৫. ১৯৩৭-এ বরিশালে সাইকেল

দেবেশ রায়

১৯৩৭ সালে এত গাড়িঘোড়া রাস্তাঘাট ছিল না যে ডাকলেই গাড়ি পাওয়া যায় আর গাড়ি পাওয়া গেলেই রাস্তা পাওয়া যায়। বরিশাল টাউন থেকে বাটাজোড় মাইল বিশের মত—সোজা পাকা রাস্তা গেছে মাদারিপুরের ভিতরে। পাশে-পাশে ঢাকাখাল দিয়ে মানিকগঞ্জ পর্যন্ত মহাজনী মালের ভারী ভারী নৌকো যায়। যাতায়াতে চল্লিশ মাইল—চার ঘণ্টার কমই লাগবে।

বাজারের খালের ছোট ব্রিজটা পার হতে-না-হতেই যোগেনের হিশেব গোলমাল হয়ে যায়—তিন-চারটি যে নদী আর খাল আছে? ছোট খালে না-হয় সাইকেল তুলে এক-একটা ডোঙা নিল। কিন্তু কালিজিরা, আমতলি আর আগাপুর এই তিনটি নদী তো ঘাটনৌকো ছাড়া পার হওয়া যাবে না। সেই ঘাটনৌকোর জন্য তো বসে থাকতে হবে। তাহলে তো বাটাজোড় পৌঁছতেই বেলা শেষ। একমাত্র উপায় ছিল—একটা নৌকো নিয়ে জনাচার মাঝি বসানো। অত টাকা যোগেনের নেই। যোগেনকে যেতে হলে তার সাইকেলেই যেতে হবে। যেন আগেই ঠিক করা আছে—এমনই সহজে যোগেন মাদারিপুরের পাকা রাস্তা ছেড়ে দিয়ে আরো পুবের পুরনো রাস্তাটা ধরল—কাশীপুর, বাবুগঞ্জ, রহমতপুর দিয়ে যেটা বাটাজোড় ছাড়িয়ে গেছে।

তাহলে কি একটা নৌকোই নিয়ে নেবে—যে-পুজোয় যে-নৈবেদ্য। নৌকো ভাড়া করার মত টাকা তার সঙ্গে নেই। সে না-হয়, ফিরে এসে জোগাড় করা যাবে। কিন্তু একটা গোটা নৌকো নিয়ে বাটাজোড় যাচ্ছে—যোগেনের নিজের কাছে দোষী ঠেকে।

