অধ্যায় ৬ : আমরা কিছু জানিনা – পিরো এবং প্রাচীন সংশয়বাদী দর্শন

কাজী মাহবুব হাসান

অধ্যায় ৬ : আমরা কিছু জানিনা – পিরো এবং প্রাচীন সংশয়বাদী দর্শন

কেউই কোনোকিছু জানেন না এবং এমনকি এই কথাটিও নিশ্চিত করে বলা সম্ভব না। আপনি যা সত্য বলে বিশ্বাস করেন, তার উপর ভরসা করা উচিত না। আপনি হয়তো ভুল প্রমাণিত হতে পারেন। সবকিছুকেই প্রশ্ন করা যেতে পারে, সবকিছুকেই সন্দেহ করা যেতে পারে, সুতরাং সবচেয়ে সেরা উপায়টি হচ্ছে, নিজের মনটাকে সবসময় উন্মুক্ত রাখা। কোনো ব্যাপারেই অপরিবর্তনযোগ্য কোনো সিদ্ধান্ত নেবেন না, তাহলে আপনি হতাশও হবেন না। এটাই প্রাচীন ‘স্কেপটিসিজম’ বা সংশয়বাদের মূল শিক্ষা। প্রাচীন সংশয়বাদ দর্শনটি কয়েক শতাব্দী ধরেই বেশ জনপ্রিয় ছিল প্রাচীন গ্রিসে, পরে রোমে। প্লেটো এবং অ্যারিস্টোটলের ব্যতিক্রম, বেশির ভাগ চূড়ান্ত মাত্রার সংশয়বাদীরা কোনো বিষয়ে, সেটি যাই হোক না কেন, কোনো ধরনের স্থির বা নিশ্চিত বা অপরিবর্তনযোগ্য কোনো ধারণ করা মত যে- কোনো অবস্থান এড়িয়ে যাওয়াই সমীচীন মনে করতেন। প্রাচীন গ্রিক দার্শনিক পিরো (৩৬৫-২৭০ খ্রিস্টপূর্বাব্দ) ছিলেন সবচেয়ে বিখ্যাত এবং সম্ভবত সকল সময়ের সেরা সংশয়বাদী। খুব নিশ্চিতভাবেই তাঁর জীবনটাও বেশ অদ্ভুত ছিল।

আপনি হয়তো বিশ্বাস করতে পারেন যে অনেককিছুই আপনি জানেন। আপনি জানেন এই মুহূর্তে এই বইটি আপনি পড়ছেন। কিন্তু সংশয়বাদীরা আপনার এই নিশ্চিত-জানা বিষয়টিকে বা জ্ঞানটিকে চ্যালেঞ্জ করে। একটু চিন্তা করে দেখুন, কেন আপনি বিশ্বাস করছেন যে, আপনি আসলে এই শব্দগুলো পড়ছেন এবং কেন মনে হচ্ছে না যে, আপনি শুধুমাত্র কল্পনা করছেন যে আপনি এটা পড়ছেন? আপনি কি নিশ্চিত হতে পারেন যে আপনি সঠিক? আপাতদৃষ্টিতে মনে হচ্ছে আপনি পড়ছেন, আপনার কাছে এটা ঠিক সেভাবেই অনুভূত হচ্ছে। কিন্তু হতে পারে পুরো ব্যাপারটি একটি ঘোর বা হ্যালুসিনেশন বা যা ঘটছে না অথচ আপনি তাই দেখছেন বা কোনো স্বপ্ন দেখছেন (এবং এটা একটি ধারণা যা রেনে দেকার্ত ব্যাখ্যা করেছিলেন আরো আঠারোশত বছর পরে, পরের কোনো পর্বে আমরা তাঁর কথা জানব)। সক্রেটিসের জোরালো দাবি যে আসলেই তিনি যা জানেন সেটি হচ্ছে তিনি খুব সামান্য জানেন, এটিও সংশয়বাদী একটি অবস্থান। কিন্তু পিরো এই ধারণাটি এগিয়ে নিয়ে গিয়েছিলেন আরো অনেকটা অগ্রসর পর্যায়ে। হয়তো একটু বেশিই সামনে।

