অধ্যায় ৪৭ : ভুল থেকে শেখা – কার্ল পপার ও থমাস কুন

কাজী মাহবুব হাসান

অধ্যায় ৪৭ : ভুল থেকে শেখা – কার্ল পপার ও থমাস কুন

১৬৬৬ খ্রিস্টাব্দে এক তরুণ বিজ্ঞানী বাগানে বসেছিলেন যখন একটি আপেল গাছ থেকে মাটিতে ঝরে পড়েছিল। বিষয়টি তাঁকে ভাবায়, কেন আপেল সরাসরি নিচের দিকে পড়ে, কেন উপরে না, বাঁকা হয়েই বা অন্যদিকে কেন নয় (এই আপেল পড়ার গল্পটি প্রচলিত হয়েছে ভলতেয়ারের কল্যাণে, তিনি এই গল্পটি শুনেছিলেন নিউটনের ভাইঝির কাছে)। বিজ্ঞানীটির নাম আইজাক নিউটন এবং এই ঘটনাই তাকে অনুপ্রাণিত করেছিল তাঁর মাধ্যাকর্ষণ-তত্ত্বটি প্রস্তাবনার জন্যে, যে তত্ত্বটি যেমন গ্রহদের গতিপথ ব্যাখ্যা করেছিল, তেমনি ব্যাখ্যা করেছিল কেন আপেল সরাসরি নিচের দিকে পড়বে। কিন্তু এরপরে কী ঘটেছিল? আপনি কি মনে করেন এরপর নিউটন সব সাক্ষ্যপ্রমাণ জড়ো করেছিলেন যা কিনা সন্দেহাতীতভাবে প্রমাণ করেছিল তাঁর তত্ত্বটি সত্য? দার্শনিক কার্ল পপার (১৯০২-১৯৯৪) অবশ্যই তা মনে করতেন না। বিজ্ঞানীরা, আমাদের সবার মতোই, তাদের ভুলগুলো থেকে শিক্ষা নেন। বিজ্ঞান অগ্রসর হয় যখন আমরা অনুধাবন করি, বাস্তবতাসংক্রান্ত কোনোকিছু নিয়ে একটি বিশেষ উপায়ে করা চিন্তাটি হচ্ছে ভুল বা মিথ্যা। দুটি বাক্যে, এটাই ছিল কার্ল পপারের দৃষ্টিভঙ্গিতে কীভাবে পৃথিবী সম্বন্ধে জ্ঞান অর্জন করার মানবতার শ্রেষ্ঠতম প্রত্যাশাটি কাজ করে। পপার তাঁর ধারণাগুলো প্রস্তাব করার আগে অধিকাংশ মানুষই বিশ্বাস করতেন বিজ্ঞানীরা পৃথিবীর কোনোকিছু সম্বন্ধে একটি ধারণা নিয়ে শুরু করেন, তারপর তারা প্রমাণ জোগাড় করার চেষ্টা করেন, যা প্রমাণ করে তাদের মনে করা ধারণাটি সঠিক। কিন্তু বিজ্ঞানী যা করেন, পপারের মতে, সেটি হচ্ছে তারা তাদের তত্ত্বগুলোকে ভুল বা মিথ্যা প্রমাণ করার চেষ্টা করেন। কোনো একটি তত্ত্বকে পরীক্ষা করে দেখার প্রক্রিয়ায় আবশ্যিক একটি অংশ হচ্ছে তত্ত্বটিকে অপ্রমাণিত বা মিথ্যা প্রতিপন্ন করা (বা দেখানো যে, তত্ত্বটি আসলে ভুল) যায় কিনা সেটি দেখা। একজন বিজ্ঞানী শুরু করেন একটি সাহসী অনুমান দিয়ে, তারপর সেটাকেই তিনি ধারাবাহিক পরীক্ষা কিংবা পর্যবেক্ষণের মাধ্যমে অপ্রমাণিত বা ভুল প্রমাণ করার চেষ্টা করেন। বিজ্ঞান সৃজনশীল আর রোমাঞ্চকর একটি উদ্যোগ, কিন্তু এটি কোনোকিছুকে সত্য প্রমাণিত করেনা, এটি যা করে তাহলো ভ্রান্ত আর মিথ্যা দৃষ্টিভঙ্গিগুলোকে বাতিল করে, আর এভাবে আশাবাদী হওয়া যেতে পারে এ প্রক্রিয়ায় এটি ক্রমশ সত্যের দিকে অগ্রসর হয়।

