শঙ্কর চ্যাটার্জী
অফিসের বিশেষ কাজে দিল্লি যেতে হবে, অনেক চেষ্টায় কালকা মেলের একটা টিকিট জোগাড় করা গেল। উপায় নেই, যাওয়ার প্রয়োজনটা খুবই জরুরি। নভেম্বরের গোড়া — যথারীতি কুয়াশার জন্য ট্রেন লেট করা শুরু হল। সন্ধ্যে সাতটা চল্লিশে পৌঁছনোর জায়গায় চার ঘন্টা দেরিতে ওল্ড দিল্লি স্টেশনে ঢুকল। আমাকে থাকার জন্যে পাহাড়গঞ্জের কাছাকাছি হোটেলে থাকতে হবে। এর আগেও যতবার দিল্লি এসেছি নিউ দিল্লি স্টেশনে নেমেছি। কিন্তু এবারে ব্যতিক্রম।
রাত সাড়ে এগারোটা নাগাদ স্টেশনের বাইরে বেরোতেই কয়েকজন দালাল এগিয়ে এল। বলে দিলাম পাহাড়গঞ্জে হোটেল বুকিং আছে। আমার লাগেজ বলতে একটা স্কাইব্যাগ। ফেরার টিকিট অবশ্য রাজধানীতে পেয়েছি। দিন দুয়েকের কাজ। পাহাড় গঞ্জের দু’একটা হোটেলে চেনাজানাও আছে। একটা অটোকে বললাম হোটেল ডি হর্সে নিয়ে যেতে। ও ডবল ভাড়া চাইল। জানতাম — রাত বারোটা বাজতে চলেছে। তার ওপর দিল্লি — ধোঁয়া, কুয়াশা আর ঠান্ডায় জগাখিচুড়ি পাকিয়ে গেছে। জানি দরকষাকষি করে কোনো লাভ হবে না — শুধু সময়ের অপচয়। একেই আঠাশ ঘন্টা ট্রেন জার্নিতে কাহিল অবস্থা। সোয়েটারটা চাপালাম। এই রাতেও গাড়ির সংখ্যা কম নয়। আধ ঘন্টার মধ্যে হোটেলের সামনে পৌছলাম। অটোওয়ালা ভাড়া নিয়েই কেটে পড়ল।
একটা কথা আছে, তুমি যখন ঝামেলায় পড়বে তখন সবদিক দিয়েই পড়বে। হোটেল ডি হর্সে কোনো রুম খালি নেই। চিন্তায় পড়লাম। অনুরোধ করলাম — ‘এর আগেও বেশ কয়েকবার আপনাদের হোটেলে উঠেছি। একটু দেখুন। এই রাত্রে কোথায় যাব?’
‘বিশওয়াস কিজিয়ে স্যার, নো রুম। কাল এক রুম খালি হোগা…’
আমি অনুনয়ের সুরে বললাম, ‘কিছু একটা, এক রাতের জন্য করুন’, ম্যানেজার বলল একটু এগিয়ে এই লাইনেই হোটেল চাঁদনী পাবেন। ওখানে পেয়ে যেতে পারেন।
দেখলাম এখানে আর সময় নষ্ট করে লাভ হবে না বরং রাত বাড়বে। ব্যাগ কাঁধে নিয়ে এগোলাম হোটেল চাঁদনীর দিকে। প্রথম দর্শনেই হোটেলটা ভালো লাগল না। একেবারে রদ্দিমার্কা টাইপের। কিন্তু আমাকে এখানেই জায়গা পেতে হবে অন্তত রাতটুকু কাটাবার জন্য। সামনের লোহার জালতি দেওয়া গেট বন্ধ। তিনচার বার ধাক্কাধাক্কি করার পর একজন বেয়ারা গোছের লোক ব্যাজার মুখে খুলল। রিসেপশনটাও তথৈবচ নোংরা ! একজন বসে বসে ঢুলছে। ঘরের কথা বলতেই উত্তর এল, ‘কোই রুম খালি নেহি।’
