জগদীশচন্দ্র বসু

রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর

তখন অল্প বয়স ছিল। সামনের জীবন ভোরবেলাকার মেঘের মতো; অস্পষ্ট কিন্তু নানা রঙে রঙিন। তখন মন রচনার আনন্দে পূর্ণ; আত্মপ্রকাশের স্রোত নানা বাঁকে বাঁকে আপনাতে আপনি বিস্মিত হয়ে চলেছিল; তীরের বাঁধ কোথাও ভাঙছে কোথাও গড়ছে; ধারা কোথায় গিয়ে মিশবে সেই সমাপ্তির চেহারা দূর থেকেও চোখে পড়ে নি। নিজের ভাগ্যের সীমারেখা তখনো অনেকটা অনির্দিষ্ট আকারে ছিল বলেই নিত্য নূতন উদ্দীপনায় মন নিজের শক্তির নব নব পরীক্ষায় সর্বদা উৎসাহিত থাকত। তখনো নিজের পথ পাকা করে বাঁধা হয় নি; সেইজন্যে চলা আর পথ বাঁধা এই দুই উদ্‌যোগের সব্যসাচিতায় জীবন ছিল সদাই চঞ্চল।

এমন সময়ে জগদীশের সঙ্গে আমার প্রথম মিলন। তিনিও তখন চূড়ার উপর ওঠেন নি। পূর্ব উদয়াচলের ছায়ার দিকটা থেকেই ঢালু চড়াই পথে যাত্রা করে চলেছেন, কীর্তি-সূর্য আপন সহস্র কিরণ দিয়ে তাঁর সফলতাকে দীপ্যমান করে তোলে নি। তখনো অনেক বাধা, অনেক সংশয়। কিন্তু নিজের শক্তিস্ফুরণের সঙ্গে প্রথম পরিচয়ের যে আনন্দ সে যেন যৌবনের প্রথম প্রেমের আনন্দের মতোই আগুনে ভরা, বিঘ্নের পীড়নে দুঃখের তাপে সেই আনন্দকে আরো নিবিড় করে তোলে। প্রবল সুখদুঃখের দেবাসুরে মিলে অমৃতের জন্য যখন জগদীশের তরুণ শক্তিকে মন্থন করছিল সেই সময় আমি তাঁর খুব কাছে এসেছি।

বন্ধুত্বের পক্ষে এমন শুভ সময় আর হয় না। তার পরে যখন মধ্যাহ্নকাল আসে তখন বিপুল সংসার মানুষকে দাবি করে বসে। তখন কার কাছে কী আশা করা যেতে পারে তার মূল্যতালিকা পাকা অক্ষরে ছাপা হয়ে বেরোয়, সেই অনুসারে নিলেম বসে, ভিড় জমে। তখন মানুষের ভাগ্য অনুসারে মাল্যচন্দন পূজা-অর্চনা সবই জুটতে পারে; কিন্তু এখন পথযাত্রীর রিক্তপ্রায় হাতের উপর বন্ধুর যে করস্পর্শ নির্জন প্রভাতে দৈবক্রমে এসে পড়ে, তার মতো মূল্যবান আর কিছুই পাওয়া যায় না।

তখন জগদীশ যে চিঠিগুলি আমাকে লিখেছিলেন তার মধ্যে আমাদের প্রথম বন্ধুত্বের স্বত চিহ্নিত পরিচয় অঙ্কিত হয়ে আছে। সাধারণের কাছে ব্যক্তিগতভাবে তার যথোচিত মূল্য না থাকতে পারে, কিন্তু মানবমনের যে ইতিহাসে কোনো কৃত্রিমতা নেই, যা সহজ প্রবর্তনায় দিনে দিনে আপনাকে উদ্‌ঘাটন করেছে, মানুষের মনের কাছে তার আদর আছেই। তা ছাড়া, যাঁর চিঠি তিনি ব্যক্তিগত জীবনের কৃষ্ণপক্ষ পেরিয়ে গেছেন, গোপনতার অন্ধ রাত্রি তাঁকে প্রচ্ছন্ন করে নেই, তিনি আজ পৃথিবীর সামনে প্রকাশিত। সেই কারণে তাঁর চিঠির মধ্যে যা তুচ্ছ তাও তাঁর সমগ্র জীবন-ইতিবৃত্তের অঙ্গরূপে গৌরব লাভ করবার যোগ্য।

