শঙ্কর চ্যাটার্জী
প্রথম পর্ব
গতবারে পুজোর আগেই মামাতো ভাই বিল্টু ফোন করল, ‘সারা জীবন তো শহরের পুজো দেখলে, এবারে আমাদের গ্রামের পুজোও একবার এসে দেখে যাও…’
আমি সেবার মামার মৃত্যুতে ওদের ঐ ধ্যাড়ধেড়ে গোবিন্দপুরে গিয়েছিলাম। বিংশ শতাব্দীর ছোঁয়া একটুও লাগেনি! বর্ধমান স্টেশন থেকে বাসে কাটোয়ার দিকে প্রায় আধ ঘন্টা যেতে হয়, তারপর সেখান থেকে ভ্যানরিকশা — অবশেষে বাকি পথটুকু হন্টন। তবে হ্যাঁ, যারা গ্রাম ভালোবাসে তাদের জন্যে আদর্শ জায়গা। মামা চিরকাল ক্ষেতখামার চাষবাস নিয়েই কাটিয়েছে, বিল্টুও তাই। আমাদের মতো শহুরে মানুষদের দু’-একদিন ভালোই লাগবে — সবুজ ধান ক্ষেত, মরাই, গোয়াল ভরা গরু, বড় বড় মাছভর্তি পুকুর, তাজা হাঁস-মুরগির ডিম, বটের ছায়া, বাঁশবন, শেয়ালের ডাক, কাশ ফুলের বাহার, শিউলি ফুলের গন্ধ, জিভে জল আনা খেজুর রস আর গুড় — আরও কত কী! নেই শুধু আলো জ্বলা রাস্তা-ঘাট, সিনেমাহল, হোটেল-রেস্তোরাঁ, শপিং মল, এসি, ফ্রিজ, ফোনের টাওয়ার। জানি না এই পাঁচ বছরে কিছু পরিবর্তন হয়েছে কি না। ওর আবদার সন্তর্পণে পাশ কাটাবার চেষ্টা করলাম।
— ‘আমি চেষ্টা করব, তবে কথা দিতে পারছি না!’
— ‘জানি তুমি এড়িয়ে যাচ্ছ,’ ও প্রান্ত থেকে ওর চিনচিনে গলা ভেসে আসে, ‘আরে! দু’দিনের জন্যে এলে এমন কিছু গাঁইয়া হয়ে যাবে না।’
ও আমার সেন্টিমেন্টে আঘাত করতে চাইছে যাতে আমি রাজী হই। এখানকার পুজো ছেড়ে, আমোদ-আহ্লাদ ত্যাগ করে ঐ জনমানবহীন জায়গায়, রাতে লো ভোলটেজের আলো, নেট নেই, ধুর, পোষাবে না।
— ‘কিছু মনে করিস না, পরে একদিন যাব। তাছাড়া ছেলে পুজোর ক’দিনই আসে মুম্বাই থেকে।’
অভিমানী গলায় বলল বিল্টু, ‘খুব আশা করেছিলাম, পুজোর ক’টা দিন গল্প করে কাটাব।’ আসলে ও আর আমি তিন-চার বছরের ছোট-বড়… ছোটবেলা থেকে কেন জানি না ও আমার খুব অনুগত ছিল! ওরা গ্রামাঞ্চলে থাকে বলেই হয়ত আন্তরিকতাটা এখনও হারিয়ে যায়নি!
— ‘রাগ করিস না, শীতের দিকে তোর বৌদিকে নিয়ে যাব।’
— ‘তুমি আর এসেছ! সেই বাবা মারা যাওয়ার পর থেকে এই পাঁচ বছরে সময় হল না!’
মোক্ষম বলেছে, কী উত্তর দেব? কথা ঘোরাবার চেষ্টা করলাম।
— ‘বাবা..তোদের এখন ওখানে অনেক উন্নতি হয়েছে। এতক্ষণ কথা বলছিস… টাওয়ার আছে তাহলে!’
— ‘সে গুড়ে বালি, আমি বর্ধমান এসেছি… জমির সার কিনতে।’
— ‘তাই বল, তোরাই বরং একবার ঘুরে যা!’
— ‘তুমি তো জানোই আমি একদিন গেলেই এখানে অন্ধকার… আচ্ছা, তোমার ভূতের গল্প লেখার নেশাটা এখনও আছে?’
এবার একটু খটকা লাগল। হঠাৎ এ কথা কেন?
— ‘তা এখনও একটু-আধটু লিখি…’
— ‘সে জন্যেই আসতে বলছিলাম… এখানে এলে গল্প লেখার খোরাকটা পেতে…’
আমার কান সজাগ হল।
— ‘কেন? ওখানে আবার কী খোরাক আছে?’
— ‘একটা জিনিস তোমায় দেখাব আর শোনাব, যাতে করে তুমি একটা ভালো স্টোরি পেয়ে যাবে…’
— ‘কী দেখাবি আর শোনাবি, কোনো বস্তাপচা পুরনো ভূতের গল্প…আর তার সাথে মিলিয়ে কিছু নিদর্শন… তাই তো? তুই ঐ বলে আমাকে ভোলাচ্ছিস?’
