬৯. রেণুর একটা নিজস্ব জগৎ
৭০. ৭০. হিমানীর বাবা-মা এবং দাদারা
৭১. ৭১. সূর্য অনেকটা উদ্দেশ্যহীন
৭২. ৭২. এলাহাবাদের সেই বাঙালি ছেলেগুলি
৭৩. ৭৩. যুবকটি সূর্যর চেয়ে
৭৪. ৭৪. অনেক দিন বাদে সূর্যকে
৭৫. ৭৫. রেণুর কাছ থেকে অনুমতি
৭৬. ৭৬. কলকাতায় ফিরেই শুনলাম
৭৭. ৭৭. কিছুক্ষণ ছোটার পর
৭৮. ৭৮. বুলবুল চেয়েছিল সূর্যকে নিয়ে
৭৯. ৭৯. ভারতের যে-কোনও শহরেই
৮০. ৮০. বাবাকে উত্তেজিত এবং খুশি দেখা গেল
৮১. ৮১. জাহাজ ছাড়বে কোচিন থেকে
৮২. ৮২. মহীশূরে সুব্রতদাদের বাড়িতে
৮৩. ৮৩. সূর্য কলকাতায় এসে পৌঁছোল
৮৪. ৮৪. রেণু এল পরদিন সকালবেলা
৮৫. ৮৫. বরানগর-আলমবাজারের দিকে
৮৬. ৮৬. গা ছুঁয়ে প্রতিজ্ঞা
৮৭. ৮৭. কৃষ্ণনগর শহরের রাস্তা
৮৮. ৮৮. পাহাড়ে দ্রুত উঠতে নেই

নোট নিতে এবং টেক্সট হাইলাইট করতে লগইন করুন

লগইন