অধ্যায় ২ : ইউডাইমোনিয়া – আরেকটু প্লেটো

কাজী মাহবুব হাসান

অধ্যায় ২ : ইউডাইমোনিয়া – আরেকটু প্লেটো

প্রায় আড়াই হাজার বছর আগের এথেন্স। জমজমাট সেই শহরে বাস করতেন প্রায় আড়াই লক্ষ মানুষ। নাগরিকদের জন্য সেখানে ছিল চমৎকার উন্মুক্ত স্নানঘর, নাট্যমঞ্চ, উপাসনালয়, বিশাল আগোরা বা শহরের চত্বর, সারি বাঁধা বাজার, ব্যায়াম করার জিমনেশিয়াম। হ্যাঁ, কোনোকিছুরই অভাব ছিল না। শিল্পকলার নানা শাখাও সেখানে তখন উৎকর্ষ অভিমুখে, এমনকি বিজ্ঞানও। পিরাইয়াস বন্দর ছিল ভূমধ্যসাগরের অন্যতম সমুদ্রবন্দর, আর বছরের অর্ধেকের চেয়েও বেশি সময় আবহাওয়া যেখানে থাকত ঈর্ষণীয়ভাবে সহনীয়। এই শহরে বাস করতেন পৃথিবীর প্রথম সত্যিকারের—এবং অনেকের মতেই সম্ভবত শ্রেষ্ঠতম দার্শনিক, প্লেটো, পশ্চিমা দর্শনের উপর যার প্রভাবকে খাটো করে দেখা কারো পক্ষেই সম্ভব নয়। এই শহরেরই এক বিখ্যাত এবং বিত্তশালী পরিবারে জন্ম নিয়েছিলেন প্লেটো।

প্লেটো অবশ্য তাঁর জীবন উৎসর্গ করেছিলেন একটিমাত্র লক্ষ্য অর্জনে, বিশেষ একটি অবস্থা অর্জন করার জন্যে মানুষকে সাহায্য করতে। তিনি সেই অবস্থাটির নাম দিয়েছিলেন ইউডাইমোনিয়া (Eudaimonia)। ইউডাইমোনিয়া, এই অদ্ভুত গ্রিক শব্দটি অনুবাদ করা বেশ কঠিন। খুব সাধারণ অর্থে শব্দটি প্রায় happiness বা সুখ-এর কাছাকাছি কোনোকিছুকে বোঝায়, কিন্তু ভাবার্থে এর অর্থ ইংরেজি fulfilment শব্দটির বেশ নিকটবর্তী, যার বাংলা আমরা করতে পারি, ‘পূর্ণতা’ বা পরিপূর্ণতা’, এ-ধরনের কোনো শব্দ ব্যবহার করে। কারণ সুখ, সুখানুভবতা বা হ্যাপিনেস ইঙ্গিত দেয় নিরন্তর আনন্দ-অনুভব করার মত একটি অবস্থা, কিন্তু ‘পূর্ণতায়’ এমন কিছু পর্ব থাকে, যেখানে তীব্র কষ্ট আর যন্ত্রণার মধ্যে দিয়ে আমাদের অতিক্রম করতে হয়, প্লেটোর মতে একটি সার্থক সুন্দর জীবনে সেই অংশটি অপরিহার্য। বেশ, মানুষকে সেই পূর্ণতা পাবার ক্ষেত্রে সফল হবার লক্ষ্যে তাহলে প্লেটো কী প্রস্তাব করেছিলেন?

তাঁর কাজে আমরা চারটি মূল ধারণাকে প্রাধান্য পেতে দেখি :