যাহ বাবা…এই হোটেলেও একই অবস্থা! দিল্লিতেই কি সারা দেশের মানুষ এসে গেছে নাকি? ওকে ডি হর্সের কথা বললাম। বিরক্ত মুখে বুকিং খাতাটা খুলে এক পলক দেখেই বলল, ‘নেহি… এক ভি খালি নেহি।’ আমিও চোখ বুলোচ্ছিলাম। উনিশ নম্বর রুমটার জায়গায় শুধু লাইন টানা। কোনো বোর্ডারের নাম লেখা নেই। আঙ্গুল দেখিয়ে বললাম, ‘ভাইসাব, উনিশ তো খালি হ্যায়।’
ম্যানেজার ঘাড় নেড়ে বলল, ‘ইয়ে কামরা ব্লকড হ্যায়…’
— ‘মতলব?’ প্রশ্ন করলাম।
— ‘মালিক কা হুকুম, কিসিকো নেহি দেনা।’
এবার আমার অনুরোধের পালা, ‘দেখো ভাই বড় বিপদে পড়েছি। একটা রাতের জন্য দাও। কাল সকালেই চলে যাব। তোমার মালিক জানতেও পারবে না।’
একটা পাঁচশো টাকার নোট বার করলাম। ও নোটটা দেখল।
— ‘নেহি স্যার, পরে ঝামেলা হলে আমার নোকরি চলা যায়গা।’
— ‘আরে আমি রেজিস্টারে সই করব না। নাম লেখার দরকার নেই।’
বেয়ারা আর ম্যানেজারের চোখে চোখে কিছু কথা হল।
বেয়ারা বলল, ‘কিছুদিন আগে ঐ ঘরে এক বোর্ডার সুইসাইড করে তারপর থেকে ঐ ঘর বন্ধ।’
শালা! বুঝেছি, আমাকে তাড়াবার বন্দোবস্ত। আরও একটা পাঁচশোর নোট বার করলাম। ওরা একটু চনমনে হয়ে উঠল। ম্যানেজার তবু একটু নারাজ।
আমি বললাম, ‘পুলিশ কি ঘর সীল করে দিয়ে গেছে?’
— ‘না স্যার, দিন সাতেক আগে এক কাস্টমার ভয় পায় তারপর থেকেই বন্ধ। নাহলে হোটেলের বদনাম হয়ে যাবে।’ ঘড়িতে একটা বাজতে বেশি দেরি নেই।
— ‘ দেখুন ট্রেন জার্নিতে এমনিতেই ক্লান্ত, এখন শুধু একটু ঘুমোতে চাই। ভূত এলেও ঐ কথা বলব। আর কথা নয়, এবার চাবিটা দিন।’
ম্যানেজার দোটানার মধ্যে পড়ল। এদিকে টাকার লোভটাও সামলাতে পারছে না। বেয়ারা মুখ খুলল, ‘ও বাবু ভীতু আদমি থা…’ ম্যানেজারের কাছ থেকে চাবিটা নিয়ে বলল, ‘আইয়ে, দোতল্লা মে আপকা কামরা।’
ওর সঙ্গে রেলিং ভাঙা সিঁড়ি বেয়ে ওপরে এলাম। করিডরের দু’পাশে সারি সারি ঘর। কয়েকটা ঘরের দরজার সামনে এখনও রাতের খাবারের এঁটো প্লেট পড়ে আছে। একেবারে কোণের ঘরটার সামনে এসে দাঁড়ালাম। যে সুইসাইড করেছিল ঘরটা ভালোই পছন্দ করেছে। ঘরের আলোটা জ্বালিয়ে দিল। ডবল বেডরুম, খাটটাও বড়। বেয়ারা জগে খাবার জল ভরে দিয়ে গুড নাইট বলে বিদায় নিল।
দরজা বন্ধ করে চটপট ব্যাগ খুলে রাতের পোশাকটা বার করে নিলাম। ট্রেনে স্নান হয়নি… একটু স্নান করতে হবে। রাত একটা বাজছে। বেয়ারাটা যতক্ষণ ঘরে ছিল একটা জিনিস চোখে পড়েছিল ও বারে বারে ভয় চকিত চোখে বাথরুমের দিকে তাকাচ্ছিল। তবে কি বাথরুমেই আত্মহত্যার ঘটনাটা ঘটেছে? মিনিটের মধ্যে চিন্তাটা সরিয়ে দিলাম।