কার্ল পপার ১৯০২ সালে অস্ট্রিয়ার ভিয়েনাতে জন্মগ্রহণ করেছিলেন। যদিও তার পরিবার খ্রিস্টানধর্মে দীক্ষিত হয়েছিল বেশ আগেই, তবে তিনি ইহুদি পূর্বসূরিদের উত্তরসূরি ছিলেন, এবং বুদ্ধিমত্তার সাথে হিটলারের অস্ট্রিয়ায় সম্প্রসারণ কর্মসূচি গ্রহণ করার আগেই তিনি সিদ্ধান্ত নিয়েছিলেন অস্ট্রিয়া ত্যাগ করার, যখন ত্রিশের দশকে হিটলার জার্মানির ক্ষমতায় এসেছিল। প্রথমে তিনি যান নিউজিল্যান্ডে, এরপর আসেন ইংল্যান্ডে, যেখানে তিনি স্থায়ী হয়েছিলেন লন্ডন স্কুল অব ইকোনোমিক্স-এর অধ্যাপনার পদ নিয়ে। তারুণ্যে তাঁর আগ্রহের ক্ষেত্র ছিল বিশাল: বিজ্ঞান, মনোবিজ্ঞান, রাজনীতি, ও সংগীত, কিন্তু দর্শন ছিল তাঁর সত্যিকারের ভালোবাসা। বিজ্ঞানের দর্শন আর রাজনৈতিক দর্শনে তিনি গুরুত্বপূর্ণ অবদান রেখে গেছেন। বৈজ্ঞানিক পদ্ধতি নিয়ে পপার লেখা শুরু করার আগ অবধি, বহু বিজ্ঞানী আর দার্শনিকরা বিশ্বাস করতেন যে বিজ্ঞানচর্চা করার উপায় হচ্ছে সেইসব প্রমাণগুলো খুঁজে বের করার চেষ্টা করা, যা আপনার হাইপোথিসিসটিকে সমর্থন করে। যদি আপনি প্রমাণ করতে চান যে, সব সোয়ান বা রাজহাঁস হচ্ছে সাদা, তাহলে আপনাকে বহু রাজহাঁস পর্যবেক্ষণ করে দেখতে হবে, আপনি যদি দেখেন সব রাজহাঁস যাদের আপনি পর্যবেক্ষণ করেছেন সেগুলো সাদা, তাহলে যুক্তিসঙ্গত মনে হতে পারে যে আপনার হাইপোথিসিস, ‘সব রাজহাঁস সাদা’ সত্য। এই যুক্তি প্রক্রিয়ায়, ‘আমার দেখা সব রাজহাঁস সাদা’ প্রস্তাবনাটি ‘সব রাজহাঁসই সাদা’ এমন উপসংহারের দিকে অগ্রসর হয়। কিন্তু স্পষ্টতই আপনি এখনও কোনো রাজহাঁস দেখেননি যার রঙ কালো। অস্ট্রেলিয়ায় যেমন কালো রাজহাঁস আছে, এছাড়া সারা পৃথিবী জুড়ে বহু চিড়িয়াখানাতেও আছে। সুতরাং ‘সব রাজহাঁস সাদা’ আপনার এই প্রস্তাবনাটি এইসব প্রমাণের সামনে যুক্তিসঙ্গত কোনো প্রস্তাবনা হতে পারেনা। এমনকি আপনি যখন হাজার হাজার রাজহাঁস দেখেছেন যেগুলো সবই সাদা, এটি তারপরও মিথ্যা প্রমাণিত হতে পারে। সব রাজহাঁস সাদা এটি সন্দেহাতীতভাবে প্রমাণ করার একটিমাত্র উপায় হচ্ছে পৃথিবীর প্রতিটি রাজহাঁসকে দেখা। যদি একটিমাত্র কালো রাজহাঁসের অস্তিত্ব থাকে, তাহলে আপনার উপসংহার ‘সব রাজহাঁস সাদা’ মিথ্যা প্রমাণিত হবে।

এটি আরোহ বা ইনডাকশন প্রক্রিয়ার একটি সংস্করণের ভুল যা ডেভিড হিউম লিখেছিলেন অষ্টাদশ শতাব্দীতে। ইনডাকশন (আরোহ) খুবই ভিন্ন ডিডাকশন (অবরোহ) থেকে। আর সমস্যার উৎস সেখানে। ডিডাকশন হচ্ছে একধরনের যুক্তিপ্রক্রিয়া প্রস্তাবনা, যেখানে যদি কোনো প্রেমিস (বা শুরুতে ধরে নেয়া কোনো প্রস্তাবনা) সত্যি হয়, তাহলে উপসংহারকেও অবশ্যই সত্য হতে হবে। সুতরাং যদি আমরা সেই বিখ্যাত উদাহরণটি নিই, ‘সব মানুষ মরণশীল’ আর ‘সক্রেটিস একজন মানুষ’ হচ্ছে দুটি প্রেমিস, যেখান থেকে যৌক্তিক উপসংহার ‘সক্রেটিস মরণশীল’ প্রস্তাবনায় পৌঁছানো যায়। কিন্তু সক্রেটিস মরণশীল, এই প্রস্তাবনাটির সত্যকে যদি অস্বীকার করা হয়, সেটা অনেকটা এমনকিছু বলার মতো হবে যে, সক্রেটিস মরণশীল আর মরণশীল নয়, একই সাথে। এই বিষয়টি একটি উপায়ে যেভাবে ভাবা যায় সেটি হচ্ছে অবরোহ প্রক্রিয়া, যেখানে উপসংহারের সত্যতা কোনো-না-কোনো ভাবে প্রাথমিক প্রস্তাবনা বা প্রেমিসের মধ্যে থাকে, এবং যুক্তি শুধুমাত্র সেটিকে বের করে আনে বাইরে। ডিডাকশন প্রক্রিয়ার আরো একটি উদাহরণ, যেমন:

প্রেমিস এক : সব মাছের ফুলকা আছে।

প্রেমিস দুই : জন হচ্ছে একটা মাছ।

উপসংহার : সে কারণে জনেরও ফুলকা আছে।

খুবই অস্বাভাবিক হবে যদি বলা হয় যে প্রেমিস এক ও প্রেমিস দুই দুটোই সত্য, কিন্তু উপসংহারটি হচ্ছে মিথ্যা। সেটি পুরোপুরিভাবে অযৌক্তিক হবে।

ইনডাকশন প্রক্রিয়াটি খুবই ভিন্ন এর থেকে। ইনডাকশন বা আরোহ প্রক্রিয়া মূলত একগুচ্ছ নির্বাচিত পর্যবেক্ষণ থেকে একটি সাধারণ উপসংহারে পৌঁছানোর প্রক্রিয়া। আপনি যদি লক্ষ করেন যে, গত চার সপ্তাহ ধরে প্রতি মঙ্গলবার সবসময়ই বৃষ্টি হচ্ছে, আপনি হয়তো সেখান থেকে একটি সাধারণীকরণ করতে পারেন যে, ‘প্রতি মঙ্গলবারেই বৃষ্টি হয়’। সেটাই আরোহ বা ইনডাকশনের একটি উদাহরণ হবে। শুধুমাত্র একটি বৃষ্টিহীন মঙ্গলবারই যথেষ্ট ‘প্রতি মঙ্গলবার বৃষ্টি হয়’এমন দাবিকে মিথ্যা প্রমাণিত করার জন্যে। চারটি পর পর মঙ্গলবার সম্ভাব্য সব মঙ্গলবারের তুলনায় খুব অল্প একটি স্যাম্পল বা নমুনা। কিন্তু এমনকি যদি আপনি আরো অসংখ্য মঙ্গলবার পর্যবেক্ষণ করেন, যেমন সাদা রাজহাঁসের ক্ষেত্রে হয়েছিল, আপনি তারপরও ভুল প্রমাণিত হতে পারেন একটি উদাহরণ দ্বারা, যা এই সাধারণীকরণের সূত্র মানছে না: একটি শুষ্ক মঙ্গলবার বা সাদা নয় এমন রাজহাঁস, যেমন। আর আরোহ প্রক্রিয়ায় এটাই সমস্যা (ইনডাকশন), যুক্তিযুক্ত করার সমস্যা ইনডাকশন পদ্ধতির উপর নির্ভর করে, যখন এটি স্পষ্টতই নির্ভরযোগ্য নয়। কীভাবে আপনি জানবেন পরের যে এক গ্লাস পানি আপনি পান করবেন সেটি আপনার শরীরে কোনো বিষক্রিয়া করবেনা? উত্তর: অতীতে আপনি যত গ্লাস পানি পান করেছেন সেগুলো সবই ভালো বা বিষমুক্ত ছিল। সুতরাং আপনিও ধরে নিচ্ছেন এটাও ভালো হবে। আমরা সবসময় এই ধরনের যুক্তিপ্রক্রিয়া ব্যবহার করি। কিন্তু স্পষ্টতই আমরা পুরোপুরি যুক্তিযুক্ত নই যখন আমরা এর উপর ভিত্তি স্থাপন করি। আমরা প্যাটার্নটি ধারণা করে নিই, যখন আসলেই সেটি থাকতে পারে আবার নাও পারে।

