বীরেশ্বর

রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর

সেদিন আমাদের বর্ষামঙ্গল অনুষ্ঠানের দিন ছিল। আমরা তারই জন্য প্রস্তুত হচ্ছিলাম। মৃত্যু যে গোপনে উৎসবের আলিঙ্গন থেকে উৎসবের কোলের একটি ছেলেকে কেড়ে নিতে এসেছিল সে সংবাদ আমার জানা ছিল না। আমাদের আশ্রম তারই অনুসরণে পাঠিয়ে দিলে আপদ অনারব্ধ উৎসবকে তার জীবনান্তের শেষ ছায়ার মতো। সেদিন আমাদের বর্ষপঞ্জীর উৎসব-গণনায় একটি শূন্য চিহ্ন রয়ে গেল যেখানে ছিল বীরেশ্বরের আবাল্যকালের আসন। শ্রীনিকেতনের হলকর্ষণ অনুষ্ঠানে যোগ দিতে যাবার মুখে কে একজন বললে গোঁসাইজির ঘরে দুশ্চিন্তাজনক রোগ দেখা দিয়েছে, ব্যস্ততার মুখে কথাটা ভালো করে আমার কানে পৌঁছয় নি। আমি মুহূর্তের জন্যেও ভাবতে পারি নি যে বীরেশ্বরই তার লক্ষ্য।

সে ছিল মূর্তিমান প্রাণের প্রতীক, যৌবনের তেজে দীপ্ত। তাকে ভালোবেসেছে আশ্রমের সকলেই, সে ভালোবেসেছে আশ্রমকে। তার সত্তার মধ্যে এমন একটি উদ্যমের পূর্ণতা ছিল যে তাকে হারাবার কথা কল্পনাও করতে পারি নি।

অবশেষে দারুণ সংবাদ নিশ্চিত হয়ে কানে পৌঁছল– তার পর থেকে কত অর্ধরাত্রে ঘুমের ফাঁকে কত ভোরবেলায় ঘুম থেকে উঠে, কতবার দিনের বেলায় কাজের মাঝে মাঝে তার ছবি মনে অকস্মাৎ ছায়া ফেলে গেল।

সংসারে যাওয়া-আসার পথে, আলো-আঁধারের পর্যাবর্তনে ভিড়ের সঙ্গে মিলে যখন মৃত্যু দেখা দেয় তখন তাকে অসংগত বলে মনে হয় না। বনে অজস্র ফুল ফোটে আর ঝরে, সেই ফোটা-ঝরার ছন্দ একসঙ্গে মেলানো। তেমনি বিরাট সংসারের মাঝখানে জীবনে মৃত্যুতে চিরদিন ধরেই তাল মিলিয়ে চলে। মৃত্যু সেখানে জীবনের ছবিতে দুঃখের দাগ কাটে, চিত্রপটকে ছিন্ন করে না। কিন্তু আশ্রমের মধ্যে সেই মৃত্যুকে আমরা তো অত সহজে মেনে নিতে পারি নে। যারা এখানে মিলেছে তারা মিলেছে পান্থশালায়, সামনে তাদের এগোবার পথ, সেই পথের পাথেয় সংগ্রহ করছে, এখানে সাংসারিক সুখদুঃখের দ্বন্দ্ব নেই। এখানকার আশাপ্রত্যাশা প্রভাত-সূর্যের আলোকে দূরপ্রসারিত ভবিষ্যতের দিকে। এর মধ্যে মৃত্যু যখন আসে তখন অভাবনীয় একাট নিষ্ঠুর প্রতিবাদ নিয়ে আসে। অতি তীব্র বেদনায় অনুভব করি এখানে তার অনধিকার।

বীরেশ্বর আমাদের মধ্যে এসেছিল শিশু অবস্থায়। সমস্ত আশ্রমের সঙ্গে সে অখণ্ড হয়ে মিলেছিল, চলছিল এখানকার তরুলতা পশুপাখির অবারিত প্রাণযাত্রার সঙ্গে সঙ্গে নিত্য বিকাশের অভিমুখে; এখানকার বিচিত্র ঋতুপর্যায়ের রসধারায় তার অভিষেক হয়েছিল। কোনো দিকে সে দুর্বল ছিল না; না শরীরের দিকে, না মনের দিকে, না শ্রেয়োবুদ্ধির দিকে। নবোদিত অরুণরশ্মির মতো তার মধ্যে পুণ্যজ্যোতির আভাস দেখা দিয়েছিল, সে ছিল অকলঙ্ক।

যদি কেউ ত্যাগ বা সেবার দ্বারা জীবনের সত্য রূপ প্রকাশ করতে পারে, তবে তা আমাদের কেবল যে আনন্দ দেয় এমন নয় শক্তিও দেয়। স্বল্পকালীন জীবনমৃত্যুর পাত্রটিকে সে আপন সত্য দ্বারা পূর্ণ করে গেছে। এই সত্যের সম্বন্ধের অবসান নেই। সত্য ভাবে যার কাছে সে আপনাকে নিবেদন করেছিল, বেঁচে থাকলে সেই আশ্রমের কাছে সে ফিরে আসতই।

এখানে অনেক ছাত্রছাত্রী আসেন, যা লাভ করবার হয়তো তা সম্পূর্ণই লাভ করেন, এখানকার আনন্দ-উৎসবে আনন্দিত হন, কিন্তু এখানে তাঁদের আশ্রমবাস অবশেষে একদিন সমাপ্ত হয়। কিন্তু আমি অনুভব করেছি, বীরেশ্বর কেবল এখানকার দান গ্রহণ করতে আসে নি, তার মনের মধ্যে অর্ঘ্য সঞ্চিত হয়ে উঠছিল, তার জীবনের নৈবেদ্য পরিপূর্ণ হয়ে উঠে এইখানকার বেদিমূলেই সমর্পিত হত। মৃত্যুর থালায় সেই নৈবেদ্যই কি এখানে সে চিরদিনের মতো রেখে গেল।

