শঙ্কর চ্যাটার্জী
প্রথম পর্ব
আবীর আদিসপ্তগ্রাম থেকে ফিরছিল ওর মোটর বাইকে চড়ে। কিছু ফুলের চারা আনতে গিয়েছিল গুরুপুর নার্সারি থেকে। শীতের সন্ধ্যে তাড়াতাড়ি নামছে। আবীরের বেশ কিছু গুণ আছে, যেমন — পরিপাটি করে বাগান সাজানো, অবসর সময়ে ছবি আঁকা। এক বছর হল ব্যাংকে চাকরি পেয়েছে সে। হিরো হিরো চেহারা তার। জি টি রোড ধরে ফিরছিল সে। রাস্তার দু’ধারে ফাঁকা মাঠ… ধানগুলো কাটার ফলে ধু ধু করছে। শীতের কুয়াশা মাঠময় ছড়িয়ে আছে। বেশ ঠান্ডা লাগছে। রাস্তাটাও আজ ফাঁকা। রাস্তার ধার ঘেঁষে বাইকটাকে থামাল। বক্সে সোয়েটার আছে। সোয়েটার পরতে গিয়ে চোখে পড়ল মাঠের পাশে দু’তিনটে আম গাছে ঘেরা একটা পোড়ো বাড়ি। সূর্য ডুবে গেলেও এখনও তার দু’-একটা ম্লান বিচ্ছুরিত রশ্মি কুয়াশা ভেদ করে বাড়িটার ওপর পড়ে এক মায়াবী পরিবেশের সৃষ্টি হয়েছে। আবীরের শিল্পী মন জেগে উঠল। মনে হল কোনো বিরাট শিল্পীর আঁকা একটা ক্যানভাস! মুগ্ধ হয়ে গেল সে। মনে মনে ভাবল প্রকৃতির থেকে বড় শিল্পী আর কেউ হয় না। এই মনোমুগ্ধকর ছবি তাকে আঁকতেই হবে। রাস্তার পাশে একটা ছোট নর্দমা ডিঙিয়ে সে পায়ে হেঁটে এগিয়ে চলল বাড়িটার দিকে। সামনে থেকে কয়েকটা ছবি মোবাইলে তুলে রাখবে। তারপর সময় পেলে রং-তুলি দিয়ে ছবি আঁকবে।
কিন্তু পরিত্যক্ত বাড়িটার কাছে এসে আবীরের তেমন ভালো লাগল না। কোনো কালে সাদা রং করানো হয়েছিল। এখন জায়গায় জায়গায় সবজে শ্যাওলার ছোপ। বাড়ির সামনে কিছু আগাছার ঝোপ। ভেবে পেল না মাঠের মাঝখানে এই বাড়ি করার উদ্দেশ্যটা কী! জায়গাটাও স্যাঁতসেঁতে। এসেই যখন পড়েছে… দিনের আলো থাকতে থাকতে কয়েকটা ছবি তুলে নেওয়া যাক। আবীর মোবাইলের স্ক্রিনে চোখ লাগিয়ে বাড়ির পুরো একটা ছবি তুলল। এর পরেই বাড়িতে ঢোকার চওড়া সিঁড়ির ওপর চোখ পড়তে অবাক হল। একটা কুড়ি-একুশ বছরের মেয়ে আনমনে আকাশের দিকে তাকিয়ে বসে আছে। যেন কত কী চিন্তা করে চলেছে। মেয়েটা দেখতে খারাপ নয়। তার ওপর আধুনিকাদের মত কালো গেঞ্জি আর নীলচে জিনস পরে আছে। চিত্রকরের চোখে ছবিটা ভালই লাগল। মনের মধ্যে ছবির একটা ক্যাপশন তৈরী করে ফেলল সে। ধ্বংসাবশেষের ওপর নতুন প্রাণ!
বাড়িটাকে ছবিতে আরও জরাজীর্ণ করে সে আঁকবে। এবার মেয়েটার দিকে তাকাতে তার চোখে সে দেখল অসন্তোষের ছায়া! স্বাভাবিক, একা বসে থাকা সুন্দরী তরুণীর অজান্তে ছবি তোলা আপত্তিজনক ব্যাপার। আবীর ঠিক করল মেয়েটি যদি আপত্তি জানায়, সে ডিলিট করে দেবে। আবীর জিজ্ঞেস করার আগেই মেয়েটি দাঁড়িয়ে উঠল। তারপর সরু রাস্তা ধরে বাড়ির পিছন দিকে চলে গেল।
এখানে সন্ধ্যের অন্ধকারে আর দাঁড়িয়ে থাকা ঠিক মনে করল না আবীর। হয়তো পাশে কোথাও মেয়েটার বাড়ি। ডেকে লোক জড়ো করতে পারে! বেইজ্জত হতে কতক্ষণ? ও পা চালিয়ে বাইকের দিকে চলল। রাস্তায় উঠে বাইক স্টার্ট দেবার সময় পর্যন্ত কাউকে এগিয়ে আসতে দেখল না। তাহলে মেয়েটা কিছু মনে করেনি — তারই মনের ভুল। বাইক দ্রুত গতিতে এগিয়ে চলল। কিন্তু মেয়েটার চোখে রাগের ভাষা ও ভুলতে পারল না। বাড়িতে এসে পৌঁছল আবীর। একটা ঝামেলা থেকে খুব জোর বাঁচা গেছে।
রাত্রে শোবার আগে ছবিটা দেখল। মনের কল্পনায় ক্যানভাস সাজাল। অস্বাভাবিক ভাবে মেয়েটার মুখ তাকে আকর্ষণ করছে। তাহলে কি সে প্রেমে পড়ে গেল? ব্যাঙ্কে টিফিনের সময় ইচ্ছে হল মেয়েটাকে একটু দেখে। যেন খুব চেনা! মোবাইলের গ্যালারি খুলে ও চমকে উঠল। অবাস্তব ব্যাপার! পুরনো বাড়িটার ছবিতে সব কিছু আগের মতো আছে। শুধু চওড়া সিঁড়িতে বসে থাকা সুন্দরী মেয়েটা নেই। যেন রবার দিয়ে ওকে কেউ মুছে দিয়েছে! মনে হল একটু আগে বসে থাকা মেয়েটা অদৃশ্য হয়ে গেছে। দু’-তিনবার ঘুরিয়ে ফিরিয়ে দেখেও কোনো সমাধান করতে পারল না। আবীরের চোখে মুখে চিন্তার ছায়া পড়ল। তার সামনে কেউ যেন বিরাট এক ধাঁধার বোর্ড ঝুলিয়ে দিয়েছে। অফিসের কাউকে এই অবাস্তব কথা বলাও যায় না। এদিকে এই রহস্যময় কান্ড ওকে চিন্তার সাগরে ফেলে দিল। তাহলে কি মেয়েটাকে ছাড়াই ও ছবি তুলেছে? কিন্তু স্পষ্ট মনে আছে ওর। কাল রাত্রেও তো মেয়েটার ছবি ঘুরিয়ে-ফিরিয়ে দেখেছে।
আবার মোবাইল খুলে গ্যালারি থেকে ছবিটা বার করে। নিশ্চুপ ভাঙা বাড়িটা শুধু দাঁত বার করে দাঁড়িয়ে আছে। আবীরের মাথাটা ধোঁয়াশা হয়ে যাচ্ছে। অফিস কলিগ শ্ৰীমন্ত বলে উঠল, ‘কী দেখছিস এত মনোযোগ দিয়ে? কোনো পর্নো ছবি?’
আবীর শুকনো হাসি হাসল, ‘পর্নো হলে ভালো হত।’
আবীর চেয়ার ছেড়ে উঠে ক্যান্টিন থেকে বেরিয়ে আসে। কাজে মন বসে না। খালি মাথায় ঘুরপাক খাচ্ছে মেয়েটার ছবি। এমনকি ওর গায়ের কালো হাতকাটা গেঞ্জিটা পর্যন্ত চোখের সামনে ভেসে উঠছে! তাহলে সবই কি তার চোখের ভুল? কোনোরকমে কাজ সেরে বাড়ি ফিরল সে।
মা মুখের দিকে তাকিয়ে প্রশ্ন করলেন, ‘তোর কী হয়েছে? কপালে চিন্তার রেখা! অফিসে কোনো ঝামেলা হয়নি তো?’