এর মধ্যে আমারও উৎসাহের কথা আছে। প্রথম বন্ধুত্বের স্মৃতি যদিচ মনে থাকে, কিন্তু তার ছবি সর্বাংশে সুস্পষ্ট হয়ে থাকে না। এই চিঠিগুলির মধ্যে সেই মন্ত্র ছড়ানো আছে যাতে করে সেই ছবি আবার আজ মনে জেগে উঠছে। সেই তাঁর ধর্মতলার বাসা থেকে আরম্ভ করে আমাদের নির্জন পদ্মাতীর পর্যন্ত বিস্তৃত বন্ধুলীলার ছবি। ছেলেবেলা থেকে আমি নিঃসঙ্গ, সমাজের বাইরে পারিবারিক অবরোধের কোণে কোণে আমার দিন কেটেছে। আমার জীবনে প্রথম বন্ধুত্ব জগদীশের সঙ্গে। আমার চিরাভ্যস্ত কোণ থেকে তিনি আমাকে টেনে বের করেছিলেন যেমন করে শরতের শিশিরস্নিগ্ধ সূর্যোদয়ের মহিমা চিরদিন আমাকে শোবার ঘর থেকে ছুটিয়ে বাইরে এনেছে। তাঁর মধ্যে সহজেই একটি ঐশ্বর্য দেখেছিলুম। অধিকাংশ মানুষেরই যতটুকু গোচর তার বেশি আর ব্যঞ্জনা নেই, অর্থাৎ মাটির প্রদীপ দেখা যায়, আলো দেখা যায় না। আমার বন্ধুর মধ্যে আলো দেখেছিলুম। আমি গর্ব করি এই যে, প্রমাণের পূর্বেই আমার অনুমান সত্য হয়েছিল। প্রত্যক্ষ হিসাব গণনা করে যে শ্রদ্ধা, তাঁর সম্বন্ধে আমার শ্রদ্ধা সে জাতের ছিল না। আমার অনুভূতি ছিল তার চেয়ে প্রত্যক্ষতর; বর্তমানের সাক্ষ্যটুকুর মধ্যেই আবদ্ধ করে ভবিষ্যৎকে সে খর্ব করে দেখে নি। এই চিঠিগুলির মধ্যে তারই ইতিহাস পাওয়া যাবে, আর যদি কোনো দিন এরই উত্তরে প্রত্যুত্তরে আমার চিঠিগুলিও পাওয়া যায়, তা হলে এই ইতিহাস সম্পূর্ণ হতে পারবে।

প্রবাসী, জ্যৈষ্ঠ, ১৩৩৩

সকল অধ্যায়

১. সাম্রাজ্যেশ্বরী
২. আচার্য জগদীশের জয়বার্তা
৩. জগদীশচন্দ্র বসু
৪. জগদীশচন্দ্র
৫. সতীশচন্দ্র রায়
৬. মোহিতচন্দ্র সেন
৭. রমেশচন্দ্র দত্ত
৮. সুহৃত্তম শ্রীযুক্ত রামেন্দ্রসুন্দর ত্রিবেদী
৯. রামেন্দ্রসুন্দর ত্রিবেদী
১০. দ্বিজেন্দ্রলাল রায়
১১. শান্তিনিকেতনের মুলু
১২. ছাত্র মুলু
১৩. শিবনাথ শাস্ত্রী
১৪. বিদ্যাসাগর
১৫. ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর
১৬. ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর – ০২
১৭. সুকুমার রায়
১৮. সুকুমার রায় – ০২
১৯. উইলিয়াম পিয়ার্সন
২০. পরলোকগত পিয়র্সন
২১. মনোমোহন ঘোষ
২২. সরোজনলিনী দত্ত
২৩. জগদিন্দ্র-বিয়োগে
২৪. লর্ড সিংহ
২৫. উমা দেবী
২৬. অরবিন্দ ঘোষ
২৭. শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়
২৮. শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায় (সংবর্ধনা উপলক্ষে পত্র : ৩)
২৯. মণীন্দ্রচন্দ্র নন্দী
৩০. হরপ্রসাদ শাস্ত্রী
৩১. হরপ্রসাদ শাস্ত্রী – ০২
৩২. প্রফুল্লচন্দ্র রায়
৩৩. আশুতোষ মুখোপাধ্যায়
৩৪. শ্যামকান্ত সর্দেশাই
৩৫. প্রিয়নাথ সেন
৩৬. জগদানন্দ রায়
৩৭. উদয়শঙ্কর
৩৮. স্বামী শিবানন্দ
৩৯. নন্দলাল বসু
৪০. খান আবদুল গফ্‌ফর খান
৪১. দিনেন্দ্রনাথ
৪২. দিনেন্দ্রনাথ ঠাকুর
৪৩. কমলা নেহরু
৪৪. বীরেশ্বর
৪৫. বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়
৪৬. মৌলানা জিয়াউদ্দিন
৪৭. লক্ষ্মীনাথ বেজবরুয়া
৪৮. কামাল আতাতুর্ক
৪৯. কেশবচন্দ্র সেন
৫০. বীরবিক্রমকিশোর মাণিক্য
৫১. ঈ. বী. হ্যাভেল
৫২. দীনবন্ধু অ্যাণ্ডরুজ
৫৩. রাধাকিশোর মাণিক্য
৫৪. প্রমথ চৌধুরী
৫৫. অবনীন্দ্রনাথ ঠাকুর

নোট নিতে এবং টেক্সট হাইলাইট করতে লগইন করুন

লগইন