— ‘মা কালীর দিব্যি, বিশ্বাস করো! তুমি পুজোর মধ্যে দু’দিনের জন্যে এসো! তোমাকে একটা অভিশপ্ত পুকুর আর এক বিদেহী আত্মা দেখাতে চাইছি। কয়েকজন ছাড়া ব্যাপারটা কেউ জানে না। জানলেও ভয়ে কানাকানি করে না! আমি সবে মাত্র জেনে ফোন করেছি’
আমার পুরনো রোগ মাথাচাড়া দিতে শুরু করেছে। উত্তেজনার সঙ্গে কৌতূহল মিশছে। ঠাকুরের দিব্যি খেয়ে বিল্টু আমাকে অন্তত ভড়কি দেবে না! তবে কি সত্যিই কিছু আছে? গোবিন্দপুর হাতছানি দিচ্ছে।
— ‘একটু খোলসা করে বল। অতটা পথ গিয়ে যদি দেখি ভাঁওতা…’
ও মনে হয় আমার কথায় ক্ষুণ্ন হল, ‘তুমি ছোটবেলায় পানিমুড়ার নাম শুনেছ তো?’
মনে পড়ে গেল, এক ধরণের জলভূত — পুকুরের পাড়ে থাকত…কিন্তু সে তো গল্প!
— ‘দ্যাখ ভাই ঝেড়ে কাশ, ব্যাপারটা কীরকম ধোঁয়াটে লাগছে।’
বোধহয় অনেকক্ষণ কথা বলা হয়ে গেছে দেখে ও শেষ টানতে চাইল। সত্যিই তো বিল উঠছে ওর!
— ‘তোমাকে একটা কথা জোর দিয়ে বলতে পারি, নিরাশ হবে না! কেননা আমিও কিছুটা সাক্ষী আছি এবং ইতিমধ্যে একটা অঘটন ঘটে গেছে… জানি না এরপর কী ঘটবে। রাজি থাকলে জানিও, বর্ধমান স্টেশনে তোমার জন্যে ওয়েট করব।‘ বলে লাইন ছেড়ে দিল।
ব্যাপারটা বেশ ভাবনায় ফেলে দিল। এতদিন বাদে এরকম একটা সংবাদ… আধুনিক সভ্যতায় যা ক্রমশ হারিয়ে যাচ্ছে! ওর কথাগুলো মনে মনে সাজালাম, পুকুর, পানিমুড়া, বিদেহী আত্মা, অঘটন, সাক্ষী!
পুজো আসতে এখনও দিন বারো বাকি। এর মধ্যে আরও কিছু তথ্য জানা দরকারই। গ্রামের মানুষরা এমনিতেই তিলকে তাল করে! স্ত্রীকে বলে রাখলাম। ও অবাক হয়ে গেল। বললাম, ‘ও একেবারে নাছোড়বান্দা, জানোই তো!’ আসল কথাটা উহ্য রাখলাম।
ছেলে এতদিন বাদে আসছে বলে স্ত্রী একটু তানানানা করছিল। বললাম, ‘দু’দিনের তো ব্যাপার।’
দিন তিনেকের চেষ্টায় বিল্টুর লাইন পেলাম, যেটুকু কেটে কেটে কথা হল তার সারমর্ম হচ্ছে — ওদের গোবিন্দপুর থেকে কিছুটা দূরে দীঘির ধার বলে একটা জায়গা আছে। সেখানে পালবাড়ির বড় বউ এক বছর আগে ওদের বাড়ীর সামনের পুকুরে ডুবে আত্মহত্যা করে পারিবারিক কারণে। তারপর থেকেই পুকুরে শুরু হয় নানান উৎপাত! হঠাৎ হঠাৎ মাছ মরে ভেসে ওঠে, জলের মাঝে বড় বড় বুড়বুড়ি কাটে! ধারে কাছে যা দু’-একটা বাড়ি আছে, সেখানে বেশির ভাগ সময় অসুখ-বিসুখ লেগেই আছে। সন্ধ্যেবেলা পালবাড়ির কেউ কেউ বড় বৌকে পুকুরের কালো জলে ভেসে থাকতে দেখেছে! আবার কখনও পুকুরঘাটে বসে ইনিয়ে-বিনিয়ে কাঁদে! একদিন ঘাটের পাশে গাবগাছে পা ঝুলিয়ে বসেছিল — আর একটা কী বলতে গিয়েই বিল্টু ঢোঁক গিলে ফেলল। এতে রহস্য আরও ঘনীভূত হল যেন! এরপরে অপেক্ষা বা না যাওয়ার কোনো প্রশ্নই নেই! পাকা কথা দিয়ে দিলাম… অষ্টমীর দিন সকালে যাচ্ছি। ও বর্ধমান স্টেশনে অপেক্ষা করবে জানাল।
অষ্টমীর দিন বেলা বারোটার মধ্যে বিল্টুর সঙ্গে ওর বাড়ি পৌছলাম। ওর বউ রিনা আর মেয়ে হাসিমুখে আপ্যায়িত করল। রিনার জন্যে শাড়ি, আলতা, সিঁদুর, মিষ্টি আমার গিন্নী পাঠিয়ে দিয়েছিল। আমি ওর মেয়ের হাতে হাজার টাকা দিলাম। খুব খুশী হল ওরা! সাদাসিধে জীবন, আর মনগুলোও পরিষ্কার, অল্পতে খুশী হয়। অবশ্য কিছু জায়গায় শহুরে বিষ ঢুকতে শুরু করেছে। ওরা অনেক রান্নাবান্নাও করেছিল। বিকালে ঠাকুরতলায় গ্রামের একমাত্র দূর্গাপ্রতিমা দেখাতে নিয়ে চলল বিল্টু। পথে বেরিয়ে এই প্রথম আসল বিষয় নিয়ে কথা বলার সুযোগ পেলাম। কেননা ও পই পই করে বলে দিয়েছিল বাড়িতে মুখ না খোলার জন্যে। স্টেশন থেকে আসার সময়ও বাসে ভীড়ের জন্যে বেশি কথাও বলা যায় নি। ঠাকুর প্রণাম করে, একটা চায়ের দোকান থেকে দু’ভাঁড় চা নিয়ে পাশেই ফাঁকা একটা জায়গায় দাঁড়ালাম।
চায়ে চুমুক দিয়ে বিল্টু বলল, ‘তুমি এখনও সাইকেল চালাও তো?’ ভুরু কুঁচকে ঘাড় নাড়লাম।
— ‘কাল বিকেলে দুটো সাইকেল নিয়ে… বন্ধুর বাড়ির নাম করে বেরোব।‘
— ‘এখান থেকে কত দূর? এখানকার যা রাস্তার অবস্থা…তার ওপর সাইকেল!’ আমার হাতে চায়ের ভাঁড়।
— ‘একটু চেনা-টেনা বাঁচিয়ে যেতে হবে, না হলেই প্রশ্নের ঝড় —’ ও খালি ভাঁড়টা পাশে ফেলে দিয়ে বলল, ‘গ্রামের এই ব্যাপারগুলো এখনও যায়নি — কোথায় যাচ্ছ? কেন যাচ্ছ? কী দরকার? নাজেহাল করে দেবে, আর পরক্ষণেই বাড়িতে খবর চলে যাবে..’ ও একবার এদিক ওদিক তাকাল।
— ‘কতক্ষণ লাগবে সাইকেল করে যেতে?’ চা শেষ করে একটা সিগারেট ধরালাম।
— ‘মিনিট কুড়ি লাগবে, সন্ধ্যের আগেই পৌঁছে যাব।’ গলার স্বর একটু নামিয়ে বলল বিল্টু।
— ‘তুই এর আগে গিয়েছিলি? বা কিছু দেখেছিস?’
