২. যোগেনের ভোটপ্রচার

দেবেশ রায়

ভোটের দিন দশেক আগে পড়ল পুষড়্যা।

দুনিয়া যদি রসাতলে যায়, তাও কোনো বরিশাইল্যাকে পুষড়্যা বা পৌষপার্বণের দিন হাতের নাগালে পাওয়া যাবে না—‘দে ভাই, একখান কাঁধ দে, দুনিয়াখান যে ভাইস্যা যায়, একখান কাঁধ লাগাইয়্যা এড্‌ডু ঠেকান দে।’ ‘আরে, এক দুনিয়া ভাইস্যা গেলে আর একখান দুনিয়া আবার কোটালের বানে ভাইস্যা আইসব—কিন্তু একখান্ পুষুড়া গেলে তো এক বছরের আগে ফিরব না। দুনিয়াডারে ভাইসব্যার দে এডডু। চিতৈ পিঠাডা খাইয়্যা নেই।’ সরায় ছোট-ছোট গর্ত করা, নতুন চালের গুঁড়োয় ভর্তি করে উনুনের ওপর ভাপে তৈরি হয়। তারই নাম চিতৈ পিঠা—ফরিদপুরে-বরিশালে। অনেক জায়গায় বলে ‘সরা পিঠা’। সরা পিঠা আকারে একটু বড় হয়, চিতৈ পিঠা তো বড় বাতাসার সাইজ। ভিরা গুড়ে ডুবায়্যে খাও চিতৈ আর নারকেলের পুর দেয়া চুষি, পুলি, পাটিসাপটা। এত গুড় আর এত দুধ আর এত নতুন চালের গন্ধে খালবিলের ওপর থিকথিকে মাছি ভনভন করে ওড়ে। মণ-মণ চিতৈ আর গুড় খাওয়ার পর পেট ছাড়ে। তবে খালবিল দিয়েই তো যাতায়াত। পেট ছাড়লে ক্ষতি কী? ক্ষতি কী? ক্ষতি কিছুই না–পেট না-বুইঝ্যা যদি পিঠ্যাও খাওয়া না যায়, তা হাইলে আর পুষড়্যার কামডা থাইকল কী? দে ফেলাইয়া। কিন্তু ভোটটা একেবারে পুষড়্যার গায়ে-গায়ে পড়ল! আজ পুষড়্যা, ভোট আটই মাঘ আর গেজেট হবে একুশে মাঘ। পুষুড়াটা ঐ আট আর একুশের মাঝামাঝি পড়লে সব দিকটা রক্ষা পেত।

এর মধ্যে বরিশালের তিরিশ জন বর্ণহিন্দু ভদ্রলোক একটা ছাপা কাগজে ভোটারদের অনুরোধ করেছেন, তারা যোগেনকে এই সাধারণ আসনে সমর্থন করছেন, ভোটাররাও যেন যোগেনকে ভোট দেন।

এই কথাগুলি ছাপা কাগজ এই সব লোকদের নামে এই কেন্দ্রের প্রধান-প্রধান জায়গাগুলিতে বিলি করা হল। বর্ণহিন্দু ভোটারদের মধ্যে একটা মত যোগেনের পক্ষে দানা বাঁধতে থাকে। তবে মিছরির দানা নয়, ঢ্যাপের দানা, একটু জোরে বাতাস লাগলেই ঝরে যায়। ভোটের দিন যতই এগিয়ে আসে, মতটা ততই শক্ত হয়ে গড়াতে থাকে। যোগেন সেটা টের পেয়ে টাউনের হিন্দুপাড়ায় বেশি করে ঘুরতে লাগল।

ঐ ছাপা-কাগজ বেরবার দিন সাতেক পরেই সদর দক্ষিণ ও ভোলা কে খারাপ খবর আসতে শুরু করে। ঐ সব জায়গায় নাকী রটে যাচ্ছে যে যোগেনবাবু হিন্দু হয়ে গেছে ও কংগ্রেসে ঢুকে গেছে। ঐ ছাপা-কাগজ দেখিয়ে-দেখিয়ে বাবুরা, মানে বাবুহিন্দুরা, মানে কংগ্রেসিরা সবাইকে বলে বেড়াচ্ছে, এই-যে ছাপানো দলিল, যাঁরা সই করেছেন এই-যে তাঁদের নাম, এঁরা বলছেন, যোগেনকেই আমরা ভোট দেব, আপনারাও যোগেনকেই ভোট দেন। দেখো, এই যে তিরিশজন মানুষের নাম—তার মধ্যে একটাও নমশূদ্র বা মুসলমানের নাম নেই।

