গাছের প্রতিশোধ – শঙ্কর চ্যাটার্জী

শঙ্কর চ্যাটার্জী

ইভেন্টে গল্প দেওয়ার জন্যে অনুরোধ ছিল। বিষয়, গাছের প্রতিশোধ। শিরোনামটা দেখেই আমার মনে ত্রিশ বছর আগেকার স্মৃতি পুনরায় ফিরে এল। যা আমি ডাক্তার ও ওষুধের সাহায্যে ভুলতে বসেছিলাম। তবে কি ঐ রকম ভয়ঙ্কর ঘটনা মন থেকে ভুলতে দেবে না? ছলে বলে মনে করিয়ে দেবে!

এক নিমেষের মধ্যে আমাকে ফিরিয়ে নিয়ে গেল সেই বিহারের প্রত্যন্ত গ্রামে। যদিও এখন ঐ এলাকা ঝাড়খন্ড হিসেবেই পরিচিত। চারিদিকে টিলায় ঘেরা সবুজ পাহাড়ি গ্রাম — পাহাড়পুর। বেশ কয়েক ঘর মানুষের বাস সেখানে। থাকার মধ্যে আছে একটা পোস্ট অফিস, গ্রামীণ ব্যাংক, ছোট সরকারি ওষুধ-না-থাকা একটা চিকিৎসা কেন্দ্র আর কয়েক সারি দোকানঘর।

ওখানকার স্থানীয় লোকদের রুটি রোজগার বলতে একটু দূরে অবস্থিত স্টোন চিপের কারখানা। আর বাকিরা পেট চালায় দূরে পাহাড় বা টিলা থেকে গাছ কেটে এনে বাজারে জ্বালানি বেচে।

দূরে ঐ যে পাহাড় কেটে স্টোন চিপ বানানোর কারখানা — সেখানে চলেছে দিনরাত বিরাট বিরাট যন্ত্রের সাহায্যে কুচি পাথর তৈরী। এলাকা জুড়ে শুধু কান ফাটা ডিনামাইটের পাহাড় ফাটানোর আওয়াজ আর বড় বড় যন্ত্রের যান্ত্রিক শব্দ! চারিদিকে শুধু সাদা পাথরের ধুলো।

তবে পাহাড়পুরে থাকলে কিছুই বোঝা যায় না। কেননা সবুজ গাছে ভরা টিলাগুলো যেন পাহাড়পুরকে বুকে করে আগলে রেখেছে। আমি গিয়েছিলাম ছয় মাসের চুক্তিতে ঐ পাথর কোম্পানির সুপারভাইজার হিসেবে। কোম্পানি সামনেই কোয়ার্টার দিয়েছিল। দু’দিনেই বুঝে গিয়েছিলাম এখানে থাকলে নির্ঘাত কালা হয়ে যাব।

ওখানকারই এক কর্মী দিবাকর আমার অসুবিধেটা বুঝতে পারল। ও এগিয়ে এল।

‘আপনি যদি ইচ্ছে করেন, এই কয়েক মাস আমাদের বাড়িতে থাকতে পারেন। পাশেই পাহাড়পুরে বাড়ি। ওখানে এইসব শব্দ-ধোঁয়ার থেকে মুক্তি পাবেন।’

ওর প্রস্তাবটা লুফে নিলাম। ও থাকা-খাওয়ার জন্যে টাকা নিতে রাজি হচ্ছিল না। আমি বললাম, ‘তাহলে যেতে পারব না। এখানে থাকতে গেলেও খরচ আছে।’

যতই বলি, সে কিছুতেই রাজি হয় না। আসলে তখনও মানুষের মনোবৃত্তি এত ব্যবসায়িক হয়নি। তাছাড়া ও আমার অধস্তন কর্মচারী। তবুও অনেক বলার পর রাজি হল।

পরের দিনই বাইকে চড়ে সুটকেস নিয়ে ওর বাড়ি গেলাম। বাড়িতে ওর বুড়ো বাবা-মা আর স্ত্রী। ছোট একটা ঘর আমাকে ছেড়ে দিল। জায়গাটা আমার খুব মনে ধরে গেল। যেন প্রকৃতির কোলে আশ্রয় পেলাম। এখানকার জল-হাওয়ায় ক্ষিদে বাড়ায়।

সন্ধ্যেবেলা কোম্পানি থেকে ফিরে স্নান সেরে উঠোনে যখন আমরা দুজন খাটিয়াতে বসতাম, স্নিগ্ধ বসন্তের বাতাস মন-প্রাণ জুড়িয়ে দিত। মনের শান্তি আর কানের শান্তি। এরপর দিবাকরের বউ কাঁসার গ্লাসে করে মোষের দুধের চা করে আনত! আহা, তার স্বাদ এখনও ভুলতে পারিনি। চা খেয়ে সন্ধ্যের অন্ধকারে লালচে সরু রাস্তা ধরে এদিক ওদিক ঘুরে বেড়াতাম। একটাই অসুবিধে, এই অঞ্চলে এখনো বৈদ্যুতিক আলো আসেনি। ও বলল খুব শিগ্গিরই এসে যাবে।

 সেদিন দিবাকর টর্চ আর একটা থলে নিয়ে বেরোল। কিছু মুদিখানার জিনিস কিনবে। ওর বাবা হাঁটু পর্যন্ত ধুতি তুলে দাওয়ায় বসে হুঁকো টানছে। ওরা হিন্দিতেই বেশি কথা বলত। কিন্তু বাংলা বুঝতে পারত। দিবাকর ভালো বাংলা বলতে পারত। কেননা ওর বাবা আসানসোলের কোলিয়ারিতে কাজ করত। সেহেতু আমার সঙ্গে কথাবার্তায় অসুবিধে হত না।