এক. আরো অনেক গভীরভাবে আমাদের চিন্তা করা শিখতে হবে : প্লেটো প্রস্তাব করেছিলেন, আমাদের জীবনে সমস্যাগুলোর মূল কারণ হচ্ছে, প্রায় কখনোই আমরা যথেষ্ট পরিমাণ সতর্কতা আর যুক্তি ব্যবহার করে আমাদের পরিকল্পনাগুলো নিয়ে ভাবি না। এবং সে-কারণেই আমাদের ভাগ্যে জোটে ভুল মূল্যবোধ, ভুল পেশা এবং ভুল সম্পর্ক। প্লেটো চেয়েছিলেন আমাদের মনে শৃঙ্খলা আর সুস্পষ্টতা ফিরিয়ে আনতে। তিনি লক্ষ করেছিলেন আমাদের বহু ধারণার উৎস আসলে, ‘জনতা’, বা বলা যেতে পারে ‘অন্যরা’ কী ভাবছে সেটি; গ্রিকরা যা চিহ্নিত করেছিল ‘doxa’ শব্দটি দিয়ে, এবং ইংরেজিতে এর অর্থ আমরা করতে পারি common sense বা সাধারণ কাণ্ডজ্ঞান, তবে ভাবগতভাবে এর মানে হচ্ছে সাধারণত অন্য সবাই যা ভাবে সেটাই। কিন্তু তারপরও তাঁর লেখা ৩৬টি বইয়ে প্লেটো বহুবারই দেখিয়েছিলেন যে এই তথাকথিত সাধারণ ধারণা বা কাণ্ডজ্ঞানগুলো ভ্রান্তি, পূর্বসংস্কার আর কুসংস্কারে পূর্ণ। ভালোবাসা, খ্যাতি, অর্থ কিংবা সদ্গুণাবলি সংক্রান্ত লোকপ্রিয় ধারণাগুলো আসলেই যুক্তির চ্যালেঞ্জের মুখে দাঁড়াতে পারেনা। প্লেটো আরো লক্ষ করেছিলেন, সহজাত প্রবৃত্তি অথবা ভাবাবেগে (কোনো সিদ্ধান্তে ঝাঁপিয়ে পড়া শুধুমাত্র ‘আমরা যা অনুভব করেছি’ তার ভিত্তিতে) পরিচালিত হওয়া নিয়ে মানুষ নিজেদেরকে কত বেশি গর্বিত ভাবে, এবং তিনি সেটি তুলনা করেছিলেন চোখবাঁধা বন্য একদল ঘোড়াদের দ্বারা ভয়ংকরভাবে অনির্দিষ্ট কোনো দিকে টেনে হেঁচড়ে নিয়ে যাওয়ার সাথে। ফ্রয়েড যেমন খুব আনন্দের সাথে স্বীকার করে নিয়েছিলেন, প্লেটো ছিলেন মনোবিশ্লেষণের জনক, সব চিন্তা আর অনুভূতিকে যুক্তির নিরীক্ষায় সমর্পণ করার জন্যে যিনি গুরুত্বারোপ করেছিলেন। যেমন প্লেটো বারবার লিখেছিলেন, দর্শনের মূলসারটি মূলত সেই নির্দেশটি : Know yourself বা নিজেকে জানুন (বা খুব প্রাচীন এই গ্রিক প্রবাদটি গ্রিকরা যেভাবে উচ্চারণ করতেন, নথি সেঅটন)।

দুই. আরো বিচক্ষণতার সাথে আমাদের ভালোবাসতে হবে: মানবিক সম্পর্কগুলোকে তাত্ত্বিক ব্যাখ্যা করার ক্ষেত্রে প্লেটো ছিলেন অন্যতম সেরা দার্শনিকদের একজন। তাঁর Symposium বইটিতে ভালোবাসা আসলে কী তিনি সেটি বোঝাতে প্রচেষ্টা করেছিলেন। আর বিষয়টি বোঝাতে তিনি একটি গল্পের আশ্রয় নিয়েছিলেন, যেখানে আমরা সুদর্শন কবি আগাথনের আয়োজিত একটি নৈশভোজের দৃশ্য দেখি, এই নৈশভোজনে আগাথন তার কিছু বন্ধুকে নিমন্ত্ৰণ করেছিলেন খাওয়া, পান করা এবং ভালোবাসা সম্বন্ধে আলোচনা করার জন্যে। ভালোবাসা কী সে-বিষয়ে অতিথিদের দৃষ্টিভঙ্গিগুলো ছিল পরস্পর থেকে ভিন্ন ও বিচিত্র। প্লেটো সেখানে তাঁর পুরোনো বন্ধু ও শিক্ষক সক্রেটিসের বক্তব্যে, যিনি প্লেটোর প্রায় সব বইয়েরই প্রধান চরিত্রগুলোর একজন, সবচেয়ে উপযোগী আর কৌতূহলোদ্দীপক তত্ত্বটি উপস্থাপন করেছিলেন। তত্ত্বটি মোটামুটি এরকম : যখন আপনি কাউকে ভালোবাসবেন, তখন আসলেই যা ঘটে সেটি হচ্ছে, আপনি সেই মানুষটির মধ্যে ভালো কিছু গুণ লক্ষ করেন, যা আপনার মধ্যে অনুপস্থিত। হতে পারে তারা বেশ শান্ত প্রকৃতির, যখন কিনা আপনার মেজাজ সহজেই ক্ষিপ্ত হতে পারে, অথবা তাদের আত্মনিয়ন্ত্রণ হয়তো বেশি, যখন আপনার নিজের জীবনে কোনো শৃঙ্খলা নেই, অথবা তারা খুব সহজেই মনের ভাব প্রকাশ করতে পারে, আপনি হয়তো ভাবনার জড়তায় আক্রান্ত। ভালোবাসার অন্তর্নিহিত কল্পনাটি হচ্ছে যে, সেই মানুষটির সংস্পর্শে আসার মাধ্যমে আপনিও কিছুটা তার মতোই হয়ে উঠতে পারবেন। তারা আপনার পূর্ণ সম্ভাবনাকে বাস্তব করার ক্ষেত্রে সাহায্য করতে পারে।