— ‘পুকুরপাড়ে সকালে গেছি — রাত্রে? অত সাহস বুকে নেই! শুধু তোমার জন্যেই যাওয়া —’ ওর চোখে মুখে একটা রহস্য খেলা করছে!
— ‘জানি, ছোটবেলা থেকেই আমার ভক্ত ছিলি…’ সিগারেটে টান মেরে ধোঁয়া ছাড়লাম, ‘আচ্ছা, তুই সেদিন ফোনে কী একটা বলতে গিয়ে ঢোঁক গিললি বল তো?’
আবার একবার এপাশ-ওপাশ তাকিয়ে গলাটা আরও খাদে নামিয়ে বিল্টু বলল, ‘চার মাস আগে পালবাড়ির মেজ বৌটাকেও টেনে নিয়ে গিয়ে বড় বৌটা পুকুরের পাশে নরম কাদার মধ্যে মাথা ঢুকিয়ে মেরেছে!’
সিগারেটের ছাই ঝাড়লাম। মনের মধ্যে কথার কাটাকুটি চলছে — ‘কোনো মানুষের কাজ নয় তো? ভূতের গল্প ফেঁদে খুন করছে?’
— ‘তাহলে তোমাকে ডাকতাম না… পুলিশরাই ব্যবস্থা নিত।’ ওর গলাটা একটু চড়ল।
— ‘এত শিওর হচ্ছিস কী করে?’ শেষ টান দিয়ে সিগারেটটা ফেলে দিলাম। ও একটু চুপ করে রইল, ‘পালবাড়ির মেজ ছেলে নির্মল, যার বউ মরেছে… সে আমার বন্ধু।’
এবার সোজাসুজি আমার মুখের দিকে তাকাল, ‘গত পাঁচমাস ধরে প্রতিটি কথা ও আমায় বলেছে…’
আমার জানার ইচ্ছে ক্রমশ বাড়ছে। এ তো দেখছি ছাইচাপা আগুন!
— ‘দ্যাখ, তুই যদি অর্ধেক কথা পেটে, আর অর্ধেক কথা মুখে বলিস… তাহলে তো পুরো ঘটনাটা আমি পাঠক-পাঠিকাদের লিখে জানাতে পারব না! গল্পটাই জোলো হয়ে যাবে।‘
— ‘বলব… সব কথাই জানাব। তোমার মতো লেখক তো নই…সব সাজিয়ে কি আর বলতে পারব?’ ওর ভুলটা ও বোধহয় বুঝতে পারল। ঘড়ির দিকে চেয়ে বলল, ‘সাতটা বাজতে চলল… চলো বাড়ি ফিরি, আমরা গেলে ওরা ঠাকুর তলায় আসবে সন্ধিপুজো দেখতে। তখন ফাঁকা বাড়িতে বাকিটা শোনাব।’
— ‘ভেরি নাইস, চল।’ উত্তেজনা আমার কণ্ঠে।
ওরা পুজো দেখতে যাওয়ার আগে আমাদের জন্যে মুড়ি, বেগুনি, নারকেল নাড়ু আর চা দিয়ে গেল। আহা… কতদিন পর নাড়ু খাচ্ছি! খেতে খেতে বিল্টু শুরু করল তার না বলা কথা আর আমি একাগ্র শ্রোতা।
‘বড় বউ আর মেজ বৌয়ের মধ্যে বনিবনা কোনোদিনই ছিল না। যৌথ পরিবারে যা হয়ে থাকে। কিন্তু বিপরীত হচ্ছে দু’ ভাই — বউদের অশান্তি, খিটিমিটি দেখেও আমল দেয় না। ভাইয়ে-ভাইয়ে গলায় গলায়! এই দেখে দুই বউই জ্বলেপুড়ে মরে… আলাদা করে স্বামীদের বুঝিয়ে লাভ হয় না… একদিন চরম বিস্ফোরণ ঘটল! তুমুল চেঁচামেচির মধ্যে সবাইয়ের সামনে বড় ভাই মুখ খুলল। বড় বউকে যাচ্ছেতাইভাবে ধমকাল। ব্যস… যেন আগুনে জল পড়ল। পুরো বাড়ি নিস্তব্ধ হয়ে গেল! বড় বউ সেই যে চুপ করল, মরার আগে পর্যন্ত কথা বলেনি।