আবীর বুঝল, চিন্তার ছাপ নিশ্চয়ই তার চোখে-মুখে পড়েছে। মৃদু হেসে সে এড়িয়ে যায়।
রাত্রে বিছানায় শুয়ে অত্যাশ্চর্য ঘটনার কথাটা ভেবে চলে আবীর। এর রহস্য যতক্ষণ না ভেদ হচ্ছে সে শান্তি পাবে না। দরকার পড়লে আবার সেই বাড়িটায় যাবে। যদি মেয়েটার দেখা পায়! ঘুমোবার আগে শেষবারের মত ফোনের গ্যালারি খোলে। পরক্ষণেই চমকে ওঠে! এই তো সেই মেয়েটা — আগের মতো সিঁড়ির চাতালে বসে আছে। চোখ দুটো রগড়ে নিয়ে নিঃসন্দেহ হয়। তাহলে এতখানি সময় ছবি থেকে ও কোথায় অদৃশ্য হয়ে গিয়েছিল? এটা কি তার মনের ভুল? তাহলে নিঃসন্দেহ হওয়ার জন্য অন্য কাউকে ছবিটা দেখাবার প্রয়োজন। ভাবল উঠে মাকে ছবিটা দেখায়। কিন্তু সময় দেখল রাত সাড়ে এগারোটা। এত রাত্রে মামুলি একটা ছবি দেখাতে গেলে বাবা-মায়ের মনে অন্য সন্দেহ দেখা দেবে। ভাববে ছেলে নিশ্চয়ই প্রেমে পড়েছে ! ছবিটা জ়ুম করে মেয়েটাকে দেখতে থাকল আবীর। বাদামি গায়ের রঙ। সরু ভ্রু দুটো যেন তুলি দিয়ে আঁকা। চোখ দুটো মাঝারি, কিন্তু মণি দুটো ঘন কালো। ঠোঁট চাপা, একটু মোটা ধরণের। মুখের সাথে মানানসই নাক। কালো টাইট গেঞ্জিতে বুকের গঠন পুরো বোঝা যাচ্ছে। পুরো ছবিটা মনের ক্যামেরায় তুলে ফেলল আবীর। তারপর মোবাইল অফ করে ঘুমিয়ে পড়ল। মেয়েটা ফিরে আসাতে যেন স্বস্তি পেল।
দ্বিতীয় পর্ব
কিন্তু সে একবারও গভীর ভাবে চিন্তা করল না মেয়েটা পুনরায় ছবিতে ফিরে এল কিভাবে? যদি তখনি এই চিন্তা করত, তাহলে এই কাহিনী হয়ত বেশি বড় হত না।
সকালে অফিস যাবার তাড়াতাড়িতে আবীরের মাথা থেকে ছবির কথা বেমালুম উধাও হয়ে গেছে। মা পর্ণা দেবী ছেলের মুখ স্বাভাবিক দেখে সন্তুষ্ট হলেন। অফিসে এসে আবীর ভাবল — আজ বাড়ি গিয়ে রং-তুলি নিয়ে বসতে হবে। ভাবনার সাথে সাথে ছবিটা ওর মস্তিষ্কে ধরা পড়ল। অফিসে এখনও বেশি কেউ আসেনি। ছবির সুন্দরী মেয়েটা ওর মনকে আকর্ষণ করতে লাগল। শরীরে এক উত্তেজনার ঢেউ খেলে গেল। মেয়েটা এখনও ছবির মধ্যে আছে তো? চিন্তাটা মাথার গভীরে কিলবিল করে উঠল। ফোন অন করে ছবি দেখার জন্যে উদগ্রীব হয়ে পড়ল আবীর।
ছবি দেখেই মোবাইল ধরা হাতটা অল্প কেঁপে উঠল। গতকালের ঘটনার পুনরাবৃত্তি ঘটেছে। মেয়েটা কর্পূরের মতো উবে গেছে! এই প্রথম ওর মনে ভয় ঢুকল। কেমন একটা গা ছমছমে অনুভূতি দেহে ছড়িয়ে পড়ল। বুদ্ধি দিয়েও এর কোনো ব্যাখ্যা খুঁজে পাচ্ছে না।
এই সময় অফিস কলিগ নীরা চেয়ারের পিছন থেকে বলে উঠল, ‘অত মনোযোগ দিয়ে কী দেখছ?’
আবীর খেয়াল করেনি নীরাকে। তাই চমকে উঠল। আর একটু হলে হাত থেকে মোবাইলটা পড়েই যাচ্ছিল। নীরা আবীরের মুখ দেখে বলল, ‘তোমার কি কিছু হয়েছে? মুখটা চকখড়ির মতো সাদা!’
নিজেকে সংযত করে আবীর। মুখে এক চিলতে হাসি ঝুলিয়ে রাখে, ‘না না, তেমন কিছু নয়।’ গা ঝাড়া দিয়ে উঠে পড়ে। নীরার কাছাকাছি থাকলে সে তার অস্বাভাবিকতা ধরে ফেলতে পারে। টয়লেটে যায় মুখে—চোখে জল দেবার জন্য। মাথা থেকে তাড়াতে চেষ্টা করে অদ্ভুত চিন্তাগুলো। নাহলে কাজে ভুল হয়ে যেতে পারে। স্থির করে নেয়, এই রহস্য যত শীঘ্র সম্ভব সমাধান করতে হবে। কিন্তু কিভাবে সেটা মাথায় এল না।
এক রাশ চিন্তা নিয়ে বাড়ি ফিরল সে। সবকিছু জট পাকিয়ে যাচ্ছে তার কাছে। রাত্রে শোবার আগে নতুন একটা চিন্তা মাথায় এল আবীরের। মেয়েটা জীবিত? না মৃতা? ঘটনা যেদিকে গড়াচ্ছে, তাতে মনে হচ্ছে ও মৃতা! ভয়টা পাকে পাকে জড়াতে শুরু করল তাকে। সত্যি মিথ্যে জানতে গেলে তাকে যেতে হবে ঘটনাস্থলে। মনস্থির করে নেয় আবীর। কাল সকালে অফিসের নাম করে বেরিয়ে ও যাবে আদিসপ্তগ্রামের ঐ ভাঙা বাড়িটায়। আশেপাশের লোককে জিজ্ঞেস করে জানতে হবে মেয়েটার পরিচয়। কিন্তু মেয়েটাকে চেনাবে কী করে সবাইকে? কেননা সকালে মেয়েটা অদৃশ্য থাকে। আর রাত্রিবেলা ওখানে যাওয়া? অসম্ভব! আগে সকালে যাওয়া যাক, তারপর দেখা যাবে। চোখ বোজার আগে ফোনটা খুলল। এটা নেশার মতো হয়ে গেছে! একবার ওর ঐ সুন্দর মুখ দেখা চাই।
কিন্তু ফোন খুলে অবাক হয়ে গেল! মেয়েটা নেই। ও বিছানায় উঠে বসল। এই রকম তো হয় না! রাত্রে ফোন খুললে তার দেখা পাওয়া যায়! তাহলে কি রহস্য কাটল?
আচমকা হালকা পায়ের শব্দ ওর কানে এসে পৌঁছল। কেউ যেন লুকিয়ে-চুরিয়ে এগিয়ে আসছে। মোবাইলের স্টিল ছবিটা যেন ভিডিও হয়ে উঠেছে। পরিষ্কার সে দেখতে পাচ্ছে… ঝোপের জঙ্গলের মধ্যে থেকে মেয়েটা ধীর পায়ে বেরিয়ে আসছে। যেন একটা সাদা ধোঁয়ার কুন্ডলী! তারপর কালো গেঞ্জি পরা মেয়েটা সেই নির্ধারিত স্থানে এসে বসে পড়ল। সঙ্গে সঙ্গে ছবিটা আগের মতো স্থির হয়ে গেল। আবীরের ইন্দ্রিয়গুলো শিথিল হতে শুরু করল। মস্তিষ্কের গভীরে শিরা-উপশিরাগুলো ভয়ে নাচতে লাগল। ও যে কল্পনায় সবকিছু দেখছে না ভালভাবেই বুঝতে পারল। সেই জন্য মনের ভয়টা চতুর্গুণ বেড়ে গেল। হৃদপিন্ডের কাঁপুনি নিজের কানে শুনতে পাচ্ছে। হাতের মোবাইলটা যেন কিলবিল করছে মুঠোর মধ্যে। ওটাও যেন জ্যান্ত হয়ে গেছে। মোবাইলটা ছুঁড়ে বিছানায় ফেলে দিয়ে খাট ছেড়ে নেমে এল। ঘরের টিউবলাইটটা জ্বালাতে মনের ভয় একটা আড়ালে লুকিয়ে পড়ল। বোতল থেকে কয়েক ঢোঁক জল খেয়ে একটু সুস্থ বোধ করতে লাগল।
ফোনে যা দেখল কাউকে বলতে গেলে তার মাথার স্বাভাবিকতা নিয়ে প্রশ্ন এসে যাবে। মেয়েটা যে জীবন্ত নয় একটু আগেই সে জানতে পেরে গেছে। তবু কাল ওখানে যেতে হবে। পুরো ঘটনা ওকে জানতে হবে। ঘড়ির দিকে তাকাল। রাত্রির বয়স ইতিমধ্যে অনেক বেড়ে গেছে। একটু ঘুমোতে হবে। অবশ্য জানে না ঘুম আসবে কি না!