বরিশালে যোগেন যে-বাড়িতে থাকে, সেখানে সবাই মিলে কথা হচ্ছিল, এই মিথ্যা প্রচারের বিরুদ্ধে কী করা দরকার। এক আধবুড়ো মোক্তার খেপে উঠে বলে, ‘আরে যোগেন না-হয় বামুনই হইল, কিন্তু তাতে যোগেনের সুবিধাড়া কী হইল? সে যদি কাস্টহিন্দুগ ভোট পাইয়া জিতে, তাইলে, কংগ্রেসের প্রার্থী তো হাইরাই যাবে নে। তাইলে?’

এই কথার নানা জবাব এল, কোনোটাই খুব স্পষ্ট নয়। ফলে, সেই মোক্তার রাগারাগি শুরু করলেন, ‘আরে, রাইত পোহাইলেই ভোট আর অ্যাহন সব সংবাদ আইনবার ধইরছে—কংগ্রেসের লিডাররা নাকী কইয়্যা বেড়াচ্ছে যে যোগেন মণ্ডল হিন্দু হইয়া গিছে।’

কেউ শুধরে দেয়, ‘যোগেন মণ্ডল তো হিন্দুই। কন কংগ্রেস হইয়া গিছে—’

মোক্তারবাবু তাকে থামিয়ে দিয়ে বলে, ‘আরে, থোন তো। ঐ তো এককথাই হইল। কংগ্রেসি লিডাররা মিটিং ধইরা কইল আর একডা মানুষও কানে হাত দিয়া দেইখল না—কান কানের জায়গায় আছেনি?’

বরিশাল শহরে যোগেনের কোনো বাড়ি ছিল না। সে প্রহ্লাদ দত্তের তার মোক্তারবন্ধু বাড়িতে থাকত। ওখানেই খেত—স্ত্রী বা বাড়ির কাউকে আনেনি। প্রহ্লাদ দত্তের বাড়িতেই এইসব কথা হচ্ছিল। দত্ত ঠান্ডা মাথার মানুষ, তার বয়সও চল্লিশ পেরিয়েছে। সে তার নিজের গলা একটুও না চড়িয়ে বলে, ‘এই, উকিল-মোক্তারগ সঙ্গে কথা কওয়ার বিপদ।’ কথাটায় একটু হাসাহাসি হল। যোগেন তো চুপ করেই ছিল, সে বেশ দুলে-দুলে হেসে উঠে, হাসি-হাসি মুখেই থাকল, চোখটা একটু নামিয়ে। অপদস্থ সেই রাগী মোক্তারবাবু, প্রহ্লাদ দত্তকে জিজ্ঞাসা করল, ‘হইত্যাছে ভোটের কথা, ইর মধ্যি মোক্তারির কথা আসে কোথিক্যা। কে না কে কইল যোগেন কংগ্রেস হইয়া গিছে, আর সব মানুষ চৈতন্যকীর্তন বাধাইয়া বসব? আরে আহাম্মকের দল, যোগেন কংগ্রেস হইয়্যা গেলে কংগ্রেসের ক্যানডিডেট সরল দত্ত কি বেগুন বেচবার বসব? আমার আরগুমেন্টের ত্রুটিখান কোথায়?’

প্রহ্লাদ দত্ত তার আগের গলাতেই বলে, ‘স্যাও আবার খুঁইজবার লাগে? আরে, চেয়ারে তো মুনশেফ নাই, আরগুমেন্ট করো কার লগে? দুধ উথলাইলেও আখার মুখে আরগুমেন্ট কইরবা না কি?’

যোগেনের আচমকা উঁচু হাসিতে প্রহ্লাদ দত্তকে থামতে হল। হাসি শেষ হলে সে বলে, ‘আরে, কথা একখান রটাইয়্যা দিয়্যা দশখান ভোট সরাইতে পাইরলেও তো অগ উবগার! সেইডা ঠ্যাকানের বুদ্ধি কর।’

যারা খবর নিয়ে এসেছিল, তাদের একজন বলে ওঠে, ‘এই কথাখান তো খুব কঠিন কথা না। যোগেন মণ্ডল কংগ্রেস হইলে সরল দত্তর কী হইব। সেই কথা আমরা কইছি। তার পালটা কথা রটছে : যোগেন মণ্ডল যত ভোট পাবে সেইগুলা সরল দত্তকে বেইচ্যা দিবে। এর উত্তর কী দিব?’