পরদিন সন্ধ্যেবেলা গা ধুতে গিয়ে পুকুর থেকে আর উঠল না! কয়েক ঘন্টা বাদে দেহ ভেসে উঠল। পুলিশ এল, মরা দেহ কাটা-ছেঁড়া হল। আত্মহত্যার কেস হল। গত বছর থেকেই পালবাড়ি চুপচাপ হয়ে গেল…মরার কিছুদিন পর থেকেই… অন্যান্যরা কিছু না দেখলেও, বাড়ির লোকেরা বড় বউকে পুকুরের আশেপাশে দেখতে পেত! বাড়ির মধ্যেই কথাটা সীমাবদ্ধ ছিল, পাছে বাড়ি আর পুকুরের বদনাম হয়ে যায়। বাড়ির সবাই সযত্নে পুকুর ব্যবহার করা ত্যাগ করল।’
একটানা কথা বলে বিল্টু জল খাওয়ার জন্য থামল। ফ্লাস্ক থেকে দুজনে চা ঢাললাম।
‘মাস ছয়েক আগে হঠাৎ করে মেজ বৌয়ের ফিটের রোগ ধরা পড়ল! একদিন দোতলা থেকে সন্ধ্যেবেলা সিঁড়ি দিয়ে নামতে গিয়ে হাত-পা শক্ত হয়ে মুখ থুবড়ে পড়ল! ভাগ্য ভালো, সেই সময়ে বড়বাবুর ছেলে ওপরে উঠছিল। কোনোরকমে ধরে ফেলে — না হলে সেদিনই সিঁড়ি বেয়ে গড়িয়ে পড়ে মারা যেত! এরপর থেকেই দু’-একদিন বাদে বাদেই ফিট হতে শুরু হল। ডাক্তার-বদ্যি কিছুই বাদ গেল না, কোনো উপশম হল না… বরং বেড়েই চলল। আর একটা নতুন উপসর্গ লক্ষ্য করা গেল — ইঁদারা বা টিউবওয়েলের জলে চান করতে বা গা ধুতে চাইত না, খালি পুকুরে যেতে চাইত! বাড়ির লোক সতর্ক থাকত। খিড়কির দরজায় চাবি দেওয়া হল। বাড়ির কুলগুরুকে ডেকে পুজোআচ্চাও করানো হল — কিন্তু কোনো লাভ হল না। ওরা নিশ্চিত হল… বড় বৌয়ের আত্মা ভর করেছে প্রতিশোধ নিতে। গয়া গিয়ে পিন্ড দিয়ে আসা হল… নির্মল আমার সঙ্গে দেখা হলেই দুঃখের কথা জানাত! কিন্তু কী সান্ত্বনা দেব মাথায় আসত না’ — আমাদের চা খাওয়া হয়ে গিয়েছিল। দূর থেকে ভেসে আসছে ঢাকের আওয়াজ। মনে হয় সন্ধিপূজা শুরু হয়ে গেছে।
এবার গল্পটা একটা রূপ পাচ্ছে। আমি জিজ্ঞাসা করলাম — ‘তারপর?’ ও আবার শুরু করল:
‘বড় ভাইয়ের ছেলে পাটনায় চাকরি পেয়ে চলে যাবে, তাই বাড়ির সবাই তাকে বর্ধমান স্টেশনে ট্রেনে তুলতে যাবে। মেজ বউকে দেখার জন্যে বড়বাবু আর নির্মলের মেয়েকে সবাই বাড়িতে রেখে গেল। তাদের চোখকে ফাঁকি দিয়ে মেজ বউ খিড়কি দরজার চাবি খুলে কোনো এক সময়ে ঐ রাক্ষুসে পুকুরে চলে গেল! মাকে ঘরে না দেখেই হাঁপাতে হাঁপাতে ওরা ছুটল পুকুরঘাটে। ভয়ার্ত চোখে দেখল ঘাটের পাশে নরম কাদামাটিতে মুখ গুঁজড়ে মায়ের মরা দেহটা পড়ে আছে! এবার পুলিশের হয়রানি বেশী হল। নির্মল একদম ভেঙে পড়ল। চারপাশে কানাকানি শুরু হল। সকলেই পালবাড়ি আর পুকুরকে এড়িয়ে চলতে শুরু করল। সকলেরই মনে ভয় দানা বেঁধেছে।’ ও থামল। ওর চোখেও ভীতু চাউনি। হাতের আঙ্গুল মটকালাম, ‘তোর বন্ধু জানে, আমার কথা?’
— ‘হ্যাঁ। ওর বাড়ীতে সাইকেল রেখে তারপর পুকুরপাড়ে যাব। যদি বরাতে থাকে… দেখা পাবে!’
মনমরা অবস্থায় মাথা দোলালাম, ‘না রে বিল্টু, এ যাত্রা আর বোধহয় হল না… মেজ বৌয়ের ওপর যদি প্রতিশোধ নেওয়া হয়ে গিয়ে থাকে, তাহলে তো আর এ তল্লাটে ওর থাকার কথাই নয়!’