তখনই তার মনের শিল্পী সত্তা জেগে উঠল। মেয়েটার একটা ছবি অতি সহজে সে এঁকে ফেলতে পারবে। তাহলে সেই ছবি দেখে কেউ না কেউ চিনবে। পত্রপাঠ বের করে ফেলল কাগজ-পেন্সিল। ঘরের এক কোণে রাখা ইজেলের কাছে গেল। তার মন জুড়ে রয়েছে মেয়েটির সুন্দর মুখখানা। মগ্ন হয়ে গেল ছবি আঁকায়। শেষ রাত্রির দিকে হুবহু মেয়েটাকে এঁকে ফেলল। ক্লান্ত শরীরটাকে এবার বিছানায় এনে ফেলল।
সকালের দিকে মাকে বলল, ‘আজ অফিস যাব না। এক বন্ধুর বাড়ি যাচ্ছি। বেলায় এসে খাওয়া-দাওয়া করব।’
মা-বাবা দু’জনেই লক্ষ করলেন আবীরের চোখ দুটো করমচার মতো লাল। দেখে মনে হবে রাত জাগার ফল। ওঁরা কিছু প্রশ্ন করার আগেই আবীর মোটর বাইকে স্টার্ট দিল।
কৌতূহলী মন নিয়ে জি টি রোড ধরে এগিয়ে চলল পুরনো, জীর্ণ একা দাঁড়িয়ে থাকা বাড়িটার দিকে। যত এগিয়ে আসছে তত মনের মধ্যে চঞ্চলতা বৃদ্ধি পাচ্ছে। দূরে চোখে পড়ছে দাঁত বার করা বাড়িটা। একটু আগে রাস্তার ধারে চোখে পড়ল গুমটি চায়ের দোকানটা। যদি কোনো খবর পাবার থাকে এটাই আদর্শ স্থান। দোকানের সামনে এসে দাঁড়াল। যেন চা-তেষ্টা পেয়েছে। সবে সাড়ে আটটা। শীতের আমেজ। হালকা সূর্যের আলোয় ভাল লাগছে। এক কাপ চা বানাতে বলল। বেঞ্চে দু’জন মাঝবয়সী লোক বসে আছে খবরের কাগজ নিয়ে। দোকানি ইয়ং ছেলে। আবীরের থেকে দু’-এক বছর কম বয়সী হবে। ও জানে কমবয়সী ছেলেরা এসব খবর রাখে। বিশেষ করে সুন্দরী মেয়েদের। মনে মনে একটা গল্প বানিয়ে রেখেছে আবীর। একটু অপেক্ষা করছে যদি দুটো খদ্দের কেটে পড়ে তাহলে কথা বলার সুবিধে। নাহলে এক্ষুণি পাঁচকান হবে।
স্পেশাল চা আর বিস্কুটের অর্ডার দেবার জন্যেই বোধহয় দোকানের মালিক খবরের কাগজ পড়া দু’জনকে বলে উঠল, ‘কাকা, আমাকে এবার বেচাকেনা করতে দাও। কাগজ তো মুখস্থ হয়ে গেল।’
ওরা অনিচ্ছাসত্ত্বেও উঠে দাঁড়াল। যাক, সুযোগটা অযাচিতভাবে এসে গেল।
‘ভাই, দূরে যে ভাঙা বাড়িটা রয়েছে ওখানে লোক থাকে না?’ আবীর তদন্তে নামল।
ছেলেটা চা তৈরী করতে করতে ওর দিকে তাকাল, ‘আগে থাকত। এখন ভূতের বাড়ি।’ ছোট্ট জবাব।
— ‘ভূতের বাড়ি?’ পায়ের ওপর পা তুলে কথাটার পুনরাবৃত্তি করল সে।
— ‘সেই রকমই অনেকটা। সাহাদের বাড়ি ছিল। ধান জমি, চাষবাসের ওপর নজর রাখার জন্য তৈরী করেছিল।’ চায়ের কাপে চিনি গুলতে গুলতে বলল ছেলেটা।
— ‘সব ছেড়েছুড়ে গেল কোথায়?’
— ‘সবই কপাল। সাহাদের একমাত্র ছেলেকে সাপে কাটল। তারপরেই এই বনবাদাড় ছেড়ে একেবারে শ্রীরামপুর চলে গেল।’
আবীরের দিকে চা আর বিস্কুট এগিয়ে দিল ছেলেটা। মনমতো কথা এগোচ্ছে না। এখনই কোনো খদ্দের এসে গেলে বাধা পড়বে। জি টি রোড দিয়ে লরিগুলো বেশ দ্রুত গতিতে যাচ্ছে। গাড়ির শব্দের জন্যে কথাগুলো ভালো শোনা যাচ্ছে না।
— ‘আপনার হঠাৎ বাড়িটার বিষয়ে এত ইন্টারেস্ট জাগল কেন ?’ ছেলেটার রোগাটে মুখে কৌতূহল। আবীর একটু সাবধান হল।
— ‘ভাবছিলাম, নিরিবিলি জায়গা। বন্ধুরা মিলে একদিন পিকনিক করতে আসব।’ বিস্কুটে কামড় বসাল।
— ‘ভুলেও অমন কাজ করবেন না। গত বছর ঐ বাড়ির সামনে একটা রেপ কেস হয়েছে। সকালে রক্তাক্ত মেয়েটাকে মরে পড়ে থাকতে দেখে আমরা পুলিশে খবর দিই। এখনও পর্যন্ত কোনো শালা ধরা পড়েনি।’
আবীর একটা সূত্র পেল। মুখে সুপ্ত উত্তেজনা দেখা দিল। গরম চায়ে চুমুক দিয়ে বলল — ‘মেয়েটার কোথায় বাড়ি?’
— ‘ব্যান্ডেলে।’
পকেট থেকে আঁকা ছবিটা বার করে ছেলেটাকে দেখাল। ছবি দেখে চোখ দুটো বড় বড় হয়ে উঠল দোকানির ।
— ‘হ্যাঁ এই তো, আপনি কি পুলিশের লোক?’ ছেলেটার চোখে একটা ভয় ভয় ভাব।
চা শেষ করে উঠে দাঁড়ায় আবীর, ‘না। আমার বোনের বান্ধবী ছিল ও। ছবি আঁকতে দিয়েছিল আমায়। শুনেছিলাম খারাপ খবরটা। ওর নাম ছিল পারমিতা।’
ইচ্ছে করে বানিয়ে নামটা বলল।
— ‘ভুল বলছেন। মেয়েটার নাম ছিল অনিন্দিতা।’ আবীরের চাল কাজে লেগে গেল। আসল নাম জানতে পারল।
— ‘ঠিক ঠিক, অনিন্দিতা। কিন্তু এই বাড়িতেই ঐ নারকীয় ঘটনা ঘটেছিল জানতাম না। মনটা খারাপ হয়ে গেল।’ পয়সা মিটিয়ে দিয়ে বাইকে চড়ল।
এরপর তার কী করণীয়? এক অজানা বিপদের মাঝে সে পড়ে গেছে। কিভাবে বেরোবে এই ভৌতিক জাল থেকে? কপালে চিন্তার ভাঁজ। আর মনে আতঙ্কের কালো ছায়া !
তৃতীয় পর্ব
বাড়িতে ঢুকেই আবীর নতুন সমস্যায় পড়ল। দেখে মা বিছানায় শুয়ে। বাবা মায়ের পায়ে বরফ ঘষছে।
উদ্বিগ্ন কণ্ঠে আবীর প্রশ্ন করল, ‘কী হল?’
বাবা উত্তর দিলেন, ‘তোর ঘর পরিষ্কার করতে গিয়ে চৌকাঠে হোঁচট লেগে এই কান্ড।’ ও দেখল পায়ের বুড়ো আঙ্গুলটা বেশ লাল হয়ে ফুলে উঠেছে।
— ‘ভাঙেনি তো?’
মা বলে ওঠেন, ‘তাহলে খুব যন্ত্রণা হত। তুই চিন্তিত হোস না। টেবিলে তোর জলখাবার রাখা আছে।’ খাবার ইচ্ছেটা চলে গেছে। কাঁধ ঝাঁকিয়ে ও টেবিলের দিকে এগোল।
বাবা বলে, ‘হঠাৎ অফিস কামাই করলি? বন্ধুর বাড়িতে কিছু বিশেষ প্রয়োজন ছিল?’ দায়সারা গোছের একটা জবাব দিল সে।
খানিক বাদে মা উঠে প্রায় নেংচে আবীরের ঘরে এলেন। ও তখন একমনে মোবাইলের ছবিতে খালি বাড়িটা দেখছে।
— ‘তুমি আবার ঐ পায়ে এক্ষুণি হাঁটাহাঁটি করছ কেন?’
— ‘শুয়ে থাকলে চলবে আমার?’ খাটে আবীরের পাশে বসলেন মা। ছেলের পিঠে হাত রেখে বললেন।
— ‘দেখ আবীর, আমি তোর মা। আমাকে কিছু লুকোস না। কয়েকদিন ধরে লক্ষ্য করছি তুই কোনো ব্যাপার নিয়ে চিন্তিত। আমাকে খুলে বল।’
আবীর একবার ভাবল বলে দেয় ঐ অদ্ভুত ছবির কথা! কিন্তু নিজেকে সামলে নেয়। সে জানে মা এইসব ভূত-প্রেত তন্ত্র-মন্ত্র খুব বিশ্বাস করে। তাছাড়া একটু আগে হোঁচট খেয়েছে। ভাববে এসব মেয়েটার বিদেহী আত্মার কারসাজি।
— ‘তুমি অহেতুক ভাবছ। সেরকম কিছু হলে আগে তোমাকেই বলব। আমি বরং ভাবছি তোমার পায়ের একবার এক্স রে করে নিয়ে আসি।’
— ‘দরকার হবে না।’ পর্ণা দেবীর মুখে তবু চিন্তার ভাঁজ। আবীর সেটা লক্ষ্য করল।
— ‘এখনও কী চিন্তা করছ?’ হেসে বলে সে।
— ‘একটা কথা বলব ? জানি তুই হাসবি।’
— ‘হাসব কেন?’