প্রহ্লাদ দত্ত অনুচ্চস্বরে বলে ওঠে, ‘অ, বেচাবেচি সব শ্যাষ? শুধু রেজিস্ট্রি বাকি? সেইডা হব ভোটের দিন?’

এ কথাতেও যোগেন একাই হেসে ওঠে। তাকে হাসতে দেখেও কেউ যে হাসে না, তার কারণ প্রহ্লাদ দত্তের কথার ভিতরকার কৌতুকটি সবাই বুঝতে পারে না। কিন্তু বুঝতে পারে এমনও তো ছিল অনেকে, তারাও হাসল না। তাদের মনে হচ্ছে হয়ত, এমন একটা গুরুতর খবরকে যথেষ্ট গুরুত্ব দেয়া হচ্ছে না।

যোগেন কারো দিকেই না তাকিয়ে বলে, ‘শুইনল্যা কবে কথাডা পরথম?’

‘আগের বারের ছোড হিজুরার হাটে।’

‘কী? কংগ্রেসের লিডার সেইখানে মিটিং ধইরছিল?’

‘না। আমরা মিটিং শুনি নাই। ছোড হিজুরার হাটে কথাটা কানে আইল।’

‘কথা তো আর পাখি না যে তোমার মাথায় হাইগ্যা উইড়া যাবে। কথা তো গাই-বলদ — গলার দড়ি ধইরা টাইন্যা খুঁটায় বাঁইধব্যার লাগে। তোমাগো কানে কথাডা আইল ক্যানে? এ তো বেশ বিস্তারিত কথা। ফুস কইর্যা কেডা-না-কেডা আন্ধারে লুকাইয়া কইয়্যা গেল, তা তো না।’

‘কথাডা আমরা শুইনছি আমাগ মাইনষের মুখে। যে কইছে স্যায় যে সব বুইঝ্যা-শুইন্যা কইছে তেমন না। আমরা জিগাইব্যার ধরি। তহন আস্তে-আস্তে ঐ যে হিন্দু-উকিল-মোক্তারের একখান কথা ছাপা হইছে তার কথা, ভোট বেচার কথা—এই সব জাইনব্যার পারি। শুইন্যা মনে হইল কথাডার মইধ্যে কায়েতি বুদ্ধির মারপ্যাঁচ আছে, এ কাঁচা বুদ্ধির কাম না। তাই কথাডার পাঁজিপুথি খুঁইজব্যার যাই নাই। আপনাগ জানাবার আইসছি। কুনো বুদ্ধি থাইকলে কয়্যা দ্যান।’

‘এহানে পুরুতঠাকুর কেডা আছে যে তোমাগো বিলান দিব? তোমার জায়গার ঘটনা, তোমরা যে ধইরতে পারছ—কথাডা পাকা মাথার কাজ—সেইডাই তো আসল কথা। তোমরাই কাটান দিবার পারবা। যারা এইসব কথা নিয়া কাতলা মাছের বিছন নাড়াবার তারা ভোটার তো?’

‘সেইসব তো জানারও টাইম হয় নাই। যেইডা কইল, সেইডা তো আমগো লোক।’

‘অ। আইজ ঐ দিকে কোন্ হাট?’

‘আইজ তো ছোড় হিজুরার হাট না।’

‘ছোড হিজুরা দিয়া কামডা কী? সে হাটে তো দুইডা নৌকাও যায় না। ঐখানে কথাডা রাইখ্যা দেয়ার সুবিধা। কচ্ছপের ডিমের নাগাল। বড় হাট কিছু আইজ নাই, ঐ দিগে?’

‘হয়। আইজ তো বিসারদির বড় হাট—চার বেড়ি লাগে নৌকা বাঁধব্যার লাগে।’

খাল, নদী আর নৌকো হচ্ছে বরিশালের একমাত্র নিরিখ। কত বড় হাট? না, এত নৌকো আসে যে হাট চার চক্করে ঘেরা হয়ে যায়।

‘তো চলো। যাই বিসারদির হাট।’

‘বিসারদির হাটে তো এ কথাডা উড়ে নাই। কাঠ না কামঠ জানার জইন্যে কুমিরের ল্যাজ তুইল্যা দেখনের কাম কী?’