যদি তাঁর জীবন সম্বন্ধে বর্ণিত সব তথ্য আমরা বিশ্বাস করি (এবং হয়তো সেই বিষয়েও আমাদেরও সংশয়বাদী হওয়া দরকার), দার্শনিক পিরো, যা-কিছু আমরা দেখি, জানি বা বুঝি তা কোনো প্রশ্ন ছাড়াই মেনে না-নেওয়াটাকেই জীবনের ধর্ম হিসাবে বেছে নিয়েছিলেন। আর সক্রেটিসের মতোই, কোনোকিছুই তিনি লিখে যাননি। সুতরাং তার সম্বন্ধে আমরা যা জানি সেটি এসেছে অন্য মানুষদের কাছ থেকে, যারা তার কথা লিপিবদ্ধ করে গেছেন, মূলত তাঁর মৃত্যুর বেশ কয়েক শতাব্দী পর। তাদের একজন, ডায়োজেনিস লেইআরশিয়াস, যেমন আমাদের বলেছিলেন, পিরো সেই সময় তারকাখ্যাতি অর্জন করতে পেরেছিলেন এবং এলিস, যে শহরে তিনি বসবাস করতেন, তার প্রধান পুরোহিত হিসাবেও নিয়োগ পেয়েছিলেন এবং তার সম্মানে সেখানে দার্শনিকদের কোনো কর দিতে হতো না। কথাটি সত্যি কিনা তা যাচাই করে দেখার কোনো উপায় নেই, যদিও দার্শনিকদের কর না-দেবার নিয়মটি মন্দ না। আমরা যতদূর বলতে পারি, যদিও, পিরো, তাঁর সংশয়বাদ নিয়ে বেশ অসাধারণ একটি জীবন কাটিয়েছিলেন। পৃথিবীতে তাঁর বেঁচে থাকার মেয়াদ খুবই সংক্ষিপ্ত হতো, যদি তাঁকে প্রায় সর্বক্ষণ রক্ষা করার জন্য বেশকিছু প্রভাবশালী বন্ধু নাথাকত। দীর্ঘ সময় বেঁচে থাকবার জন্য একজন চূড়ান্ত সংশয়বাদী মানুষের প্রয়োজন অপেক্ষাকৃত কম-সংশয়বাদী মানুষদের সহায়তা অথবা খুব বেশি পরিমাণে সৌভাগ্য।

জীবনের প্রতি তাঁর দৃষ্টিভঙ্গি ছিল সংক্ষেপে এরকম : আমরা পুরোপুরিভাবে আমাদের ইন্দ্রিয়গুলোকে বিশ্বাস করতে পারি না। কখনো কখনো তারা আমাদের বিভ্রান্ত করে। যেমন, অন্ধকারে আপনি কী দেখতে পারছেন, সে-বিষয়ে খুব সহজেই আপনি ভুল করতে পারেন। যা দেখতে শিয়ালের মতো মনে হলেও হতে পারে সেটি শুধুমাত্র একটি বিড়াল। অথবা আপনি হয়তো ভাবতে পারেন, আপনি শুনেছেন যে, কেউ আপনার নাম ধরে ডেকেছিল, যখন সেটি শুধুমাত্র গাছের পাতায় বাতাসের শব্দ ছাড়া আর কিছুই না। যেহেতু আমাদের ইন্দ্ৰিয় প্রায়শ‍ই আমাদের বিভ্রান্ত করে, পিরো সিদ্ধান্ত নিয়েছিলেন তিনি তাদের ‘কখনোই’ বিশ্বাস করবেন না। তিনি কিন্তু সেই সম্ভাবনাকে একেবারে প্রত্যাখ্যান করেননি যে, তারা তাকে হয়তো সঠিক তথ্যও দিতে পারে, কিন্তু পুরো বিষয়টি নিয়ে তিনি একটি খোলা মন রাখার ব্যাপারেই মতামত দিয়েছিলেন। সুতরাং, যখন বেশিরভাগ মানুষই কোনো খাড়া পাহাড়ের প্রান্তে গভীর খাদের দৃশ্যকে যথেষ্ট শক্তিশালী প্রমাণ হিসাবে ধরে নেন যে, এখন আর সামনের দিকে হাঁটা খুবই বোকামি হবে, পিরো তা মনে করতেন না। তিনি মনে করতেন তাঁর ইন্দ্রিয় হয়তো প্রতারণা করছে, সুতরাং তিনি তাঁদের বিশ্বাস করতেন না। এমনকি খাদের প্রান্ত যখন তার পায়ের আঙুল স্পর্শ করে বা সামনের দিকে ঝুঁকে পড়ার অনুভূতিও তাঁকে বিশ্বাস করাতে পারেনি তিনি গভীর খাদের নিচে পাথরের উপর পড়ে যাবার উপক্রম হয়েছেন। এমনকি এটিও স্পষ্ট না তাঁর কাছে যে, উপর থেকে নিচে পাথরের উপর পড়াটা তাঁর স্বাস্থের জন্য খুবই খারাপ কিছু হবে কিনা।