১৯৩৭-এ গ্রামেবন্দরে বা এমনকী ছোটখাটো শহরেও সাইকেল এত কম ছিল যে মাইল-মাইল ছড়ানো ধানক্ষেতের একপার থেকে আর-একপারে কেউ সাইকেল চড়ে যাচ্ছে দেখামাত্র যে-কেউ চোখের পাতা ফেলার আগে বলে দিতে পারবে—কে যাচ্ছে। বড় নদীর একপার থেকে আর-একপারের চলন্ত সাইকেল দেখেই চেনা যায়—কে যাচ্ছে। যোগেনের সাইকেলও তেমনি চেনা হয়ে যাচ্ছে—ঐ শায়েস্তাবাদের মাইঝ্যান মীর যায়, কলেজ পাশ দিয়ে কলকাতা থেকে ফিরেছে একেবারে সাইকেল কাঁধে—সবুজ রঙের র‍্যালে, ‘আর সবাই বি এ পাশ, মাইঝ্যান মীর সাইকেল পাশ।’ ঐ জাঁহাপুরের ঘাটবাবু যায়—সাইকেল—কোম্পানি হারকিউলিস নাকী ঘাটবাবুকে প্রথমে সাইকেলে চড়া শিখিয়েছে, তারপরে সাইকেল থেকে নামা শিখিয়েছে, তারপরে সাইকেলটা গড়ানো শিখিয়েছে, তারপর সাইকেলটা উপহার দিয়েছে এই এক শর্তে যে অন্য কোনো কোম্পানির সাইকেল ঘাটবাবু জাহাপুর ঘাটে স্টিমার থেকে নামতে দেবে না। ঘাটবাবু সবটাই খুব তাড়াতাড়ি শিখেছে ফলে কোনো-কোনো শেখা পুরো শেখা হয়নি। একটা বড় অসুবিধে—ঘাটবাবু কিছুতেই সাইকেল থেকে নামতে পারে না। নামতে হলে সে ব্রেক কষে ডাইনে বা বাঁয়ে হেলে গিয়ে ধরা—ম্ করে পড়ে যায়। আর নয় তো চেঁচাতে থাকে’, ‘আরে কে আছিস, নামাইয়্যা নে, নামাইয়া নে। সবাই ছুটে এসে সামনে সাইকেলের হ্যান্ডেল আর পেছনে ক্যারিয়ারটি ঠেলে বা টেনে ধরে আর ঘাটবাবু হ্যান্ডেল থেকে হাতদুটো তুলে যেন মায়ের কোলে উঠছে এমন করে মানুষজনের দিকে দু-হাত বাড়িয়ে দেয়। তবে এ নিয়ে খুব কিছু অসুবিধে হয় না। রাস্তার মাঝখানে সাইকেল থেকে নামার কোনো দরকার তার ঘটবে কেন। অন্য কারো তাকে যদি হয়, সে নামিয়ে নেয়। তবে রাস্তা তার খেয়াল থাকে, আলরাস্তা ছাড়া বড় একটা সাইকেল চালায় না। সাইকেলের সামনে কোনো বাধা না ঘটলে বা আচমকা আলটা কেটে দেয়া না-হলে-সাইকেল মিছেমিছি পড়তে পারে না। কিন্তু ঘাটবাবু সাইকেল নিয়ে আল থেকে ডাইনে-বাঁয়ে ক্ষেতের নরম মাটিতে পড়ে যেতে পছন্দ বা নিরাপদ বোধ করে। পড়তে যখন হবেই, আল থেকে ক্ষেতে পড়াটাই ভাল। সাইকেল থেকে তাকে নামিয়ে নিয়ে তাকে আবার ঝাড়তে হত। ঘাটবাবুর হারকিউলিস সাইকেল ‘৩৭ সালের আগেই অথচ তাকে নিয়ে ছড়া রটল ‘৪১ সালে যুদ্ধের মধ্যে, তখন তো আরো কত জনের সাইকেল হয়ে গেছে, সাইকেল দেখে লোক চেনাতেও কারো মন নেই। ঘাটবাবুর সাইকেল নিয়ে ছড়াকাটতে যে একটা যুদ্ধই দরকার হল, তার কারণ, যুদ্ধ না হলে, ‘ঘুষ’ কথাটা কি এতটা চেনা হত? ‘ঘুষের সাইকেলের আছাড়ও বেশি, ঝাড়নও বেশি।’

আর-এক সাইকেলের নাম ছিল ‘নইলিবিবির সাইকেল’। গুলামকাঠির মোনাগাজি – শাহেব-জমিদার চার নম্বর নাকী পাঁচ নম্বর বিবি আনল যখন, তার সব দাড়ি পেকে বুকের মাঝবরাবর ঝুলে পড়েছে আর মাথায় চুল আছে শুধু দুই কান আর ঘাড়ের ওপর। নতুন বিবির বয়স টেনেটুনে বাড়ালেও পনের কিন্তু এত রোগা যে বার-তের বললেও কেউ অবিশ্বাস করবে না। মোনাগাজিশাহেব একে গাজি, তায় জমিদার। তার যদি বিয়ে করার ইচ্ছে হয় তাহলে দশের কিছু বলার নেই বরং দু-একদিন বিরিয়ানি খাওয়া যাবে। শুধু বিরিয়ানি খাওয়া ছাড়াও জিভের তো অন্য কাজও আছে। হাটবাজারের মানুষ গাজিশাহেবকে জিজ্ঞাসা করত, ‘আরে, গাজিশাহেব, আপনার রহইস্যডা এড্‌ডু দেন-না, শরীলের এত্ত গরম জাগান ক্যামনে? এইডা তো পাটের কাঠির আগুন না, গাজিশাহেব, যে ধপ্ কইর্যা জ্বইল্যা উইড্যা ছাই হয়্যা যায়। এইডা তো পাটের ফাঁসের আগুন—এতখান্ বছর জ্বইল্যাই দাব্যায়। চাইর-চাইরডা বিবিও যে-আগুন ঠান্ডা কইরব্যার পারে নাই, সেই আগুনে তো ঐ বাচ্চাবিবিডা ঝইলস্যা যাবে।’