‘আরে, কথাখান উঠে নাই তো, আমরাই উঠাই। আর যদি উঠাইবই তাহলে ছোড হাজুরির নাগাল গেঁড়ি হাটে ফিশফিশ কইর‍্যা তুইলব ক্যান। যদি উঠাইবই তাইলে বিসারদির হাটেই উঠাইব। যারা শুনে নাই তারা শুইনবেও, জবাবও বানাইবে। চলো। বিসারদির হাট।’

‘মিটিং তো ডাকা নাই।’

যোগেন একটু হেসে বলে, ‘আরে, এই ভোট আইস্যা কী শিখাইল রে বাগ? মানুষের লগে কথা মিটিং ছাড়া কহা যাবে না?’

যোগেন দাঁড়িয়ে পড়েছিল, তারপর খুব নিচু স্বরে গেয়ে উঠল, ‘যদি ডাকার মতন পাইরত্যাম ডাইকতে।’ যোগেনের গানের গলার খ্যাতি আছে নিকটজনদের মধ্যে। ‘খাড়াও, পিরান গলাইয়া আসি।’

বিসারদি বরিশাল শহর থেকে সোজা পুবে। এখন শীতের সময়—খালেবিলে জল কম, মানে ছোটখাটো খালেবিলে। বরিশালের খালবিল নদীনালার জল বর্ষা নিয়ন্ত্রিত নয়। বর্ষা টানা হলে হয়ত নতুন একটা খাতায় জল জমে উঠল—পায়ে-হাঁটার বদলে লোকজন ডিঙি বেয়ে এপার-ওপার শুরু করল—সে আর নতুন কথা কী—কত বাড়িতে তো বাহ্যি করতেও ডিঙা নিয়ে বাঁশবনে যেতে হয়। বর্ষা কমে এলে বা থেমে গেলে হয়ত সেই খাতের জল নেমে যায়, পায়ে হাঁটা পুরনো মাঠ বেরিয়ে পড়ে। কিংবা, বর্ষা শেষ হয়ে গেলেও খাতের জল সরল না—তখন ঐ ডিঙিতেই আসা-যাওয়া চলতে লাগল। কেউ জিজ্ঞাসাও করে না। সকলেই জানে, বর্ষায় জমা জলে ‘জান’ ঢুকে গেছে, অন্য কোনো বড় খাতের জল।

বরিশালের নদীনালা, খালবিলের জল, বাড়ে কমে, স্রোত পায়, মুখ বদলায় সমুদ্রের জোয়ার ভাটায়। প্রতিদিন, প্রতি একটা সূর্যোদয়ে বরিশালের, প্রায় পুরো বরিশালের শিরা-উপশিরা দিয়ে জোয়ার বয়ে যায়—ঘোর দুপুরে, কাকভোরে, কৃষ্ণপক্ষের সন্ধ্যায় ঝকঝকে তারাগুলির টলটলে প্রতিবিম্ব মুছতে মুছতে। বা, শুক্লপক্ষে ক্রমোজ্জ্বল জলরাশির শীকরচ্ছটায় রহস্য ছড়াতে ছড়াতে।