— ‘সকালে তোর ঘরের সামনে দিয়ে যাবার সময় একটা পচা দুর্গন্ধ নাকে এসে লাগে। ভাবলাম কোনো টিকটিকি মরেছে তাই এসে ঢুকেছিলাম।’
মায়ের কথা শুনে আবীরের চোখে সুপ্ত উত্তেজনা তৈরি হল।
পর্ণা দেবী বললেন, ‘আচমকা কেউ যেন আমায় ধাক্কা মারল।’ তাঁর কণ্ঠে ভয়ের স্পর্শ, ‘তোর বাবাকে এ কথা বলতে পারিনি। এখনই হাসবে। সত্যি বলছি তোকে, এতটুকু বানিয়ে বলছি না।’
আবীরের বুকে একটা হিমেল বাতাসের স্রোত বয়ে গেল। হারানো সূত্রগুলো যেন একে একে এসে জড়ো হচ্ছে। তার মনের সাহস একটু একটু করে কমছে। কয়েকদিনের ঘটনা এখন মাকে বলা মানে… এদিকে আর কিছু সময় বাদে নতুন একটি রাত্রের মুখোমুখি হতে হবে তাকে। একেবারে একলা! এখনও সে তেমন ভাবে ভেঙে পড়েনি। কিন্তু মায়ের কথা শুনে তার স্নায়ুগুলো ভেঙে চুরে যেতে কতক্ষণ?
— ‘আ-আমার মনে হয় তুমি ভুল করছ। সকালবেলায় তোমায় কে ঠেলে ফেলে দেবে?’
আবীর কথাটা বলল বটে কিন্তু তার গলায় শক্তির অভাব।
সেদিন রাত্রে অনিচ্ছাসত্ত্বেও নিজের ঘরে ঢুকল আবীর। অন্য ঘরে শুতে চাইলে আগে মা-ই সন্দেহ করত। ঘরের দরজা বন্ধ করতেই মনে হল বাইরের জগৎ থেকে সে বিচ্ছিন্ন হয়ে গেছে। ঘরের লাইট বন্ধ করতে গিয়েও থেমে গেল। অন্ধকারের রাজ্যে প্রবেশ করতে মন সায় দিল না। ধীর পায়ে খাটে এসে বসল। ফোনটা হাতে নিতেই মনে হল ঠান্ডা একটা অজগর সাপ ছুঁয়ে ফেলেছে। বুঝতে পারছে তার বুকের সাহস এরই মধ্যে তলানিতে ঠেকেছে! ঠাকুরকে স্মরণ করল। এরপর যেন কোনো বিভীষিকার সে সম্মুখীন না হয়! তাহলে তার মোকাবিলা সে করতে পারবে না। আবীর বিছানায় বসে রইল। মাথার গভীরে উদ্ভট দৃশ্যগুলো জোর করে টেনে এনে তার চোখের সামনে কেউ মেলে ধরছে। আসলে কোনো অদৃশ্য শক্তি তাকে ক্রমশ দুর্বল করে দেওয়ার চেষ্টা করছে। বাইরের ঠান্ডার থেকে ঘরের মধ্যের শীতলতা যেন কয়েকগুণ বেশি। এই সময় ইজেলের দিকে চোখ পড়ল। ভয়ার্ত বিস্ময়ে দেখল আঁকার স্ট্যান্ডে আটকানো রয়েছে অনিন্দিতার ছবি! এই ছবি তো সে নিজের হাতে কাল এঁকেছিল। অসম্ভব! এ কীভাবে হতে পারে! ছবিটা তো নিচতলায় তার ব্যাগের মধ্যে আছে। অথচ তার অজান্তে ছবিটা এখানে এল কীভাবে? বুদ্ধি ক্রমশ ভোঁতা হয়ে যাচ্ছে। তবে কি মৃতা অনিন্দিতার আবির্ভাব ঘটছে? কথাটা মনে হতেই আবীরের হৃদপিন্ডটা দ্রুত তালে চলতে শুরু করল।
ছবির দিকে সম্মোহিতের মতো তাকিয়ে রইল। পেন্সিল দিয়ে সাদা কাগজে আঁকা ছবিতে আস্তে আস্তে রং ধরছে! শুধু মুখমণ্ডলের জায়গায় নতুন করে হাত পা গজাচ্ছে! ফিরে আসছে কালো গেঞ্জি পরা অনিন্দিতা। আবীর ভাবছে কতক্ষণ এই দৃশ্য বসে বসে সে দেখতে পারবে? আলো ভর্তি ঘরে এক অদ্ভুত নীরবতা বিরাজ করছে। আবীরের সারা দেহ যেন বরফের মতো জমাট বেঁধে গেছে। হাত-পা সব পাথরে পরিণত হয়ে যাচ্ছে। নড়াচড়ার ক্ষমতাটুকু পর্যন্ত ও হারিয়ে ফেলেছে।
মোবাইলে রাখা ছবিটা পুরোপুরি ছবি আঁকা স্ট্যান্ডে এসে গেছে। আবীরের চোখ সতর্ক হল। মেয়েটা অল্প অল্প নড়ছে। যে কোনো মুহূর্তে ছবি থেকে বেরিয়ে আসবে। আবীরের ষষ্ঠ ইন্দ্রিয় ওকে বিপদের সতর্কতা জানাল। অনিন্দিতা একটা পা মেঝেতে রাখার সঙ্গে সঙ্গে আবীর বিকট আর্তনাদ করে উঠল। সেই ভয়ার্ত আর্তনাদ পাশের ঘরে শুয়ে থাকা পর্ণা দেবীর কানে পৌঁছল।
দরজা ধাক্কার শব্দে আবীর যেন বাস্তবে ফিরে এল। কোনো রকমে উঠে দরজা খুলে দিল। ওর বাবা-মা ছেলেকে দেখে ভয় পেয়ে গেলেন। আবীরের মুখটা যেন একটা ভয়ের মুখোশ হয়ে গেছে! অত বড় ছেলে বাচ্চার মতো মায়ের কোলে ঝাঁপিয়ে পড়ল। বাবা-মা দুজনে ধরে ওকে নিজেদের ঘরে নিয়ে গেলেন। আবীরের মুখ দিয়ে গোঙানি ছাড়া কিছু বেরোচ্ছে না।
ওঁরা বুঝতে পারছেন, কোনো কারণে অত্যধিক ভয় পেয়েছে আবীর। ও স্বাভাবিক না হলে কিছু জানা যাবে না। জল খেয়ে খানিকটা ধাতস্থ হল আবীর। ও দেখল আর লুকিয়ে লাভ হবে না। কেননা এই কয়েক দিনে অনিন্দিতার আত্মা শক্তি বাড়িয়ে নিয়েছে। মোবাইলের মধ্যে যে ছিল আবদ্ধ সে এখন বাইরে বেরিয়ে এসেছে। এরপর আরও কতখানি অগ্রসর হবে জানা নেই।
ঠান্ডার কাঁপুনি এখনও শরীর থেকে দূর হয়নি। সেই অবস্থাতেই ও পুরো ঘটনাটা বলল। সব শুনে পর্ণা দেবীর বুকটা আতঙ্কে হিম হয়ে উঠল। মাঝরাত্রে চারিদিকে একটা ভয়ের থমথমে ভাব। বাবা শ্যামলবাবুর মনেও কিছুটা অস্বস্তি দেখা দিল। তবু কিছুটা অবিশ্বাস এখনও মনে রয়েছে।
তিনি বললেন, ‘তুই মায়ের সঙ্গে এখানে শুয়ে পড়। আমি তোর ঘরে গিয়ে শুয়ে পড়ছি।’
পর্ণাদেবী বাধা দিলেন, ‘তুমি বেশি সাহস দেখিও না। অবিশ্বাস সব ক্ষেত্রে ভালো নয়। আমিও আজ সকালে এইরকম কিছু আন্দাজ করেছিলাম।’
— ‘অন্তত ওর ঘরের আলোটা অফ করে দিয়ে আসি।’
আবীর কিছু একটা বলতে যাচ্ছিল। তার আগেই পাশের ঘরে উনি চলে গেলেন। মা ও ছেলে কান খাড়া করে রইল। ওরা কি নতুন কোনো বিপদের আশঙ্কা করছে?
শ্যামলবাবুর মনেও একটা সন্দেহ দানা বেঁধেছে। আবীরের ঘরে ঢুকতে সতর্কতা অবলম্বন করলেন। মন বড়ই অদ্ভুত বস্তু। কখন নিজের অগোচরে ভয় জিনিসটা ঢুকে পড়ে বোঝা যায় না। আলো জ্বলা ঘরে ঢুকতেই শ্যামলবাবুর চোখের সামনে দিয়ে কেউ যেন সাঁৎ করে আলমারির আড়ালে লুকোল। থমকে গেলেন উনি। এক মুহূর্ত দাঁড়িয়ে রইলেন। তবে কি তাঁর মনেও বিকার ঢুকে গেছে?