আপনি যদি মনে করেন বিজ্ঞান অগ্রসর হয় ইনডাকশন প্রক্রিয়ায়, যেমন বহু দার্শনিক ভেবেছিলেন, তাহলে আপনাকে ইনডাকশন প্রক্রিয়ার সমস্যার মুখে পড়তে হবে। এই অনির্ভরযোগ্য উপায়ের যুক্তিপ্রক্রিয়া কীভাবে বিজ্ঞানের ভিত্তি হতে পারে? পপারের দৃষ্টিভঙ্গিতে যেভাবে বিজ্ঞানের বিকাশ হয় সেটি পরিষ্কারভাবে এই সমস্যাটিকে এড়িয়ে যেতে পারে। এর কারণ তার মতে, বিজ্ঞান ইনডাকশনের উপর নির্ভর করেনা। বিজ্ঞানীরা একটি হাইপোথিসিস, বাস্তবতার কোনো প্রকৃতি নিয়ে তথ্যপুষ্ট একটি ধারণা দিয়ে শুরু করেন। একটি উদাহরণ হতে পারে, যেমন, ‘সব গ্যাসই সম্প্রসারিত হয় যখন উত্তপ্ত করা হয়’। এটি খুব সাধারণ একটি হাইপোথিসিস, কিন্তু এই পর্বে বাস্তব জীবনে বিজ্ঞানের সংশ্লিষ্ট অনেক পরিমাণসৃজনশীলতা আর কল্পনার সাথে। বিজ্ঞানীরা তাদের ধারণা খুঁজে পান নানা জায়গায়: রসায়নবিদ অগুস্ত কেকুলে, যেমন স্বপ্ন দেখেছিলেন একটি সাপ তার নিজের লেজে কামড় দিচ্ছে, যা তাঁকে ধারণা দিয়েছিল সেই হাইপোথিসিসটির যে, বেনজিনের অণু হচ্ছে হেক্সাগোনাল (ষড়ভুজ) রিঙের মতো, যে হাইপোথিসিসটি এখনও তার সত্যতা বজায় রেখেছে বিজ্ঞানীদের এটিকে ভুল প্রমাণ করার প্রচেষ্টার মুখে। এরপর বিজ্ঞানীরা একটি উপায় খুঁজে বের করেন সেই হাইপোথিসিসটি পরীক্ষা করে দেখার জন্যে এই ক্ষেত্রে, যেমন, বিভিন্ন ধরনের গ্যাস সংগ্রহ করে তাদের উত্তপ্ত করে দেখা। কিন্তু টেস্টিং বা পরীক্ষা করে দেখা মানে কিন্তু এই হাইপোথিসিসের সমর্থনে প্রমাণ খোঁজা নয়, এর মানে হচ্ছে প্রমাণ করা যে, প্রস্তাবনাটি মিথ্যা বা ভুল প্রতিপন্ন করার প্রচেষ্টার চ্যালেঞ্জের মুখেও এই হাইপোথিসিস টিকে থাকতে পারে। আদর্শ পরিস্থিতিতে বিজ্ঞানীরা সেই গ্যাস খুঁজে বের করার চেষ্টা করেন যা এই হাইপোথিসিসের সাথে খাপ খায় না। মনে করে দেখুন রাজহাঁসের ক্ষেত্রে একটিমাত্র কালো রাজহাঁসই যথেষ্ট সেই সাধারণীকরণকে মিথ্যা প্রমাণ করার জন্যে, সব রাজহাঁসই সাদা। একইভাবে এখানে একটিমাত্র গ্যাস লাগবে যা তাপ দিলে প্রসারিত হবে না, যা ‘সব গ্যাসই সম্প্রসারিত হয় যখন তাপ দেয়া হয়’ এই হাইপোথিসিসকে ভ্রান্ত প্রতিপন্ন করবে।

