পিন্ডদান – শঙ্কর চ্যাটার্জী

শঙ্কর চ্যাটার্জী

সঞ্জিতের কয়েকদিন ধরেই ভয় ভয় লাগছিল। আর কয়েকদিন বাদেই তার অপারেশন। পেটের যন্ত্রণার কারণে ডাক্তার দেখানো। শেষে ধরা পড়ল পেটে টিউমার। বেশ বড় আকার ধারণ করেছে। ও নিজেও বুঝতে পারেনি। কতই বা বয়স ওর… বড় জোর চব্বিশ। নিজের গাফিলতির জন্যে এই অবস্থা! মুঠো মুঠো পেন কিলার খেয়েছে। বাবা-মায়ের একমাত্র সন্তান।

জলপাইগুড়ির নার্সিং হোমেই ডা. সোম অপারেশনটা করবেন। বাবা চেয়েছিল কলকাতায় গিয়ে অপারেশন হোক। কিন্তু ডা. সোম সাহস দিলেন। তাই ওরা রাজি হল। আজ বুধবার, ডাক্তার শনিবার অপারেট করবেন। শুক্রবার বেলায় ভর্তি হতে হবে। কেমন যেন একটা নার্ভাস লাগছে ওর। যদি অপারেশন সাকসেসফুল না হয়? ডাক্তার যতই আশ্বাস দিক না কেন… যার হয় সে-ই একমাত্র বুঝতে পারে।

কত রকম বাজে চিন্তা মাথায় আসে! যদি সে মরে যায়? এই সুন্দর পৃথিবীর আলো যদি আর দেখতে না পায়? সে মরে গেলে বাবা-মায়ের কী হবে? তাছাড়া আর একটা চিন্তা তাকে বেশি ভাবাচ্ছে। আগামী মাসে নতুন চাকরিতে জয়েন করার কথা। হায়দ্রাবাদে একটা নামজাদা কোম্পানি। ফ্লাইটের টিকিট কাটাও কমপ্লিট।

ডাক্তারবাবু অবশ্য বলেছেন, একটু ডিফিকাল্ট সার্জারি হলেও দিন বারোর মধ্যে ফিট হয়ে যাবে সঞ্জিত। কে জানে কতটা সত্যি?

শুক্রবার ওরা নার্সিং হোমে এল। তার আগেই ওর গ্রুপ অনুযায়ী ব্লাড নার্সিংহোম জোগাড় করে রেখেছে। মা যাওয়ার আগে ওর মাথায় হাত বুলিয়ে দিয়ে গেল। বাবা ওর জন্য কেবিনের ব্যবস্থা করেছে যাতে ছেলের কোনো অসুবিধে না হয়!

কাল সকাল দশটায় অপারেশন হবে। প্রায় ঘন্টা দেড়েকের ব্যাপার। বিকেল থেকেই ওর খাওয়া বন্ধ। স্যালাইন দেওয়া শুরু হল। ওর কেবিনের ঘড়িতে রাত দশটা বাজছে। এখন একাই রয়েছে সঞ্জিত। মাথার মধ্যে চিন্তাগুলো হুটোপাটি করছে। এখন এই শান্ত পরিবেশে সেগুলো যেন আরও প্রকট হয়ে উঠছে। খালি মনে হচ্ছে আজকের রাতটাই তার জীবনের অন্তিম রাত! ডাক্তারের প্রতিশ্রুতিও কেমন জোলো ঠেকছে! মনটা ক্রমশ দুর্বল হয়ে পড়ছে।

এটা তো তার পক্ষে ভালো লক্ষণ নয়। সঞ্জিত চেষ্টা করল মনকে শক্ত করতে। কত বড় বড় জটিল অপারেশন নির্বিঘ্নে হয়ে যাচ্ছে। এই তো রাঙা মামার ওপেন হার্ট সার্জারি হল কিছুদিন আগে। এখন দিব্যি ঘুরে বেড়াচ্ছে। মনকে প্রবোধ দেবার চেষ্টা করে সে। এখন মনে হচ্ছে সিঙ্গেল কেবিন না নিলেই ভাল হত। তবু অন্য রোগীর সঙ্গে কথা বললে এইসব ছাইপাঁশ চিন্তাগুলো মাথায় আসত না।

এই সময় একজন নার্স ঢুকল। সে স্যালাইনের বোতলটা চেক করে বলল, ‘রাতের আয়া আসবে, যদি কিছু দরকার লাগে বলবেন।’ সঞ্জিত এবার একটু চোখটা বন্ধ করে ঘুমোবার চেষ্টা করতে লাগল। নতুন একটা ভাবনা মনে উদয় হল। এই কেবিনে এর আগেও অনেক রোগী এসেছে। তার মধ্যে সবাই কি বেঁচে ফিরে গেছে?

ব্যস… শুরু হয়ে গেল নতুন এক কাহিনী। তার আত্মা যদি এখনও এখানে থেকে থাকে? ভয়ে ভয়ে চোখ খুলে ঘরের চারদিকে দেখতে গিয়ে মনে হল দমটা আটকে গেল! ঘরের কম আলোয় দেখল জানলার কাছে টুলে বসে একটা সবুজ পাড়ওয়ালা সাদা শাড়ী পরা একটা মেয়ে। মুখটা অন্ধকারে ঢাকা। বুকের মধ্যে কে যেন হাতুড়ি পেটাচ্ছে। উঠে বসতেও শক্তি পাচ্ছে না। হাত-পা ঠান্ডা লাগছে। মুখ দিয়ে অনেক কষ্টে উচ্চারণ করল, ‘কে? কে ওখানে?’ গলার স্বরটা ভেঙ্গে গেল।

ওর গলার আওয়াজে মেয়েটা ধীরে ধীরে মাথা তুলে সঞ্জিতের দিকে তাকাল। মিষ্টি গলায় বলল, ‘কী হল, ভয় পেয়েছেন নাকি?’

মনে অল্প সাহস ফিরে এল। নিজের মনেই লজ্জিত হল। এই তাহলে রাত্রের আয়া। ওর চোখ বন্ধ থাকাকালীন নিশ্চয়ই এসে বসেছে! আমতা আমতা করে বলল, ‘ঘরের বড় আলোটা জ্বালিয়ে দিন।’

মেয়েটা উঠে আলোটা অন করল। মুখের দিকে তাকিয়ে বলল, ‘অপারেশনের আগে মনটা একটু দুর্বল হয়। ভয় নেই। ঘুমোন, আমি আছি। টুলে বসে বই পড়ছি।’

এবার সত্যিই লজ্জা লাগল। কী ভাবল মেয়েটা কে জানে? সঞ্জিতের থেকে বয়সে ছোট। চোখটা বন্ধ করল। বইয়ের পাতা ওল্টানোর শব্দে বুঝল মেয়েটা আবার বই পড়ায় মনোযোগ দিয়েছে।

চোখ বুজে সঞ্জিত ভেবে চলে, আজ বাদে কাল ও চাকরি করতে যাচ্ছে। সেখানে একাই থাকতে হবে। আর এইটুকুতেই ভয় পেয়ে যাচ্ছে! উল্টে ঐ কমবয়সী আয়াটাই জ্ঞান দিয়ে দিল। চোখ পিটপিট করে তাকাল। একমনে বই পড়ছে মেয়েটা। সাদা শাড়িতে ছিপছিপে শরীরটা যেন চোখটা টানে। ওর মায়াবী চোখ দুটো বড় সুন্দর। এখনও কোনোদিন কোনো মেয়ের সাথে তার ভালোবাসা হয়নি। এই মুহূর্তে ঘরে ওরা শুধু দু’জন। তবে কি ও মেয়েটাকে ভালোবাসতে শুরু করে দিয়েছে? পরক্ষণেই নিজের মনকে সংযত করে। মাথা থেকে পাগলামিটা দূর করে। মনে হচ্ছে এবার ঘুমটা আসছে।

হাতের ওপর কোমল স্পর্শ পেয়ে ঘুমটা পাতলা হল। চোখ মেলতেই একেবারে মুখের সামনে মেয়েটাকে দেখতে পেয়ে চমকে উঠল! মনে হল ওর গলাটা টিপতে আসছে!

‘চমকে উঠলেন কেন?’ মৃদু হাসল মেয়েটা, ‘এইরকম ভীতু ছেলে আগে দেখিনি।’ সঞ্জিত দেখল স্যালাইনের খালি বোতলটা ও বদলাতে এসেছে।

‘মোটেই ভয় পাইনি।’ সতেজ কণ্ঠ সঞ্জিতের। ‘ঘুমের ঘোরে ছিলাম তাই।’

মেয়েটা মিষ্টি গলায় বলল, ‘বাথরুম যাবেন? কেননা এরপর নতুন স্যালাইনের বোতল লাগাব।’ সঞ্জিত ঘড়িটা দেখল। এগারোটা কুড়ি। ও সম্মতি জানাল। কিন্তু মেয়েটাও কি ওর সঙ্গে বাথরুমের ভেতরে যাবে নাকি? তাহলে তো লজ্জায় বাথরুম করতেই পারবে না।

মেয়েটা বোধহয় ওর মনের ভাব বুঝতে পারল। তাই বলল, ‘আপনি একজন রোগী হিসেবেই নিজেকে মনে করুন। তাহলেই লজ্জাটা কেটে যাবে। তাছাড়া আমি চোখ বন্ধ করে থাকব।’

সঞ্জিতের হাতটা সন্তর্পণে ধরে ওকে উঠতে সাহায্য করল মেয়েটা। টয়লেটে এসে দাঁড়াল ওরা। আয়া চোখ বন্ধ করে বলল, ‘নিন, আমার চোখ বন্ধ।’ পাজামার মতো নার্সিং হোমের ড্রেসটার চেন খোলার সময় ওর চোখ বাথরুমের আয়নাটার দিকে পড়তেই চোখে অন্ধকার দেখল। মাথার ক্ষুদ্র গ্রে সেলগুলো উত্তেজিত হয়ে ওকে বিপদের আগাম নোটিস দিল। দুনিয়ার আতঙ্ক ঝাঁপিয়ে পড়ে ওর ইন্দ্রিয়গুলো টুকরো টুকরো করতে শুরু করল! বাথরুমের আয়নার দিকে রক্তশূন্য মুখে ও তাকিয়ে দেখছে, শুধুমাত্র সঞ্জিত একাকী দাঁড়িয়ে! মেয়েটার চিহ্ন মাত্র নেই!

কাঁপা চোখে পিছন ফিরে তাকাতেই সারা শরীর হিম হয়ে গেল। মেয়েটা চোখ বুজে ওর পিছনেই দাঁড়িয়ে আছে! এত কাছে যে ওর নিঃশ্বাস ঘাড়ের ওপর পড়ছে। ব্যাপারটা পরীক্ষা করার জন্যে আরও একবার আয়নার দিকে তাকাল। আয়নার ভেতর সঞ্জিত ছাড়া আর কেউ নেই!

 ওর মস্তিস্ক ক্রমশ ধোঁয়াটে হয়ে যাচ্ছে। দু’চোখ জুড়ে কালো আঁধার ছাইছে। পায়ের জোর কমে যাচ্ছে। শেষ বার ওর মগজ জানিয়ে দিল ওর সাথে যে রয়েছে সে মানুষ নয়। এটা জানার সঙ্গে সঙ্গেই ও চেতনা হারাতে শুরু করল। মুখ দিয়ে একটা গোঙানির শব্দ বেরিয়ে এল।

 হাঁটু ভেঙে মাটিতে পড়ার আগে দুটো শক্ত হাত ওকে জড়িয়ে ধরল। অস্পষ্ট একটা শব্দ কানে এল, ‘ডাক্তারবাবু, তাড়াতাড়ি আসুন… পেশেন্ট জ্ঞান হারিয়ে ফেলছে।’

 জলের ঝাপটায় জ্ঞান ফিরল সঞ্জিতের। চোখে পড়ল ডাক্তারের সাথে নার্সদের উদ্বিগ্ন মুখ। ডাক্তার প্রশ্ন করলেন, ‘কী ব্যাপার? আপনি একা একা টয়লেটে গেছেন কেন? তাও আবার স্যালাইনের সিরিঞ্জ খুলে? রাতের আয়া তো বাইরেই বসে ছিল।’

রাতের আয়া বলল, ‘ভাগ্যিস একটা গোঙানির আওয়াজ পেয়ে এসেছিলাম! নাহলে বিরাট একটা দুর্ঘটনা ঘটত! আপনিই বলুন স্যার, আর আপনার বাড়ির লোকদের কী জবাব দিতাম?’ সঞ্জিতের মুখে কোনো কথা সরছে না! কী বলবে? ঘাড় ঘুরিয়ে একবার টুলটার দিকে তাকাল। নেই… কেউ নেই! শুধু টেবিলের ওপর পাখার হাওয়ায় খোলা বইটার পাতাগুলো ফরফর করে উড়ছে।

বাকি রাতটুকু কীভাবে কাটাবে ও?