গাজি়য়াবাদ স্টেশন থেকে পুরি-সবজি খেয়ে নিয়েছিলাম। জগ থেকে এক গ্লাস জল খেয়ে সিগারেট ধরিয়ে বাথরুমে ঢুকলাম। গিজ়ারটা অন করে দিলাম। জল গরম হতে একটু সময় লাগবে। সিগারেট টেনে ধোঁয়ার কুন্ডলী ছাড়লাম। বাড়িতে আগেই জানিয়ে দিয়েছি ট্রেন লেটের কথা। কলটা চালালাম। হাত দিয়ে দেখলাম, কোথায় গরম জল? এ তো কনকনে ঠান্ডা! বেয়ারাটাকে ডাকার কথা মাথায় আসতেই ভাবলাম থাক। একেই ঘর দিয়েছে, ভাববে এই রাতে আবার গরম জলে স্নান করার বায়না! সিগারেটে কয়েকটা টান মেরে ফেলে দিলাম। এই বরফ ঠান্ডা জলে স্নান… অসম্ভব! হাত-মুখ ভাল করে সাবান দিয়ে ধুলাম। হ্যান্ডেলে একটা সাদা তোয়ালে ছিল ওটা নিয়েই ঘেন্না লাগল। লালচে—লালচে ছোপ। সত্যি বলছি তখনও মনে ভয় জিনিসটা টোকা মারেনি। ব্যাগে পাতলা টাওয়েল আছে ওটা আনবার জন্য জল-পায়েই বেরোতে যাব — বিস্ময়ের সাথে দেখলাম ধূমপান করে যেসব ধোঁয়া ছেড়েছিলাম সেগুলো জমাট বেঁধে একটা মানুষের মুখের মতো অবয়ব সৃষ্টি করেছে। বাথরুমের শাওয়ারের ওপর সেটা ভাসছে। ভালোভাবে লক্ষ্য করতে চোখ, কান, নাক সবই বোঝা যাচ্ছে। ভাবলাম চশমা নেই তাই ভুল দেখছি। তাড়াতাড়ি করে চশমাটা পরে বাথরুমের দরজাটার সামনে এলাম।
অবিকল একটা মানুষের মুখমন্ডল। মুন্ডুটা ভাসতে ভাসতে বাথরুমের ছোট্ট জানলাটা দিয়ে বাইরে অন্ধকারে মিলিয়ে গেল। প্রথম ভয়ের টোকাটা ধাক্কায় পরিণত হল। কয়েক মিনিটের জন্য বোবা হয়ে গেলাম। তারপরেই মনকে শক্ত করলাম। ওদের বলা আত্মহত্যার ঘটনাটাই আমার মনে বিরূপ প্রতিক্রিয়ার সৃষ্টি করেছে। আর দেরি না করে ঘরের আলোটা জ্বালিয়ে বিছানায় শরীর রাখতেই একরাশ আরাম আর ঘুম আমায় আলিঙ্গন করল। শোবার আগে বাথরুমের দরজাটা লক করে দিলাম। বেশ একটা ঠান্ডা ঠান্ডা ভাব। পায়ের নিচ থেকে রোঁয়াওঠা বোঁটকা গন্ধওয়ালা কম্বলটা গায়ে চাপা দিলাম। সারা দুনিয়া কাঁপিয়ে রাজ্যের ঘুম আমার দু’চোখে চলে এল।
বেশ শীত শীত অনুভব হতে ঘুমের ঘোরটা বাধাপ্রাপ্ত হল। হঠাৎ এত ঠান্ডা লাগছে কেন? বাধ্য হয়ে চোখ চাইতেই অবাক হলাম। কম্বলটা আমার গায়ে নেই! কোথায় গেল ওটা? উঠে বসে বড় বড় চোখে দেখি পায়ের কাছে ভাঁজ করা কম্বলটা রয়েছে। যেমনটি শোবার আগে ছিল। তবে কি ঘুমের ঘোরে কম্বল না নিয়েই শুয়ে পড়েছি? সঙ্গে সঙ্গে মস্তিস্ক মনে করিয়ে দিল বোঁটকা গন্ধটার কথা। সত্যি তো, কম্বলটা না নিলে বোঁটকা গন্ধটা পেলাম কী করে?
যতই ঘর পাওয়ার জন্য ম্যানেজারকে সাহসের বড়াই করে আসি না কেন এখন মনে হচ্ছে সাহসে ঘাটতি দেখা দিচ্ছে!
বুঝতে পারছি না এরপরেও আর কোনো অলৌকিক ঘটনার সম্মুখীন হব কিনা?