বিসারদি নদী, কীর্তনখোলার চরই প্রায়, আবার চর নয়ও। মানে, বিসারদি যেতে, বরিশাল থেকে, কীর্তনখোলা পেরতে হয় না। বরং বলা যায় কীর্তনখোলায় ঢুকতে হয়—বিসারদির তিনদিকেই কীর্তনখোলা। ভাঙনের নদীতে এইটুকু একটা জাগা ডাঙা, নদী হয়ে যেতে কতক্ষণ কিন্তু কী এক কারণে বিসারদির পাড় ভাঙে না কখনো, বা এমনকী কীর্তনখোলা কোনোদিনই ‘‘ে-কারের মত বাঁকটাকে সোজা করে নিয়ে বিসারদিকে চর বানিয়ে দেয়নি। তবে কারণও জানা গেছে, নদী গবেষণায়। যে-জোড়টুকু ভাঙেনি সেটা জলের ভিতরের বেশ উঁচু ডাঙা। অর্থাৎ কীর্তনখোলার বাঁকটাতে জল ততটা গভীর নয়, যতটা একটু বাঁয়ে। তাহলে তো জল বাঁয়েই যাবে। কিন্তু এসব তো নানা যন্ত্রপাতি দিয়ে জমি-নদী আর নদীর জমি মাপামাপির ফলে জানা গেছে। মানে, জানার মতন বিদ্যে যাদের আছে, তারা জানতে পারে, এখন। যাদের ে বিদ্যে নেই, তারা তখনো জানত না, এখনো জানে না। বরিশালের মানুষজনের জল, নদী, বন্যা, পাড়ডাঙা—এসব নিয়ে কোনোদিনই মাথাব্যথা নেই। ব্যথা করতে হলে মাথা কেটে বাদ দিতে হবে। জলের ভিতরই থাকতে-থাকতে জলের সঙ্গে চেনাজানাও তো হয়ে যায়। বিসারদির লোকজন তাই সেই চেনাজানায় জেনে গিয়েছিল, বিসারদি-ভাঙার ভয় তত নেই। সেই কারণেই বিসারদিতে একটা গঞ্জ-বন্দর তৈরি হয়ে গেছে, সাতদিনে একদিন হাট বসে। নদীর আরো অনেক ভিতরচরের চাষীবা সওদা আনে। সওদা মানে দুটো শশা বা দুটো কুমড়ো নয়, বোরো ধানের পাহাড় বানিয়ে দেয়। পুবের আড়িয়াল খাঁ আর পশ্চিমের কীর্তনখোলা, জুড়ে দেয়া একটা মাঝারি নদী। উত্তরে আর দক্ষিণেও সেরকমই জোড় লাগানো আরো ছোট একটা নদী দিয়ে ঘেরা চরকাড়িয়া, চাঁদপুর আর টুঙ্গিবাড়িয়া মিলে বেশ খানিকটা টানা চরে ভাল বোরো ফলন হয়। সেখানকার চাষীরাই বিসারদিকে বাঁচিয়ে রেখেছে। টুঙ্গিবাড়িয়ার চাষীরা এ হাটে আসে না।

বরিশালের মানুষজন নদীর নামধাম নিয়ে একেবারেই মাথা ঘামায় না, জিভে যে-নাম আসে, বলে দেয়। আরো ওপর থেকে নামছে বলে যদি-বা আড়িয়াল খাঁ, মেঘনা এ-সব নাম একটু বেশি চলে, তাই বলে আড়িয়াল খাঁ আর কীর্তনখোলার ভিতর যত আড়াআড়ি নদী বা খাল আছে, তার নাম দিতে গেলে আর নামে কুলবে না। বিসারদির হাটের দৌলতে আর বরিশাল সদর কাছে বলে, চরকাড়িয়া-চাঁদপুরের উত্তরের নদীটার একটা নাম জুটেছে, যেটা ধরে কোনো কোনো সময় বোঝানো হয়—নদী বিসারদি। দক্ষিণের নদীটার কথা কখনো-সখনো বলতে হলে ছোট-বিসারদি বলে কাজ চালিয়ে নেয়া হয়। যেমন যোগেন মণ্ডল বলল, তার সঙ্গীদের, ‘বড় না ছোট, কোনডা দিয়া ভাইসবেন?’

‘ঘুর্ হইব তো বিসারদি নদী দিয়্যা হাট যাইতে—’

‘অ—’

যোগেনের এতটা যাতায়াত নেই ওদিকে যে কোনো খাল দিয়ে কোথায় তাড়াতাড়ি পৌঁছনো যাবে, তা তার সবসময় খেয়াল থাকবে। জলপথে পথের কোনো গোলমাল নেই, হয় এক বাঁক পিছনে, নয় এক বাঁক সামনে। এর ওপর আবার ছোট-ছোট খাঁড়ির গলিঘুঁজিও আছে। তবে খুব বেশি যাতায়াত না থাকলে, সেসব খাঁড়িতে ঢুকলে জলহারানোর ভয় থাকে।

.