আয়া আবার নতুন করে ছুঁচ ফুটিয়ে স্যালাইন চালু করল। সঞ্জিত জানে বাকি রাতটুকু জেগেই কাটাতে হবে। সকালে বাবা এলেই জেনারেল বেডের কথা বলতে হবে। পরক্ষণেই মনে হল মেয়েটা যদি ওখানেও দেখা দেয়? তাছাড়া ওটি-তেও তো থাকতে পারে? বুঝে পেল না কী করা উচিৎ? ভোরের জন্য প্রতীক্ষা করে চলল। বাবা-মাকে বলে সিদ্ধান্ত নিতে হবে।।

সকালবেলায় সঞ্জিতের বাবা-মা নার্সিং হোমে এল। কিন্তু ছেলেকে দেখে ওরা অবাক হয়ে গেল। এক রাত্তিরে চোখমুখের এ কী অবস্থা হয়েছে ওর? মনে হচ্ছে চিন্তায়, ক্লান্তিতে মুখটা জর্জরিত। রাতারাতি চোখের কোলে এক পোঁচ কালি। মা নির্মলা দেবী উদ্বিগ্ন গলায় বলেন, ‘কী হয়েছে তোর? শরীর ভালো আছে তো?’ বাবা সূর্যবাবুও চিন্তান্বিত।

সঞ্জিত একটু ভাবল। তারপর ঠিক করল রাত্রের ঘটনাটা বলে দেওয়াই ভাল। এরপর যদি মেয়েটা আবার দেখা দেয়? সে ধাক্কা ও সামলাতে পারবে না…

 মিনমিনে স্বরে রাতের ঘটনাটা বলল। ওঁরা দুজনেই একটু চমকালেন। বুঝতে পারছেন না কতখানি সত্যি বা কতটা মনের ভুল? মা ছেলের কথা পুরোপুরি অবিশ্বাস করতে পারলেন না। কিন্তু সূর্যবাবুর মনে হল ও নিশ্চয়ই কোনো ভয়ঙ্কর স্বপ্ন দেখেছে!

সঞ্জিত জোর গলায় বলল, ‘বিশ্বাস করো তোমরা, আমি এক চুল বাড়িয়ে বলছি না। এরপরেও যদি এই নার্সিং হোমে থাকতে হয়…’ ওর মনের মধ্যে লুকিয়ে থাকা ভয়টা আবার প্রকাশ পেতে শুরু করল। বাবা-মায়ের মুখটাও গম্ভীর হল। ওদের মাথায় আসছে না এই অবস্থায় ছেলেকে নিয়ে কোথায় যাবে? যার আর ঘন্টাখানেক পর অপারেশন! সূর্যবাবু দোনামোনা হয়ে বললেন, ‘বেশ, ডাঃ সোম আসুক। কিন্তু জানি এই হাস্যকর গল্প উনিও বিশ্বাস করবেন না। তাছাড়া এই মুহূর্তে তোকে অন্য কোথাও নিয়ে যাওয়াও তো রিস্কের ব্যাপার।’

সঞ্জিতও বাবার চিন্তা আর কথাটা বুঝতে পারছে। নিজের মনটাকে তাই শক্ত করার চেষ্টা করল। দেখা যাক ডাক্তার শুনে কী বলেন?

সাড়ে নটার সময় ডাঃ সোম এলেন। সূর্যবাবু সব বললেন। সোমের মুখে অবাস্তবতার ছোঁয়া, ‘হ্যাঁ, আমি নার্সদের মুখে যেটা শুনেছি, তা হল আপনার ছেলে একাই স্যালাইনের নল খুলে বাথরুমে গিয়েছিল। এটা খুব অন্যায়। কিন্তু তখন এসব কথা ও বলেনি।’

সঞ্জিত তোতলাল, ‘না মানে — তখন আমার মনের অবস্থা স্বাভাবিক ছিল না।’

‘শোনো, অনেক রোগী সার্জারির আগে একটু দুর্বল হয়ে পড়ে। সেইজন্যে নানা রকম ভুলভাল দেখে। এই হোমে প্রতিদিন কত পেশেন্ট আসছে-যাচ্ছে, কই এই ধরণের কথা কোনোদিন শুনিনি। এইসব কথা পাঁচ কান হয়ে গেলে নার্সিং হোমেরই বদনাম হয়ে যাবে। তুমি আজকালকার ছেলে হয়ে… প্লিজ় সঞ্জিত, মন থেকে ভুল ধারণা ছাড়ো।’ ডাক্তার সোম তো ছোটখাটো একটা বক্তৃতাই দিয়ে ফেললেন। এরপর আর কী বলার থাকতে পারে? সত্যি কি তার মনের ভুল? স্বপ্ন কখনও এত জ্যান্ত হয়? ও দোটানায় পড়ে যাচ্ছে।

ডাক্তার ওর প্রেশার আর হার্ট বিট চেক করে গম্ভীর হয়ে গেলেন। মুখে একরাশ বিরক্তি নিয়ে বললেন, ‘দেখো, কয়েক ঘন্টার ব্যবধানে ভুলভাল চিন্তা আর সারারাত না ঘুমিয়ে প্রেশারটাকে হাই করে তুললে!’ সূর্যবাবুর দিকে তাকিয়ে বললেন, ‘ও এত নার্ভাস বুঝতে পারিনি। মনে হচ্ছে এই মুহূর্তে অপারেট করা ঠিক হবে না। ওর শরীরের অবস্থা একটু স্থিতিশীল হোক। খুব ঝামেলায় পড়া গেল।’ সঞ্জিত বাবার মুখেও বিরক্তি দেখল। শেষে ঠিক হল বিকেল পাঁচটা নাগাদ অপারেশন হবে। ডাক্তার নার্সকে কয়েকটা ওষুধ আর ইনজেকশন লিখে দিয়ে চলে গেলেন।

মা-বাবা দুজনেই ওকে বোঝালেন। নির্মলা দেবী ঠাকুরের ফুল এনেছিলেন। ছেলের বালিশের নিচে রেখে বললেন, ‘আর ভয় লাগবে না। তুই বরং ঘুমোবার চেষ্টা কর…’ সঞ্জিত ওদের দিকে তাকিয়ে বলল, ‘হয়ত আমার মনের ভুল! যাক, ভাবনা করবে না। বিকালে চলে এস।’ এইসময় নার্স সিরিঞ্জ নিয়ে ঘরে ঢুকল। ইঞ্জেকশন নেবার দু’মিনিটের মধ্যেই চোখের পাতা ভারী হয়ে এল। গভীর ঘুমের মধ্যে সঞ্জিত প্রবেশ করল।

বিকেলে ওর ঘুম ভাঙল। শরীরটা বেশ ঝরঝরে লাগছে। মাথাটাও একটু হালকা। মা-বাবার সাথে ডাক্তারও কেবিনে ঢুকলেন। সোম সবকিছু দেখে হেসে বললেন, ‘এই তো ইয়ং ম্যান একেবারে ফিট। আর ঘন্টাখানেকের মধ্যে তোমার শরীর থেকে ঐ আবর্জনার তালটা বাদ দিয়ে দিলেই দু’দিনের মধ্যে চাঙ্গা হয়ে উঠবে।’ সঞ্জিতের মনে সাহসটা ফিরে আসতে শুরু করল।

‘কিন্তু একটা কথা স্যার।’ ও বলল, ‘সার্জারির পর আমাকে জেনারেল বেডে রাখবেন!’

একটু কী ভেবে সোম বললেন, ‘…ওয়েল তাই হবে।’ পনেরো মিনিটের মধ্যে ওকে রেডি করে ওটি-তে নিয়ে গেল। জীবনে এই প্রথম অপারেশন থিয়েটারে ও ট্রলি চেপে প্রবেশ করল।

তখনও সঞ্জিত জানত না, ওর জন্য কী অভিজ্ঞতা ওখানে ওঁৎ পেতে রয়েছে!

সঞ্জিত চোখ মেলে চারধার দেখল। নানাবিধ ডাক্তারি অত্যাধুনিক যন্ত্র। যার অর্ধেক নাম ও জানে না। ওকে যে টেবিলে শোয়ানো হল তার একটু উঁচুতে জোরালো আলোর সমাহার। মনে হয় ওর অপারেশনটা অল্প জটিল। কেননা সোম ছাড়াও দু’জন ডাক্তার রয়েছেন। এছাড়া দু’জন নার্স। সবাইয়ের মুখে কাপড়ের মাস্ক বাঁধা। পাশেই একটা সরু টেবিলে অজস্র বিভিন্ন ধরণের কাঁচি, ছুরি, চিমটে। একটা ট্রেতে বান্ডিল বান্ডিল তুলো।

এইসব দেখে মনটা অল্প দুলে উঠল! একজন ডাক্তার এগিয়ে এসে তার কব্জির কাছে ইঞ্জেকশনের সিরিঞ্জটা ফোঁটালেন। ওর বাড়ি কোথায় জিজ্ঞেস করলেন। সঞ্জিত শুধু রেল কলোনি কথাটাই বলতে পারল। বাকিটা উহ্য থেকে গেল। মনে হতে লাগল একটা উঁচু জায়গা থেকে কে যেন অনেক নিচের অন্ধকার গহ্বরে ঠেলে ফেলে দিল। শরীরটা হালকা থেকে হালকাতর হয়ে চলল। ক্রমশ ও অন্ধকারের মধ্যে বিলীন হয়ে যাচ্ছে। আশপাশের যে ছুরি-কাঁচির শব্দগুলো কানে আসছিল তাও এক মুহূর্তে মিলিয়ে গেল।

একেই কি অজ্ঞান করা বলে? খুব তো একটা সুখকর নয়! মনে হচ্ছে কেউ ওর নাকে-মুখে রবারের কিছু পরিয়ে দিচ্ছে! বুকের মধ্যে বাতাসটাও যেন কমে আসছে — হাঁ করে একটু বাতাস নেবার চেষ্টা করতেই একটা কি রকম গা গোলানো গন্ধ নাক-মুখ দিয়ে দেহে ঢুকল। তার সাথে সাথেই ও পুরো চেতনাটাই হারিয়ে ফেলল।

কতক্ষণ… কত সময়… ও কালো কুচকুচে মেঘের মধ্যে সাঁতার কেটেছে জানে না! দূরে, বহু দূরে একটা আলোর বিন্দু চোখে পড়ছে। এতক্ষণ বাদে ও আলো দেখতে পেল। আলোর বিন্দুটা ক্রমশ বড় আকার ধারণ করার সঙ্গে সঙ্গেই চারিদিকে একটা আবছা আলোর সৃষ্টি হচ্ছে। যার ফলে অন্ধকারটা ধীরে ধীরে কমে যাচ্ছে। আলোর প্রাণী আলো ছাড়া অন্ধ। সত্যি অন্ধদের কী কষ্ট! এখন নতুন করে বুঝতে পারছে। ওর মনটাও আস্তে আস্তে সচল হচ্ছে।

মস্তিস্কটাও কিছুটা কাজ করছে। কেননা মনে পড়ছে ওর অপারেশন হচ্ছিল। সেটা কি শেষ হয়ে গেছে? না এখনও শুরু হয়নি? মাথাটা এখনও সম্পূর্ণ সক্রিয় হয়নি বলেই চিন্তাগুলো জুড়ছে না। মাঝপথেই ভেঙ্গে যাচ্ছে। জিভটা খুব শুকনো ঠেকছে। বড্ড তেষ্টা পাচ্ছে। একটু জল পেলে ভাল হত। কাউকে ডেকে বলবে? কিন্তু আশপাশে অস্পষ্ট আঁধারে কাউকে দেখা যাচ্ছে না। তবে কি ওকে ওটি-তে ফেলে রেখে সবাই চলে গেল!