মুদিখানার দোকানে গিয়ে দেখি একজন অল্প বয়স্কা বিধবা মহিলা কেনাবেচা করছে। ফেরার সময় দিবাকর বলল, ‘ঐ মেয়েটির নাম সুমরি। ওর স্বামী এক বছর আগে মারা গেছে। কতই বা বয়স হবে প্রসাদের? গাঁট্টাগোট্টা পেশীবহুল চেহারা। জানি না বিশ্বাস করবেন কি না… ওর মৃত্যুটা আমি আজও রহস্যজনক মনে করি।’

রহস্যজনক কথাটাতেই আমার মনে প্রথম কৌতূহলের জন্ম দিল। ‘কীরকম রহস্যজনক একটু শুনি?’

টর্চের আলোয় পথ চলতে চলতে দিবাকর বলল, ‘সে এক আজব ঘটনা। গ্রামের কেউই কুলকিনারা করতে পারেনি। আপনি শুনলে ভাববেন আজগুবি গল্প শোনাচ্ছি।’

ওর গলার স্বরে একটা ভয়ের হালকা ছোঁয়া পেলাম। এর ফলে আমার আগ্রহটা বাড়ল।

— ‘বলে ফেলো। শুনি মৃত্যুর কারণটা।’

— ‘বাড়ি এসে গেছে। রাত্রে খেয়েদেয়ে শুতে যাবার আগে শোনাব।’

কী আর করি, অগত্যা অপেক্ষা।

রাত ন’টা নাগাদ খাওয়া-দাওয়া সেরে ওদের উঠোনের খাটিয়ায় এসে বসলাম। এর মধ্যে চারিদিক নিস্তব্ধ হয়ে গেছে। দাওয়াতে একটা হারিকেন জ্বলছে। দিবাকরের বউ ঘরের ভেতর শাশুড়ির পা টিপে দিচ্ছে। আমাদের মাথার ওপর কালো আকাশের গায়ে অসংখ্য নক্ষত্র মিটমিট করছে। বসন্তের হাওয়া ক্রমশ হিমেল হচ্ছে।

— ‘নাও, শুরু করো, প্রসাদের মৃত্যু কাহিনী।’ আমার কণ্ঠে আগ্রহ।

দিবাকর গলাটা একটু ঝেড়ে নিল।

— ‘এখন ওদের বাড়ির সামনে যে মুদির দোকানটা দেখলেন, ওটা প্রসাদ মারা যাওয়ার পর পেট চালাতে ওরা খুলেছে। কেননা প্রসাদের বুড়ি মা আর বউ ছাড়া সংসারে কেউ নেই। আগে প্রসাদের কাজ ছিল পাহাড়ের জঙ্গলে গিয়ে কাঠ কেটে বাজারে বিক্রি করা। এ কাজ অনেকেই করে। ও প্রতিদিন ভোর থাকতে কুঠার, কাটারি আর দড়ির বাঁক নিয়ে টিলায় উঠে যেত। তারপর কাঠ নিয়ে বাজারে বেচে বিকালের দিকে বাড়ি ফিরত। সেদিনও রুটিন অনুযায়ী বেরিয়েছিল।’

ও অল্প থামল। আমি শরীরটা খাটিয়ায় ছড়িয়ে দিলাম।

‘সেদিন প্রসাদ বাড়ি ফিরল বেলা করে খালি হাতে। বাড়ির লোকেরা প্রথমে ভেবেছিল কাঠ পায়নি বা শরীর খারাপ। কিন্তু ওদের ভুল ভাঙল একটু বাদেই। প্রসাদের মুখ-চোখের একটা পরিবর্তন ওদের চোখে পড়ল। তারপরেই এল ধুম জ্বর! তার সঙ্গে ভুল বকা — এখানকার লোকেরা ডাক্তারের থেকে ভৈরববাবাকে বেশি বিশ্বাস করে। ওষুধের থেকে জলপড়া-তাবিজে বেশি আস্থা রাখে। ভৈরববাবা দেখেই বলল বুরা বাতাস লেগেছে। কোম্পানি থেকে ফিরে ওদের বাড়ি গেলাম। তখনও জ্বরে বেহুঁশ হয়ে চাটাইয়ে পড়ে আছে। কুপির আলোয় দেখলাম মাথার কাছে একটা কচুপাতায় খানিকটা তেল-সিঁদুর মাখানো বেলপাতা। ভৈরববাবার ঔষধি। বুঝলাম ডাক্তারের ধারেকাছে যায়নি ওরা। প্রসাদের সারা মুখে লাল লাল ফুসকুড়ি! আমার আওয়াজ পেয়ে তাকাল। চোখ দুটো লাল করমচার মত। বিড়বিড় করে বলল, “…সাবধান দিবাকর, উয়ো পেড় জিন্দা হ্যায়…।”

‘একই কথা বারবার ঘুরিয়ে ফিরিয়ে বলে চলেছে। মাথায় আসছে না ও কী বলতে বা বোঝাতে চাইছে। তবে পেটে যেটুকু বিদ্যে আছে তার জোরে বুঝলাম — ঐ জঙ্গলে নিশ্চয়ই ওর সাথে কিছু একটা আজব বা অলৌকিক কান্ড ঘটেছে, ওর মন এবং মাথা সেই ভার নিতে পারেনি! বারবার সে কথা ওকে জিজ্ঞেস করলাম। ওর সঙ্গে আর কেউ ছিল কিনা? আমার দিকে বোবার মত শুধু চেয়ে রইল। ভালভাবে দেখলাম ওর দু’চোখের ভেতর অজস্র আতঙ্ক দানা বেঁধে রয়েছে!