কীভাবে তিনি চূড়ান্তভাবে নিশ্চিত হবেন এইসব সম্ভাব্য পরিণতিগুলোর ব্যাপারে? তাঁর বন্ধুরা, যারা স্পষ্টত সবাই তাঁর মতো সংশয়বাদী ছিলেন না, এই ধরনের নানা দুর্ঘটনা ঘটানো থেকে তাকে বিরত রাখতেন। যদি তাঁরা সেটি না করতেন, প্রায় প্রতিটি মিনিটে তিনি নানা ঝামেলায় পড়ে যেতেন। হিংস্র একদল কুকুর দেখে কেনই বা ভয় পেতে যাবেন, যদি আপনি নিশ্চিত না হতে পারেন তারা আপনাকে আক্রমণ করতে চাইছে কিনা সেই বিষয়ে? শুধুমাত্র তারা চিৎকার করছে বা দাঁত রের করে আপনার দিকে দৌড়ে আসছে বলে এমন মনে করা উচিত হবে না যে নিশ্চিতভাবে তারা আপনাকে কামড়ে দেবে। এমনকি যদি তারা সেটাও করে, আবশ্যিকভাবেই যে আপনি ব্যথাই পাবেন তা কিন্তু নিশ্চিতভাবে বলতে পারবেন না। রাস্তা পার হবার সময় দুইদিক থেকে ধেয়ে আসা যানবাহনগুলোর দিকে আপনি কেন খেয়াল করবেন? ঐসব যানবাহন হয়তো আপনাকে নাও আঘাত করতে পারে। কে আসলেই তা জানেন? আর কীইবা এমন পার্থক্য হবে আপনি মৃত কিংবা জীবিত থাকার মধ্যে? কোনো-না- কোনোভাবে পিরো তাঁর এই পুরোপুরি নির্বিকার থাকার দর্শন নিয়ে জীবন কাটাতে পেরেছিলেন এবং প্রচলিত আর স্বাভাবিক সব মানবিক আবেগ আর আচরণের নিয়মগুলোকে জয় করেছিলেন।

যাইহোক এগুলো পিরোর জীবন ঘিরে সম্ভবত রটানো কিংবদন্তী। তাঁকে নিয়ে এই গল্পের কিছু বানানো হয়েছে সম্ভবত তাঁর দর্শনকে নিয়ে উপহাস করার জন্যে। কিন্তু একেবারে সবই যে বানানো তার সম্ভাবনা কম। যেমন, একটি বিখ্যাত ঘটনা বলছে, একবার সমুদ্রযাত্রায় প্রবল ঝড়ের মুখে পুরোপুরিভাবে শান্ত ছিলেন তিনি, প্রবল বাতাস ছিন্নবিচ্ছিন্ন করছিল জাহাজের পাল, বিশাল ঢেউ আছড়ে পড়ছিল। তাঁর চারপাশে সবাই ছিল আতঙ্কিত, কিন্তু এসব কোনোকিছুই পিরোকে একটুও বিচলিত করতে পারেনি। যেহেতু আমরা আপাতদৃষ্টিতে যা দেখি, তারা প্রায়শই খুব ছলনাময়, তিনি কিছুতেই চূড়ান্তভাবে নিশ্চিত হতে পারেননি এই ঝড়ে তার ক্ষতি হবে কিনা। তিনি শান্ত থাকতে পেরেছিলেন যখন এমনকি সবচেয়ে অভিজ্ঞ নাবিকও ভীতসন্ত্রস্ত হয়ে পড়েছিল। তিনি দেখিয়েছিলেন যে এমনকি এইসব পরিস্থিতিতেও নির্বিকার এবং অবিচলিত থাকা যায়। এই গল্পটির সম্ভবত সত্যতা আছে।