এবার সেই পুরোনো ভয়টা হঠাৎ করে মনে ফিরে আসছে। তার সঙ্গে ফিরে আসছে সেই ছিপছিপে ফর্সা শরীরটা। যাকে অনেকটা সময় ধরে ও মন আর মাথা থেকে দূরে সরিয়ে রেখেছিল। মনে হচ্ছে সেই অশরীরীর অপেক্ষার বাঁধ ভেঙে গেছে! অন্ধকারের দেওয়াল ভেদ করে সে বেরিয়ে আসতে চাইছে। তার সেই সবুজ পাড়ওয়ালা সাদা শাড়ি পরা দেহটা এক পা এক পা করে সঞ্জিতের দিকে এগিয়ে আসছে। মৃত্যুর গহ্বর থেকে ফের মাথা তুলেছে সেই মৃতা! সঞ্জিতের সারা শরীরে হিম শীতল স্পর্শ অনুভূত হচ্ছে।

সেই আলোর বিন্দুটাও যেন স্থির হয়ে গেছে। তাই ঐটুকু আলো চারিদিক আলোকিত করতে সক্ষম হচ্ছে না। তবে কি আবার সে স্বপ্ন দেখছে? জোর করে চোখের পাতাগুলো খোলার চেষ্টা করতেই ও অবাক হয়ে গেল। এ কি! অদ্ভুত ব্যাপার! ওর চোখের পাতা দিব্যি নড়াচড়া করছে! তার মানে সঞ্জিত জেগেই আছে। ওর অনেক আগেই জ্ঞান ফিরে এসেছে! তাহলে ওর অপারেশন শেষ হয়ে গেছে! ওকে তার মানে সেই পুরোনো অন্ধকার কেবিনটাতেই শুইয়ে দিয়ে গেছে? ঘাড় ঘুরিয়ে এদিক-ওদিক দেখার চেষ্টা করল। সবই যেন অস্পষ্ট — পরিষ্কার কিছু নয়। অ্যানেসথেসিয়ার প্রভাব কি এখনও কাটেনি?

চোখ দুটোকে বড় বড় করে দেখার চেষ্টা করতে আবছা ভাবে চোখে পড়ল অপারেশন ঘরটা। তার টেবিলেই ও শুয়ে আছে। এক ঝটকায় মস্তিস্কটা সচল হল এবং তখনই হৃৎপিন্ডটা কেঁপে উঠল। কেননা চারিদিকে আবছা দেখার কারণটা ও অনুভব করতে পারল। একটা সাদা চাদর দিয়ে ওর মাথা থেকে পা পর্যন্ত ঢাকা! তবে কি ও মরে গেছে? না হলে এভাবে চাদর দিয়ে ওর দেহ ঢাকা কেন? হাতের ঝটকায় মাথা থেকে চাদরটা সরাতেই অপারেশন চেম্বারটা চোখের সামনে স্পষ্ট ভেসে উঠল। ঐ তো চারিদিকে রক্ত মাখা ছুরি, কাঁচি ছড়ানো। পেঁজা পেঁজা রক্তে মাখানো তুলো! কিন্তু ঘরের অতগুলো উজ্জ্বল আলো কোথায় গেল? সেখানে ছোট একটা টিমটিমে আলো জ্বলছে। ডাক্তার বা নার্সরাই বা কোথায় গেল? এখানে ওকে একা ফেলে দিয়ে কেন চলে গেছে?

একটু উঠে বসতে গিয়ে পেটের কাছটায় একটা বিরাট যন্ত্রণা মোচড় দিয়ে উঠল! ঘাড় উঁচু করে পেটের দিকটায় দৃষ্টি পড়তেই মনে হল অ্যানেসথেসিয়া ছাড়াই ও জ্ঞান হারিয়ে ফেলবে! ওর পেটটা দু’ ফালা করে কাটা! ভেতরের নাড়িভুঁড়িগুলো লাল রক্তে দগদগ করছে। ওরা সেলাই পর্যন্ত না করে চলে গেছে!

এই সময় একটা কনকনে ঠান্ডা হাতের স্পর্শ কপালে পেল। এক লহমায় সারা শরীরের তাপমাত্রা মাইনাস ডিগ্ৰীতে নেমে গেল। মনে হচ্ছে হিম শীতল ঠান্ডায় দাঁতে দাঁত লেগে যাবে। ওর ভয়ার্ত চোখ দুটো সামনেই মেয়েটার ফ্যাকাশে মুখটা দেখতে পেল। বড় জোর আধ হাত দূরে দাঁড়িয়ে। ওর শীর্ণ হাতটা সঞ্জিতের কপালে ঠেকানো!

বিড়বিড় করে মেয়েটা বলল, ‘তোমার জল তেষ্টা পেয়েছে? আমিও বড় তৃষ্ণার্ত।’

ছুটে টেবিল থেকে নেমে দরজার কাছে পালাতে গিয়েও সেকেন্ডেরও কম সময়ে মগজ সাবধান করে দিল। সাবধান — তোমার কাটা পেট থেকে সমস্ত নাড়িভুঁড়ি মেঝেতে পড়ে ছড়িয়ে ছিটিয়ে যাবে! নিজেকে সংযত করল। এইরকম বিপদের মধ্যে কোনোদিন কেউ পড়েছে বলে ও মনে করতে পারল না। মেয়েটা খিলখিল করে হেসে উঠল যা ওর শরীরের রক্ত চলাচলকে বোধহয় থামিয়ে দিল।

ভাঙা গলায় সঞ্জিত কোনো রকমে বলল, ‘আমি কোথায়?’

দূর থেকে যেন মেয়েটার কণ্ঠস্বর কানে এল, ‘তুমি-আমি এখন একই জায়গায়। আমাদের এখন কেউ বিরক্ত করতে পারবে না।’

সঞ্জিত স্বাভাবিক অবস্থায় থাকলে এই সরল কথাটার মানে বুঝে যেত। কিন্তু এই মুহূর্তে বুঝতে পারল না। তাই আরও ভয়ঙ্কর পরিস্থিতির মধ্যে গিয়ে পড়ল।

সঞ্জিত ভয়ের গলায় বলে উঠল, ‘ডাক্তাররা আমায় ফেলে কোথায় গেল?’

মেয়েটা ওর মাথায় হাত বোলাতে বোলাতে বলল, ‘ওরা এখানে থেকে আর কী করবেন? ওদের আর কিছু করার নেই। অবশ্য একটু বাদে এসে তোমার পেটটা সেলাই করে দিয়ে যাবে। তারপর তোমার দেহটা ঠান্ডা ঘরে ঢুকিয়ে দেবে। যেমন আমাকেও করেছিল।’

সঞ্জিত এবার শিউরে উঠল। সে মৃত! এই কথাটা এবারে মগজে ঢুকল, ‘না আমি মরতে চাই না। আমাকে ছাড়া মা-বাবা বাঁচবে না।’ গলা চিরে হাহাকার বেরিয়ে এল। মেয়েটা আরও কাছে সরে এল। তার সঙ্গে ঠান্ডাটাও বাড়ল।

‘তুমি তো তবু কাছে আমাকে পাচ্ছ। আর আমি? এই কালো অন্ধকার জগতে সম্পূর্ণ একা! উঃ! কী অমানুষিক যন্ত্রণা!’ মেয়েটার গলায় হারানোর সুর।

এই প্রথম সঞ্জিত মেয়েটার মুখের দিকে তাকাল। সারা মুখটাতে একটা পাতলা সাদা চামড়া দিয়ে ঢাকা। এত পাতলা চামড়া যে ওর মুখের ভেতরের হাড়গোড় পরিষ্কার দেখা যাচ্ছে। মনের ভয়টাকে দমিয়ে বলল, ‘তুমিও কি এই নার্সিংহোমে মারা গেছিলে?’ সেই আয়ারূপী যুবতী মহিলা হাওয়ায় ভর দিয়ে ওর টেবিলে উঠে বসল। চারিদিকের শীতলতা ক্রমশ বেড়েই চলেছে।

— ‘তোমার কেবিনের বেডে আমার মৃত্যু হয়েছে মাস চারেক আগে। তোমারই মতো এই কাটা ছেঁড়ার টেবিলে। সেই থেকে এইখানেই রয়েছি। যদি কোনো সঙ্গীসাথী পাই।’

কথাগুলো ওর কান দিয়ে ঢুকে সারা দেহটাকে বরফের চাদরে মুড়ে দিল। নিজের মরার কথা বিশ্বাস করতে মন চাইছে না! কিন্তু চারপাশের পরিবেশ ওকে মানতে বাধ্য করছে।

— ‘আমার দেহটা নিয়ে ওরা এখন কী করবে?’ ও যেন অঙ্ক মেলাতে পারছে না।

— ‘তোমার বাড়ির লোকের হাতে তুলে দেবে।’

এবার মোদ্দা কথাটা মাথায় ঢুকে ওকে আরও ম্রিয়মান করে তুলল। বাবা-মায়ের হাতে যখন ওর মৃত শরীরটা তুলে দেবে, সেই দৃশ্যটা ওর সামনে ফুটে উঠল। ওদের কথা মনে পড়তেই বুকটা যন্ত্রণায় গুমরে উঠল। জানে মা সহ্য করতে পারবে না। একমাত্র ছেলের মৃত্যুশোক।

মেয়েটাও করুণ স্বরে বলল, ‘আমার বাবা-মা আর দাদাও ভেঙে পড়েছিল। মা এখনও সুস্থ হতে পারেনি। সব থেকে কষ্ট পাই আমরা, যারা মৃত। চোখের সামনে প্রিয়জনদের বুকফাটা কান্না আর হাহাকার দেখতে হয় আর সহ্য করতে হয়!’ সঞ্জিত ভাবে এই মেয়েটার সাথে যদি একান্তই তাকে থাকতে হয় তাহলে ওর নামটা জানাও প্রয়োজন।

— ‘আমার নাম কাকলী।’ মনে পড়ে গেল এই জগতে মনের কথা পড়ে নেওয়া যায়। কিন্তু কই সঞ্জিত তো মেয়েটার মনের কথা পড়তে পারছে না?

‘কয়েকদিন কাটুক, আমার মনের কথা তুমিও পড়তে পারবে।’ কাকলী ওর কাঁপুনি দেখে বলল, ‘বুঝতে পারছি, ঠান্ডা লাগছে। কয়েক ঘন্টা বাদে এটা সহ্য হয়ে যাবে!’

একটা প্রশ্ন ওর মনে জাগল, ‘আমি কি ইচ্ছে করলেই মা-বাবাকে দেখতে পারি?’