 ওর ঘর থেকে বেরিয়ে এসে বললাম কাল সকালেই ওকে নিয়ে হাসপাতাল যেতে হবে। কিন্তু ভোররাতেই আমার বাড়িতে গ্রামের লোক ডাকতে এল। প্রসাদের শেষ অবস্থা। ছুটলাম ওখানে। ওকে দেখে বেশ ভয়ই লাগল। ওর মুখটা নীলচে হয়ে গেছে। গলার শির ফুলিয়ে বলে চলেছে সেই এক কথা — “পেড় বিলকুল জিন্দা! ছোটা ভি জিন্দা হ্যায়।” ওর কষ বেয়ে গড়িয়ে পড়ছে রক্তের ধারা। ক্রমশ ওর গলার আওয়াজ কমে যাচ্ছে। মনে হচ্ছে কেউ ওর গলাটা টিপে শ্বাস রোধ করে ওকে মারছে! আমি ওর শেষ কথাগুলো শোনার জন্যে হাঁটু গেড়ে বসে কানটা মুখের কাছে নিয়ে গেলাম। একটু বাদেই ও মারা গেল।’

দিবাকর একটানা কথা বলে একটু চুপ করল। একমনে গল্পটা শুনছিলাম। ইতিমধ্যে ওর বউ ঘরে চলে গেছে। পাহাড়ের দিক থেকেই একটা ঠান্ডা হাওয়ার স্রোত ভেসে আসছে। উঠে বসলাম।

‘প্রসাদের জীবনের শেষ কথাগুলো বলো, যা একমাত্র তুমি শুনেছিলে।’ ও যা বলল তাতে আমার শরীরেও একটা অদ্ভুত শিহরণ অনুভূত হল! এবং তার সঙ্গে মনের মধ্যে লুকিয়ে থাকা কৌতুহলটা সারা দেহে ছড়িয়ে পড়ল ঐ অদ্ভুত রহস্য জানবার জন্য।

আমি দাঁড়িয়ে উঠেছি। ওর মুখ থেকে প্রসাদের শেষ কথাগুলো শোনবার জন্য।

একটু দোনামোনা করে দিবাকর বলল, ‘দেখুন স্যার, আমরা জানি মৃত্যুপথযাত্রী মিথ্যে কথা বলে না। প্রসাদ যা বলেছিল তার সারাংশ হল, ছোট শিমুল গাছটা কাটাই তার ভুল হয়েছে। কেননা বড় শিমুলটা আকারে ইঙ্গিতে বুঝিয়ে দিচ্ছিল। বাধাও দিচ্ছিল নানান ছলে! কিন্তু ও গা করেনি। আর সব কাঠুরেরা এদিক-ওদিক ছড়িয়ে-ছিটিয়ে ছিল। ধারালো কুঠারের এক কোপ যেই ছোট গাছটার ডালে বসিয়েছে….অমনি! উঃ কি ভয়ঙ্কর! মনে হল একটা জলজ্যান্ত মানুষের ডান হাতটা কেটে ফেললাম! এবার দেখলাম ঝাঁকড়া বিরাট গাছটা যেন রাগে ফুঁসছে! আমার সামনে ঠিক একটা দানব দাঁড়িয়ে আছে। তারপর…’

‘তারপর?’ আমার মুখে প্রশ্ন।

দিবাকর বলল, ‘এরপর আর একটা বাক্যও বলে যেতে পারেনি।’ এইসময় দূরের কোনো গাছ থেকে কয়েকটা প্যাঁচা কর্কশ স্বরে ডেকে উঠল। আমার সারা মন পরবর্তী ঘটনা জানার জন্য পাগল হয়ে উঠল। মনে হতে লাগল এই মুহূর্তে ছুটে টিলাটার ওপর উঠি। চুম্বকের মতো সেই অদেখা জায়গাটা টানতে লাগল। মনটাকে সাময়িকভাবে সংযত করলাম।

‘চলো শুয়ে পড়া যাক। রাত হল।’ ঘরে এসে শুয়ে পড়লাম। আমি জানি, এখুনি চোখে ঘুম আসবে না। খালি মাথায় ঘুরছে… প্রসাদ ওখানে কী দেখেছিল? যাতে মনে হল গাছগুলো জ্যান্ত? আর বাকিরা… তাদের গাছগুলো জীবন্ত হল না কেন? ও ভুল দেখেনি তো? কেননা এত অবাস্তব… কেউ বিশ্বাস করবে? হঠাৎ দিবাকরের কথাটা মনে পড়ে গেল। মৃত্যুপথযাত্রী মিথ্যে কথা বলে না। তবে কি সত্যি ওখানে জীবন্ত গাছ আছে? আমরাও তো জানি গাছের প্রাণ আছে। তাহলে একবার ওখানে যাওয়া দরকার। এত কাছে এসে এমন জিনিস না দেখে ফিরে যাব? এইসব কথা চিন্তা করতে করতে বোধহয় ঘুমিয়ে পড়েছিলাম।

ঘুমের ঘোরে দেখি একটা ঝাঁকড়া পাতাভর্তি শিমুল গাছ মাথা উঁচিয়ে দাঁড়িয়ে আছে। পাশেই ছোট একটা গাছ। বড় গাছটা যেন মাতৃস্নেহে সন্তানকে ডালপালা দিয়ে জড়িয়ে রেখেছে। আশ্চর্য দৃশ্য! সকালে ঘুম ভাঙতে স্বপ্নের কথাটা মনে পড়ল। আবার শুরু হল চিন্তার জট। প্রসাদকে সে কীভাবে হত্যা করল? কী এমন বিষ ছড়াল যে জোয়ান লোকটা দু’দিনের জ্বরে মুখে রক্ত তুলে মরে গেল? এইরকম একটা রোমহর্ষক কাহিনীর উৎস স্থলে এসেও না দেখে ফিরে যাব?