প্লেটোর দৃষ্টিতে, ভালোবাসা মূলত একধরনের শিক্ষা: আপনি আসলেই কাউকে ভালোবাসতে পারবেন না, যদি আপনি তাদের দ্বারা নিজের কোনো উন্নতি সাধন করতে না চান। ভালোবাসা হওয়া উচিত দুটি মানুষের একসাথে বেড়ে ওঠার প্রচেষ্টা, আর এই বেড়ে ওঠার প্রক্রিয়ায় পরস্পরকে সহযোগিতা করার প্রক্রিয়া। তার মানে আপনার এমন কোনো মানুষের সংস্পর্শে আসা উচিত যে কিনা আপনার বিবর্তনের জন্য প্রয়োজন অনুপস্থিত অংশটি ধারণ করে; আপনার যে গুণটি নেই সেটি তারা ধারণ করে। আধুনিক সময়ের প্রেক্ষাপটে এই কথাগুলো শুনতে বেশ অদ্ভুত মনে হতে পারে, যখন আমরা ভালোবাসাকে ব্যাখ্যা করার চেষ্টা করি এমন কাউকে খুঁজে বের করা, যে কিনা ঠিক বর্তমানে যে অবস্থায় আছে সেটাই নিখুঁত। তর্কের সময় যেমন আমরা প্রায়শই প্রেমিকযুগলকে বলতে শুনি, ‘যদি তুমি আমাকে ভালোবাসতে, তাহলে আমাকে বদলাবার চেষ্টা করতে ন’। প্লেটো ঠিক একেবারে এর বিপরীতটাই ভাবতেন। তিনি আমাদের অনেক কম- মাত্রায় লড়াকু মনোভাব এবং অহংকার নিয়ে সম্পর্কে জড়াতে পরামর্শ দিয়েছিলেন। তার মানে আমাদের উচিত হবে মেনে নেয়া যে, আমরা আসলে সম্পূর্ণ নই, এবং ভালোবাসার মানুষদের সুযোগ দিতে হবে আমাদের কিছু শেখানোর জন্য। একটি ভালো সম্পর্কের অর্থ হতে হবে, আমরা সেই অন্য মানুষটিকে তারা ঠিক যেরকম, সেভাবেই ভালোবাসব না। এর অর্থ প্রতিজ্ঞাবদ্ধ হওয়া যে আমরা তাদেরই সেরা সংস্করণে রূপান্তরিত হবার প্রচেষ্টায় সহযোগিতা করব। এছাড়া ঝোড়ো আর বিপদসংকুল যাত্রাপথ, যা এর অনিবার্য অংশ, সেটিও সহ্য করার প্রতিজ্ঞা করতে হবে; একই সাথে আমাদের নিজেদের উন্নয়নের পথে তাদের কোনো প্রচেষ্টাকে প্রতিরোধ করা থেকে বিরত থাকতে হবে।