কাকলী ঘাড় নাড়ল, ‘নিশ্চয়ই, কিন্তু তাতে তোমার আরও মনটা ভেঙে যাবে। বিরাট যন্ত্রনা… তাদের দুঃখ, দুর্দশা দেখেও তুমি কিছু করতে পারবে না। বোঝাতেও পারবে না তাদের সামনেই তুমি দাঁড়িয়ে রয়েছ।’

‘তাহলে, এই যে ভূত দেখা—’

ওকে কথা শেষ করতে না দিয়েই কাকলী বলল, ‘তার জন্যে অনেক শক্তির দরকার যা এই মুহূর্তে তোমার কাছে নেই। দেখছ তো, এখনও মানুষের শরীরের অনুভূতিগুলো তোমায় ছেড়ে যায়নি। তুমি আমাকে দেখে ভয় পাচ্ছ — তোমার ঠান্ডা লাগছে… তোমার মনটা এখনও মানুষের জগতে পড়ে রয়েছে।’

‘এই জগৎ থেকে আমাদের মুক্তি নেই?’ চুপ করে রইল সে। বোধহয় এর উত্তরটা এখনো জানেনি।

এই সময় কয়েকজনের মিলিত জুতোর শব্দ দরজার কাছে শোনা গেল। তবে কি ওরা দেহটা নিতে আসছে? কাকলী হঠাৎ হিংস্র গলায় বলে উঠল, ‘তোমায় নিতে আসছে ওরা। আমি একটু আড়ালে থাকি।’ কথাটার মানে বুঝতে পারল না।

সঞ্জিত সভয়ে দেখল এক নিমেষে হাওয়ায় ভর করে কাকলী ছাদের সিলিঙে উঠে গিয়ে চার হাত-পায়ে সাদা টিকটিকির মতো আটকে রইল! কি ভয়ঙ্কর লাগছে! যেন একটা বড় টিকটিকি লাল লাল চোখ নিয়ে সিলিং থেকে ওকে লক্ষ্য করছে! সঞ্জিত নিজে অশরীরী হয়ে এই সব দৃশ্য দেখে কেন ভয় পাচ্ছে? তবে কি কাকলীর কথা ঠিক? মানুষের স্বভাব, অনুভূতি বদলাতে একটু সময় লাগবে?

কিন্তু কাকলি ভয়ে লুকিয়ে আছে কেন? তবে কি অদৃশ্য হওয়াটা এখনও পুরোপুরি রপ্ত করতে পারেনি? কোনো উত্তরই মেলাতে পারছে না। মাথাটা ঝিম ঝিম করছে। ও কান খাড়া করে শব্দটার গতিবিধি শুনতে লাগল।

জুতোর শব্দটা দরজার কাছ থেকে আবার দূরে চলে যাচ্ছে। তবে কি এখন ওরা দেহটা নিয়ে যাবে না? এবার নতুন একটা উপলব্ধি ওর শরীরে প্রবেশ করতে শুরু করল। শীতের ভাবটা ক্রমশ কমতে শুরু করেছে। কাকলীর কথা ফলতে শুরু করল তাহলে? ও বলেছিল, একটু বাদেই এই জগতের আবহাওয়ার সঙ্গে তোমার আত্মা মানিয়ে নেবে!

এছাড়াও একটা নতুন ভাবনা মাথার এক কোণে ঝিলিক দিল! ঠান্ডা কমে যাবার আরেক অর্থ হচ্ছে তার শরীরের রক্ত গরম হতে আরম্ভ করেছে! একটা ক্ষীণ আশা, যদি সে পুনর্জীবন পায়? কথাটা মাথায় আসতেই মনে একটা আনন্দের জোয়ার খেলে গেল। ইস যদি তাই হত?

সঞ্জিতের হঠাৎ ছাদের দিকে চোখ পড়তেই অবাক হয়ে গেল। কাকলীকে কোথাও দেখতে পেল না। আশ্চর্য, এই তো একটু আগেই টিকটিকির মতো আটকে ছিল! ঘরের আলোটা ক্রমশ জোরালো হচ্ছে। তাহলে আলোর জন্যে ও অদৃশ্য হয়ে গেছে। অন্ধকারের জীব আলো সহ্য করতে পারে না। সঞ্জিত নিজে পারছে কি করে? ওরও তো মৃত্যু হয়েছে।

চারিধার আলোয় উদ্ভাসিত হয়ে চলেছে। আহা কি সুন্দর আলো! আলোর এত রূপ আগে ও কোনোদিন বুঝতে পারেনি। একটা গুঞ্জনধ্বনি কানে আসছে মনে হচ্ছে! ও কানটা যথাসম্ভব খাড়া করল। হ্যাঁ একটা অস্পষ্ট, সম্মিলিত কথার আওয়াজ ও শুনতে পাচ্ছে। মানুষের কথার শব্দ! ওহ, কী মধুর! রক্ত-মাংসের জীবন্ত মানুষ দেখার জন্যে ওর শরীর-মন ব্যাকুল হচ্ছে।

মানুষের চেঁচামেচি, কোলাহল সঞ্জিতের চিরদিনই অপ্রিয়। আর আজ এই মুহূর্তে মনের একটাই ইচ্ছে যে কোনো মানুষের উপস্থিতি। এই সময় শরীরে একটা মৃদু ধাক্কা লাগল। আবার কি কাকলী ফিরে এল?

তাকাতেই আলো ঝলমল নার্সিংহোমের জেনারেল বেডগুলো চোখে পড়ল। এর পরেই দেখতে পেল বাবা-মায়ের উদ্বিগ্ন মুখ। পাশেই দাঁড়িয়ে ডা. সোম। সোমের ভরাট কণ্ঠ কানে এল, ‘হ্যালো ইয়ংম্যান, এই তো সেন্স ফিরে এসেছে। অপারেশন সাকসেসফুল।’ বাবার মুখে হাসি ছড়িয়ে পড়ল। মায়ের কোমল হাতের স্পর্শ কপালে পেল। একটা সুন্দর ভালোলাগা মন থেকে সারা শরীরে ছড়িয়ে পড়ল। মা বলছে, ‘বলেছিলাম, ঠাকুরের ফুল আছে। সব ঠিক হয়ে যাবে।’

ও তাহলে নতুন জীবন ফিরে পেল! মনে পড়ছে অভাগী কাকলীর কথা। সে তো রয়ে গেল ঐ অন্ধকারের জগতে একা। বড় একা! এখন ভয়ের থেকে ওর প্রতি করুণাটাই বেশি হচ্ছে। যদি কোনো মন্ত্রবলে ওকেও এই আলোর দুনিয়ায় ফেরানো যেত!

কয়েকদিন সঞ্জিত জেনারেল বেডেই রইল। ও মনে মনে চাইত একবার যেন কাকলী আসে। কিন্তু নিরাশ হল। এবার সে ধরে নিল ডাঃ সোমের কথাই সত্যি। ওর মনের ভ্রম। সেই ধারণা নিয়েই সে নার্সিং হোম ছাড়ল।

নতুন চাকরি হায়দ্রাবাদে জয়েন করার আগে কয়েক বার খোঁজ খবর নিল। কিন্তু নিরাশ হল। নার্সিংহোম কর্তৃপক্ষ কিছু জানাতে পারল না। তারপর একদিন জলপাইগুড়ি ছাড়ল নতুন চাকরীর উদ্দেশ্যে।

এরপর থেকে ও কাকলীকে একদিনের জন্যেও স্বপ্নে দেখেনি। মন থেকে ধীরে ধীরে ঐ নামটা ফিকে হয়ে যেতে শুরু করল। ওখানে গিয়ে অর্ণবের সাথে পরিচয় হল। ওদের কোম্পানীতে চাকরি করে। আলাপ জমতে বেশি দেরী হল না। কেননা একে বাঙালী, তার ওপর শিলিগুড়ির ছেলে।

ওদের কোম্পানী দূর্গাপুজোয় ছুটি দেয় না। বরং দেওয়ালিতে কয়েকদিন বন্ধ থাকে। একেই নতুন চাকরী, মনটা খারাপ হয়ে গেল। কালীপুজোয় বাড়ি গিয়ে কী হবে? তাও যদি নিজের বোন থাকত, ভাই ফোঁটা নেওয়া যেত। ঐ বিশেষ দিনটাতে সত্যি মনটা খারাপ লাগে।

অফিসে বসে অর্ণবের সাথে এই নিয়েই আলোচনা করছিল। ‘আমার তো বোন নেই। তোমার নিশ্চয়ই আছে?’ ওর কথাটা শুনে অর্ণবের মুখে একটা দুঃখের ছায়া পড়ল।

‘ছিল। এখন আর নেই। সাত-আট মাস আগে গলব্লাডার স্টোন অপারেশন করতে গিয়ে মারা গেছে।’ পার্স থেকে বোনের ফটোটা বার করতেই সঞ্জিতের সামনে গোটা দুনিয়াটা দুলে উঠল। সেই মুখ, সেই চোখ, সেই গড়ন। বিড়বিড় করে মুখ দিয়ে বেরিয়ে এল — ‘কা-ক- লী!’ অর্ণব বিস্ময়ে ওর দিকে তাকায়।

‘তুমি চিনতে নাকি আমার বোনকে?’

কী উত্তর দেবে সঞ্জিত? মরার পর তোমার বোনকে দেখেছি? তার সঙ্গে কথা বলেছি? সেটা বিশ্বাসযোগ্য হবে?

তাই কোনোরকমে বলল, ‘আমার বন্ধুর বোনের মতো দেখতে। তার নামও কাকলী।’ এতদিন বাদে যেন তার মনের অঙ্ক মিলে গেল। এবার চেষ্টা করতে হবে কাকলীকে ঐ অবস্থা থেকে যদি মুক্তি দেওয়া যায়! তার জন্য ওকে গয়া পর্যন্ত যদি যেতে হয়… অবশ্যই যাবে। সঙ্গে অর্ণবকে নিয়ে।

তাহলে সত্যি আর একটা অদৃশ্য জগৎ আছে! যেখানে আমাদের সবাইকে কোনো না কোনো এক দিন পা রাখতেই হবে।

অর্ণব আর সঞ্জিত মিলে ঠিক করল সামনেই কালী পুজো। ঘোর অমাবস্যা। খুব ভালো দিন। ঐ দিনেই অর্ণবের মৃতা বোন কাকলীর অতৃপ্ত আত্মার শান্তিলাভে গয়ায় গিয়ে পিন্ডদান করবে। যাওয়ার তোড়জোড় শুরু করল। বাড়িতে কিছু জানাল না। কেননা অনেক প্রশ্নের সম্মুখীন হতে হবে।

অর্ণব বলল, ‘আমরা পিন্ডদানের বিষয়ে কিছুই জানি না। কোথায়, কীভাবে দিতে হয়?’

‘চিন্তা কোরো না। আগে গয়ায় পৌঁছোই! তারপর ব্যবস্থা। আর হ্যাঁ, ওখানে গিয়ে আবার যাকে তাকে প্রশ্ন করো না। শুনেছি খুব পান্ডার উৎপাত। ভালোরকম টাকা খিঁচে নিতে পারে!’

ওরা প্রথমেই অফিসে ছুটির দরখাস্ত দিল আর কাকলীর একটা ছবি বাঁধাই করে নিল। ওখানে গিয়ে হয়তো কাজে লাগতে পারে!

