উইলিয়াম পিয়ার্সন

রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর

ভারতবর্ষে ফিরিবার ঠিক পূর্বে ইটালিতে ভ্রমণকালে শ্রীযুক্ত উইলিয়াম পিয়ার্সন মহাশয়ের আকস্মিক দুর্ঘটনায় মৃত্যুর খবর আমাদের নিকট পৌঁছিয়াছে। তাঁহার নাম জনসাধারণের নিকট বিস্তৃতভাবে পরিচিত না হইতে পারে, কিন্তু আমার স্থির বিশ্বাস যে তাঁহার মৃত্যুতে যে ক্ষতি হইল তাহা শুধু তাঁহার আত্মীয় এবং বন্ধুবান্ধবের মধ্যেই আবদ্ধ নহে। বিশ্বমানবের প্রতি ভালোবাসা তাঁহার কাছে যেরূপ সত্যকার সামগ্রী ছিল, সেবার আদর্শকে তিনি তাঁহার সহিত যেরূপ পূর্ণভাবে মিলাইতে পারিয়াছিলেন, খুব কম লোকেরই ভিতর আমরা তাহা দেখিয়াছি। যে-সকল অজ্ঞাত অখ্যাতনামা লোকের মধ্যে প্রতিবেশীদের দৃষ্টি আকর্ষণ করিবার মতোও কোনো বিশেষত্ব ছিল না, সম্পূর্ণ বিশ্বাসের সহিত স্বতঃপ্রবৃত্ত হইয়া তিনি তাহাদের নিজের সখ্য দান করিতে সর্বদাই প্রস্তুত ছিলেন, এবং এই দানের মধ্যে জ্ঞাতসারে বা অজ্ঞাতসারে অহংকার রিপুর সৎকর্মসাধনজনিত আত্মতৃপ্তিগত ভাববিলাসের কিছুমাত্র প্রভাব ছিল না। দুঃস্থ অভাবগ্রস্ত লোককে তিনি নিত্যনিয়ত যে-সাহায্য করিতেন তাহার জন্য তাঁহার সর্বসাধারণের প্রশংসা দ্বারা পুরস্কৃত হইবার কোনো সম্ভাবনা ছিল না, তাঁহার কাছে নিজের দৈনিককৃত্যের মতোই তাহা নিতান্ত সহজ এবং প্রচ্ছন্ন ছিল। তাঁহার দেশপ্রেম ছিল সর্বমানবের দেশের প্রতি, পৃথিবীর যে-কোনো দেশের লোকের উপর কিছুমাত্র অবিচার বা নিষ্ঠুর আচরণ ঘটিলে তিনি অন্তরের সহিত বেদনা অনুভব করিতেন, এবং মহৎভাবে অনুপ্রাণিত হইয়া তাহাদের সাহায্যে প্রবৃত্ত হওয়ার জন্য তিনি নির্ভীকচিত্তে আপন দেশবাসীর নিকট শাস্তি বরণ করিয়া লইয়াছেন। শান্তিনিকেতন আশ্রমকে তিনি আপন আবাসভূমি বলিয়া জানিয়াছিলেন, তিনি অনুভব করিয়াছিলেন যে, এইখানেই তিনি তাঁহার বিশ্বমানবের প্রতি সেবার আদর্শকে উপলব্ধি করিতে পারিবেন, এবং যে-ভারতের কল্যাণের সহিত তাঁহার জীবনের সকল আশা জড়িত ছিল, তাহার প্রতিও নিজের সুগভীর ভালোবাসা প্রকাশ করিবার সুযোগ পাইবেন।