আড়াল থেকে কেউ ছুঁড়ে দিত, ‘আরে, ঝইলস্যালে তো আবার বিরিয়ানি।’

গাজিশাহেব মিটমিটিয়ে হাসত, ‘কওড়া কী? তোমাগো বিবিরে তো টানাটানি করি নাই, নিজে শাদি কইর্যা বিবি বানাইছি। তোমাগো বিচির জোর থাইকলে তোমরাও বানাও।’

‘তাই বইল্যা চাইরবার?’

‘এই, গোনায় ভুল ঢুকাইও না। তিনবার।’

‘তিনবার কী কইর‍্যা হয়? হিশাব ধরেন। ধরেন তুফানির মা—’

‘আরে, করোডা কী? বিবি আমার আর গনা ধরো তোমরা? আরে ভাই, অ্যাহন এড্‌ডু নাতিনাতনির লগে খেইলব্যার মন চায়, তাই, আইনল্যাম এক বিবি। ছুড়াছুডি কইরব, খেইলব, থাকব, আল্লার জীব, আল্লা যহন আমার ভাতের টান রাখেন নাই, আর-এড়া জীবের সঙ্গে ভাগ কইরতে দোষ কী?’

‘আপনার তো তিন-চাইর বাড়িভর্তি নাতিনাতনি। তাগ সঙ্গে খেলা হয় না? খেলার লগে নাতনির মতন একখান বিবি আইনলেন, গাজিশাহেব?’

‘আরে, সেইডা খেলা কি নাতিনাতনির লগে শ্যাষ হয়? খেলার শ্যাষে যে-খেলাডা না অইলে বিস্বাদ ঠেকে? তো এইডা তো বিধান। নাতনির নাগাল বিবি করো। খেলা তাহাইলে আর শ্যাষ হইবার না। ঘুমের আগে বিবি হইয়্যা ঘুমায় আর ঘুমের শ্যাষে নাতনি হইয়া জাগে।

সেই মোনাগাজি একবার খুলনা গেলেন আর ফিরলেন এক সাইকেল নিয়ে। মোনাগাজি শাহেব কি এই বয়সে সাইকেল চড়বেন? ‘না, না। রংটং আর চাকা দুইখান দেইখ্যা মনে আইল, নতুন বিবিডা খেইলবার পারব। আগনও যায়, পাছনও যায়। আর, শুদু-শুদু ঘুরানোও যায়। তাহাইলে বুঝো, কতখান খেলা এড্‌ডা খেলনায়?’

মোনাগাছিশাহেব সে-সাইকেল ঠেলে নিতে পারে না, হ্যান্ডেল ঘুরে-ঘুরে যায়। শেষে স্টিমারের এক খালাশি সেটা দুই হাতে মাথার ওপর তুলে পাড়ে নিয়ে যায়। পাড়ে তো নেওয়া গেল, কিন্তু গাজিসাহেবের হাভেলি নলচিড়ায় যাবে কী করে, সাইকেল? সাইকেল না থাকলে গাজিশাহেব তো হেঁটেই যেতেন। খুলনার দোকানদার তাকে বলেছিল, ‘হেঁইটে যদি যাবার পারে, সাইকেলটাও ধইরে-ধইরে যাবার পারবেন। শুধু ধইরে থাইকলেই হবে।’ ধরে থাকলেও যে হয় না তা তো বোঝাই গেল। স্টিমারঘাটা, স্টিমার আসা-যাওয়ার সময় ভিড় তো হয়ই। তাছাড়া, মোনাগাজিশাহেবকে আদাব জানাতেও দু-চারজন আসে। তার ওপর ওরকম একটি ঝকঝকে নতুন সাইকেল দেখে ভিড় আরো বেড়ে যায়। তারও ওপর যখন জানা যায় সাইকেলটা মোনাগাজিশাহেবই এনেছেন—খুলনা থেকে, তখন ভিড় আরো বেড়ে যায়। তারপরেও যখন জানা যায় সাইকেলটা নলচিড়া পর্যন্ত নিয়ে যাওয়া যাচ্ছে না—তখন ভিড়টা সবচেয়ে বেড়ে যায়। মোড়ল-মাতব্বররাও জুটে চেঁচামেচি শুরু করে।