অর্ণব এখনও বুঝতে পারছে না বন্ধুর এত উৎসাহ কেন ওর বোনের ব্যপারে? কোম্পানীর ছুটি মঞ্জুর হয়ে গেল। দু’বার ট্রেন বদল করে যেতে হবে। কালী পুজোর দিন চারেক আগেই ওরা রওনা হল গয়ার উদ্দেশ্যে।

ট্রেনে অর্ণব সঞ্জিতকে চেপে ধরল, ‘সত্যি কথা বলবে ভাই? কাকলীর পিন্ডদানের ব্যপারে তোমার উৎসাহের কারণটা যদি একটু বলো। অনেকদিন ধরেই জিজ্ঞেস করব করব করছি।’ সঞ্জিত আর এড়াতে পারল না। অপারেশনের আগে আর পরের ঘটনাটা খুলে বলল।

অর্ণব ভয়মিশ্রিত মুখে বলল, ‘এই ধরণের ঘটনা আজও ঘটে তাহলে? ও আমার নিজের বোন হয়েও তোমাকে দেখা দিয়েছে! আত্মাদেরও গতিবিধি বোঝা দায়…।’

গয়া পৌঁছতে বেশ ধকল গেল ওদের! একটা ছোটখাটো হোটেলে উঠল। স্টেশনেই দু’-একজন ধরেছিল পিন্ডদান করার জন্যে এসেছে কিনা? অফিসের কাজে এসেছে বলে পাশ কাটিয়ে গেছে। সঞ্জিত হোটেলের বয় ছোকরা বিহারি ছেলেটার সঙ্গে ভাব জমাল। তারপর ওর মুখ থেকে পিন্ডদানের ব্যপারে বেশ কিছু তথ্য জানতে পারল। বেয়ারাটাকেও বুঝতে দিল না কেননা হোটেলের সঙ্গেও পান্ডাদের যোগসাজশ থাকে।

ঘরে ঢুকে ও অর্ণবকে বলল, ‘যা বুঝলাম, এখানে তিন জায়গায় পিন্ডদান করা চলে। জানি না সত্যি মিথ্যে কিনা?’ বলে চেয়ারে বসল। ‘তিনটে স্থান হল বিষ্ণুপাদ মন্দির, রামশিলা মন্দির আর প্রেতশিলা মানে ভূতের পাহাড়!’ কথাটা শুনেই অর্ণবের গায়ে একটু কাঁটা দিয়ে উঠল।

সঞ্জিত বলে চলে, ‘দুর্ঘটনা বা আত্মহত্যা, অল্প বয়সে মৃত্যু বা অপঘাতে মৃত্যু… মোদ্দা কথা, অতৃপ্ত আত্মার শান্তি কামনায় পিন্ডদানের মোক্ষম স্থান হল প্রেতশিলা।’

— ‘এইটুকু সময়ে অনেক কথা জেনে ফেলেছ।’

— ‘আরও আছে।’ চেয়ারে হেলান দিল সঞ্জিত, ‘একটা ছোট টিলার ওপর প্রেতশিলা অবস্থিত। প্রায় সাতশোর ওপর উঁচু-নিচু পাথরের সিঁড়ি ভেঙে ওপরে পৌঁছতে হয়। সেখানে শ্মশানকালীর মন্দির আছে। পাহাড়টাই যেন পুরো শ্মশানের ওপর দাঁড়িয়ে আছে। নীচে একটা কবরস্থানও আছে।’ অর্ণব চোখ বড় বড় করে শুনছে।

‘প্রেতশিলায় একটা বড় ঝাঁকড়া তেঁতুল গাছ আছে। সেই গাছটাকে এখানকার অনেকেই ভয় পায়।’ অর্ণব আর চুপ করে থাকতে পারল না, ‘ভয় পায়? কেন কেন?’ ও নিজেই ভয় পাচ্ছে। এইসব কথা কোনোদিন শোনেনি।

— ‘বেয়ারাটা যা বলল ঐ গাছে নাকি অশরীরীরা থাকে। শেষে কয়েকটা কথা বলল। সারা পাহাড়ে কোনো জল পাওয়া যায় না! আর বিকেল পাঁচটার মধ্যে ওখানকার স্থানীয় মানুষ, পুরোহিত, পান্ডারা পর্যন্ত প্রেতশিলা ছেড়ে নিচে নেমে আসে। পুরো টিলাটাই তখন জনমানবশূন্য এক প্রেতপুরী!’

— ‘ভাই সঞ্জিত, কারোর মাধ্যমে পিন্ডদান করে দাও। পয়সা খরচ হয় হোক। কথাগুলো শুনেই আমার সারা গা ছমছম করছে!’ একটা ভয়ের হালকা প্রলেপ ওর মুখ জুড়ে খেলা করছে।

— ‘আমরা নিজেরা না গেলে তোমার বোন মুক্তি পাবে কী করে? ওসব কথা ছাড়ো, এখানকার লোকরা একটু রং চড়িয়েই বলে। বরং বিকেলে চলো, ফাল্গুনী নদীটা দেখে আসি। সীতার অভিশাপে যা ফল্গু নদীতে রূপান্তরিত। নদীর জলের স্রোত বালির নিচ দিয়ে বয়ে চলেছে। অন্তঃসলিলা।’ চেয়ার ছেড়ে দাঁড়াল সঞ্জিত, ‘যাই স্নান করে নিই।’

— ‘তুমি অনেক কিছু জানো। আর আমার থেকে অনেক বেশি সাহসী।’ ওর কথা শুনে সঞ্জিত মনে মনে ভাবে, অপারেশনের পর থেকেই ওর সাহস তলানিতে এসে ঠেকেছে। এতদূর পর্যন্ত এসেছে শুধু নিজের তাগিদে! যাতে কাকলী পুনরায় ওর স্বপ্নে ফিরে না আসে! এবং মেয়েটাও যেন মুক্তি পেয়ে যায়!

কিন্তু ও ঘুণাক্ষরেও টের পায়নি… কাকলী অনেক আগেই ওর কাছাকাছি চলে এসেছে! মুক্তির লোভে!

বিকেলে ওরা বেরোল ফল্গু নদী দেখার জন্যে। হোটেলের ম্যানেজারকে জিজ্ঞেস করে জায়গাটায় কীভাবে যেতে হবে জেনে নিল। নভেম্বর মাসের প্রথম। পরশু কালীপুজো। গয়ায় ইতিমধ্যে ঠান্ডা পড়তে শুরু করে দিয়েছে। দুজনে একটা করে গলা কাটা সোয়েটার পরে নিয়েছে।

নদীর রূপ দেখে ভালো লাগল। যেন ছোটখাটো মরুভূমি। দূরে এক ফালি জলের রেখা। ওরা কয়েক ধাপ নেমে এসে সিঁড়িতে বসল। বেশ কিছু স্থানীয় মানুষ বালি খুঁড়ে জল বার করছে।

অর্ণব বলল, ‘সকালে এসেছি, সন্ধ্যে হতে চলল। আসল কাজের এখনও কোনো ব্যবস্থা হল না। কালীপুজোর পরদিনই আমাদের ফেরার টিকিট।’ সঞ্জিতও বসে বসে এই কথাটা ভাবছিল। আসলে ওদের দু’জনের আসা-যাওয়া, হোটেল খরচা অনেক টাকাই বেরিয়ে গেছে। এখন পিন্ডদানের জন্যে যদি হাজার পাঁচেক টাকা চেয়ে বসে! বড়জোর এক হাজার খরচা করতে পারবে।

ধীরে ধীরে সন্ধ্যের আঁধার নামছে। নদীর ওপারে কুয়াশার জাল। ঠান্ডাটাও বাড়ছে। ওরা উঠে দাঁড়াল। দু’তিন ধাপ সিঁড়ি ওঠার পরই ওদের চোখ আটকাল একটা ছোটখাটো মানুষের জটলার দিকে। ওপরের ধাপে কাউকে ঘিরে গোল হয়ে দাঁড়িয়ে থাকা কিছু লোক। ওরাও গেল কী ঘটনা জানবার জন্যে।

 তখনও ওরা জানত না কী বিপদের মধ্যে ওরা পড়তে চলেছে।

ভিড়ের মধ্যে বেশিরভাগ স্থানীয় লোক। কয়েকজন বাঙালিও আছে। ওরা পা উঁচু করে দেখল সামনে একটা ধুনি জ্বালিয়ে জটা-দাড়ি-গোঁফধারী একজন লম্বাটে রোগা মতো লোক। সারা কপালে সিঁদুরে মাখামাখি। চোখ বুজে বিড়বিড় করে দুর্বোধ্য মন্ত্র পড়ছে। খুব সম্ভবত কোনো তান্ত্রিক বা কাপালিক। কেননা জ্বলন্ত ধুনির পাশেই ছোট একটা মাথার খুলি। খুব সম্ভবত কোনো বাচ্চার হবে। ওরা লোকমুখে শুনল খুব শক্তিধর তান্ত্রিক। দিন পনের হল এখানে আসন পেতেছে। সঞ্জিতের অবাক লাগল। এখানে আসার সময় তো চোখে পড়েনি!

একজন দেহাতি লোক বলল বাবা সকাল থেকে বিকেল পর্যন্ত এই নদীতে বালির মধ্যে সারা দেহ ঢুকিয়ে শুধু মাথাটুকু বার করে তপস্যা করেন। তারপর ভক্তরা ওঁকে বালির ভেতর থেকে বার করে এখানে নিয়ে আসে। এই সন্ধ্যে থেকে সারা রাত্রি এখানে আগুন জ্বালিয়ে বসে মন্ত্র পড়বে। কথা শুনে কয়েকজন হাত তুলে প্রণাম করছে।

অর্ণব বলল, ‘বাবাজি, হাত-ফাত কুছ দেখতে হ্যায়?’ ওর বাংলা মিশ্রিত হিন্দি শুনে একজন এগিয়ে এল।

‘জী, আপ থোড়া দের রুক যাইয়ে। বন্দোবস্ত হো যায়গা।’ এই ভয়টাই সঞ্জিত খাচ্ছিল। দুটো ষন্ডামার্কা ভক্ত অর্ণবকে নিয়ে গিয়ে বাবার সামনে বসিয়ে দিল। অগত্যা ওকেও দাঁড়িয়ে যেতে হল। বুঝল ছাড়া পেতে গেলে কিছু পকেট থেকে খসবে। বন্ধুর ওপর একটা ঠান্ডা রাগ জমে উঠল।

বাবা মন্ত্র পড়েই চলেছে। থামার নাম নেই। সঞ্জিত ঘড়ি দেখছে — প্রায় দশ মিনিট হতে চলল। ভক্তরা বুঝতে পারছে ওরা অধৈর্য্য হয়ে পড়ছে। কয়েকজন উঠে দাঁড়িয়ে ভিড় পাতলা করে দিল। এর ফলে ওদের মন আশঙ্কায় দুলে উঠল। অর্ণব নিজের বোকামির জন্যে আফসোস করতে লাগল।

তান্ত্রিক চোখ খুলে চাইল। একটা অন্তর্ভেদী চাউনি। তারপর গম্ভীর গলায় বলল, ‘ঘোর বিপদ। তেরে সামনে ঘোর বিপদ বেটা।’ কথাটা শুনে অর্ণবের মুখ শুকনো হল। এরপরের কথায় সঞ্জিতও অবাক হল, ‘আয়ে হো পিন্ডদান কে লিয়ে! লেকিন, উসি মে কুছ গড়বড়ি হোগা।’ ওরা ভাবছে কথাটা ইনি জানলেন কী করে? তবে কি আন্দাজে ঢিল ছুঁড়লেন? এবার বাবা সঞ্জিতের দিকে তাকিয়ে বলল। ‘প্যায়সে কে লিয়ে ফিকর মত করো। এক প্যায়সা ভি নেহি লাগেগা। শুভ দিন মে আয়ে হো। সব ঠিক কর দেঙ্গে।’ বলে পুনরায় চোখ বুজে ফেললেন।

দু’জন বাহুবলি ভক্ত ওদের বলল, ‘বাবার কৃপা পেয়ে গেলেন। আমরাই সব কিছু করে দেব। চলুন হোটেলে পৌঁছে দিয়ে আসি।’

ওদের মনে হচ্ছে অনুরোধের আড়ালে নির্দেশ দিচ্ছে। ওরা হোটেল পর্যন্ত এল। যাবার সময় বলে গেল আর কারোর সঙ্গে কথা না বলতে। যা করবার তারাই করে দেবে। গুরুদেব ঠিক ঐ আত্মাকে শান্তি দেবেন।

হোটেলের ঘরে ঢুকে সঞ্জিতের রাগ ফেটে পড়ল, ‘তোমার জন্যেই ওদের খপ্পরে পড়লাম। জানি না এদের জাল কেটে বেরোতে পারব কি না।’

অর্ণব একটু চুপ থেকে বলল, ‘মানছি। কিন্তু টাকাপয়সা লাগবে না কিছু।’

— ‘তুমি ঐ কথা বিশ্বাস করেছ নাকি?’ বুঝল ও একটু সরল প্রকৃতির। রাত্রে খেয়েদেয়ে একরাশ মাথায় ভাবনা নিয়ে শুল সঞ্জিত। চোখ বুজে ভেবে চলল — কালকেই যদি প্রেত শিলাতে পিন্ড দিয়ে চলে আসা যায়, তাহলে এদের বলা যাবে কাজ মিটে গেছে। অর্ণবকে বলতে গিয়ে দেখল অর্ণব ঘুমিয়ে গেছে।

সন্ধ্যে থেকে পিন্ডদান, তান্ত্রিক, এইসব কথা ক্রমাগত চিন্তার ফলে বোধহয় সঞ্জিতের স্বপ্নেও তার প্রতিফলন ঘটল। কেননা অনেকদিন পর কাকলীর রক্তশূন্য সাদা মুখটা ভেসে উঠল। বিস্ময়ে দেখল ওর ভয়ার্ত মুখ! বুঝতে পারছে না কাকলী এত ভীত কেন? তবে কি অদৃশ্য জগতে এখনও একাই বিচরণ করছে? তারপরেই স্বপ্নের পরিবর্তন ঘটল। দেখছে একটা উঁচু টিলা থেকে ওরা দু’জন হাঁপাতে হাঁপাতে সিঁড়ি ভেঙে নামছে। আর পিছনে কয়েকটা কালো হাত বাতাসের মত তাড়া করে আসছে!