যদি কোনো বিজ্ঞানী একটি হাইপোথিসিসকে ভুল প্রমাণ করেন, মানে তিনি যদি দেখান যে এটি মিথ্যা, তাহলে সেই ফলাফলটি হচ্ছে নতুন একটুকরো জ্ঞান, সেই জ্ঞান যে হাইপোথিসিসটি ভুল। মানবতা অগ্রসর হয়, কারণ আমরা এখান থেকে নতুন কিছুশিখি। বহু গ্যাস লক্ষ্য করে, যাদের তাপ দিলে সম্প্রসারিত হয়, আমাদের কোনো জ্ঞান দেয় না, শুধুমাত্র হয়তোবা আমাদের হাইপোথিসিসের প্রতি খানিকটা আত্মবিশ্বাসের যোগান দেয়। কিন্তু একটি বিপরীত উদাহরণ আসলেই আমাদের কিছু-না-কিছু শেখায়। পপারের মতো কোনো একটি হাইপোথিসিসের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ বৈশিষ্ট্য এটি অবশ্যই falsifiable, বা যাকে মিথ্যা বা ভুল প্রমাণ করা যেতে পারে। তিনি এই ধারণাটি ব্যবহার করেছিলেন বিজ্ঞান ও যাকে তিনি বলতেন ছদ্মবিজ্ঞান, দুটির মধ্যে পার্থক্য করতে। একটি বৈজ্ঞানিক হাইপোথিসিস হচ্ছে এমনকিছু যা ভুল প্রমাণ করা যেতে পারে: এটি এমন ভবিষ্যদ্বাণী করে, যা দেখানো যেতে পারে ভুল। যদি আমি বলি, অদৃশ্য, অশনাক্তযোগ্য কোনো পরীরা আমাকে দিয়ে এই বাক্যটি টাইপ করাচ্ছে’, তাহলে এমন কোনো পর্যবেক্ষণ নেই যা আপনি করতে পারেন, যা আমার এই প্রস্তাবটিতে ভুল প্রমাণ করতে পারে। যদি পরীরা অদৃশ্য হয়, তারা কোনো চিহ্ন না রাখে, তাহলে কোনো উপায় নেই দেখানো যে তাদের অস্তিত্বের দাবিটি মিথ্যা। এটি মিথ্যা প্রমাণযোগ্য নয়, আর সেকারণে এটি কোনো বৈজ্ঞানিক প্রস্তাবনা হতে পারে পপার ভেবেছিলেন যে বহু প্রস্তাবনা উপস্থাপন করা হয়েছে সাইকোঅ্যানালাইসিস (মনোবিশ্লেষণ) সম্বন্ধে, যা অপ্রমাণযোগ্য এই প্রক্রিয়ায়। তিনি ভাবতেন এগুলো অপরীক্ষাযোগ্য। যেমন, কেউ যদি বলে যে সবাই প্ররোচিত হয় তাদের অবচেতন ইচ্ছাগুলো দ্বারা। তাহলে কোনো পরীক্ষা নেই সেটি যাচাই করে দেখার জন্যে। প্রতিটি টুকরো প্রমাণ, সেই মানুষগুলোসহ যারা অস্বীকার করছে যে তারা কোনো অবচেতন ইচ্ছা দ্বারা পরিচালিত নয়, সেটিও, পপারের মতে, ধরে নেয়া হয়েছে সাইকোঅ্যানালাইসিসের সত্যতার বাড়তি প্রমাণ হিসাবে। মনোবিশ্লেষকরা বলবেন,আপনি অবচেতনকে অস্বীকার করছেন সেই বাস্তব তথ্যটাই প্রমাণ করে যে আপনার একটি শক্তিশালী অবচেতন ইচ্ছা আছে আপনার বাবাকে চ্যালেঞ্জ করার জন্য। কিন্তু এই প্রস্তাবনাটি পরীক্ষা করা যাবে না, কারণ কোনো কল্পনাযোগ্য প্রমাণ নেই, যা দেখাতে পারে এটি মিথ্যা। পরিণতিতে, পপার দাবি করেন, সাইকোঅ্যানালাইসিস বিজ্ঞান নয়। বিজ্ঞান আমাদের যেভাবে জ্ঞান দেয় এটি সেভাবে কোনো জ্ঞান আমাদের দিতে পারেনা। পপার এভাবে মার্ক্সবাদী ইতিহাসকে আক্রমণ করেছিলেন, যুক্তি দিয়ে যে প্রতিটি সম্ভাব্য পরিণতিকে বিবেচনা করা হবে সেই দৃষ্টিভঙ্গির সমর্থনে, যে মানবতার ইতিহাস হচ্ছে শ্রেণিসংগ্রামের ইতিহাস। সুতরাং আবারো এটির ভিত্তি ভুল প্রমাণ করা সম্ভব নয় এমন একটি হাইপোথিসিস। এর ব্যতিক্রম, আলবার্ট আইনস্টাইনের তত্ত্ব যে সূর্য আলোকে আকর্ষণ করবে ভুল প্রমাণযোগ্য বা এটি ভুল প্রমাণ করা সম্ভব এমন একটি প্রস্তাবনা। ১৯১৯ সালে সূর্যগ্রহণের সময় তাদের আপাত অবস্থান লক্ষ্য করার প্রক্রিয়া এটি ভুল প্রমাণ করতে ব্যর্থ হয়। কিন্তু সেটি তা করতে পারত। নক্ষত্র থেকে আসা আলো সাধারণভাবে দৃশ্যমান নয়, কিন্তু সূর্যগ্রহণের কিছু কিছু দুর্লভ পরিস্থিতিতে বিজ্ঞানীরা তাদের অবস্থানগুলো দেখতে পেয়েছিলেন ঠিক সেখানে আইনস্টাইনের তত্ত্ব তাদের অবস্থান যেখানে পূর্বধারণা করেছিল। যদি তারা অন্য কোনো অবস্থানে আছে বলে মনে হতো তাহলে সেটি আইনস্টাইনের তত্ত্ব কীভাবে আলো খুব বেশি ভারী বস্তু দ্বারা আকৃষ্ট হয় সেটিকে ভুল প্রমাণ করত। পপার কিন্তু মনে করেননি যে এই পর্যবেক্ষণগুলো প্রমাণ করেছে আইনস্টাইনের তত্ত্বটি সত্য। কিন্তু তত্ত্বটির প্রমাণযোগ্যতা এবং বিজ্ঞানীরা যে তত্ত্ব ভুল সেটি প্রমাণ করতে পারেননি, এই বাস্তব তথ্যই এর পক্ষেই প্রমাণ জোগায়। আইনস্টাইন এমন ভবিষ্যদ্বাণী করেছেন যা ভুল হতে পারত, কিন্তু সেগুলো ভুল প্রমাণিত হয়নি।