তাঁর তারুণ্যে পিরো ভারত ভ্রমণ করেছিলেন। হয়তো এই অভিজ্ঞতাই তাঁকে অনুপ্রাণিত করেছিল তাঁর অপ্রচলিত জীবনাচরণের। ভারতের আধ্যাত্মিক শিক্ষক আর গুরুদের ঐতিহ্যবাহী একটি ধারা আছে, যারা নিজেদের চরমতম এবং প্রায় অবিশ্বাস্য শারীরিক প্রতিকূলতার মধ্যদিয়ে নিয়ে যান; যেমন জীবন্ত কবর, শরীরের সংবেদনশীল অংশ থেকে ভারী কিছু ঝোলানো বা কোনোরকম খাদ্যগ্রহণ ছাড়া বহু সপ্তাহ বেঁচে থাকা ইত্যাদি, শুধুমাত্র তাদের মনের ভিতরের স্থিরতা অর্জন করার জন্য। দর্শনের প্রতি পিরোর দৃষ্টিভঙ্গি অবশ্যই কোনো মিস্টিক বা অতীন্দ্রিয়বাদীর মতো ছিল। তবে যে কৌশলই তিনি ব্যবহার করুন-না কেন সেটি অর্জন করার জন্যে, তিনি যা প্রচার করতেন, অবশ্যই তিনি সেই অনুযায়ী আচরণও করতেন। তাঁর স্থির মানসিক অবস্থা তাঁর চারপাশে সবার উপর গভীর একটি প্রভাব ফেলেছিল। কোনোকিছু নিয়ে যে তিনি বেশি ব্যতিব্যস্ত হতেন না, কারণ,তাঁর মতানুযায়ী, চূড়ান্তভাবে সবকিছুই নির্ভর করে দৃষ্টিভঙ্গি বা মতামতের উপর। যদি কোনো সুযোগই না থাকে সত্যটাকে উদ্ঘাটন করার জন্য, অযথা অস্থির হবার কোনো কারণ নেই। তাহলে আমরা সবধরনের দৃঢ় বিশ্বাস থেকে নিজেদের দূরে রাখার জন্য, কারণ দৃঢ় স্থির বিশ্বাসগুলোর সাথে সবসময়ই সংশ্লিষ্ট থাকে বিভ্রান্তি বা ডিল্যুশন।

আপনার সাথে যদি পিরোর দেখা হতো, সম্ভবত আপনি ভাবতেন তিনি উন্মাদ এক ব্যক্তি। এবং হয়তো কোনো একভাবে তিনি অবশ্যই তা ছিলেন। কিন্তু তাঁর দৃষ্টিভঙ্গি আর আচরণ ছিল সঙ্গতিপূর্ণ। তিনি ভাবতেন যে আপনার নানা ধরনের স্থির বিশ্বাস শুধুমাত্র অযৌক্তিক এবং যা আপনার মনের শান্তির জন্য প্রতিবন্ধকতা স্বরূপ। যদি সবকিছু এমনই তো হবার কথা হিসাবে আপনি গ্রহণ করে নেন, সেটি হবে বালির উপর বাড়ি বানানোর মতো। আপনার চিন্তার ভিত্তিগুলো আপনি যেমনটা ভাবতে ভালোবাসছেন যে খুব মজবুত, সেটি আদৌ তেমন নয়, এবং আপনাকে সুখী করার সম্ভাবনাও খুব ক্ষীণ। পিরো খুব চমৎকারভাবে তাঁর এই দর্শনকে সারসংক্ষেপ করেছিলেন তিনটি প্রশ্নের আকারে। সুখী হতে চান এমন কারো এই প্রশ্নগুলি অবশ্যই জিজ্ঞাসা করা উচিত : কোনোকিছু সত্যিকারভাবে কেমন? তাদের প্রতি কী ধরনের দৃষ্টিভঙ্গি গ্রহণ করবেন? কী হবে এমন কোনো ব্যক্তির, যিনি কিনা সেই দৃষ্টিভঙ্গি গ্রহণ করেছেন?