বরিশালের লোকের মুখের লব্‌জ—‘নাও থাইকতে পাও ক্যান।’

‘পাঁঠা থাইকতে, চালকুমড়া ক্যান’, বিসারদির হাটে খোলা কাঁচালঙ্কার স্তূপের এক দোকানে চেয়ারে বসে যোগেন বলল, মনজুর আলমকে। মনজুরের স্থায়ী দোকান ও গুদাম আছে—পুরনো লোক, বড় ব্যবসায়ী। যোগেনকে দেখেই সে দোকান থেকে দৌড়ে এসেছে, ‘আরে, আপনি আইবেন, কই, ঢোল দেয় নাই তো, কয়ও নাই তো কেউ। দেহ তো কাণ্ডখান’। যোগেনের সঙ্গীদের দিকে তাকিয়ে মনজুর ধমকে ওঠে, ‘এই বৈশালল্যাগ কুনোদিন পুবপচ্চিম জ্ঞান হইব? কাছা খুইল্যা নামাজ দিলেই পচ্চিম হইল? বলদার দল! আরে, এড্‌ডা জিতুয়া ক্যানডিকরে কান্ধে কইর‍্যা আইস্যা হাজির, য্যান, কাত্তিক পূজার কাত্তিক আইনছে চোরের নাগাল, কারো তুলসীতলায় লুক্যাইয়া থুইয়া যাবে। বল্দার দল! আয়েন, আয়েন, গদিত বসেন মণ্ডলমশায়, চারিদিকে তো জয়কার! আর এইগুলান্ আপনারে নিয়্যা আইল এমন চুপে? গেট নাই, মালা নাই, আয়েন। মিটিংডা ধইরছ তো? নাকী তাও নাই? আয়েন।’

মনজুরের গদির সামনেই এই কাঁচালঙ্কার পাহাড়, সেখানে মনজুরের চিৎকার চেঁচামেচিতে লোকজন জুটে গেছে। যোগেন মনজুরকে বলল, ‘আরে অগ দোষ কী? আমার লগে আইসছে। আমি নিজেই আইল্যাম’, আর তারপরই যোগ করল, ‘পাঁঠা থাইকতে চালকুমড়া ক্যান?’ যেন তার সঙ্গীরা চালকুমড়া আর সেই পাঁঠা। বৈষ্ণবদের রীতি আছে, বলি দিতেই হয় যে পুজোয়, সে পুজোয় চালকুমড়ো বলি দেয়া। মানে, যারা বলি-দেয়ার পুজোতে অভ্যস্ত, তারা বৈষ্ণব হয়েও বলিটা পুরো ছাড়ার সাহস পায় না। বরিশালের বর্ণহিন্দুদের মধ্যে বৈষ্ণবধর্মের খুব একটা বিশেষ প্রভাব নেই। কিন্তু নমশূদ্রদের মধ্যে আছে। তারা প্রায়ই তুলসীতলায় হরিলুট দেয় ও নিজেদের মত করে গৌরগান গায়। সে গৌরগানের সঙ্গে নদীয়ার বা বর্ধমানের নামকীর্তন বা পালাকীর্তনের সম্পর্ক নেই, তেমন কোনো নাটকীয়তা বা রোম্যান্সও নেই। ওরা ‘কীর্তন’ বলে না, বলে ‘নাম’ করতে যাচ্ছি। এর কিছু-কিছু কারণ আন্দাজ করা খুব কঠিন না। হলেও দরকারও নেই।

মনজুর বলে, ‘আয়েন, দুকানে বয়েন, জিরান নেন।’

যোগেন বলে, ‘আরে, আয়া তো পড়ছিই। আবার কোথায় আইব।’

‘আপনি কি এই খুলা জাগায় খাড়াইয়্যা থাইকবেন? এদ্দূর আইলেন, এডডু বইসবেনও না? জিরানও নিবেন না?’

‘আচ্ছা মনজুর ভাই, তোমারে এডডা ধাঁধা জিগাই? জবাব দিবার পাইরলে দুকানে বইসব না পাইরলে বইস্যা থাকব।’

এর মধ্যে ভিড় বেশ বেড়ে উঠেছে। সবাইই যোগেনের কাছাকাছি আসতে চায় কিন্তু কাঁচালঙ্কার পাহাড়টার জন্য ভিড়টা তার উলটোদিকে একটু কেতরে যায়। যোগেন ধাঁধার কথা বলতেই ভিড় থেকে হাসি, হাততালি, ‘কন্ কন্’, উঠল।

‘আমরা জব দিলে কুথায় বইসবেন?’

‘তোমাগো কাঁধে। এতগুলা কাঁধে একখান মানুষের নিবার পারবা না?’

‘নিব তো নিব। সে তো ভোটে জিতার পর।’

সকল অধ্যায়

নোট নিতে এবং টেক্সট হাইলাইট করতে লগইন করুন

লগইন