বৈজ্ঞানিক পদ্ধতির প্রকৃতি সম্বন্ধে পপারের বিবরণটি বহু বিজ্ঞানী ও দার্শনিককে প্রভাবিত করেছিল। পিটার মেদাওয়ার, যিনি চিকিৎসাবিজ্ঞানে নোবেল পুরস্কার পেয়েছিলেন, বলেছিলেন, ‘আমি মনে করি কার্ল পপার বিজ্ঞানের ইতিহাসে অতুলনীয়ভাবেই শ্রেষ্ঠতম দার্শনিক।’ বিজ্ঞানীরা বিশেষভাবে তার সেই বিবরণটি পছন্দ করেছিলেন, যে তাদের কর্মকাণ্ড সৃজনশীল ও কল্পনাপ্রসূত। এছাড়াও তারা অনুভব করেছিলেন যে, পপার বুঝতে পেরেছিলেন কীভাবে তারা তাদের কাজ করেন। দার্শনিকরা খুবই আনন্দিত হয়েছিলেন যে যেভাবে আরোহ বা ইনডাকশনের কঠিন সমস্যাটিকে তিনি পাশ কাটাতে পেরেছিলেন। ১৯৬২ সালে, যদিও, আমেরিকার বিজ্ঞান ইতিহাসবিদ ও পদার্থবিদ থমাস কুন একটি বই প্রকাশ করেন The Structureof Scientific Revolutions, সেটি বিজ্ঞান কীভাবে অগ্রসর হয় সেই বিষয়ে অন্য একটি ধারণা প্রস্তাব করেছিল এবং এটি প্রস্তাব করেছিল যে পপার বিষয়টি ভুল বুঝেছেন। কুন বিশ্বাস করতেন যে পপার যথেষ্ট পরিমাণ নিবিড়ভাবে বিজ্ঞানের ইতিহাসকে লক্ষ্য করেননি। যদি তিনি সেটি সেভাবে দেখতেন তাহলে একটি বিশেষ প্যাটার্ন তিনি অবশ্যই লক্ষ করতেন। বেশিরভাগ সময় যাকে আমরা বলি normal science বা সাধারণ বিজ্ঞান, সেটি চলমান। বিজ্ঞানীরা একটি প্যারাডাইম বা স্বীকৃত কাঠামোর মধ্যেই তাদের কাজ করেন, যা সেই সময়ের বিজ্ঞানীরা সবাই অনুসরণ করেন। সুতরাং, যেমন, সূর্যের চারপাশে পৃথিবী আবর্তিত হচ্ছে সেটি মানুষ অনুধাবন করার আগেই, সেই সময়ে প্যারাডাইম ছিল, সূর্য পৃথিবীর চারপাশে আবর্তিত হচ্ছে। জ্যোতির্বিজ্ঞানীরা তাদের গবেষণা করেছেন এই কাঠামোর মধ্যে এবং তাদের কাছে ব্যাখ্যা থাকত, যদি কোনো প্রমাণ সেই কাঠামোতে ঠিকমতো খাপ না খেত। এই প্যারাডাইমের মধ্যে কাজ করেই, কোপার্নিকাসের মতো বিজ্ঞানী সেই ধারণায় উপনীত হয়েছিলেন যে, পৃথিবী সূর্যের চারিদিকে ঘোরে, তার এমন ধারণাকে ভাবা হবে তিনি তার গণনায় কোথাও-না-কোথাও ভুল করেছেন। কুনের মতে, এমন কোনো ফ্যাক্ট বা বাস্তব তথ্য নেই যা অপেক্ষা করছে আবিষ্কৃত হবার জন্য, বরং, ফ্রেমওয়ার্ক বা প্যারাডাইম অনেকাংশেই ঠিক করে যে আপনি কী নিয়ে ভাবতে পারেন।