মানুষের অদম্য কৌতূহলই তাকে বারে বারে বিপদের মধ্যে ফেলেছে! তবু মানুষ তার কৌতূহল বৃত্তি দমন করতে পারেনি। কোম্পানির কাজের টেবিলে বসে মনস্থির করে ফেললাম। যাই ঘটুক, দেখতেই হবে ঐ জ্যান্ত গাছটাকে! আমি তো তার কোনো ক্ষতি করতে যাচ্ছি না!

দিবাকরকে কথাটা বলতেই ও বিষম খেল।

‘স্যার, আমার মনে হয় ওখানে না যাওয়াই ভাল। কেননা আমরা প্রসাদের কথা অনুযায়ী ভৈরববাবাকে নিয়ে জায়গাটার কাছাকাছি গিয়েছিলাম। উনিও সব দেখে শুনে বলেছিলেন ওখানে অপদেবতারা থাকে! গ্রামের লোকজন তারপর থেকে ঐ পথ মাড়ায় না। জায়গাটা সত্যিই নির্জন আর গা ছমছমে! গাছগুলোও কেমন ভয়ঙ্কর টাইপের। একটু হাওয়া দিলে মনে হয় কে যেন করুণ সুরে ইনিয়ে—বিনিয়ে কাঁদছে!’

ওর কথায় গায়ে একটা শিরশিরানি উপলব্ধি করলাম। কিন্তু ঐ যে বললাম… কৌতূহল! ভয়ের সাথে যাবার ইচ্ছেটাও বেড়ে গেল। বললাম, ‘তোমার যদি যেতে আপত্তি থাকে, আমাকে ঐ পাহাড়টার নিচ পর্যন্ত পৌঁছে দাও। এরপর একাই আমি উঠব।’

মাথায় এল না নির্দিষ্ট স্থানটা চিনব কিভাবে। ও আমার মুখের দিকে কয়েক সেকেন্ড তাকিয়ে থেকে বলল, ‘আপনি আর একবার ভাবুন। জেদের বশে কিছু করবেন না। বাড়িঘর ছেড়ে এতদূর এসেছেন! যদি সত্যি কোনো বিপদে পড়েন…’

দিবাকর ওর কথা শেষ করতে পারার আগেই বলে উঠলাম, ‘প্রথমেই বলি, যতই মরণপথের যাত্রী হোক… ওর কথা বিশ্বাস করা মানে অলৌকিক ঘটনাকে প্রশ্রয় দেওয়া। এখনও পর্যন্ত এইরকম কাহিনী কেউ শোনেনি বিশ্বাস তো দূরের কথা। তুমিও কিছুটা লেখাপড়া জানো। তুমিও অনুভব করেছ — চোখে দেখেছ কি?’ উত্তর দিতে পারল না দিবাকর। একই সঙ্গে এটাও বুঝল আমাকে নিবৃত্ত করা যাবে না।

আমতা আমতা করে বলল, ‘বেশ, আগামী রবিবার দু’জনে যাব। যতই হোক, আপনাকে একা ছেড়ে দিতে পারি না। কেননা আমাদের বাড়িতে থাকেন। ভালো মন্দ কিছু হলে…’

— ‘খারাপটা আগে ধরছ কেন? আমরা ওদের ধ্বংস করতে তো যাচ্ছি না।’ ওকে অভয় দিলাম।

— ‘কিন্তু স্যার, আমার বাড়িতে বা পাহাড়পুরে কারোর কাছে মুখ খুলবেন না। তাহলে কিন্তু যাওয়া পন্ড!’

ওর কথায় সায় দিলাম। পা দুটো যেন এখুনি ছুটে চলে যেতে চাইছে অজানা রহস্যকে জানতে!

কিন্তু তখনও বুঝিনি প্রকৃতির কিছু রহস্য জানতে নেই এবং সেও সেই রহস্য উন্মোচন করতে চায় না! যেমন গভীর সমুদ্রের ভেতরের রহস্য, বারমুডা ট্রায়াঙ্গল… আমাজনের গভীরে নিয়মিত কত কী ঘটে চলেছে… মূর্খের মতো নিজের অজান্তেই নিজের মৃত্যুর পরোয়ানায় সই করে দিলাম।

রবিবার খুব ভোরে আমরা মোটর বাইক চেপে বেরোলাম। বাড়িতে বলা হল কোম্পানির কাজে বেরোচ্ছি। একটা ব্যাগে কিছু শুকনো খাবার আর দু’বোতল জল নেওয়া হল। দিবাকর একটা সরু কাস্তের মতো কাটারি ভরে নিল। যেতে যেতে বললাম।

— ‘কাটারিটা নিলে কেন?’