সাইকেলটাতে দু-একজন হাত দিয়েছে কিন্তু কেউই গড়ানোর সাহস পায়নি। গাজিশাহেব তখন একজনকে, যে তার সামনে ছিল তাকেই, বলে, ‘হে-ই, চল্, সাইকেলডা মাথায় কইর্যা হাঁটা দে আমার লগে।’ স্টিমার থেকে সেই খালাশিটা যেভাবে নামিয়েছিল, সেভাবেই তো নিয়ে গেলে হয়! নলচিড়া আর কদ্দূর? হাঁটা দিলেই তো পৌঁছে যাবে।

গাজিশাহেব কাকে বলেছিল সেটা তার কাছেও খুব স্পষ্ট ছিল না। কেউ একজন কাঁধে করে তার পেছন-পেছন চলে আসবে। গাজিশাহেব রওনা দিতেই একজন বলে ওঠে, ‘ছাহেব, গড়ায় কী না, দ্যাখব?’

‘দ্যাখ।’

মুহূর্তে লোকটি ঐ ভিড়ের সবচেয়ে বিশিষ্ট হয়ে ওঠে। সে দুই হাতে হ্যান্ডেলের দুই মাথা এত শক্ত করে চেপে ধরে যে তার কাঁধ ফুলে ওঠে। কিন্তু সে টানতেই সাইকেলটা চলতে শুরু করে। তাকে তারিফ দিয়ে কেউ চেঁচিয়ে ওঠে, ‘বাপের নাম রাখলি রে, বেটা!

এত হৈচৈয়ে লোকটিই একটু নার্ভাস হয়ে যায় বোধহয়। সে হ্যান্ডেলটা আরো শক্ত করে চেপে ধরে আর সেই জোরের একটু হেরফেরে সাইকেলটা ডানদিকে ঘুরে যায়। লোকটি আরো চেপে ধরতেই সাইকেলটা ডাইনে কাত হয়ে মাটিতে পড়ে যায়। লোকজন তাকে ও সাইকেলটাকে তুলে খাড়া করে। লোকটি কিছুতেই হ্যান্ডেল থেকে মুঠো খুলছিল না। ‘আরে, মুইঠ্যা খুল। তুই কি শু‍ইয়্যা শুইয়্যা চালাবি?’

সাইকেলের সামনের চাকাটা উঁচু হয়েছিল—সেটা একটু ঘুরছিলও, ‘জো–র দ্যাখ, জো–র, চাকার জো–র, ক্যামন নিজের থিক্যাই পাক খায়।’

গাজিশাহেব শুধু বলল, ‘কইল্যাম মাথাত্ নিবার, আর তুই গড়ান ধরলি? এক কাম কর্ একখান গাড়ি ধর্।’

গাড়ি মানে গরুর গাড়ি। ‘ধর্’ মানে নিয়ে আসা। কোত্থেকে সেটা নিশ্চয়ই গাজিসাহেবের জানার কথা নয়। গাজিশাহেব তো আর নিলামে ওঠা তিন পাইয়ের জমিদার না, তাঁদের জমিদারির সনদ বাদশাহ জাহাঙ্গিরের আমলের। এত পুরনো ঘর বলেই যেমন বুড়ো বয়সে নতুন বিবি করতে পারে, তেমনি তা নিয়ে হাটে বসে দশের ঠাট্টাতামাশাও নিতে পারে, আবার সেইসব কিছু নিয়ে জীবন, নরনারী আর দিনযাপনের রহস্যও করতে পারে। এত পুরনো ঘর বলেই তাকে জমিদারির ঠাটঠমক আয়ত্ত করতে হয় না—গ্রামের সঙ্গে মিশেই থাকে। তবু তো মোনাগাজি জমিদার-তাকে তো সরকারে রাজস্ব জমা দিতে হয়। সে যদি নিজের মনেই বলে, ‘একটা গাড়ি ধর্’ তাহলে দেখতে-না-দেখতে দু-দশটা গাড়ি তো নিজে থেকেই এসে পড়বে। তবে এই স্টিমারঘাটাটা গাঁয়ের বাইরে—তাই হয়ত একটু সময় লাগে বা দশটা গাড়ির বদলে দুটো আসে।