আমার শুকনো মুখটার দিকে তাকিয়ে বিল্টু ভাঙা গলায় বলল, ‘পনের দিন আগে নির্মল ওর বৌদিকে দেখল বলেই তো তোমায় ফোন করে আসতে বললাম।’
আমার চোখে মুখে হারানো উত্তেজনা আবার ফিরে এল।
‘কোথায় এবং কী দেখল?’ আমার উৎসাহের গলা। কিন্তু ও মুখ খোলার আগেই রিনা আর তার মেয়ে ফিরল। আমরাও ঐ প্রসঙ্গ বন্ধ করলাম। আর একটু বাদে এলে কী ক্ষতিটা হত? আবার অপেক্ষা।
দ্বিতীয় পর্ব
রাতে আমি আর বিল্টু একসঙ্গে শুলাম। আমার মনে নির্মলের দেখা পাওয়ার ব্যাপারটা শোনার আগ্রহ এই কয়েক ঘন্টায় তুঙ্গে উঠেছে। মন বলছে যদি এখনও সে থেকে থাকে তাহলে বড় বিপদ! কেননা ও যতদূর সম্ভব পিশাচিনীতে পরিণত হয়ে গেছে। পীরবাবার কথা মনে পড়ছে। এই সময়ে এখানে থাকলে ভয়টা কাটত। ততক্ষণে রাত সাড়ে দশটা বেজে গেছে। আর চুপ থাকতে না পেরে বলে উঠলাম, ‘এবার শুরু করে দে, না হলে আবার কখন বাধা পড়বে!’ খাটে পা ছড়িয়ে বসে বিল্টু শুরু করল তার অসমাপ্ত কাহিনী —
‘নির্মল সন্ধ্যেবেলায় ঘরে বসে বই পড়ছিল। মনটা ওর একদম ভেঙে গেছে। কয়েকদিন বাদে পুজো। মা-মরা মেয়েটার কথাও ভাবছিল বই মুখে করে। হঠাৎ পুকুরের ধার থেকে ঝপাং করে কিছু একটা জলে পড়ার শব্দ ভেসে এল। ভয়ে মুখ শুকিয়ে উঠল ওর। আবার কি কেউ জলে ঝাঁপ দিল? একরকম ছুটে নিচে নেমে এসে পুকুরের ধারে চলল। সূর্য অস্ত গেলেও এখনও পুরো আঁধারে চারিদিক ছেয়ে যায়নি। পুকুর ঘাটে দাঁড়িয়ে দেখল সিঁড়ির শেষ ধাপের কাছাকাছি জলটা কেমন অস্বাভাবিক ভাবে ঘোলাচ্ছে। তাহলে বড় কোনো মাছ ঘাই মেরেছে। কিন্তু তার ভাবনাকে ভুল প্রমাণ করে বড় বৌদির মুন্ডুটা জলে ভেসে উঠল! ওর চোখের দিকে তাকিয়ে বীভৎস হাসি হাসল। আতঙ্কে ওর থরথর করে কাঁপুনি শুরু হল। কয়েক মিনিটের মধ্যে মুন্ডু সমেত বুক পর্যন্ত, কদর্য দেহটা জলের ওপর দেখা দিয়ে ডুবে গেল। কালো জলের ওপর শুধু বুড়বুড়িগুলো ভেসে রইল। এর মাঝে বাবাকে ঘরে খুঁজে না পেয়ে পুকুরঘাটে চলে এসেছে মেয়ে। ভয়ে সিঁটিয়ে যাওয়া বাবাকে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে ও কোনোরকমে ধরে ধরে বাড়ির ভেতর নিয়ে এল।‘ একটানা বলে বিল্টু থামল।
তাহলে কি আবার কাউকে পিশাচিনী টানছে? মাথার ভেতর এই প্রশ্নটাই আমার এল। এরপর আর কথা না বাড়িয়ে ঘুমোবার চেষ্টা করলাম।
পরদিন বিকেল বেলায় পাজামা-পাঞ্জাবি পরে বিল্টুর সঙ্গে সাইকেল নিয়ে বেরোলাম পালবাড়ির উদ্দেশ্যে। প্রকৃতির আলো থাকতে থাকতে যেতে চাইছি যাতে কমপক্ষে পুকুরটার একটা ছবি তুলতে পারি। সঙ্গে নিত্যসঙ্গী টর্চ আছে। ওদের পাড়া ছাড়িয়ে আঁকাবাঁকা মেঠো পথ দিয়ে বিল্টুর পিছু পিছু চলেছি। মাঝে মাঝে কাশ ফুলের জঙ্গল। দূষণমুক্ত বাতাস, নীল আকাশে সাদা স্তূপাকার মেঘ! দূর থেকে ভেসে আসা ঢাকের আওয়াজ। সব মিলেমিশে বেশ ভালো লাগছে। বিল্টু বোধহয় কোনো শর্টকার্ট রাস্তা দিয়ে নিয়ে চলেছে। কেননা বেশি লোকের আনাগোনা নেই। কুড়ি মিনিট সাইকেল চালাবার পর একটা সাদা দোতলা বাড়ির সামনে এসে দাঁড়ালাম। খুব সম্ভবত এটাই পাল বাড়ি। আমার চোখ তখন অভিশপ্ত পুকুরটাকে খুঁজছে। ও বুঝতে পেরে বলল, ‘তুমি যাকে খুঁজছ সেই মানুষখেকো পুকুরটা বাড়ির পিছন দিকে।’