তিন. সৌন্দর্যের গুরুত্ব : আমরা সবাই সুন্দর যে-কোনো কিছুই পছন্দ করি। কিন্তু আমাদের উপর সুন্দর কোনোকিছুর প্রভাব বিস্তার করার ক্ষমতায় তারা খানিকটা রহস্যময়। আমরা যদি সবকিছুর সাথে তুলনামূলক বিচার করি তাহলে সৌন্দর্য জীবনধারণের জন্য খুব বেশি গুরুত্বপূর্ণ কিছু নয়, এমন কিছু ভাবার প্রবণতা আছে আমাদের। কিন্তু প্লেটো প্রস্তাব করেছিলেন, আপনার চারপাশে কী ধরনের ঘরবাড়ি, বা মন্দির, কিংবা পাত্র অথবা ভাস্কর্য আছে সেটি অবশ্যই গুরুত্বপূর্ণ। আর প্লেটোর আগে কেউই এই গুরুত্বপূর্ণ প্রশ্নটি জিজ্ঞাসা করেননি: কেন আমরা সুন্দর জিনিস পছন্দ করি? তিনি এই প্রশ্নটির একটি মনোমুগ্ধকর কারণও খুঁজে বের করেছিলেন বলে দাবি করেছিলেন: আমরা সৌন্দর্যকে চিহ্নিত করি ‘ভালো’ বা ‘শুভ’ কোনোকিছুর অংশ হিসাবে। আমরা অনেক ভালোকিছু হবার ইচ্ছা পোষণ করি: দয়ালু, নম্র, ভদ্র, ভারসাম্যময়, বৈরিতামুক্ত, শান্তিপূর্ণ, শক্তিশালী, মর্যাদাপূর্ণ, আর এগুলো হচ্ছে মানুষের মধ্যে বিদ্যমান গুণাবলি। তবে এই গুণগুলো কোনো বস্তুরও হতে পারে। আমরা আবেগাক্রান্ত এবং উদ্বেলিত হই যখন এইসব গুণাবলি কোনো জিনিসের মধ্যে খুঁজে পাই যা আমাদের জীবনে অনুপস্থিত। একারণেই আমাদের জীবনে প্রতিটি সুন্দর জিনিসেরই সত্যিকারের গুরুত্বপূর্ণ কিছু কাজ আছে। তারা আমাদের আমন্ত্রণ জানায় তাদের অভিমুখে বিবর্তিত হবার জন্য, তাদের মতো রূপান্তরিত হয়ে ওঠার জন্য। সৌন্দর্য আমাদের অন্তর্গত সত্তাকে শিক্ষা দিতে পারে।

এই বিষয়টি আরো একটি দিকে আমাদের মনোযোগ আকর্ষণ করে, কুৎসিত বা কদর্যতাও গুরুত্বপূর্ণ একটি ব্যাপার। কারণ এটি আমাদের সামনে ক্ষতিকর আর নষ্ট হয়ে যাওয়া বৈশিষ্ট্যগুলো প্রদর্শন করে। এটি আমাদের তাদের মতো হবার জন্য প্ররোচিত করে: কঠোর, বিশৃঙ্খল, শিষ্টাচারহীন। এটি দয়ালু, নম্র আর শান্তিপ্রিয় হবার পথটিকে যথেষ্ট অমসৃণ করে তোলে। প্লেটো শিল্পকলাকে দেখেছিলেন থেরাপিউটিক বা নিরাময় করতে সক্ষম এমন কোনো উপায় হিসাবে: কবি ও শিল্পীদের (বর্তমানে ঔপন্যাসিক, টেলিভিশন প্রযোজক, ডিজাইনাররা) কর্তব্য হচ্ছে সুন্দর জীবন কাটানোর জন্য আমাদের সাহায্য করা। কিন্তু শিল্পকলায় সেন্সরশিপ বা বিধিনিষেধ আরোপে বিশ্বাস করতেন প্লেটো। আপাতদৃষ্টিতে বিষয়টি স্ববিরোধী মনে হতে পারে। কিন্তু অপেক্ষা করুন, তিনি আসলে কী বলতে চেয়েছিলেন? বেশ, তাঁর মতে, যদিও শিল্পীরা আমাদের সুন্দরভাবে বাঁচতে সাহায্য করতে পারে, দুর্ভাগ্যজনকভাবে, তারা কিন্তু একইভাবে, সহায়ক নয় এমন দৃষ্টিভঙ্গি আর ক্ষতিকর ধারণাগুলোকেও মর্যাদাপূর্ণ করে উপস্থাপনও করতে পারে। শুধুমাত্র শিল্পী হওয়াটাই নিশ্চিত করেনা যে তারা শিল্পকলার ক্ষমতা ব্যবহারের ক্ষেত্রে বিজ্ঞতার পরিচয় দেবে। আর সে-কারণেই প্লেটো বিশ্বাস করতেন, শিল্পীদের কাজ করা উচিত দার্শনিকদের নির্দেশাধীন হয়ে, যারা তাদের সঠিক ধারণা দেবেন ও নির্দেশ দেবেন, যেন তারা সেই ধারণাগুলোকে বিশ্বাসযোগ্য এবং জনপ্রিয় করে উপস্থাপন করে। শিল্পকলা সেই অর্থে হবে ভালোকিছুর জন্যে একধরনের প্রোপাগান্ডা বা প্রচারণা অথবা বিজ্ঞাপন।