— ‘ঐ সরু পাহাড়ি রাস্তায় গত এক বছরে কেউই যায়নি। তাই আগাছা আর বুনো লতাপাতায় ভরে থাকবে। কেটে সাফ করতে করতে উঠতে হবে।’

সকাল সাড়ে সাতটার মধ্যে একটা সরু নদীর সামনে এসে দাঁড়ালাম। ও বাইকটা একটা ঝোপের আড়ালে রেখে দিল। নদী বলতে একদম শুকনো। মাঝে মাঝে পাথরের খাঁজে কিছু জলের রেখা। সোনালী রোদ চারিদিকে ছড়িয়ে রয়েছে। চারিধার নির্জন, কোনো জনমনিষ্যি নেই। পাথর ডিঙিয়ে ডিঙিয়ে আমরা নদী পেরোলাম। সামনেই দেখা যাচ্ছে পাহাড়ের মতো সবুজ টিলাটা। সারা মনে একটা সুপ্ত উত্তেজনা খেলা করছে।

 টিলাটার নিচে এসে দাঁড়ালাম। ঘাড় উঁচু করে ওপরের দিকে তাকালাম। একটা নুড়ি পথ এঁকেবেঁকে ওপরের দিকে উঠে গেছে। দিবাকর দোটানার সুরে বলল, ‘এই সেই পথ। পারবেন তো উঠতে?’ বুঝতে পারছি ওর মন এখনও ভয় কাটিয়ে উঠতে পারেনি।

‘চিন্তা করো না। ঠিক উঠে যাব।’

শুরু হল চড়াই ভেঙে ওপরে ওঠা। ঝোপঝাড়গুলোতে নানা রঙের প্রজাপতি উড়ে বেড়াচ্ছে। চারিদিকে বুনো গাছের মেঠো গন্ধ। কিছু কিছু জায়গায় পাহাড়ি পথটা এরই মধ্যে গুল্ম লতাপাতায় ছেয়ে গেছে। দিবাকর হাতের কাটারি দিয়ে সেগুলো কাটতে কাটতে ওপরে উঠছে। তার পিছনে আমি। খানিকটা ওঠার পর কপালে ঘাম জমল। শহুরে মানুষ পাহাড়ে চড়ার অভ্যেস নেই। ভাবছি এই দুর্গম পথ বেয়ে প্রসাদরা কাঠের বোঝা নিয়ে কিভাবে প্রতিদিন যাওয়া আসা করত?

একটু দাঁড়িয়ে পিছন ফিরে নিচের দিকে তাকালাম। রুক্ষ পাথরে ভরা নদী এখন অনেক নিচুতে। আমাকে দাঁড়াতে দেখে দিবাকরও দাঁড়িয়ে গেল।

‘একটু জল খাবেন?’

ঘাড় নাড়ালাম। ও বোতলটা দিল।

এক ঢোঁক গলায় ঢেলে বললাম, ‘আর কতদূর?’

ও ঘাড় চুলকে বলল, ‘এখনও অনেকটা। একেবারে পাহাড়ের মাথার কাছে।’ আবার শুরু হল পথ চলা। পায়ের নিচের পাথরগুলো ক্রমশ পিছল হচ্ছে। কেননা লতাপাতার মাড়ানো রসে শুকনো পথ পিচ্ছিল আকার ধারণ করছে। মাঝে মাঝেই বড় বড় গাছ জায়গাটা ছায়া করে রেখেছে। বেশির ভাগ গাছে কাঠঠোকরার বাসা। তাদের ডাক কানে আসছে।

এই সময় প্রথম বিপদের সম্মুখীন হলাম। হঠাৎ করে আমার পায়ের ক্যাম্বিস জুতোটা হড়কে গেল। টাল সামলাতে পারলাম না। কয়েক ধাপ নিচে গড়িয়ে পড়বার মুহূর্তে আশপাশের লতানো গাছগুলোকে প্রানপণে আঁকড়ে ধরলাম। পড়ন্ত শরীরটা আটকাল। দিবাকর লাফিয়ে নেমে এসে আমায় তুলল। হাতের কনুইটা ভালো রকম ছড়ে গেল।

উদ্বিগ্ন গলায় ও বলল, ‘যত ওপরে উঠবেন পথ তত পিছল। অভ্যেস নেই আপনার। এখনও বলছি, ফিরে চলুন।’

জেদ চেপে গেল। কিন্তু মাথায় একটা কথা ঘুরপাক খেতে শুরু করল। তবে কি কেউ আমাকে বাধা দিয়ে সামনের ভয়ঙ্কর বিপদের কথা জানান দিচ্ছে? আমার মস্তিস্ক কি আমায় সাবধান করে দিতে চাইছে? কেউ কি চাইছে না অজানা রহস্য পুনরায় উন্মোচন হোক?

কনুইটা রুমাল বার করে মুছতে মুছতে বললাম, ‘সামান্য দুর্ঘটনা। ভেবো না। এবার সাবধানে উঠব।’

ও কাঁধ ঝাঁকাল। শুরু করলাম চড়াই ভাঙা। সাড়ে আটটা বাজছে। তার মানে এক ঘণ্টা মত সময় ক্রমাগত উঠেছি। নিচের দিকে তাকিয়ে আর নদীটাকে দেখতে পেলাম না। জঙ্গলের মধ্যে হারিয়ে গেছে। এখানকার পরিবেশটা অল্প স্যাঁতসেঁতে। কয়েকটা নাম-না-জানা গাছ জায়গাটাকে অন্ধকারাচ্ছন্ন করে রেখেছে। গাছের ডালে পাতায় অসংখ্য মাকড়সার জাল। নিস্তব্ধ, নির্জন চতুর্দিক।