তাঁর উত্তরগুলো ছিল খুব সরল এবং সুস্পষ্ট। প্রথমত, আমাদের পক্ষে কখনোই জানা সম্ভব না পৃথিবীটা আসলেই সত্যি কেমন, এটি আমাদের ক্ষমতার বাইরে। বাস্তবতার আসল প্রকৃতিটি কী, কেউ কোনোদিনও জানতে পারবেনা। এই ধরনের জ্ঞান, মানুষের পক্ষে কোনোভাবেই অর্জন করা সম্ভব না, সুতরাং বিষয়টি ভুলে যান পুরোপুরিভাবে। এই দৃষ্টিভঙ্গিটি পুরোপুরিভাবে সাংঘর্ষিক প্লেটোর থিওরি অব ফর্মের সাথে এবং দার্শনিকরা বিমূর্ত ভাবনার মাধ্যমে এসব বিষয়ে জ্ঞান অর্জন করতে পারেন (প্রথম পর্ব দেখুন) তাঁর এমন ধারণার সাথে; দ্বিতীয়ত, এর পরিণতিতে, আমাদের উচিত হবে না কোনো একটি দৃষ্টিভঙ্গির প্রতি প্রতিশ্রুত হওয়া। কারণ আমরা কোনোকিছুই নিশ্চিতভাবে জানতে পারিনা, সে- কারণে কোনো বিষয় সংক্রান্ত বিচার করার প্রক্রিয়া স্থগিত করে, কোনোকিছুর প্রতি প্ৰতিশ্ৰুত বিশ্বাস না নিয়েই আমাদের জীবন কাটানো উচিত।

প্রতিটি বাসনা যা আপনি অনুভব করেন তা প্রস্তাব করে কোনো একটি কিছু অন্য সব কোনোকিছু অপেক্ষা উত্তম। আর অসুখী হবার মতো পরিস্থিতির উদ্ভব হয় যখন আপনি যা চান তা পান না। কিন্তু আপনার পক্ষে জানা সম্ভব নয় কোনো একটি কিছু অন্য কোনো কিছু অপেক্ষা উত্তম কিনা। সুতরাং, তিনি মনে করতেন, সুখী হতে হলে আপনার উচিত হবে সবধরনের বাসনা থেকে নিজেকে মুক্ত করা এবং এর ফলাফল কী হবে সে-বিষয়ে আদৌ কোনো চিন্তা না-করা। এটাই হচ্ছে সঠিকভাবে বাঁচার উপায়। কোনোকিছুতে কিছু যায় আসে না, এই বিষয়টাকেই শনাক্ত করা। এভাবে, কোনোকিছুই আপনার মনের পরিস্থিতির উপর কোনো প্রভাব ফেলতে পারবেনা, মনের ভেতর সেই প্রশান্তি আপনি অনুভব করতে পারবেন। তৃতীয়ত, যদি আপনি এই শিক্ষা অনুসরণ করেন এটাই আপনার সাথে ঘটবে। আপনি শুরু করবেন নির্বাক হয়ে, এর কারণ সম্ভবত আপনার জানা থাকবে না কোন্ বিষয়ে কী বলতে হবে। অবশেষে, আপনিও সব চিন্তামুক্ত হবেন। এবং জীবনে আপনি বা অন্য যে-কেউই সবচেয়ে শ্রেষ্ঠ যা আশা করতে পারে, সেটি হচ্ছে এই পরিস্থিতি, প্রায় ধর্মীয় কোনো অভিজ্ঞতার মতো।