চার. সমাজ পরিবর্তন : একটি সরকার বা সমাজের আদর্শরূপ কী হওয়া উচিত সে বিষয়টি নিয়ে প্লেটো অনেক সময় নিয়ে ভেবেছিলেন। তিনিই পৃথিবীর প্রথম ‘ইউটোপিয়া’র ভাবনা ভাবা দার্শনিক। এই ক্ষেত্রে, তিনি অনুপ্রাণিত হয়েছিলেন এথেন্সের সবচেয়ে বড় প্রতিদ্বন্দ্বী আরেকটি গ্রিক রাষ্ট্র, স্পার্টাকে দেখে। স্পার্টা ছিল শহরাকৃতির একটি বিশাল যন্ত্রের মতো, যার উৎপাদিত পণ্য ছিল সাহসী সৈনিক। স্পার্টাবাসীরা যা-কিছু করত, যেভাবে তারা তাদের সন্তানদের প্রতিপালন করত, যেভাবে তাদের অর্থনীতি সংগঠিত ছিল, যাদের তারা শ্রদ্ধা করত, যেভাবে তারা শারীরিক মিলন করত, তারা যা-কিছু খাদ্য হিসাবে গ্রহণ করত, সবকিছুই পরিকল্পিত ছিল শুধুমাত্র এই একটি উদ্দেশ্য পূরণে। এবং সামরিক দৃষ্টিভঙ্গি দিয়ে বিচার করলে স্পার্টা বিস্ময়করভাবে সফল ছিল। কিন্তু প্লেটো সেটা নিয়ে চিন্তিত ছিলেন না, তিনি জানতে চেয়েছিলেন, কীভাবে একটি সমাজ উন্নত হতে পারে, তবে সামরিক শক্তি সৃষ্টির মাধ্যমে নয় বরং এর নাগরিকদের জন্য ইউডাইমোনিয়া বা পরিপূর্ণতা সৃষ্টি করার ক্ষেত্রে? কীভাবে একটি রাষ্ট্র নির্ভরযোগ্য উপায়ে এর নাগরিককে সাহায্য করতে পারে পরিপূর্ণ একটি জীবন অর্জনের জন্য? তাঁর বিখ্যাত ‘দ্য রিপাবলিক’ বইটিতে প্লেটো কিছু বিষয় শনাক্ত করেছিলেন, তাঁর মতে এমন কোনো রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা করার জন্য এই বিষয়গুলো পরিবর্তন করা উচিত :

প্রথমত, অনুকরণযোগ্য নতুন বীরের প্রয়োজন: এথেন্সের সমাজের মূল লক্ষ্য ছিল সম্পদ অর্জন করে বিত্তশালী হবার প্রচেষ্টা করা, যেমন কুখ্যাত বিত্তবান অভিজাত আলসিবিয়াডেস, কিংবা ক্রীড়াক্ষেত্রে সুপরিচিত কোনো খেলোয়াড়, যেমন মাইলো অব ক্রোটোন। প্লেটো অবশ্য এসব পছন্দ করতেন না। কারণ তিনি বিশ্বাস করতেন আমরা কাকে শ্রদ্ধা করব বিস্ময় বিমুগ্ধতার সাথে, সেটি নিয়ে ভাবনার প্রয়োজন আছে। কারণ বিখ্যাত এইসব ‘সেলিব্রিটিরা’ আমাদের দৃষ্টিভঙ্গি, ধারণা এবং আচরণকে প্রভাবিত করে, আর খারাপ অনুকরণীয় চরিত্র বা হিরোরা চরিত্রের দুর্বলতাকে মোহনীয় কোনো বৈশিষ্ট্য হিসাবে উপস্থাপন করে। সে-কারণে প্লেটো চেয়েছিলেন এথেন্সকে নতুন ধরনের সেলিব্রিটি দেবার জন্য, যারা বিদ্যমান তথাকথিত সেলিব্রিটিদের প্রতিস্থাপিত করবে আদর্শগতভাবে বিজ্ঞ এবং ভালো মানুষদের দ্বারা, যাদের তিনি নাম দিয়েছিলেন ‘গার্ডিয়ান’ বা অভিভাবক : যারা চরিত্রগতভাবে কীভাবে সুবিকশিত হতে হয়, সেই বিষয়ে সবার জন্যে অনুকরণীয় মডেল হবেন। জনকল্যাণে অবদান, নম্রতা, সুআচরণ, ভালো অভ্যাস, সব ধরনের খ্যাতি ও বিখ্যাত হবার মোহের প্রতি বিতৃষ্ণা, বিস্তৃত প্রজ্ঞা আর গভীর অভিজ্ঞতা দ্বারা তারা বিশেষায়িত হবেন। সমাজে তারাই হবেন সবচেয়ে শ্রদ্ধেয় আর সম্মানিত ব্যক্তি।