এই সময় নীরবতা ছাপিয়ে একটা গুনগুন শব্দ কানে এল। দিবাকরও কান খাড়া করে শব্দটা শুনে আশেপাশে তাকাল। এরপরেই আমাদের দৃষ্টি পড়ল সামনের পলাশ গাছটার দিকে। বিরাট একটা মৌচাক। সেখানে লাখো লাখো মৌমাছির ভিড়। এত বড় মৌচাক জীবনে দেখিনি। দিবাকরের মুখে চিন্তার ছায়া। আসলে মৌচাকটা এত নিচের দিকে আর ওর পাশ দিয়েই আমাদের উঠতে হবে।

ও বলল, ‘আমাদের হামাগুড়ি দিয়ে উঠতে হবে। একটু ছোঁয়া লাগলেই…’

ওর গলা কাঁপছে। হামাগুড়ি দিতে গিয়েই কনুইয়ের কাছে ব্যথাটা মালুম হল। নিঃশ্বাস বন্ধ করে জায়গাটা পেরোলাম।

দিবাকর অল্প উত্তেজিত স্বরে বলল, ‘সামনের বড় পাথরটা দেখতে পাচ্ছেন… ওটা ডিঙোলেই আমাদের প্রসাদের মৃত্যু স্থান। রহস্যের কেন্দ্রবিন্দুতে পৌঁছে যাব।’

ওর কথায় মনের মধ্যে চাপা উত্তেজনাটা চোখে মুখে ফুটে উঠল। অভীষ্ট সিদ্ধ হতে চলেছে! মনে হচ্ছে এভারেস্ট জয়ের থেকেও বেশি কিছু করতে চলেছি। শরীরের হারানো শক্তি যেন ফিরে এল। আমরা এগিয়ে গেলাম পাথরটার দিকে।

 দিবাকর বাঁ হাতটা পাথরের ওপর রাখতেই ফাটল থেকে একটা খয়েরি বিরাট তেঁতুলে বিছে বেরিয়ে এল। যেন ছোটখাটো একটা সাপ!

‘দি-বা-ক-র!!!’ বলে চেঁচিয়ে উঠলাম। বিছেটা তার হলুদ রঙের হুলগুলো খাড়া করে ফেলেছে ফোটাবার জন্য। আমার চিৎকার শোনা মাত্র ও বোধহয় সেকেন্ডরও কম সময়ে ডান হাতের কাটারিটা দিয়ে ওটাকে আঘাত করল। বিছেটা ছিটকে আমার পায়ের কাছে এসে পড়ল। তারপর সরসর করে পাশের জঙ্গলে ঢুকে গেল। বিরাট ফাঁড়া গেল। ওটা কামড়ালে কি হত ভাবতেই গা-টা শিরশির করে উঠল। তৃতীয় বাধা পার হয়ে পাথরটার ওপর উঠতেই চোখের সামনে ভেসে উঠল সবুজ মাঠের মতো খানিকটা ফাঁকা জমি। তার মানে টিলাটার মাথায় উঠে এসেছি। গাছপালা বেশি না থাকার জন্য সূর্যের দেখা পেলাম। দুজনেই ক্লান্ত। দিবাকর আঙ্গুল তুলে দেখাল, ‘ঐ দেখুন, সামনে ঐ নরখাদক শিমুল গাছ! পাশেই ওর বাচ্চাটা।’

আমি অবাক। আশ্চর্য! হুবহু এই গাছ দুটোকে স্বপ্নে দেখেছি! এ কী করে সম্ভব? অচেনা, অজানা এই দুর্গম স্থানের ছবি আমার স্বপ্নে এল কী করে? ব্যাখ্যা খুঁজে পেলাম না। নজরে পড়ল ছোট গাছটার একটা ডাল কাটা। এই কাটা ডালটাই প্রসাদের মৃত্যুর কারণ। অবাক দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছি। গাছ দুটোর কাছাকাছি কোনো গাছ নেই। এরা দু’জন যেন বিচ্ছিন্ন। এক পলক দেখলে মনে হবে ডান হাত কাটা একটা বাচ্চা তার মায়ের পাশে দাঁড়িয়ে আছে। আর মা একটা হাত তার সন্তানের মাথায় দিয়ে রেখেছে।

এতক্ষণ উত্তেজনার জন্য খিদেতেষ্টাগুলো চাপা ছিল। এবার বাড়তে শুরু করল। দিবাকর আমার মনের ভাষা বুঝতে পারল। ও হাঁটু গেড়ে বসে ব্যাগ থেকে দুটো পাঁউরুটি আর মিঠাই বার করল। পাঁচ মিনিটেই খাওয়া শেষ করে জল খেলাম। আমরা দু’জনে বসে গাছ দুটোর দিকে তাকিয়ে রয়েছি। আমাদের থেকে দূরত্ব বড় জোর পঞ্চাশ-ষাট হাত হবে। মনে হচ্ছে ওরাও একমনে আমাদের চালচলন লক্ষ্য করছে। বোধহয় বুঝতে চেষ্টা করছে আমাদের উদ্দেশ্য।

আচমকা একটা বোঁটকা ঘামের গন্ধ নাকে ভেসে এল। আমাদের গায়ের গন্ধ? কই এতক্ষণ তো পাইনি? দিবাকরও নাক টানে বলল, ‘একটা বিদঘুটে ঘামের গন্ধ পাচ্ছেন?’ সায় দিলাম।