আমি জানি এ দেশে এবং ভারতবর্ষের বাহিরে তাঁহার এমন অনেক বন্ধু আছেন যাঁহারা তাঁহার মহৎ নিঃস্বার্থ হৃদয়ের প্রতি শ্রদ্ধা অনুভব করেন, এবং তাঁহার এমন অনেক বন্ধু আছেন যাঁহারা তাঁহার মৃত্যুসংবাদে মর্মাহত হইয়াছেন। আমার মনে দৃঢ় ধারণা যে তাঁহার এই প্রিয় আশ্রমে তাঁহার নামে একটি স্থায়ী স্মৃতি নির্মাণ করিবার ইচ্ছাকে সকলেই অনুমোদন করিবেন। আমাদের আশ্রম-সংক্রান্ত হাসপাতালটি যাহাতে নূতন করিয়া তৈরি হয়, এবং যথাবশ্যক সাজসরঞ্জাম সংগ্রহের পর উত্তমরূপে চালিত হয়, ইহাই তাঁহার একান্ত বাসনা ছিল, এবং বরাবরই তিনি এইজন্য সচেষ্ট ছিলেন এবং যথাসম্ভব অর্থদান করিয়াছেন। আমার বিশ্বাস, আমরা যদি তাঁহার এই ইচ্ছাকে কার্যে পরিণত করিতে পারি, এবং ছেলেদের জন্য স্বতন্ত্র বিভাগের ব্যবস্থা রাখিয়া একটি ভালোরকম হাসপাতাল নির্মাণ করি, তাহা হইলে তাঁহার স্মৃতিকে যথার্থ সম্মান করা হইবে, এবং মানবের দুঃখকষ্টে তিনি যে সমবেদনা অনুভব করিতেন তাহার আদর্শ এই হাসপাতাল আমাদের সর্বদা মনে করাইয়া দিবে। এই অভিপ্রায়ে আমরা তাঁহার বন্ধুবান্ধব এবং তাঁহাকে শ্রদ্ধা করেন এমন সব লোকের নিকট আজ উপস্থিত হইতেছি, এবং আশা করিতেছি যে এ বিষয়ে সকলেই আমাদের মুক্তহস্তে দান করিয়া সাহায্য করিবেন।

প্রবাসী, অগ্রহায়ণ, ১৩৩০

সকল অধ্যায়

১. সাম্রাজ্যেশ্বরী
২. আচার্য জগদীশের জয়বার্তা
৩. জগদীশচন্দ্র বসু
৪. জগদীশচন্দ্র
৫. সতীশচন্দ্র রায়
৬. মোহিতচন্দ্র সেন
৭. রমেশচন্দ্র দত্ত
৮. সুহৃত্তম শ্রীযুক্ত রামেন্দ্রসুন্দর ত্রিবেদী
৯. রামেন্দ্রসুন্দর ত্রিবেদী
১০. দ্বিজেন্দ্রলাল রায়
১১. শান্তিনিকেতনের মুলু
১২. ছাত্র মুলু
১৩. শিবনাথ শাস্ত্রী
১৪. বিদ্যাসাগর
১৫. ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর
১৬. ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর – ০২
১৭. সুকুমার রায়
১৮. সুকুমার রায় – ০২
১৯. উইলিয়াম পিয়ার্সন
২০. পরলোকগত পিয়র্সন
২১. মনোমোহন ঘোষ
২২. সরোজনলিনী দত্ত
২৩. জগদিন্দ্র-বিয়োগে
২৪. লর্ড সিংহ
২৫. উমা দেবী
২৬. অরবিন্দ ঘোষ
২৭. শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়
২৮. শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায় (সংবর্ধনা উপলক্ষে পত্র : ৩)
২৯. মণীন্দ্রচন্দ্র নন্দী
৩০. হরপ্রসাদ শাস্ত্রী
৩১. হরপ্রসাদ শাস্ত্রী – ০২
৩২. প্রফুল্লচন্দ্র রায়
৩৩. আশুতোষ মুখোপাধ্যায়
৩৪. শ্যামকান্ত সর্দেশাই
৩৫. প্রিয়নাথ সেন
৩৬. জগদানন্দ রায়
৩৭. উদয়শঙ্কর
৩৮. স্বামী শিবানন্দ
৩৯. নন্দলাল বসু
৪০. খান আবদুল গফ্‌ফর খান
৪১. দিনেন্দ্রনাথ
৪২. দিনেন্দ্রনাথ ঠাকুর
৪৩. কমলা নেহরু
৪৪. বীরেশ্বর
৪৫. বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়
৪৬. মৌলানা জিয়াউদ্দিন
৪৭. লক্ষ্মীনাথ বেজবরুয়া
৪৮. কামাল আতাতুর্ক
৪৯. কেশবচন্দ্র সেন
৫০. বীরবিক্রমকিশোর মাণিক্য
৫১. ঈ. বী. হ্যাভেল
৫২. দীনবন্ধু অ্যাণ্ডরুজ
৫৩. রাধাকিশোর মাণিক্য
৫৪. প্রমথ চৌধুরী
৫৫. অবনীন্দ্রনাথ ঠাকুর

নোট নিতে এবং টেক্সট হাইলাইট করতে লগইন করুন

লগইন