এটাই হচ্ছে তাঁর তত্ত্বটি। পিরোর জন্য আপাতদৃষ্টিতে তাঁর প্রচারিত তত্ত্বটি কাজ করেছিল, বাকি মানবজাতির বেশিরভাগ অংশের জন্য এটি একই পরিণতির কারণ হবে এমন প্রত্যাশা করা খুব কঠিন কাজ হবে। আমাদের মধ্যে খুব অল্প কয়েকজনই পারবেন তাঁর প্রস্তাবিত সেই ধরনের নির্লিপ্ততা অর্জন করতে। এবং সবার সেই ভাগ্যও হবে না পিরোর মতো, যেমন অত্যন্ত খারাপ কোনো ভুল থেকে বাঁচানোর জন্য তাদের নিবেদিত বন্ধুদের একটি দল থাকবে। বাস্তবিকভাবে, যদি সবাই তাঁর পরামর্শ অনুসরণ করতেন, তাহলে কেউই অবশিষ্ট থাকতেন না পিরোর সংশয়বাদীদের তাদের নিজেদের থেকে রক্ষা করার জন্য এবং এই পুরো দর্শনের ভাবনাটাই দ্রুত হারিয়ে যেত, যেমন তারা একের-পর-এক খাদের কিনারা থেকে নিচে ঝাঁপিয়ে পড়তেন, বা চলন্ত কোনো যানবাহনের সামনে দাঁড়িয়ে যেতেন অথবা হিংস্র কুকুরের আক্রমণের শিকার হতেন। পিরোর এই দৃষ্টিভঙ্গির মূল দুর্বলতা হচ্ছে তিনি ‘আপনি কোনোকিছু সম্বন্ধেই জানতে পারবেন না’ এই ভাবনা থেকে সরাসরি উপসংহারে উপনীত হয়েছিলেন, ‘সেকারণে আপনার উচিত হবে কোনোকিছু বিপদজ্জনক কিনা সেই বিষয়ে আপনার সহজাত প্রবৃত্তি আর অনুভূতিকে অবজ্ঞা করা।’ কিন্তু আমাদের এই সহজাত প্রবৃত্তি আমাদের রক্ষা করে নানাধরনের সম্ভাব্য বিপদ থেকে। তারা হয়তো সবসময় বিশ্বাসযোগ্য হয় না ঠিকই, কিন্তু এর মানে এই না যে আমাদের উচিত হবে সেগুলো পুরোপুরি উপেক্ষা করা। এছাড়া এমনকি পিরোরও সরে আসার কথা যখন কোনো হিংস্র কুকুর তাকে আক্রমণ করার জন্য ঝাঁপিয়ে পড়েঃ তার পক্ষে পুরোপুরিভাবে তার শরীরের স্বয়ংক্রিয় প্রতিক্রিয়া এড়ানো সম্ভব না, তিনি যতই চেষ্টা করুন না কেন। সুতরাং পিরোর মতো সংশয়বাদী হয়ে বাঁচতে চেষ্টা করা বিভ্রান্তিকর একটি পথ হতে পারে। এমনকি এটিও স্পষ্ট নয় এভাবে জীবন কাটালেই কেউ, পিরো যেমন বলেছিলেন, সেরকম মানসিক প্রশান্তির সন্ধান পাবেন। সুতরাং পিরোর সংশয়বাদিতা নিয়ে সংশয় প্রকাশ করা সম্ভব। আপনি হয়তো প্রশ্ন করতে চাইতে পারেন, প্রশান্তি কি আসলেই অর্জন করা সম্ভব কিনা সেইসব ঝুঁকি নেবার মাধ্যমে যা পিরো নিয়েছিলেন? পিরোর জন্য হয়তো বিষয়টি কাজ করেছে, তাহলে কী প্রমাণ আছে এটি আপনার জন্য কাজ করতে পারে? আপনি হয়তো শতকরা একশো ভাগ নিশ্চিত হতে পারবেন না যে একটি হিংস্র কুকুর আপনাকে কামড়াবে কিনা, কিন্তু যথেষ্ট বুদ্ধিমানের কাজ হবে সেই সতর্কতা গ্রহণ করা, যখন আপনি কিনা শতকরা নিরানব্বই ভাগ নিশ্চিত।