মনে হচ্ছে এক সার জংলী মানুষ সামনে এসে দাঁড়িয়েছে। তাদের গায়ের বুনো গন্ধ নাকে ঢুকছে! এবার দেখলাম বড় গাছটার পাতাগুলো থিরথির করে কাঁপতে শুরু করল। বাতাসে কাঁপছে? কিন্তু বাচ্চা গাছটার পাতাও তো কাঁপত। ওগুলো তো স্থির! দিবাকর বড় বড় চোখে দেখছে। আমাদের অবাক করে মা গাছটার দুটো ডাল একটু নিচে নেমে এসে বাচ্চাটাকে জড়িয়ে ধরল! যেন আমাদের হাত থেকে রক্ষা করার তাগিদে।

 সঙ্গে সঙ্গে হৃৎপিন্ডটা লাফ মেরে উঠল। আমরা ভুল দেখছি না তো? এ তো সত্যি অবিশ্বাস্য! প্রসাদের কথায়… জিন্দা পেড়! আমরা দুজনেই দূরে চুপচাপ বসে আছি! তাহলে ওরা ভয় পাচ্ছে কেন?

এইসময় আমার চোখে পড়ল সামনে পড়ে থাকা কাটারিটা! বিদ্যুতের মতো মাথায় খেলে গেল এই অস্ত্রটাই তাহলে আসল কারণ? ওরা অত দূর থেকে দেখতে পাচ্ছে? বিড়বিড় করে বললাম, ‘কাটারিটা ব্যাগে ঢোকাও।’

দিবাকর তাই করে উঠে দাঁড়াল।

‘ফিরে চলুন। আর এক মুহূর্তও এখানে থাকা ঠিক নয়। ওরা বিলকুল জ্যান্ত।’ ওর মুখে রীতিমতো ভয়।

‘যা দেখার, আপনি দেখে নিয়েছেন। আরও কিছু দেখার চেষ্টা না করাই ভাল। তারপর হয়ত প্রাণ নিয়ে ফিরতে পারব না।’ বলে যাবার জন্যে পা বাড়াল।

ওর কথা শুনে সেইসময়ই ফিরে আসা উচিত ছিল। তাহলে ঐ ভয়ঙ্কর দৃশ্য দেখতে হত না…

দিবাকর ফিরে যাবার জন্যে পা বাড়াতেই ওর হাতটা ধরলাম।

‘ভয় পেও না। ব্যাগটা এখানে রেখে খালি হাতে গাছটার কাছে যাব। কাটারি ছাড়া গেলে দেখি ওদের কী প্রতিক্রিয়া হয়?’ তাহলে আমিও মেনে নিচ্ছি ওরা জীবিত! আমাদের মতো ওদেরও ইন্দ্রিয়গুলো সজাগ।

ও ভৈরববাবার কথা আবার বলল, ‘উনি নিষেধ করেছিলেন। তবু আপনার কথায় এখানে এসেছি। প্রসাদের মৃত্যুর কথাটা ভাবুন।’

আমি ওর পিঠে হাত দিলাম। ‘তুমি লেখাপড়া জানা লোক। ঐসব ভূত-প্রেতে বিশ্বাস করো? তাছাড়া গাছগুলোর একটাই প্রতিবন্ধকতা ওরা আমাদের মতো দৌড়তে পারে না। সেইরকম বিপদে পড়লে ছুটে পালাব।’

তবু ওর মনের ভয় কাটাতে পারলাম না। অগত্যা বললাম, ‘বেশ, তুমি এখানেই দাঁড়াও। আমি গাছটার কাছে গিয়ে একবার দেখে আসি।’ ও অসহায় গলায় বলল, ‘গাছে হাত দিয়ে দেখবেন… জ্যান্ত কি না?’ বুঝতে পারছি ও এই স্থান থেকে পালাতে চাইছে। একটু আগেই যা দৃশ্য দেখেছি তাতে পালানোই স্বাভাবিক। কিন্তু আমার মন বলছে এখনও কিছু দেখার বাকি আছে। সেই শেষ দেখার ইচ্ছে আমাকে আকর্ষণ করছে। সম্মোহিতের মত এগিয়ে চললাম গাছটার দিকে। ও পুতুলের মত দাঁড়িয়ে রইল বিস্ফারিত চোখে।

অনেকটা কাছে এগিয়ে এসেছি। এত কাছে চলে এসেছি যে শিমুল গাছ দুটোকে হাত বাড়ালেই ছোঁয়া যাবে। ঘামের উগ্র গন্ধটা সারা দেহে যেন ছড়িয়ে যাচ্ছে। ওদের গা থেকে আসছে নাকি? কথাটা মনে আসতেই একটু শিউরে উঠলাম। মাথার ওপর ডালপালা বিস্তার করে গাছটা দাঁড়িয়ে। চোখে পড়ল ওর বিরাট কান্ডটা এবং তখনই আমার যেন ষষ্ঠ ইন্দ্রিয় জাগ্রত হল। ভয়ার্ত চোখে দেখলাম ওর মোটা কান্ডটা মানুষের বুকের মতো ওঠানামা করছে।

শেষ প্রশ্ন জানার জন্য দুরু—দুরু বুকে দু’হাত দিয়ে গাছটাকে ছুঁলাম। এক লহমায় সারা শরীরে জমে থাকা ভয়টা আতঙ্কের আকার নিল। একি! ঠিক যেন দাঁড়িয়ে থাকা কোনো মানুষের শরীর ছুঁলাম। যার সারা দেহ ঘামে জবজব করছে!

বোধহয় এক মিনিটও হবে না দিবাকরের বিকট চিৎকার কানে আছড়ে পড়ল।

স্যার, ওপরের দিকে তাকান!!’