আমাদের সাড়া পেয়ে বিল্টুর বয়সীই একজন লোক বেরিয়ে এল। মুখে শোকের চিহ্নের সাথে দু’ চোখে এক দূরাগত ভয়ের ছায়া। ম্লান মুখে আমাদের আপ্যায়িত করল। বিল্টু বলল, ‘আমার দাদা, যার কথা বলেছিলাম। পুকুরটা একটু দেখতে চাইছে। নির্মল ঘাড় নেড়ে সায় জানাল কিন্তু আমাদের সঙ্গে এল না। বিল্টু দেখলাম চেনে। বাগানের মাঝখান দিয়ে ইঁটের সরু রাস্তা বাড়ির পিছন দিকে চলে গেছে। আমরা ঐ পথ ধরে বন্ধ খিড়কি দরজার কাছে এলাম। দরজা খুলে পাঁচ-সাত পা এগোলেই পুকুরটা। বেশ বড় লম্বাটে ধরণের। ওদিকের প্রান্তে তিন-চারটে টিনের চাল দেওয়া ছোট ছোট বাড়ি চোখে পড়ছে। পুকুরের আশেপাশে বড় বড় গাছ রয়েছে। বেশির ভাগই ফলের গাছ — আম, কাঁঠাল, জাম। এছাড়া গাবগাছ ও তেঁতুলগাছও চোখে পড়ছে। এত গাছের আধিক্যের জন্য জলের রং কালচে লাগছে। জলের ওপর সবুজ শ্যাওলার চাক ভাসছে। ঘাটের কাছে এসে দাঁড়ালাম। কালো জল একেবারে স্থির। আশ্বিন মাসের বাতাস হীন সন্ধ্যা নামছে। এক-আধটা ঝিঁঝির ডাক কানে এল। তরঙ্গহীন জলের গভীরে কি খেলা চলছে কে জানে! গাছের দরুণ রোদের আলো আটকে যাওয়ার জন্য চারিদিকে কেমন একটা স্যাঁতসেঁতে ভাব।
বিল্টু আঙুল তুলে যেখানে নির্মলের বউয়ের দেহটা পড়েছিল, সেই জায়গাটা দেখাল। পুকুরের পাড়ের কাছে লম্বা লম্বা ঘাসের মাঝে কাদা মাখামাখি একটু জায়গা। বধ্যভূমি! কথাটা আচমকা মনে আসতে শরীরে অদ্ভুত শিহরণ খেলে গেল। চশমাটা ঠিক করে নিলাম। ঘাসে ভরা স্থানটা আশ্চর্যজনক ভাবে আকর্ষণ করছে! জোর করে চোখটা সরিয়ে নিলাম। মনে হচ্ছে কিছু একটা আছে! বিল্টুকে বললাম, ‘এই ঘাটে বসে খানিকটা সময় কাটিয়ে দেব।’
‘সে হবে ’খন, এখন চলো। নির্মল চায়ের ব্যবস্থা করেছে,’ ওর কথায় কেমন যেন পালাই পালাই রব। এই সময় কাছের ঝাঁকড়া গাব গাছটার মোটা ডালগুলো আচমকা দুলে উঠল। মনে হল গাছের ডালে দাঁড়িয়ে কোনো শক্তিশালী লোক ডালটা পা দিয়ে দোলাল। কিছু শুকনো পাতা ঝরে পুকুর জলে পড়তে লাগল।
‘হনুমানের দল হবে বোধহয়।’ আমি বললাম।
বিল্টুর মুখ শুকিয়ে এতটুকু হয়ে গেছে। ও আমার হাত ধরে বাড়ির দিকে টানতে শুরু করেছে। এখনই যদি ও এত ভয় পেয়ে যায় রাত পর্যন্ত আমার সঙ্গে এই ঘাটে বসে থাকবে কী করে? অগত্যা পালবাড়িতে ঢুকলাম।
নির্মল আর ওর দাদা চা খেতে খেতে বারবার নিষেধ করল — সন্ধ্যের পর ওখানে না যাওয়াই মঙ্গল। কেননা নির্মল সেদিন ওর বৌদিকে দেখার পর থেকে মেজ বৌমার মতো খালি পুকুরে যাওয়ার জন্য ব্যস্ত হয়ে পড়ছে! আমি আর ওর মেয়ে বাধা দিচ্ছি।
নির্মল আধখানা বিস্কুট মুখে পুরে বলল, ‘দাদার কথা ঠিক। কিরকম একটা অমোঘ আকর্ষণ অনুভব করছি। বিশেষ করে সন্ধ্যের পর থেকে মনকে শক্ত রাখার হাজার চেষ্টা করেও ব্যর্থ হচ্ছি। যেমন নেশাগ্রস্তকে নেশার জিনিস টানে, তেমনই।’ ওর চোখের তারাগুলো থিরথির করে কাঁপছে। এই প্রথম আমার মস্তিষ্কে একটা বিপদ ঘন্টি বাজল। ও নিশ্চয়ই আত্মার আকর্ষণে পড়ে গেছে।
‘আমার মন বলছে, আবার কিছু অশুভ ঘটনা ঘটতে যাচ্ছে। আপনাদের উচিত, এই বাড়ি ছেড়ে অন্য কোথাও চলে যাওয়া —’
দুই ভাই সহমত হল। বিল্টু আমাদের কথা চোখ গোলগোল করে শুনছে। ওঠার নাম নেই। জানলা দিয়ে দেখতে পাচ্ছি সন্ধ্যের আঁধার গুটি গুটি করে নেমে আসছে।
বলে উঠলাম, ‘এবার পুকুরের দিকে যাওয়া যাক! যার জন্যে এতদূর আসা।’ দেখলাম সবাইয়ের মুখেই আতঙ্কের ছাপ।
নির্মল হঠাৎ বলে উঠল, ‘কেউ না যাক, আমি আপনার সঙ্গে যাচ্ছি।’