সন্তর্পণে এগিয়ে এসে আলমারির পাশটা দেখলেন। নেই… কেউ নেই। বিলকুল ফাঁকা। ছবি আঁকার স্ট্যান্ডে কোনো ছবি দেখতে পেলেন না। বিছানায় পড়ে থাকা ছেলের মোবাইলটা তুলে নিয়ে গ্যালারিটা দেখতে গিয়ে শরীরে এক শিহরণ খেলে গেল! মনে হল তার পিছনে কেউ দাঁড়িয়ে মুখ বাড়িয়ে ছবিটা দেখার চেষ্টা করছে। মাথা ঘুরিয়ে দেখার চেষ্টা করেও ব্যর্থ হলেন।
ফাঁকা ঘরে তিনি একাকী দাঁড়িয়ে আছেন। কিন্তু বেশ বুঝতে পারছেন অন্য কারো উপস্থিতি। যে এই মুহূর্তে সম্পূর্ণ অদৃশ্য। বুকের স্পন্দন ইতিমধ্যে দ্রুততর হয়েছে। ফোনটা রেখে তাড়াতাড়ি ঘর ছেড়ে বেরিয়ে এলেন। এমনকি আলোটা পর্যন্ত নেভাতে ভুলে গেলেন।
এরপর তিনজনে মিলে ঘরে বসে অপেক্ষা করে চলল ভোরের জন্যে। ছোটখাটো খুটখাট শব্দও বুকের মাঝে শিহরণের ঢেউ তুলছে। পর্ণা দেবী মনে মনে ঈশ্বরের নাম জপ করে চলেছেন।
আবীর বলল, ‘আমার ব্যাঙ্কের এক কাস্টমার চন্দন লাহিড়ীর মামা রুদ্রনাথ চট্টোপাধ্যায় কামাখ্যার একজন নামকরা তান্ত্রিক। চন্দনদার মুখে শুনেছিলাম ওর মেয়েকে এইরকম বিপদ থেকে মামা বাঁচিয়েছিলেন।১ আমি কাল সকালেই ওঁকে ফোন করব। নিশ্চয়ই কোনো সাহায্য পাওয়া যাবে।
চতুর্থ পর্ব
সারা রাত জেগে তিনজনেই ভোরের দিকে ঘুমিয়ে পড়েছিল। পর্ণা দেবীর ঘুম ভাঙল সকাল সাতটায়। দেখল পাশেই বাপ আর ছেলে অঘোরে ঘুমোচ্ছে। সিঁড়ি দিয়ে নিচে নেমে এলেন তিনি। শ্যামলবাবু আজ বাদে কাল রিটায়ার করবেন। তাই জমানো ছুটিগুলো নিয়ে প্রায় এক মাস হল বাড়িতে বসে আছেন। ছেলেও বোধহয় অফিস যাবে না। মুখে ব্রাশ দিয়ে কিচেনের দরজাটা খুলতেই রাতের ভয়টা ফিরে এল।
বাস্কেটে রাখা এঁটোকাঁটা সারা মেঝেতে ছড়ানো ছিটানো রয়েছে। দরজা-জানলা বন্ধ অবস্থায় বিড়াল ঢোকার প্রশ্ন আসে না। তবে? কে এসব করল? তাহলে কি আবীরের বাবা রাত্রে নিচে নেমেছিলেন? এর মধ্যে শ্যামলবাবুও নিচে নেমে এসেছেন।
‘এসব আবার কে করল?’ বিস্ময়ে হতবাক তিনি। পর্ণাদেবীর দু’চোখ জুড়ে ভয় কিলবিল করছে। কর্তা-গিন্নি দুজনেই বিস্ফারিত চোখে দাঁড়িয়ে রইলেন।
— ‘আমার খুব ভয় করছে। না জানি আরও কী কী বিপদ অপেক্ষা করে আছে!’ পর্ণাদেবীর গলা কাঁপছে। শ্যামলবাবু উত্তর দেওয়ার মতো কোনো কথা খুঁজে পাচ্ছেন না। বন্ধ ঘরে এসব কান্ড কে ঘটাবে? ইঁদুর বা ছুঁচো আসাও সম্ভব নয়। কেননা নর্দমায় জালতি দেওয়া আছে।
— ‘আবীর ঘুম থেকে উঠলে ওর চন্দনদাকে ফোন করতে বলছি।’ অন্যমনস্ক ভাবে বলেন শ্যামলবাবু, ‘এসব কথা পাড়ায় রটলেও মুশকিল। এখুনি সব আসবে মজা দেখার জন্য।’
এই সময় আবীর নেমে এল। সবকিছু দেখে শুনে আর অপেক্ষা না করে চন্দন মিত্রকে ফোন করল। ফোনটা স্পিকারে রাখল যাতে বাবা-মাও শুনতে পান।
— ‘কী ব্যাপার, সাতসকালে ব্যাঙ্কবাবু যে!’
— ‘দাদা, তোমায় একটু বিরক্ত করছি। তোমার একটু সাহায্যের প্রয়োজন।’ এরপর আবীর পুরো ঘটনা সংক্ষেপে বলে যায়।
— ‘খুব সাংঘাতিক ব্যাপার। আমার নিজের জীবনের কথা মনে পড়ে যাচ্ছে। এমনই ভয়ঙ্কর অবস্থার মধ্যে পড়েছিলাম। রুদ্র মামা না থাকলে কী যে হত! তোমার কপাল ভালো। মামা এখন এখানেই আছেন। আগামী সপ্তাহে গৌহাটি ফিরে যাবেন। তোমার বাড়ির ঠিকানাটা দাও।’
— ‘চন্দনদা, যেমন করে পারো ওঁকে নিয়ে এসো। আর প্লিজ় ব্যাঙ্কে কিছু জানিও না।’
— ‘এসব কথা কেউ জানবে না। তবে মনে হয় আজ হবে না। এক যজমানের বাড়িতে যজ্ঞের কাজে মামা ব্যস্ত থাকবেন। তবু মামাকে ঘটনাটা জানাচ্ছি। পরে ফোন করছি। ভয় পাবে না। মামা বলেন ঐসব অতীন্দ্রিয় শক্তিকে যত ভয় পাবে, তত ক্ষতি করার শক্তি ওদের বৃদ্ধি পায়।’
ওপ্রান্ত থেকে লাইন কাটার শব্দ এল।
তিনজনের মুখে আগামী বিভীষিকার ছায়া। পর্ণা দেবী রান্নাঘর পরিষ্কার করে স্নান করতে বাথরুমে গেলেন। এমনিতেই বেলা হয়ে গেছে। রাজ্যের সব কাজ পড়ে আছে — কিন্তু কাজ করার শক্তিটাই হারিয়ে গেছে। আবীর চা খেয়ে ব্যাগ থেকে আঁকা ছবিটা বার করল। একই ছবি যেমনটি ও এঁকেছিল! তাহলে কি ও কল্পনায় ঐসব ভয়ঙ্কর দৃশ্য দেখল? মনের মাঝে সত্যি-মিথ্যের আলোড়ন। শ্যামলবাবুর মনে পড়ছে রাত্রে আবীরের ঘরে কারুর অদৃশ্য উপস্থিতির কথা। এই রকম উপলব্ধি কোনোদিন হয়নি জীবনে। পর্ণা দেবী পুজো করতে করতে ভাবছেন, কালকে কেউ যেন ধাক্কা দিয়ে তাকে ফেলে দিল! প্রত্যেকেই অলৌকিক শক্তির উপস্থিতি উড়িয়ে দিতে পারছে না।
কয়েক ঘন্টা বাদে আবীরের ফোন বেজে উঠল। চন্দনদা ফোন করছে।
— ‘হ্যাঁ বলো দাদা।’
— ‘তোমরা তিনজনেই একসঙ্গে আছো নিশ্চয়ই। মামা কিছু কথা তোমাদের বলবেন।’
আবীর সঙ্গে সঙ্গে ওদের ডেকে নিয়ে স্পিকার অন করল। ফোনের ও প্রান্ত থেকে একটা গম্ভীর গলা ভেসে এল।
— ‘আমি রুদ্রনাথ চট্টোপাধ্যায় বলছি। তোমরা হয়তো ভাবছো আমি কোনো জটাধারী হাতে ত্রিশূল গলায় রুদ্রাক্ষ কপালে রক্ত তিলকধারী তান্ত্রিক! কাল যখন তোমাদের বাড়ি যাব তখন ভুল ভাঙব। তোমাদের মতোই সাধারণ মানুষ আমি। মায়ের পুজো আর জপতপে আমার সময় কাটে। চেষ্টা করি তারা মায়ের সাহায্যে মানুষের কিছু উপকার করতে। দেখো, আমি তন্ত্র গ্রন্থ পড়েছি। মারণ, উচাটন, বশীকরণ — এই তিন ক্রিয়া মূলত অভিচার হিসেবে উল্লেখ আছে সেখানে। তলিয়ে দেখলে তিনটি ক্রিয়াই মারাত্মক অপরাধমূলক। একটিতে হত্যা, আরেকটিতে পীড়ন ও শেষেরটিতে ইচ্ছার বিরুদ্ধে কাজ করানোর হুমকি। তিনটে জিনিসকেই আমি মন থেকে মেনে নিতে পারি না। তাই আমাকে তান্ত্রিক ভাবার কোনো কারণ নেই।’
রুদ্রনাথের গম্ভীর কণ্ঠস্বর তাদের মন্ত্রমুগ্ধের মতো আকর্ষণ করতে থাকে।