ওপরে তাকাতেই সারা শরীর অবশ হয়ে এল। একটা কালো মোটা ডাল বিদ্যুৎগতিতে নিচে নেমে আসছে আমার মাথা লক্ষ্য করে। যেন কোনো দানব তার লৌহমুষ্টি দিয়ে আঘাত করতে চলেছে। ছেঁড়া ধনুকের ছিলার মতো এক লাফ দিয়ে পিছতেই ডালটা সপাটে এসে পায়ের কাছে পড়ল। এক চুল সময়ের এদিক-ওদিক হলে এতক্ষণে আমার মাথা ফেটে চৌচির হয়ে যেত।

কী ভয়ানক প্রতিহিংসা! ওপর দিক থেকে মড়মড় আওয়াজে আমার মস্তিস্ক সজাগ হল। আরও একটা শুকনো ডাল আপনা থেকেই ভাঙতে শুরু করেছে। এরপর এখানে দাঁড়িয়ে থাকা আত্মহত্যার সামিল। দৌড়ে এগোলাম দিবাকরের দিকে। ও আমার আসার প্রতীক্ষায় যেন অপেক্ষারত।

এবার শুনতে পাচ্ছি মেঘমুক্ত আকাশে ঝড়ের শব্দ। হু হু বেগে ছুটে আসছে এক বিরাট ঝড়! আশেপাশের গাছগুলোতেও লেগেছে ঝড়ের কাঁপন! আমরা দু’জন লাফিয়ে বড় পাথরটার কাছে পৌঁছতেই এক রাশ ঝরা শুকনো পাতা আর কাঠিকুটি উড়ে এল আমাদের লক্ষ্য করে। সরু সরু ডাল তীব্র বেগে মুখে মাথায় লাগছে। যেন কারা ঝাঁকে—ঝাঁকে তীর ছুঁড়ছে! পাথরটা ডিঙিয়ে নিচের পথ ধরলাম।

ভাবতে পারছি না এই অসম্ভব ব্যাপারগুলো ঘটছে কীভাবে? তবে কি গাছেদের সাথে প্রকৃতিও কি আমাদের ওপর রুষ্ট? একটু নামতেই চোখের সামনে আরও এক বিভীষিকা দেখতে পেলাম! প্রবল বাতাসের ধাক্কায় সেই বিরাট মৌচাক ছেড়ে হাজার হাজার মৌমাছি চারিদিক কালো করে উড়ে বেড়াচ্ছে।

দিবাকর কোনোও রকমে বলল, ‘কিছু করার নেই। ঐ ঝাঁকের মধ্যে দিয়েই যেতে হবে। শুধু চোখ দুটো বাঁচাবার চেষ্টা করবেন।’

বুঝতে পারছি আমার গোঁয়ার্তুমির জন্যেই মহা বিপদে পড়া। অতগুলো মৌমাছি যদি হুল ফোটায়? বুক থেকে কান্নার একটা ডেলা উঠে আসতে চাইছে। এ যেন যেচে ফাঁসির দড়ি গলায় পরা! তবে কি প্রসাদও এইরকম মৌমাছির বিষের শিকার হয়েছিল?

আমরা পকেট থেকে রুমাল বার করে মুখ আড়াল করার চেষ্টা করলাম। হাস্যকর প্রয়াস! প্রথম হুলটা পিঠে ফোটাবার সঙ্গে সঙ্গে মনে হল পিঠে কে যেন গরম ছুঁচ ঢুকিয়ে দিল। ঐ জায়গাটা পেরোতে গিয়ে কমপক্ষে কত কামড় খেলাম জানি না। কেননা প্রাণের মায়া বড় মায়া। মনে হচ্ছে আমরা গড়িয়ে গড়িয়ে নিচে নেমে চলেছি। পিছনে তাড়া করে আসছে কালান্তক যমের মতো সমস্ত বৃক্ষরাজি, পাখি, কীটপতঙ্গ — তার সঙ্গে প্রকৃতি। মনে হচ্ছে সকলে একজোট হয়েছে আমাদের চরম শিক্ষা দিতে।

নিচে নদীটা দেখা যাচ্ছে। আমরা পৌঁছতে পারব তো ওখানে জীবন্ত অবস্থায়? এই সময় আমাদের কানের কাছে কারা যেন রাগে হিসহিসিয়ে বলে উঠল, ‘যুগ যুগ ধরে আমাদের ধ্বংস করে চলেছিস তোরা। বহু দিন চুপ করে সহ্য করে চলেছি আমরা! প্রতিনিয়ত সবুজ গাছগুলো নির্বিবাদে কেটে চলেছিস। কত পশুপাখি অকারণে মারছিস। এইটুকু জ্ঞান নেই, প্রকৃতির ভারসাম্য আমরাই রাখি। নিজেদের আবার জ্ঞানী ভেবে অহংকার করিস? আমরা অচলা অবলা বলে শুধু চিরন্তন নীরবে সহ্য করে যাব? না… আর নয়। সবুজ ধ্বংস করতে দেব না। কেননা এখান থেকেই সৃষ্টি হয় নব জীবনের বীজ, নতুন পরিবেশ। এবার থেকে আমরাও প্রতিশোধ নেব, নিজেদের বাঁচাতে।’

তাড়া খাওয়া জন্তুর মতো যন্ত্রণায় কাতরাতে কাতরাতে আমরা নেমে চললাম সমতলের দিকে।

সকল অধ্যায়

নোট নিতে এবং টেক্সট হাইলাইট করতে লগইন করুন

লগইন