বলেই ও তড়াক করে দাঁড়িয়ে পড়ল। চমকে উঠলাম আমি। সভয়ে দেখলাম, নির্মলের মুখে প্রতিজ্ঞার চিহ্ন। শুধু যাওয়ার অপেক্ষা। সতর্ক হলাম। আমার কৌতূহল চরিতার্থ করার চেয়ে নির্মলকে বিপদের হাত থেকে বাঁচানো আগে প্রয়োজন। ওর মা-মরা মেয়ের মুখ চেয়ে কঠিন গলায় বললাম, ‘পুকুরঘাটে কেউ যাবে না! এমনকি আমিও না।’
আমার কথা শুনে ও মুখটাকে রাগের মুখোশ বানিয়ে ফেলল। আমাদের দিকে রাগের দৃষ্টিতে তাকাল। এক মুহূর্তে মানুষের শরীরে এত পরিবর্তন ঘটতে পারে, ধারণা ছিল না। ওর হাত-পায়ের পেশীগুলো রীতিমতো শক্ত হয়ে উঠেছে। চোয়ালে দৃঢ় প্রতিজ্ঞা। ও পা বাড়াল যাবার জন্য।
অন্তিম পর্ব
আমরা নির্মলকে জাপটে ধরলাম। কিন্তু ওকে ধরে রাখতে পারছি না। ওর গায়ে যেন দশটা দানবের শক্তি ভর করেছে! কোথা থেকে এল এত ক্ষমতা? আমাদের তিনজনকে যেন মেঝেতে ফেলে দেবে। মিনিট কয়েক টানা-হ্যাঁচড়ার পর ও নিস্তেজ হয়ে পড়ল। আমরা তখন রীতিমতো হাঁফাচ্ছি। শরীর ঘামে ভিজে গেছে। বাইরে তখন সন্ধ্যের অন্ধকার ঘন হচ্ছে। আমার ভূত দেখার ইচ্ছে কমে গেছে। আমাদের চেঁচামেচিতে নির্মলের মেয়ে মুখে একরাশ ভয় নিয়ে ঘরে ঢুকল।
‘বাপি তুমি ওরকম আবার করছ? মা চলে গেছে, এবার তুমিও কি আমাকে ছেড়ে চলে যাবে?’ কান্নায় ওর গলা বুজে আসছে। খুব কষ্ট লাগল।
এই সময় খিড়কি দরজা ধাক্কাবার শব্দ কানে এল। কেউ বা কারা সজোরে বাইরে থেকে ধাক্কা দিয়ে চলেছে! ওদের ওখানে রেখে আমি আর বিল্টু টর্চ হাতে বাইরে এলাম। ইশারায় নির্মলের দাদাকে বললাম ভেতর থেকে দরজা বন্ধ করে দিতে যাতে ওর ভাই পালিয়ে যেতে না পারে। এদিকে খিড়কি দরজার আঘাত ক্রমশ বাড়ছে। এভাবে চললে কিছুক্ষণের মধ্যে কাঠের দরজা ভেঙে পড়তে পারে।
খিড়কি দরজার দিকে কোনো আলো নেই। টর্চের আলোয় আমরা দুজন দরজার কাছাকাছি এসে পড়েছি। এখনও সমানে দরজার পাল্লা দুটো বারবার ধাক্কার চোটে কেঁপে উঠছে! মনে হচ্ছে, বাইরে অন্তত জনা ছয়েক লোক একসঙ্গে দরজার ওপর লাথি, ঘুঁষি মারছে!
বিল্টু ভয়ার্ত গলায় বলল। ‘শঙ্করদা, খবরদার দরজা খুলো না। বুঝতে পারছ না কেন? ওগুলো মানুষ নয়। খুললে, আমরাও মারা পড়ব।”
ওর কথাগুলো আমার কান দিয়ে ঢুকে মনে আঘাত করল। কিন্তু এত সামনে এসে, অতীন্দ্রিয় শক্তিকে চাক্ষুষ দেখতে পাব না? এতদিন বইয়ে, সিনেমায়, তান্ত্রিকদের কাছে যা শুনে এসেছি! তার প্রত্যক্ষ অভিজ্ঞতা থেকে বঞ্চিত হব?
এবার দরজায় একটা মড়মড় শব্দ হল। তার সাথে পাল্লাতে চিড় ধরল। তান্ত্রিকের কথাটা মাথায় আসতেই মৃত পীরবাবার মুখটা মনের আয়নায় ভেসে উঠল। ওঁর মাজারে যেতাম নানাবিধ অলৌকিক ক্রিয়াকলাপ দেখার নেশায়। যা পরবর্তী সময়ে গল্পের আকারে লিপিবদ্ধ করেছি।
সেই সময় পীরবাবা বলেছিলেন এইসব অশুভ শক্তির মুখোমুখি হওয়ার জন্যে নিজেকেও তান্ত্রিক বিদ্যায় পারদর্শী হতে হয়। দেহে মনে শক্তি সঞ্চয় করতে হয়। নাহলে পিশাচ শক্তির হাতে মৃত্যু অবধারিত। কথাটা মনে পড়তেই নিজেকে সংযত করলাম। তবু কৌতূহল দমন করতে না পেরে চিড় ধরা কাঠের ফাটলে টর্চের আলো ফেললাম।
আতঙ্কিত চোখে দেখলাম ফাটল দিয়ে এক দলা পুকুরের দুর্গন্ধ যুক্ত শ্যাওলা ঢুকে আসছে! সেই শ্যাওলার মধ্যে বিজবিজ করছে অসংখ্য পোকা। অর্থাৎ দরজার বাইরে নরকের কীটদের আগমন ঘটেছে। আমার মধ্যে এক অদ্ভুত পরিবর্তন ঘটে গেল। কারা যেন অন্তরাল থেকে আমাকে নির্দেশ দিচ্ছে দরজা খোলার! আমি দরজার ছিটকিনিটা খুলতে গেলাম! পিছন থেকে বিল্টুর ভয়ার্ত আর্তনাদ কানে ঢুকছে না। কেউ যেন আমার সমস্ত ইন্দ্রিয়গুলো অকেজো করে দিয়েছে!