ভয়ে ওর ঘুমটা ভেঙে গেল। অপারেশনের সময়ে যে রকম ভয়ের অনুভূতি শরীরে লাগত সেইরকম অনুভূতি সারা দেহে ফিরে এসেছে। একটু জল খেয়ে বাথরুমে গেল। বাথরুমের দরজাটা খুলতেই ভূত দেখল। শাওয়ারের কাছে দেওয়ালে ঠেস দিয়ে কাকলীর অর্ধেক শরীরটা ভাসছে! নিজেকে সামলাতে পারল না। গলা চিরে একটা চাপা আর্তনাদ বেরিয়ে এল।আর তাতেই অর্ণবের ঘুমটা ভেঙে গেল।

 ও দৌড়ে এসে সঞ্জিতকে ধরে ফেলল। মুখটা দেখেই সঞ্জিত বুঝে ফেলল প্রচন্ড ভয় পেয়েছে। ওকে অর্ণব বিছানায় বসিয়ে বলল, ‘কী হয়েছে? কী দেখে ভয় পেয়েছ?’

সঞ্জিত নিজেকে সামলাল। অহেতুক অর্ণবকে ভয় পাইয়ে লাভ নেই। হিতে বিপরীত হতে পারে। কাকলীর বিদেহী আত্মা তাহলে এখনও ওদের সঙ্গেই আছে! সঞ্জিতের বুকটা একটু কাঁপল।

— ‘বোধহয় স্বপ্নের ঘোর কাটেনি। তাই চোখে ভুল দেখেছি।’ কথা ঘোরাল ও। ‘ভালো কথা, কালকেই আমরা বোনের পিন্ডদানের জন্যে বেরিয়ে পড়ব।’

— ‘ওরা যদি এসে কিছু বলে?’

— ‘আমার ওপর ছেড়ে দাও। মুখ আর খুলবে না।’

— ‘পাগল… আর ভুল করি?’

রাত দুটো বাজে। সঞ্জিত জানে চেষ্টা করেও ঘুম আনতে পারবে না। কেননা চোখ বুজলেই ও দেখা দেবে। কিন্তু কেন? ও কি বুঝতে পারছে না… ওর শান্তির জন্যেই এতদূর ছুটে আসা? যাক, আর আজকের রাতটুকু কষ্ট করো কাকলী। কালকেই তোমার মুক্তি!

আমরা ভাবি এক, হয় আর এক। সেটা দু’জনে হাড়ে হাড়ে বুঝতে পেরেছিল সকালে।

সকালেই ব্রেকফাস্ট সেরে ওরা বেরোল। যাবার সময় কাকলীর বাঁধানো ছবিটা হাতব্যাগে পুরে নিল। এক বোতল জল নিল, কেননা শুনেছে পাহাড়ে জল পাওয়া যায় না। এরপর যা যা লাগবে ওখানকার দোকান থেকেই কিনে নেবে। ওখান থেকেই দরদাম করে পান্ডা নিয়ে নেবে। যেমন করে হোক এই তান্ত্রিকের খপ্পর থেকে বেরোতে হবে।

কিন্তু প্রেত শিলার কাছে এসে দুজনেই স্থবির হয়ে গেল। তান্ত্রিক বাবার দুই ভক্ত সামনেই দাঁড়িয়ে। একজন বলে উঠল, ‘আপ লোগ ইঁয়াহা?’ অর্ণব কিছু বলার আগেই সঞ্জিত বলে উঠল, ‘ঘুমনে আয়া।’

আর এক ভক্ত ব্যাগটার দিকে চেয়ে যা বলল তার সারমর্ম হল এটা বেড়াবার জায়গা নয়। অতৃপ্ত আত্মারা এখানে সারাক্ষণ হাঁ করে আর হাত পেতে থাকে এক ফোঁটা জলের জন্যে! তার মধ্যে অনেক দুষ্ট আত্মারাও থাকে অনিষ্ট করার জন্যে। এখানে সময় নষ্ট না করে ফিরে যাও। সন্ধ্যের মধ্যে আমরা তোমাদের হোটেলে গিয়ে নিয়ে আসব। কেননা আজকে বাবা বিশেষ পুজোয় বসবে তোমাদের জন্য।

এত কথা শোনার পর আর এগোনো যায় না। টিলাটার দিকে তাকিয়ে সঞ্জিতের রাত্রের দুঃস্বপ্নটার কথা মনে পড়ে গেল। হুবহু এই পাহাড়টাকেই সে দেখেছে! কী করে সম্ভব হল? এর আগে সঞ্জিত কোনোদিন এখানে আসেনি! ফেরার রাস্তা ধরল। সঞ্জিত বলল, ‘মন বলছে, এরা আমাদের নিয়ে অন্য কিছু করতে চাইছে। নাহলে আমাদের সারাক্ষণ নজরে রাখত না!’

— ‘ঠিকই বলেছ। পিন্ডি-ফিন্ডি না দিয়ে চল আজকেই কেটে পড়ি।’

সঞ্জিত নিজেও তাই চায়। কিন্তু কাকলীর মুখটা ভাসছে মনে। এতটা পথ এসে আসল কাজ না সেরেই ফিরে যাবে?

— ‘কী ভাবছ?’

— ‘যেমন করেই হোক পিন্ডর কাজটা সারতে হবে।’

অর্ণব অধৈর্য্য হয়, ‘ওদের চোখকে ফাঁকি দেবে কী করে? এদিকে হাতে বেশি সময় নেই।’

সঞ্জিত কাঁধ ঝাঁকিয়ে বলে, ‘কাকলীই আমাদের রাস্তা দেখাবে!’ বুঝল বেফাঁস কথাটা বেরোল। বন্ধুর চোখ দুটো বড়বড় হল।

সঞ্জিত পরক্ষণেই কথা ঘোরাল, ‘আমি বলতে চাইছি ও নিজেও মুক্তির জন্যে দিন গুনছে। এবার চলো, রৌদ্রের তেজ বাড়ছে।’ চারিদিকে একটা রুক্ষ হাওয়া হু হু করে বইছে।

অনেকেই আসছে প্রিয়জনের পিন্ডদানের উদ্দেশ্যে। অনেকের হাতে ছবি। না জেনে ছবিটা এনে ভালোই করেছে। ওরা ফিরে চলল বিকালের কথা চিন্তা করতে করতে। কিন্তু হোটেলে ঢোকার আগে সঞ্জিত অর্ণবকে নিয়ে চলল বাজারের পথে। ও বুঝতে পারছে না সে কি করতে চাইছে। ভাবল প্রশ্ন করে। কিন্তু সঞ্জিতের কঠিন মুখ ও শক্ত চোয়াল দেখে চুপ করে রইল। এই বিরাট ঝামেলায় পড়ার জন্যে একেই সে দায়ী!

কিন্তু যে জিনিসপত্র বন্ধু কিনছে… এরপর না প্রশ্ন করে থাকতে পারল না।

বাজারের একটা দশকর্মার দোকান থেকে পিন্ডদানের জন্যে যা যা লাগবে সব কিনল সঞ্জিত। এরপর ট্যাক্সি স্ট্যান্ডে গেল। এক গাড়ির ড্রাইভারের সঙ্গে কথা বলল বিকেল পাঁচটার মধ্যে প্রেত শিলায় পৌঁছে দেবে কত নেবে? ড্রাইভারটা অবাক হয়ে গেল। বলল, ‘ইস সময় কাহে উধার যায়েগা?’ সঞ্জিত বুদ্ধি করে বলল, ‘একদম ভোরে পিন্ডদান করব। কাল কালীপুজো খুব ভিড় হবে। তাছাড়া কালকেই আমাদের কলকাতায় ফিরতে হবে। রাতটা নিচে কোনো জায়গায় কাটিয়ে দেব।’ ড্রাইভার বলল চারটের মধ্যে স্ট্যান্ডে চলে আসতে। সঞ্জিত কিছু টাকা অ্যাডভান্স দিয়ে ওর ফোন নম্বরটা নিল। অর্ণব আর থাকতে না পেরে বলে উঠল, ‘তুমি কী করতে চাইছ বলবে?’

‘আমরা আজ রাতেই প্রেত শিলায় চড়ব। পাঁজিতে মন্ত্র লেখা আছে। পাঁজি অনুযায়ী সব কিনেছি। ওরা কল্পনাই করতে পারবে না যে রাত্রে আমরা ভূতের পাহাড়ে থাকব। এক ঢিলে দুই পাখি মারা যাবে। ওদের ফাঁকিও দেওয়া যাবে তার সঙ্গে কাকলীর পিন্ডদান হয়ে যাবে। কথাটা অর্ণবের মনে ধরল। কিন্তু সন্ধ্যের সময় প্রেত শিলায় ওঠা? সঞ্জিতকে কথাটা বললেই রেগে যাবে বলে চুপ করে রইল। কেননা ওর জন্যই এইরকম ঝামেলায় পড়ে গেছে ওরা।

হোটেলের রিসেপশনের সামনে কয়েকজনের সঙ্গে উত্তেজিত ভাবে কথা বলতে ম্যানেজারকে দেখল ওরা। কৌতূহলবশত এগিয়ে গেল। যা শুনল তাতে মন-মাথা হালকা হয়ে গেল। একটু আগেই পুলিশ এসে দলবল সমেত তান্ত্রিককে থানায় ধরে নিয়ে গেছে কয়েকদিন আগে পাশের গ্রামে এক দম্পতির এফআইআরের ভিত্তিতে। ওদের ছোট মেয়েটাকে অসুখ সারাবার নাম করে এক রাত তান্ত্রিকের ডেরায় রাখে। তারপর দিন থেকে তান্ত্রিক ফেরার। ছোট মুন্ডুটার সাথে বাবাকে লক আপে পুরেছে। ওঃ, ঘাম দিয়ে যেন জ্বর ছাড়ল ওদের।

রুমে এসে অর্ণব বলল, ‘তাহলে আর অসময়ে ঐ ভূতের পাহাড়ে গিয়ে লাভ নেই।’

‘বরং দেরী না করে আজই যাওয়া উচিত। কেননা তোমার বোন তার কাজ করে দিয়েছে। এবার আমাদের পালা। বলেছিলাম না! কাকলী একটা রাস্তা দেখাবে।’

এরপর আর কিছু বলা যায় না। যতই হোক তার বোনের আত্মার শান্তির জন্যে করছে। তাছাড়া গাড়িকেও অ্যাডভান্স দেওয়া হয়ে গেছে।

তান্ত্রিকের ঝামেলা কেটে যাওয়াতে অর্ণবের মনেও একটা জোর এসে গেছে। তাড়াতাড়ি স্নান সেরে নিরামিষ খাবারের অর্ডার দিল। যতই হোক মাছ-মাংস খেয়ে পিন্ড দিতে যাবে না। ওদের পরিণত বয়স, পরিণত মস্তিস্ক হলে এরকম হঠকারী সিদ্ধান্ত নিত না। সব কিছুরই দিনক্ষণ আছে। তাছাড়া পুরোহিত বা পান্ডারা হল একটা মাধ্যম। যুগ যুগ ধরে এই নিয়ম চলে আসছে। যৌবনের রক্তে বলীয়ান হয়ে তার ব্যতিক্রম ঘটানো সব সময় ঠিক নয়।

সাড়ে তিনটে নাগাদ যখন ওরা হোটেল ছাড়ল ম্যানেজারকে জানিয়ে গেল অফিসের কাজে বেরোচ্ছে, রাত্রে ফিরবে না। কাল সকালের দিকে আসবে। ট্যাক্সি স্ট্যান্ড থেকে ওদের গাড়ি যখন ছাড়ল বিকেল চারটে বেজে গেছে।