— ‘আমাদের প্রত্যেকের মনের গভীরে দুটো শক্তি কাজ করে। পজে়টিভ আর নেগেটিভ। পজেটিভ হল ঈশ্বর চিন্তা। আর নেগেটিভ হল ভূত-প্রেত প্রভৃতি। অবশ্য এটা আমার ধারণা। প্রেত বা পিশাচ নেগেটিভ এনার্জি। চন্দনের মুখে যা শুনলাম তাতে এই মুহূর্তে তোমাদের মনে নেগেটিভ শক্তির আধিক্য। তাই অশুভ শক্তি সহজে তোমাদের ঘিরে ফেলেছে। এর থেকে বেরিয়ে আসতে গেলে কী কী করতে হবে মন দিয়ে শোনো।’ উনি একটু থামলেন। তিনজনে কান খাড়া করে আছে।
— ‘তোমরা সকলে শুদ্ধভাবে থাকবে। পরিষ্কার কাচা জামাকাপড় পরবে। বাথরুম থেকে বেরোনোর সময় ভালো করে পা ধোবে। রাত্রে বাথরুমে গেলে একা একা আলো না জ্বালিয়ে চলে যাবে না। বাড়ির ঘরদালানে গঙ্গাজল ছিটিয়ে রাখবে। ধুনো পোড়াবে। এঁটো বাসন জল দিয়ে অন্তত ধুয়ে রাখবে। বাস্কেটে অভুক্ত খাবার ফেললে ভালো করে এঁটে চাপা দিয়ে রাখবে। গায়ত্রী মন্ত্র বা যে কোনো ঠাকুরের নাম জপ করবে। যে তোমাদের দেখা দিচ্ছে তার ছবি বা ফটো বাড়িতে রাখবে না। ফোন থেকে ঐ ছবি এখনই ডিলিট করে দাও। যে ছবি এঁকেছ বাড়ির বাইরে গিয়ে আগুনে পুড়িয়ে দাও। বুঝতে পারছি তোমাদের বাড়িতে প্রেতের প্রবেশ ঘটেছে। ঐ বিষয় নিয়ে বাড়ির মধ্যে কোনো আলোচনা করবে না। কেননা ওরা কান খাড়া করে রাখে। ওদের নিয়ে আলোচনাতে ওরা খুশি হয়। আজ রাত্রে বিশেষ ঘরটাতে শোবে না। তিনজনে একসঙ্গে ঘুমোবে। রাতে তোমাদের ঐ অতৃপ্ত আত্মা নানাভাবে আকর্ষণ করবে। যদি মনে হয় আজ রাত্রিটা অন্য কোথাও কাটাতে পারো। তবে যেগুলো বললাম এখন থেকে পালন করলে প্রেতের শক্তি কিছুটা হ্রাস পাবে। কাল সকালে আমি চন্দনকে নিয়ে যাব। ভালো কথা, আজ নিরামিষ খেয়ো। জয় তারা।’ অপর প্রান্ত নীরব হল।
রুদ্রমামার কথা শুনে ওদের মনে অল্প অল্প করে সাহস ফিরে এল। আবীর ব্যাগ থেকে ছবি বার করে পোড়াতে ছুটল। তারপর এসে মোবাইল থেকে ফটো ডিলিট করে দিল। যেন মনে খানিকটা সাহস ফিরে এল। পর্ণা দেবী অক্ষরে অক্ষরে কথাগুলো পালন করতে থাকলেন। রাত্রে ভালো ঘুম হয়নি বলে দুপুরে একই ঘরে তিনজনে শুয়ে পড়ল। কিন্তু বিকাল হতে পুরনো ভয় ধীরে ধীরে হামাগুড়ি দিয়ে ওদের সামনে এগিয়ে আসতে লাগল।
পর্ণাদেবী একবার বললেন, ‘আজ রাতটা কোনো হোটেলে গিয়ে কাটিয়ে দিই।’
শ্যামলবাবু বলে ওঠেন, ‘বাড়ি ফাঁকা রেখে গেলে চোর চুরি করতে ছাড়বে না। তাছাড়া রুদ্রবাবু তো কালই আসবেন।’
আবীরও বাবার কথায় সহমত জানাল। কাজের লোক বিকালে কাজ করে চলে গেল। পর্ণা দেবী সন্ধ্যে দিয়ে এসে রান্না চাপালেন। বাকি দুজন ডাইনিং রুমের চেয়ারে চুপ করে বসে আছে। যেন কারো আসার প্রতীক্ষায়। আবীর মন থেকে যতই অনিন্দিতার কথা ভোলার চেষ্টা করছে, কেউ যেন জোর করে ওর মগজে অনিন্দিতার মুখের ছবি ঢুকিয়ে দিচ্ছে। আচমকা ওপরে আবীরের ঘরে কিছু পড়ে যাবার শব্দ হল। পর্ণা পর্যন্ত কিচেন থেকে বেরিয়ে এলেন। দেখলেন বাবা আর ছেলে ভয় চকিত চোখে সিঁড়ির দিকে তাকিয়ে আছে। পর্ণা বুঝে গেলেন ব্যাপারটা। তিনিও আতঙ্কিত হয়ে পড়লেন।
‘বলেছিলাম তোমাদের, একটা রাত হোটেলে কাটিয়ে দাও। এখনও সারা রাত্রি পড়ে আছে। এবার না আমি হার্টফেল করে ফেলি!’
‘….শ…শ…শ…শ!’ শ্যামলবাবু ঠোঁটে আঙুল চাপলেন। পর্ণার কানে রুদ্রনাথের কথাগুলো বেজে উঠল। বাড়িতে বসে ওদের আলোচনা একদম করবে না। ওদের কান খুব সতর্ক। এই সময় ওপরের ঘরের মেঝেতে ঠকঠক করে আওয়াজ হতে শুরু করল। কেউ যেন হাতুড়ি দিয়ে পেরেক ঠুকছে! শীতের জন্য জানলাগুলো সব বন্ধ। ওদের নাকে একটা পোড়া গন্ধ এসে ঢুকল। পর্ণা কিচেনে গিয়ে দেখেন কড়ায় বসানো তরকারিটা পুড়ে কালো হয়ে গেছে। গ্যাসটা তাড়াতাড়ি বন্ধ করে দিলেন। আবার নতুন করে রান্না চড়াতে হবে। এদিকে মেঝেতে পেরেক ঠোকার শব্দ ক্রমাগত হয়ে চলেছে। ভয়ে, রাগে, দুঃখে পর্ণা আর নিজেকে সংযত করতে পারলেন না। হাউ হাউ করে কেঁদে উঠলেন।
আবীর এসে মাকে জড়িয়ে ধরল, ‘কেঁদো না। আমরা যত ভয় পাব ওদের তত বেশি শক্তি বৃদ্ধি হবে। আর রান্না চাপাতে হবে না। আজ রুটি আর মিষ্টি খেয়ে নেব। চলো টিভি চালিয়ে দিচ্ছি। মনটা অন্যদিকে থাকবে।’ ড্রয়িংরুমে এসে আবীর আস্থা চ্যানেলটা চালাল। ভজন হচ্ছে। ভলিউমটা বাড়িয়ে দিল। একটু বাদেই ওপরে হাতুড়ির শব্দ বন্ধ হয়ে গেল। ওরা মুখ তাকাতাকি করল।
রাত্রে ওপরের ঘরে শুতে যেতেও কেমন যেন অস্বস্তি হচ্ছে। আবীর ভাবে কী কুক্ষণে ঐ ভাঙা বাড়িতে গিয়েছিল! পর্ণা দেবী আবার কিছু ধুনো জ্বালালেন। সবে সাড়ে সাতটা বাজে। মনে হচ্ছে পাড়া থেকে ওরা বিচ্ছিন্ন হয়ে গেছে। শীতটাও যেন আজ বেশি লাগছে।
পর্ণা দেবী বললেন, ‘তাড়াতাড়ি খেয়ে নিয়ে ওপরের ঘরে চলে যাব। ভগবান আছে, তিনি রক্ষা করবেন।’ সবাই বুঝল মনের ভয় তাড়াতে কথাগুলো বলা।
অন্তিম পর্ব
রাত্রে তিনজনে একসঙ্গে শুয়ে পড়ল। সবে ঘড়িতে দশটা বেজেছে। শীতের রাত, চারিদিকে নিশ্চুপ। এমনিতেই পাড়াটা নিরিবিলি। ওদের কারোর চোখে ঘুম নেই। কান পড়ে আছে পাশের ঘরের দিকে। একটু বাদে কানে এল পাশের ঘর থেকে চাপা কান্নার আওয়াজ। কেউ অব্যক্ত যন্ত্রণায় কাতর স্বরে এক টানা কেঁদে চলেছে।
তিনজনের বুক ভয়ে হিম হয়ে এল। পর্ণা বিড়বিড় করে বিপত্তারিণীর নাম জপ করতে লাগল। আবীর বিছানায় উঠে বসল।
ওর বাবা বলে উঠলেন, ‘উঠলি কেন?’
— ‘টয়লেটে যাব।’
পর্ণা বিরক্তির স্বরে বলে ওঠেন, ‘এই তো এসে শুলি, এর মধ্যে…’ আসলে দরজা খুলে যেতে হবে। বাইরে ভয়ঙ্কর আত্মা কোথায় ঘাপটি মেরে বসে আছে কে জানে!