অল্প কিছু দিনের জন্যে সংসারে আমরা আসি আর চলে যাই। বিশ্বব্যাপী মানবপ্রাণের যে জাল বোনা নিত্যই চলেছে তার মধ্যে ছোটোবড়ো একটি করে সূত্র আমরা জুড়ে দিই। তার মধ্যে অনেক আছে বর্ণ যার ম্লান, শক্তি যার দৃঢ় নয়। কিন্তু যে ভালো, সে ভালোবেসেছে, মানুষের ইতিহাসসৃষ্টির মধ্যে সে অলক্ষ্যেও সার্থক হয়ে থাকে। পৃথিবীতে এমন অনেকে আছে এবং গেছে যাদের নাম জানি নে, মহাশিল্পীর শিল্পে চিরকালের জন্যে তারা কিছু রঙ লাগিয়ে গেছে। বীরেশ্বর তার সরলতা, তার নির্মলতা, তার সহৃদয়তায় আমাদের মনে যে প্রীতির উদ্রেক করে গেছে তারই দ্বারা তার জীবনের শাশ্বতমূল্য আমরা মৃত্যু অতিক্রম করেও অনুভব করি।

জীবনকে সম্পূর্ণ ব্যর্থ করে বিদ্রূপ করতে এসেছে মৃত্যু, এ কথা মনে নেয় না। বিশ্বের মধ্যে এত বড়ো নিরর্থকতার ব্যঙ্গ তো দেখতে পাই নে। জগৎকে তো দেখতে পাচ্ছি সে মহৎ সে সুন্দর। তার সেই মহত্ত্ব মৃত্যুকে পদে পদে মিথ্যা করে দিয়ে, অমঙ্গলকে মুহূর্তে মুহূর্তে বিলীন করে দিয়ে বিরাজ করে, নইলে সে যে থাকতেই পারত না। এই জগৎ নিত্যই চলছে, কিন্তু আপনাকে তো হারাচ্ছে না। জগতের সেই স্থায়ী সত্যের দিকেই সে রয়ে গেছে, মহাকালের যাত্রাপথে ক্ষণকালের অতিথিরূপে এসে যে আমাদের স্নেহ আমাদের আশীর্বাদ নিয়ে গেছে। তাকে আমরা হারাই নি, তোমরা তার প্রিয়জন, আমরা তার গুরুজন– এই কথাই আজ অন্তরের সঙ্গে উপলব্ধি করি।

প্রবাসী, কার্তিক, ১৩৪৪

সকল অধ্যায়

১. সাম্রাজ্যেশ্বরী
২. আচার্য জগদীশের জয়বার্তা
৩. জগদীশচন্দ্র বসু
৪. জগদীশচন্দ্র
৫. সতীশচন্দ্র রায়
৬. মোহিতচন্দ্র সেন
৭. রমেশচন্দ্র দত্ত
৮. সুহৃত্তম শ্রীযুক্ত রামেন্দ্রসুন্দর ত্রিবেদী
৯. রামেন্দ্রসুন্দর ত্রিবেদী
১০. দ্বিজেন্দ্রলাল রায়
১১. শান্তিনিকেতনের মুলু
১২. ছাত্র মুলু
১৩. শিবনাথ শাস্ত্রী
১৪. বিদ্যাসাগর
১৫. ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর
১৬. ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর – ০২
১৭. সুকুমার রায়
১৮. সুকুমার রায় – ০২
১৯. উইলিয়াম পিয়ার্সন
২০. পরলোকগত পিয়র্সন
২১. মনোমোহন ঘোষ
২২. সরোজনলিনী দত্ত
২৩. জগদিন্দ্র-বিয়োগে
২৪. লর্ড সিংহ
২৫. উমা দেবী
২৬. অরবিন্দ ঘোষ
২৭. শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়
২৮. শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায় (সংবর্ধনা উপলক্ষে পত্র : ৩)
২৯. মণীন্দ্রচন্দ্র নন্দী
৩০. হরপ্রসাদ শাস্ত্রী
৩১. হরপ্রসাদ শাস্ত্রী – ০২
৩২. প্রফুল্লচন্দ্র রায়
৩৩. আশুতোষ মুখোপাধ্যায়
৩৪. শ্যামকান্ত সর্দেশাই
৩৫. প্রিয়নাথ সেন
৩৬. জগদানন্দ রায়
৩৭. উদয়শঙ্কর
৩৮. স্বামী শিবানন্দ
৩৯. নন্দলাল বসু
৪০. খান আবদুল গফ্‌ফর খান
৪১. দিনেন্দ্রনাথ
৪২. দিনেন্দ্রনাথ ঠাকুর
৪৩. কমলা নেহরু
৪৪. বীরেশ্বর
৪৫. বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়
৪৬. মৌলানা জিয়াউদ্দিন
৪৭. লক্ষ্মীনাথ বেজবরুয়া
৪৮. কামাল আতাতুর্ক
৪৯. কেশবচন্দ্র সেন
৫০. বীরবিক্রমকিশোর মাণিক্য
৫১. ঈ. বী. হ্যাভেল
৫২. দীনবন্ধু অ্যাণ্ডরুজ
৫৩. রাধাকিশোর মাণিক্য
৫৪. প্রমথ চৌধুরী
৫৫. অবনীন্দ্রনাথ ঠাকুর

নোট নিতে এবং টেক্সট হাইলাইট করতে লগইন করুন

লগইন