সূর্যের তেজ ক্রমশ কমে আসছে। ঘিঞ্জি রাস্তা ছাড়িয়ে গাড়ি ফাঁকা রাস্তা ধরল। আগামীকাল কালীপুজো। শ্মশানকালীর মন্দিরেও পুজো হবে। ভক্তরাও নিশ্চয়ই ভোরের আলো ফোটার আগেই চলে আসবে।

 ড্রাইভারটা ওদের বলল, ‘আপনারা কমবয়সী, অ্যাডভেঞ্চার ভেবে যেন রাতের অন্ধকারেই সিঁড়ি ভেঙে ওপরে উঠবেন না!’ ওরা অভয় দিল। পাঁচটা দশ নাগাদ ওদের নামিয়ে দিয়ে ভাড়া নিয়ে ট্যাক্সি দ্রুত গতিতে ফিরে গেল। মনে হল পালিয়ে বাঁচল।

সকালে যখন এসেছিল এখানে তখন কত লোকজন! আর এখন? পুরো শ্মশান। ওরা পায়ে পায়ে টিলাটার নিচে পৌঁছল যেখান থেকে পাথরের সিঁড়ি শুরু হয়েছে। ইতিমধ্যে সূর্য অস্ত গেছে। শেষ আলোর রশ্মিটুকু পশ্চিম আকাশে এক চিলতে লেগে রয়েছে। ওরা সেই স্বল্প আলোতে পাহাড়ের উঁচু দিকটার দিকে তাকাল।

 বড় বড় গাছগুলো থেকে দল বেঁধে পাখি আর কাকেরা ডাকতে ডাকতে সমতলভূমির দিকে নেমে আসছে। মনে হচ্ছে ওরাও ঐ স্থান ছেড়ে পালাচ্ছে! একটা দুটো দোকান খোলা ছিল। সেগুলোরও ঝাঁপ বন্ধ হচ্ছে। সামনাসামনি আর কাউকে দেখা যাচ্ছে না। শেষ দোকানী যাবার সময় ওদের দেখে বলল, ‘হেই বাঙালী বাবু, আপ লোগ ইস সময় ইধার?’

সঞ্জিত হেসে বলল, ‘কাল ভোরেই পিন্ডদান করে কলকাতায় ফিরব।’

— ‘রাত ভর এহি রহেঙ্গে ক্যা?’ দোকানির বিস্ময়ের গলা।

অর্ণব এবার বলল, ‘ডর কা কুছ বাত হ্যায় কেয়া?’

লোকটা কিছু একটা বলতে গিয়েও ঢোঁক গিলে নিল। পাহাড়ের উঁচু দিকটায় তাকিয়ে চোখটা নামিয়ে বড় বড় পা ফেলে লোক বসতির দিকে হাঁটা দিল। চারিদিকে ক্রমশ আঁধার ছাইছে। তার সঙ্গে ঠান্ডাটাও বাড়ছে। ওরা ব্যাগ থেকে ফুল হাতা সোয়েটার বার করে গায়ে চড়াল।

সঞ্জিত হাতে হাত ঘষে বলল, ‘এসো, এই বন্ধ দোকানটার সামনে বসে একটু ধূমপান করি। একটু রাত হোক, তারপর প্রেত শিলায় উঠব। নাহলে আবার কেউ দেখে বাধা দেবে।’

অর্ণবের মনে একটা অজানা ভয় খেলা করতে শুরু করেছে! চারিদিকের পরিবেশ এর জন্যে অনেকটা দায়ী।

প্রায় ঘন্টাখানেক ধরে দুজনেই নীরব প্রতীক্ষায় কাটাল। এর মধ্যে একটাও কথা হয়নি। যেন সব কথা হারিয়ে গেছে। আসলে দুজনেই ভাবনার সাগরে ডুবে আছে। সঞ্জিত ব্যাগ থেকে টর্চটা বার করল। ঘড়িতে নটা বাজছে।

‘চলো এবারে যাত্রা শুরু করি।’

সঞ্জিতের কথা শুনে অর্ণবের মনে হল শেষ যাত্রা নয় তো? অনিচ্ছা সত্ত্বেও সিঁড়ির দিকে এগোল। সিঁড়ির প্রথম ধাপটার কাছে এসে আলো ফেলে দেখল ওপরের দিকে পাঁচ-ছয় ধাপ পর্যন্ত আলোর রেখা যাচ্ছে। তারপর ঘুটঘুটে অন্ধকার! এঁকেবেঁকে সিঁড়িটা বোধহয় নরকের শেষ প্রান্তে উঠে গেছে।

অর্ণব আরও একবার বলার চেষ্টা করল — ভোরেই না হয় ওঠা যাবে। ততক্ষণে সঞ্জিত টর্চের আলোয় দুটো ধাপ উঠে গেছে। বাধ্য হয়ে ওর সঙ্গ নিতে হল। বেশ খানিকটা একনাগাড়ে উঠে অর্ণব হাঁপাতে হাঁপাতে বলল, ‘এবার একটু দাঁড়াও জিরিয়ে নিই।‘

বাধ্য হয়ে সঞ্জিত দাঁড়াল। দূরে নিচে লোকালয়ের আলোগুলো জোনাকির মতো জ্বলছে। সিঁড়ির দু’পাশে শুধু পাথুরে জমি, আর জঙ্গলের মধ্যে বড় বড় গাছ মাথা উঁচু করে দাঁড়িয়ে আছে। চতুর্দিক নিস্তব্ধ, নিঃঝুম। সারা ধরিত্রী যেন কিসের আগমনের প্রতীক্ষায় অপেক্ষারত! আবহাওয়ায় শীতলতার পরিমাণ ক্রমশ বাড়ছে। এতক্ষণ সিঁড়ি দিয়ে উঠছিল বলে ঠান্ডার পরিমাণটা বুঝতে পারেনি। এখন মালুম পাচ্ছে।

অর্ণব শুকনো ঠোঁটটা চেটে বলল, ‘মনে হয় আমরা গোঁয়ার্তুমি করছি। শুধু ঐ শুকনো আতপ চাল, তিল, কলা দিয়ে পাকিয়ে ছুঁড়ে দিলেই পিন্ডদান হয়ে যাবে? মন্ত্র-তন্ত্র লাগবে না?’

 — ‘এর আগেও বলেছি। চিন্তা কোরো না। পাঁজি নিয়ে এসেছি। দানে যা যা লাগবে সবই এনেছি। মন্ত্রটাও পাঁজিতে আছে।’ ও চুপ করে গেল।

হঠাৎ একটা শোঁ শোঁ করে হাওয়া উঠল। মনে হল এক খন্ড বরফ ওদের গায়ে কেউ বুলিয়ে দিয়ে গেল।

‘আর দাঁড়িয়ে থেকে লাভ নেই,’ সঞ্জিতের ব্যস্ত কণ্ঠ।

— ‘সবে আশিটা সিঁড়ি উঠেছি। এখনও ছশো কুড়ি বাকি।’ ও কি সিঁড়িও গুনছে নাকি? ছশো সিঁড়ি শুনে আরও যেন হাঁফিয়ে পড়ল। ইতিমধ্যে বন্ধু তিন ধাপ সিঁড়ি উঠে গেছে।

— ‘আরে একসঙ্গে চলো, অন্ধকারে কিছু দেখতে পাচ্ছি না…’ বলতে বলতেই অর্ণব হোঁচট খেল। পাথরের সিঁড়িতে মুখটা আর একটু হলেই ঠুকে যেত। সঞ্জিত তাড়াতাড়ি দু ধাপ নেমে এল।

‘হোঁচট খেলে কী করে?’ উদ্বিগ্ন গলা।

— ‘কিসে পা লাগল!’ টর্চ ফেলতেই দুজনের চোখেই আতঙ্ক দেখা দিল। কনুই থেকে একটা কালো শুকনো কাটা হাত। সিঁড়ির কোণে পড়ে আছে! অর্ণবের শরীরে হিস্টিরিয়া রোগীর ছোঁয়া লাগল। বেতসপাতার মতো কাঁপতে কাঁপতে মুখ দিয়ে একটা শব্দই বেরিয়ে চলল — ‘ভূ…ভূ… ভূত!’

বিপদের ঘন্টি অবজ্ঞা করেও যদি কেউ জেদ বজায় রাখতে চায় তার অবস্থা যে কতখানি শোচনীয় হয়? কিছুক্ষণের মধ্যে সঞ্জিত বুঝতে পেরেছিল।

সঞ্জিতও বেশ ভয় পেয়ে গেছে। একটু আগেও এই সিঁড়ি দিয়ে কত লোকজন ওপরে উঠেছে… কারোর চোখে পড়েনি? তার মানে তখন কাটা হাতটা এখানে ছিল না। মনটাকে শক্ত করে হাতটার ওপর আলো ফেলতেই নিজেদের ভুল বুঝতে পারল। ঐ আকৃতির একটা শুকনো গাছের ডাল।

 অর্ণব অনেকটা সুস্থ হল, ‘একটু জল দাও।’

 সঞ্জিত বোতল বার করে বলল, ‘বেশি খেও না। মাত্র দু’বোতল জল এনেছি। জানোই তো এই অঞ্চলে জলের বড় অভাব। হাঁ করো মুখে ঢেলে দিচ্ছি।’ ও হাঁ করতেই চারিদিকে একটা চামড়া পচার বিকট গন্ধে জায়গাটা ভরে উঠল। মনে হল অন্নপ্রাশনের ভাত পর্যন্ত গলা দিয়ে উঠে আসবে!

সঞ্জিতের কানের কাছে কে যেন ফিসফিস করে বলে উঠল, ‘শীগগির জলের বোতল ব্যাগে ঢোকাও। কত শত বছর ধরে কত অতৃপ্ত আত্মারা এক ফোঁটা জলের জন্যে হাহাকার করছে। আর তুমি ওদের সামনে জলের লোভ দেখাচ্ছ?’ এ তো সেই স্বপ্নের কাকলীর গলা! ও চমকে উঠে অন্ধকারটার দিকে তাকাল। কেউ কোত্থাও নেই। কিন্তু কথাগুলো মাথার মধ্যে গিয়ে হাত-পা অবশ করে দিল। কথাগুলোর মধ্যে সত্যতা আছে। জল পান করার লোভে বিদেহী শরীরগুলো নিশ্চয়ই কাছাকাছি চলে এসেছে!

বন্ধুর মুখে টর্চটা ধরে অর্ণব বলল, ‘কী হল, জল দাও!’ ওর মনে হল কোনো অশরীরী জল চাইছে! বোতলটা চটপট ব্যাগের ভেতর ঢুকিয়ে কাঁপা গলায় বলল, ‘আর খেতে হবে না। বরং তাড়াতাড়ি পা চালাও।’ আবার শুরু হল সিঁড়ি ভাঙা। ওদের জুতোর শব্দে ওরা বারবার চমকে উঠছে। মনে হচ্ছে সিঁড়ি বেয়ে নরকের দরজায় পৌছচ্ছে। কত রাত হল কে জানে? আকাশে অসংখ্য তারার মেলা। অমাবস্যার রাত্রি বলে অন্ধকারটা বেশি জমাট।

খানিকটা সময় ধরে একনাগাড়ে উঠছে। দু’জনের কোমরেই বেশ ব্যথা করছে। যতই জোয়ান হোক, এই পাথুরে সিঁড়ি চড়ার অভ্যেস নেই। এই ঠান্ডাতেও ঘেমে গেছে। সঞ্জিতেরও মনে হচ্ছে একটু দাঁড়ানো দরকার। প্রায় দুশো সিঁড়ি উঠে এসেছে। বুকটা তেষ্টায় ফেটে যাচ্ছে। অর্ণবের অবস্থাও একই রকম। কিন্তু জলের নাম মনে আসতেই সিঁটিয়ে উঠল। ইচ্ছেটাকে দমন করল।

এই সময় ওদের কানে বাচ্চা ছেলের কান্না ভেসে এল। অর্ণব ভয়চকিত গলায় বলল, ‘নিচে কবরখানা থেকে কোনো মরা বাচ্চা কাঁদছে।’

 সঞ্জিত ভালো করে শুনে বলল, ‘শকুনের বাচ্চা।’

 অন্ধকারে টর্চের আলো বন্ধ করতেও ভয় লাগছে! কিন্তু টর্চটা সেই থেকে একটানা জ্বলছে। ব্যাটারী যদি ফুরিয়ে যায়? কথাটা মনে আসা মাত্রই সঞ্জিতের মনের কোটরে লুকিয়ে থাকা ভয়টা শক্তি বাড়াতে শুরু করল। মাত্র দুশো সিঁড়ি ভেঙেই কাহিল হয়ে পড়েছে। এখন মনে হচ্ছে গোঁয়ার্তুমিটা না করলেই ভালো ছিল! ঘড়িতে সবে সাড়ে বারোটা বাজে।

অর্ণব মনে হয় খুবই ক্লান্ত হয়ে পড়েছে। মিনমিনে স্বরে বলল, ‘আর পারছি না। একটু জল দেবে?’