শ্যামলবাবু উঠে দাঁড়ালেন, ‘চল, আমি দাঁড়াচ্ছি।’ আবীরের মনে হল যেন সে বাচ্চা ছেলে ।
‘দাঁড়াতে হবে না। দরজা খুলে রেখে যাচ্ছি।’ আবীর বাইরে বেরিয়ে বাথরুমের আলো জ্বালাল। কৌতূহলবশত ওর ঘরের বন্ধ দরজার দিকে তাকাল। তখনি ওর চোখে পড়ল আবছা একটা ছায়া! অবিকল এক নারীমূর্তি। ছায়ামূর্তিটা অল্প অল্প দুলছে। ওর বুকের মধ্যে ভয়াল ভয়ঙ্কর অনুভুতিটা জাগ্রত হয়ে স্নায়ুগুলোকে অকেজো করে দিল। ও সহ্য করতে পারল না। কেননা ইতিমধ্যে মূর্তিটা বাতাসে ভর দিয়ে ওর কাছাকাছি এসে গেছে। এক ঝলক হিমেল বাতাস আবীরের সারা অঙ্গে হাত বুলিয়ে দিল। জ্ঞান হারিয়ে ফেলার আগে বুঝতে পারল বাবার শক্ত দুটো হাত ওকে ধরে ফেলল।
শ্যামলবাবু কোনোরকমে ছেলেকে ধরে খাটে এনে শুইয়ে দিলেন। সারা রাত এ ভাবে কাটল। আবীর মাঝে মাঝেই চেতনা হারিয়ে ফেলছিল। পর্ণা কাঁদো কাঁদো মুখে সারা রাত ঠাকুরের নাম করে চললেন। শ্যামলবাবু কথা হারিয়ে মোমের পুতুল হয়ে গেছেন। কারণ আবীরের জ্ঞান যখনই ফিরেছে ওঁরা আবীরের মুখে দেখেছেন গভীর আতঙ্কের ছায়া। বিড়বিড় করে ভুল বকছে। মা-বাবা দুজনেই ভাবছেন কখন এই কালরাত্রির অবসান ঘটবে! অবশেষে পুব আকাশে রং ধরল। দু’-একটা পাখির ডাক কানে আসতে লাগল। সময় জানিয়ে দিল ভোরের বার্তা।
সকালে চন্দন ফোন করল। আবীর এখনও ততটা সুস্থ হয় নি। তাই শ্যামলবাবু ফোন ধরলেন। ছেলের কাল রাতের অভিজ্ঞতার কথা জানালেন।
‘আমরা সন্ধ্যে নাগাদ আপনার বাড়ি পৌঁছে যাব। কারণ মামা বলেছেন যা করার, তা সূর্য অস্ত যাওয়ার পর করতে হবে। বাড়িতে শুধু আপনারা তিনজনই থাকবেন। লোক জানাজানি যেন না হয়। এখন রাখছি।’
সন্ধ্যেবেলা চন্দন মিত্র নিজে ড্রাইভ করে তার রুদ্রমামাকে নিয়ে এল। আবীর ততক্ষণে সুস্থ হয়ে উঠেছে।
রুদ্রনাথ চট্টোপাধ্যায়কে দেখে প্রথমেই যার চেহারা মনে ভেসে ওঠে সে হল অভিনেতা সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায়। ঐরকম লম্বা, ফর্সা গায়ের রং। মুখ-চোখ এক ধাঁচের। শুধু কণ্ঠস্বরটা আরও গম্ভীর। পরণে লম্বা গেরুয়া পাঞ্জাবি, তার ওপর ঠান্ডার জন্য একটা কালচে জহর কোট। সাদা পাজামা। লম্বা কাঁধ পর্যন্ত কাঁচা-পাকা চুল। দেখলে মনে একটা শ্রদ্ধা আসে। বয়স আন্দাজ করা মুশকিল। পঞ্চান্নও হতে পারে, আবার পঁয়ষট্টিও হতে পারে। তবে শক্তসমর্থ চেহারা।
ঘরে ঢুকে হাত জোড় করে নমস্কার করলেন তিনি।
‘কী, আমাকে দেখে তান্ত্রিক বলে মনে হচ্ছে?’ অল্প রসিকতার ছাপ তাঁর কণ্ঠে। ওরা দুজনকেই আপ্যায়িত করল। পর্ণা দেবী উঠলেন কিচেনে যাওয়ার জন্য।
‘শুধু এক কাপ লিকার চা। চিনি কম। কাজের আগে সাধারণত আমি কিছু খাই না।’ রুদ্রনাথ বললেন।
চন্দন আবীরের দিকে তাকিয়ে বলল, ‘তুমি দেখছি খুব নার্ভাস হয়ে পড়েছ।’
আবীর অনিন্দিতার বিষয়ে মুখ খুলতেই রুদ্র বাধা দিলেন, ‘খেয়াল রেখো, আমাদের সব কথাবার্তা ওপরে বসে কান পেতে সে শুনছে।’
আবীর ঢোঁক গিলে ফেলল। পর্ণা দেবী চা নিয়ে এলেন। চায়ে চুমুক দিয়ে রুদ্রনাথ বললেন, ‘বাইরে থেকে বুঝেছি বাড়িটা দোতলা। সাধারণত এরা ওপর মহলটাই পছন্দ করে। তাই তোমার ঘরে বসেই আমাদের কাজ করতে হবে।’ তারপর পর্ণার দিকে তাকিয়ে বললেন, ‘এক ঘটি গঙ্গা জল, কিছু ধুনো, কয়েকটা ধূপ আর একটু কর্পূর আমার লাগবে।’
শ্যামলবাবু বললেন, ‘আপনি নিশ্চিত, এইরকম কিছুর আবির্ভাব ঘটেছে?’
— ‘দেখুন আমি নিজেকে মনস্তাত্ত্বিক হিসেবে পরিচয় দিই। আমার মন আমাকে জানিয়ে দেয় নেগেটিভ এনার্জির উপস্থিতি। এত বছর এইসব নিয়ে ঘষামাজা করে আরও অভিজ্ঞতা বেড়েছে। ওদের গন্ধ আমি পাই।’
চায়ে শেষ চুমুক দিয়ে কাঁধে ঝোলার মতো ব্যাগটা নিয়ে উঠে দাঁড়ালেন।
‘ওপরের ঘরে আমি আর আবীর শুধু যাব। আপনারা এখানেই থাকুন। ওকেও কিছু সময় বাদে নিচে পাঠিয়ে দেব। কেননা আমি চাই না ঐ ভয়ঙ্কর দৃশ্যগুলো আপনাদের মনে স্মৃতি হয়ে থাকুক।’
রুদ্রনাথের কথাগুলো একটা ভয়ের রেশ নিয়ে ঘরে ঘুরে বেড়াতে লাগল। আবীর আর রুদ্রনাথ সিঁড়ি বেয়ে ওপরে চলে গেল। দরজার সামনে কথামতো ধূপ, ধুনো, গঙ্গাজল সাজানো ছিল। দরজা খুলতেই একটা বোঁটকা গন্ধ আবীরের নাকে এসে লাগল। রুদ্রনাথের কথামতো আবীর ঘরের আলোটা জ্বালাল। কিন্তু টিউবলাইটটা দপদপ করতে লাগল। স্টার্টারটা বোধহয় খারাপ হয়ে গেছে। ষাট পাওয়ারের বাল্ব জ্বালিয়ে দিল আবীর।
রুদ্রনাথ ঘরের দরজা ভেজিয়ে দিয়ে বললেন, ‘তুমি নির্ভয়ে থাকো। আমি সঙ্গে আছি।’
সারা ঘরে গঙ্গা জল ছেটাতে গন্ধটা একটু কমল। ছবি আঁকার স্ট্যান্ডের সামনে রুদ্রনাথ মাটিতে বসে ওকেও বসার ইঙ্গিত করলেন। ধুনো জ্বালিয়ে তার মধ্যে কর্পূর ফেলে দিলেন। ধূপগুলো জ্বালিয়ে দিলেন। এবার পদ্মাসনে বসে চোখ বুজলেন। তার আগে আবীরকে পুনরায় সতর্ক করে দিলেন, ‘যাই দেখো না কেন, ভীত হবে না। তোমাকে ও কিছু করতে পারবে না।’
আবীরের মনে সতর্কবাণী আরও ভয়ের রেশ ছড়িয়ে দিল। কোনো মারাত্মক ঘটনা ঘটার অপেক্ষায় দুরুদুরু বুকে সে বসে রইল। চোখের পলক ফেলতেও ভয় লাগছে। চন্দনের মামা নিশ্চল হয়ে বসে বিড়বিড় করে মন্ত্র পড়ে চলেছেন। যেন কোনো সাধক মায়ের পূজায় নিমগ্ন। বদ্ধ ঘরে ধূপ ধুনো কর্পূরের ধোঁয়ায় শ্বাস নিতে কষ্ট হচ্ছে আবীরের। একটা ক্ষীণ চাপা শব্দ ঘরের কোণ থেকে ভেসে এল। আবীর শব্দের উৎস লক্ষ্য করে ঘরের উত্তর কোণটার দিকে তাকাল। হলদেটে আলোয় দেখল কোণটা কালো ঝুলে ভর্তি! ভেবে পেল না এক দিনে এত ঝুল এল কোত্থেকে? ঐ ঝুলের জাল ভেদ করে অনিন্দিতার মুখটা দেখা যাচ্ছে! এখন আর সেই সুন্দর মুখ নেই। বরং এক কদাকার রক্তমাখা মুখমন্ডল যা যে কোনো সাহসী মানুষের হৃদপিন্ড বিকল করে দিতে পারে।
চোখ বোজা রুদ্রনাথ মনে হয় আবীরের মনের আতঙ্ক উপলব্ধি করতে পারলেন। কেননা সেই মুহূর্তে তিনি চোখ চেয়ে তার দিকে তাকিয়ে শান্ত স্বরে বললেন, ‘এটাই কি সেই প্রেতাত্মা, যাকে তুমি কয়েকদিন ধরে দেখে চলেছ?’