দর্শনের ইতিহাসে সব সংশয়বাদী পিরোর মতো এমন চরম পন্থার ছিলেন না। মধ্যপন্থী সংশয়বাদিতার একটি চমৎকার ঐতিহ্য আছে, যেমন সব ধারণাকে প্রশ্নবিদ্ধ করা এবং আমরা যা বিশ্বাস করি তার স্বপক্ষে প্রমাণগুলোকে নিবিড়ভাবে পর্যবেক্ষণ করা এবং সবকিছুই সবসময় সন্দেহ করে বাঁচার প্রচেষ্টা ছাড়াই এই সংশয়বাদ তার কাজ করতে পেরেছে। এই ধরনের সংশয়বাদীর প্রশ্নগুলোই দর্শনের প্রাণ। সব মহান দার্শনিকই এই অর্থে সংশয়বাদী ছিলেন। এটি ডগম্যাটিজম বা প্রশ্নাতীতভাবে কোনো কিছু মেনে নেয়ার মতবাদবিরোধী। যারা কিনা এই ধরনের যুক্তিহীন বিশ্বাস ধারণ করেন তারা খুবই আত্মবিশ্বাসী হন যে একমাত্র তারাই সত্যিটা জানেন। দার্শনিকরা এইসব মতবাদগুলোকেই চ্যালেঞ্জ করেন। তারা জিজ্ঞাসা করেন কেন মানুষ বিশ্বাস করে, তারা যা বিশ্বাস করে, কী ধরনের প্রমাণ আছে তাদের সেই মতামত আর উপসংহারগুলোর সমর্থনে। এটাই সক্রেটিস এবং অ্যারিস্টোটল করেছিলেন এবং বর্তমান সময়ের দার্শনিকরাও সেটি করে থাকেন। কিন্তু তারা শুধুমাত্র বিতর্ক করার খাতিরে এই কাজটি করেন না। মাঝারি মাত্রার দার্শনিক সংশয়বাদিতার মূল উদ্দেশ্য হচ্ছে সত্যের কাছাকাছি পৌঁছানো অথবা নিদেনপক্ষে উন্মোচন করা, কতটা কম আমরা জানি বা জানা সম্ভব হতে পারে। এই ধরনের সংশয়বাদী হবার জন্য আমাদের কারোরই পাহাড়ের খাদের কিনার থেকে পড়ে যাবার ঝুঁকি নেবার কোনো প্রয়োজন নেই। কিন্তু আপনার প্রয়োজন আছে ব্রিতকর প্রশ্ন করার জন্য তৈরি থাকা এবং মানুষ আপনাকে যে উত্তরগুলো দেবে সেগুলো খুব সমালোচনামূলক দৃষ্টিভঙ্গি দিয়ে ভাবা। যদিও পিরো সব ভাবনা থেকে মুক্তির কথা প্রচার করেছিলেন, আমাদের বেশিরভাগ মানুষের পক্ষে সেটি অর্জন করা সম্ভব নয়। একটি খুব সাধারণ চিন্তা হচ্ছে সেই বাস্তবতাটি, আমরা প্রত্যেকেই একদিন মারা যাব। অন্য একজন গ্রিক দার্শনিক, এপিকিউরাসের কাছে কিছু বুদ্ধিদীপ্ত প্রস্তাবনা ছিল, কীভাবে আমরা এই মৃত্যু-ভাবনাটার সাথে বোঝাপড়া করতে পারি। কিন্তু এপিকিউরাসকে নিয়ে কথা হবে পরের পর্বে।