— ‘তুমি বায়না-টায়নাগুলো একটু কম করো।’ জলের নাম শুনে সঞ্জিত কর্কশ গলায় বলল, ‘তুমি তো তবু একবার জল খেয়েছ, আর আমি?’

— ‘যাহ বাবা, তুমি এত রেগে যাচ্ছ কেন? তুমিও খাও না!’

সঞ্জিত আসল কথাটা না পারছে বলতে, না পারছে গিলতে। সেইজন্যে ভয়, রাগ মিশে মাথাটা এলোমেলো হয়ে যাচ্ছে।

— ‘চলো চলো আরও একটু এগিয়ে জল খাওয়া যাবে…’

পুনরায় শুরু হল সিঁড়ি বেয়ে ওঠা। প্রায় মিনিট পাঁচেক ওঠার পর সঞ্জিত হঠাৎ দাঁড়িয়ে গেল।

মনে হচ্ছে হাতের ব্যাগটা কেউ পিছু থেকে টানছে! আতঙ্কের নাগপাশ ওর মনটাকে গিলতে শুরু করল। আতঙ্কে গায়ের রোমকূপগুলো খাড়া হয়ে গেল। ওকে দাঁড়াতে দেখে অর্ণব টর্চ হাতে দাঁড়িয়ে গেল। সঞ্জিতকে দেখে মনে হচ্ছে সারা শরীরে প্রাণ নেই। অর্ণব কাছে এসে বলল, ‘তখনই বললাম একটু জল খাও।’ উত্তর দেবার ক্ষমতাটুকুও ও হারিয়ে ফেলেছে। কেননা ব্যাগটা এখনও কেউ ধরে রেখেছে। টেনেও ছাড়াতে পারছে না। পিছনে ফিরেও কাউকে দেখতে পাচ্ছে না। মনে হচ্ছে ব্যাগের ভেতরে রাখা পিন্ডের যাবতীয় জিনিস আর জলটুকু কেউ ছিনিয়ে নিতে চাইছে!

বন্ধুর মুখের চেহারা দেখে অর্ণবের বুকটাও কেঁপে উঠল। সঞ্জিত যে প্রচন্ড ভয় পেয়েছে সেটা অর্ণব বুঝতে পারছে। কিন্তু কেন ভয় পেয়েছে সেটাই মাথায় ঢুকছে না। পাশেই সেই ঝাঁকড়া তেঁতুল গাছটা। লোকে বলে এটাতে নাকি অশরীরীদের বাস। কোনোরকমে কয়েকটা কথা উচ্চারণ করে সঞ্জিত, ‘এই ব্যাগটা এক… একটু ধ… ধরবে?’

অর্ণব ব্যাগটা হাতে নিতে গিয়ে বলে, ‘কই ব্যাগটা ছাড়ো?’

সঞ্জিত ব্যাগটা আগেই ছেড়ে দিয়েছে। টর্চের আলোতে দেখল ব্যাগটা শূন্যে ঝুলছে! আর অন্যদিক ধরে অর্ণব টানাটানি করছে।

সঞ্জিত এই প্রথম আর্তনাদ করে উঠল, ‘ছেড়ে দাও। ব্যাগটা ছেড়ে দাও।’

বন্ধুর চিৎকারে অর্ণব ব্যাগটা ছাড়তেই ব্যাগটা সিঁড়িতে ধপাস করে পড়ল।

দুজনেই ভয়ের শেষ সীমানায় পৌঁছে গেল। কেননা দুজনেই এইমাত্র উপলব্ধি করেছে বিদেহী অতৃপ্ত আত্মাদের উপস্থিতি। ওরা বুঝতে পারছে না এরপরে কী হতে চলেছে? এবং সেই নারকীয় কান্ড প্রতিরোধ করার ক্ষমতা এই মুহূর্তে ওদের শরীরে কতটুকু অবশিষ্ট আছে?

পায়ের কাছে পড়ে থাকা ব্যাগটা দুজনেই বিহ্বল দৃষ্টিতে দেখছে। সঞ্জিত দাঁতে দাঁত চেপে নিচু হয়ে ব্যাগটা তুলল। কেননা ওর মধ্যে কাকলীর ছবিটাও আছে। অর্ণবের হাতের টর্চটা একটু দপদপ করে উঠল। যা ভেবেছিল তাই ঘটতে চলেছে। টর্চের ব্যাটারি দেহ রাখতে চলেছে। তার মানে একটু বাদেই অমাবস্যার কালো অন্ধকার ওদের গ্রাস করতে চলেছে।

কাকলীর একটা কথা সঞ্জিতের মনে হঠাৎ উদয় হল… এখানে এই আঁধারে আমি একা। বড় একা। এবার থেকে আমরা দুজন একসঙ্গে এই অন্ধকার জগতে থাকব। স্বপ্নের সেই কথাগুলো ওর দেহ মনকে নাড়িয়ে দিল। তাহলে কি কাকলীর গোপন ইচ্ছে সার্থক হতে চলেছে? নাহলে কীসের আকর্ষণে সঞ্জিত এখানে এসেছে? এত বারণ, নিষেধ শোনার পরও গভীর রাত্রে এই পথের যাত্রী হল কেন? চোখের সামনে এতগুলো ঘটনা ঘটে যাবার পরও কি মোক্ষলাভের আশায় এখনো দাঁড়িয়ে আছে?

বিপদের সংকেত কি বুঝতে পারছে না? তার সঙ্গে অর্ণবকেও বিপদের মুখে ঠেলে দিচ্ছে না? এইটুকু সোজা কথা মাথায় ঢুকছে না কেন যে টর্চের দুটো ব্যাটারি একনাগাড়ে সারারাত আলো বিকিরণ করতে পারে না। তারপর? আলোর শেষ রশ্মিটুকু হারিয়ে যাবার পর ঘুটঘুটে কালো অন্ধকারে অন্ধের মতো তারা কী করবে? কোন শক্তি দিয়ে অন্ধকারকে জয় করবে?

কাকলীর বিদেহী আত্মা পারবে তাদের পুনরায় আলোর জগতে ফিরিয়ে দিতে? প্রশ্নের পর প্রশ্ন ওর মস্তিষ্কে আছড়ে পড়ছে। যার ফলে ওদের এগিয়ে যাওয়া ক্রমশ শিথিল হচ্ছে।

 এবার দুজনে দাঁড়াতে বাধ্য হল। কেননা কয়েক ধাপ সিঁড়ির ওপরে চার-পাঁচটা কুয়াশার ডেলার মতো কী পড়ে আছে! সঞ্জিত আলোটা কুয়াশার মন্ডগুলোর ওপর ফেলল। এইরকম আশ্চর্য কুয়াশা জীবনে দেখেনি। আকাশ এদিকে পরিষ্কার। একেকটা ফোলানো বড় বেলুনের মতো কুয়াশার আকৃতি! সঞ্জিত এক ধাপ উঠল ভালো করে দেখার জন্যে।

দুজনেই পরিষ্কার দেখতে পেল কুয়াশার ডেলাগুলো স্থির নয়! থিরথির করে কাঁপছে। মনে হচ্ছে ওগুলো জীবন্ত! টর্চের আলোয় মনে হচ্ছে একেকটা হাত-পা বিহীন মানুষের অবয়ব! মুখের কাছটা অল্প কালচে — যেন ছোট ছোট হাঁ করে আছে। ধীরে ধীরে ওপরের ধাপগুলোতে ওদের সংখ্যা বাড়ছে। কয়েক মিনিটের মধ্যে ওপরের সব ধাপগুলো অজস্র কুয়াশাপুতুলে ভরে গেল।

সঞ্জিত আর অর্ণবের মস্তিষ্কে একসাথে বিপদের সংকেত বাজতে শুরু হয়েছে। কেননা ওরা বুঝতে পারছে, আর ওপরে যাওয়া সম্ভব নয়! ওগুলো যে অতৃপ্ত আত্মার দল তাতে কোনো সন্দেহ নেই। কুয়াশার মূর্তিগুলো এবার এক ধাপ করে নেমে ওদের দিকে এগিয়ে আসছে। তার সঙ্গে হাওয়ায় ভেসে আসছে পচা, বাসি, মাংস পোড়ার গন্ধ। আর একটা সিঁড়ি নামলেই ওরা ওদের ছুঁয়ে ফেলবে।

সঞ্জিত ব্যাগটা শক্ত করে জড়িয়ে ধরল। দুজনের চোখেই পালাবার শপথ। সঞ্জিত কোনোও রকমে উচ্চারণ করল, ‘শিগগির নিচে নেমে চলো।’

পা দুটো যেন অপেক্ষা করছিল নির্দেশ শোনার জন্যে। পড়ি কি মরি করে দুটো তিনটে ধাপ টপকে টপকে ওরা নামতে লাগল। বিদ্যুৎবেগে নামছে ওরা প্রাণের ভয়ে! পিঠের কাছেই শুনতে পাচ্ছে কান্না, হাসি, রাগ মেশানো অশরীরীদের গর্জন।

ওদের মনে একটাই প্রশ্ন পারবে কি নিচের মাটিতে পা রাখতে? এদের স্পর্শ এড়িয়ে? একেবারে সিঁড়ির শেষ ধাপে পৌঁছে আর পারল না শরীরের ভারসাম্য রাখতে। হুমড়ি খেয়ে পড়ে গেল মাটিতে। চোখ দুটোতে কালো অন্ধকার নেমে এল। জ্ঞান হারাল ওরা।

কোলাহলের শব্দে ওরা যেন ঘুম থেকে উঠল। ওদের ঘিরে একটা মানুষের জটলা। সঞ্জিত মনে মনে ঠিক করে নিল কী বলবে। তারপর বলল ভোর রাত্রে তারা এসেছে পিন্ডদানের জন্যে। অনেকটা পথ হেঁটে এসেছে তাই ঘুমিয়ে পড়েছিল। এদিক-ওদিক তাকিয়ে দেখে নিল ঐ সন্ধ্যের দোকানিটা আশেপাশে আছে কিনা? ভাগ্যিস হাত-পা কেটে ছড়ে যায়নি তাই রক্ষে!

এরপর একজন পুরোহিত নিয়ে ওরা প্রেত শিলায় উঠল। রাতের ঘটনাটা তখনও চোখের সামনে ভাসছে! ভালোভাবে পিন্ডদান সম্পন্ন হল। ওরা যখন নেমে আসছে ওদের চোখে পড়ল পাহাড়ের ঢালু বেয়ে কাকলীর অস্পষ্ট শরীরটা এগিয়ে চলেছে জঙ্গলের দিকে। একবার মুখ ফিরিয়ে ওদের দিকে তাকাল। দেখল সেই মুখে একটা তৃপ্তির ছাপ। একটু বাদেই ধোঁয়ার শরীরটা মিলিয়ে গেল চিরতরের জন্যে।

সকল অধ্যায়

নোট নিতে এবং টেক্সট হাইলাইট করতে লগইন করুন

লগইন