আচমকা আমার পকেটে থাকা মোবাইলটা কর্কশ শব্দে চিৎকার করে উঠল। যার ফলে হঠাৎ পুনরায় ইন্দ্রিয়গুলো সচল হয়ে উঠল। দু’ পা দরজা থেকে পিছিয়ে এসে ফোনটা কানে ঠেকালাম। দরজার শব্দের জন্যে কানে চেপে ধরলাম মুঠোফোনটা।
ছেলের উত্তেজিত কণ্ঠ ভেসে এল, ‘অনেক চেষ্টায় এইমাত্র লাইন পেলাম। মায়ের সকাল থেকে প্রচন্ড জ্বর। এখন টেম্পারেচার চার ছাড়াল। ভুল বকছে। আমি একা…।’
‘চিন্তা করিস না। আমি আসছি।’ কথার মাঝে লাইন কেটে গেল। দরজায় ধাক্কার শব্দ উপেক্ষা করে বাস্তবে ফিরে এলাম। পিছন ফিরে দেখলাম আমার থেকে হাত তিনেক দূরে দাঁড়িয়ে বিল্টু ভয়ে কাঁপছে। ওর কাছে এসে কাঁধে ঝাঁকুনি দিলাম।
‘তোর বৌদির খুব জ্বর। ছেলে একা। আমায় এখুনি ফিরতে হবে। খুব তাড়াতাড়ি। আমি সাইকেলের কাছে যাচ্ছি। তুই ওদের বলে আয়।’
এখান থেকে যাওয়ার কথা শুনে ওর শরীরে যেন প্রাণ ফিরে এল। ও ছুটল বাড়ির ভেতরে। যাওয়ার আগে শেষবারের জন্যে ঐ নরকের দরজার দিকে ভয়ে ভয়ে তাকালাম। এতদিন যাদের কথা লিখতাম তারা যে আমার এত কাছাকাছি আসবে কোনোদিন কল্পনা করিনি। যতই আমি সাহসী হই না কেন খিড়কি দরজা খুলে ওদের সামনে দাঁড়ানোর ক্ষমতা বা সাহস এখনও সঞ্চয় করতে পারিনি। পীরবাবা জীবিত নেই। কিন্তু তার সহকারী রফিক আছে। আজ যদি ও সাথে থাকত? নিশ্চয়ই দরজা খুলে ওদের ভয়াল ভয়ঙ্কর রূপ দেখতাম।
স্ত্রীর কথা মনে হতে জোরে পা চালালাম সাইকেলের দিকে। ঘড়িতে সময় সন্ধ্যে সাতটা। জানিনা কতক্ষণে বাড়ি পৌঁছতে পারব। এখনও কানে আসছে দূর থেকে দরজা ঠেলার শব্দ! বিল্টু আর আমি ফিরে চললাম ওদের বাড়ির দিকে মনে একরাশ ভৌতিক অভিজ্ঞতা নিয়ে। জানি না পাল বাড়ির বাসিন্দাদের কপালে কী লেখা আছে!
বিল্টুর বাড়ি এসে পাঁচ মিনিটের মধ্যে বেরিয়ে পড়লাম। বিল্টু ভ্যান রিক্সা নিয়ে স্টেশনে এল। বারণ করা সত্ত্বেও শুনল না। না খেয়েদেয়ে পুজোর দিনে চলে আসছি বলে ওদের মন খারাপ। কিন্তু স্ত্রীর কথা মনে করে আটকাতে পারল না। ট্রেনে ওঠার আগে বিল্টুকে বললাম, ‘যেমন করে পারিস পাল বাড়ির খবর আমাকে দিবি…।’
‘তুমিও বৌদির খবর জানাবে।’ ট্রেনে উঠে পড়লাম। ফাঁকা ট্রেনে বসে কয়েকটা কথা মাথায় ঘুরপাক খাচ্ছে। এক নম্বর হল, এই মুহূর্তে পাল বাড়িতে কী হচ্ছে? দ্বিতীয়, স্ত্রীর অসুখের কথা। তাহলে কি ঈশ্বর স্ত্রীর অসুখের অজুহাতে ভয়ঙ্কর বিপদ থেকে আমাকে সরিয়ে আনলেন?
একাদশীর দিন স্ত্রীর জ্বর কমল। ভাইরাল ফিভার। এর মধ্যে বিল্টু এক সেকেন্ডের জন্যে লাইন পেয়ে তার বৌদির খোঁজখবর নিয়েছে। আর কোনো কথা হয়নি। আমি উৎকণ্ঠায় আছি। এ ছাড়া কাহিনীটা সম্পূর্ণ করা দরকার।
কয়েকদিন পরে বিল্টুর ফোন পেলাম। জানাল সেই রাত্রে আরও কিছুক্ষণ ধাক্কাধাক্কি চলার পর শব্দ থেমে যায়। নির্মলকে কোনোরকমে জোর করে ঘরে আটকে রেখেছিল ওরা। বড় ভাই পাটনায় ছেলেকে ফোন করে, বাড়িতে তালা ঝুলিয়ে ওরা ছেলের কাছে চলে গেছে।
বুঝলাম, আরও একটা অভিশপ্ত বাড়ির সংখ্যা বাড়ল।
নোট নিতে এবং টেক্সট হাইলাইট করতে লগইন করুন
লগইন