যাক, এসব নিয়ে গবেষণা করতে গেলে ঘুমটারই বারোটা বাজবে। তার ওপর কাল সকালেই অফিসের কাজে পার্লামেন্ট স্ট্রিটে ছুটতে হবে। সারাদিনই শোয়া-বসা হবে না। শীতটা ভালোই মালুম হচ্ছে। ঘড়িতে দেড়টা বাজছে। তার মানে দশ মিনিটও ঘুমোইনি। বোঁটকা গন্ধওয়ালা লাল কম্বলটা আবার টেনে নিয়ে শুয়ে পড়লাম। চোখ বন্ধ করে ভাবলাম, আবার টেনে নেবে না তো? কথাটা মনে আসতেই একটা হালকা শিহরণ শরীরে খেলে গেল। বুঝতে পারছি এই অবাস্তব চিন্তাগুলোই ঘুমটাকে জোর করে তাড়িয়ে দিচ্ছে!
আচ্ছা, ওরা বলল এই ঘরেই সুইসাইড করেছে। আর বেয়ারাটাও যেভাবে বাথরুমের দিকে তাকাচ্ছিল তার মানে ওটাই আত্মহত্যার স্থান! কিন্তু কীভাবে মরল? গলায় দড়ি? অসম্ভব! কেননা টয়লেটের ছাদটা নিচু, তাছাড়া কোনো হুক নেই। তাহলে? মনের মধ্যেই পোস্টমর্টেম শুরু হল আমার ইচ্ছার বিরুদ্ধে।
এই রকম হয় দেখবেন, যেটা নিয়ে ভাবতে চাইবেন না — আপনার মন সেটা নিয়েই বেশি ভাববে। তাহলে কি আগুনে পুড়ে? কিন্তু কিছুদিন আগেকার ঘটনা — দেওয়ালে পোড়া দাগ থাকত! নতুন রং করলেও বোঝা যেত। আর কী উপায়ে? শুধু প্রশ্নের পর প্রশ্ন— উত্তর কিছু নেই।
ক্রমশ মাথাটার ভেতর তালগোল পাকাতে শুরু করল। এ তো মহা বিপদে পড়া গেল! চোখের ঘুম দূরে সরে যেতে লাগল। মাথাটা এইসব চিন্তায় অস্বাভাবিক গরম হতে শুরু করল। কিছুতেই বাগে আনতে পারছি না। মনে হচ্ছে এক টুকরো জ্বলন্ত অঙ্গার মস্তিষ্কের কোষে কোষে ঘোরাফেরা করছে!
ধুর ছাই… কী কুক্ষণে এই ঘরটা নিলাম! উঠে একটু ধূমপান করা যাক। পরক্ষণেই ইচ্ছেটাকে দমন করলাম। আবার যদি ধোঁয়ার দেহ তৈরী হয়ে যায়? ধোঁয়ার মুন্ডুটার কথা নতুন করে মনে পড়ে গেল। তবে কি আমি এই মুহূর্তে ভয়ের মধ্যে বাস করছি? কেননা চোখের ভারী পাতা দুটো বন্ধ করতেও পারছি না। চোখ দুটো যেন কিসের আগমনের প্রতীক্ষায় ভীত!
এদিকে সেই রকম ভৌতিক দৃশ্য এখনও পর্যন্ত আমি দেখিনি। তবে কি যে আত্মহত্যা করেছে, তার বিদেহী আত্মা আমার মনের ওপর প্রভাব বিস্তার করে চলেছে? এই কথাটা মাথায় আসতে আমি আরও বেশি করে ভয়ের সমুদ্রে ডুবতে শুরু করলাম। কয়েক সেকেন্ডের মধ্যেই তীব্র শীতল অনুভূতি শরীরটাকে গ্রাস করল। তার মানে এর আগেও যে বোর্ডার এই ঘরে ছিল সে শুধু শুধু ভয় পায়নি। খুট করে একটা শব্দে আমার সমস্ত ইন্দ্রিয় সজাগ হয়ে উঠল। আধশোয়া অবস্থায় ঘরের চারদিকে ভয়ার্ত দৃষ্টিতে তাকালাম। নীলচে আলোতে সারা ঘরটা নীলাভ হয়ে উঠেছে। মনে হচ্ছে ঘর জুড়ে সন্ধ্যার আলো আর আমি একা অতন্দ্র প্রহরী!