দ্বিতীয়ত, বিধিনিষেধেরও প্রয়োজন আছে আমাদের : বর্তমানে সেন্সরশিপের কথা শুনলে আমরা চিন্তিত হয়ে পড়ি। কিন্তু প্লেটো চিন্তিত ছিলেন ভুল ধরনের স্বাধীনতার প্রভাব নিয়ে। সেই সময়ে এথেন্স ছিল এমনকি সবচেয়ে খারাপতম ধারণা প্রচারণার ক্ষেত্রেও সবার জন্যে উন্মুক্ত একটি জায়গা। উন্মত্ত ধর্মীয় ধারণা, শুনতে ভালো লাগে অথচ ভয়ংকর সব ধারণা শুষে নিয়েছিল জনগণের উৎসাহ এবং যার পরিণতিতে এথেন্সবাসীদের সহ্য করতে হয়েছে ব্যর্থ সরকারব্যবস্থা এবং কুপ্ররোচনায় বিপথগামী হয়ে যুদ্ধের মুখোমুখি হতে (যেমন স্পার্টার উপর সর্বনাশা আক্রমণ)। প্লেটো বিশ্বাস করতেন নিরন্তরভাবে সংশয়াচ্ছন্ন উচ্চকণ্ঠের বিশৃঙ্খলা আসলেই এথেন্সবাসীদের জন্য মঙ্গলজনক নয়, সুতরাং তিনি এইসব রাজনৈতিক বক্তাদের এবং বিপদজ্জনক ধর্মপ্রচারকদের কর্মকাণ্ডগুলো নিয়ন্ত্রণ করার পক্ষপাতী ছিলেন। আজকের যুগের গণমাধ্যমের শক্তি নিয়ে কোনো সন্দেহ নেই প্লেটো খুব বেশি সংশয়গ্রস্থ হয়ে পড়তেন।

তৃতীয়ত, সুশিক্ষার ব্যবস্থা করা : প্লেটো শিক্ষাব্যবস্থা উন্নত করার ব্যাপারে তীব্র উৎসাহী ছিলেন, কিন্তু তাঁর মূল লক্ষ্য ছিল পাঠ্যসূচির উপর বিশেষভাবে নজর দেয়া। শুধুমাত্র গণিত বা বানান শিক্ষা নয়, কীভাবে আরো ভালো মানুষ হওয়া যায় শিক্ষার্থীদের আমাদের সেটা শেখানো প্রয়োজন: সাহস, আত্মনিয়ন্ত্রণ, যৌক্তিকতা, স্বাধীনতা, আত্মনির্ভরশীলতা ও সুস্থির মেজাজ কীভাবে অর্জন করা যায় সেই সবকিছুও শেখা প্রয়োজন। তার এই ধারণাটিকে বাস্তবে রূপ দেবার জন্য প্লেটো একটি স্কুল প্রতিষ্ঠা করেছিলেন এথেন্সে, ‘দি একাডেমি’। প্ৰায় ৪০০ বছর ধরে যে প্রতিষ্ঠানটি সফলতার সাথে টিকে ছিল। কীভাবে বাঁচতে হয় আর ভালোভাবে মরতে হয় শুধুমাত্র সেটা শেখার জন্যেও সেখানে জড়ো হতো শিক্ষার্থীরা। বিস্ময়কর এবং খানিকটা দুঃখজনক যে কীভাবে বর্তমানের আধুনিক শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলো এই উচ্চাকাঙ্ক্ষাগুলোকে নিষিদ্ধ ঘোষণা করেছে। এখন যদি কোনো ছাত্র অক্সফোর্ড কিংবা হার্ভার্ড বিশ্ববিদ্যালয়ে গিয়ে হাজির হয় কীভাবে বাঁচতে হবে সেটা শেখার আকাঙ্ক্ষা নিয়ে, অধ্যাপকরা পুলিশ ডাকবেন অথবা তার জায়গা হয়ে মানসিক রোগীদের আশ্রমে।