পরিস্থিতি অন্যরকম হতে শুরু করে যখন, কুনের ভাষায় একটি paradigm shiftএর মতো পরিস্থিতি ঘটে। কোনো প্যারাডাইম শিফট হচ্ছে বোঝার একটি সম্পূর্ণ উপায় যখন পুরোপুরিভাবে উল্টে যায়বা আমূল পরিবর্তন হয়। এটি হতে পারে যখন বিজ্ঞানীরা এমন কিছু পান যা বিদ্যমান প্যারাডাইমের সাথে খাপ খায় না। যেমন, পর্যবেক্ষণগুলো সেই প্যারাডাইমের মধ্যে, যেমন পৃথিবীর চারপাশে সূর্য আবর্তিত হচ্ছে এমন ধারণার সাথে সামঞ্জস্যপূর্ণ হয়না। কিন্তু এমনকি তারপরও বহু সময় লাগে পুরোপুরিভাবে সেই চিন্তা করার পদ্ধতিটি পরিত্যাগ করার জন্য। বিজ্ঞানীরা, যারা তাদের সারাজীবন কাজ করেছেন কোনো একটি প্যারাডাইমের মধ্যে, কাজ করার জন্য তারা সাধারণত ভিন্ন কোনো দৃষ্টিভঙ্গিকে স্বাগত জানায় না। যখন তারা একসময় নতুন প্যারাডাইমে তাদের ভাবনা পরিবর্তন করেন, আবারো সাধারণ বিজ্ঞানের একটি পর্ব শুরু হতে পারে, এবার সেটি কাজ করে নতুন কাঠামোয়। আর এভাবে এটি চলতে থাকে। আর এটাই ঘটেছিল যখন মহাবিশ্বের কেন্দ্রে পৃথিবীর উপস্থিত সেই ধারণাটি উল্টে গিয়েছিল। একবার যখন মানুষ সৌরজগৎকে সেভাবে ভাবতে শুরু করেছে, সাধারণ বিজ্ঞান অনেককিছু করার পেয়েছে সূর্যের চারপাশে পৃথিবীর প্রদক্ষিণরত গ্রহগুলোর গতিপথ বোঝার জন্য।

পপার, বিস্ময়কর নয়, বিজ্ঞানের ইতিহাসের এই বিবরণের সাথে একমত হননি, যদিও তিনি স্বীকার করেছেন সাধারণ বিজ্ঞানের ধারণাটি বেশ উপযোগী। তিনি কি সেই বিজ্ঞানীর মতো যার কাছে পুরোনো হয়ে যাওয়া একটি প্যারাডাইম ছিল অথবা তিনি কুনের চেয়েও বাস্তবতা সংক্রান্ত কোনো সত্যের আরো কাছাকাছি পৌঁছাতে পেরেছিলেন, এটি বেশ কৌতূহলী প্রশ্ন।