নজর আটকাল বাথরুমের দরজার ওপর। আধ খোলা হয়ে রয়েছে। হলফ করে বলতে পারি শোবার আগে দরজাটা আমি লক করে দিয়েছিলাম। তাছাড়া লক খোলার শব্দটাও একটু আগে পেয়েছি। এবার আমার মুখে আতঙ্ক দেখা দিল। কেননা চোখের সামনে দরজাটা ধীরে ধীরে খুলে যাচ্ছে! উঠে যে জোরালো আলোটা জ্বালাব সে শক্তিটুকুও হারিয়ে ফেলেছি। ভেবে পাচ্ছি না… কখন এত ভয় আমার মনে প্রবেশ করল!
এবার কানে এল বাথরুমে কল খোলার আর বালতিতে ছর ছর করে জল পড়ার শব্দ। কে যেন বালতিতে জল ভর্তি করছে!! এই সময় বুদ্ধি একটু জাগ্রত হল। হাত বাড়িয়ে ইন্টারকমের রিসিভারটা তুলে নিয়ে একশ’ সাত নম্বরে রিসেপশনে ফোন করলাম। যদি কেউ জেগে থাকে? কাঁপা হাতে শুনতে লাগলাম অপর প্রান্তে রিং হওয়ার শব্দ। বেজেই চলেছে ঘন্টি — হয় ঘুমিয়ে পড়েছে নচেৎ মারা গেছে। রিসিভারটা নামিয়ে রাখলাম। এই অনন্ত নৈশব্দ্যের মধ্যে আমি একা। জল পড়ার শব্দটা বন্ধ হয়ে গেল। মুখে-চোখে আতঙ্ক নিয়ে বাথরুমের দিকে তাকালাম। আর সঙ্গে সঙ্গেই আমার সমস্ত স্নায়ু তাসের ঘরের মতো ভেঙে পড়ল।
বেশ দেখা যাচ্ছে একটা অস্পষ্ট সাদা ধোঁয়ার মতো শরীর বাথরুমে নড়াচড়া করছে। কেননা দরজাটা হাট করে খোলা। একটু বাদেই স্নান করার শব্দ কানে এল। কপালে এই ঠান্ডার মধ্যে বিন্দু বিন্দু ঘাম জমতে শুরু করেছে। প্রেশারটা ঊর্ধ্বমুখী হচ্ছে। বুকেও একটা চাপা ব্যথা অনুভব করছি। মন বলছে স্নান শেষ হবার পর ও কি এই ঘরে আসবে? আমি নিশ্চিত সেই বীভৎস দৃশ্য আমার হৃৎপিণ্ড সহ্য করতে পারবে না। সে তার কাজ করা বন্ধ করে দেবে।
স্নান করার আওয়াজ বন্ধ হল। আমি বিছানায় বসে জীবনের অন্তিম সময়ের জন্যে অপেক্ষা করছি।
এরপর কী ঘটবে? আমার মন মস্তিস্ক কে প্রশ্ন করে কোনো উত্তর পেল না। সেই অন্তিম ক্ষণ এল। হালকা ধোঁয়ার শরীরটা বাথরুম থেকে এক পা এগিয়ে ঘরে এল। সঙ্গে সঙ্গেই ঘরের টেম্পারেচার কয়েক ডিগ্ৰী কমে গেল। চারিদিকে হাড় হিম করা ঠান্ডায় মনে হচ্ছে মর্গের ভেতর বসে আছি!