চতুর্থত, উত্তম শৈশব : যদিও অনেক পরিবার সর্বোচ্চ চেষ্টা করে, আর কখনো কখনো শিশুরা ভাগ্যবানও হয় ভালো পরিবার পাবার ক্ষেত্রে, যাদের পিতামাতা সুস্থির ভারসাম্যময় ভালো শিক্ষক, যারা সত্যিকারভাবে বিজ্ঞ এবং নির্ভরযোগ্যভাবেই প্রাপ্তবয়স্ক, কিন্তু বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই পিতামাতারা তাদের সব সংশয় আর ব্যর্থতা সংক্রমিত করেন তাদের সন্তানদের মধ্যে। প্লেটো মনে করতেন শিশুদের সঠিকভাবে প্রতিপালন করার কাজটি হচ্ছে সবচেয়ে কঠিনতম (এবং সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ) দক্ষতাগুলোর একটি। প্লেটো তীব্রভাবে সমব্যথী ছিলেন সেইসব শিশুদের প্রতি যাদের পারিবারিক পরিবেশ তাদের পূর্ণবিকাশের প্রতি বৈরী। সুতরাং তিনি প্রস্তাব করেছিলেন বহু শিশুর জন্য বাস্তবিকভাবে অনেক উত্তম হবে যদি জীবনের প্রতি দৃষ্টিভঙ্গিগুলো তারা তাদের পিতামাতা থেকে গ্ৰহণ না করে বরং কোনো বিজ্ঞ অভিভাবকের কাছ থেকে গ্রহণ করে, যে অভিভাবকদের রাষ্ট্র আর্থিকভাবে পৃষ্ঠপোষকতা করবে সেই কাজটি করার জন্য। তিনি প্রস্তাব করেছিলেন পরবর্তী প্রজন্মের একটি উল্লেখযোগ্য অংশকে প্রতিপালন করবে এমন অভিভাবকরা যারা তাদের নিজেদের পিতামাতা থেকে অনেক বেশি যোগ্য।

প্লেটো আর সক্রেটিস, দুজনকে নিয়েই প্রায়শই সংশয়াচ্ছন্ন হতে দেখা যায়। সক্রেটিস ছিলেন প্লেটোর বন্ধু ও শিক্ষক, যার কাছ থেকে প্লেটো অনেককিছুই শিখেছিলেন। সক্রেটিস কোনোকিছু লিখে যাননি, তবে প্লেটো প্রচুর বই লিখে গেছেন, যাদের প্রায় প্রত্যেকটিতে অন্যতম প্রধান একটি চরিত্র সক্রেটিস। প্লেটো ধারণাগুলো এখনও গভীরভাবে উদ্দীপক এবং আকর্ষণীয়। সেই ধারণাগুলোকে একীভূত করে তাদের আদর্শবাদিতা আর উচ্চাকাঙ্ক্ষা। তিনি চেয়েছিলেন দর্শন আমাদের সাহায্য করবে পৃথিবীকে পরিবর্তন করতে। তার এই উদাহরণের দ্বারা অনুপ্রাণিত হওয়া আমাদেরও উচিত হবে।