সকল অধ্যায়

১. অধ্যায় ১ : যে মানুষটি প্রশ্ন করেছিলেন – সক্রেটিস এবং প্লেটো
২. অধ্যায় ২ : ইউডাইমোনিয়া – আরেকটু প্লেটো
৩. অধ্যায় ৩ : প্ৰকৃত সুখ – অ্যারিস্টোটল
৪. অধ্যায় ৪ : দার্শনিকদের থেকে সাবধান – ডায়োজেনিস ও প্রাচীন সিনিক দর্শন
৫. অধ্যায় ৫ : তাৎক্ষণিক সুখ – আরিস্টিপপাস ও সাইরেনাইক দর্শন
৬. অধ্যায় ৬ : আমরা কিছু জানিনা – পিরো এবং প্রাচীন সংশয়বাদী দর্শন
৭. অধ্যায় ৭ : বাগানের পথ – এপিকিউরাস
৮. অধ্যায় ৮ : স্টয়িসিজম, কোনোকিছু গ্রাহ্য না করার শিক্ষা – এপিকটিটাস, সিসেরো, সেনেকা
৯. অধ্যায় ৯ : কার হাতের পুতুল আমরা? – অগাস্টিন
১০. অধ্যায় ১০ : দর্শনের সান্ত্বনা – বোয়েথিয়াস
১১. অধ্যায় ১১ : ত্রুটিহীন একটি দ্বীপ – আনসেল্ম ও অ্যাকোয়াইনাস
১২. অধ্যায় ১২ : শিয়াল এবং সিংহ – নিকোলো মাকিয়াভেলি
১৩. অধ্যায় ১৩ : সাধারণের দর্শন – মিশেল দো মনতাইন
১৪. অধ্যায় ১৪ : নোংরা, পাশবিক এবং সংক্ষিপ্ত – থমাস হবস
১৫. অধ্যায় ১৫ : প্রবচনে দর্শন – ফ্রাঁসোয়া দ্য লা রোশফুকো
১৬. অধ্যায় ১৬ : আপনি স্বপ্ন দেখছেন না তো? – রেনে দেকার্ত
১৭. অধ্যায় ১৭ : বাজির দান রাখুন – ব্লেইজ পাসকাল
১৮. অধ্যায় ১৮ : কাঁচ ঘষে লেন্স যিনি বানাতেন – বারুখ স্পিনোজা
১৯. অধ্যায় ১৯ : রাজকুমার ও মুচি – জন লক ও টমাস রিড
২০. অধ্যায় ২০ : ঘরের মধ্যে হাতি – জর্জ বার্কলি (এবং জন লক)
২১. অধ্যায় ২১ : সম্ভাব্য সব পৃথিবীর সেরা? – ভলতেয়ার এবং গটফ্রিয়েড লাইবনিজ
২২. অধ্যায় ২২ : কাল্পনিক ঘড়িনির্মাতা – ডেভিড হিউম
২৩. অধ্যায় ২৩ : জন্মগতভাবে স্বাধীন – জ্যাঁ-জাক রুসো
২৪. অধ্যায় ২৪ : রঙিন চশমায় দেখা বাস্তবতা – ইমানুয়েল কান্ট
২৫. অধ্যায় ২৫ : প্রায়োগিক সুখ – জেরেমি বেনথাম
২৬. অধ্যায় ২৬ : মিনার্ভার পেঁচা – জর্জ ডাবলিউ. এফ. হেগেল
২৭. অধ্যায় ২৭ : বাস্তবতার ক্ষণিক দর্শন – আর্থার শোপেনহাউয়ার
২৮. অধ্যায় ২৮ : বেড়ে ওঠার জন্যে পরিসর – জন স্টুয়ার্ট মিল
২৯. অধ্যায় ২৯ : অবুদ্ধিমত্তাপূর্ণ ডিজাইন – চার্লস ডারউইন
৩০. অধ্যায় ৩০ : জীবনের বিসর্জন – সোরেন কিয়ের্কেগার্ড
৩১. অধ্যায় ৩১ : দুনিয়ার মজদুর এক হও – কার্ল মার্ক্স
৩২. অধ্যায় ৩২ : তাতে কী এসে যায়? – সি. এস. পার্স ও উইলিয়াম জেমস
৩৩. অধ্যায় ৩৩ : ঈশ্বরের মৃত্যু – ফ্রিয়েডরিখ নিচাহ
৩৪. অধ্যায় ৩৪ : ছদ্মবেশী চিন্তা – সিগমন্ড ফ্রয়েড
৩৫. অধ্যায় ৩৫ : ফ্রান্সের বর্তমান রাজার মাথায় কি টাক আছে? – বার্ট্রান্ড রাসেল
৩৬. অধ্যায় ৩৬ : বুহ!/ হুররে! – আলফ্রেড জুল (ফ্রেডি) আয়ার
৩৭. অধ্যায় ৩৭ : স্বাধীনতার যন্ত্রণা – জ্যাঁ-পল সার্ত্র, সিমোন দ্য বুভোয়া, আলবেয়ার্ট কামু
৩৮. অধ্যায় ৩৮ : সিসিফাসের সুখ – আলবেয়ার্ট কামু
৩৯. অধ্যায় ৩৯ : অস্তিত্ববাদের ধাত্রী – সিমোন দ্য বুভোয়া
৪০. অধ্যায় ৪০ : ভাষার সম্মোহন – লুদভিগ ভিটগেনস্টাইন
৪১. অধ্যায় ৪১ : মনের দর্শন – এডমন্ড হুসেরেল
৪২. অধ্যায় ৪২ : বেঁচে থাকার রহস্যময়তা – মার্টিন হাইডেগার
৪৩. অধ্যায় ৪৩ : বিষণ্ণতার রাজপুত্র – এমিল চিওরান
৪৪. অধ্যায় ৪৪ : ইতিহাসের ময়নাতদন্ত – মিশেল ফুকো
৪৫. অধ্যায় ৪৫ : যেমন মানুষটি কোনো প্রশ্ন জিজ্ঞাসা করেননি – হানা আরেন্ট
৪৬. অধ্যায় ৪৬ : নতুন করে দেখা – জ্যাক ডেরিডা
৪৭. অধ্যায় ৪৭ : ভুল থেকে শেখা – কার্ল পপার ও থমাস কুন
৪৮. অধ্যায় ৪৮ : লাগামহীন রেলগাড়ি আর অনাকাঙ্ক্ষিত ভায়োলিনবাদক – ফিলিপ্পা রুথ ফুট আর জুডিথ জার্ভিস থমসন
৪৯. অধ্যায় ৪৯ : অজ্ঞতার মাধ্যমে ন্যায়বিচার – জন রলজ
৫০. অধ্যায় ৫০ : কম্পিউটার কি চিন্তা করতে পারে? – অ্যালান ট্যুরিং এবং জন সার্ল
৫১. অধ্যায় ৫১ : একজন আধুনিক গোমাছি – পিটার সিংগার

নোট নিতে এবং টেক্সট হাইলাইট করতে লগইন করুন

লগইন