ছায়ামূর্তিটা বাথরুমের সামনেই দাঁড়িয়ে আছে। এই সময় মাথার ভেতর কে যেন আমাকে অ্যালার্ম দিল! এখনও সময় আছে। পালাও। শরীরটাকে শক্ত করলাম। দরজা খুলে পালাতে হবে। হাত-পা রেডি হয়ে গেল। কিন্তু তখনও আতঙ্কিত হবার আরও কিছু বাকি ছিল। খাট থেকে দাঁড়াবার মুহূর্তে দরজাটা লক্ষ্য করেই ভয়ে হাত-পা পেটের মধ্যে সেঁধিয়ে যাবার উপক্রম হল। নেই… দরজাটাই ওখানে নেই! এক পলকে চারধারে তাকিয়ে দরজাটা খুঁজে পেলাম না। শুধু দেওয়াল আর দেওয়াল! কপাল থেকে এক ফোঁটা ঘাম হাতে পড়ল — এক কণা বরফের টুকরো যেন! হে ভগবান, গলা দিয়ে কোনো শব্দ বেরোচ্ছে না।
ঘাড় ঘুরিয়ে মূর্তিটাকে দেখলাম। ডান হাতের কব্জি থেকে লাল রক্তের ধারা টপ টপ করে মেঝেতে পড়ে আল্পনা আঁকছে। তার মানে ও এইভাবেই আত্মহত্যা করেছে। ঐ অশরীরী এবার টলতে টলতে দু’পা এগিয়ে খাটটার কাছে এল। আমার হৃৎপিণ্ডের ধুকপুকুনির শব্দ কানে বাজছে। কোথায় পালাব? পালাবার রাস্তা কোথায়? ঐ বীভৎস দৃশ্য এই বয়সে কতক্ষণ সহ্য করতে পারব? হার্টফেল করা কেউ রুখতে পারবে না। ঐ ছায়াশরীর এবার ঘরের পাশে যে চেয়ারটা রাখা আছে সেখানে গিয়ে দু’হাত ঝুলিয়ে মাথা নিচু করে বসল। পরিষ্কার দেখতে পাচ্ছি ডানহাতের কব্জির একটু ওপরে বাথরুমের রক্তের দাগওয়ালা তোয়ালেটা জড়ানো। সম্মোহিতের মতো ওর ক্রিয়াকলাপ দেখছি। শত চেষ্টাতেও চোখ সরিয়ে নিতে পারছি না।
বুকের ভেতরে কে যেন হাতুড়ি পেটাচ্ছে। তবে কি আমি ধীরে ধীরে মৃত্যুর দিকে এগিয়ে চলেছি? বাড়ির কথা মনে পড়ছে। ওরা জানতেও পারবে না কীভাবে আমি মারা গেলাম। ইস… যদি স্টেশনেই রাতটা কাটাতাম! মূর্তিটার মাথাটা ক্রমশ একদিকে হেলে পড়ছে! রক্তের স্রোতও কমে আসছে।
হঠাৎ আমাকে চমকে দিয়ে বালিশের পাশে রাখা মোবাইলটা কুঁই কুঁই করে উঠল। প্রথম অনুভব করলাম কোনো জীবিত মানুষ আমার সঙ্গে যোগাযোগ করতে চাইছে। মাথাটা সক্রিয় হতে শুরু করল। ওর থেকে চোখ না ফিরিয়ে কাঁপা হাতে ফোনটা কানে ঠেকালাম।
স্ত্রীর কণ্ঠ ভেসে এল, ‘ভোররাতেই ডিস্টার্ব করছি। সারারাত জেগে তোমার কথাই চিন্তা করছি। অনেকক্ষণ খবর পাইনি তোমার।’
কানে কথাগুলো যেন দেহে প্রাণ ফিরিয়ে আনছে। দেখতে পাচ্ছি সেই ধোঁয়ার ভয়ঙ্কর দেহ ধীরে ধীরে অস্পষ্ট থেকে অস্পষ্টতর হয়ে যাচ্ছে। মনে হচ্ছে এ যাত্রা আমি বেঁচে গেলাম।
ভাঙা গলায় বললাম, ‘কটা বাজে?’
— ‘কেন হঠাৎ এই প্রশ্ন? তোমার গলাটা কীরকম শোনাচ্ছে… এখন ভোর সাড়ে চারটে।’
সামনের চেয়ারটা খালি… শূন্য! অতৃপ্ত আত্মা বিলীন হয়ে গেছে এই ঘরেরই কোনো স্থানে।
‘আমি পরে ফোন করব।’ বিছানা ছেড়ে মাটিতে পা দিলাম। এখনও পুরোপুরি ভয়টা শরীর থেকে যায়নি। ঐ অবস্থায় জিনিসপত্র ব্যাগে ঢুকিয়ে পোশাক বদলে নিলাম। শুকনো ক্লান্ত মুখে ভোরের আলো ফোটার আগেই চাঁদনী হোটেল ছেড়ে রাস্তায় পা রাখলাম। বাইরে কুয়াশা ঢাকা দিল্লি। আমি চলেছি হোটেল ডি হর্সের দিকে। যেন শ্মশান ফেরত এক যাত্রী।
নোট নিতে এবং টেক্সট হাইলাইট করতে লগইন করুন
লগইন