সে ভয়ে ভয়ে ঘাড় নাড়ল। উনি ঝোলার ভেতর থেকে একটা ছোট কালচে চকচকে পাথর বার করে আবীরের দুই ভুরুর মাঝখানে ঠেকালেন। আবীরের সারা শরীরে একটা বিদ্যুৎ খেলে গেল। দেহে এক অদ্ভুত তরঙ্গ সমস্ত স্নায়ুগুলোকে নাড়িয়ে দিল। মস্তিষ্কের কোষে কোষে এক জ্বলন্ত আগুনের ডেলা ঘুরে বেড়াতে লাগল। মাত্র কুড়ি সেকেন্ড স্থায়ী হল সেই অনুভূতি। পাথরটা সরিয়ে নিলেন উনি। এক নরম স্নিগ্ধ প্রলেপ সমস্ত দেহে ছড়িয়ে পড়তে লাগল। সেই আবেশে তার দু’চোখ জুড়ে ঘুম নামতে শুরু করল।
‘এই ঘরে তোমার কাজ শেষ। যাওয়ার আগে দরজাটা ভেজিয়ে দিয়ে যাও।’ বাধ্য ছেলের মতো ও উঠে দাঁড়াল। নিচে নেমে এসে দেখে চন্দনদার সাথে মা আর বাবা উদ্বিগ্ন হয়ে বসে আছে। ওকে ঢুকতে দেখে তাদের মুখে প্রশ্নের চিহ্ন। আবীরের সারা দেহ এখন ঝরঝরে লাগছে। শরীরে নতুন শক্তি। ঘুম ঘুম ভাবটা উধাও। সব থেকে আশ্চর্য লাগছে হাজার চেষ্টা করেও অনিন্দিতার মুখটা ও মনে করতে পারছে না। যাকে একটু আগেও ওপরের ঘরে দেখে এসেছে। কেউ যেন অদৃশ্য শক্তি দিয়ে সযত্নে ঐ দুঃস্বপ্নের সময়গুলো মন ও মাথা থেকে মুছে দিয়েছে।
ওদের উৎকণ্ঠার মুখ দেখে নিজেই বলে, ‘রুদ্রমামা কাজ সেরে নিচে আসবেন। আমরা বরং ঐ সময়টুকু গল্প করি।’ ওরা বুঝে গেছে আবীর বর্তমানে সুস্থ। পর্ণা দেবী ছেলের মুখে পুরনো জৌলুস দেখতে পাচ্ছেন। মনে মনে সাধক মানুষটার প্রতি বিশ্বাস আরও বেড়ে গেল। ছেলের মনে যে স্বাভাবিকতা ফিরে এসেছে এতে দুজনেই খুশি। দু’জনে কৃতজ্ঞতা জানালেন চন্দনকে।
আবীর ওদের সাথে বলে উঠল, ‘চন্দনদা, ভাগ্যিস তোমার সাথে ব্যাঙ্কে পরিচয় হয়েছিল আর তোমার মুখ থেকে রুদ্রমামার কথা শুনেছিলাম। এ যাত্রায় রক্ষা পেলাম।’
মা-বাবা দুজনে চন্দনকে বললেন, ‘ছেলের মুখ থেকে তোমার মেয়ের বিপদের কথা কিছু কিছু শুনেছিলাম।’
এই সময় ওপর থেকে জোরে জোরে মন্ত্রের উচ্চারণ ভেসে এল। তার সাথে কারোর ইনিয়ে-বিনিয়ে করুণ কান্নার শব্দ। তিনজনের মুখ একটু গম্ভীর হয়ে গেল।
‘চিন্তার কোনো কারণ নেই। মামার ওপর আমার অগাধ বিশ্বাস। ওঁর যে কি শক্তি তার চাক্ষুষ প্রমাণ পেয়েছি। এমনকি ওঁর গৌহাটির আশ্রমেও আমি গেছি। বিয়ে-থা করেননি। বাড়ি ছেড়ে নিরুদ্দেশ হয়ে গিয়েছিলেন। বেশ কয়েক বছর বাদে সন্ধান পাওয়া যায় কামরূপে। ততদিনে মামা সিদ্ধপুরুষ হয়ে গেছেন।’
ঘড়িতে সাড়ে সাতটা বাজছে। পর্ণা উঠে দাঁড়ালেন। রান্নাঘরের দিকে এগোলেন। সন্ধ্যে থেকে ওরা এসেছে। তাছাড়া তাদের রাতের রান্নাও হয়নি। পর্ণা দেবী লুচি আর আলুর দম করতে ব্যস্ত হয়ে পড়লেন।
প্রায় এক ঘন্টা বাদে দোতলা থেকে রুদ্রনাথের গুরু গম্ভীর কণ্ঠ ভেসে এল। ‘তোমরা সবাই একবার ওপরে এসো।’ ওরা ভাবল তাহলে কি অতৃপ্ত আত্মার হাত থেকে অবশেষে মুক্তি মিলল? ঘরে ঢুকতে ওরা দেখল আবীরের ছবি আঁকা কাঠের স্ট্যান্ড ভেঙে পড়ে আছে। ঘর্মাক্ত রুদ্রনাথ তার কাজের টুকিটাকি সরঞ্জাম ঝোলার মধ্যে ঢোকাতে ব্যস্ত। খোলা জানলা দিয়ে শীতের ঠান্ডা বাতাস ঘরে ঢুকছে।
ওরা এসে দাঁড়াতে তিনি বললেন, ‘হাঁটু গেড়ে বসে পড়ো। শান্তির জল ছিটিয়ে দিচ্ছি।’
একটা বেলপাতা দিয়ে জল ছিটিয়ে দিলেন সবার মাথায়। তারপর বললেন, ‘তোমাদের বাড়ি এখন প্রেত মুক্ত। কাল সকালে ঘরটা ভালো করে গঙ্গাজল দিয়ে ধুয়ে দেবে। ঘরের কোণে যে ঝুলগুলো রয়েছে ঝাঁটা দিয়ে পরিষ্কার করে কোনো পুকুরে ফেলে দেবে। আর এই কাঠের স্ট্যান্ডটা বাইরে নিয়ে গিয়ে পুড়িয়ে দেবে। কেননা এটার ওপর ভর করে মেয়েটার আত্মা অন্ধকার জগতে বিলীন হয়ে গেছে। পারলে এই ঘরে হোম সহকারে সত্যনারায়ণ পুজো করবে।’
সিঁড়ি দিয়ে নামার সময় শ্যামল বাবু বললেন, ‘এই ঘর এখন ব্যবহার করা যাবে?’
— ‘যে সব উপাচার বললাম তারপরেই ব্যবহার করা যেতে পারে।’
নিচে নেমে এসে সোফায় বসতে বসতে রুদ্রনাথ বললেন, ‘ন’টা বাজতে চলল। চলো ভাগ্নে এবার যাওয়া যাক।’
ওরা হাঁ হাঁ করে উঠল, ‘দশ মিনিট বসতে হবে।’
পর্ণা দেবী ওদের জন্যে লুচি, বেগুন ভাজা, আলুর দম আর মিষ্টি নিয়ে এলেন।
আবীর বলল, ‘কীভাবে ওকে তাড়ালেন একটু বলবেন?’
রুদ্রনাথ লুচি খেতে খেতে বললেন, ‘আবার ঐ সব আলোচনা করে তাদের আমন্ত্রণ জানাতে চাও ?’
তিনজনে একসঙ্গে বলে উঠল, ‘কখনওই না।’
শ্যামলবাবু ফিসফিস করে চন্দনকে ওঁর দক্ষিণার ব্যাপারটা। জিজ্ঞাসা করতে কথাটা কানে গেল রুদ্রনাথের। তিনি বললেন, ‘এটা আমার পেশা নয়। তাছাড়া লুচি-বেগুনভাজা আমার প্রিয়। বরং আর দু’খানা লুচি খেতে পারি।’
পর্ণা দেবী ছুটলেন কিচেনের দিকে মুখে হাসি নিয়ে। যেন কত দিন পরে হালকা মনে হচ্ছে নিজেকে।
ওরা যখন গেট খুলে গাড়ির কাছে গেল তখন ঘড়ির কাঁটা দশের ঘর ছুঁয়েছে। রুদ্রনাথ চাপা গলায় বলল, ‘যদি পারো গরম জলে তিনজনেই স্নান করে নিও। আর একটা কথা।’ আবীরের দিকে তাকিয়ে বললেন, ‘যে কোনো ভাঙা বা পোড়ো বাড়িতে একা একা ঢুকে পড়তে যেও না। অনেক কষ্টে প্রতিহিংসাপরায়ণ আত্মাকে তোমার কাছ থেকে সরাতে পেরেছি।’
আবীর বলে ওঠে, ‘অবশ্যই মনে রাখব। ছোট একটা প্রশ্ন , মেয়েটাকে যারা অত্যাচার করে মারল তাদেরকে ছেড়ে দিল কেন সে?’
— ‘ভালো প্রশ্ন। আমরা ক্ষমতাশালী লোকের অন্যায় কেন অনেক সময় সহ্য করি ? প্রতিবাদ করতে কেন পারি না ? ওরাও তাই। নরম দুর্বল চিত্তের মানুষের ওপর তাদের প্রতিহিংসা মেটায়। সময় পেলে গৌহাটি এসো। অনেক রকম আলোচনা হবে।’
গাড়িতে উঠে পড়লেন রুদ্রনাথ চট্টোপাধ্যায়।
_____
১. ‘মুখোশের আড়ালে’ গল্পে সে কাহিনী লিপিবদ্ধ আছে
নোট নিতে এবং টেক্সট হাইলাইট করতে লগইন করুন
লগইন