স্টিমারঘাটা থেকে নলচিড়া যাওয়া যদি হাঁটার বদলে গাড়িতে সহজ হত, তাহলে গাজিশাহেব নিজের গাড়িই তো লাগিয়ে রাখতে পারত, তার নিজেরই জন্য। স্টিমারঘাটা থেকে নলচিড়া পায়ে যেতে যদি লাগে এক আঙুল টাইম, তাহলে গাড়িতে যেতে লাগে অন্তত দুই আঙুল, মানে, ডবল টাইম। গরুর গাড়ি তো পায়েহাঁটা আল ধরে যেতে পারে না, তার তো চওড়া জায়গা দরকার, মাঠ দিয়ে বা বাঁধ দিয়ে। তার ওপর মাটির ওঠানামা আছে, ঠেলাঠেলি আছে।

একটা গাড়িতে সাইকেলটাকে শোয়ানো হল। প্যাডল পাটাতনে ঠেকে যাওয়ায় সামনের চাকাটা শূন্যে উঠে গেল। তার মানে সারা রাস্তা ঘটর ঘটর। গাড়োয়ান গাড়ির পেছনে গোঁজা একটা ছালা এনে প্যাডলের নীচে দিয়ে সামনের চাকাটাকে ডাইনে একটু নেতিয়ে দিল—চাকাটা আর উঁচু হয়ে থাকল না। ভিড়টার দিকে তাকিয়ে গাড়োয়ান বলল, ‘বাইন্ধ্যা দিব না কী?’ গাজিশাহেবকে জিজ্ঞাসার সাহস নেই তার। তারই বয়সের একজন বলে ওঠে, ‘বান্ধাবান্ধির কাম নাই। চল্ গিয়্যা। আমি ধইরা রাখব।

গাড়ি চলতে শুরু করল আর সেই গাড়ির পেছন-পেছন চলতে লাগল পুরো ভিড়টা। এক মুরুব্বি এসে গাজিশাহেবকে বলে, ‘আপনার আর লগে-লগে যাওয়ার কামডা কী? এই নাইমলেন ইস্টিমার থিক্যা। আপনি বাড়িত্ যাইয়্যা বসেন, আমরা তো আছি।’

‘সেইডা কি ঠিক কাম হইব? একলগেই যাই।’

সামনে গরুর গাড়ি। তার ওপর দুই গাড়োয়ান পা ঝুলিয়ে। গরুর গাড়ির ওপর সাইকেল, শোয়ানো। যে জানে না, তার পক্ষে দূর থেকে আন্দাজে সাইকেল বোঝা তো সম্ভবই নয়, এমনকী গাড়ির ওপর উঠে উবু হয়ে গন্ধ শোঁকার পরও সেটা যে সাইকেল এটা বোঝা তার পক্ষে কঠিন, খুব কঠিন। কারণ, এমন যে যেতে পারে, সাইকেল, তা সে কোনো কালে তো শোনেনি। শোনেইনি। এমন হতে পারে, আজ যদি সে দেখে ও বোঝে, বোঝে ও দেখে, তাহলে, সাইকেল আর গরুর গাড়ি তার মাথায় এতই ঘোর ঢুকিয়ে দেবে যে সে আর সারা জীবনে সেটা ছাড়াতে পারবে না।