সকল অধ্যায়

১. অধ্যায় ১ : যে মানুষটি প্রশ্ন করেছিলেন – সক্রেটিস এবং প্লেটো
২. অধ্যায় ২ : ইউডাইমোনিয়া – আরেকটু প্লেটো
৩. অধ্যায় ৩ : প্ৰকৃত সুখ – অ্যারিস্টোটল
৪. অধ্যায় ৪ : দার্শনিকদের থেকে সাবধান – ডায়োজেনিস ও প্রাচীন সিনিক দর্শন
৫. অধ্যায় ৫ : তাৎক্ষণিক সুখ – আরিস্টিপপাস ও সাইরেনাইক দর্শন
৬. অধ্যায় ৬ : আমরা কিছু জানিনা – পিরো এবং প্রাচীন সংশয়বাদী দর্শন
৭. অধ্যায় ৭ : বাগানের পথ – এপিকিউরাস
৮. অধ্যায় ৮ : স্টয়িসিজম, কোনোকিছু গ্রাহ্য না করার শিক্ষা – এপিকটিটাস, সিসেরো, সেনেকা
৯. অধ্যায় ৯ : কার হাতের পুতুল আমরা? – অগাস্টিন
১০. অধ্যায় ১০ : দর্শনের সান্ত্বনা – বোয়েথিয়াস
১১. অধ্যায় ১১ : ত্রুটিহীন একটি দ্বীপ – আনসেল্ম ও অ্যাকোয়াইনাস
১২. অধ্যায় ১২ : শিয়াল এবং সিংহ – নিকোলো মাকিয়াভেলি
১৩. অধ্যায় ১৩ : সাধারণের দর্শন – মিশেল দো মনতাইন
১৪. অধ্যায় ১৪ : নোংরা, পাশবিক এবং সংক্ষিপ্ত – থমাস হবস
১৫. অধ্যায় ১৫ : প্রবচনে দর্শন – ফ্রাঁসোয়া দ্য লা রোশফুকো
১৬. অধ্যায় ১৬ : আপনি স্বপ্ন দেখছেন না তো? – রেনে দেকার্ত
১৭. অধ্যায় ১৭ : বাজির দান রাখুন – ব্লেইজ পাসকাল
১৮. অধ্যায় ১৮ : কাঁচ ঘষে লেন্স যিনি বানাতেন – বারুখ স্পিনোজা
১৯. অধ্যায় ১৯ : রাজকুমার ও মুচি – জন লক ও টমাস রিড
২০. অধ্যায় ২০ : ঘরের মধ্যে হাতি – জর্জ বার্কলি (এবং জন লক)
২১. অধ্যায় ২১ : সম্ভাব্য সব পৃথিবীর সেরা? – ভলতেয়ার এবং গটফ্রিয়েড লাইবনিজ
২২. অধ্যায় ২২ : কাল্পনিক ঘড়িনির্মাতা – ডেভিড হিউম
২৩. অধ্যায় ২৩ : জন্মগতভাবে স্বাধীন – জ্যাঁ-জাক রুসো
২৪. অধ্যায় ২৪ : রঙিন চশমায় দেখা বাস্তবতা – ইমানুয়েল কান্ট
২৫. অধ্যায় ২৫ : প্রায়োগিক সুখ – জেরেমি বেনথাম
২৬. অধ্যায় ২৬ : মিনার্ভার পেঁচা – জর্জ ডাবলিউ. এফ. হেগেল
২৭. অধ্যায় ২৭ : বাস্তবতার ক্ষণিক দর্শন – আর্থার শোপেনহাউয়ার
২৮. অধ্যায় ২৮ : বেড়ে ওঠার জন্যে পরিসর – জন স্টুয়ার্ট মিল
২৯. অধ্যায় ২৯ : অবুদ্ধিমত্তাপূর্ণ ডিজাইন – চার্লস ডারউইন
৩০. অধ্যায় ৩০ : জীবনের বিসর্জন – সোরেন কিয়ের্কেগার্ড
৩১. অধ্যায় ৩১ : দুনিয়ার মজদুর এক হও – কার্ল মার্ক্স
৩২. অধ্যায় ৩২ : তাতে কী এসে যায়? – সি. এস. পার্স ও উইলিয়াম জেমস
৩৩. অধ্যায় ৩৩ : ঈশ্বরের মৃত্যু – ফ্রিয়েডরিখ নিচাহ
৩৪. অধ্যায় ৩৪ : ছদ্মবেশী চিন্তা – সিগমন্ড ফ্রয়েড
৩৫. অধ্যায় ৩৫ : ফ্রান্সের বর্তমান রাজার মাথায় কি টাক আছে? – বার্ট্রান্ড রাসেল
৩৬. অধ্যায় ৩৬ : বুহ!/ হুররে! – আলফ্রেড জুল (ফ্রেডি) আয়ার
৩৭. অধ্যায় ৩৭ : স্বাধীনতার যন্ত্রণা – জ্যাঁ-পল সার্ত্র, সিমোন দ্য বুভোয়া, আলবেয়ার্ট কামু
৩৮. অধ্যায় ৩৮ : সিসিফাসের সুখ – আলবেয়ার্ট কামু
৩৯. অধ্যায় ৩৯ : অস্তিত্ববাদের ধাত্রী – সিমোন দ্য বুভোয়া
৪০. অধ্যায় ৪০ : ভাষার সম্মোহন – লুদভিগ ভিটগেনস্টাইন
৪১. অধ্যায় ৪১ : মনের দর্শন – এডমন্ড হুসেরেল
৪২. অধ্যায় ৪২ : বেঁচে থাকার রহস্যময়তা – মার্টিন হাইডেগার
৪৩. অধ্যায় ৪৩ : বিষণ্ণতার রাজপুত্র – এমিল চিওরান
৪৪. অধ্যায় ৪৪ : ইতিহাসের ময়নাতদন্ত – মিশেল ফুকো
৪৫. অধ্যায় ৪৫ : যেমন মানুষটি কোনো প্রশ্ন জিজ্ঞাসা করেননি – হানা আরেন্ট
৪৬. অধ্যায় ৪৬ : নতুন করে দেখা – জ্যাক ডেরিডা
৪৭. অধ্যায় ৪৭ : ভুল থেকে শেখা – কার্ল পপার ও থমাস কুন
৪৮. অধ্যায় ৪৮ : লাগামহীন রেলগাড়ি আর অনাকাঙ্ক্ষিত ভায়োলিনবাদক – ফিলিপ্পা রুথ ফুট আর জুডিথ জার্ভিস থমসন
৪৯. অধ্যায় ৪৯ : অজ্ঞতার মাধ্যমে ন্যায়বিচার – জন রলজ
৫০. অধ্যায় ৫০ : কম্পিউটার কি চিন্তা করতে পারে? – অ্যালান ট্যুরিং এবং জন সার্ল
৫১. অধ্যায় ৫১ : একজন আধুনিক গোমাছি – পিটার সিংগার

নোট নিতে এবং টেক্সট হাইলাইট করতে লগইন করুন

লগইন