সকল অধ্যায়

১. অধ্যায় ১ : যে মানুষটি প্রশ্ন করেছিলেন – সক্রেটিস এবং প্লেটো
২. অধ্যায় ২ : ইউডাইমোনিয়া – আরেকটু প্লেটো
৩. অধ্যায় ৩ : প্ৰকৃত সুখ – অ্যারিস্টোটল
৪. অধ্যায় ৪ : দার্শনিকদের থেকে সাবধান – ডায়োজেনিস ও প্রাচীন সিনিক দর্শন
৫. অধ্যায় ৫ : তাৎক্ষণিক সুখ – আরিস্টিপপাস ও সাইরেনাইক দর্শন
৬. অধ্যায় ৬ : আমরা কিছু জানিনা – পিরো এবং প্রাচীন সংশয়বাদী দর্শন
৭. অধ্যায় ৭ : বাগানের পথ – এপিকিউরাস
৮. অধ্যায় ৮ : স্টয়িসিজম, কোনোকিছু গ্রাহ্য না করার শিক্ষা – এপিকটিটাস, সিসেরো, সেনেকা
৯. অধ্যায় ৯ : কার হাতের পুতুল আমরা? – অগাস্টিন
১০. অধ্যায় ১০ : দর্শনের সান্ত্বনা – বোয়েথিয়াস
১১. অধ্যায় ১১ : ত্রুটিহীন একটি দ্বীপ – আনসেল্ম ও অ্যাকোয়াইনাস
১২. অধ্যায় ১২ : শিয়াল এবং সিংহ – নিকোলো মাকিয়াভেলি
১৩. অধ্যায় ১৩ : সাধারণের দর্শন – মিশেল দো মনতাইন
১৪. অধ্যায় ১৪ : নোংরা, পাশবিক এবং সংক্ষিপ্ত – থমাস হবস
১৫. অধ্যায় ১৫ : প্রবচনে দর্শন – ফ্রাঁসোয়া দ্য লা রোশফুকো
১৬. অধ্যায় ১৬ : আপনি স্বপ্ন দেখছেন না তো? – রেনে দেকার্ত
১৭. অধ্যায় ১৭ : বাজির দান রাখুন – ব্লেইজ পাসকাল
১৮. অধ্যায় ১৮ : কাঁচ ঘষে লেন্স যিনি বানাতেন – বারুখ স্পিনোজা
১৯. অধ্যায় ১৯ : রাজকুমার ও মুচি – জন লক ও টমাস রিড
২০. অধ্যায় ২০ : ঘরের মধ্যে হাতি – জর্জ বার্কলি (এবং জন লক)
২১. অধ্যায় ২১ : সম্ভাব্য সব পৃথিবীর সেরা? – ভলতেয়ার এবং গটফ্রিয়েড লাইবনিজ
২২. অধ্যায় ২২ : কাল্পনিক ঘড়িনির্মাতা – ডেভিড হিউম
২৩. অধ্যায় ২৩ : জন্মগতভাবে স্বাধীন – জ্যাঁ-জাক রুসো
২৪. অধ্যায় ২৪ : রঙিন চশমায় দেখা বাস্তবতা – ইমানুয়েল কান্ট
২৫. অধ্যায় ২৫ : প্রায়োগিক সুখ – জেরেমি বেনথাম
২৬. অধ্যায় ২৬ : মিনার্ভার পেঁচা – জর্জ ডাবলিউ. এফ. হেগেল
২৭. অধ্যায় ২৭ : বাস্তবতার ক্ষণিক দর্শন – আর্থার শোপেনহাউয়ার
২৮. অধ্যায় ২৮ : বেড়ে ওঠার জন্যে পরিসর – জন স্টুয়ার্ট মিল
২৯. অধ্যায় ২৯ : অবুদ্ধিমত্তাপূর্ণ ডিজাইন – চার্লস ডারউইন
৩০. অধ্যায় ৩০ : জীবনের বিসর্জন – সোরেন কিয়ের্কেগার্ড
৩১. অধ্যায় ৩১ : দুনিয়ার মজদুর এক হও – কার্ল মার্ক্স
৩২. অধ্যায় ৩২ : তাতে কী এসে যায়? – সি. এস. পার্স ও উইলিয়াম জেমস
৩৩. অধ্যায় ৩৩ : ঈশ্বরের মৃত্যু – ফ্রিয়েডরিখ নিচাহ
৩৪. অধ্যায় ৩৪ : ছদ্মবেশী চিন্তা – সিগমন্ড ফ্রয়েড
৩৫. অধ্যায় ৩৫ : ফ্রান্সের বর্তমান রাজার মাথায় কি টাক আছে? – বার্ট্রান্ড রাসেল
৩৬. অধ্যায় ৩৬ : বুহ!/ হুররে! – আলফ্রেড জুল (ফ্রেডি) আয়ার
৩৭. অধ্যায় ৩৭ : স্বাধীনতার যন্ত্রণা – জ্যাঁ-পল সার্ত্র, সিমোন দ্য বুভোয়া, আলবেয়ার্ট কামু
৩৮. অধ্যায় ৩৮ : সিসিফাসের সুখ – আলবেয়ার্ট কামু
৩৯. অধ্যায় ৩৯ : অস্তিত্ববাদের ধাত্রী – সিমোন দ্য বুভোয়া
৪০. অধ্যায় ৪০ : ভাষার সম্মোহন – লুদভিগ ভিটগেনস্টাইন
৪১. অধ্যায় ৪১ : মনের দর্শন – এডমন্ড হুসেরেল
৪২. অধ্যায় ৪২ : বেঁচে থাকার রহস্যময়তা – মার্টিন হাইডেগার
৪৩. অধ্যায় ৪৩ : বিষণ্ণতার রাজপুত্র – এমিল চিওরান
৪৪. অধ্যায় ৪৪ : ইতিহাসের ময়নাতদন্ত – মিশেল ফুকো
৪৫. অধ্যায় ৪৫ : যেমন মানুষটি কোনো প্রশ্ন জিজ্ঞাসা করেননি – হানা আরেন্ট
৪৬. অধ্যায় ৪৬ : নতুন করে দেখা – জ্যাক ডেরিডা
৪৭. অধ্যায় ৪৭ : ভুল থেকে শেখা – কার্ল পপার ও থমাস কুন
৪৮. অধ্যায় ৪৮ : লাগামহীন রেলগাড়ি আর অনাকাঙ্ক্ষিত ভায়োলিনবাদক – ফিলিপ্পা রুথ ফুট আর জুডিথ জার্ভিস থমসন
৪৯. অধ্যায় ৪৯ : অজ্ঞতার মাধ্যমে ন্যায়বিচার – জন রলজ
৫০. অধ্যায় ৫০ : কম্পিউটার কি চিন্তা করতে পারে? – অ্যালান ট্যুরিং এবং জন সার্ল
৫১. অধ্যায় ৫১ : একজন আধুনিক গোমাছি – পিটার সিংগার

নোট নিতে এবং টেক্সট হাইলাইট করতে লগইন করুন

লগইন