তার ওপর পেছনে এত ভিড়, চারপাশের সব মোড়ল-মাতব্বর, কাচ্চাবাচ্চা, কে নেই? সবচেয়ে আগে, মোনাগাজি তার শাদা দাড়ির নিশান উড়িয়ে। শুরুতে কেউ-কেউ গাজিশাহেবের পাশে-পাশে যাচ্ছিল, মোড়ল-মাতব্বরদের কেউ-কেউ, তারপর কোনো এক সময় পেছিয়ে গেছে। পেছিয়ে গেছে—মানে, দু-এক পা। গাজিশাহেব কোথাও বসে থাকলে, সে তার দলিজেই হোক আর হাটের বাঁশের মাচাতেই হোক, তার মুখোমুখি বসে কিংবা দাঁড়িয়ে হাসিমশকরাও করা যায়। বা, গাজিশাহেব কোথাও দাঁড়িয়ে থাকলে, এই যেমন ছিল স্টিমারঘাটায়, তাকে ঘিরে দাঁড়িয়ে-দাঁড়িয়েও কথা বলা যায়। কিন্তু সে তার নইলিবিবির জন্য একটা সাইকেল কিনে এনে স্টিমার থেকে নামাতে পারল না, নিজে গড়িয়ে-গড়িয়ে বাড়ি নিয়ে যেতে পারল না, এখন গরুর গাড়িতে চাপিয়ে পেছন-পেছন যাচ্ছে, যেন কফিনের পেছনে কবরখানায়, তখন কি আর খেলা, খেলা? থাকে, তখন কি তার পাশে-পাশে হাঁটা যায়?

মাঠঘাট থেকে দু-একজন চেঁচিয়ে প্রশ্ন করে, ‘যায়ডা কী?’

যে-বাচ্চারা অনেক পেছনে তারা সরু গলায় চিৎকার তুলে জবাব দিচ্ছিল, ‘নইলিবিবির সাইকেল।’

নইলিবিবির সাইকেল—মোনাগাজির তিন নাকী চার নাকী পাঁচ নম্বরের বিবির খেলনা আর যোগেন উকিলের সাইকেল বরিশালের পয়লা এম এল এ-র বাহন?

অ্যাহন তিন সাব-ডিভিশন, ষোল থানা জুইড়া সেই বাহনের দলাইমালাই চইলত্যাছে, বাহন যাতে খাড়াইতে পারে, খাড়াইয়া দৌড় মাইরব্যার পারে। আর সে-বাহন অ্যাহন তার একমাত্র সওয়ারি পিঠে…। ১৩৪৩ বঙ্গাব্দের নিদাঘশেষে একদিন একজন সাইকেলারোহী পুরুষ চন্দ্রদ্বীপ হইতে পাড়-রহমতপুরের পথে একাকী গমন করিতেছিল। যোগেনের ঠোটে একটু হাসি লেগে থাকে। আরে, বাটখারার ওজন নিতে না পারলে কি আর দাঁড়িপাল্লার পাল্লা ওজন নিতে পারে? নামের মত নাম না-হলে কি আর নামের ওজন বওয়া যায়? যদি বলা যায়, বাখরগঞ্জ থেকে রহমতপুরে যাইতেছিল, তাহলে কি আর ‘গমন করিতেছিল’, বলা যায়? কোন শব্দে পাল্লা চড়ে যাবে—তার একটা বিচার নেই না কী? যোগেনের ঠোটের বাঁকা হাসি আর-একটু ছড়িয়ে পড়ে। যোগেন মণ্ডল—এ শব্দের ওজনের কোনো বাটখাড়া হয়? যোগেন্দ্রনাথ মণ্ডল—এরকম বানালেও দাঁড়ায় না। শ্রীযুক্তবাবু রাজকৃষ্ণ রায়চৌধুরি মহাশয়, শ্রীযুক্তবাবু রামজীবন রায় মহাশয়, শ্রীযুক্তবাবু শশিকুমার ঘোষ মহাশয়—এসব নামের ওজন কত? শ্রীযুক্তবাবু যোগেন্দ্রনাথ মণ্ডল, এই নামের ভিতরে কোনো মাংস নাই, যে-মাংস থেকে ওজন বাড়ে। পিছনে যার ‘মণ্ডল’, সামনে কি তার ‘শ্রীযুত’ চলে? পিছনেই যার ‘মণ্ডল’, তাকে কি পেছন থেকে ‘মহাশয়’-এর গোঁজ দেওয়া যায় হয়ত চলতেও পারে-মণ্ডলমশয়রা? ‘মণ্ডল’-এর পর ‘মহাশয়’—চলে? চালালেও?

বরিশালে চলে না—সেখানে এত নাম, এত গল্প, এত জমিদারি, এত নৌযুদ্ধ, এত চোরাগোপ্তা।

সকল অধ্যায়

নোট নিতে এবং টেক্সট হাইলাইট করতে লগইন করুন

লগইন